“একটা ময়ূর পুষবে গো? বেশ পায়ে-পায়ে ঘুরবে। সকালবেলা হাত থেকে কল-বের-করা ছোলা খাবে, ঠুকরে-ঠুকরে। বর্ষায় পেখম তুলে নাচবে।”
“ময়ূর ছোলা খায়?”
“কী খায়?”
“তোমার মাথা আর আমার মুণ্ডু।”
“আহা, রাগ করছ কেন?”
“না, না, রাগ করব কেন? আহ্লাদ করব। ময়ূরের ডাক শুনেছ কখনও? কানের পর্দা ফেটে যাবে।”
“তা হোক, কিন্তু কী সুন্দর দেখতে হয়, বলো তো? সামনের বারান্দাটায় ছাড়া থাকবে। রাস্তার লোকে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে যাবে। মঞ্জুনাথ বলে ডাকলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাবে...”
“মঞ্জুনাথটা আবার কে?”
“মনে মনে ভেবে রেখেছি, ময়ূরটার নাম রাখব মঞ্জুনাথ। মঞ্জুনাথ... মঞ্জুনাথ... নামটা কী মিষ্টি, না গো?”
“কী? ময়ূরের নাম মঞ্জুনাথ? ইয়ার্কি হচ্ছে? জানো না, ময়ূর ভারতের জাতীয় পক্ষী? ময়ূর পোষা বেআইনি। যখন পুলিশ এসে কোমরে দড়ি দিয়ে টানতে-টানতে নিয়ে যাবে, তখন বুঝবে।”
“কে বলল বেআইনি?”
“আমি বলছি...”
“সত্যি গো? বেআইনি?”
মালবিকা বিমর্ষ হয়ে জানলার দিকে মুখ করে বসে রইল। ওকে দেখে মায়া হল কিংশুকের। মালবিকা আপাতত পুরোদস্তুর বিছানা-বন্দি। গতবার ওর জরায়ু থেকে ভ্রূণ ঝরে গিয়েছিল পাঁচ মাসের মাথায়। যমজ ভ্রূণ, পূর্ণ-পরিণত হয়ে ওঠার আগেই বৃন্ত ছিঁড়ে গিয়েছিল কোনও এক অজ্ঞাত কারণে। এবার তাই অতিরিক্ত সতর্কতা। ওঠা হাঁটা, ঘরের কাজ তো বটেই, একান্ত অপরিহার্য না হলে বিছানা থেকে নামাও বারণ। সারাদিন শুয়ে বসে থেকে মালবিকা অস্থির হয়ে পড়ে। সন্ধেবেলা কিংশুক অফিস থেকে ফিরলে তাকে আর ছাড়তে চায় না। কিছু না কিছু নিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো বায়না করে। কিংশুক স্তোক দিয়ে বলল, “আচ্ছা, আমি বাজারে যাব যখন খোঁজ নিয়ে দেখব’খন ময়ূর পাওয়া যায় কি না।”
মালবিকার মুখে আলো ফুটল। হাততালি দিয়ে বলল, “জানো, ছোটবেলায় আমাদের পাড়ায় একজন পাখিধরা আসত। সে একটা লম্বা লাঠির মাথায় আঠা লাগিয়ে গাছ থেকে পাখি পেড়ে আনত। কী যেন নাম ছিল লোকটার... আতিক না বাতিক কী যেন...”
কিংশুক বলল, “ছেলেধরা শুনেছি, পাখিধরা শুনিনি বাপের জন্মে।”
মালবিকা ঠোঁট ওলটাল, “তোমরা শহরের লোক, গ্রামে-গঞ্জে কত রকমের মানুষ থাকে।”
“এই, আবার শুরু হল তোমার গ্রামের ব্যাখ্যান।”
“আচ্ছা বাবা, ঘাট হয়েছে, চুপ করছি,” বলল বটে মালবিকা, কিন্তু দু’-মিনিটের মধ্যেই আবার হেসে হেসে বলল, “ছেলেধরাও ছিল, ঘাড়ে ঝোলা নিয়ে আসত, কী যে ভয় পেতাম!”
কিংশুক কথা ঘোরাবার জন্য জিজ্ঞেস করল, “আজ মিনতি-মাসি এসেছিল?”
