চিঠি। শব্দটি খুব ছোট্টো হলেও যোগাযোগের এই মাধ্যমটি আমাদের অতি প্রিয়। যার ভেতরে লুকিয়ে থাকে বিচিত্র অনুভূতির অনুরণন, বহু আনন্দের হাতছানি, কখনো বা একান্ত বিষাদকথন। কিন্তু আজকাল কেউ কাউকে হাতে চিঠি লেখে না। নিভু নিভু প্রদীপের ক্ষয়ে আসা সলতের মতো কোনোমতে টিঁকে আছে হাতে লেখা চিঠির মাধ্যমটি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বর্তমানে হাতে লেখা চিঠি বিলুপ্তির পথে! এখন আর অভিমানে কেউ তেমন করে বলে না"মাথার কসম পত্র দিও!" প্রতিশ্রুতি রক্ষায় নিবেদিত জনের গলাতেও আর উঠে আসে না আন্তরিক প্রতিধ্বনি, "বলেছিলে তাই চিঠি লিখে যাই, কথা আর সুরে, মনবলে তুমি রয়েছো যে কাছে আঁখি বলে কত দূরে।"
হাতে লেখা চিঠিময় সময়ের চালচিত্র পেয়েছি আমরা কবি সুকান্তের কবিতায়, "কত চিঠি লেখে লোকে, কত সুখে, প্রেমে আবেগে স্মৃতিতে কত দুঃখ ও শোকে।" আরো জেনেছি নিজস্ব আবেগে পুড়তে থাকা কালিদাস ও তার প্রিয় মানুষটির বিরহব্যথা বইতে না পেরে মৌসমী মেঘকে দূত হিসেবে প্রিয়ার কাছে পাঠিয়েছিলেন মনের আকুতি জানিয়ে। কালিদাসের যুগের বহুকাল পর আধুনিক মানুষও একই আকুতি নিয়ে বলেছে, "ভালো আছি, ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।"
টেলিগ্রাম একসময় খুব প্রচলিত যোগাযোগ মাধ্যম ছিল। সেই অতি প্রয়োজনীয় মাধ্যমটি এখন শুধুই ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নেয়া একটি অধ্যায়। “টেলিগ্রাম!” এই শব্দে বুকটা ধ্বক্করে ওঠেনি এমন মানুষ, বিশেষত মধ্যবয়সী এবং প্রবীণদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে যোগাযোগ প্রকৌশলের সিলেবাস থেকে এই টেলিগ্রাম চিরতরে বিদায় নিয়েছে ২৭শে জানুয়ারি ২০০৬ সালে।
একদিন হয়তো ডাকযোগে আসা চিঠি মাধ্যমটি ও টেলিগ্রামের পথে হাঁটা ধরবে। যাদুঘরের কাঁচের শেলফে থরেথরে সাজিয়ে রাখা চিঠি সামগ্রী বলে যাবে মানুষের এক সময়কার আবেগে মোড়া মাধ্যমটির কথা। এরই মধ্যে ডাকবিভাগে হাতে লেখা ব্যক্তিগত পর্যায়ের চিঠির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এটি যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা নয়। বিশ্বজুড়েই ডাকঘরের বুকে বসছে প্রযুক্তির যান্ত্রিক থাবা। বাংলাদেশ ডাকবিভাগের স্লোগান, "চিঠি লিখুন কারণ ইহা স্থায়ী" এই বাক্যবন্ধ এখন আর তেমন করে বিচলিত করে না ব্যস্ত নাগরিকমন। আজকাল আর হাতে চিঠি লিখে সময় ব্যয়ের বিলাসিতায় গা ভাসাতে আগ্রহী নয় ইঁদুরদৌঁড়ে সামিল হওয়া (অধিকাংশ) প্রতিযোগী মানুষ। ছোট্টো ডিভাইসের মাধ্যমে টেক্সট নামের আধুনিক যান্ত্রিক চিরকুটের মাধ্যমে মনের খবর জানিয়ে-জেনে দায়দায়িত্ব উদ্ধারের স্মার্টনেস শিখিয়ে দিয়েছে যুগের হাওয়া। এক মানুষ তাই আর এখন অন্য মানুষকে চিঠি লেখার আকুতি জানাতে ভুলে যাচ্ছে। চিঠিযুগ খুব আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিচ্ছে তার রোমান্টিকতার রেশমি চাদর।
উইকির মতে, চিঠি হলো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি লিখিত বার্তা প্রেরণের মাধ্যম। এর প্রতিশব্দ পত্র, লিপি। লিখিত বর্ণমালার উদ্ভবের আগে মানুষ চিত্র বা ছবির মাধ্যমেই মনের ভাব আদানপ্রদান করে থাকতো।
খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে মানুষ ছবি এঁকে ভাব প্রকাশের পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এই পদ্ধতি পিক্টোগ্রাম (Pictograms) নামে পরিচিত। একটি পিক্টোগ্রাম একটি বস্তু বা আইডিয়াকে ধারণ করতো। যেমন, একগুচ্ছ তারকাকে রাত্রি বোঝানো হতো। বল্লম হাতে মানুষের ছবি সংগ্রামরত জীবনের ইতিহাস বলতো। পিক্টোগ্রাম বা চিত্রকর্ম পদ্ধতির সর্বপ্রথম প্রচলন ঘটে মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ান অঞ্চলে।
আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন মিশরীয়রা 'হায়ারোগ্লিফিক্স' (hieroglyphs) নামে এক ধরনের লেখন পদ্ধতির উদ্ভাবন করে। এই পদ্ধতি খানিকটা পিক্টোগ্রামের মতোই তবে শব্দ বা কথা প্রকাশের জন্য এতে কিছু বিশেষ ধরনের প্রতীক ব্যবহার করা হতো। যেমন, ঠোঁটের ছবিটি দিয়ে 'মুখ' এবং 'জ' শব্দটি বোঝানো হতো এবং কিছু হায়ারোগ্লিফিক্সকে একসাথে জুড়ে দিয়ে একএকটি শব্দ গঠন করা হতো। কিন্তু এই পদ্ধতিটি খুব ধীর গতি সম্পন্ন হওয়ায় পরবর্তীতে মিশরীয়রা হায়ারাটিক স্ক্রিপ্ট (hieratic script) নামে দ্রুতগতির একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। ধারণা করা হয়, এসব অঙ্কিত চিত্র অনেক সময়ই প্রেরকের কাছে সঠিক তথ্যটি প্রকাশের পরিবর্তে ভিন্ন অর্থ করে অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতো। তবে এটি ধরে নেয়া খুব একটা অসঙ্গত হবে না যে প্রাথমিকভাবে সৃষ্ট এইসব জটিলতাও হয়তো সে সময়কার মানুষের মনে আরো দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং মনোভাব প্রকাশে অধিক কার্যকর কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবনের দিকে পা বাড়াতে প্রেরণা যুগিয়েছিলো।
পৃথিবীতে ঠিক কবে কখন প্রথম চিঠিটি লেখা হয়েছিলো বা কে কাকে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন সে বিষয়ে সঠিক হদিস না মিললেও পৃথিবীর প্রথম প্রেমপত্রটি কে কাকে লিখেছিলেন সেটি জানা গেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ সালে ব্যাবিলনিয়াতে প্রেমিক 'গিমিল' এক খণ্ড ইটের উপর ভালোবাসার কথা খোদাই করে প্রেমিকা 'কাসবুয়ার' কাছে পাঠিয়েছিলেন। এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন প্রেমপত্র। আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো চিঠিটি হচ্ছে ৩৩০০ বছর আগে পাথরে খোদাইকৃত একটি চিঠি, যা মিশর রাজসভা থেকে ইসরায়েল রাজসভায় পাঠানো হয়েছিলো।
উপমহাদেশীয় প্রাচীন ইতিহাস অনুসারে জানা যায়, পূর্বে এখানে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় সংবাদ আদান প্রদানের মাধ্যম হিসেবে পাঠানো হতো নির্বাচিত দূত বা কাসিদ ('কাসিদের' অর্থ হলো দূত কিংবা বার্তাবাহক)।
তবে দূরবর্তী অঞ্চলে দ্রুত খবর পাঠানোর কাজে জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল কবুতর। কবুতরকে চিঠি বহন করার কাজে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সেইসব প্রশিক্ষিত কবুতরের পায়ে চিঠি বেঁধে উড়িয়ে দিলে কবুতর নির্দিষ্ট গন্তব্যে চিঠি পৌঁছে দিতো। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে সিরিয়া এবং ইরানে কবুতরের মাধ্যমে বার্তা বহন শুরু হয়৷ খ্রিষ্টাব্দ ১২শতকে সিরিয়া, মিশর, বাগদাদসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর সাথে বার্তাবাহক কবুতরের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা হতো। রোমে কবুতরের মাধ্যমে অলিম্পিক গেমসের ফলাফল জানানো হতো৷ সে রীতিটিকে স্মরণ করে অলিম্পিক গেমসের শুরুতে সাদা পায়রা ওড়ানো হয়৷ চেঙ্গিস খান তার বিশাল রাজ্যের খবর আদান-প্রদানের জন্য কবুতর ব্যবহার করতেন। বিশেষত যুদ্ধকালীন সময়ে সংবাদ বহনের জন্য কবুতর ব্যবহার হতো ব্যাপক মাত্রায়। গোয়েন্দাগিরিতেও প্রশিক্ষিত কবুতরের দক্ষতা ছিল তাক লাগানোর মতো। কবুতরের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখার চমকপ্রদ ইতিহাস আছে ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুলিশ বিভাগের। ডাকবাহক বা দূত হিসেবে কবুতরের নানা চমকপ্রদ আর চিত্তাকর্ষক প্রচুর তথ্য রয়েছে ইতিহাসের পাতা জুড়ে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত ডাক ব্যবস্থা আজ থেকে ৮০০ বছর আগে উপমহাদেশে প্রচলিত ডাক ব্যবস্থার একটি আধুনিক রূপ। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লির প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের শাসনামলে ডাক ব্যবস্থার অনেক উন্নতি ঘটে। এক্ষেত্রে তিনি আরবদের আদলে ঘোড়ার মাধ্যমে ডাক বিলিবন্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এর পরে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি, মোহাম্মদ বিনতুঘলক তাঁদের শাসনামলে ডাক ব্যবস্থার উন্নতিতে ভূমিকা রাখেন।
