ছোটবেলা থেকেই ওর বিদেশে যাবার শখ। তাই পাত্র এন-আর-আই, নিউইয়র্কে থাকে শুনে বিয়েতে রাজিই হয়ে গেল সুলগ্না। দেখাশোনা আলাপ হয়ে গেল বিয়ের আগেই, দুই পরিবারের সবাই খুশি, অরিন্দম তো মুগ্ধই, সুলগ্নাও মনে মনে বেশ উত্তেজিত। কলেজ শেষ হয়ে গেছে, কলেজের প্রেমটাও ঠিক জমেনি, সুলগ্নার অ্যামবিশান খুব একটা বেশি কিছু নয়। ছোটখাটো একটা চাকরি ও করতে চায় কিন্তু কেরিয়ারের চেয়ে ঘরকন্নার দিকেই ওর মন বেশি। প্রথম চারটে বছর ওদের যেন হনিমুন করতে করতেই কেটে গেল। তারপর পাঁচনম্বর অ্যানিভার্সারির রাতে ওরা যখন কলকাতায়, একেবারে হঠাৎ করেই একটা অস্বস্তিকর আলোচনার শুরু—
'হ্যাঁরে টুটুন তোরা বাচ্চাকাচ্চার কথা ভাবিসনি এখনও?' টুটুন ওর ডাকনাম।
'না তো বেশ মজায় আছি, তাড়া কিসের?'
'তাড়া আছে বাপু, নাতিনাতনির মুখ না দেখে মরতে চাই না।'
সুলগ্না হেসে আকুল, 'এটা টুয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি মা, এত তাড়াতাড়ি কেউ মরে না।'
'না রে বেয়ান বলছিলেন। জানিনা বাপু বেশি দেরি করলে নাকি তারপর আর হয়না।'
'মা-আ'।
কথাটা সেদিন শেষ হয়েও হলনা, নিউইয়র্কে ফেরার আগে আরো ক'বার নাতিনাতনির অভাব নিয়ে মৃদু নালিশ শুনতে হল ওকে। অরিন্দম অবশ্য হেসেই উড়িয়ে দেয় এসব কথা, ছেলেমেয়ে না হলেই নাকি ভালো হয়। ওকে না জানিয়েই সুরক্ষার সব ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছিল শুধু। তারও বছরখানেক বাদে এক রাত্তিরে কথাটা আবার উঠল। ঘরের মধ্যে তখন টেলিভিশনের নীলাভ আলোর আমেজ, ওর শরীরের কোমল অন্দরমহলে অরিন্দমের ব্যস্ত অতিথি তখন আরামে ঝিমিয়ে পড়ছে।
'এই অরিন একটা কথা শোন। আমি কিন্তু অনেকদিন হলো প্রোটেকশন নেওয়া ছেড়ে দিয়েছি।'
'তো' অরিন্দম একটু হাঁপাচ্ছে, এই মুহূর্তে ওর মাথা কাজ করছে না।
'তো আমার এতদিনে প্রেগনেন্ট হয়া উচিৎ ছিল না?'
