কুমার সপ্তাশ্ববাহন! তোমাকে প্রথম কৈশোরে শেষ দেখেছিলাম। আজ এতদিন পরে, যখন তুমি কৈশোর এবং তারুণ্য অতিক্রম ক'রে যৌবনে পদার্পণ করেছ, তখন দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। তুমি পিতার মতোই রূপবান, সুদেহী। - বললেন মহারাজ পদ্মনাভ। তোমাকে দেখলে সহসা মহারাজ অনঙ্গদেব বলে ভ্রম হয়। আশা করি তুমি পিতার ন্যায় বিচক্ষণ, বীর এবং ন্যায়পরায়ণও হয়েছো।
- রাজন্যদেব! লজ্জিত কুমার বললেন - আপনার ঈষৎ বিভ্রম উপস্থিত হয়েছে। আমি এখনও পিতার অপেক্ষা দৈর্ঘ্যে বিতস্তিপ্রমাণ ন্যূন। বিচক্ষণতা, বীরত্ব এবং ন্যায়পরায়ণতা বিষয়ে পিতাই আমার আদর্শ। পিতার মুখে আপনার যে-সব কীর্তি সংক্ষেপে আসার সময় শুনে এসেছি, তাতে এখন আপনিও আমার পিতা এবং মাতার সঙ্গে আমার নিকট তুল্য শ্রদ্ধেয়।
- শুনে সুখী হলাম। কিন্তু ধনুর্বিদ্যায় তোমার পিতার অলৌকিক অধিকার। ঐ বিদ্যায় আমারও নিতান্ত অখ্যাতি নেই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারিনা।
- পিতা বলে দিয়েছেন, 'মহারাজ পদ্মনাভ নিতান্ত বিনয়ী। নিজের অসামান্য গুণাবলী সর্বদাই আবৃত করে রাখেন। তাঁর কাছে চক্র ও গদাচালনা বিষয়ক উপদেশ প্রার্থনা করবে। চক্র ও গদায় তাঁর সিদ্ধি প্রবাদপ্রতিম। তিনি আমার অপেক্ষা বয়সে কিছু ঊন হলেও এজন্য তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি।'
পদ্মনাভ হাসলেন - তিনি আমার প্রতি আনুকূল্যবশতঃ যা কিছু বলেছেন, তার যথার্থ বিবেচনা করা যাবে যদি পরস্ব অপহারক দানব অসভ্যভাবে তোমার ক্ষতিসাধন করার উদ্যম করে। এই যাত্রা তোমার একার। কিন্তু যদি মহারাজ অনঙ্গদেব এবং মহারাণী নীলিমাকে যুদ্ধযাত্রা করতে হয়; পদ্মনাভপুরের রণনিপুণ চমূ, যার পুরোভাগে থাকবেন মহারাজ পদ্মনাভ এবং মহারাণী কমলা - তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে।
কুমারের দুই চক্ষু প্রদীপ্ত হয়ে উঠলো - আর্য! মার্জনা করবেন। পিতৃদেব এবং মাতৃদেবী যেমন আপনার চক্র ও গদা বিষয়ক সিদ্ধি এবং প্রজারঞ্জকতা বিষয়ে আমায় অবহিত করেছেন, তেমনই মহারাণী কমলার চিত্রকলায়, শঙ্খবাদনে এবং প্রজারঞ্জকতায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর সংবাদও দিয়েছেন। একথাও আমি তাঁদের মাধ্যমে জ্ঞাত হয়েছি যে দেবী কমলা বীরাঙ্গনা বটেন। কিন্তু কিসে তাঁর বিশেষ অধিকার, সেকথা বিশদভাবে জানার অবকাশ ছিল না। আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করুন, যদি তা অশোভন না হয়।
- রথচালনায়। - উদ্ভাসিত মুখে বললেন পদ্মনাভ। এছাড়া তাঁর প্রিয় অস্ত্রপাশ। শঙ্খবাদনের কথা শুনেইছো। মঙ্গলশঙ্খের বাদনে যেমন কল্যাণশব্দে অন্তঃপুর পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, রণ বিজয়শঙ্খের নিনাদে তেমন অরাতির অন্তরে ত্রাসের সঞ্চার হয়, সে হীনবল হয়ে পড়ে। চক্রচালনাতেও তিনি অদ্বিতীয়া কিন্তু হনন না করে বন্ধনে বাঁধাই তাঁর অভিপ্রেত মনে হয় বলে অধিকাংশ সময়ই তিনি পাশ প্রয়োগের পক্ষপাতী। মহারাণী অন্তঃপুরে তোমার প্রতীক্ষায় আছেন।
চলো, আমরা যাই।
মহারাণী কমলাকে প্রণাম করে কুমার যখন উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর দুই চক্ষু বন্দনাগান গেয়ে উঠলো। মহারাজ পদ্মনাভকে পিতৃসদৃশ মনে হয়েছিল। এখন এই দেবীমূর্তি মাতৃপ্রতিমা হয়ে তাঁর সমস্ত অন্তরকে মথিত করে তুললো। তাঁর ললাট চুম্বন করে সস্নেহে বললেন কমলা - কী হল পুত্র! তোমার দুই নয়নে বাষ্প কেন?
কুমার চক্ষুমার্জনা করে বললেন - মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
কমলা বললেন - বৎস! আমি যে কবে থেকে তোমার মা হয়ে গিয়েছি। শুধু অনুষ্ঠানটুকু বাকি। তারও তো সময় সমাগত হয়েছিল। সহসা এ কী বজ্রপাত!
কুমার বললেন - বজ্রপাতই বটে! তবে মনে হয় এই বজ্র এখনো কাউকে হত বা আহত করেনি। - বলতে বলতে বীরদর্প এবং রোষে তাঁর সর্বাঙ্গ তরুণ সূর্যের মতো দীপ্ত হয়ে উঠলো - যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলেই দানবরাজ্যের মঙ্গল, নচেৎ ...
