ISSN 1563-8685




গ্রন্থ-সমালোচনা

|| উঁকিঝুঁকি নয়, সটান অন্তঃপুরে ||

বাংলা কথাসাহিত্যে মুসলিম অন্তঃপুর; আফরোজা খাতুন; দে’জ পাবলিশিং,কলকাতা-৭০০০৭৩; প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০১১

প্রবন্ধ হইল সেই ধরনের লিখন, যাহা পড়িলে বিশেষ বোঝন যায় না। প্রবন্ধ ভারিভুরি বিষয় লইয়া হইতেই হইবে, যাহাতে প্রবন্ধের ভার অপেক্ষা প্রাবন্ধিকের ধার অধিক শানাইবে। আকারে পৃথুল না হইলে ফির প্রবন্ধ কী ?!

—‘প্রবন্ধ’ সম্পর্কে এ’হেন ধারণা অপ্রচলিত নয়। তবে না, হয়েছে; এই ছকের বাইরেও বাঙলাভাষায় বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, যা পড়লে মন স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। অন্নদাশঙ্কর থেকে আবু সয়ীদ আইয়ূব থেকে অশোক মিত্র মশায়ের বহু প্রবন্ধপাঠের সুখস্মৃতি আজও স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

নবীনা আফরোজা খাতুনের “বাংলা কথাসাহিত্যে মুসলিম অন্তঃপুর” এই জাতীয় প্রবন্ধ-গ্রন্থ, যার তন্বী অবয়বের সঙ্গে নির্মেদ ভাষা, স্বচ্ছ চিন্তা ও দেখার ভঙ্গি সহজেই বইটিকে ‘প্রিয় পুস্তক’-এর স্তরে তুলে দেয়, বইপড়ে ভালো লাগার রেশটি দীর্ঘায়িত হয়।

***

‘মুসলিম অন্তঃপুর’ এমন একখানি বিষয় যার নাম শুনলেই থমকে যেতে হয়, পাছে অজান্তেও না অসম্মান করে ফেলি। মুসলিম অন্তঃপুরের (অতি)রক্ষণশীলতার পাশাপাশি ধর্মীয় অভিভাবকদের রক্তচক্ষুর ডর-ই এর কারণ। কিন্তু মুসলিম নারীর, সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী থেকে বেগম রোকেয়া হয়ে আমাদের আফরোজাদের প্রতিবাদও এই পর্দানশীনতার বিরুদ্ধেইঃ পর্দা না উঠলে আলোক ঢুকবে কোথা দিয়ে? এই পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে জেহাদ সেই ১৮৭৬ থেকে একালের ২০০৫-র গল্পেও ঘুরে ফিরে এসেছে। তালাক, বহুবিবাহ, দেনমোহর সমস্যার পাশাপাশি তাই পর্দানশীনতার সমস্যাও দগদগে হয়ে রয়েছে।

প্রাবন্ধিক স্টাইলটি এই রেখেছেনঃ সেই ১৮৭৬ থেকে ২০০৮ খৃঃ পর্যন্ত প্রায় ষাটখানি বাঙলা উপন্যাস ও ছোটগল্পের নজির টেনে সে-সেখানে কী-কীভাবে ‘মুসলিম অন্তঃপুর’-এর চিত্র ফুটে উঠেছে তার একটি চিত্র এঁকেছেন । উপস্থাপনার ভঙ্গি ‘বুলেট-পয়েন্টস্‌’ নয়, সাবলীল কথাচ্ছলে এসেছে বলে পড়ার আনন্দ মাটি হয়নি, বরং পাঠককে সেই সেই গ্রন্থখানির নিকটে এনে দিয়েছে। বেশ। আর মস্ত চালচিত্রে যেমন ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য রয়েছে, তেমনই আছে ওপার ও এপার বাঙলা, আছেন লেখিকা ও লেখক (হিন্দু-মুসলমান দুই-ই)। সব মিলে আড়াইশ’ পৃষ্ঠার মধ্যে এর উপস্থাপনা সহজ নয়। লেখিকা এখানে ফুলমার্কস পাবেন। কারণ, বেশ মুন্সীয়ানায় তিনি ভাষ্যকার (narrator) ও টীকাকার (commentator) ভূমিকাদ্বয় মিলিয়েছেন—দ্বিতীয়টি কখনওই প্রথমটিকে ছাপিয়ে রসভঙ্গ ঘটায়নি। সুন্দর পরিমিতিবোধ।

