Little Magazines



পরবাসে
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের

আরো লেখা

এবং বই


ISSN 1563-8685




শাপভ্রষ্ট

|| ১ ||

লোকে সাধারণত ফুলদানিতে রজনীগন্ধার স্টিক সাজিয়ে রাখে। দময়ন্তী দেখল কাচের বাহারি ফুলদানিটায় যত্ন করে এক গুচ্ছ লাল রঙের কুরুবক রাখা রয়েছে। ব্যাপারটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়, আঙুলের ছাপের মতো তাদের স্বত্বাধিকারী প্রতিটি মানুষই আলাদা। তাদের রুচিও আলাদা হবে সে আর এমন আশ্চর্য কী? মুশকিল হচ্ছে ফুলদানির পাশে শো-কেসের ওপর সোনালী ফ্রেমে আটকানো ফ্যামিলি ফটোগ্রাফটাকে নিয়ে। বাবা-মায়ের মাঝখানে দুই বেণী-দোলানো একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে। পিছনে পাহাড়, জঙ্গল, নদী। নদীটা সম্ভবত তিস্তা। বিয়ের পর পর অনিন্দ্যর সঙ্গে দার্জিলিং গিয়েছিল। পাথর-ডিঙনো পাহাড়ি নদীটা নেচেকুঁদে শিলিগুড়ি থেকেই সঙ্গী হয়েছিল। কোনও নদী একবার মাথার মধ্যে ঢুকে পড়লে সারা জীবনের মতো আপনজন হয়ে যায়। বহুদিন পরে দেখা হলেও এক লহমায় যাবতীয় খুনসুটি, পুরনো গল্প মনে পড়ে যায়। অবশ্য নদী নয়, ফটোটা দেখে দময়ন্তী আঁতকে উঠল অন্য কারণে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না। উঠে গিয়ে কাছ থেকে দেখল। বিপাশা বলছিল মেয়ে মনিপালে হোস্টেলে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। তার মানে ছবিটা অন্ততপক্ষে বছর দশ-বারো আগের তোলা। জয়ন্তীদি জিজ্ঞেস করল, “কী রে, কী দেখছিস অমন করে?”

দময়ন্তীর এখানে এসে পড়াটা নিতান্তই কাকতালীয়। জয়ন্তীদি ধরে না আনলে এ বাড়িতে আসার, এতদিন পর বিপাশার সঙ্গে দেখা হবার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। এমনকী জয়ন্তীদির সঙ্গে দেখা করাটাও পাকে-চক্রে। গত শুক্রবার অনিন্দ্য অফিস থেকে ফিরে বলেছিল পরের দিন মানে শনিবার ভোরবেলা ট্যুরে বেরিয়ে যেতে হবে। অনিন্দ্যটা বরাবরই এইরকম, আগে থেকে কিছু বলে না, শেষ মুহূর্তে... দময়ন্তী খুব রাগ করেছিল। ডিসেম্বরের শেষাশেষি, কলকাতায় সবে শীত নামছে। এই সময় ছুটি পেলে মানুষ পিঠে রোদ নিয়ে পার্ক স্ট্রিটে ঘুরে বেড়ায়। কতদিন যে নিউমার্কেটে যাওয়া হয় না! অনিন্দ্য ইদানীং ঘর থেকে একদম বেরোতে চায় না। বললেই কোনও না কোনও বাহানা দিয়ে কাটিয়ে দেয়। দময়ন্তী ঠিক করে রেখেছিল এই উইকেন্ডে তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যাবে, বাইরে খাবে, আশ মিটিয়ে শপিং করবে, কোনও কথা শুনবে না। সব প্ল্যান চৌপাট হয়ে গেল। মুখ হাঁড়ি করে অনিন্দ্যকে শুনিয়েছিল, “যাও... ফিরে এসে আর আমায় দেখতে পাবে না।”

অনিন্দ্য কাতর গলায় বলেছিল, “আমার কী দোষ বল, মন? ক্লায়েন্ট মিটিং কল করেছে... বসের যাবার কথা ছিল। লাস্ট মোমেন্টে ক্যান্‌সেল করল। বসের শাশুড়ি বাথরুমে পা পিছলে পড়ে, কোমরের হাড় ভেঙে হাসপাতালে। আমি না গেলে বেজায় ঝামেলা হবে।”

অনিন্দ্য ভোরবেলা বেরোবার সময় গায়ে আলতো করে হাত রেখে ডেকে বলে গিয়েছিল, ‘মন যাচ্ছি।’ ‘উঁ’ বলে সাড়া দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল দময়ন্তী। বেশ বেলা করে ঘুম ভেঙেছিল, উঠে দেখেছিল পুবের জানলা থেকে রোদ সরে গেছে। ঘরের মধ্যে অন্ধকার। মনে হয়েছিল খালি ফ্ল্যাটটা যেন গিলে খেতে আসছে। তখনই জয়ন্তীদির ফোনটা এসেছিল, “চিনতে পারছিস? কে বলছি বল তো?”