কোষবদ্ধ অসিতে অজান্তেই ঝনৎকার তুললেন।
পদ্মনাভ এবং কমলা প্রীত চক্ষে কুমারকে অবলোকন করলেন। কমলা বললেন - আমরাও উভয়েই তোমার মতোই মনে করছি। নতুবা একমাত্র সন্তান অপহৃতা, আমাদের ধৈর্য বজায় রাখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু কন্যার শয়নকক্ষে প্রাপ্ত লিপিখানির শিল্পসৌকর্য এবং দর্পিত ভাষণের ঋজুতা ও সারল্য আমাদের আশ্বস্ত করেছে। যার এতখানি রুচিবোধ সে কোনো হীন কাজে প্রবৃত্ত হবে না নিশ্চয়।
একটু থামলেন কমলা - অন্যদিকে তার কৌশলী বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। সদাজাগ্রত বিশ্বস্ত রণদক্ষপ্রহরীবেষ্টিত এই পুরী। প্রকাশ্য দিবালোকে না হোক, দিবাবসানের মধ্যে সে কন্যাকে হরণ করে নিয়ে গেল অথচ কেউ জানতে পারলো না! এ যে কী করে সম্ভব!
কুমার নতমুখে চিন্তা করতে লাগলেন। তাঁর মুখাবয়বে ললাটে চিন্তার বিদ্যুৎ খেলা করে যেতে লাগলো। পদ্মনাভ বললেন - এখন তোমার কী অভিপ্রায়?
কুমার বললেন - রজনী আগতপ্রায়। সারারাত্রি বিশ্রামান্তে ঊষাকালে যাত্রা। নির্দিষ্টলক্ষ্যে পৌঁছোতে আমার কী পর্যন্ত সময় লাগতে পারে সে সম্পর্কে আমায় যদি অবহিত করেন।
পদ্মনাভ বললেন - কুমার অনঙ্গপুরীর রাজধানী, বিশেষত রাজপুরী হতে পদ্মনাভপুরের রাজধানী, বিশেষতঃ রাজভবন - সপ্তযোজন দূর। অপরদিকে পদ্মনাভপুর হতে ঐ মেঘাবৃত পর্বতশীর্ষ একুশ যোজন দূর। আমাদের রাজধানীর পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে জনবসতি আছে। কিন্তু উত্তর দিকে লোকবসতি নেই। আছে রাজকীয় উপবন। এই উপবন পঞ্চযোজন বিস্তৃত। এরপর এক যোজন বিস্তৃত মালভূমি। তারপর একযোজন বিস্তৃত খরস্রোতা নদী। নদীর অপরপারে সপ্তযোজন গহন অরণ্য। অরণ্য শেষ হয়েছে ঐ মেঘশীর্ষ পর্বতমালার পাদদেশে। সেখান হতে অরণ্যশীর্ষ অতিক্রমণকারী সুউচ্চ বন্ধুর পথ শেষ সপ্তযোজন।
কুমার মনে মনে সমস্ত পর্যালোচনা করে বললেন তাহলে প্রথম পাঁচযোজন নিরাপদ এবং নয়নাভিরাম পথ। দ্বিতীয় একযোজন মালভূমি?
পদ্মনাভ বললেন - কিছু আরণ্যক এবং পার্বত্যপ্রাণী ভিন্ন যেমন - শশক, মৃগ, শাখামৃগ, শৃগাল, চিত্রক--অন্য উৎপাত নেই।
- তৃতীয় একযোজন নদী?
- বিভিন্ন প্রজাতির রসনা অথবা নয়নরঞ্জন মৎস্যকুল বাদে একমাত্র জলচর প্রাণী - শিশুমার। তবে নদী নিতান্ত খরস্রোতা। কিয়ৎদূর অন্তর অন্তর ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দ্বীপভূমি আছে। যার কোনোটি উপলময়। কোনোটি শষ্পাচ্ছাদিত এবং প্রায় সব কয়টিতেই অল্পবিস্তর বৃক্ষলতাদি আছে।
কুমার! পরবর্তী সপ্তযোজন অরণ্য এবং শেষ সপ্তযোজন পর্বতারোহী পথ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অনুমান-নির্ভর। দানব এবং মানব রূপকথা ও তৎপূর্ববর্তী কাল থেকেই পরস্পর মিত্রতাহীন। সে-কারণে যুদ্ধবিগ্রহ হতে হতে উভয়পক্ষই সম্ভবতঃ ক্লান্ত এবং বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। দানবেরা সম্ভবতঃ অরণ্য এবং পর্বতের নিঃসপত্ন অধিকার আয়ত্তে রেখে এতপথ অতিক্রমণের শ্রম এবং মনুষ্যহিংসা ত্যাগ করে। মানবেরা সন্ত্রস্ত এবং অত্যাচারিত না হবার জন্য নদীর এই কূল পর্যন্তই তাদের গতাগতি সীমাবদ্ধ রাখে। নদী তাই দুই বিপরীতস্বভাব গোষ্ঠীর মধ্যে আবহমান কাল বহমান।
ক্ষণকাল মৌন থেকে পদ্মনাভ বললেন - মহারাজ অনঙ্গদেব লিখেছেন তুমি শস্ত্রমাত্র সম্বল হয়ে একাকী দানব রাজ্যে প্রবেশ করতে চাও। কিন্তু অজ্ঞ-স্বভাব প্রতিপক্ষের সততার উপর ভরসা করে এই প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ কতদূর সমীচীন?