বেগম রোকেয়া, মীর মোশাররফ হোসেন, সুফিয়া কামাল, কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, গৌরকিশোর ঘোষের মত প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের পাশাপাশি আয়েশা খাতুন, আলাউদ্দীন আল আজাদ, সেলিনা হোসেন বা মোহাম্মদ হাসেমের মত সাহিত্যিকদেরও উল্লেখ এসেছে। সলজ্জ স্বীকারোক্তি, এঁদের অনেকের নামই জানতাম না। কিন্তু আফরোজার উপস্থাপনার জোরে এনাদের লেখা মূলে পড়ার ইচ্ছেটা জেগে উঠল। এখানেই প্রাবন্ধিকের জয়। যদিও মনে প্রশ্ন জেগে ওঠেঃ পর্দা, তালাক, দেনমোহর, বহুবিবাহ ও হিল্লাবিবাহের মত মুসলিম অন্তঃপুরের যে যে সমস্যায় প্রাবন্ধিকের বিচরণ, ‘পড়ে’ বা ‘লিখে’ তাদের সমাধান হয় কি না। নৈলে, মুসলিম নারীর যে উত্তরাধিকার সমস্যা নিয়ে ১৯২০ খৃঃ কাজী ইমদাদুল হক ‘আবদুল্লাহ্‌’ উপন্যাস লেখেন, সেই একই সমস্যা নিয়ে অর্ধশতাব্দী পরে আবু ইসহাক সাহেবকে ‘আবর্ত’ গল্পখানি কেন লিখতে হয়? হিন্দু সমাজেও, পণপ্রথার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনা’ (১৮৯২) গল্পের সওয়া-শ’ বছর পরে আজও কেন পণের জন্য বধূহত্যা ঘটে চলেছে? তাই ভাবি, ‘লিখে’ কিছু হয়? ঔষধে কাজ না হলে সার্জারি করাতে হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে সার্জারিটা যে কী—তা কে বলে দেবে?

দুটি ছোটগল্পের উল্লেখ পৃথক আলোচনার দাবি রাখেঃ নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ ও সাত্যকি হালদারের ‘খোঁজার বেলা’। ‘রস’ কি মুসলিম অন্তঃপুরের ছবি এঁকেছে? অন্যভাবে বললে, তালাক বা মুসলিম অন্তঃপুরের সমস্যাটাই কি ‘রস’ গল্পের মূল উপজীব্য? তা নয়, প্রত্যেক মানুষেরই এক একটা নিজ নিজ পরিচয় (identity) আছে, তা তার মূল পেশাটার সঙ্গে যুক্ত। এই হিসেবেই কেউ শিক্ষক তো কেউ পটুয়া তো কেউ ড্রাইভার। নায়ক মোতালেফ যেমন ‘গাছি’ বা ‘রসিয়া’। এই জায়গাটা কোনোভাবে বিপন্ন হয়ে গেলে তার অস্তিত্বটাই হারিয়ে যায়, যা সে কখনই মেনে নিতে পারবে না। শরীরী ভালোলাগা-টাগা সেখানে তুচ্ছ হয়ে পড়ে। মোতালেফ তাই নিজ কর্মক্ষেত্রে হেরে গিয়েই মাজু খাতুনের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এটা মানুষের চিরন্তনী পরিচিতির-সমস্যা (identity crisis), ‘মুসলিম অন্তঃপুর’-এর সমস্যা নয়।

আর সাত্যকি হালদারের ‘খোঁজার বেলা’ গল্পের নায়িকার কোরানের অর্থ খুঁজতে যাওয়া গভীরতর অন্বেষণের প্রশ্ন, মুসলিম অন্তঃপুর এখানে গৌণ। অবশ্য, গভীরতর অর্থে অন্তঃপুর যদি হৃদয়পুর বোঝায়, সে অন্য কথা।

এইখানে একটু অপ্রাপ্তির ছোঁয়া লাগল। বইয়ের নামখানি যেহেতু “......মুসলিম অন্তঃপুর”, “.....মুসলিম অন্তঃপুরের সমস্যা” নয়, তাই এতো সব সমস্যার পাশাপাশি পড়তে পাবার আশা ছিল, মুসলিম অন্তঃপুরবাসিনীরা কীভাবে অবসর কাটাতেন, বিনোদন কী ছিল তাঁদের, খেলাধুলা করতেন কিনা (দারিয়াবান্ধা বা চু-কিৎ-কিৎ বা পতঙ্গ ওড়ানো বা খিড়কিপুকুরে সাঁতার তো চালু ক্রীড়া), লুকিয়ে লুকিয়ে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বা ‘আনন্দমঠ’(!) পড়তেন কিনা, চালু রোগের নিদান কী ছিল থেকে ডালে কী ফোড়ন দিতেন ইত্যাদি ইত্যাদি। নাঃ, এ’হেন তুচ্ছ বিষয়ে লিখে কোনো সাহিত্যিকই তাঁর কলমের কালি ফুরোবেন না। কিছুদিন পূর্বে মৃত্তিকা প্রকাশনির একটি বইঃ “বাংলার মুসলিম উৎসব” পড়ে বড্ড ভালো লেগেছিল (নামটা স্মৃতি থেকে লিখলাম, ভুল হতে পারে)। আফরোজা কিন্তু অন্তঃপুরের কথা শোনাতে গিয়ে উৎসব বা আনন্দের কথা পাড়েননি। কেবল সমস্যা সমস্যা শুনতে শুনতে মন ভারি হয়ে আসে।