'তাই নাকি?' অরিন্দম ক্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকল যেন কথাটার মানেই জানেনা। হাসি পেয়ে গেল সুলগ্নার।
'খুব হয়েছে এখন ঘুমাও, কালকে কথা হবে।'
সেই কাল গিয়ে অনেক কাল হতে চলল, ব্যাপারটাও আর হাসি-ঠাট্টার রইল না। শুরু হয়ে গেল ডাক্তার, ওষুধ, ইঞ্জেকশন, বায়োপসি। আদরের সময়গুলো হয়ে উঠলো রুটিনবাঁধা যান্ত্রিক, উপভোগের বদলে আশঙ্কা আর একঘেয়েমি। জীবনের ছন্দটাই বদলে গেল ওদের। সারা মাস ধরে ওষুধগুলোর বিচ্ছিরি সাইড-এফেক্ট, অবসাদ, মাথাধরা আর মুড-সুইং, তারপর মাসের শেষে একরাশ হতাশা। এবারও নেগেটিভ, অর্থাৎ আবার ওই ক্লান্তিকর রুটিনের চাকা, টেলিফোনে পরিচিত বকবকানি আর দীর্ঘশ্বাস— ওঃ ভগবান আর কত দিন।
'আমরা একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করলে পারি না'।
'তুমি বড্ড অধৈর্য্ অরিন। ডাক্তার তো জবাব দেননি এখনো, তোমরা মা-ছেলে আমাকে আর একটু সময় দাও' নিজের গলাটা নিজেরই কেমন কর্কশ শোনাল কি? এতদিনে ওরা জেনে গেছে যে অরিনের দিক থেকে কোনো খামতি নেই, ওর দেহরসে বীজেরা অজস্র এবং সুঠাম, তাদের ছুটোছুটি, ব্যস্ততায় খুঁত নেই এতটুকুও। কিন্তু সুলগ্নার অন্দরমহলের লাজুক নায়িকারা বসেই রয়েছেন এক বিদঘুটে মোটা পর্দার ওপারে। সেই জন্যই কি এতটা জেদ চেপে গেছে, ব্যক্তিগত হারজিতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা— মাঝে মাঝে ভেবে পায় না সুলগ্না। দুবার ডাক্তার বদলেও, যখন কোনো মতেই তাদের বাইরে আনা গেলনা তখন অগত্যা ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের কথাটা উঠল। এবার পেট ফুটো করে সার্জনের পিপেট বার করে আনবে আধফোটা কুঁড়ির মতো সব ওভাম, তারপরে ল্যাবরেটরির পেট্রিডিসে শুরু হবে বীজেদের সঙ্গে তাদের কোর্টশিপ। যেমনি নাকি একজন আরেকজনকে ছুঁয়ে ফেলেছে, মোক্ষম ম্যাজিকে তারা মিশে যাবে একে অপরের অন্তরাত্মায়, জিনেরা শুরু করবে এক প্রিমিটিভ প্রলয়নাচন, আদিম আশংকার সঙ্গে মিলে যাবে অজানা ভবিষ্যতের অন্তহীন সম্ভাবনা। ঠিক সেই মুহূর্তেই তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে গর্ভের নরম অন্ধকারে।
'অরিন'।
'উঁ'।
'দেখেছো বাড়ির সামনের চেরিগাছটায় কুঁড়ি আসতে শুরু করেছে। আচ্ছা, তুমি ছেলে হলে খুশি হবে না মেয়ে হলে?'
'নো চয়েস টুটুন। তুমি আবার ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে বোসো না যেন।'
'টুইন হলে বেশ হয় না। একসাথে দুটো বড় হয়ে যাবে, আবার এইসব ঝামেলার মধ্যে যেতে হবেনা। একটা বাচ্চা হলে নাকি কিসব প্রবলেম হয়?'
'ফালতু টেনশন নিয়ো না তো? আরে বাবা অপারেশন বেবি ইজ সাক্সেসফুল, এখন রিল্যাক্স। দুদিন বাদেই তো সব জানতে পারবে। ডাক্তার বলেছেন টুইন হবার সম্ভাবনা খুব বেশি।'
'খুব আনন্দ হওয়া উচিৎ কিন্তু মনের ভিতর থেকে ভয়টা কিছুতেই যাচ্ছে না কেন অরিন?'
'বলিছি না রিল্যাক্স। অন্য কথা ভাবো, আমাদের নতুন বছরের প্রোগ্রাম, বেড়াতে যাওয়া এইসব।'
'অরিন বাচ্চাটা বাঁচবে তো? নাকি সেই সেবারের মতো?'