এক মুহূর্ত থমকেছিল, তারপর উচ্ছসিত হয়ে বলেছিল, “কে জয়ন্তীদি? কেমন আছ? কোত্থেকে?”

জয়ন্তীদির গলা ভোলা মুশকিল। অনার্সে ফিজিক্স পড়াত জয়ন্তীদি। অসম্ভব ভাল পড়াত, যেমন সাবজেক্টে দখল তেমন ভরাট গলার স্বর। কলেজ পিকনিকে গিয়ে রবীন্দ্র-সংগীত শুনিয়েছিল, ‘ভালবাসি, ভালবাসি, এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়...’

এখনও কানের মধ্যে বাজে। জয়ন্তীদি একদম বন্ধুর মতো ছিল, সারা জীবন একা, বিয়ে-থা করেনি, কেন কে জানে? বলল, রিটায়ারমেন্টের পর কলকাতার মায়া কাটিয়ে শান্তিনিকেতনে নিজের বাড়ি করে পাকাপাকি শিফট করে গেছে। ভালো আছে... খুব ভালো আছে। কার কাছ থেকে যেন দময়ন্তীর ফোন নম্বর পেয়েছে, কথা হয় না কতদিন, খুব মনে পড়ে ওদের ব্যাচের ছেলেমেয়েদের...। ফোন রাখার সময় বলল, “চলে আয় না একবার, আসবি? এখানে সোনাঝুরি ফুটতে শুরু করেছে, মহুয়াও... দেখবি, খুব ভাল লাগবে।”

অনিন্দ্যর ফিরতে এক সপ্তাহ। সাত-সাতটা দিন একা একা রান্না করতে হবে, খেতে হবে, রাত্তিরে বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করতে হবে। সময়ে একটা ছেলেপুলে হলেও না-হয় তার খিদমত খাটতে খাটতে দিন যেত। তা সে ডাক্তাররা অনেক আগেই জবাব দিয়ে দিয়েছে। দময়ন্তী হঠকারীর মতো বলেছিল, “যাব... ঠিকানা দাও...”

খুশি হয়েছিল জয়ন্তীদি। চটজলদি একটা ওভার-নাইট ব্যাগে দু’-চারটে পোষাক-আশাক আর দৈনন্দিন টুকিটাকি গুছিয়ে দময়ন্তী বেরিয়ে পড়েছিল। হাওড়া থেকে বিশ্বভারতী ধরে বোলপুর পৌঁছোতে সন্ধে পার। ষ্টেশনে নেমে দেখেছিল জয়ন্তীদি অপেক্ষা করছে। চেনা রিক্সায় জয়ন্তীদির পাশে বসে যাবার সময় শীত লাগছিল। রিক্সাওলার বকবকানি শুনতে শুনতে জ্যাকেটের চেন টেনে হুডটা মাথার ওপর তুলে দিয়েছিল, জ্যাকেটটা গতবার ইউএস থেকে এনে দিয়েছে অনিন্দ্য, হিউস্টন গিয়েছিল অফিসের কাজে। গায়ে দিলে বেশ উষ্ণ লাগে।

রিক্সা থেকে নেমে দেখেছিল ছবির মতো সুন্দর একটা বাড়ি। বারান্দায় মাধবীলতা, বসার ঘরে বেতের সোফাসেট, জানলায় ছিমছাম পর্দা, একটা সিংগল ডিভান, বুক শেলফে রবীন্দ্ররচনাবলী। অর্ধেকটা রাত্তির গল্পে গল্পে কেটে গিয়েছিল, কলেজের গল্প, বন্ধুবান্ধবদের গল্প, কে কোথায়... । বেলা করে ঘুম থেকে উঠে চা খেতে খেতে জয়ন্তীদি বলেছিল, “তোকে আজ বিকেলবেলায় একজনের বাড়ি নিয়ে যাব...”

দময়ন্তী ভুরু তুলেছিল। জয়ন্তীদি বলেনি তখন, রহস্য করে হেসেছিল। খেয়েদেয়ে একঘুম দিয়ে ওঠার পর বলেছিল, “চা খেয়ে তৈরি হয়ে নে, বেরবো।”

দময়ন্তীর গা ম্যাজম্যাজ করছিল, নতুন জায়গা, টেম্পারেচার কলকাতার থেকে দু’-এক ডিগ্রি কমই হবে, চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “কোথায় গো?”