শেষ পরিচ্ছদে ভারতের অন্য অন্য প্রদেশের শাহ্‌বানু, ইমরানা ও গুড়িয়ার মত মেয়েদের জ্বলন্ত সমস্যা আরও ভাবিত করে তোলে। যদিও বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে যোগ নেই, তবু অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সংগ্রহের মান বাড়িয়েছে ইসমত চুঘতাইয়ের দু’টি উর্দু গল্পের উল্লেখ। একমাত্র এখানেই দুটি হিন্দু-মুসলিম যুবক-যুবতীর প্রেম-ভালোবাসা ও বিবাহের প্রসঙ্গ এসেছে, আলোচিত ষাটখানি বাঙলা রচনায় যা নেই।

আলো-আঁধারিভরা প্রচ্ছদখানি বেশ হয়েছে, দেবব্রত ঘোষ-কৃত। বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েছে। বাঁধাই দুর্বল। তবে, সব মিলিয়ে বইখানি ভালো লেগেছে—সেটাই মনে থেকে যাবে। নবীনা লেখিকার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।



|| সমাজ জীবন ইতিহাস ও গণিতের জলতরঙ্গ ||

প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা; অধ্যাপক নলিনীকান্ত চক্রবর্তী; জ্ঞানবিচিত্রা প্রকাশনী; জগন্নাথবাড়ি রোড,আগরতলা-৭৯৯ ০০১; ISBN: 81-8266-022-X

এক বিঘৎ-পরিমাণ ‘সরল কর’-র উত্তর ‘১’,

বা,

“এক বান্দর এক তৈলাক্ত বাঁশ বাহিয়া উঠিতেছে ও হড়কাইয়া হড়কাইয়া পড়িতেছে.......”,

বা,

“কোনো কাজ ৫ জন পুং ৭ জন নারী ও ১৩ টি গর্দভ ১৭ দিনে করিতে পারিলে ঐ কাজ ২৩ দিনে করিতে.....”
ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

হেমেন রায়-প্রেমেন মিত্তির পড়া এক বালকের কাছে উপরোক্ত শ্রেণিপাঠ্য গণিত কম কল্পবিজ্ঞানীয় লাগত না। নৈলে কে এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে খাম্‌কা এক বংশদণ্ডে খাঁটি সর্ষের তেল লাগাতে যাবে... বা পৃথিবীর কোন্‌কাজ করতে নারী-পুরুষ ও গর্দভের সহাবস্থান লাগতে পারে.......এ’সব ভেবে ভেবে পেন্সিল চিবিয়ে আখ ও অঙ্কে গাড্ডু!

বস্তুতঃ, জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল ধারার মত গণিতও জীবন থেকেই উৎসারিত, তা ঐ তৈলাক্ত বাঁশ বাহিয়া গড়াইয়া পড়ে না। এই ‘জীবনে জীবন যোগ করা’-টা না থাকলে গণিত কিছু ভয়াবহ সংখ্যার আনাগোনা হয়ে পড়তে বাধ্য। আর, গণিত তো হল এক চাবিকাঠি, পদার্থবিদ্যা অর্থনীতি বা রসায়নের মতো বিজ্ঞানের অন্যতর ধারাগুলোকে বুঝতে যা সাহায্য করে।

গণিত তাই উঠে এসেছে জীবন থেকেই। এবং কবে থেকে? প্রাচীন ব্যাবিলন দ্বিঘাত সমীকরণ (quadratic equation)-এর চর্চা করেছিল। খৃষ্টজন্মের দেড় হাজার বছর পূর্বে মিশরে রৈখিক সমীকরণের (linear equation) সমাধান হয়েছিল । প্রাচীন চিনের গণিত তো ছিল আরও সমৃদ্ধ ও মৌলিক। খৃষ্ট-সমসাময়িক কালে চিন নয় ভল্যুমের ‘গণিতকোষ’ লিখে ফেলেছিল! লিখনপদ্ধতিঅজ্ঞ ইনকারা পেরুতে যে রঙিন দড়ির মালায় (‘কিপু’) একাউন্টস রাখত ও ভাববিনিময় করত, তার সঙ্গে আধুনিক বারকোডের অদ্ভুত মিল!

অতএব, গণিতের এক ইতিহাস থাকবেই। জ্যামিতিতে অতিভূজের মান ও কলনবিদ্যার অন্তরকলন (Differential Calculus) একই কালে একই দেশে জ্ঞাত ছিল না, বহু দেশে বহু তাপসের প্রচেষ্টায় ক্রমপুষ্ট হয়েছে। অতএব ‘ইতিহাস’: ‘কালিক’-এর পাশাপাশি ‘স্থানিক’-ও। আর, এই নিয়েই প্রায় দুই হাজার বছরের গণিতের ইতিহাস লিখেছেন মান্য গণিতবেত্তা অধ্যাপক নলিনীকান্ত চক্রবর্তী মহাশয়, দীর্ঘ পাঁচ দশক যিনি গণিতচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ।

অধ্যাপক চক্রবর্তী অবশ্য ‘স্থানিক’-টাকে ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। আলোচ্য বইখানির নাম তাই “প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা”। দেড়শ’ পৃষ্ঠার মধ্যে মনোজ্ঞ ও সহজপাঠ্য ঢঙে সেটা লেখাও মোটেই কম মুন্সীয়ানার কাজ নয়, কারণ পেশাওয়ার থেকে কেরল হয়ে তাম্রলিপ্তি—ভারতের আড়াই সহস্রাব্দের গণিতেতিহাস কম ব্যাপক নয়।