- ক্ষত্রিয় মৃত্যুভয় করে না। রাজন! অপরপক্ষে অপযশের ভয় তার প্রবল। আমাকে একাকী যেতে বলা হয়েছে। এর সঙ্গে সাহসিকতার সম্বন্ধ আছে, সেকথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি সসৈন্যে গেলে প্রথমেই উপহাসের পাত্র হব। তাতে রাজকন্যার ক্ষতিরও আশংকা থেকে যায়।
কমলা বললেন পৌরাণিক সময় থেকে দৈত্য-দানবেরা কন্যাহরণ করছে। এই কাজে রাজ্য বা পুরী ধ্বংস হয়েছে, লোকালয় শ্মশান হয়েছে। কিন্তু লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী কখনো এমন বলে না যে কন্যার কোনো ক্ষতিসাধন হয়েছে। বরং তাদের পুরীতে দীর্ঘদিন অবস্থানের ফলে সে তাদের দুর্বলতাগুলি অবগত হওয়ার সুযোগপ্রাপ্ত হয়ে পরবর্তীকালে গোপনে অভিযানকারী রাজপুত্রদের সাহায্যে তাদেরই ক্ষতি এমনকি বিনাশের কারণ হয়েছে।
রাজপুত্র ক্ষণকাল মৌন থাকলেন। নীরব চিন্তার শেষে বললেন - প্রত্যূষে যাত্রা করবো আমি। শুভকার্যে কালহরণ কর্তব্য নয়।
একটি ক্ষুদ্র জম্বুবৃক্ষের ছায়ায় বসলেন রাজপুত্র। কটিবন্ধ হতে লম্বমান দানবপতির লিপিখানি মোচন করে মুগ্ধ মনোযোগে দেখতে লাগলেন - একবার সৃষ্টির সেই অপরূপ শোভা আর একবার দানবকৃত অনুকৃতি। পট দুখানি লক্ষ্য করতে করতে অস্ফুটে আবৃত্তি করলেন - 'যদি সাহস থাকে, থাকে মেধা, বুদ্ধি, বিবেচনা, বোধ ...' সহসা চোখদুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তাঁর। অদূরে শিলাময় এক গহ্বরে বৃষ্টিবারি সঞ্চিত হয়ে একটি প্রাকৃতিক কুণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল, লিপিখানি নিয়ে সাবধানে তার একটি অংশ নিমজ্জিত করলেন সলিলে। অল্প সময় পরে তুলে নিশ্চিত হলেন - লিপি অবিকৃত। তারপর সমগ্র পটখানি সলিলে নিমজ্জিত করে কিয়ৎক্ষণ পরে তুলে বিস্তৃত করে ধরলেন এবং ধরেই রাখলেন কিছুক্ষণ। শেষে শিরশ্চালন করে পটটি সূর্যালোকে আস্তৃত করে দিলেন এক প্রশস্ত সমতল শিলাখণ্ডে। অশ্বপৃষ্ঠ হতে নামিয়ে আনলেন উপবন হতে আহরিত ফলের রাশি। ক্ষুধার শান্তিবিধানে মনোনিবেশ করলেন।
বেশ কিছু সময় অতিক্রান্ত হল। সমস্ত ফল নিঃশেষ করে কুণ্ডের জলে হস্তপ্রক্ষালন করলেন। উত্তরীয়ে মার্জনা করলেন হস্ত। তারপর এগিয়ে এসে চিত্রলিপিখানি তুলে নিয়েই আত্মহারা হয়ে গেলেন। গাঢ় কণ্ঠে বললেন - ধন্য! ধন্য!!
সূর্যকিরণের ক্রমাগত তাপবর্ষণ চিত্রলিপির পটখানির আর্দ্রতাই হরণ করেনি, রহস্যময় কোনো রঞ্জনদ্রব্যের উপর ক্রিয়া করে স্বর্ণরেখায় ফুটিয়ে তুলেছে মেঘমণ্ডিত গিরির কোলে সুবর্ণবর্ণ দানবপুরী। পুরী হতে সুবর্ণপথ গিরিপথ, বনপথ হয়ে নদীর অপরপারে একটি নির্দিষ্ট অবতরণ স্থানকে নির্দেশ করছে। চিত্রে যোজন বিস্তৃত নদীবক্ষে যে সব দ্বীপ-উপদ্বীপ চিত্রিত তার মধ্যে সাতটি সুবর্ণবর্ণ ধারণ করে সংকেত করছে গতিপথ। এই কূলের নিকটবর্তী সুবর্ণদ্বীপটি ভূচিত্রে সূর্যালোকিত মরকতখণ্ড হয়ে আহ্বান করছে রাজপুত্রকে।
রাজপুত্র দূরে সঞ্চরমান বাহনকে আবাহন করলেন। অস্ত্রাদি যথাযথ দৃঢ়বন্ধনে শরীরের সাথে যুক্ত আছে কিনা পরীক্ষা করলেন। অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে নদীতীর পর্যন্ত এসে একবার থামলেন। লিপিখানি বিস্তৃত করে মানচিত্র ও নিসর্গচিত্রকে মিলিয়ে নিলেন কয়েকবার। তারপর লিপিপট বিন্যস্ত করে যথাস্থানে রক্ষা করে অশ্বকে চালনা করলেন জলে। অশ্ব তাঁকে নিয়ে সাঁতার কেটে চলল।
সমস্ত দিন অতিক্রান্ত হলো নদী অতিক্রম করতে। সুবর্ণ সপ্তদ্বীপ বিশ্রাম দিয়েছে রাজপুত্রকে। মধ্যপথ অতিক্রমণের পর এক দ্বীপে ভল্লের সাহায্যে বিশালকায় মৎস্যশিকার করে অরণির সাহায্যে শুষ্ক পত্রে শাখায় অগ্নি সৃজন করে অগ্নিপক্ক মৎস্যে জঠরাগ্নি নির্বাপিত করেছেন।
সপ্তম দ্বীপটি হতে অবতরণ স্থান পর্যন্ত অতিক্রম করতে সময় লাগল সর্বাধিক। প্রথমতঃ এই দূরত্বটিই সর্বাধিক, দ্বিতীয়তঃ দীর্ঘপথ ও সময় ক্রমাগত সন্তরণ করে তাঁর বাহনটি শ্রান্ত এবং বলহীন হয়ে পড়েছিল। তীরভূমিতে পৌঁছে সে ভেঙে পড়ল একেবারে। কুমার দেখলেন অদূরে নিবিড় অরণ্য। সন্ধ্যা আগতপ্রায়। একটি মহাবৃক্ষ লক্ষ্য করে তিনি অগ্রসর হলেন। অশ্বকে বন্ধন করলেন কাণ্ডে। আরোহণ করলেন সুউচ্চ শাখায়। উত্তরীয় দ্বারা নিজেকে উত্তমরূপে বন্ধন করে নিম্নে যখন দৃষ্টিপাত করলেন, দেখলেন শাখা প্রশাখায় দৃষ্টি আচ্ছন্ন। সুবিশাল শ্বেত অশ্বও দৃষ্টিগোচর হয়না। দেখতে দেখতে নিবিড় অন্ধকারে চারিদিক সমাচ্ছন্ন হল। রাজপুত্রও নিদ্রাভিভূত হলেন।
