ISSN 1563-8685




চল-চল-চল স্মৃতির অতলে চল

ল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল—পর্দার ওপারে ভোরের আবছা আলো—বারান্দায় খাঁচায় পাখিটা ডাকছে—ভোর-ভোর আজ ওরও ঘুম ভেঙে গিয়েছে—চোখ মেলে অভ্যাস মতো বাঁদিকে মাকে খুঁজি, পাই না, রাতে শোয়ার সময় মা বাঁদিকে ছিল—এখন মা ডান দিকে—বাবা নিজের জায়গায়—বাবার বাঁদিকে মা—টুকুন তখনো হয়নি—বাবা-মা-আর আমি—লেপ কম্বলের সাথে শীতের সকাল।

চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল।

খেজুরের রস—আজ আমাদের দিন—মল্লিককাকুরা এ বাড়িতে থাকেন না—আমরা তিন ভাড়াটেই বাড়ির মালিক, নারকেল-সুপুরি-খেজুর—কোনো ঝগড়া নেই আমাদের, সমান তিন ভাগ—খেজুরের রসের বেলায় দিনের হিসেব—রহিম চাচা এখনই আসবে—লুঙ্গির কসিটা টাইট করে বেঁধে চড়চড় করে উঠে যাবে গাছে—গাছে ঝোলানো মাটির হাঁড়িটা নামিয়ে তারপর কসিতে বাঁধা হাঁড়িটা গাছে টাঙিয়ে দেবে—গাছ থেকে নেমে মায়ের হাত থেকে একটা টাকা নিয়ে বিড়ি ধরাতে-ধরাতে চলে যাবে রাজুদের বাড়ি।

রাজু আর আমি এক স্কুলে পড়ি, বন্ধু নই আমরা—ও আমার বর—আমি ওর বৌ—এক সাথে স্কুলে যাই আমরা—আগে ও—পিছনে আমি। রাজুর হাতে বাঁশের একটা সরু কঞ্চি—পরিমল স্যার রোজ ওটা ওকে স্কুলে নিয়ে যেতে বলেছেন—স্যার এক-এক করে নামতা ধরেন—না পারলে ওনার হাতের কঞ্চি দাগ ফেলে আমাদের হাতে—গুনে-গুনে পাঁচ ঘা—গুনতে থাকি—এক—দুই—তিন—চার—ফেরার পথে রাজু রাস্তার পাশের নর্দমা থেকে তে- চোখা মাছ ধরে—কচু পাতায় জল ভরে আমি তাড়াতাড়ি করে নিয়ে আসি—রাজু বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি চল, নয় তো মাছ মরে যাবে—পা চালাই—বাড়ির উঠোনের কোনে মাটি খুড়ে পুকুর বানিয়েছি—আধ হাত গভীর আর আধ হাত ব্যাসের পুকুর, মাছেদের জন্য।

সামনের রবিবার মাছগুলি সোমাকে দিয়ে দিতে হবে। নয় তো, ওর ছেলের সঙ্গে আমাদের মেয়ের বিয়ে দেবে না। কাল থেকে অবশ্য সোমার ছেলের একটা হাত পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তো ওকে বলে দিয়েছি ও যেন ওর বাবাকে বলে রবিবারের মধ্যে একটা নতুন ছেলে পুতুল কিনে দিতে—নইলে হাত ভাঙা ছেলের সঙ্গে আমাদের টুকির বিয়ে দেব না।

রবিবারের পর নতুন করে আবার মাছ ধরতে হবে, রাজুকে জিজ্ঞাসা করতে হবে বিয়েতে ও কটা মাছ নেবে? বেশি মাছ চাইলে ওকেও বলব আমার সঙ্গে মাছ ধরতে, আমি তো মেয়ে, আমি কি সব কাজ একা-একা করতে পারি?

চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল।

বারান্দার কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো দোলনায় টুকুন দোল খায়, রান্নাঘর থেকে মা রান্নার ফাঁকে এসে দোলা লাগায়, স্কুলে যাওয়ার পথে আমি দোলা দিই। কড়াইতে তেল ঢেলে মা ছড়া কাটে—দোল-দোল দুলুনি, রাঙা মাথায় চিরুনি। ড্যাব-ড্যাব করে টুকুন তাকিয়ে থাকে—তর্জনিটা মুখে নিয়ে চুষতে থাকে। অফিস থেকে ফিরে বাবা টুকুনকে কোলে নিয়ে আমায় পড়াতে বসেন—এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের ফর্মুলা মুখস্ত করান, ট্রানস্লেশন করা শেখান। গফুর আর আমিনার কথা বলতে-বলতে বাবার চোখ ছলছল করে ওঠে। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে আমিও কেঁদে ফেলি, মা রান্নাঘর থেকে বড় বাটিতে আম তেল মাখা মুড়ি নিয়ে আসে, বাবাকে চা ঠাণ্ডা হওয়ার আগে তাড়াতাড়ি করে মুড়ি খেয়ে নিতে বলে। টুকুন বাবার কোল থেকেই মুড়ির বাটিতে থাবা মারে, রান্নাঘর থেকে মা বলে—এই তো ভাতের ফ্যানটা গেলেই আসছি ...

চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল।

রাতের খাওয়া শেষে এঁটো বাসন মেজে মা এখন আয়নার সামনে—বাবা বিছানায় শুয়ে—চোখের সামনে মোটা বই, এখন আর রাতে শোয়ার জায়গা ওলট-পালট হয় না, আমি আর টুকুন পাশাপাশি, আমাদের দুই সীমান্তে বাবা আর মা, টুকুন ঘুমিয়ে পড়েছে, শুয়ে-শুয়ে আমি মা-কে দেখি, রোজই দেখি। এই সময় মাকে দেখতে আমার খুব ভালো লাগে, মায়ের চেহারায় সারাদিনের সেই ব্যস্ততাটা এখন আর থাকে না, মাকে দেখে এই সময় দম দেওয়া আমার সেই পুতুলটার কথা মনে পড়ে যায়—দম শেষ হয়ে যেতে থাকলে পুতুলটা যেমন আস্তে আস্তে ঘুরতে থাকে, মা-ও যেন এখন দিনের শেষে ধীর লয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখে ক্রিম লাগিয়ে মা এবার শোবে, টুকুনকে টপকে আমার কপালে একটা হামি খাবে, তারপর টুকুনকে বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করবে, তার আগে অবশ্য বাবাকে বলবে বেশি রাত অবধি জেগ না, শরীর খারাপ করবে।

চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল।

গরমের ছুটিতে তিন দিনের জন্য পুরী—টুকুনটা খুব লাকি—আমার ট্রেনে চড়তে পনের বছর বয়স অবধি অপেক্ষা করতে হল। ও কিন্তু ছ'বছর বয়সেই চড়ে ফেলল। ফেরার সময় আমার বার্থটা উপরে, উলটো দিকের বার্থে সেই ছেলেটা, পরশু বিচের ধারে বসে ওকে ছবি আঁকতে দেখেছি, আচ্ছা ছেলেটা কি সেদিন আমাকে লক্ষ করেছিল? চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি, ঘুম আসছে না, চোখ খুলে পাশ ফিরে তাকালে বইয়ের পাতায় ছেলেটি চোখ সরিয়ে নিচ্ছে, আমাকে বেশীক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখলে রিডিং ল্যাম্পটা জ্বালাচ্ছে আর নেভাচ্ছে, যতক্ষন না ঘুম এল, খেলাটা খেলতে থাকলাম আমরা, তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম—স্বপ্নে আজ অনেকদিন বাদে রাজু এল—কি রে বুকুন, তোকে কখন থেকে পুকুরের পাড়ে খুঁজছি? তুই সমুদ্রের পাড়ে কখন এসে দাঁড়ালি?