আর, গণিতের কোন্‌কোন্‌ ধারা ও ব্যক্তিত্বকে না ছুঁয়ে গেছেন অধ্যাপক চক্রবর্তী? সেখানে যেমন ‘জৈন গণিত’ ও ‘বাখশালি পাণ্ডুলিপি’-র চর্চা হয়েছে, তেমনই রয়েছে আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত ভাস্করাচার্য থেকে ‘হালের’ সওয়াই জয়সিংহের মত যুগন্ধরগণের জীবন ও কর্মের আলোচনা। এবং গাণিতিক সূত্রের কচকচি যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে।

এ’বইয়ের ‘ঘ্রাণ নিতে’ তাই গণিতজ্ঞ হবার দরকার নেই, মনের অনুসন্ধিৎসাটুকু থাকলেই হবে। নৈলে, উদাহরণ নিন না, যে চক্রবাল (cyclic) নিয়ম কোনো প্রচলিত গণিতগ্রন্থে পাতা পঞ্চাশেকের এক অধ্যায় জুড়ে আলোচিত হয়ে থাকে, তার খেইটুকু অধ্যাপক চক্রবর্তী ধরিয়ে দিয়েছেন দু’পাতার মধ্যে, ভাস্করের নিয়ম ও লাগ্রাঁজের নিয়মের আলোচনার মধ্যে দিয়ে। মনের উৎসাহটাকে জাগিয়ে দেয়, আরও পড়ার ও জানার ইচ্ছেটা চেগে ওঠে। কোনো শিক্ষকের এটাই না প্রধান কর্তব্য!

ক্ষণজন্মা জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাজা সওয়াই জয়সিংহের অধ্যায়টি সবচেয়ে মনোজ্ঞ লেগেছে। কী অবলীলায় ইতিহাস ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো দুই আপাত-সুদূর বিষয়কে মিলিয়ে দিয়েছেন! লেখককে প্রণাম জানাই।

ত্রিপুরার ‘জ্ঞানবিচিত্রা প্রকাশনী’ ন্যায্য মূল্যে সুন্দর সুন্দর বই পাঠকদের হাতে তুলে দিয়ে আসছেন অনেক দিন ধরে। বর্তমান পুস্তকখানি এই ধারারই এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়ে থাকবে—স্বল্প সময়ের মধ্যে একাধিক সংস্করণ তারই প্রমাণ।

দু’একটি প্রাসঙ্গিক কথা এই ধরা থাকঃ

• নিউটন-লিবনিজের দু’শ বছর পূর্বে কেরলের মাধবাচার্য কলনবিদ্যা (calculus)-র যে মৌলিক চর্চা করেছিলেন, আজকের দিনে তা তাঁকে ‘father of calculus’-এর মর্যাদা এনে দিয়েছে। ভারতীয় গণিতচর্চার এ’ এক মহৎ অধ্যায়। তাই, ‘ভাস্কর পরবর্তী মধ্যযুগের ভারতীয় গণিত’-পরিচ্ছেদে মাধব সম্বন্ধে অর্ধপৃষ্ঠা আলোচনায় মন ভরলো না।
• ভারতীয় গণিতে ইসলামী পণ্ডিতরা সম্পূর্ণ অনুল্লেখিত থেকে গেছেন। জন্মসূত্রে ভারতীয় না হলেও, ‘ভারততত্ত্ব’ ও সংস্কৃত ভাষাচর্চার ইতিহাস যেমন জোন্স বা ম্যাক্স মূলার ব্যতিরেক অসম্পূর্ণ, তেমনই, মধ্যযুগীয় ভারতীয় গণিতের আলোচনা আল বিরুনি ছাড়া হতে পারে না।

পরিশেষের ‘গ্রন্থ-সহায়িকা’-খানি হ্রস্ব কিন্তু কাজের। একটি বর্ণানুক্রমিক শব্দাবলীর তালিকা থাকলে আরও ভালো হত। প্রচ্ছদখানি ছিমছাম ও সুন্দর—পাঠককে গ্রন্থটির নিকট টানবে।

সবমিলিয়ে, দেড়শ’ পৃষ্ঠার মধ্যে অধ্যাপক চক্রবর্তীর “প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা” গ্রন্থখানি মাথায় করে রাখার মতো বই। আমাদের বিনম্র প্রণতি জানাই।



|| ‘যদুনাথ’ শোনালেন কোম্পানির গল্প ||

The East India Company: The World’s Most Powerful Corporation [‘The Story of Indian Business’: series]; Tirthankar Roy; (Series Editor Gurcharan Das); Penguin Books. First published 2012. ISBN 9780670085071