গভীর রাত্রিতে নিদ্রাভঙ্গ হল সিংহগর্জনে। অন্ধকারে দৃষ্টি চলে না। তবু বোধ হল মহীরুহের তলদেশে কিছু একটা আলোড়ন চলেছে। তবে কি প্রিয় অশ্বকে সিংহ আক্রমণ করেছে? ভাবতে ভাবতেই অশ্বের রুদ্ধকণ্ঠ আহ্বান কানে এল। রাজপুত্র ত্বরিত বেগে ধনুর জন্য হস্তপ্রসারিত করেই থমকে গেলেন। দৃষ্টি রুদ্ধ হলেও শব্দভেদী বাণ মারা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সে বাণ পথ পাবে না। ওঠার সময়ই তো লক্ষ্য করেছেন - বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা তাঁর আর অশ্বের মধ্যে আড়াল তৈরি করেছে। ধনু আকর্ণ আকর্ষণ করলে বাণ পত্রশাখা ছেদন করে লক্ষ্যে পৌঁছোবে, কিন্তু তার সে গতিবেগ থাকবে না। সিংহ আহত হবে, নিহত হবে না। ভাবতে ভাবতেই পুনরায় শুনতে পেলেন সিংহনাদ। তারপর মৃদু আলোড়ন ক্রমশঃ ঘনপত্রাচ্ছন্ন বনমধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। রাজপুত্রের অন্তঃকরণ বিষাদে পূর্ণ হয়ে গেল। অনুমান করলেন সিংহ অশ্বকে আয়ত্ব করে নিবিড় বনমধ্যে আকর্ষণ করে নিয়ে গেল। অসহায় ক্রোধে তাঁর দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ হল। এখন আর করণীয় কিছু নেই।
অবশিষ্ট রাত্রিটুকু কেটে গেল কোনোরকমে। ঊষার আবির্ভাব হবার বেশ কিছু পরে রাজপুত্র নেমে এলেন বৃক্ষের আশ্রয় ত্যাগ করে। অসময়ে জাগরণের ক্লান্তি দূর করলেন প্রক্ষালনে, স্নানে। তারপর সুসজ্জিত হয়ে অগ্রসর হলেন বনের দিকে।
প্রায় দুই যোজন পথ অতিক্রম করার পর রাজপুত্র থামলেন। শ্রমে তাঁর সর্বাঙ্গ তপ্ত হয়ে উঠেছে। ঘন পত্রান্তরাল থাকায় প্রখর হয়ে রৌদ্র তাঁকে দগ্ধ করতে পারেনি। কিন্তু গুরুভার অস্ত্ররাজি বহন করে পদব্রজে এতখানি দূরত্ব অতিক্রম তাঁর ব্যায়ামপুষ্ট তনুকেও ক্লান্ত করেছে। রাজপুত্র লিপিমানচিত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন তিনি বিশেষ একটি স্থানে এসে পৌঁছেছেন। লিপি যথাস্থানে রক্ষা ক'রে চতুর্দিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করতে চোখে পড়লো প্রচুর ফলবান বৃক্ষ। আম্র, জম্বু, পনস, কদলী। ইচ্ছামতো ফলাহার করলেন। প্রাকৃতিক কুণ্ড থেকে স্বচ্ছ জল পান করে তৃণশয্যায় দেহ এলিয়ে দিলেন। নির্জন বলে মৃদুমন্দ বায়ু আর পাখির কূজনে তাঁর নিদ্রাকর্ষণ হচ্ছিল। কিন্তু আলস্য ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বৃক্ষতলে নিদ্রা যাওয়া নিরাপদ নয়। দিবাভাগে হিংস্র জন্তুর আক্রমণ সচরাচর ঘটতে দেখা যায়না, তবু। তাছাড়া সপ্তযোজন অরণ্যের মধ্যে মাত্র দুইযোজন অতিক্রম করা গিয়েছে। অতএব ...
রাজপুত্র আবার অগ্রসর হলেন। অতিক্রান্ত হল আরও এক যোজন। ইতিমধ্যে সূর্যরশ্মি, যা বৃক্ষশীর্ষ ভেদ করে ইতস্ততঃ মাটিতে এসে পড়ছিল, শীর্ষত্যাগ করে পার্শ্বদেশ থেকে তির্যকভাবে আসতে শুরু করেছে। ফলে ভূমিসংলগ্ন অঞ্চল ছায়াচ্ছন্ন হতে আরম্ভ করেছে। রাজপুত্র যথাসম্ভব দ্রুত পদক্ষেপে অতিক্রম করলেন আরো অর্ধযোজন। এতক্ষণে সূর্য অস্তমিতপ্রায়।
কুমার এইবার ক্ষান্ত দিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে চতুর্দিক নিরীক্ষণ করলেন। অরণ্য এইখানে অপেক্ষাকৃত বিরল। বহুদূর বিস্তৃত তৃণভূমির মধ্যে একটিমাত্র মহামহীরুহ অরণ্যশীর্ষ অতিক্রম করে মাথা তুলেছে। রাজপুত্রকে দেখে চিত্রল মৃগের একটি দল অবাক চোখে চেয়ে আছে তৃণভূমির শেষপ্রান্ত হতে। কুমার ধনুতে শরযোজনা করলেন অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী একটি মৃগকে লক্ষ্য করে। কিন্তু তার চোখ দুটি চোখে পড়তে শরক্ষেপ করতে পারলেন না। ফলের সন্ধানে আশেপাশে দৃষ্টিপাত করলেন। একটিমাত্র নারিকেলবৃক্ষের শীর্ষে গুটিকতক ফল চোখে পড়লো। এই বৃক্ষে আরোহণ করার বিদ্যা তাঁর অধিগত নয়। উত্থিত হল শরাসন। নিপুণ বাণাঘাতে একে একে সব কয়টি ফলই সবেগে ভূমিতে অবতীর্ণ হল। রাজপুত্র ভূপাতিত ফল এবং বাণ সংগ্রহ করতে করতে দেখলেন চিত্রলেরা অন্তর্ধান করেছে।
