—এরপর?
এরপর খুব সুন্দর ঢংঢং ঢংঢং মিষ্টি আওয়াজ করে দেওয়াল ঘড়িটা সময় জানিয়ে দিল।
—অর্থাৎ?
অর্থাৎ গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে গেল।
—তাহলে?
তাহলে এরপর যদি কিছু থাকে তা গল্প নয়।
তাই আমাদের এই কাহিনীর পরে যদি কখনো ছেঁড়া মেঘের মতো অকারণে ভেসে বেড়ায় কিছু কথা, কিছু দৃশ্য, তবে তা একেবারেই এই কাহিনীর অন্তর্গত নয়।
হয়তো তা কেবল ওই পঁচিশবর্ষীয়া বিধ্বস্ত নারীর এবং ওই সত্তরোত্তীর্ণ জীর্ণ বৃদ্ধার অবয়বহীন চেতনার অস্পষ্ট আভাস।
এবং তা কোনো গল্পের উপাদান কিংবা অংশ হতে পারে না।
তবুও তা কখনো কখনো কোন্ অমলিন কথামালা হয়ে — কোথায় ভেসে বেড়ায়—যেখানে পৃথিবীর কোনো অক্ষরসর্বস্ব গল্পই তার তল পায় না?
এইভাবে এক আশ্চর্য ভাসমান ভেলায় কিংবা স্বপ্নে তৃণা দেখতে পায় নির্মলাকে, যেখানে নির্মলা তাকে বলছে—'বুড়ি—ও বুড়ি - এবার চোখ বন্ধ কর—দেখবি ঘুম এসে যাবে'। আর সে বলছে—'ঘুম আসবে কি করে দিদু-দ্যাখো চারিদিকে কতো রঙিন কাঁচের জানালা—কতো রংবেরঙের আলো পড়ছে—আমার মুঠোয় দ্যাখো তোমার কাঁথার রঙিন মাছ-রঙিন জল—কত্তো রকমের সুতো—আলোয় কিরকম লাগছে'। তারপরেই সে হঠাৎ দেখতে পায় তার রুগ্ন বাবাকে ঠিক যেন তার পাশটিতেই শুয়ে রয়েছে। তখন সে বলে ওঠে—'আরে! পাশে তুমি শুয়েছিলে বাবা—ইস্ গাটা কি ঠাণ্ডা তোমার—কাঁথাটা গায়ে দিয়েদি—দিদু—ও দিদু—বাবা ওমনি করে শুয়ে আছে কেন—কাঁথাটা দিলে আরাম লাগবে—কাঁথাটা দাও না দিদু—কাঁথাটা...'
একইভাবে এক অপরূপ কথামালায় কিংবা স্বপ্নে নির্মলা দেখতে পায় তৃণাকে, যেখানে তৃণা বলছে—দিদু—ও দিদু—কে গাইছে গো—'আমায় নিয়ে যাবি কেরে'—কি সুন্দর গলা! আর সে বলছে—দাদামনি-দাদামনি গাইছেরে—অন্ধকারে বসে—যাবি? —সাবধান—খুব অন্ধকার। তারপর হঠাৎই সে দেখতে পায় তার অতি পরিচিত ঘরটিকে, যেখানে শুয়ে রয়েছে তার একমাত্র সন্তান ডোডো। তখন সে বলে ওঠে—একি! কোথায় এলি! এঘরে ঢুকলি কেন? এখানে যে ডোডো থাকে—ওই যে শুয়ে রয়েছে—অনেকদিন ধরে—মারা গেছে তো—অনেককাল আগে—আমার কাছে রেখে দিয়েছি—কাউকে বলবি না—খবরদার—ও বুড়ি—দ্যাখ তো পায়ের কাছটা কেমন কুঁচকে গেছে কাঁথাটা—আয় ঠিক করে দি—আয়—কিচ্ছু হবে না—আয়...
— এভাবেই এই আশ্চর্য আকারের দৃশ্যগুলো বারবার ভেসে আসে স্বপ্নে—তৃণা ও নির্মলার—বারবার—
— কেন?
আমরা জানি না।
আমরা জানি মানুষ স্বপ্ন দ্যাখে। সুখে দ্যাখে। দুঃখে দ্যাখে। হয়তো যতদিন সে বেঁচে আছে ততদিন ধরেই দ্যাখে এই স্বপ্ন। আর এই স্বপ্নে ভেসে আসে তার নিজেরই অনেক অজানা মুখ। কোথা থেকে ভাসতে ভাসতে এসে তারা কোথায় মিলিয়ে যায় কে জানে।
অন্তত আমরা অতশত জানি না।
জীবনের স্বাভাবিক স্রোতে দুটি অসমবস্তু ভাসতে ভাসতে একদিন খুব কাছাকাছি এসেছিলো—আবার একই স্রোতে তারা দুদিকে ভেসে গেল বরাবরের মতো —
আমরা তা জানি।
জানি তার কারণ স্মৃতি। স্মৃতিও স্রোতের মতো। বহমান।
তাই এই স্মৃতির মধ্যে ভেসে আসে হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে ছড়ানো কিছু অক্ষরমালা।
অক্ষর! অর্থাৎ কোনো কাহিনীর ভিত্তি!