অনেকদিন হলো রাজুরা আমাদের পাড়া ছেড়ে চলে গিয়েছে, যাওয়ার সময় বলেছিল, নতুন ঠিকানা দিয়ে চিঠি দেবে, রাজুর চিঠিটা আজও কিন্তু আসেনি।

চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল।

পুরী থেকে ফেরার পর জ্বরটা এল, মা বললো—পই-পই করে তখন বললাম সমুদ্রের হাওয়ায় অত ঘুরিস না, শুনলি না, এখন দেখ, কত দিন আবার স্কুল কামাই হয়? বাবা বললো হাওয়া বদলের জ্বর, অত চিন্তার কিছু নেই, এক সপ্তাহ লাগল জ্বরটা সারতে, স্কুল যেতে শুরু করলাম, শরীর দুর্বল, মাথা ঘোরে, কিছু খেতে ইচ্ছে করে না, অফিস ফেরত বাবা বেদানা নিয়ে আসে, মা দানা ছাড়িয়ে দিলে অর্ধেকটা টুকুন খায়, বাকি অর্ধেক আমি। স্কুলে টিফিনের পর সেদিন জ্বরটা আবার এল, নীলা দিদিমণি টুকুনকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে একটা রিকশ করে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। রাতে সেদিন মা আমার আর টুকুনের ঘরে শুলো। মাকে জড়িয়ে আমি স্বপ্ন দেখলাম—হলুদ আলোর ছেলেটা বলছে, বুকুন দেখ, আমি তোমার জন্য একটা সমুদ্র নিয়ে এসেছি, রাজুকে তুমি পুকুরটা ফেরত দিয়ে দাও।

চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল।

বাবার মৃত্যুর পর হিসেব মতো বাবার চাকরিটা আমারই করার কথা ছিল, কিন্তু আমি চলতে পারি না, তাই মা বাধ্য হয়ে চাকরিটা নিল। বিছানা আর হুইলচেয়ারে বসে এ-ঘর থেকে অন্য ঘর, এখন এটাই আমার দুনিয়া। সেই জ্বরটা দু'দিন পর-পর ঘুরে আসছিল—কত পরীক্ষা হলো, জ্বরটা কিন্তু আসতেই থাকল, তারপর এক সময়ে জ্বর আসাটা বন্ধ হল, কিন্তু ততদিনে আমার পা দুটো অদ্ভুত ভাবে সরু হয়ে গিয়েছিল, একদিন খেয়াল করলাম, স্বপ্নেও পুকুর বা সমুদ্র কারো পাড়েই আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।

চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল।

মা বলে গিয়েছে ফিরতে দেরি হবে, ছায়ামাসীর মেয়ের মেয়ে হয়েছে, অফিস ফেরত মা আর মাসী বাচ্চাটাকে দেখতে যাবে, টুকুন আজ কিছুক্ষন আগে কলেজ থেকে ফিরেছে, এবার ওর গ্রাজুয়েশনের ফাইন্যাল ইয়ার, টুকুন আজ একা ফেরেনি, শুয়ে-বসে থাকতে-থাকতে আমার ইন্দ্রিয়গুলি এখন অনেক সজাগ। ইন্দ্রনীল আজও এসেছে টুকুনের সঙ্গে। টুকুন আমাকে এখন আর কিছু বলে না—স্কুলের কথা, কলেজের কথা, মনখারাপের কথা, খুশির কথা—কোনো কিছুই আর ও গল্প করে না আমার সাথে, রাতে পাশাপাশি খাটে শুয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে শুয়ে থাকে, ইন্দ্রনীলকে নিয়ে মাঝে-মাঝেই টুকুন এখন কলেজ ফেরত বাড়ি আসে। মায়ের ঘরটায় ওরা এখন পুকুর-পুকুর খেলবে কিংবা সমুদ্র-সমুদ্র, বিছানায় শুয়ে আমি চোখ বন্ধ করব, অনেক চেষ্টা করব, কিন্তু কিছুতেই সেই পুকুর বা সমুদ্রটাকে আমি আর খুঁজে পাব না।

চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল।

বাবা মারা যাওয়ার আগে মল্লিককাকুর কাছ থেকে আমাদের ভাড়ার পোর্শনটা কিনে নিয়েছিল। আর মা মারা যাওয়ার বছর দুয়েক আগে টুকুনের বিয়েটা দিয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পর টুকুন অবশ্য বেশিদিন শ্বশুরবাড়ির ঘর করেনি, মা বেঁচে থাকতেই ইন্দ্রনীলকে নিয়ে ও ফিরে এসেছিল আমাদের কাছে, মা মারা যাওয়ার পর টুকুন আর ইন্দ্রনীল একদিন সন্ধ্যায় অফিস ফেরত এসে বসল আমার ঘরে—জিজ্ঞাসা করল আমি কেমন আছি। টুকুন চিকেন কাটলেট প্লেটে করে সাজিয়ে দিল, ইন্দ্রনীল এগিয়ে দিল চায়ের কাপ। আমি ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালাম—জন্মদিন? ভুল ভাঙল, ছোটবেলার মত আমার চুলে তেল লাগাতে-লাগাতে টুকুন বলল