মালবিকা ঘাড় নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, এই তো তুমি আসার আধ ঘন্টা আগেই গেল। রাতের রান্না করে রেখে গেছে। খালি ভাতটা ফুটিয়ে নিতে হবে।”
“মিনতি-মাসিকে জিজ্ঞেস কোরো তো ক’দিন রাত্তিরে এসে থাকতে পারবে কি না? ট্যুরে যেতে হবে।”
“কবে যাবে?” মালবিকা শঙ্কিত হল। কিংশুক বলল, “এই মাসের শেষাশেষি... না গেলেই নয়।”
“যখন থাকবে না, তখন যদি... আগের বারের মত...”
“কু-কথা বোলো না, কিচ্ছু হবে না। ডক্টর রায়ের সঙ্গে কথা বলেই যাব।”
“খুব ভয় করে, জানো।”
“ফালতু টেনসান কোরো না তো।”
মালবিকা গোমড়া মুখ করে বসে রইল। কিংশুক বলল, “খুশি থাকার চেষ্টা করো। ডক্টর রায় কী বলেছিলেন, ভুলে গেলে?”
মালবিকা বিছানার ওপর পা ঠুকল, “সারাদিন এক ঠাঁয়ে বসে থাকতে হলে বুঝতে। আমি কিছু জানি না, আমার একটা ময়ূর চাই, ব্যাস।”
“আরে, কী করছ? দুম-দাম হাত পা ছুঁড়ো না।”
“তুমি আমায় একটা ময়ূর এনে দাও। আজই...”
“উঠল বাই তো কটক যাই... আমি কি ময়ূর বানাব?”
“তুমি যেখান থেকে পারো, খুঁজে নিয়ে এসো।”
“শোনো, শোনো, তার থেকে তুমি বরং রঙিন মাছ পোষো। আমি একটা অ্যাকোয়ারিয়াম কিনে এনে দেব। ওই কোণাটায় রেখে দেব, তুমি বিছানায় বসেই দেখতে পাবে।”
“না, আমার ময়ূরই চাই,” মালবিকা গোঁয়ারের মতো বলল। মুখ কালো করে উল্টো দিকে ঘুরে বসল।
কিংশুক মালবিকার পাশে গিয়ে গা ঘেঁষে বসল। তাকে ভোলাবার চেষ্টা করল, “লক্ষ্মী সোনা আমার, দেখি, মন খারাপ করে না, একবার আমার দিকে তাকাও।”
মালবিকা বলল, “না...”
কিংশুক তার পিঠে হাত রেখে নিজের দিকে টানল। মালবিকা রাগ করে হাত সরিয়ে দিল। একটু আগে বলা কথাই ফিরিয়ে দিল কিংশুককে, “ডক্টর রায় কী বলেছেন মনে নেই বুঝি?”
“কী?” ভুরু কোঁচকাল কিংশুক।
“সরে বসো, এখন কাছে আসা বারণ।”
স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন গাইনিকলজিস্ট ডক্টর রায়। কিংশুক অবাধ্য হতে হতে সামলে নিল। উঠে গিয়ে কিচেন থেকে জলের বোতল নিয়ে এল। এক ঢোঁক জল খেয়ে বলল, “হুঁহ্, ডক্টর রায় সব জেনে বসে আছেন।”
২
অফিসের কাজে জয়পুর গিয়েছিল কিংশুক। যেদিন বাড়ি ফিরল তার ঠিক তিন দিন পর থেকে সব কিছু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাস, ট্রেনের চাকা থেমে গেল, উড়োজাহাজ পাখা গুটিয়ে নিল। ওষুধপত্র বা একান্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান ছাড়া বাকি সমস্ত দোকানপাটে ঝাঁপ পড়ল। মানুষ আতঙ্কে অন্তরীন, রাস্তাঘাট সুনসান, দিনে যদিও বা দু’-চারজন, অন্ধকার নামলে মহল্লা প্রেতপুরী। দেশ জুড়ে লকডাউন শুরু হল, কিংশুকের ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম।
জয়পুর থেকে দুটো কাঠের ময়ূর কিনে এনেছিল কিংশুক। হাতে পেয়ে মালবিকার খুশি আর ধরে না। হলই বা কাঠের তৈরি, জ্যান্ত নয়, কিন্তু কী সুন্দর দেখতে। গাঢ় সবুজ রঙের পেখম, পিঠে সোনার জলের নক্সা, লাল কুতকুতে মোতির মতো চোখ। মালবিকা বলল, “দেখো, কী রকম করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আহা, ওদের খিদে পেয়েছে মনে হয়।”
কিংশুকের কপালে ভাঁজ পড়ল, “কাদের খিদে পেয়েছে?”