আমাদের এই কাহিনীর ভিত্তি।
দিদু,
তোমায় এই চিঠিটা দিয়ে গেলাম। চিঠিতে কিছু কথা লেখার চেষ্টা করলাম। জানিনা পারলাম কিনা। এগুলো আমার তোমাকে জানানো উচিত। মুখে বলতে পারলাম না। তাই লিখলাম।
প্রথমেই বলি যে কাঁথাটা তুমি আমায় বার করে দিলে তার কাহিনীটা শুনলাম আজ সকালে। ভাবতেই কেমন লাগছিলো। এতদিন আগেকার কাঁথা। এত পুরোনো কথা জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে। আর এই কাঁথাটাই আমি সারারাত গায়ে জড়িয়ে ছিলাম। মনে পড়ছে তোমার কথাগুলো। কাঁথাটার প্রতি সুতোর সেলাইয়ে কতদিন আগেকার মানুষের কত যত্ন, ভালোবাসা জড়িয়ে রয়েছে। আর এই কারণেই এই কাঁথাটা আর গায়ে দিতে পারবো না আমি। আমি এর একটা সুতো ছোঁয়ারও যোগ্য নই। কেন সেটা এবার বলছি।
জন্মেছিলাম সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। জন্মে থেকেই রুগ্ন বাবাকে দেখে আসছি। পা দুটো প্যারালিসিসে নাড়তে পারে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ইংলিশ পড়াতেন স্টুডেন্টদের। আর যখন পড়াতেন না ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন বাইরের জানালাটার দিকে। কখনো কখনো সন্ধেয় মা না থাকলে রঘুজ্যাঠাকে দিয়ে ড্রিংকস আনিয়ে খেতেন ঘরের দরজা বন্ধ করে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাবার পিঠে বিরাট একটা ঘা হয়ে গিয়েছিল। দেখিনি কখনো। শুনেছিলাম। ঘরে গন্ধ বেরোত। চাদরে, জামাকাপড়ে সেই গন্ধ লেগে থাকতো। রঘুজ্যাঠা আর মা পরিষ্কার করতো। আমি যাইনি কখনো। বাবার যেদিন খুব বাড়াবাড়ি, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ডক্টর মুখার্জি এসেছিলেন। বেরোনোর সময় দেখেছিলাম। তুষার-স্যারের সঙ্গে আউটডোর স্টাডি ছিল আমার। যেমন যাই গিয়েছিলাম। যেমন দেরি করে ফিরি তেমনই ফিরেছিলাম। দেখলাম সব শেষ হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলাম থাকলেই বা কি করতাম। পরদিন সন্ধেয় শালিনীর সঙ্গে বুকফেয়ারে গেলাম। কারণ বাড়িতে থেকেই বা কি করবো। সেদিনই সর্বজিতের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
দিদু কি লিখতে কি সব লিখে ফেলছি। কত হাবিজাবি কথা লিখে ফেললাম। বিরক্ত হোয়ো না। এবার ঠিকঠাক করে লিখছি। আসল ব্যাপারটা কি জানো — আমি কাউকে ভালোবাসিনি কক্ষনো—কোনোদিন। বাবাকে না — মাকে না — সর্বজিৎকে না। এমনকি যে সন্তান আসছিল তাকেও না। সত্যি কথা বলতে কি আমিই তো তাকে মেরে ফেললাম। আমি তো চাইনি তাকে। আমার কেরিয়ারের জন্য। তাছাড়া সেইসময় আমার সঙ্গে সর্বজিতের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ও আমার প্রতিটি কথায় অশান্তি করত। আর ওকে দেখলেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে যেত। তাই ও যখন সেপারেশন চাইল দিয়ে দিলাম। দূর হোক আমার জীবন থেকে। ওর জন্যেই মাকে হারিয়েছি আমি।
মা আর কোনোদিনও ফিরে এলো না। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে মা ভীষণভাবে আমার উপর নির্ভর করত। আমাকে এক মুহূর্তও ছেড়ে থাকতে পারতো না। সেইজন্যেই সর্বজিতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মা সহ্য করতে পারতো না। হঠাৎ করে সর্বজিতের সঙ্গে চলে গেলাম। মা ভীষণ শক্ড্ হয়েছিল। পরদিন সকালে বাড়ি ফিরে দেখলাম মা চলে গেছে। আর কোনো দিনও ফিরলো না। আমি আজও সেইভাবে মাকে খুঁজতে বেরোলাম না।
মাঝে মাঝে রাস্তায় এইভাবে ঘুরে বেড়াই কেন কে জানে। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছেই হয় না। যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই। কাল সন্ধের পর এইভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম রাস্তায়। হঠাৎ মনে হল সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এর এই জায়গাটায় আমি আগে কখনো এসেছি। তাই হাঁটতে হাঁটতে এদিকটায় চলে এলাম। একটু একটু করে সব মনে পড়ে যেতে লাগলো —এইরকম দেবদারু গাছ—এই রকম ইঁট রঙের বাড়ি—বাড়ির বাইরে কবেকার ভাঙাভাঙা গণেশমূর্তি—মনে পড়ে গেলো—সিদ্ধেশ্বর মুখার্জির বাড়ি! জাস্টিস মুখার্জি! মায়ের মামা হতেন। অনেকবার এসেছি ছোটোবেলায়। ভিতরে কাঠের সিঁড়ি। জানালায় সব রঙিন কাঁচ। তাই কি মনে হল ডোরবেলটা টিপলাম।
দ্যাখো আবার কিসব উল্টোপাল্টা লিখে ফেললাম। যাক্গে। তবে এখানে এসে আমি যে কি পেলাম তা লিখে বোঝাতে পারবো না। তুমি আমায় এত যত্ন করলে কেন? আমি কি এত যত্নের যোগ্য?
আর কোনোদিনও হয়তো দেখা হবে না। প্রণাম নিও। ভালো থেকো।
—ইতি
  বুড়ি
মুক্তোর মতো হাতের লেখায় দুপাতার একটা চিঠি। ভাঁজ করে রাখছিল কাঁথাটার এক কোনার তলায়। আর খুব যত্ন করে পাট করে রাখছিল কাঁথাটা। রাখছিল নির্মলার পায়ের কাছে। নির্মলা শুয়েছিলেন। একটু ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। ঘুম ভেঙেছিল দেওয়াল ঘড়ির আওয়াজে। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখেছিলেন যে তৃণা ঘরে নেই। দেখেছিলেন পায়ের কাছে পাট করে রাখা কাঁথাটাকে।
আর তারই কোনা দিয়ে চাপা দেওয়া ছিল একটা ভাঁজ করা কাগজ।
নির্মলা বের করেছিলেন কাগজটাকে কাঁথার তলা থেকে। পড়েছিলেন সেটিকে সঙ্গে সঙ্গে। এবং বিস্মিত হয়েছিলেন।
ছবির মতো তাঁর চোখে ভেসে উঠছিলো গত কয়েকঘন্টার ঘটনাগুলি।
এইতো গতরাতের কথা। আটটা বেজে গেছে। কলিং বেলটা বেজে উঠলো। বিমলার গলা কানে এল— 'না না ও নামে এখানে কেউ থাকে না।' কি হয়েছে ব্যাপারটা দেখতে গিয়ে নির্মলা দেখলেন দরজায় একটি অল্পবয়েসী মেয়ে। কেমন যেন বিধ্বস্ত। তবে চেহারায় ভদ্রশিক্ষিত বলেই তাঁর মনে হল। নির্মলা বললেন— 'কি ব্যাপার? কি চাই?' বিমলা বলল 'তুমি আবার উঠে এলে কেন?' নির্মলা দেখলেন মেয়েটি হাঁফাচ্ছে। একটু ঝুঁকি নিয়েই উনি মেয়েটিকে ঘরের ভিতর আসতে বললেন। বললেন 'ভিতরে এসো—কি হয়েছে? হাঁফাচ্ছো কেন? বোসো— এই সোফাটায় বোসো।'
বিমলা দরজার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটি ঘরে ঢুকে বলল — 'একটু জল হবে?' নির্মলার কেমন যেন মায়া লাগলো মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে। লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো সরলসুন্দর মুখশ্রী।
জল খাওয়ার পরেও মেয়েটি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। নির্মলা জিজ্ঞেস করলেন— 'কাকে চাও? কার বাড়ি খুঁজছো?'