'টুটুন আমরা যে কেউই যখন-তখন মারা পড়তে পারি। ওই একফোঁটা ভ্রুণ থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা চিড়িয়াখানার জিরাফ — সবাই সমান অবস্থায় একই রকম ভালনারেবল। এটা চানসের ব্যাপার, ডাক্তার বলেছেন ওর বাঁচার চান্স যে কোনো স্বাভাবিক বাচ্চার মতোই।'
'হয়েছে হয়েছে ফিলোসফার সাহেব, এবার আমাকে খুব সাবধানে জড়িয়ে ধরো দেখি? আহা-রে এখন ক'মাস তোমায় উপোস করে থাকতে হবে।'
'আমার যন্তর তিন শিফটে চলছে অনেকদিন। কিছুদিন লক আউট গেলে ভালোই হবে বোধহয়। কিন্তু ডাক্তার যে বললেন ওটা কোনো ব্যাপার নয়।'
'না না তুমি বড্ড দাপাদাপি করো, কি হতে কি হয়ে যায় আবার। এখন রামনাম আর গান্ধীনাম করে কাটাও কিছুদিন, আধ্যাত্মিক উন্নতি হোক। বাবা হতে হবে না? আর শোনো, তিন মাসের আগে কাউকে কিছু বলবে না, বিশেষ করে তোমার মা'কে।'
দেখতে দেখতে ঘুরে গেল বছরটা। বেবি শাওয়ারের নেমন্তন্ন, দেশ থেকে বাবা-মা-শ্বশুর-শাশুড়ির আগমন, অফিসে হইচই, ফেসবুকে অভিনন্দন, সন্ধ্যাবেলা ব্লগ লেখা, ঘর সাজানো, রাজ্যের বই, ম্যাগাজিন আর ম্যাটারনিটি ড্রেস, সব কিছুই হয়ে চলল কেতামাফিক। শীতের শেষের দিকে তখনও চেরিগাছেরা সাড়া দিতে শুরু করেনি, সুলগ্না হাসপাতালে ভর্তি হল। নানারকম ঝামেলায় শেষ তিন মাস ও খুব ভুগেছে —রক্তের চাপ বেশি, অ্যানিমিয়া, বাচ্চা ছোটো, আরো কি কি যেন সব। ওই সময়ে অরিন্দম অনেকটা সময় কাটাতো হাসপাতালের কাফেটেরিয়ায়। অশোকের সঙ্গে সেখানেই ওর আলাপ। দুজনেরই বউ ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডে ভর্তি, দুজনেই যদুবংশের সন্তান, অর্থাৎ যাদবপুর ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র, দুজনেই প্রথম বাবা হবে। অশোক একটু চুপচাপ ধরনের, অনেকক্ষণ বই মুখে নিয়ে বসে থাকতে পারে। ওর বৌদি রিমলি একেবারে উলটো, সারাক্ষণ তার খুনসুটি আর হাসিঠাট্টা, ওকে পেয়ে সুলগ্নাও ভরসা পেয়েছে, নার্ভাসনেসটা বেশ একটু কমেছে ওর। দুটো নতুন আনন্দের বাণ্ডিল নিয়ে বাড়ি গেল ওরা সবাই। অরিন্দম-সুলগ্নার ছেলে হয়েছে, অশোক-রিমলির মেয়ে। দুই পরিবারে এখন গলায় গলায় বন্ধুত্ব। জীবননদী এখন কলকল করে বয়ে চলবে আরো কয়েক বছর।
অরিন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে যাও, অশোক ভর্তি হয়েছে, ইনজিওরড। একটা ট্রাকের সঙ্গে ওদের গাড়ির ধাক্কা লেগেছে।'
'আবার অ্যাক্সিডেন্ট! রিমলি কোথায়? বাচ্চাটা?'
'তানিয়া আমার কাছে আছে। রিমি এমারজেন্সিতে'।
হাতের কাজটা কোনোরকমে শেষ করে দৌড়লো অরিন্দম। এমারজেন্সির একপ্রান্তে বসে আছে রিমলি, তার সঙ্গে দুজন পুলিশ অফিসার। একটা হাতাছেঁড়া টি-শার্ট গায়ে রিমলিকে ঝোড়ো কাকের মতো লাগছে, কাঁধে আর কব্জির কাছটায় ব্যাণ্ডেজ। রীতিমতো শক পেয়ে আছে মেয়েটা, হাত কাঁপছে থরথর করে, এদিকে পুলিশ দুজন জেরা করার মুডে।
'ম্যাডাম আপনার কি মনে হয় না যে এটা রেকলেস ড্রাইভিং, নাহলে এক মাসের মধ্যে দুদুটো অ্যাক্সিডেন্ট হলো কিভাবে? ঠিক করে বলুন আপনার স্বামী কি ধরনের নেশা করেন? ওনার কি চাকরি চলে গেছে? উনি কি আপনাকে মারধর করেন? মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে কি উধাও হয়ে যান?'