পরদিন প্রাতে চলা আরম্ভ করে সপ্তাশ্ববাহন দেখলেন, ভূমি অল্প-অল্প করে ঊর্দ্ধগামী হচ্ছে। আজও দুইযোজন অতিক্রম করে তিনি থামলেন। শ্রমে ও ক্ষুধায় তখন তাঁর শরীর বিকল। প্রাতে গতকালের সংগৃহীত নারিকেলের চারটি দ্বারা উদরপূর্তি করেছিলেন। তার পূর্ব দিনে নদীবক্ষে অগ্নিপক্ক মৎস্য ভিন্ন অন্য আমিষ আহার এ-পর্যন্ত জোটেনি। গতদিন বিভিন্ন সময়ে চিত্রল মৃগযূথ, শশক, বন্য কুক্কুট ইত্যাদি নয়নপথে পতিত হয়েছিল। কিন্তু আজ প্রাতে কয়েকটি বন্যবরাহ দর্শন এবং কয়েকবার দূর বৃক্ষশাখা হতে বানরের অস্ফুট ধ্বনি শ্রবণ ভিন্ন অন্য প্রাণির আভাস পাননি। এ অঞ্চলে আহারযোগ্য ফলের বৃক্ষ একে অপ্রচুর, তাতে যে কয়টি আছে- আশ্চর্যরকম ফলশূন্য। তবে কি বানরকূল সমস্ত ফল আত্মসাৎ করেছে! কিন্তু তারা কি শুধু একই অঞ্চলে ঘোরাফেরা করে? এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে রাজপুত্র লিপিচিত্র পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। দেখলেন অরণ্যসীমা শেষ হওয়ার মাত্র অর্ধযোজন হাতে থাকতে একটি ক্ষীণ জলধারা পর্বত হতে এসে মহানগরীর বিশাল ক্রোড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেখানে পৌঁছোতে পারলে কি পুনরায় মৎস্যপ্রাপ্তি সম্ভব? মনে মনে পর্যালোচনা করে ভাগ্যপরীক্ষার জন্য শ্রান্তশরীরে আবার উঠে দাঁড়ালেন। সহসাই বনান্তরালে নড়াচড়ার শব্দ কানে এল। একটি চিত্রল মৃগের চিত্রিত পৃষ্ঠে সূর্যালোক প্রতিফলিত হল। রাজপুত্র অনিচ্ছায় ধনুতে শরযোজনা করলেন। ক্ষুধার তাড়না অত্যন্ত প্রবল। নাহলে এমন সুন্দর প্রাণী বধে মন সায় দেয়না।
লক্ষ্য স্থির করতে গিয়ে দেখলেন মৃগটি বৃক্ষের অন্তরাল থেকে অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গায় বেরিয়ে এসেছে। নিতান্তই শাবক। বারবার পড়ে গিয়ে কাতর শব্দ করে উঠছে। মনে হয় পিছনের কোনো পায়ে আঘাত লেগেছে।
রাজপুত্র ধনু নামিয়ে রাখলেন। নিঃশব্দে অগ্রসর হলেন বৃক্ষের অন্তরালে আর হরিণশিশুটিকে ধরে ফেললেন অল্প আয়াসে। ভীত শাবকটিকে গায়ে হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করতে করতে দেখলেন, তার বামপাশের পিছনের পায়ে যেকোনো ভাবেই হোক, গুরুতর আঘাত লেগেছে।
রাজপুত্র উঠে দাঁড়ালেন। অস্ত্রাদি সংগ্রহ করে গন্তব্য পথে এগিয়ে চললেন। ক্রমশঃ উন্নত হতে থাকা ভূমিতে এক বৃক্ষসমাবেশ পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় একবার পিছনে তাকালেন। দেখলেন তৃণভোজন অসমাপ্ত রেখে মৃগশিশুটি তাঁর দিকে চেয়ে আছে।
পরবর্তী এক যোজন শ্রান্ত অভুক্ত দেহে পার হতে যথেষ্ট ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার প্রয়োজন হল। কিন্তু সে শ্রম সার্থক হল, যখন স্বচ্ছসলিলা পর্বতনন্দিনীর কোলে বিশাল আকৃতির একজোড়া মাছের দেখা পেলেন কুমার। অগভীর জলে তীরের কাছে মাছ দুটি স্থির হয়েছিল একটি বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের আলো-আঁধার মেশা কোলের কাছে। রাজপুত্র সুনিপুণ ভল্লে নিকটের মৎস্যটিকে বিদ্ধ করে পরমুহূর্তেই বিপুল বলে ভল্লের সাহায্যেই তাকে শূন্যে উত্তোলন করে সে ভল্ল তীরে নিক্ষেপ করলেন। এত দ্রুত ব্যাপারটি ঘটে গেল যে জলে সামান্যই আলোড়ন উঠলো। অপর মাছটি কিছু চঞ্চল হয়ে উঠলো বটে, কিন্তু কোনো বিপদের সম্ভাবনা বুঝতে না পেরে আবার অন্ধকার অভিমুখী হয়ে স্থির হয়ে গেল। রাজপুত্র ত্বরিতে কোষ হতে অসি নিষ্কাশন করে ভূপতিত মৎস্যের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন।
অগ্নিপক্ক আমিষে গুরুভোজন হয়ে গেল রীতিমতো। বহুক্ষণ নিরাহারে থাকার ফল। এইবার শ্রান্ত শরীর বিশ্রামের জন্য দাবী জানাতে লাগালো। রাজপুত্র অবশিষ্ট মৎস্যখণ্ড পাতায় রেখে লতা দিয়ে বাঁধলেন। মুখপ্রক্ষালনাদি সেরে সব কিছু নিয়ে আরোহণ করলেন এক মহা-মহীরুহে। তন্দ্রা নামছে তখন তাঁর সর্বাঙ্গ ছেয়ে। দিনান্তের শেষ আলোকরশ্মির লেশ মুছে গিয়ে দিগন্তরেখায় যখন চন্দ্র উদিত হলেন, রাজপুত্র গভীর নিদ্রায় অভিভূত।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠতে লাগল। ক্ষীণধারা শাখা নদী থেকে ক্রমবিলীয়মান অরণ্যের শাখায় পত্রে, বৃক্ষবিরল তৃণভূমিতে আসন্নপূর্ণিমার জ্যোৎস্না তার মায়াউত্তরীয়খানি বিছিয়ে দিতে লাগল। কয়েকটি নিশিচর সুস্বর বিহঙ্গ থেকে থেকে গেয়ে উঠে সে স্বপ্নকে করে তুলতে লাগল সুখবিভোর। বনজপুষ্পের মধুগন্ধ ক্ষণে-ক্ষণে মদির করে তুলতে লাগল মৃদু পবনকে।