মেয়েটি ঢোঁক গিলে বললো— 'জাস্টিস মুখার্জির বাড়ি — সিদ্ধেশ্বর মুখার্জি।'
নির্মলা বললেন 'ও বাড়ি তো আর নেই। ভাঙা হয়ে গেছে মাসখানেক আগে। তা ও বাড়িতে তোমার কি প্রয়োজন?'
এইবার আমতা আমতা করে মেয়েটি যা বললো তাতে বোঝা গেল জাস্টিস মুখার্জি মেয়েটির মায়ের মামা হতেন।
কিন্তু এতে যা বোঝা গেল না তা হল এত রাতে এইভাবে মেয়েটির জাস্টিস মুখার্জির বাড়ি খোঁজার কি দরকার। কারণ নির্মলার পরের প্রশ্নগুলিতে মেয়েটি মাথা নীচু করে নিরুত্তর হয়েছিল।
বিমলা পাশ থেকে মন্তব্য করেছিল— 'এইভাবে রাতবিরেতে কেউ বাড়ি খুঁজতে বেরোয় নাকি! আশ্চর্য্যি'!
নির্মলা মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন — 'কি নাম তোমার, বাড়ি কোথায়?' নির্মলার প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি জানিয়েছিল যে তার নাম তৃণা ব্যানার্জী। থাকে লেকটাউনে। একটা অ্যাডভার্টাইজিং কোম্পানীতে চাকরি করে। বলতে বলতেই মেয়েটি সোফায় এলিয়ে পড়লো অচেতন হয়ে। নির্মলা ছুটে গিয়ে বললেন — 'কি হল? কি হল? বিমলা একটু এদিকে এসো তো দেখি।' বিমলা পর্দার আড়াল থেকে সব দেখছিল। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে বলল — 'কি ঝঞ্ঝাট এই রাতবিরেতে।'
ততক্ষণে নির্মলা মেয়েটির চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেওয়া শুরু করেছেন। জলের ঝাপটায় হঠাৎ জ্ঞান ফিরে এলে মেয়েটি বিড়বিড় করে বলে উঠলো— 'এই এই কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে—আমি যাব না—যাব না'—বলতে বলতে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল— 'কি হল আমি কোথায়— আমি কোথায়—'
নির্মলা মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন— 'কিচ্ছু হয়নি— এইতো এখানে বসে আছো—এই যে—আমার দিকে তাকাও'।
মেয়েটি এবার চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল—'সরি —মানে মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিল।' বিমলা পিছন থেকে মন্তব্য করেছিল —'যত্তো ঢং'। নির্মলা বলেছিলেন — 'বিমলা তুমি এবার ও ঘরে যাও'। বিমলা বলেছিল — 'যাচ্ছি উনি চলে যান — দরজাটা দিয়ে তবে যাব তো'। মেয়েটি এবার অত্যন্ত অপ্রস্তুতের মতো উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল — 'সরি — আসি —কিছু মনে করবেন না প্লিজ'। বিমলা বলেছিল — 'হ্যাঁ চলুন দরজাটা দিয়ে দি'। নির্মলা এবার শান্ত অথচ গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন — 'বিমলা তুমি ও ঘরে যাও। দরকার হলে আমি ডেকে নেব'। আর মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন — 'দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে কথা আছে'।
সমস্ত ঘটনাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল নির্মলার পরপর করে যেন ছবির মতো।
তৃণার সে রাতে আর যাওয়া হল না। নির্মলা বুঝলেন তৃণা শিক্ষিত ভদ্রমেয়ে কিন্তু কোনো দুর্বিপাকে পড়ে এই অবস্থায় এসেছে। এই শীতের রাতে একটি অসুস্থ অল্পবয়েসী মেয়েকে রাস্তায় বের করে দিতে তাঁর বিবেকে বাধলো। এবার অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে তৃণা সোফায় এসে বসল। নির্মলার মনে হল মেয়েটি চোরজোচ্চর বদমায়েশ নয়। তিনি তৃণাকে বললেন— 'শরীর ভালো নেই তোমার। বাড়িতে জানিয়ে বেরিয়েছো?' মেয়েটি কোনো উত্তর করল না। নির্মলা বললেন — 'বাড়ির লোকজন চিন্তা করছে কত বলতো।' মেয়েটি মাথা নীচু করেই উত্তর দিল— 'কেউ চিন্তা করছে না।' এরপর নির্মলার প্রশ্নগুলির উত্তরে মেয়েটি যা জানিয়েছিল তা হল— মেয়েটির বাড়ি লেকটাউনে। মা-বাবা কিছুদিন আগে গত হয়েছেন। ফলে মেয়েটির নিজের বলতে কেউ নেই। অভিভাবক বলতে সম্পর্কে রঘুজ্যাঠা। ওদের বৃদ্ধ বাড়িওয়ালা। আর বহুপুরোনো কাজের মাসি মোক্ষদা। নির্মলা লক্ষ্য করেছিলেন মেয়েটির মাথায় সিঁদুরের চিহ্ন নেই। হাতে নেই শাঁখা-পলা ইত্যাদি। চেহারা দেখে মনে হল অনেক ঝড় বয়ে গেছে মেয়েটির উপর দিয়ে। কিন্তু মুখটিতে এখনো শিশুর সারল্য।
নির্মলার চোখে ভাসছিল তৃণার দেবীপ্রতিমার মতো মুখশ্রীটি।