একটি নিখাদ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। সামানপত্তর কেনা এবং বেচা এবং কেনা ও বেচা—এই যাহার কাজ। ট্রেডিং কোম্পানি যারে কয়। কোনো কিছু বানানো অর্থাৎ ‘ম্যানুফ্যাকচার’ করা এর কাজ নয় (যদিও গুদামঘরগুলো তার ‘ফ্যাক্টরি’ নামেই পরিচিত ছিল)। এমনই এক কোম্পানি পৌনে তিনশ’ বচ্ছর দাপিয়ে রাজ করে গেছে আধা পৃথিবী জুড়ে, এবং পৃথিবীর অর্থনীতি রাজনীতি ও ভূগোলকে নতুন করে লিখে দিয়ে গেছে। আর তার ‘সাফল্যের’ মূলমন্ত্রটা কী ছিল? না, মুনাফালোভ ও মুনাফালোভ ও আরও মুনাফালোভ। তারজন্য ফলাও ঘুষের দুর্নীতি, যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়। ড্রাগব্যবসা করে হলেও মুনাফা চাই! আর কোন্‌সময়ে এ’কোম্পানির রমরমা? টেলিগ্রাফ-স্টিমইঞ্জিন দূরস্থান, যেকালে দ্রাঘিমাটা পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণীত হয়নি, পালতোলা জাহাজে লণ্ডন থেকে সুরাট পৌঁছতে প্রায় এক বৎসর সময় লাগত, স্কার্ভিরোগে জর্জরিত নাবিককুল!

কিন্তু এ’সকল অবিশ্বাস্য ঘটনাও আসলে সত্যি হয়েছিল। স্প্যানিশ আর্মাডাকে (১৫৮৮) অযাচিতভাবে হারিয়ে দিতে পেরে নব্য ইংরেজ ব্যবসায়িকুল তখন উৎসাহে ফুটছে। তাদের একটা দল হাজার ত্রিশেক (পরে বেড়ে হল হাজার সত্তর) পাউণ্ড চাঁদা তুলেছে, গড়েছে এক কোম্পানি, যার নাম, ‘জয়েন্ট স্টক কোম্পানি’। সুদূর পুবদেশের সমুদ্রবাণিজ্যের অগাধ ঝুঁকিকে ভাগ করে নেওয়াই এর উদ্দেশ্য। ১৬০০ খৃঃ শেষ দিনে রানি প্রথম এলিজাবেথের কাছ থেকে এনারা আদায় করে নিলেন ‘কেপের পূর্বদেশে’ একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার—‘চার্টার’, যা (১৮১৩ খৃঃ পর্যন্ত) প্রতি বিশ বছরে বছরে নবীকরণ করে নিতে হত রাজা/রনির (পরে পার্লামেন্ট-এর) কাছ থেকে। হ্যাঁ, এই হল বিশ্ব ইতিহাসের বৃহত্তম ট্রেডিং কোম্পানিঃ ‘ইংলিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি’ (১৭০৭ খৃঃ-র পর থেকে ‘বৃটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি’)—The Honourable Company! যতই গালি দাও, যতই এডমণ্ড বার্কের দল ওয়ারেন হেস্টিংসের মুণ্ডুপাত করুক, যতই ‘রেগুলেটিং এক্ট’ দিয়ে একে তাঁবে রাখার চেষ্টা হোক, অষ্টাদশ শতক থেকে যে ‘সূর্য-না-ডোবা’ বৃটিশ সাম্রাজ্যের সূচনা তার শুরুয়াৎ কিন্তু এই ‘জন কোম্পানি’-র লাভের গুড় চেটেই। এটা কে অস্বীকার করবে? অতলান্তিকের পরপারে বৃটেন যখন আমেরিকা খুইয়ে বসল, তখন এই কোম্পানিই ভারত জিতে এনে দিয়ে সিংহের দবদবা বজায় রেখে ছিল। পরে ‘পাটনা আফিম’ চিনদেশে বেচে কোম্পানির দ্বিতীয় সূর্যোদয়।

এ’সব কাহানি এক উপন্যাসের গতিতে শুনিয়েছেন লেখক শ্রীমান তীর্থঙ্কর রায়, বর্তমানে ‘লণ্ডন স্কুল অব্‌ ইকনমিক্সের’ বাণিজ্য-ইতিহাসের অধ্যাপক। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনি। ‘পেঙ্গুইন বুক্‌স্‌’ তাঁদের জনপ্রিয় ‘ভারতীয় বাণিজ্য ইতিহাস’ সিরিজে টমাস ট্রটমান (মুখবন্ধে গুরচরণ দাস নামের বানানটা ভুল লিখেছেন), স্কট লেভি, লক্ষ্মী সুহ্মমণ্যানের মত নামী ঐতিহাসিকদের পাশাপাশি ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া কোং’-পর্বটি লিখতে ডেকেছেন উদীয়মান শ্রীমান তীর্থঙ্করকে। গোগ্রাস-পাঠে আড়াইশ’ পৃষ্ঠার বইখানি নামিয়ে বোঝা গেল কী অসাধারণ মুন্সীয়ানায় তাঁর কর্তব্যখানি পালন করেছেন তীর্থঙ্কর। স্যর যদুনাথের ‘আওরঙজেব’ মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার, এই লেখা পড়তে পড়তে। স্কুলপাঠ্যে “পলাশির যুদ্ধে মিরজাফরের বেইমানির ফলে ক্লাইভ সিরাজকে হারাইলেন,” বা, “১৭৬৫ খৃঃ কোম্পানির দেওয়ানি লাভ হইল”--জাতীয় গোলগোল বাক্য পড়তে অভ্যস্ত আমরা কদাচিৎ তার পিছনের গল্পগুলো খুঁজতে যাই। তীর্থঙ্কর কিন্তু প্রথমেই গোড়ানাড়া দুটি প্রশ্ন দিয়ে লেখা শুরু করেছেনঃ (১) এই কোম্পানির ‘উদ্ভবের’ আসল স্বরূপটা কী, যার মধ্যেই কিনা গুটিয়ে ছিল তার ভবিষ্যতের ডানামেলা; ও (২) ‘সংজ্ঞা’ কি এই কোম্পানির? আসলে কেমন একটা কোম্পানি ছিল এটা, ব্যবসা করতে যাকে নিরন্তর যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে? পরের দু-শ’ পাতায় পরতে পরতে খুলতে লেগেছে এ’ যাদুকোম্পানির পাঁচালি।