পর্যটক ইবনে বতুতার বিবরণী থেকে জানা যায় সে সময় দুভাবে ডাক বিলি-বন্টনের ব্যবস্হা ছিলো। এক হলো ঘোড়ার মাধ্যমে চিঠিপত্র বিলিবন্টন অন্যটি হলো পায়ে হেঁটে বহনকারী সাধারণ ডাক। বার্তার গুরুত্ব বা পথের দূরত্ব, নিরাপত্তা ইত্যাদি ভেদে দূত বা প্রেরক র্নিদিষ্ট ছিলো। ডাক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখেন শেরশাহ (শাসনকাল: ১৫৩৮-১৫৪৫)। শেরশাহের আমলের ঘোড়ার ডাক খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সেই মধ্যযুগীয় ডাক ব্যবস্থার বির্বতন হতে হতে আজকের আধুনিক পোষ্টঅফিস ব্যবস্থা। মাত্র কয়েক বছর আগেও সাইকেলে চড়ে খাকি পোশাকে কাঁধের ঝোলানো ব্যাগে চিঠির তোড়া নিয়ে ঘরের দুয়ারে এসে পরিচিত ডাকপিয়ন যখন ‘চিট্টি আছে’ বলে হাঁক দিতো, বুকের ভেতর কী অদ্ভুত সুখানুভূতির আলোড়ন হতো। চিঠি প্রাপ্তির সেই সুখ আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে প্রায়।
এখনো চিঠি লেখে মানুষ। হাতে লেখা চিঠির জায়গা এখন দখল করেছে ইমেইল, মোবাইল কিংবা এস.এম.এস.। একসময় যে আবেগ কিংবা প্রয়োজনের তাগিদ মানুষকে গুটি গুটি অক্ষরে চিঠি লেখতে অনুপ্রাণিত করতো, আজ প্রযুক্তির চরম উন্নতি আর নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা চিঠি লেখবার সেই আবেগটি কেড়ে নিয়েছে। ব্যস্ত মানুষ কাগজ কলমের খোঁজ না করে আন্তর্জালেই চুকিয়ে ফেলছে তার সমস্ত লেনদেন।
কিন্তু হাতে লেখা একটি চিঠি যেভাবে লেখকের আবেগ অনুভূতি প্রাপককে ছুঁয়ে দেয় ইমেল, কিংবা এস.এম.এস. কি পারে সেভাবে অনুভূতির ঘরে টোকা দিতে? না পারার সে খেদ শুনি আমেরিকান নারীবাদী লেখিকা লিজ কার্পেন্টারের উক্তিতে, "চিঠি লেখা বন্ধ করে কী যে মূল্যবান অভিজ্ঞতা হারাতে বসেছি। ফোনের কথা কি আরেকবার পড়া সম্ভব?"
চিঠির মতো ইমেইলে স্পর্শের সুখ না থাকলেও দ্রুততম যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে এটি বর্তমানে জনপ্রিয়। পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্ত থেকে মানুষ এক মিনিটের কম সময়ে পাঠিয়ে দিতে পারে জরুরী তথ্য কিংবা নিদারুণ আবেগ। এসে গেছে তারও চেয়ে দ্রুতগতির মেসেঞ্জার। দুটি মোবাইল যন্ত্রে সেকেন্ডের মধ্যে যুক্ত হতে পারে পৃথিবীর দুই প্রান্তের মানুষ। কে বলতে পারে অদূর ভবিষ্যতে ইমেইল হঠে গিয়ে শুধুমাত্র সংকেত ব্যবহার করে সময় সংকোচনের পথে হাঁটা দেবে না আগামি সময়! সেটি হলে ইতিহাসের উলটপুরাণই ঘটবে সন্দেহ নেই।
কেবলমাত্র বাংলা নয় পৃথিবীর বহু ভাষায় “চিঠি” সাহিত্যের একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। রবীন্দ্রনাথ একাই বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার চিঠিতে চিঠিতে ভরিয়ে গেছেন দু’হাতে। জ্ঞানীগুণীদের চিঠি সম্পদে বাংলাসহ ইংরেজি সাহিত্যভাণ্ডার দারুণভাবে ঋদ্ধ। কোনো ইলেকট্রনিক মেইল লেখিয়ে পাঠক যখন সাহিত্যের সেসব সোনালী অক্ষরে চোখ রাখবেন, তার মনের কোণেও হয়তো প্রিয়জনের হাতে লেখা একটা চিঠি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগবে। প্রিয় সুহৃদকে খুব বলতে ইচ্ছে করবে,
“এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিও।”
---------------------------------
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১. The history of the written letters.
২. মাসিক টেকনোলজি (অক্টোবর সংখ্যা-২০০৩)
৩. উইকি
(পরবাস-৭৭, ১০ জানুয়ারি ২০২০)