তৃণা বলেছিল—জাস্টিস সিদ্ধেশ্বর মুখার্জি তৃণার মায়ের মামা হন। অর্থাৎ সম্পর্কে তৃণার দাদু। নির্মলার মনে পড়েছিল জাস্টিস মুখার্জি আর তাঁর শ্বশুরমশায়ের পরিবার পরস্পর জ্ঞাতি সম্পর্কিত। দুটি বাড়ি প্রায় একই সময়ে একই ধাঁচে তৈরি। জাস্টিস মুখার্জির বাড়িতো এই সেদিন ভাঙা হয়ে গেল। আর শ্বশুরমশায়ের পারিবারিক ভিটেতো ভাগ হতে হতে একতলার এই টুকরোতে দাঁড়িয়েছে।
এইসব ভাবতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন নির্মলা। খেয়াল হতে দেখেছিলেন কেমন কুঁকড়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে তৃণা। নির্মলা বলেছিলেন — 'যাই হোক। একটু খেয়ে নাও এখন'। তৃণা বলেছিল — 'না না আমার খাওয়া লাগবে না'। নির্মলা বলেছিলেন— 'আমি তোমার চেয়ে অনেক বড়ো—তোমার দিদার বয়েসী—বড়োদের কথা শুনতে হয় —চল'। খাওয়ার টেবিলে মাথা নীচু করে চুপচাপ সামান্য কিছু খেয়েছিল তৃণা। সামনেই বসেছিলেন নির্মলা। একবার মনে হয়েছিল মেয়েটি যা বলল তা সব সত্যি কি না।
নির্মলা বললেন— 'খাওয়ার পর তুমি বাইরের ঘরে ডিভানে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি পাশের ঘরে আছি। ঘরের নাইট ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে শুয়ো।' এই বলে নির্মলা ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। বিমলা বলল — 'তুমি থাকতে দিলে রাতে? চেনা নেই জানা নেই কোথাকার কে।' নির্মলা বললেন— 'না একেবারে অজানা অচেনা নয়। একটা দূরসম্পর্ক তো দেখতেই পাচ্ছি। তাছাড়া ও রাস্তার উটকো মেয়ে নয় বুঝতে পারছি। হয়তো কোনো মাথার গণ্ডগোল কিংবা যাইহোক— ভয়ের কিছু নেই। আমার অভিজ্ঞতাও অনেক হল বিমলা। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।'
খানিকবাদে, নির্মলা দেখলেন বিমলা নিশ্চিন্তেই আছে। অর্থাৎ নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নির্মলার এমনিতেই ঘুম দেরিতে আসে। নির্মলা বাইরের ঘরে উঁকি মেরে দেখলেন তৃণা সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে আধশোয়া হয়ে। কাছে গিয়ে দেখলেন মাঝেমাঝেই কেঁপে উঠছে তৃণার শরীরটা। লক্ষ্য করে দেখলেন মেয়েটার গায়ে একটা পাতলা কার্ডিগান। নির্মলা তৃণার চোখ বন্ধ করা মুখের দিকে তাকালেন। মনে হল নিষ্পাপ মুখ। মনে হল ডোডো বেঁচে থাকলে ওর মেয়ে হোলে এতদিনে ... ভাবতে ভাবতে চোখের দৃষ্টিটা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল নির্মলার।
কোনোক্রমে নিজেকে সামলে ভিতরের ঘরের কাঠের আলমারির সামনে গেলেন নির্মলা। কাঠের পাল্লায় বিরাট আয়না লাগানো সেকালের আলমারি। ঘরের হাল্কা হলুদ নাইট ল্যাম্পের আলোয় নির্মলা দেখলেন সামনে যেন প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে এক মূর্তি— আয়নাটা অসহ্য বলে মনে হল তার কাছে—সঙ্গে সঙ্গে পাল্লাটা খুললেন একটানে—
সবচেয়ে নিচের তাক থেকে খুব সন্তর্পণে একটা একটা করে জামা-কাপড় সরিয়ে খুব যত্ন করে নির্মলা বার করলেন একটা হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের প্যাকেট। প্যাকেটটিকে আস্তে করে খুলতেই বেরিয়ে এল বহু পুরোনো একটি রঙচঙে কাঁথা। পরম মমতায় সেই কাঁথাটিকে আস্তে করে হাতে তুলে নিলেন নির্মলা। খুব সাবধানে কাঁথাটার ভাঁজগুলো খুলতে লাগলেন এক এক করে। রঙচঙে বস্তুটা এবার বিরাট হয়ে দেখা দিল। প্রায় চার হাত বাই ছয় হাতের বিরাট কাঁথা। ভিতরে সুতোর অজস্র কাজ। অসংখ্য অদ্ভুত রঙের সমারোহ।
নির্মলার কত কি মনে পড়ে যাচ্ছিল। কতদিন বাদে আবার দেখলেন কাঁথাটাকে। কাঁথার মধ্যিখানে হাতির পিঠে রাজা। পিছনে তার লোকজন। কাঁথার চারিধার ঘিরে ফুল-লতা-পাতা। আর মাঝে মাঝে রঙিন জল আর মাছ। নির্মলা হাতের আঙুল দিয়ে ছুঁয়েছিলেন সেই ফুল-লতা-পাতা, মাছগুলিকে। পুরোনো কাপড়ের অদ্ভুত গন্ধে ভরে গিয়েছিল জায়গাটা। আবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল নির্মলার দৃষ্টি। নির্মলা চোখ মুছে কাঁথাটাকে পাট করে রেখে দিলেন ডিভানটার উপর। তারপর তৃণার কাছে গিয়ে আস্তে করে ডাকলেন—'ওঠো —উঠে শুয়ে পড়ো ওই ডিভানটার উপর।'
তৃণা ধড়মড় করে উঠে বসে বলল— 'ওহো! সরি — ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।' নির্মলা বললেন — 'ঠিক আছে। এখন শুয়ে পড়ো। তোমার জন্য গরম কিছুই নেই। ওই কাঁথাটা গায়ে দিয়ো।'
কথাটা বলতে গিয়ে কি একটু কেঁপে গিয়েছিল নির্মলার গলাটা?