“লালকমল আর নীলকমলের, আবার কাদের?”
“অ! তার মানে তোমার মঞ্জুনাথ ক্যানসেল?”
“মঞ্জুনাথ... ও হ্যাঁ, ক্যানসেল।”
“সে কী? বেশ ছিল তো নামটা... মঞ্জুনাথ। মঞ্জুনাথের সঙ্গে মিলিয়ে অন্যটার নাম রাখতে পারতে - রঞ্জুনাথ।”
“ধ্যুর, রঞ্জুনাথ আবার কারো নাম হয় নাকি? কী যে বলো!”
“হয় না বুঝি? তা হবে... আচ্ছা, একটা কথা বলো তো, কোন জন লালকমল, কোন জন নীল? আমি তো দু’জনকে আলাদা করতে পারছি না।”
“যাঃ! তুমি না! ভালো ক’রে দেখো, খুব সহজ চেনা। লালকমলের ঠোঁটের কোণে একটা কালচে দাগ আছে। আর নীলকমলের বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের নখটা অর্ধেক ভাঙ্গা... এই যে।”
“তা বটে...”
মিনতিদি আসছে না। কিংশুকই অফিসের কাজের ফাঁকে চাল ডাল ফুটিয়ে নেয়। মাছ থাকলে দু’-টুকরো মাছ-ভাজা, না থাকলে আলু-ডিম-সেদ্ধ। মালবিকাকে উঠতে দেয় না। মালবিকা খাবার সময় নিজের থালা থেকে এক মুষ্টি মাখা ভাত সরিয়ে রাখে। লালকমল নীলকমল খাবে। কিংশুক প্রথম প্রথম আপত্তি করেছিল, “কাঠের পুতুল কি খাবার খায়?”
“ওরা পুতুল নয়।”
“তবে কি মানুষ?”
মালবিকা জবাব দেয়নি। ঠান্ডা চোখে তাকিয়েছিল। নিয়ম মত লালকমল নীলকমলকে ভাত-জল দিয়েছিল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “খাও বাবারা, পেট ভরে খাও।”
ক’দিন যাবার পর কিংশুকেরও যেন মনে হল, লালকমল নীলকমল আগের থেকে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে। আকারে আয়তনেও কি বেড়েছে? ঠিক বুঝতে পারল না। মালবিকা চান করতে গিয়েছিল। পুতুল দুটোকে খাটের লাগোয়া সাইড টেবিল থেকে সাবধানে হাতে তুলে দেখল। আগের থেকে যেন ভারী লাগল। বিক্রি করার সময় দোকান থেকে বলেছিল হ্যান্ডিক্র্যাফট। হাতে তৈরি হলে কিছু না কিছু অসৈরণ, কোনও না কোনও অনিচ্ছাকৃত গরমিল তো থাকবে। কিন্তু একটা পাখি যেন অন্যটার কার্বন কপি। অনেক চেষ্টা করেও লালকমলের ঠোঁটের দাগ খুঁজে পেল না কিংশুক। আশ্চর্য, দাগটা মিলিয়ে গেল নাকি? নীলকমলের বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের ভাঙা নখটাও তো অদৃশ্য। সেটাও কি আপনা আপনি গজিয়ে উঠল? মুশকিল হচ্ছে, কিংশুক কিছুতেই পাখিদুটোকে আলাদা করে চিনতে পারে না। এমন নয় যে চেনাটা খুব জরুরি, তবু... মালবিকা ঠিক বুঝতে পারে কে লাল কে নীল।
রাত্তিরে শোবার সময় মালবিকা পাখিগুলোকে বুকের কাছে নিয়ে শোয়। তাকে কাছে টানতে গেলেই টের পায় কিংশুক, স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে শক্ত নিষেধের মতো পাখিগুলো জেগে বসে আছে। সে আর ইদানীং মালবিকার নম্রতার নাগাল পাচ্ছে না। ময়ূরদুটো যেন মালবিকা আর তার পেটের মধ্যে বাড়তে থাকা বাচ্চাটাকে দিনরাত আগলে রেখেছে। চোখ জ্বেলে পাহারা দিচ্ছে দু’জনকে। কাছাকাছি হতে গেলেই চোখ রাঙিয়ে বলছে – ডক্টর আঙ্কেল বারণ করেছে না... ভাবটা যেন কিংশুক আদৌ তার বৌ-বাচ্চার শুভাকাঙ্ক্ষী নয়। তাদের ভালমন্দর দায়-দায়িত্ব কিংশুকের থেকেও পাখিগুলো বেশি বোঝে। কিংশুকের মাথা গরম হয়ে যায়। সে জোর করে সরিয়ে দিতে চায় পাখিগুলোকে। মালবিকা ছাড়তে চায় না। বলে, “না, না, ওরা থাকুক।”
“কেন ছেলেমানুষি করছ? কখন কোথায় লেগে-টেগে যাবে...”