জয়ন্তীদি বলেছিল, “গেলেই জানতে পারবি, অচেনা মানুষ নয়।”

পিচের রাস্তা ছেড়ে রেখে লাল মাটির রাস্তা ধরে দু’-তিন মিনিটের হাঁটা পথ। একতলা বাড়ি, সামনে এক চিলতে বাগান, গাঁদা গোলাপ স্থলপদ্ম ফুটে আছে। কলিং বেলে আঙুল ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই এসে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিল বিপাশা। সেই বিপাশা! কৃষ্ণকলি বিপাশা! তার দুটি কালো হরিণ চোখ তুলে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। জয়ন্তীদি নিশ্চয়ই ওকেও দময়ন্তীর কথা বলেনি, বলেনি যে ও শান্তিনিকেতনে আসছে। জানলে হয়তো দেখা করতে চাইত না। কোনও না কোনও অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে যেত, বাড়িতে থাকত না। দময়ন্তীই কি চাইত? জয়ন্তীদি কি দময়ন্তী আর বিপাশার মধ্যের সমীকরণটা জানত না? নাকি জেনেও... ভেবেছে এতদিন পর একটা সমাধানে পৌঁছনো যাবে।

জয়ন্তীদি বলেছিল, “কী রে, বাক্যিহারা হয়ে গেলি যে দুজনেই? কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বল?”

বিপাশা সামলে নিয়েছিল। ঠোঁটের কিনারায় জোর করে হাসি টেনে দুজনকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল। জয়ন্তীদি এদিক ওদিক তাকিয়ে বিপাশাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “পুপু, তোর বর কোথায় রে? দেখছি না...”

বিপাশা বলেছিল, “বেরিয়েছে একটু, এসে পড়বে... বস তোমরা, আমি চা করে আনি।”

দময়ন্তী বুঝেছিল স্বাভাবিক হওয়ার জন্য বিপাশা একটু সময় চাইছে। আশ্চর্য কিছু নয়। শেষবার দেখা হয়েছিল কলেজ ছাড়ার মাস তিনেক পর। বিপাশা নিজেই দেখা করতে চেয়েছিল। রেস্তোরাঁর মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “অনিন্দ্যকে আমার কাছ থেকে কেন কেড়ে নিলি মন? কী ক্ষতি করেছিলাম তোর?”

বাবা-মা কী একটা জরুরি কাজে মেজকার বাড়ি গিয়েছিল, বলে গিয়েছিল রাতে ফিরবে না। দময়ন্তী ফাঁকা বাড়িতে অনিন্দ্যকে ডেকে নিয়েছিল। ভর সন্ধেবেলা, ভূতে মারে ঠেলা... অনিন্দ্য অস্বীকার করতে পারেনি। দময়ন্তীর তখন ক্যাফে ল্যাতের মতো নিরবচ্ছিন্ন মসৃণ ত্বক, সমুদ্র-শঙ্খের মতো ভরাট ঠোঁট, হেমন্তের শস্য-ক্ষেতের মতো উদ্ভিন্ন-শরীর... কী সাধ্য ছিল রোগা-ভোগা কালো মেয়েটার? বিপাশার কান্না দেখে অস্বস্তি হয়েছিল, তার সঙ্গে একটা চাপা উল্লাসবোধও যে মিশে ছিল না, এ কথা হলফ করে বলতে পারে না দময়ন্তী — এথেলেটিক্স মিটে ট্রফির মতো অনিন্দ্যকে জিতে নেবার উল্লাস, বিপাশাকে গো-হারান হারিয়ে দেবার উল্লাস... ‘এভ্‌রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন ওয়ার’। বোকা মেয়েটা বোঝেনি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। দময়ন্তী ওর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে পারেনি, শুধু বলেছিল, ‘পুপু, চুপ কর, লোকে দেখছে...’

জয়ন্তীদি বলল, “এই তো চা খেয়ে বেরোলাম, একটু পরে চা করিস না-হয়। তোর মেয়ে হোস্টেল থেকে ফেরেনি এখনও? কবে থেকে ছুটি পড়ছে?”

বিপাশা বলেছিল, “কে রূপু, ওদের কী প্রোজেক্টের কাজ শেষ করতে হবে, দু’দিন পরে আসবে।”

দু’-চারটে টুকরো-টাকরা কথাবার্তা, জমছিল না। বিপাশা আবার বলল, “চায়ের জল চাপিয়ে আসি, ও এসে পড়বে।”

বিপাশার ও’কে দেখার জন্যে লোভ হচ্ছিল দময়ন্তীর। বিপাশা উঠে গেল।

তখনই শো-কেসের ওপর ফুলদানির পাশে রাখা সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো ফ্যামিলি ফটোটার ওপর চোখ পড়ল দময়ন্তীর। কাছে গিয়ে ভাল করে দেখল, ফুটফুটে মেয়েটা এক হাতে বিপাশার আঙুল ধরে রেখেছে অন্য হাতে অনিন্দ্যর। অনিন্দ্য হাসছে, পিছনে তিস্তা।


|| ২ ||

ট্রেন অজয়ের চর পার হয়ে যাচ্ছে। মানুষটা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে দেখছে। সাদা দাড়ি উড়ছে হাওয়ায়। দেখে মনে হয় এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা। তবু অজয়ের চরে পড়ে থাকা রোদ্দুর দেখে যেন তার আশ মেটে না। একটু আগেই একতারা বাজিয়ে গান ধরেছিল — তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জান না, তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা, মন জান না...। সকালে জয়ন্তীদি বলেছিল, “তিন-চার দিন থাকবি বলেছিলি, আজকেই ফিরে যাবি?”