নির্মলা নিজের ঘরে চলে এলেন। ঘুম আসতে দেরি হয়নি। কিন্তু সে ঘুম যথারীতি ভেঙে গিয়েছিল রাত তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ। সাধারণত খানিকক্ষণ বাদে ভোররাতে আবার ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। সে রাতে কিন্তু আর ঘুম আসেনি তাঁর। মনে পড়ছিল সব পুরোনো কথা।
ওনার যখন এই মেয়েটির মতো বয়স তখনকার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা—
'পূবদিক হল লালে লাল ওই উড়িছে লাল নিশান
আমাদের আজ রুখিবে যে
অনেক কষ্ট লভিবে সে
আসিবে মৃত্যুবাণ...'
স্বামী কমরেড অরুণ প্রকাশ মুখার্জি মিছিলে গান গাইছেন—শোষিত নিপীড়িত মানুষের স্বার্থে—এদিকে ঘরে অভুক্ত শিশুসন্তান...।
এরপর খানিকবাদে নিঃশব্দে উঠে বসে পা টিপে টিপে বাইরের ঘরে গিয়েছিলেন তিনি। দেখেছিলেন অঘোরে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। ওর পা থেকে কাঁথাটা সরে গিয়েছিল খানিকটা। অতি সন্তর্পণে কাঁথা দিয়ে আবার ঢেকে দিয়েছিলেন তৃণার অনাবৃত শরীরের অংশটিকে। তারপর খুব যত্নে নাকি পরম মমতায় তিনি হাত বুলোতে লাগলেন তৃণার উপর— নাকি কাঁথাটির উপর কে জানে। হঠাৎ ঢংঢং করে চারটে বাজলো। সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে দ্রুত ঘরে ফিরে গিয়েছিলেন নির্মলা। ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে ভাবছিলেন উৎকণ্ঠায় তৃণা কিছু টের পায়নি তো? খানিকবাদে পা টিপে টিপে আবার বাইরের ঘরে উঁকি মেরে দেখেছিলেন তৃণা ঘুমোচ্ছে অঘোরে। ঘরে ফিরে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন নির্মলা। বাকি রাত কাটিয়ে দিয়েছিলেন জেগেই।
পরদিন সকালে তাঁর সঙ্গে তৃণার কথোপকথন শুরু হয়েছিল ঐ কাঁথার সূত্র ধরেই।
তৃণা— এ কাঁথাটা কি অদ্ভুত।
নির্মলা— কেন? অদ্ভুত কিসে?
তৃণা— কত রকমের কাজ করা—একদিকে ফুল-লতা-পাতা আবার মধ্যে মধ্যে নদী, মাছ—আবার মাঝখানে হাতির পিঠে রাজা—খুব ইন্টারেস্টিং—
নির্মলা— তা বলতে পার।
তৃণা— মনে হয় অনেকদিন আগেকার? না?
নির্মলা— কয়েক জায়গায় ছেঁড়া পেলে বলে? পুরোনো কাপড় তো। কয়েক জায়গায় পিঁজে গেছে।
তৃণা— কতদিন আগেকার কাজ?
নির্মলা— তা প্রায় একশ বছর হবে।
তৃণা— একশ বছর! সে তো বহুকাল আগের ব্যাপার! আপনি এটাকে এইভাবে আলমারিতে রেখে দিয়েছেন? এতো কালেকটরস আইটেম! সাংঘাতিক দামী!
নির্মলা— না। এটা কোনো কালেকটরস আইটেম নয়। এটা সবচেয়ে বেশি দামী আমার কাছে। বোধহয় আমার চেয়ে যত্নে একে কেউ রাখবে না।
তৃণা— (একটু অপ্রস্তুতের হাসি হেসে) না আমি ঠিক সেভাবে বলতে চাইনি। আসলে কমার্শিয়াল আর্টের স্টুডেন্ট ছিলাম তো। ওইভাবেই দেখছি ব্যাপারটাকে।
নির্মলা— (একটুক্ষণ চুপ করে থেকে, কাঁথাটা ডিভান থেকে হাতে তুলে নিয়ে) এই রঙিন মাছগুলো আমার করা— এই ফুল-লতা-পাতাগুলো আমার শাশুড়ীমায়ের করা — আর ভিতরের রাজারাজড়া ওনার মায়ের হাতের কাজ। আমার শাশুড়ীমায়ের মা শুনেছি খুব গুণবতী ছিলেন। একমাসে এতবড় কাজ শেষ করেছিলেন। শাশুড়ীমায়ের মুখে সব শুনেছি।
তৃণা— একমাসে! অসম্ভব! (একটু হেসে) তাহলে নিজের স্বামীর জন্যে তাড়াহুড়ো করে বানিয়েছিলেন তাই না?
নির্মলা— (তৃণার মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে) সতেরো বছর বয়সে বিধবা হয়ে দু-মাসের সন্তান নিয়ে বাপের বাড়ি এসেছিলেন চারুবালা। চরকা কেটে সুতো তৈরি করে রোজগার করতেন। কাঁথা সেলাই করে রোজগার করতেন। সেই জমানো টাকায় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। একপয়সাও সাহায্য নেননি কারো থেকে। আর সাহায্য করবেই বা কে।
তৃণা— (অবাক হয়ে) কেন?
নির্মলা— সেকালে মেয়েদের গুণপনা থাকলে সাথেসাথে কপালটাও পোড়া থাকত। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল চারুবালার। সতেরো বছর বয়সে বিধবা হল— কোলে তখন দু-মাসের মেয়ে— সেই মেয়ে কোলে অপয়া মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি এল—অপয়া নাম ঘুচলো না—অসুস্থ বাবার জন্য সারারাত জেগে জেগে একমাসে বানিয়েছিলেন কাঁথাটা—তা সে ওনার সইলো না। চারুবালার বাবা মারা গেলেন সন্ন্যাস রোগে। শীতের একরাতে। এরপর মামার বাড়িতে দাসীবৃত্তি, চরকা কাটা, কাঁথা সেলাই। তিলতিল করে জমিয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়া। সে যুগে মেয়ে সুপাত্রেই দিয়েছিলেন চারুবালা। এসব আমার শাশুড়ীমা'র মুখ থেকে শোনা। যাক্গে। কথায় কথায় কত কি বলে ফেললাম।
তৃণা— আমার শুনতে খুব ভালো লাগছে। বলো বলো (বলেই অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে) সরি, আপনাকে তুমি বলে ফেললাম।
নির্মলা— (হেসে) এখন থেকে তুমিই বোলো। তোমার ডাক নামটা কি তৃণা?