রিমলি কিছুরই ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারছে না। অরিন্দম এসে আস্তে আস্তে অবস্থাটা সামাল দিল। 'দেখুন এই মুহূর্তে উনি কিছুই বলতে পারবেন না। নেশা করার কি প্রমাণ আপনারা পেয়েছেন? পেশেন্টের রক্তে তো অ্যালকোহল পাওয়া যায়নি, ইউরিন ড্রাগ টেস্টও নেগেটিভ। এখন আমরা পেশেন্টকে সুস্থ করার দিকে মন দিই, কাল সকালে নাহয় আবার কথা হবে। এই নিন আমার কার্ড।' অরিন্দমের কার্ডে একটা নামকরা ইউনিভার্সিটির নাম, সেটাকে সবাই একটু সমীহ করে এই এলাকায়। পুলিশ রেহাই দিল ওদের শেষ অবধি।
'চিন্তা করোনা আমি ল'ইয়ারকে ফোন করেছি, তুমি আমার সঙ্গে বাড়ি চল এখন। তানিয়া ঠিক আছে, ঘুমোচ্ছে, টুটুন ফোন করছে তোমায়।'
রিমলি এতক্ষণ শক্ত করে ধরে ছিল অরিন্দমের হাত, ওর হাতের পাতা ঠাণ্ডা আর ভিজে। এবার কাঁপা আঙুলে ফোনটা ধরল। অশোক ঘুমোচ্ছে, একটু বাদে ওর ব্রেইন স্ক্যান করা হবে।
সুলগ্না এমনিতেই নার্ভাস, সবকিছু শুনে আরো অস্থির হয়ে পড়ল।
'সত্যিই কি ওর কিছু হয়েছে?'
'আমি জানি না। ওর ব্যবহার কিছুটা বদলেছে সত্যিই। আরো চুপচাপ, মাঝে মাঝে যেন কেমন একটা অদ্ভুত কনফিউসড দৃষ্টি। অফিসের কাজেও বেশ ঝামেলা চলছে। প্রায়ই মাথাধরার কথা বলে, জানা জিনিস ভুলে যায়। কিন্তু নেশাটেশা করতে তো কখনো দেখিনি, ওই যা উইকএণ্ডে তোমাদের সাথেই বসে একটু আধটু হুইস্কি।'
'অ্যাক্সিডেন্ট যখন হল, তখন কি ও সুস্থ ছিল?'
'না, ও বোধহয় বসে বসেই অজ্ঞান হয়ে গেছিল, মুখ থেকে একটা গোঙানির মতো আওয়াজ শুনছিলাম, গাড়ির ওপর কোনো কন্ট্রোলই ছিল না। চোখের সামনে দেখলাম ট্রাকের পেছনটা এগিয়ে আসছে। কি ভয়ানক ভেবেছিলাম দুজনেই মরে যাব, মেয়েটার কি হবে কে জানে, উঃ মা, মাগো' এতক্ষণে কাঁদছে রিমলি, এলোমেলো খোলা চুলে ওর মুখটা ঢেকে গেছে, চোখ ছাপিয়ে নামছে জলের ধারা। অরিন্দম টের পেল ওর মনের কোনায় কিসব যেন পুরোনো শিরশিরানি, একেবারে অসংলগ্ন কিছু এলোমেলো চিন্তা উঁকি মারছে। এক ঝটকায় ওগুলোকে তাড়িয়ে দিয়ে দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে চাইল সে।
'রিমি, ওকে নিউরোলজিস্ট দেখছে, খুব সম্ভবতঃ ওর এপিলেপসি ধরনের কোনো অসুখ হয়েছে, চিকিৎসা করালেই সেরে যাবে। এখন চলো কিছু মুখে দাও, নিজের স্বাস্থ্যটাও তো দেখতে হবে। হাতে ব্যথা করছে নাকি? ডাক্তার ব্যাটা কেবল লেকচার দিল, ওষুধ দিলনা কিছু? চল টুটুনের সাথে কথা বললে ভালো লাগবে তোমার। এই তো এসে গেছি, এবার কান্নাটা থামাও প্লীজ, তোমার মেয়ে ভয় পেয়ে যাবে'।
পরের দিন সকালেই সব প্রশ্নের উত্তর মিলে গেল। অশোকের ব্রেইন ক্যান্সার হয়েছে —বিকট একটা নাম, গ্লায়োব্লাস্টোমা মালটিফরমিস। সার্জারি হবে, তারপর রেডিয়েশন আর কেমোথেরাপি, কিন্তু এ অসুখ সারবার নয়। এখন থেকে জীবন হয়ে উঠবে একটা অন্ধকার ভয় দেখানো কানাগলি।