মস্ত বড় ক্যানভাস এর। ১৬০১-এ ল্যাঙ্কাস্টারের প্রথম সমুদ্রযাত্রায় ব্যান্টামে (ইন্দোনেশিয়া) ঠোক্কর ডাচ কোম্পানির সঙ্গে, মরিচব্যবসার বাঁটোয়ারা নিয়ে। এরপর জাহাঙ্গিরের দরবারে উইলিয়ম হকিন্স (১৬০৮ খৃঃ) ও স্যর টমাস রো (১৬১৫ খৃঃ)। কোম্পানির লাভের বহরে রাজার চক্ষু ছানাবড়া ও ১৬৩৫-এ নয়া এক ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির চার্টার প্রদান (ও ১৬৫৫-এ তার মিশে যাওয়া পুরনোটার সঙ্গে)। ডে-অক্সেণ্ডেন-চার্নকের মত তুখোড় অফিসারদের হাতে মাদ্রাজ-বোম্বাই-কলিকাতা নগরীর পত্তন (এই ক্রমে)....থেকে বকলমে সোনারখনি বাঙলাদেশের মসনদে! এই প্রথম মসীর রূপান্তর অসি-তে। তারপর কোম্পানির দেওয়ানিলাভের মত অবিশ্বাস্য ঘটনা (১৭৬৫ খৃঃ)! ভাবা যায়, যে কোনও মুনাফালোটা কোম্পানি এক রাজ্যের সরকারি খাজানার অধিকারি হয়ে বসেছে? কিশোর বিয়ানিকে লর্ড ক্লাইভ ভাবতে পারেন? তাই হত, যদি ট্রেডিং কোং ‘বিগ বাজার’ আজ, ধরা যাক, মহারাষ্ট্রের অর্থদফতরের মালিক হয়ে বসত!!

দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা, অচেনা-অজানা দেশ, নানা রোগভোগ-যুদ্ধবিগ্রহ শেষে, গড়ে, কোম্পানির ৫০% সার্ভেন্ট বেঁচে ফিরত দেশে। নিউব্লাড আমদানি করতে তাই কোম্পানিকে তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য করতে দিতে হত, কারণ নৈলে ওই স্বল্প বেতনে তাদের পড়তায় পোষাতো না। এই ব্যক্তিগত বাণিজ্য চিরকাল কোম্পানির এক শিরঃপীড়ার কারণ থেকে গিয়েছিল। সিরাজের সঙ্গে তাদের বিবাদও এই নিয়েই—কোম্পানির পাওয়া ফারমান কে শিখণ্ডি করে ক্লাইভ ও তার সাঙ্গপাঙ্গের দল নবাবের প্রাপ্য শুল্ক ফাঁকি দিয়ে নিজ নিজ জেব স্ফীত করছিল। চমৎকারভাবে এই মূল সমস্যাটার আলোচনা করেছেন লেখক। আবার এই একচেটিয়া ব্যবসার বিরোধিতা যে বৃটেনেই শুরু হয়, স্মিথের ‘ওয়েলথ অব্‌ দ্য নেশনস্‌’ যে তার জ্বলন্ত প্রতিবাদ—এ’প্রসঙ্গও চমৎকারভাবে আলোচিত। কোন্‌টা নয়? গল্পগুলো? টমাস রো’র উপঢৌকনের চারটে আইরিশ হাউণ্ড সম্মুখসমরে এক হাতিকে নাস্তানাবুদ করল। তাতে এতই মশগুল বাদশাহ্‌ জাহাঙ্গির যে কোথায় পড়ে রইল হিরেমোতির উপহার! আর হেস্টিংসের পান্তাভাত ও ঘুসোচিংড়ির ঝোল খাওয়ার গল্পটা? এই খেয়েই না ভাবী গভর্নর-জেনারেল তাঁর বশংবদ কান্তবাবুর গৃহে লুকিয়ে ছিলেন মির কাসেমের সঙ্গে বিবাদকালে। পরে উনি পান্তার বড্ড ভক্ত হয়ে পড়েন!