তৃণা— বুড়ি। আমায় বুড়ি বলে ডাকবে?
নির্মলা— (হেসে) আচ্ছা বেশ।
এইভাবে কত সহজেই তৃণার সঙ্গে গল্পে মজে গিয়েছিলেন নির্মলা। যেন সে কতকালের অতি পরিচিত। তৃণাও যেন এক পরমাত্মীয়ের কাছে গল্পের নেশায় মত্ত হয়ে গিয়েছিল তখন।
তাদের সমস্ত কথাবার্তা যেন ছবির মতো পরপর ভেসে আসছিল নির্মলার মনে—এইভাবে—
তৃণা— এরপর কি হল কাঁথাটার বলো?
নির্মলা— (হেসে) সে তো আমার শ্বশুরবাড়ীর গল্প।
তৃণা— তো কি হল?
নির্মলা— (হেসে) তুই যে আমার শ্বশুরমশায়ের জ্ঞাতিভাইয়ের নাতনী। আমার শ্বশুরবাড়ীর ভিতরের কথা তোকে বলব কেন?
তৃণা— কোনো উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে হেসেছিল। নির্মলার মনে হয়েছিল এত সুন্দর হাসি তিনি বহুকাল দেখেননি।
আর সেই সঙ্গে মনে হয়েছিল এইভাবে জোর করে গল্প আদায় করে নিত যে সে যেন আবার এতকাল বাদে চেহারা বদলে মুখের সামনে এসে বসেছে।
ফলে গল্পের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল নির্মলা—
'আমার শ্বশুরমশাই কিন্তু ডাকাত ছিলেন। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চাংড়িপোতা স্টেশন লুঠ করেছিলেন। বোধহয় ১৯০৭ সালে। তারপর আবার জেলেও গিয়েছিলেন।'
তৃণা— (অবাক হয়ে) সত্যি?
নির্মলা— একেবারে সত্যি। আমার শাশুড়ীমার মুখ থেকে শোনা।
তৃণা— (একই রকম অবাক হয়ে)— কেমন দেখতে ছিলেন? ইয়া লম্বা—বিরাট চেহারা—বিরাট গোঁফ?
নির্মলা— (হেসে) দূর পাগলী। রোগা-প্যাংলা চোখে চশমা—সে যুগের স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন রে—আমার অবশ্য চাক্ষুষ দেখার প্রশ্নই ওঠে না।
তৃণা— কেন?
নির্মলা— শুনেছিলাম, সেই ডাকাতির পর দিনদুয়েক বাদে বাড়ি ফিরেছিলেন। মাত্র একদিনের জন্য। তারপর পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। অনুশীলনী সমিতি করতেন তো। আর ফেরেননি কোনোদিন।
তৃণা— সেকি? কোনোদিনও না?
নির্মলা— শাশুড়ীমায়ের মুখে শুনেছিলাম—উনি পাক্কা পাঁচবছর অপেক্ষা করেছিলেন স্বামীর জন্য। আসলে শ্বশুরমশায়ও আমার শাশুড়ীকে খুব ভালোবাসতেন। শ্বশুরমশায় যাওয়ার সময় নাকি শাশুড়ীমাকে ওই কাঁথা সেলাই করতেই দেখেছিলেন। বলেছিলেন কয়েকদিনের জন্য যাচ্ছি এসে দেখবো তখনও তুমি কাঁথা সেলাই করেই যাচ্ছ। (এর পর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে) পাঁচটি বছর ধরে আশা রেখে রেখে রোজ ওই কাঁথাটি নিয়ে বসতেন আমার শাশুড়ীমা, জানি না কেন ওনার স্থির বিশ্বাস ছিল ওই কাঁথা সেলাই করতে বসলে ওনার স্বামী ফিরে এসে দেখবেন ওনার কাজ। সেইমতো রোজ সকাল সন্ধে একমনে স্বামী বিজয়কৃষ্ণের মুখ মনে করে কাঁথাটার আশপাশ সব ভরিয়ে ফেলেছিলেন উনি। একদিন সকালে খবর এল বছরখানেক আগেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। পালাতে গিয়ে—নদীতে নৌকা উল্টিয়ে।
এ খবরের সত্যি-মিথ্যে যাচাই করা অসম্ভব। কিন্তু ওইদিন থেকেই কাঁথাটা তুলে রেখে দিয়েছিলেন নলিনীবালা।
তৃণা— নলিনীবালা?
নির্মলা— চারুবালার মেয়ে নলিনীবালা। আমার শাশুড়ীমা।
তৃণা— তারপর কি হল কাঁথাটার?
নির্মলা— তারপর আর কি! কাঁথাটা পড়ে রইল ওইভাবে শাশুড়ীমায়ের কাঠের সিন্দুকে। ব্যস্!
তৃণা— তা তুমি যে বললে এই ধার ঘেঁষে যে রঙিন মাছগুলো রয়েছে ওগুলো তোমার করা। কবে করলে?
নির্মলা— ধারগুলো পিঁজে গিয়েছিল তো। তাই ব্যবহার করতে ভয় হত যদি নষ্ট হয়ে যায়। তাই করেছিলাম।
তৃণা— সেটাইতো জিগগেশ করছি। কবে করলে?
নির্মলা— তা আরো বছর তিরিশেক কেটে যাওয়ার পর।
তৃণা— (অবাক হয়ে) আরো বছর তিরিশেক বাদে? (একটু হেসে) দাদুর জন্য?