দময়ন্তী মাথা নিচু করে ব্যাগ গুছোচ্ছিল। চোখ না তুলেই বলেছিল, “হ্যাঁ।”

জয়ন্তীদি কিছু বলেনি। কীই বা বলবে? গতকাল সন্ধের পর থেকে দু-জনের ক’টা কথা হয়েছে, হাতে গোনা যায়। বিপাশাদের কলিং বেলটা বাজলে মনে হয় পাখি ডাকছে। বিপাশা দরজা খুলে দিয়ে বলেছিল, “দেখ, কে এসেছে...”

দময়ন্তীকে দেখে অনিন্দ্য খুব যে আশ্চর্য হয়েছিল এমন নয়। অন্তত তার মুখ দেখে মনে হয়নি সে ধাক্কা খেয়েছে। নির্লজ্জের মত হেসে বলেছিল, “আরে দময়ন্তী যে, কতদিন পর! কী খবর? কেমন আছ?”

জয়ন্তীদি বলেছিল, “দেখ মন, তোর জন্যে ডবল সারপ্রাইজ...”

সারপ্রাইজই বটে। ফটোটা দেখার পর থেকে দময়ন্তী রাগে জ্বলছিল। অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলেছিল, “কী খবর জান না? একদিনেই সব ভুলে মেরে দিলে?”

বিপাশা অবাক হয়ে বলল, “মানে? তোর সঙ্গে আবার ও’র কোথায় দেখা হল?”

দময়ন্তী হিস হিস করে বলেছিল, “সেটা ও’কেই জিজ্ঞেস কর না!”

জয়ন্তীদি বললেন, "এই মন, কী যা তা বকছিস!"

দময়ন্তী আর ধৈর্য রাখতে পারেনি, বলেছিল, “জয়ন্তীদি, তুমি জান না, এই রাসকেলটা দু’-জায়গায় দু’টো সংসার পেতে রেখেছে। গাছেরও খাচ্ছে, তলারও কুড়োচ্ছে। কলকাতার ফ্ল্যাটে আমার সঙ্গে আর এখানে বিপাশাকে নিয়ে... তাই ভাবি এত কীসের ট্যুর! শান্তিনিকেতনে না এলে জানতেও পারতাম না।”

বলতে বলতে দময়ন্তীর মুখ দিয়ে থু-থু বেরচ্ছিল। অনিন্দ্য বলেছিল, “মন, শান্ত হও, তুমি যা ভাবছ, তা নয়।”

বিপাশা বলল, “সে কী! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। মন এসব কী বলছে? তুমি কলকাতায়...”

দময়ন্তী নিজের মোবাইলটা তুলে নিয়ে বলেছিল, “দেখবি, এই দেখ...”

বিপাশা আর জয়ন্তীদি দময়ন্তীর মোবাইলে জমিয়ে রাখা ওদের দু’জনের অন্তরঙ্গ ছবিগুলোর ওপর ঝুঁকে এসেছিল। দেখতে দেখতে বিপাশার কান লাল হয়ে যাচ্ছিল।

অনিন্দ্য বলেছিল, “তোমরা সবাই কিন্তু আমায় ভুল বুঝছ।”

জয়ন্তীদির সহ্য হয়নি, সরে এসে বলেছিল, "ছিঃ অনিন্দ্য, এর পরেও...”

অনিন্দ্য জয়ন্তীদিকে অগ্রাহ্য করে বলেছিল, “মন, আমার কথা শোনো, বোঝার চেষ্টা করো, তোমার অনিন্দ্য আর পুপুর অনিন্দ্য এক নয়, তারা আলাদা...”

দময়ন্তী ঠোঁট কুঁচকে বলেছিল, “কেন মিথ্যে কথা বলছ?”

ট্রেনটা সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বাউল মানুষটা কখন দরজা থেকে সরে এসে সামনের খালি সীটে বসেছে খেয়াল করেনি দময়ন্তী। দেখল একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফিরে তাকাতে চোখ সরিয়ে নিল না। বলল, “ও মেয়ে, তোমায় এমন অস্থির লাগে কেন?”