দু’একটা প্রসঙ্গ সসংকোচ তুলতে চাইবঃ

যোগাযোগ-ব্যবস্থাঃ যেকালে ইংল্যাণ্ড থেকে ভারত আসতে কম করে ছয় মাস সময় লাগত। কোম্পানির লণ্ডন হেড কোয়ার্টার্স আধা পৃথিবী ঘুরে তার কন্ট্রোলটা তবে বজায় রাখত কী করে? প্রতি বুধবারের ‘কোর্ট অব্‌ ডিরেক্টর্স’-এর মিটিঙের ফরমান ভারতে এসে পৌঁছত কী ভাবে ও কত তাড়াতাড়ি? সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ‘সিক্রেট কমিটি’ কীভাবে তার ছড়িটা ঘোরাতো? উদা. (পৃঃ ১৫৮) ১৭৪৬ খৃঃ দুপ্লের মারে ইংরেজদের মাদ্রাজ ছেড়ে পলায়ন। আবার যেই ইউরোপে বৃটিশ-ফ্রেঞ্চ শান্তি স্থাপন হয়ে গেল মাদ্রাজ ফিরে পেল ইংরেজরা। এত দ্রুত খবর এসে পৌঁছল কী করে? ইংল্যাণ্ড-ভারত কি প্রতি দিন একাধিক জাহাজ চলাচল করত? P & O Steam Navigation Company–র কাল কিন্তু তখনও আসেনি।
মোড়কঃ বাঙলার পাটের ব্যবসা তো তখনও বহুদূরে। ‘পাটনা আফিম’, ‘সোরা’ বা ‘ক্যালিকো’-র প্যাকেজিং হত কীভাবে জানার ইচ্ছে রয়ে গেল।
• শেষের ‘সময়সারণী’-তে (পৃঃ ২২৬) যে Banking panic in Calcutta (1833)-র উল্লেখ, মূলপাঠে তার হদিশ পাইনি।

***

বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কলকাতায় তখন সবে রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে। রেশন কার্ড না করালে অন্ন জুটবে না। অতএব ঠিক্কর দুপুরে এক নিরীহ অধ্যাপককে রেশন দোকানে ধরনা দিতে হয়েছে। তাঁর নামলেখা দেখে খেঁকিয়ে উঠল দোকানি, ‘বুড়ো হয়েছেন, নামের আগে Sri বানানটাও ঠিক করে লিখতে শেখেননি?’

একবার দেখে নিয়ে ধীরে বলেন বৃদ্ধ, ‘আজ্ঞে না, বানান ভুল করিনি। ওটা Sri নয়, Sir-ই হবে। আমি Sir Jadu Nath Sarkar !’

এমনই অমায়িক ছিলেন সেই জ্ঞানতাপস, দেশকে আধুনিক ইতিহাস পড়তে শিখিয়েছিলেন যিনি। আমাদের আজকের ঐতিহাসিকও কালে সেই দর্জা পাবেন—সন্দেহ রাখিনা।



|| না, কোনো অভিমান নেই। আজও ঠিকানার সন্ধানে.... ||

ঠিকানাঃ কলকাতা’ ; সুনীল মুন্সী; প্রথম প্রকাশ ১৯৭৪; ‘থীমা’ প্রকাশন ২০১০; ISBN 978-81-86017-75-3

একটা শহরের ক’টা ঠিকানা থাকতে পারে? না, বলা ভুল হল, ‘শহরের’ নয়, ‘শহরে’। দামাস্কাস, রোম বা বারাণসীর মত প্রাচীন শহরের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কলকাতা-বোম্বাইয়ের মত অর্বাচীন শহরে?

কোনো একটা শহরের ইতিকথা বড় কম কথা নয়। ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় মর্মব্যথা খোঁজার লোক না হয় মেলা ভার হয়, তবু কেবল ইটের ঘরের ঠিকানার সন্ধানও কি কম? শুধু ঘর কেন, পথ-ঘাট বাগিচা-সমাধি-শ্মশান—কোথায় ছড়িয়ে নেই শহরের ঠিকানা? বৌবাজারের যে বটগাছতলায় বসে চার্নক হুঁকো টানতেন, বা আলিপুরের যে ‘খুনি’ গাছের নিচে ফিলিপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে ওয়ারেন হেস্টিংসের ডুয়েল হয়েছিল—সে-সবের ঠিকানা পোস্টওয়ালারা লিখে রাখেনি।