রজনীর প্রথম, দ্বিতীয় হয়ে তৃতীয়যাম শেষ হওয়ার মুখে, এমন সময়ে নিদ্রাভঙ্গ হল রাজপুত্রের। সারা দেহে তিনি অনুভব করলেন তেজ, নবোদ্যম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বৃক্ষ হতে অবতরণ বা অঙ্গসঞ্চালনের চেষ্টা করলেন না। নিদ্রাশিথিল দেহ ও বোধকে নিতে লাগলেন গুছিয়ে। তিনি অবস্থান করছিলেন মহাবৃক্ষের যে স্থানে, তিনটি প্রধান শাখা কাণ্ড থেকে নির্গত হওয়ার ফলে সেখানটি প্রশস্ত একটি ক্ষেত্রের রূপ নিয়েছিল। স্থানটি এতই সুপরিসর যে পূর্ণদেহী একজন মানুষ স্বচ্ছন্দে শয়ন করতে পারে। মধ্যস্থলে ঈষৎ নিম্নাভিমুখী হওয়ার ফলে নিদ্রিত ব্যক্তির গড়িয়ে পড়ারও সম্ভাবনা থাকে না। শয়নের সময় পূর্বদিনের মতো নিজেকে বন্ধনের প্রয়োজন বোধ করেননি। এখন শায়িত অবস্থাতেই পার্শ্ব ফিরে দৃষ্টিপাত করলেন নিকটে-দূরে। নৈশ অরণ্যপ্রকৃতির রূপে জুড়িয়ে গেল তাঁর দুই চোখ। দিনের উজ্জ্বল আলোতেও ক্ষুধা, ক্লান্তি, দূরত্ব অতিক্রমণের একাগ্রতা যা দেখতে দেয়নি, তাও দুচোখ ভরে ধরা দিল এইবার - অরণ্যের অবকাশে মাত্র আধযোজন দূরত্বে বিশাল সমুন্নত গিরিগাত্র। সুবিপুল শিলাস্তূপ স্তরে স্তরে উঠে গিয়েছে।
এই অবস্থানের কিছু নিম্নে একটি তরুণ শাখার অগ্রভাগে অগ্নিপক্ক মৎস্যের সম্ভার ঝুলিয়ে রেখেছিলেন রাজপুত্র। সেদিকে চোখ পড়তে সচমকে সোজা হয়ে উঠে বসলেন। পত্রাচ্ছাদিত খাদ্যবস্তুর লম্বমান রূপ অদৃশ্য। ঘন পত্রপল্লব ভেদ করে একফালি জ্যোৎস্না এসে পড়েছে সেই শাখার ঠিক সেই অংশটিতে। দেখা যাচ্ছে - শাখা শূন্য।
কুমার দ্রুত হাত দিয়ে চক্ষুমার্জনা করে তাকালেন - শূন্য সব।
রাজপুত্র প্রাক্সন্ধ্যায় শয়নের পূর্বে উপরে উপযুক্ত শাখা না পেয়ে ত্রিতলিকায় তাঁর অবস্থান ক্ষেত্রের নিম্নে একটি শাখায় লম্বিত করে রেখেছিলেন তাঁর আয়ুধসমূহ - শরাসন, তূণীর, অঙ্গত্রাণ, শিরস্ত্রাণ, খেটক, মুদ্গর। সমান্তরাল দুটি শাখার উপর উপশাখাগুলির সহায়তায় রক্ষা করেছিলেন শূল। শুধু কটিবন্ধ হতে করবাল ও পাশ মোচনের উদ্যম করেননি নিদ্রার প্রবল আকর্ষণে। এখন অগ্নিপক্ক মৎস্যমাংসের অন্তর্ধান তাঁকে সচকিত এবং উদ্বিগ্ন করে তুলল। ত্বরিতে সুখ-শয়নস্থান ত্যাগ করে নেমে এলেন উদ্দিষ্ট স্থানের দিকে। আশঙ্কা সত্য। অন্তর্হিত হয়েছে চাপ, তূণ, উরস্ত্র, শিরস্ত্র, চর্ম, মুষল, ভল্ল।
কয়েকমুহূর্ত কুমার স্তব্ধভাবে শূন্য শাখা-প্রশাখাগুলির দিকে চেয়ে রইলেন নির্নিমেষে। তারপর পূর্বাপেক্ষা ত্বরিত গতিতে ফিরে গেলেন পূর্ব অবস্থানে। কোষ হতে অসি নিষ্কাশন করে মহাবৃক্ষের মহাকাণ্ডে পিঠ দিয়ে বসলেন বীরাসনে। দৃষ্টি সতর্কভাবে পরিক্রমা করতে লাগল - বাম-সম্মুখ-দক্ষিণ ... দেখলেন নীচ থেকে আক্রমণ অসম্ভব, বাম এবং দক্ষিণ উভয় দিকে তাঁর অবস্থান ছাপিয়ে বিপুল শাখার বেড়। পশ্চাৎ হতে আক্রমণ অসম্ভব। মহাবৃক্ষের মহাকাণ্ড অনন্তনাগের দেহকাণ্ডের মতো বিশাল, বরাভয়ের মতো রক্ষাকারী। উপর হতে আক্রমণ সম্ভব নয়। এই ত্রিতলিকার উপরের তল এত ঊর্দ্ধে এবং ঠিক এরই উপরে যে সেখান থেকে আক্রমণ করতে গেলে সরাসরি লম্ফ দিয়ে পড়তে হয়। এই পরিমাণ দুঃসাহস দেখালে তার পরিণাম অত্যন্ত অশুভ হওয়ার সম্ভাবনা। অতএব সম্মুখ এবং উভয় পার্শ্বই সম্ভাব্য আক্রমণের দিক হতে পারে।
রাজপুত্র অবিচলভাবে বসে রইলেন। তাঁর মন ডুবে যেতে লাগলো চিন্তার গভীরে। দৃষ্টি যদিও একাগ্র নিষ্ঠায় পরিক্রমা করে যেতে লাগলো দৃশ্যপট।
ক্রমে ক্রমে জ্যোৎস্নার অমল আলোকে ছাপিয়ে জেগে উঠতে লাগলো ঊষার অরুণরাগ। রাজপুত্র কিছুক্ষণ সতর্ক পর্যবেক্ষণের পর অবতরণ করলেন ভূমিতে।
নদীতে স্নান এবং জলপানের পর কুমার দ্রুত এগিয়ে চললেন। রাত্রিতে সুপ্রচুর বিশ্রামের পর শরীর সতেজ। কিন্তু সুতৃপ্ত স্নানের পর তরুণশরীরে প্রবল ক্ষুধার উদ্রেক হতে লাগলো। যেহেতু উপস্থিত কোনো উপায় নেই, অভীষ্ট সিদ্ধির পথে এগিয়ে চলাই অয়স্কর।