বছরখানেক বাদে একটা শান্ত বিকেলবেলা, অফিস থেকে ফিরে চুপচাপ বসে ছিল সুলগ্না। সদ্য একটা খারাপ খবর পেয়েছে ও, অপেক্ষা করে আছে কখন অরিন্দম বাড়ি আসবে। তার আগে ওর মনে যেন কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই, একদম একটা খালি খালি ভাব। ডাক্তারি রিপোর্টটা হাতের নাগালেই, ল্যাপটপটাও সামনে, তবু একা একা খবরটা নিয়ে রিসার্চ করতেও ইচ্ছে হচ্ছে না ওর। অরিনের কাছে খবরটা পৌঁছে দিলেই যেন নিশ্চিন্তি, বাকিটা ওই যে করে হোক সামলে দেবে, যেমন সবসময় দেয়। এরই নাম কি ভরসা, ডিপেনডেনস, দশ বছর ধরে এই প্রতিদিনের ছায়ারোদ্দুরে লুকোচুরি? সুলগ্না কি আর একলা একলা কিছু করতে পারবেনা, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লেও না? অরিন ফেরার আগে শুধু এই বুকের মধ্যে ঠাণ্ডা অনুভূতি আর গলার কাছে শিরশিরানি নিয়ে বসে থাকা।
'ধ্যাৎ, এটা কিছু নয়, ম্যামোগ্রামে অনেক কিছু উল্টোপালটা দেখায়। তবে বায়োপসি করতে বলছে করিয়ে নাও। আচ্ছা দেখি দেখাও তো একবার।' অরিন্দম খুব একটা চিন্তিত নয় মনে হল। এটা আদর নয়, এখানে কোনো উত্তাপ নেই কিন্তু আশ্বাস আছে—প্রখর আলোয় খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবল সুলগ্না। অরিন্দম কি বুঝলো কে জানে কিন্তু বায়োপসি করানোই ঠিক হল। বাঁ দিকের বুকে একটা টিউমার দেখা দিয়েছে।
'আমার ভীষণ ভয় করছে অরিন। আমারও অশোকের মতো ক্যান্সার হল? আমি সিগারেট খাইনা, মদ খাইনা। আমিও ওর মতো হয়ে যাবো, ধুঁকতে ধুঁকতে অপরের বোঝা হয়ে বাঁচতে হবে।' হাসপাতাল থেকে ফিরে সুলগ্না একেবারে ভেঙে পড়েছে।
'না টুটুন না, এই দুটো অসুখই ক্যান্সার বটে কিন্তু এদের স্বভাব একেবারে আলাদা। অরিন্দমের যা হয়েছে তোমার তা নয়। ডাক্তার এক ঘন্টা ধরে এতো যে বোঝাল, সব ভুলে গেলে। ব্রেস্ট ক্যান্সার অনেক সময়েই সেরে যায়। শুনলে না, এর সাথে ফিমেল হরমোনের সম্পর্ক আছে, সম্ভবত তোমার ইনফার্টিলিটি ট্রিটমেন্টের সময়ে, গুচ্ছের ওষুধ নেবার ফল। ওরা আরেকটা ওষুধ দিয়ে তোমার হরমোন কমিয়ে দেবে, ব্যাস হয়ে গেল।'
'ওরা আমার বুকে অপারেশন করবে, রেডিয়েশন দেবে, কেমোথেরাপি নিয়ে আমার চুল উঠে যাবে, তারপর হরমোন কমাবার ওষুধ দিয়ে ওরা আমার মেনোপজ করিয়ে দেবে, আমি কুচ্ছিৎ বুড়ি হয়ে যাব। তারপর আমার আর কি বাকি থাকবে অরিন? তোমার জীবনটাও তো নষ্ট হয়ে যাবে।'
'আমার কথা তোমায় ভাবতে হবেনা, বুবাইয়ের কথা বরং ভাবো। মা ছাড়া ছেলেটার একদিনও চলেনা, ওর জন্যই তোমাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। আমি দিব্যি থাকব, উই আর ইন দিস টুগেদার।'
সুলগ্নার চোখের দৃষ্টিটা কেমন অস্বাভাবিক হয়ে গেল, 'ঠিক বলেছো অরিন, আমি যেভাবেই হোক বেঁচে থাকব দেখো। থাকতেই হবে, মনের জোরে সব কিছু করা যায়। এত কষ্ট করে যে সন্তানকে এই পৃথিবীতে এনেছি তাকে মানুষ করে তোলার আগে মরার প্রশ্নই ওঠেনা। ইট ইস নট ফেয়ার, তাই না অরিন।'