“না, কিছু হবে না। তুমি ওপাশ ফিরে শোও।”
লালকমল নীলকমল আসার পর থেকে মালবিকার যাবতীয় মনখারাপ ভোজবাজির মতো উবে গেছে। সে আজকাল সারাদিন হাসিখুশি থাকে, কারণে অকারণে গুনগুন করে গান গায়। লালকমল নীলকমলের সঙ্গে খেলা করে, কথা বলে। খাটের পাশেই জানলা। লালকমল নীলকমল জানলার শানে বসে বাইরের গাছপালা, মেঘলা আকাশ দেখে। জানলার গরাদে ঠোঁট ঘষে। লকডাউন বলে সাধারণত কেউ আসে না বাড়িতে। একবার একটা ক্যুরিয়ারের ছেলে এল ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড দিতে। কিংশুক তার হাতের কাগজে সই দিতে দিতে শুনল লালকমল নাকি নীল... কে জানে... ‘কঁক্’ করে ডেকে উঠল। ছেলেটা ভিতরে উঁকি দেবার চেষ্টা করছিল। কিংশুক তাড়াতাড়ি তাকে ভাগিয়ে দিল। ফিরে এসে বলল, “একদিন তোমার পোষ্যদের জন্যে বিপদে পড়তে হবে দেখছি।”
মালবিকা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “দেখো না, যা দস্যি হয়েছে দুটো। এক মুহূর্ত থির হয়ে বসে না।”
কিংশুক ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ক্রেডিট কার্ডের খামটা ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে থমকে গেল। শেভ করা হয় না দিন দশেক, চুলটাও লম্বা হয়েছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নিচে কালি। চাউনিতে একটা অনাবশ্যক রুক্ষতা। চেহারাটা কেমন বদলে যাচ্ছে, যেন কিংশুক নয়, আয়নার মধ্যে অন্য কোনও লোক। গালে একটা বিরক্তিকর ব্রণ উঠেছে। আঙুল দিলে ব্যথা। পাখি দুটো বড্ড বেশি উপদ্রব করছে। মালবিকার প্রশ্রয় পেয়েই মাথায় চড়ে বসেছে। একটা বিহিত করা দরকার। একবার ভাবল, নখ বিঁধিয়ে ব্রণটা গেলে দেয়। তারপর ভাবল, থাক। নিজে নিজেই চুপসে যাবে।
৩
ডক্টর রায় বললেন, “লক্ষণ ভাল ঠেকছে না। আপনি বরং অ্যাডমিট করে দিন।”
ডেলিভারির নির্ধারিত দিনের দেরি আছে, এখনও প্রায় মাস খানেক। গত রাত থেকে মালবিকা বলছে, বাচ্চার নড়াচড়া যেন কম। সকালে উঠেই ডক্টর রায়কে ফোন করেছিল কিংশুক। ডক্টর রায়ের ক্লিনিক হাঁটাপথ। কিন্তু তিনি জানিয়েছিলেন, ক্লিনিক বন্ধ, বিল্ডিঙের ওয়াচম্যানের কোভিড পজিটিভ ধরা পড়েছে। মালবিকাকে নিয়ে দূরের একটা নার্সিংহোমে আসতে বলেছিলেন। ডক্টর রায় সেই নার্সিংহোমটির সঙ্গে অ্যাটাচড। বলেছিলেন তিনিও আসছেন সেখানে ঘন্টা খানেকের মধ্যে। নিচে নেমে গাড়ি বার করতে গিয়ে কিংশুক দেখেছিল ব্যাটারি ডাউন, গাড়ি স্টার্ট হচ্ছে না। গাড়ির আর দোষ কী, পনেরো কুড়ি দিন স্টার্ট না পড়লে বসে যাবারই কথা। মালবিকা শঙ্কিত হয়ে বলেছিল, “এখন কী হবে?”