না, এ’হেন ঝাপসা ঠিকানা নয়, কলকাতা শহরের ঐতিহাসিক ৩৭টি ঠিকানার গল্প শুনিয়েছেন প্রখ্যাত ভৌগোলিক শ্রীসুনীল মুন্সী মহাশয়। শোনানোর গুণে ভূগোল-ইতিহাস-রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ওনাকে অনেকে প্রখ্যাত চক্ষুবিশেষজ্ঞ নীহার মুন্সীর অনুজ হিসেবে জানেন, তো কেউ ভারতের প্রথম(?) বাঙালি মহিলা-সাংবাদিক বিদ্যা মুন্সির স্বামী হিসেবে। আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজের নামজাদা ভূগোল-অধ্যাপক হিসেবে দেখেছি। তাঁর এই লেখাগুলি কোথাও লুপ্তপ্রায় হয়েছিল। শমীকবাবুর ‘থীমা’-প্রকাশনী বহু যত্নে হালে তার পুনর্মুদ্রণ করে আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। বিদ্যাসাগর মশায়ের উদ্যোগে যে বাড়িতে প্রথম বিধবা-বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল (৪৮ কৈলাস বোস স্ট্রিট); মেডিক্যাল কলেজের বিপরীতে যে বাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্র থাকতেন (৬ প্রতাপ চ্যাটার্জি লেন); ৬ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীটের ‘সঞ্জীবনী’-সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্রের যে বাড়ি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল (শ্রী অরবিন্দ ও গান্ধীজী যে-বাড়িকে ‘তীর্থক্ষেত্রের’ দর্জা দিতেন); বা চিৎপুরের যে বাড়িতে প্রথম ‘নীলদর্পণ’ অভিনীত হয় (মল্লিকবাড়ি চিৎপুর)—সে-সে-সব ঠিকানার গল্প হালকা তুলির কয়েক টানে তিন-তিন চার-চার পাতার মধ্যে শুনিয়ে গেছেন শ্রীমুন্সী। বলার ধরনে, দেড়শ’ পাতার বইখানি এক নিঃশ্বাসে শেষ না করে ওঠার উপায় নেই। আর কত কত না ঠিকানার গল্প উঠে এসেছেঃ প্রথম বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠা থেকে প্রথম বেতারকেন্দ্র স্থাপন থেকে মুরারিপুকুর বোমার মামলা থেকে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার প্রকাশ। কৃশকলেবর কেতাবখানি কলকাতার ‘বায়োডেটা’ প্রায়।

প্রায়! কারণ খোঁজ তো আরও কত ছিলঃ বড়বাজার অঞ্চলের যে গুরদ্বারে গুরু তেগবাহাদুরের পদরজ পড়েছিল বলে প্রবাদ; বা কলিঙ্গায় (ওয়েলেসলি স্কোয়ার) উঠে আসার আগে বৌবাজারের যেখানে ‘কলিকাতা মাদ্রাসা’-র স্থাপনা হয়; বা সিংহল থেকে এসে ১৮৯১-এ যেখানে আঙ্গরিক ধর্মপাল ‘মহাবোধি সোসাইটি’-র স্থাপনা করেন; বা ৮৬এ লোয়ার সার্কুলার রোডের যে-বাড়িতে বেগম রোকেয়া ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’-এর প্রথম অধিবেশন ডাকেন—সে-সব তো তীর্থক্ষেত্র। আসলে, ‘কলকাতা’ বলতেই বর্ণহিন্দুরা এক অদৃশ্য গণ্ডি টেনে ফেলেন—তার বাইরেটা যেন আর কলকাতা নয়। নৈলে, সিমলা বাজারের যে বাড়ি ভাড়া করে আসাদুল্লাহ্‌খাঁ সাহেব (‘ঘালিব’) তিন বছর ভাড়া ছিলেন, তার মহত্ব কি বৃটিশ কম্যুনিস্ট নেতা ফিলিপ স্প্র্যাটের ডেরার চেয়ে কম? ‘মোহনবাগান ভিলা’-র ঠিকানাও খুঁজছিলু্ম। নেই। বস্তুতঃ, কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে কোনো-না-কোনো ভাবে জড়িত ঠিকানাগুলি এ’বইতে বড্ড বেশি ঠাঁই পেয়েছে , সেটা স্যরের আকৈশোর পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলেই নিশ্চয়।

সঙ্গের স্কেচগুলি লেখককৃত। ডেসমণ্ড ডইগ বা রথীন মিত্রের মত পেশাদারদের সঙ্গে তুলনা টেনে ফেলা রুখেও বলি, অনেকগুলিতেই চেনা বাড়িও অচেনা লেগেছে। বৃটিশ কম্যুনিস্ট নেতা (ও মিরাট ষড়যন্ত্রের অন্যতম ‘আসামি’) ফিলিপ স্প্র্যাটকে কেম্ব্রিজের ফিজিক্স ট্রাইপোস লেখা হয়েছে, উনি কিন্তু ম্যাথসের ট্রাইপোস ছিলেন। শেষে ‘সংযোজন’-এর সাক্ষাৎকারটি যেন একটু বেশিই ব্যক্তিগত (বা, পারিবারিক), তবু মনোজ্ঞ।

ছিমছাম বইখানি হাতে তুলে নিলে মন ভালো হয়ে যায়। অজয় গুপ্তকৃত প্রচ্ছদখানির মান, ঐ দেখুন, তুলনা মেলা ভার। অসাধারণ!!

আসলে, কোনো শহরের অনেক ঠিকানা থাকে না। ‘মিছিলের মুখে’র মত প্রতি শহরের ঠিকানা একটিই আছে। সে ঠিকানা, অবশ্য, খুঁজে পাওয়া সহজসাধ্য নয়। তাতে অভিমান করলে চলবে কেন?



(পরবাস-৫১, জুন-জুলাই, ২০১২)