দময়ন্তী মাথা নাড়ল, “না তো,” বোলপুর ষ্টেশন থেকে কেনা খবরের কাগজটায় নজর দিল। সামনের পাতায় যত রাজ্যের হাবিজাবি খবর, রাজনীতি, অর্থনীতি...। পাতা উলটে হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ, শোকবার্তা... পাঁচের পাতায় একটা খবরে চোখ আটকালো, গোন্ডিয়ার অভয়ারণ্যে বনকর্মীরা একটা সাত আট মাসের মাদী অ্যালবিনো সম্বর হরিণের সন্ধান পেয়েছে। তার গায়ের রং সাদা বলে নাকি বনের বাকি হরিণেরা তাকে দল থেকে বার করে দিয়েছে। অনিন্দ্যর কথাগুলো মাথা থেকে সরছে না। ওরা তিনজন মেয়ে নিস্তব্ধ হয়ে তিনদিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল। অনিন্দ্য ঘরের মধ্যে পায়চারী করছিল, মাথার চুলে আঙুল চালাচ্ছিল, সম্ভবত আত্মরক্ষার উপায় খুঁজছিল। হঠাৎ থেমে বলেছিল, “পুপু তোমার মনে আছে যেবার মেয়ে হয়েছিল, খুব বৃষ্টি, অজয় নদ ভেসে গিয়েছিল... আমাদের বাগানে জল উঠে এসেছিল... আমি নারসিংহোমের ডেলিভারি রুমের বাইরে সারা রাত বসে...”

বিপাশা বলল, “নাইন্টিনাইন জুলাই... রূপু মানে রূপসার জন্মের সময়... কেন, কী হয়েছে?”

অনিন্দ্য দময়ন্তীর দিকে ফিরে বলল, “মন, তখন তুমি তোমার অনিন্দ্যর সঙ্গে শিলং পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলে... সেখান থেকে চেরাপুঞ্জি...।”

দময়ন্তীর মনে পড়ে গেল, হোটেলের জানলায় মেঘ, ঝুঁকে তাকালে শিলং উপত্যকা, বড়া পানি, এলিফ্যান্ট ফলস, পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে জ্যাকারান্ডা... ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে অনিন্দ্যর ঠান্ডা হাত। সন্দিগ্ধ ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী প্রমাণ করতে চাইছ, অনি?”

অনিন্দ্য বলেছিল, “একজন মানুষ কি একই সময়ে দু’-জায়গায় থাকতে পারে?”

দময়ন্তী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেছিল, “না, পারে না,” তারপর গলায় শ্লেষ ঢেলে বলেছিল, “এবার বলবে তোমরা দু’জন আইডেন্টিক্যাল ট্যুইন।”

অনিন্দ্য ম্লান মুখে বলেছিল, “নাঃ...”

ট্রেনটা ঢিকোতে ঢিকোতে চলছে। বাউল মানুষটা আবার প্রশ্ন করল, “মেয়ে, ও মেয়ে, তোমার চোখে জল কেন?”

“কই না তো,” বলে চোখের কোণে আঙুল ছোঁয়াল দময়ন্তী। বুড়ো লোকটা একতারা বাজিয়ে গেয়ে উঠল, “আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে... আছে সে নয়নতারায়...,” বাউলরা কি রবীন্দ্রসংগীতও গায়?

অনিন্দ্যকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। টলমল করতে করতে এসে সোফায় বসে পড়েছিল। দু’-হাতে মুখ ঢেকে বলেছিল, “নাঃ, আমার কোনও যমজ ভাই-টাই নেই। তোমাদের কাছে আর লুকিয়ে লাভ নেই। আমি মানুষ নই... আমি একজন শাপভ্রষ্ট দেবদূত।”

কথাটা অনিন্দ্য এত ক্যাজুয়ালি বলেছিল দময়ন্তী ভেবেছিল শুনতে ভুল করেছে। নিশ্চিত হবার জন্যে জিজ্ঞেস করেছিল, “অ্যাঁ... কী?”

জয়ন্তীদি শব্দ করে হেসে উঠেছিল, বলেছিল, “বাব্বা! একেবারে শাপভ্রষ্ট দেবদূত! তা হ্যাঁ রে, তুই কোন ঠাকুরের পাকা ধানে মই দিয়েছিলি যে শাপ লাগল?”

রসিকতাটা অনিন্দ্য গায়ে মাখেনি, আবার বলেছিল, “বিশ্বাস করো তোমরা, আমি সত্যিই একজন দেবদূত... অভিশপ্ত, দেবলোক থেকে নির্বাসিত।”

দময়ন্তী বলেছিল, “আজগুবি কথা বলার জায়গা পেলে না?”

অনিন্দ্য বলেছিল, “জানি তোমাদের মেনে নিতে কষ্ট হবে, তবু... তুমি আর পুপু, তোমরা দুজনেই আমাকে চেয়েছিলে, তাই আমি তোমাদের দু’জনের কাছেই ছিলাম, সব সময়, এক মুহূর্তের জন্যেও তোমাদের ছেড়ে যাইনি। আমি তোমাদের কাউকে ঠকাইনি, না তোমাকে না পুপুকে।”

জয়ন্তীদি বলেছিল, “মিথ্যে কথা বলার একটা সীমা থাকে অনি...”