কিংশুক বলেছিল, “দাঁড়াও দেখি...”
একবার ফোন করেই বাচ্চুর গাড়িটা পেয়ে গিয়েছিল কিংশুক। পাড়ার ছেলে, কিংশুককে ‘দাদা, দাদা’ করে। চারটে গাড়ি হরবখত ভাড়া খাটে বাচ্চুর। নরম্যাল টাইমে আগে থেকে না বুক করলে গাড়ি পাওয়া ভার হয়। বাচ্চুরও পাত্তা পাওয়া যায় না। গাড়ি নিয়ে কাঁহা কাঁহা মুল্লুক চষে বেড়ায়, কখনও বক্রেশ্বর তো কখনও মুকুটমণিপুর। আজ নিজেই গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিল।
কিংশুক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, “ভাগ্যিস ছিলে...”
স্টিয়ারিং ধরে বলেছিল, “দাদা, দুঃখের কথা কী বলব, লকডাউনের ঠেলায় ব্যবসা লাটে ওঠার যোগাড়। কেউ বাড়ি থেকেই বেরোয় না তো গাড়ি ভাড়া করবে কী? ভাবছি শাক-সব্জির স্টল দেব, দরকার মতো হোম সার্ভিস।”
রাস্তায় পুলিশ গাড়ি থামিয়েছিল বার দুয়েক। অবশ্য মালবিকার অবস্থা দেখে ছেড়ে দিয়েছিল তৎক্ষণাৎ।
বেরোবার সময় লালকমল নীলকমলকেও সঙ্গে নিয়ে আসতে চেয়েছিল মালবিকা। কিংশুক বলেছিল, ঘন্টা দু’-তিনের ব্যাপার... তখনও জানত না মালবিকাকে অ্যাডমিট হতে হবে। গাড়িতে যাবার সময়ই মালবিকা বলেছিল পেটে একটা ব্যথা চিনচিন করছে। ডক্টর রায়ের কেবিনের সামনে বসে থাকার সময় ব্যথাটা বাড়ল। ডক্টর রায় বললেন, “অবজারভেশানে রাখা দরকার।”
মালবিকাকে অ্যাডমিট করে সন্ধে পর্যন্ত নারসিংহোমেই বসে ছিল কিংশুক। মালবিকা বলল, “আমি তো এখন ঠিক আছি। তুমি বাড়ি যাও। বেচারা পাখিদুটো না খেয়ে না দেয়ে বসে আছে। তুমিও তো কিছু মুখে দাওনি।”
ডক্টর রায়ও সন্ধেবেলা রাউন্ডে এসে বললেন, “ইমার্জেন্সি নেই যখন, রাত্তিরে থাকার দরকার নেই। তেমন কিছু অসুবিধে হলে আমি আপনাকে ফোন করব।”
বাচ্চু গাড়ি নিয়ে বসে ছিল। বলল, “দাদা, চিন্তা করবেন না। একটা ফোন দেবেন শুধু, গাড়ি নিয়ে পোঁছে যাব।”
বাড়ি ফিরে কিংশুক দেখল লালকমল নীলকমল মুখ শুকিয়ে বসে আছে। ফ্রিজে পাঁউরুটি ছিল, কাঁচা পাঁউরুটি জ্যাম মাখিয়ে নিজে খেল, ওদেরকেও দিল। জল রাখল সামনের বাটিতে। ময়ূরদুটো মুখ দিল না। লালকমল জিজ্ঞেস করল, “আগে বলো মা কেমন আছে?”