দিদি, আয় বাড়িটাকে আমরা সুন্দর করে ফ্লাট বাড়ি বানাই।

আমি বললাম, ভালো তো।
—তবে দিদি সই কর প্রোমোটারের সঙ্গে এগ্রিমেন্টের এই কাগজে, তোর আর এত পৃষ্ঠা কষ্ট করে পড়ার দরকার নেই, আমি সব পড়ে নিয়েছি।

সই করি, বলি তোকে আর ইন্দ্রনীলকেই কিন্তু সব কিছু ম্যানেজ করতে হবে, আমি তো দৌড় ঝাঁপ ...
—না, না, তোর দৌড় ঝাঁপ করতে হবে না, শুধু পরশু একবার কষ্ট করে তোকে যেতে হবে
—কোথায়?
—ওই যে প্রোমোটাররা তোর জন্য একটা লাইফ-টাইম বেডের অ্যারেঞ্জ করেছে বারাসাতের সৃজনে।
—সৃজন? সেখানে...

বাকিটুকু ইন্দ্রনীল বলেছিল, বাংলায় না, ইংরেজিতে, দিদি, ইউ নো, অ্যাট দিজ এজ, ইউ নিড সাম স্পেশাল কেয়ার, ইউ নিড পিপল হু উইল গিভ ইউ কোম্পানি, ইউ নিড পিপল হু উইল টেক কেয়ার অফ ইউ। এণ্ড দিজ কেয়ারিং সেন্টার ইজ অলসো হ্যাভিং দেয়ার ওন মেডিক্যাল টিম। সো উই হোপ, ইউ উইল এনজয়... কঠিন কথাগুলি ইংরেজিতে কি সহজেই না বলা যায়!

চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল।

আমাদের বাড়িটা ভেঙে অ্যাপার্টমেন্টটা হয়েছে, এগ্রিমেন্ট অনুসারে টুকুন আর ইন্দ্রনীল তার তিন তলায় ফ্লাট পেয়েছে—আমার এক মাত্র বোনঝি সৃজাকে নিয়ে ওরা সেখানেই থাকে। ওদের জিনিসপত্র নিয়ে ওরা সেখানে থাকে—ওদের সুখ আহ্লাদ নিয়ে ওরা সেখানে থাকে। মা-বাবার ফটো নিয়ে ওরা সেখানে থাকে। পুরীর সমুদ্রের তীরে তোলা আমার আর টুকুনের ফটোটা টুকুন ওর ড্রয়িং রুমে রাখেনি—

আমি অনেক দূরের এই 'সৃজনে'। এখানে আমার অনেক বন্ধু, অনেক কথা, সুখ দুঃখের ভাগাভাগি। আমাদের সবারই শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গ চিরদিনের জন্য বিকল হয়েছে। আমরা সবাই এক সঙ্গে কাঁদি, এক সঙ্গে হাসি। আর রাতে একাকী স্মৃতির পাতা খুলে বসি—চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল। সেই টিয়া পাখি-খেজুরের রস-রহিম চাচা-আমিনা-মহেশ- গফুর—বাড়ির উঠোনের খেলার পুকুর, রাজুর সরু কঞ্চি। পুরীর সমুদ্র, রিডিং ল্যাম্পের জ্বলা-নেভা। স্মৃতিগুলি নাগরদোলার মত ঘুরতে থাকে—নীচ থেকে উপরে, উপর থেকে নীচে। আমি দেখতে থাকি মনোযোগ দিয়ে—কে জানে, আবার যদি কখনো কারোর ভুমিকায় অভিনয় করতে হয়—চল-চল-চল-স্মৃতির অতলে চল...



(পরবাস-৫১, জুন-জুলাই, ২০১২)