অনিন্দ্য শুকনো হেসেছিল, “জয়ন্তীদি, তুমি তো আমাদের ফিজিক্স পড়িয়েছিলে, মাল্টিভার্সের কথা শোনোনি? সময় অক্ষের প্রতিটি খণ্ড-মুহূর্ত এক-একটা সমান্তরাল বিশ্বের সম্ভাবনা তৈরি করে। আমরা দেবদূতরা ইচ্ছে করলে একই সঙ্গে একাধিক বিশ্বে বসবাস করতে পারি।”

জয়ন্তীদি সামান্য থতমত খেয়ে বলেছিল, “তর্কের খাতিরে তোর কথা মেনে নিলেও আপাতত মন আর পুপু দুজনেই তো একই পৃথিবীর বাসিন্দা। তা’হলে তুই কী করে দু’জনের সঙ্গে...?”

অনিন্দ্য জয়ন্তীদির দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসেছিল, “কখনও কখনও দুটো সমান্তরাল রেখা পাশাপাশি চলতে চলতে মিলে যায়। রেললাইনের ডাইভারসান দেখেছ? ওইরকম অনেকটা...”

রেললাইন আর জীবন কি এক হল? বিপাশা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। অনিন্দ্য উঠে গিয়ে ওর পিঠে হাত রেখেছিল, বলেছিল, “কেঁদো না পুপু, নিয়তিকে বদলানোর ক্ষমতা আমাদের কারও নেই। বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প বললেই হয় তো মিটে যেত। কিন্তু তোমাদের সত্যিটা জানার দরকার ছিল। পরে আর বলার সুযোগ পেতাম না। আমাকে যে আজকেই ফিরে যেতে হবে।”

দময়ন্তী চমকে উঠেছিল। বিপাশা অনিন্দ্যর হাত চেপে ধরেছিল, “ফিরে যাবে মানে? কোথায়?”

অনিন্দ্য বিষণ্ণ মুখে বলেছিল, “যেখান থেকে এসেছিলাম, সেখানেই... ডাক এসেছে, শাস্তির মেয়াদ শেষ, আর থাকবার উপায় নেই।”

অনিন্দ্য উঠে দাঁড়িয়েছিল। বিপাশা বলেছিল, “আমি তোমায় কোথাও যেতে দেব না।”

দময়ন্তী মুখ তুলে দেখল, বাউল মানুষটা এখনও তার দিকে চেয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তে বলল, “আমায় যে পরের স্টেশানে নামতে হবে গো। তুমি এমন মন খারাপ করে বসে থাকলে যাই কী করে বল তো?”


|| ৩ ||

বিপাশা হাউ হাউ করে কাঁদছিল, “রূপু যখন জিজ্ঞেস করবে, বাবা কোথায়, আমি কী বলব?”

অনিন্দ্য জবাব দেয়নি। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। যেমন করে শববাহকেরা মৃত পরিজনের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েক মুহূর্ত পরে বিপাশাকে কাছে টেনে সিঁথিতে চুমু খেয়েছিল। দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “যাই মন?”

ওর গলার স্বরে কী ছিল, দময়ন্তী চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। অনিন্দ্যকে কি কেউ ডেকেছিল? শব্দ করে নয়, অথচ ওদের মনে হয়েছিল, বাইরে বারান্দায় কেউ ওর জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। অনিন্দ্য বিপাশার হাত ছাড়িয়ে সদর দরজা খুলে অন্ধকারের মধ্যে নেমে গিয়েছিল। ওরা তিনজন চিত্রার্পিতর মতো দাঁড়িয়েছিল, অনেকক্ষণ... যদি ফিরে আসে। আসেনি। বিপাশা মেঝের ওপরই থপ করে বসে পড়েছিল। জয়ন্তীদি বলেছিল, “এই পুপু, ওঠ... সোফায় উঠে বস।”

বিপাশা ওঠেনি, একবার জয়ন্তীদির দিকে একবার দময়ন্তীর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।

রাতটা কোনওমতে জয়ন্তীদির বাড়িতে কাটিয়ে সকালবেলা নিয়ম-মাফিক কলকাতার ট্রেনে ধরেছিল দময়ন্তী। এমন নয় যে কলকাতা গেলেই কোনও সুরাহা হবে। সেই হতচ্ছাড়া শহরটাতেও তো একটা তালাবন্ধ হা-হা খালি ফ্ল্যাট ছাড়া আর কিছু নেই। বাকি জীবনটা হয় তো ওই অ্যালবিনো সম্বরটার মতো একা একাই কেটে যাবে। সতর্ক করার কেউ নেই, প্রতিবার তেষ্টা পেলে ভয় পাবে কখন পেছন থেকে চিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে। জলের আশেপাশেই যে মৃত্যুর মতো শিকারি পশুরা ওঁত পেতে বসে থাকে।

বাবা মা কোনওদিনই অনিন্দ্যকে মেনে নেয়নি। অনিন্দ্য বলেছিল ও অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। নিজের বাপ-মা, আত্মীয়-স্বজনের খবর জানে না। বিপাশার তো তবু একটা মেয়ে আছে। তার মুখের দিকে চেয়ে সময় কেটে যাবে। দময়ন্তী কার জন্যে বাঁচবে? সামনের সাদা আলখাল্লা পরে বসে থাকা মানুষটার চোখ থেকে করুণা ঝরছে। মনে হচ্ছে যেন পূর্বজন্মের চেনা। তাকে সব কথা বলা যায়। দময়ন্তী দুম করে জিজ্ঞেস করে বসল, “আমি এখন কী করি বল তো?”