কিংশুক বলল, “ভাল,” বলেই ভাবল, আশ্চর্য তো, সে এখন পরিষ্কার ময়ূরের ভাষা বুঝতে পারছে। এমনকী কোন জন লালকমল, কোন জন নীলকমল, তাও। ওই তো, লালকমলের চোখের কোণে জল টলটল করছে। নীলকমল আসা ইস্তক সেই যে ঘাড়ে ঠোঁট গুঁজে বসে আছে, ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না। ময়ূরদুটো সে রাতে ভাল করে খেলই না। কিংশুকও শুধু পাঁউরুটি জল খেয়ে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন সকাল-সকাল ডক্টর রায়ের ফোন এল। মালবিকাকে অপারেট করতে হবে, সিজারিয়ান সেকশান। যদিও প্রিম্যাচিওর, বাচ্চাকে বাঁচাতে হলে তা-ছাড়া গতি নেই। কিংশুক যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে। কাগজপত্রে সই-সাবুদ দরকার। বাচ্চুকে ফোন করল কিংশুক। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়ির সামনে গাড়ি লাগিয়ে দিল বাচ্চু। বেরোবার সময় কিংশুক ময়ূরদুটোকে বলল, “আসি রে, লক্ষ্মী হয়ে থাকিস বাবারা। দুষ্টুমি করিস না।”
লালকমল বলল, “আমাদের জন্যে ভেবো না, আমরা ঠিক থাকব।”
নীলকমল বলল, “দুশ্চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নার্সিংহোমে পৌঁছে কিংশুক দেখল মালবিকা ওটিতে যাবার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে। কিংশুক যেতেই ওর হাত চেপে ধরল। কিংশুক বলল, “একদম ঘাবড়িও না, আজকাল আকচার সিজারিয়ান অপারেশান হচ্ছে। ডক্টর রায় বলেছেন, কোনও ভয় নেই।”
মালবিকা কাঁপা গলায় বলল, “নিজের জন্যে ভয় পাচ্ছি না। হ্যাঁ গো, পেটেরটা ঠিক আছে তো?”
কিংশুক সাহস দিল, “ওর কিচ্ছু হয়নি, আমি বলছি। দেখো তুমি...”
নার্স এসে মালবিকার হাতে চ্যানেল করে দিয়ে গেল। ছুঁচ ফোটানোর সময় মালবিকা একবার ‘উঃ’ করে উঠল। তারপর মুখ ফিরিয়ে কিংশুককে জিজ্ঞেস করল, “আমার লাল নীল কেমন আছে গো?”
“তোমার পথ চেয়ে বসে আছে।”
“জানি না কবে ছাড়া পাব। ওদের দেখাশুনো কোরো।”
“ওদের নিয়ে ভেবো না। আমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে দু’জনের।”
মালবিকার মুখে হাসি ফুটল, বলল, “যাক, বাঁচলাম।”
৪
চৌতিরিশ দিন পর, বাচ্চুর গাড়িতে মালবিকা মেয়ে কোলে বাড়ি ফিরল। পাক্কা একুশ দিন ইনকিউবেটরে ছিল মেয়েটা। যখন জন্মেছিল দু কিলোও ওজন ছিল না, যমে মানুষে টানাটানি, শেষ পর্যন্ত মানুষই জিতে গেল। এই একটা মাস ওদের যে কী ভাবে কেটেছে তা ওরাই জানে। মালবিকা নাওয়া খাওয়া ভুলে ইনকিউবেটরের পাশে ঠায় বসে থেকেছে। কিংশুক দু’-চার ঘন্টার জন্য বাড়ি ফিরেছে। নাকে মুখে দুটি গুঁজে আবার ফিরে গেছে। লালকমল নীলকমল কী খাচ্ছে কী করছে দেখার সময় পায়নি। কোনোদিন থালায় দুটো শুকনো বিস্কুট, একখানা ঠসে যাওয়া কলা বা আপেল রেখে চলে গেছে। তারাও আপত্তি করেনি।
নিজেদের নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে কিংশুক আর মালবিকা ওদের মেয়ের নাম রেখেছে কমলিকা। কমলিকা এখন বেশ ডাগরটি হয়ে উঠেছে। গালে রং ধরেছে, চোখ ফুটেছে, গায়ে গত্তি লেগেছে। ডাকলে ফিরে তাকায়। মায়ের কোল খোঁজে। মেয়েকে নিয়ে ঢুকতেই লালকমল নীলকমল ডানা ঝাপটে মালবিকার পায়ের কাছে উড়ে এসে বসল। মালবিকা বলল, “দাঁড়া, দাঁড়া, অস্থির হোস না, দেখাচ্ছি...”