কিয়ৎ পরেই অনুভূত হলো - শরীরের সেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাব শিথিল হয়ে এসেছে অনেকখানি। আরামের স্পৃহা জেগে উঠেছে। ক্ষুধার বোধ জলপানের পূর্বে কিছু কম ছিল। এখন তা প্রবল হয়ে দাবি জানাতে লাগলো উদরপূর্তির। পথ কষ্টকর হয়ে দীর্ঘ বোধ হতে লাগলো প্রতিপদে। রাজপুত্র প্রমাদ গণলেন।
পথ অনেক সময়ই গিরিগাত্র অবলম্বন করে বৃত্তাকারে অগ্রসর হচ্ছিলো। কখনো একটি উচ্চস্থান থেকে অপেক্ষাকৃত নিম্ন স্থানে নেমে এসে আবার পরবর্তী উচ্চস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। রাজপুত্র একজায়গায় থমকে দাঁড়ালেন। একটি মধ্যম মাপের বৃক্ষকে অবলম্বন করে শিখরের দিকে দৃষ্টি করে চিন্তা করলেন কিয়ৎক্ষণ। তারপর গিরিপথ ত্যাগ করে উঠতে লাগলেন গিরিগাত্র অবলম্বন করে। এতে পথশ্রম বৃদ্ধি পেলেও অনেকটা পথ একসঙ্গে অতিক্রম করা সম্ভব হতে লাগলো। ক্লান্ত শরীর তপ্ত এবং স্বেদসিক্ত হতে থাকলেও কুমার এতে প্রসন্ন হয়ে উঠলেন।
লিপিচিত্র অনুযায়ী প্রায় এক-চতুর্থাংশ পথ অতিক্রম করার পর গিরিগাত্র ক্রমশ খাড়া হয়ে উঠতে লাগলো। বিরল হয়ে আসতে লাগলো বৃক্ষও। রাজপুত্র এক শৈলশিরার প্রান্তে এসে পৌঁছোলেন।
সুবিস্তৃত এই ফাটল, গভীরতাও তার বিস্তারের মতোই। গহ্বরে নেমে অপরপাশে যাওয়া বা এইপ্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত লম্ফ দ্বারা অতিক্রম করা সম্ভব নয়। এখন কী কর্তব্য?
চিন্তামগ্ন রাজপুত্রের অঙ্গে কয়েকবিন্দু জলকণা পতিত হলো। চকিতে মুখ তুলে দেখলেন - সূর্যের দীপ্তি কখন ম্লান হয়েছে নানাবর্ণ মেঘে। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে বর্ষণের। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বাতাস মাতাল হয়ে উঠলো। বিদ্যুৎ চমকিত হলো। ঘনধারায় নেমে এল বর্ষা।
রাজপুত্র প্রথমে আশ্রয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু এই স্থান, এমনকি সদ্য পিছনে ফেলে আসা স্থানেও কোনো গুহা বা আচ্ছাদন নেই। সহসা তাঁর মুখ আলোকিত হয়ে উঠলো - ধারাস্নানে স্বেদতপ্ত ক্লান্তশরীর পুনরুজ্জীবিত করার এই তো সুযোগ! - মুক্ত আকাশের নিচে গিরিশিরার প্রান্তে দাঁড়িয়ে ধারায় সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে নিতে লাগলেন রাজপুত্র।
কতক্ষণ কেটেছিল, স্মরণ ছিল না। সহসা কিছুদূরে একটি শিলাখণ্ড স্থানচ্যুত হয়ে সশব্দে এসে পড়ায় তাঁর সংবিৎ ফিরল। মনস্ক হয়ে দেখলেন - বর্ষাস্নাত পর্বতের গা বেয়ে নেমে এসেছে শত শত ক্ষণস্রোত ধারা। তাদের গতিপথ লক্ষ্য করতে গিয়ে দেখলেন - আর একটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ শিলাখণ্ড গড়াতে গড়াতে নেমে আসছে। রাজপুত্র ত্বরিতে স্থান পরিবর্তন করলেন। ক্ষণপূর্বে যে স্থানে তিনি দণ্ডায়মান ছিলেন, সেই স্থানটিতে এসে থামলো পাথরটি। সচকিতে দেখলেন - আর একটি পাথর গড়াতে শুরু করেছে। এটি আরও বৃহৎ। পতনপথে বিভিন্ন প্রস্তরখণ্ডে প্রতিহত হতে হতে বেগবৃদ্ধি হতে লাগলো তার। আঘাতে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতি এবং তাদের আঘাতে আরও ক্ষুদ্রাকৃতি প্রস্তর ছিটকে গিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে গড়িয়ে আসতে লাগল। সবগুলিরই যাত্রাপথ তিনি যেখানে অবস্থান করছেন, সেইদিক লক্ষ্য করে।
রাজপুত্র ওষ্ঠাধর দংশন করলেন। পশ্চাতের দিকে লক্ষ্য করে দেখলেন পতনশীল শিলাসমূহের পতন বেগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নেমে গিয়ে কোথাও সরে আত্মরক্ষা অসম্ভব। একদিকে শৈলশিরা অপরদিকে সমুচ্চ গিরিগাত্র। পতনশীল শিলার গতিপথ ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তমান। একটিমাত্র বৃহদাকৃতি শিলা মানবশরীরকে চূর্ণ ও পিষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট। এখন উপায়? ভাবতে ভাবতেই গুরুগম্ভীর শব্দে নেমে আসতে লাগল আরো একটি বৃহৎপ্রস্তর। কুমার নিজেকে সংযত রাখতে রাখতে নিমেষের মধ্যে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে লাগলেন। সহসাই গিরিশিরার অপর পার্শ্বে চোখ পড়লো তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে কটিতে হাত পড়লো। সুদীর্ঘ এক পাশ উঠে এলো হাতে। সবল বাহুর প্রচণ্ড অভিক্ষেপে উড়ে গিয়ে পাশ আলিঙ্গন করল শিরার অপর পার্শ্বের সুবৃহৎ এক