মানুষটা স্মিত মুখে বলল, “এ তো খুব সহজ কথা গো। মনের মানুষ যা চাইবেন, তাই করবে। আমরা তো তাঁর হাতের পুতুল বই অন্য কিছু না... তিনি যেমন নাচান, পায়ে ঘুঙ্গুর বেঁধে তেমনই নাচি...”

দময়ন্তী বলল, “কী করে জানব, তিনি কী চান?”

সে হাসল, তার হাসিটি বড়ো সুন্দর, বড়ো আলোময়। বলল, “সে কথা তাঁকেই জিজ্ঞেস করো না কেন, তিনিই রাস্তা দেখাবেন। আমি সামান্য মানুষ, আমি কি তাঁর হদিশ জানি?” একটু থেমে লালন সাঁইয়ের গান ধরল, “বাড়ির কাছে আরশি নগর, সেথা পড়শি বসত করে... একঘর পড়শি বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে...”

গান শুনতে শুনতে দময়ন্তী ভাবল আহা! একবার যদি পড়শি তাকে ছুঁয়ে দিয়ে যেত! যতই যাই হোক, অনিন্দ্যকে ছেড়ে থাকতে হবে ভাবলেই যম-যাতনাটা শরীরের দখল নিচ্ছে। এখনও মেনে নিতে অসুবিধে হচ্ছে অনিন্দ্য আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। চব্বিশ-পঁচিশ বছরের সম্পর্ক এক লহমায় নস্যাৎ করে দিয়ে চলে গেল। তার একটুও পায়ে পা জড়াল না? দেবদূতেরা বুঝি এমনই হয়! নির্মম, মোহ-মমতাহীন।

সাত দিন পরে মাঝ রাত্তিরে সত্যিই কি বাগুইহাটির ফ্ল্যাটের কলিং বেলটা আর বেজে উঠবে না?

প্রতিবার ট্যুর থেকে ফিরে দরজাটা পিঠ দিয়ে ঠেলে বন্ধ করে অনিন্দ্য তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিত, সারাদিনের মামড়ি পড়া কর্কশ ঠোঁট ডোবাত তার ভিজে ঠোঁটে। বলত, ‘আঃ, ক্লান্তি কেটে গেল। মনে হচ্ছে আবার একবার নতুন করে জন্মালাম।’ ওর পাগলামি দেখে দময়ন্তী হাসত, বলত, ‘এসো খোকাবাবু, ঘরে এসো।’ কিন্তু অনিন্দ্যর ফিরে আসা মানেই তো বিপাশার স্বামীর ফিরে আসা, রূপসার বাবার ফিরে আসা। একজন মিথ্যেবাদী লম্পটের ফিরে আসা। অনিন্দ্যকে পেতে হলে এতগুলো অচেনা অনিন্দ্যকে মেনে নেওয়া কি সম্ভব হবে?

আচ্ছা এমন তো নয় যে কাল সন্ধের ঘটনাটা পুরোটাই একটা নাটক। নির্দেশনাঃ শ্রী অনিন্দ্য ঘোষ, অভিনয়ে নাট্যসূর্য অনিন্দ্য ঘোষ, অন্যান্য ভূমিকায় শ্রীমতী বিপাশা মিত্র, জয়ন্তী সেন... জয়ন্তীদিকে বোধ হয় সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখা যায়। ধরা পড়ে গেছে দেখে, অনিন্দ্য একাই সম্ভবত নাটকটা মঞ্চস্থ করেছিল। অনিন্দ্যর ইঙ্গিতে বিপাশা জাস্ট ধরতাই দিয়ে গেছে। হ্যাঁ’তে হ্যাঁ, না’তে না মিলিয়েছে। বিপাশা কলেজে নাটক করত না? গ্রুপ থিয়েটারেরও দু’-একবার করেছে মনে হয়, কে যেন বলেছিল। অসাধারণ অভিনয়, স্বীকার করতেই হবে। ওরা জানত দময়ন্তী ফিরে যাবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত কোথাও ঘাপ্টি মেরে থাকলেই হল। ইতিমধ্যে হয় তো অনিন্দ্য ঘরে ফিরে মাছ ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলছে। দু’জনে হাসাহাসি করছে দময়ন্তীকে কেমন বোকা বানিয়েছে।