নিচু হয়ে মেয়ের মুখ দেখাল দু’জনকে। দু’জনে খুশিতে ‘কঁক কঁক’ করে ডেকে উঠল। মালবিকার পায়ে ঠোঁট ঘষল। মালবিকা শোবার ঘরে খাটের ওপর কমলিকাকে শুইয়ে দিল। লালকমল নীলকমল তাকে ঘিরে বসল। মালবিকা তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, “ইস, কত রোগা হয়ে গেছিস তোরা। ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করিসনি?”
কিংশুক বলল, “কতদিন ভালমন্দ খাওয়া দাওয়া হয়নি। ফ্রিজে চিকেন আছে। আজ রাতে জমিয়ে চিকেন বিরিয়ানি রাঁধব। সবাই মিলে মৌজ করে খাব।”
শুধু চিকেন বিরিয়ানি নয় কিংশুকের এক বন্ধু বিদেশ থেকে ফেরার সময় হুইস্কির বোতল এনেছিল। সন্ধেবেলা বিরিয়ানি রান্না হয়ে যাবার পর সেটা খুলে বসল কিংশুক। অন্যসময় মালবিকা নাক সিঁটকোয়। আজ বারণ করল না। অবশ্য কিংশুক বেশি খেল না। বাবা হবার পর তার দায়িত্ব-জ্ঞান বেড়ে গেছে।
মেয়ের জন্য খাটের লাগোয়া একটা ক্র্যাডল কিনে রেখেছিল কিংশুক। তাতে বিছানা পেতে ঘুমন্ত মেয়েকে শুইয়ে দিল মালবিকা। তারপর দু’জনে খেতে বসল। গরম, মশালেদার চিকেন বিরিয়ানি। প্রতি গরাসে জীবনের স্বাদ। কিংশুক রেঁধেছে ভাল। লালকমল নীলকমলের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তারা কমলিকার মাথার কাছে বসে ফিসফিস করে গল্প করতে লাগল। মালবিকা বলল, “দেখিস, যেন বোনের ঘুম না ভেঙে যায়।”
রাত্তিরে বিছানায় কিংশুকের বুকের কাছে ঘন হয়ে এল মালবিকা। আজ আর দুজনের মাঝখানে লালকমল নীলকমল নেই। কিংশুক ঘাড় উঁচু করে দেখল দু’জনে কমলিকার মাথার কাছে বসে ডানা গুটিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনটি দেবশিশু নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে দেয়লা করছে। আজ যেন চাঁদের হাট বসেছে ওদের ঘরে। সন্তর্পণে হুইস্কির গন্ধমাখা ঠোঁট দিয়ে মালবিকার কানের লতি ছুঁল কিংশুক। অনেকদিন পর কিংশুকের ছোঁয়া পেয়ে ভাললাগায় শিউরে উঠল মালবিকা। কিংশুক তার পিঠে নখ দিয়ে নিঃশব্দে মেয়ের নাম লিখল – কমলিকা, তারপর কী মনে করে, লালকমল, নীলকমল... মালবিকা বুঝতে পেরে হাসল। কিছুটা সুখে, কিছুটা আশ্লেষে। হাসিতে সামান্য শব্দ হয়েছিল। কিংশুক তার মুখে হাত চাপা দিল, যদি ওদের ঘুম ভেঙে যায়! আহা, ওরা তিন ভাই-বোন নির্বিঘ্নে ঘুমোক। চাঁপা ফুল আর রাঙা পরিদের স্বপ্ন নামুক ওদের চোখে। সে জন্য কিংশুককে যদি সঙ্গমকালীন ভারি নিশ্বাস দাবিয়ে রাখতে হয়, রাখবে। মালবিকাকে যদি মৃদু শীৎকার গিলে নিতে হয়, নেবে। তাতে সুখের যতটুকু ঘাটতি হয় সেটুকু ওরা ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে। এমনকী ওদের দিকে নজর দিতে গিয়ে মালবিকা যদি কিংশুককে তেমন সময় দিতে না পারে, বুকে পাথর চেপে তাও মেনে নেবে। যুগপৎ ময়ূর এবং মানুষের বাবা-মা হওয়া মুখের কথা নাকি!
(পরবাস-৮০, ১২ অক্টোবর, ২০২০)