নির্মলা— (একটুক্ষণ চুপ থেকে) দাদু? নাহ্।
এরপর নির্মলা জানালার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন অল্পক্ষণ। বাইরে শীতের সকালের উপযুক্ত নীল উজ্জ্বলতা। এই আকাশ ডোডো খুব ভালোবাসত। টাইফয়েডের সময় দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকত ডোডো ওই নীল আকাশের দিকে। নির্মলার হঠাৎ করে সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। নিজের অজান্তেই চোখ চলে গিয়েছিল ঘরের কোনায় রাখা শ্বেতপাথরের টেবিলের উপরের ছোট্ট বাঁধানো ছবিটির দিকে। এবং তারপরেই ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল নির্মলার দৃষ্টি।
তৃণা নির্মলাকে চুপ করে থাকতে দেখে জিগগেশ করেছিল— কি গো দিদু বলবে না বুঝি দাদুর কথা?
নির্মলা খুব আস্তে আস্তে আবার বলতে শুরু করেছিলেন—তোর দাদু খুব পণ্ডিত লোক ছিলেন। খুব কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছিলেন। অল্পবয়সে পিতৃহারা হয়েছিলেন তো।
একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন— 'তোর দাদুর এক বোন ছিল। তার নাম অরুন্ধতী। ছোটবেলায় প্রদীপের আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল সে। তোর দাদু ভীষণ ভালোবাসতেন বোনকে। বাড়ির সব ঠাকুর দেবতার মূর্তি একরাতে ভেঙে দিয়েছিলেন।'
তৃণা— সেকি!
নির্মলা— (মৃদু হেসে) ডাকাতের ছেলে তো—চণ্ডালে রাগ—তার উপর আবার বলশেভিক।
তৃণা— (অবাক হয়ে) সেটা আবার কি?
নির্মলা— (ফের মৃদু হেসে) তোরা তো আবার এ যুগের ছেলেমেয়ে—বলশেভিক বললে বুঝবি না। এখনকার কম্যুনিস্ট যাকে বলে আর কি। আমার স্বামী ছিলেন সে যুগের কম্যুনিস্ট লিডার। কমরেড অরুণপ্রকাশ মুখার্জি।
তৃণা— আর তুমি?
নির্মলা— (হেসে) আমি তো আরেক কমরেডের মেয়ে। সে যুগের তাবড় কম্যুনিস্ট রণেন্দ্রনাথ বসুর একমাত্র কন্যা।
তৃণা— তাহলে তুমি কম্যুনিস্ট হলে না যে?
নির্মলা— (আবার হাসতে হাসতে) দাদামণি, মানে আমার দাদামশায়ের কাছে ছোট্টবেলা থেকে মানুষ হয়েছিলাম তো। বেথুন কলেজে ইংরেজিতে অনার্স পড়তাম। হীরুবাবুর মতো লোক বাড়িতে এসে সেতার শেখাতেন। ছোটো থেকে দাদামণির কোলে বসে কত রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছি। বাবার এসব পছন্দ ছিল না। তাই বাবা তাড়াতাড়ি কমরেড জামাই করে ফেললেন।
তৃণা বোধহয় সামান্য অধৈর্য্য হয়ে প্রশ্ন করেছিল— 'কাঁথাটার কি হল বলো না।'
নির্মলা আবার তাকিয়ে ছিলেন ওই ছোট্ট ছবিটার দিকে। নিজের মনে বলতে শুরু করেছিলেন—কটা মাছ আছে কাঁথাটায়—কটা হলুদ রঙের আর কটা কমলা রঙের ফুল—কটা বড় বড় পাতা আর কটা ছোট ছোট পাতা—সারাদিন ধরে এই করত ডোডোটা। প্রায় তিনমাস বিছানায় শুয়ে ছিল তো টাইফয়েডে। সন্ধের দিকে শীত করে খুব জ্বর আসতো। লেপ কম্বলের সঙ্গে ওই কাঁথাটাও বেরিয়েছিল। আর ওটাই তখন হল ওর সবচেয়ে প্রিয় খেলার জিনিস। ভীষণ কল্পনাপ্রবণ ছিল তো। কাঁথার ধার বরাবর মাছ গুনতো ভিতরের কোনা ধরে ধরে বিভিন্ন রঙের ফুল আর পাখির হিসেব করত। সেগুলো নাকি আবার উড়ে যেত উড়ে আসত রঙ বদলাতো—কত রকমের কল্পনা— বলতে বলতে গলার স্বরটা হঠাৎ বুজে এসেছিল নির্মলার।
তৃণা বোধহয় দৃশ্যতই অপ্রস্তুতে পড়ে গিয়েছিল এই পরিস্থিতিতে। ঠিক সেই সময় দেওয়াল ঘড়িটাতে ঢং করে একটা বাজলো। নির্মলা তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিলেন— 'একটা বাজলো—দ্যাখতো কথায় কথায় কত বেলা হয়ে গেল—চল চল কিছু খেয়ে নিবি চল।'
তৃণা তখনও একদৃষ্টে তাকিয়েছিল ওই টেবিলে রাখা ছবিটার দিকে।
খাওয়ার টেবিলে বসে নির্মলা লক্ষ্য করেছিলেন এইসব কথার পর মেয়েটা যেন কেমন চুপ মেরে গেল। নির্মলা প্রশ্ন করেছিলেন—'কি হল—চুপ করে আছিস যে—আমার মনে হয় তুই আমায় কিছু লুকোচ্ছিস—লুকোচ্ছিস কেন রে—তুই আমায় দিদু বললি না—দিদুকে কিছু লুকোতে আছে—তুই এত ভালো মেয়ে—'
তৃণা বলেছিল—কি করে বুঝলে?