নাটক হোক বা না-হোক, অনিন্দ্য কলকাতায় না ফিরলেই মঙ্গল। তবু ধরো, যদি সে সাত দিন সাত রাত পরে মাথা নিচু করে এসে দাঁড়ায়, বলে, ‘দময়ন্তী, আমার ভুল হয়ে গেছে। এবারের মতো...’ দময়ন্তী কি তাকে ক্ষমা করে দিতে পারবে? অথবা দরজায় দাঁড়িয়ে যদি ভান করে সে এসবের কিছুই জানত না। জামশেদপুর থেকে ক্লায়েন্টের সঙ্গে ম্যারাথন মিটিং সেরে ফিরছে। জামায় এখনও ঘামের গন্ধ লেগে আছে। সেটা আরও মারাত্মক। দময়ন্তীর মনে হল সে এই চাপটা নিতে পারবে না।

তার চেয়ে অনিন্দ্যর দেবদূত হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া অনেক স্বস্তিকর। একজন মানুষ কি এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না? কোনও চিহ্ন রেখে হাওয়ায় মিশে যেতে পারে না? কতো মানুষই তো সন্ন্যাসী হয়ে ঘর ছাড়ে, গুমখুন হয়, আচমকা লা-পতা হয়ে যায়। ঘনিষ্ঠ মানুষেরা হাসপাতালে, মর্গে, থানায় খোঁজ-খবর করে, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় — অমুক চন্দ্র তমুক, তুমি যেখানেই থাক...। লোকে প্রশ্ন করবে না, এমন নয়। আত্মীয়স্বজন না-হয় তিন কুলে কেউ নেই, চেনা-পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের কী বলবে? বাজার-দোকানে, ব্যাঙ্কে, পোস্ট-অফিসে সর্বত্র একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। অনিন্দ্য যে কী উটকো ঝামেলার মধ্যে তাকে ফেলে দিয়ে গেল!

বাউল মানুষটা বলল, “মুখে আবার আঁধার নামে কেন মেয়ে?”

দময়ন্তী শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছল, “কোথায় আঁধার?” জিজ্ঞেস করল, “এমন আনন্দ বিলিয়ে বেড়াও, তোমার কি কোনও দুঃখ নেই?”

মানুষটা হাসল, “ফকিরের আবার কীসের দুঃখ গো? তার তো আর কিছু হারাবার ভয় নেই।”

তা বটে, যা হারাবার তা সংসারী মানুষই হারায়। দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, “সারাদিন এমন ঘুরে বেড়াও?”

সে বলল, “সারাদিন কি আর? রাতে আমার হাতের জল বাতাসা না পেলে যে তাঁর ঘুম আসে না গো। ফিরতেই হয়।”

“নিজে খাও কী?”

“মাধুকরী করে যা পাই।”

“থাক কোথায়?”

“যেখানে ভালবাসা...,” হেসে বলল, “যেখানে ভাল বাসা...”

এত হাসি, এত খুশি, আসে কোত্থেকে? ট্রেনটার গতি কমে আসছে। ষ্টেশন আসছে। সামনের মানুষটা উঠে দাঁড়াল। নেমে যাবে। কোথাও কিছু নেই, দময়ন্তীর বুকটা টনটন করে উঠল, ভাবল, এর মধ্যেই! অস্থির লাগছে। ভেতরে কোথাও একটা ঝড়ের অভিসন্ধি চলছে। যেন পারাপারের নৌকোটা ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে। দময়ন্তীকে এক্ষুণি একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঈশ্বর! কেন যে তাকে বার বার এমন আতান্তরে ফেলে! দময়ন্তীর এক পা ঘাটে অন্য পা নৌকার পাটায়। মাঝি জল মাপছে, আকাশের মেঘ দেখছে... এবার রশিতে টান দেবে। মানুষটা দময়ন্তীর দিকে হাত বাড়িয়ে মন্দ্রস্বরে বলল, “আসবে আমার সঙ্গে, আমার আখড়ায়?”

দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, “তোমার আনন্দর ভাগ দেবে?”

মোহন হাসি হেসে সে ঘাড় দোলাল, বলল, “হ্যাঁ।”

মানুষটা কি সম্মোহন জানে? দময়ন্তী মন্ত্রমুগ্ধর মতো উঠে দাঁড়াল, বলল, “চল তবে...”

মফস্‌সলের ষ্টেশন, নিচু প্ল্যাটফর্ম। ট্রেন থামতে সে সাবধানে দময়ন্তীর হাত ধরে নামাল। শেড পার হয়ে আলোর বিপরীতে যেদিকটায় মায়াবী অন্ধকার ঘন হয়ে আছে, সেই দিকে হেঁটে গেল দু’জন।




(পরবাস-৭৮, ৮ই এপ্রিল, ২০২০)