শৈলচূড়ার সূক্ষ্মাগ্র মস্তককে। রাজপুত্র সবলে আকর্ষণ করে পাশের দৃঢ়সংবদ্ধতা বিষয়ে নিশ্চিত হতে হতে শুনলেন আরো বেশি সংখ্যক গুরুভার শিলা স্খলিত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে ভীমবেগে। দৃঢ়হস্তে পাশ ধারণ করে পিতৃমাতৃনাম স্মরণ করে এ প্রান্ত থেকে শরীরকে শূন্যে ভাসিয়ে দেওয়ার পূর্বমূহুর্তে রাজপুত্র লহমার জন্য লক্ষ্য করলেন অতিকায় এক শিলাখণ্ড অন্য শিলায় প্রতিহত হয়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠেছে ঠিক তাঁর অবস্থানভূমিতে অবতরণের জন্য। সেই মুহূর্তে তাঁর শরীর বিহঙ্গের মতো শূন্যে উড্ডীন হল। পরমুহূর্তে পর্বত কম্পিত করে সেই বিশাল পর্বতখণ্ড তাঁর ক্ষণপূর্ব অবস্থিতির স্থানটি নিষ্পিষ্ট করে শৈলশিরার গহ্বরে পতিত হল। পতনের ভীমশব্দে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল গিরিশিরা পর্বত।
পাশবদ্ধ পর্বতশীর্ষ হতে তার পাদদেশের দূরত্ব এবং করধৃত পাশের দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে রাজপুত্রের ধারণা যথাযথ হওয়ায় তিনি এসে অবতরণ করলেন ঐ চূড়ার পাদদেশে। গিরিশিরার অপর পার্শ্বে তখন প্রলয় শুরু হয়েছে।
কিছুক্ষণ লাগল ধাতস্থ হতে। রাজপুত্র কোনোদিকে না তাকিয়ে মুদিত নেত্রে অপেক্ষা করতে লাগলেন - দ্রুতশব্দ হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক হওয়ার, আকস্মিকতার আঘাত কাটিয়ে ওঠার, ভূস্খলন থেমে বা কমে যাওয়ার।
কোনোটাই তৎক্ষণাৎ হল না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বজ্রগর্ভ মেঘের ধ্বনির মতো ধ্বনি এবং প্রতিধ্বনি বাজতে লাগল পর্বতের শিখরে শিখরে। তারই মধ্যে একসময় চোখ মেললেন রাজপুত্র। দেখলেন - এখনও গড়িয়ে আসছে দুই একটি পর্বতখণ্ড। তার পতন কখনও রুদ্ধ হচ্ছে বৃক্ষ, প্রস্তর বা পর্বতগাত্র দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কখনও বা গিরিশিরার অভ্যন্তরে পতিত হয়ে তা সৃষ্টি করছে মহানাদ। বৃষ্টি এতক্ষণে থেমেছে। বর্ষণক্ষান্ত মেঘমালা সাজিয়ে তুলেছে কাছের দূরের অনতিউচ্চ চূড়াকেও। আবার ঝকমকিয়ে উঠছে রোদ। বর্ষণপ্রসন্ন বৃক্ষপর্বত স্নিগ্ধ হাসি হাসছে তার আভায়।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন রাজপুত্র। ঈষৎ পদচারণা করে পরীক্ষা করে নিলেন অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি। সর্বাঙ্গ বেদনাতুর। যথেষ্ট আঘাত লেগেছে কর ও পদতলে। তবে, রাজপুত্র হিসাব করে দেখলেন, দেনার চাইতে পাওনার ভাগই প্রবল। একমুহূর্ত। তারপরই হিসাব-নিকাশ আপাতত সরিয়ে রেখে ঊর্দ্ধারোহণ শুরু করলেন। পাশ মোচিত হয়ে স্থান পেল কটিতে।
প্রায় শতহস্ত অতিক্রান্ত হলে একটি প্রশস্ত ক্ষেত্রের সম্মুখে এসে উঠলেন রাজপুত্র। সমচতুষ্কোণ চত্বরটি যেন নিপুণ কোনো ভাস্কর একটিমাত্র বৃহৎ শিলাকে তক্ষণ করে সৃষ্টি করেছে। এমনিতেই সুমসৃণ সেই শিলা ধারাস্নানে হয়ে উঠেছে আভাময়, সুচিক্কণ। এই কৃষ্ণশিলার মধ্য ভাগে আর একটি সমচতুষ্কোণ বেদিকা। অপরূপ এক সরোবরে অগণিত পদ্মপত্র, পদ্মকোরক। সলিল - কৃষ্ণবেদিকার ভিত্তি, পত্রসমূহ - রক্তাভ, মরকতবর্ণ প্রস্তর, কোরক ও পদ্মসমূহ - মর্মর শিলা। মধ্যভাগে এক অপরূপ শ্বেতপদ্ম। পূর্ণপ্রস্ফুট পুষ্পটি আকারে সুবৃহত, পূর্বমুখী। এই পুষ্পের অভিমুখে সুবর্ণবর্ণ কিরণচ্ছটার দুইটি কিরণদণ্ডের উপর - হিরণ্যবর্ণ সপ্তাশ্ববাহিত সূর্য।
রাজপুত্র নির্নিমেষ নয়নে এই শিল্পসুষমার রূপসুধা পান করতে লাগলেন। অভিভূতভাবে অগ্রসর হলেন। সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন কমলবনের। একটি দীর্ঘ সুবর্ণচম্পকের বৃক্ষ চত্বরের পশ্চাদ্ভাগ হতে সমগ্র চত্বরটিকে ছায়া করে আছে। বৃক্ষটি পুষ্পভারাবনত। কুমার কটি হতে মোচন করলেন পাশ। পাশ শূন্যে যাত্রা করল এবং বেষ্টন করল একটি শুষ্ক শাখাকে। পুষ্পপ্রেঙ্খায় দোলা দেওয়ার মতো ধীরলয়ে নতনেত্রে পাশ আকর্ষণ করলেন কুমার। একবার .. দুবার .. তিনবার .. চারবার .. পাঁচ ছয় সাতবার ...। প্রতিবার আকর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে অজস্র পুষ্পবর্ষণে আস্তৃত হল চত্বর। আন্দোলনের রেশ নিয়ে দুলতে থাকল শাখা । ...
(পরবাস-৫১, জুন-জুলাই, ২০১২)