নির্মলা বলেছিলেন— 'বয়সটা কি কম হোলো রে—' আবার বলেছিলেন— 'বাড়ির লোকজনকে কখনো উৎকণ্ঠায় ফেলতে নেই—তাদের কত কষ্ট হয়—'
এই কথার উত্তরে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তৃণা বলেছিল— 'আমি তো একটু বাদেই চলে যাচ্ছি—'
নির্মলা তৃণার কথা সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন— 'আমি কি তাই বলেছি?—এখন কোত্থাও যাবে না তুমি—চুপচাপ ওই সোফাটায় গিয়ে বিশ্রাম করবে—'
তৃণা কেন কে জানে আর কোনো প্রতিবাদ করেনি। কোনো কথা না বলে সোফাটায় গিয়ে খবরের কাগজ মুখে নিয়ে বসেছিল।
নির্মলা ইচ্ছে করেই ডিভানটায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন— 'একটু জিরিয়েনি—তুই কাগজটা নিয়ে পাশে এসে বোস।'
নির্মলা নিশ্চিত ছিলেন যে— এ মেয়েকে বিশ্বাস করা যায়।
নির্মলার শুয়ে শুয়ে পুরোনো কত কথা মনে পড়ছিল—মনে পড়ছিল—এইতো সেদিন—সেইরাতে—কাঁপতে কাঁপতে ঢুকেছিল ডোডো—গায়ে কি জ্বর তার—ওই কাঁথাটাই মুড়ি দেওয়াতে গিয়ে দেখলেন ওর তলায় লুকোনো রিভলভার—জিজ্ঞাসা করলেন—'এ কিরে?' ঠিক সেই সময়েই বাইরে কড়া নাড়ার আওয়াজ এল—ডোডো ধড়মড় করে উঠে বলেছিল— 'ব্রতীন এসেছে—আমি এক্ষুনি আসছি'—তিনদিন বাদে বেলেঘাটার গলি থেকে পাওয়া গিয়েছিল ডোডোর দেহটা—একটা একতলা বাড়ির দেওয়ালের পাশে—সেই দেওয়ালে লেখা ছিল—সত্তরের দশক মুক্তির দশক...
আবার হঠাৎ মনে পড়তে লাগলো একেবারে ছোটোবেলার কথা—ভবানীপুরের দাদামণির বাড়ির সেই ছাদ—সন্ধের অন্ধকারে দাদামণির কোলে বসা—দাদামণির গলায়... 'এত সাধনা এত কামনা কোথায় গিয়ে মেশে'... কিছুই মানে বোঝা যেত না—শুধু ক্রমশ কালো হতে থাকা আকাশে একটা দুটো অজানা সাদা পাখির উড়ে যেতে দ্যাখা—
তারপরেই মনে হল মেয়েটার বোধহয় কেউ কোত্থাও নেই—তাই বাড়ির কোনো টান নেই—সম্পর্কে তো তাঁর নাতনীই বলা যেতে পারে—আজকের দিনটা মেয়েটাকে থেকে যেতে বললে কেমন হয়—অবশ্য কোনোভাবে যদি বাড়িতে খবর দিতে পারে—
এইসব ভাবতে ভাবতে নির্মলা যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কে জানে।
তাই নির্মলা জানতেন না, সেই সময়েই, ঠিক সেই সময়েই—তৃণা উঠে বসেছিল সোফা থেকে—খুব সন্তর্পণে—আর ওইরকমই নিশ্চুপে পা টিপে টিপে খাট থেকে নেমে এগিয়ে গিয়েছিল টেবিলটার দিকে—আস্তে করে সেখান থেকে তার ছোট্ট কাঁধের ব্যাগটা খুলে বার করেছিল একটা লেখার প্যাড আর পেন—তারপর সোফায় বসে লিখতে শুরু করেছিল এক অদ্ভুত তাড়নায়—
ঘড়ির কাঁটা খটখট শব্দ করে এপাশ ওপাশ দুলতে থাকল—বাইরে শীতের দুপুরের রোদ ক্রমশ নিস্তেজ হতে শুরু করল—গাছের ছায়াগুলি দ্রুত লম্বা হয়ে যেতে লাগল—আর ওই সাদা কাগজটায় একটি একটি করে ফুটে উঠতে থাকল কিছু অক্ষরসমষ্টি— 'দিদু, আমি চলে যাচ্ছি......' ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু নির্মলা তখনও অঘোর ঘুমে। লেখা হয়ে গেলে তৃণা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল নিদ্রিত নির্মলার মুখটিরদিকে—তারপর ওই কাঁথাটির দিকে—তারপর কি মনে করে যেন পরম মমতায় সেটিকে পাট করে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল কাঁথাটার গায়ের কারুকার্যগুলিতে—ঠিক সেই সময়েই ঢং করে একটা আওয়াজ শোনা গিয়েছিল ঘরের দেওয়াল ঘড়িটায়—তৃণা সচকিত হয়েছিল—সঙ্গে সঙ্গে সদ্য লেখা কাগজের টুকরোটা কাঁথাটার কোনা দিয়ে চাপা দিয়ে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তার ছোট্ট কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ির বাইরে...
এরপর?
এর একটুক্ষণ পরেই ঢং ঢং করে দেওয়াল ঘড়িটা সময় জানিয়ে দেবে যথাযথভাবে।
ধড়মড় করে উঠে বসবেন নির্মলা।
উঠে দেখবেন ঘরে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই।
দেখবেন পায়ের কাছে পাট করা কাঁথাটা।
এবং দেখবেন কাঁথাটার কোনা দিয়ে চাপা রাখা একটা ভাঁজ করা কাগজ।
কাগজটা অবশ্যই তুলে নিয়ে দেখবেন সেটা দু-পাতার একটি চিঠি।
মুক্তোর মতো হাতের লেখা। সঙ্গে সঙ্গে পড়তে থাকবেন সেই লেখাটা।
পড়বেন এবং স্তম্ভিত হবেন।
চশমা মুছে আবার পড়তে শুরু করবেন প্রথম থেকে।
—তারপর?
—তাহার পর?
—তাহার পর সব নিশ্চুপ।
—কেবল ওই দেওয়াল ঘড়ির পেণ্ডুলামটি সমানে দুলিতে থাকিবে—ঢংঢং ঢংঢং—যেন বলিতে থাকিবে—জানা নাই জানা নাই—
এইভাবে বরাবর একই কথা বলিতে থাকিবে দেওয়ালের ওই বহু পুরাতন অ্যাংলো সুইস ঘড়িটি...
সাথে সাথেই আমাদের গল্পের নটে গাছটি মুড়িয়া যাইবে...
আর তখন হইতেই কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি তৃণা ও নির্মলার স্বপ্নে অমলিন কথামালা হইয়া ভাসিয়া আসে—কখনো কখনো—পৃথিবীর কোনো অক্ষরসর্বস্ব গল্পই তাহার তল পায় না।
(পরবাস-৫১, জুন-জুলাই, ২০১২)