হাসপাতালের কাছেই সদ্য একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া দুটো গাড়ি, চারদিকে পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স। চোখের সামনে এক বছর আগের দৃশ্যটা ভেসে উঠল অরিন্দমের। ড্রাইভ করতে করতে ও শুনতে পাচ্ছে মাথার ভিতর একটা পুরোনো বিপদ সংকেত। সুলগ্না আবার ভাগ্যের সাথে দরাদরি করছে। কে বলেছে জীবনটা ফেয়ার টুটুন, কে বলতে পারে যে আমরা আগাগোড়াই কোনো নিষ্ঠুর, নিয়ন্ত্রণহীন জুয়াখেলার আসরে বসে নেই। সেখানে শুধু হারজিত আছে, ন্যায়বিচারের দাবি হাস্যকর। কিন্তু এসব কথা তো মুখে আনার কথা নয়, অরিন্দম প্রাণপণে ওকে আশ্বাস দিয়ে চলল সারাটা পথ। বাড়ি ফিরেই খুব করে আদর করল ওকে, নিজের উৎসাহে নিজেই অবাক হয়ে গেল কেমন। শেষ অবধি ক্লান্ত হয়ে সুলগ্না এলিয়ে পড়েছে, লিপস্টিক মুছে নেওয়া ওর ঠোঁটে একটুখানি হাসির আভাষও দেখা দিয়েছে বোধহয়। যত্নে হাইলাইট করা ওর কালো-বাদামি চুল বালিশের ওপর ছড়ানো। খোলা বুকের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, বাঁ দিকের একটা জায়গা খসখসে আর অসমান, ঠিক কমলালেবুর মতো। এইখান থেকে জীবনটা হয়ে যাবে ঠিক যেন একটা বিদঘুটে বেঁকে যাওয়া আয়না।
'কেমন আছে অশোক?'
'ভালো নয়। টিউমারটা আবার বেড়েছে, ডান দিকটায় একেবারে জোর পাচ্ছে না। সামনের মাসে আবার হিউস্টন যেতে হবে।' রিমলি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল।
'তানিয়াকে আমরা রেখে দেব। বুবাই খুশি হবে। একেবারে মনমরা হয়ে থাকে ছেলেটা।'
'অসুবিধা হবে না তোমাদের। টুটুনও তো ভালো নেই।'
'অশোকের তুলনায় ভালো। বাই দা ওয়ে তোমাদের ট্যাক্সের কাগজপত্র হয়ে গেছে, এই নাও। বাচ্চাদের কারাটে ক্লাসে আমি নিয়ে যাব, তুমি বরং ফেরৎ নিয়ে এসো' অরিন্দম একটা মোটা খাম বাড়িয়ে দেয়।
রিমলি জানে অরিন্দমই ঠিক সময়ে ওদের ফেরৎ আনবে। ওর সজাগ দৃষ্টি আর নিখুঁত প্ল্যানিং দুটো কেন, দরকার হলে দশটা সংসার সামলে দিতে পারে। প্রতিটি ওষুধপত্র, অ্যাপয়ন্টমেন্ট, বাচ্চাদের পড়াশুনা, বিল, চিঠি, মর্টগেজ, ঘাস কাটা, কার্পেট ভ্যাকুয়াম, কোনোটায় এক ফোঁটা খামতি চোখে আসবে না। বেচারা রিমলিকেই বাইরের কাজ সব নতুন করে শিখতে হবে। হায় ভগবান ওর যে গাড়ি চালাতেও নার্ভাস লাগে এখনো।
'এই তো জানু পেতে বসেছি পশ্চিম আজ বসন্তের শূন্য হাত ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও। আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।'
কবিতার বইটা বন্ধ করে একপাশে সরিয়ে রাখল সুলগ্না। বাইরে একটা রংবেরঙের চেরিফোটা বসন্তের রবিবার। সকালবেলায় ওরা দুজন বিছানায় আধশোয়া, মাঝখানে বুবাই এখনো ঘুমের দেশে, কাল অনেক রাত অবধি টিভি দেখেছে ছেলেটা।
কেন এটা রিল্যাপস করল অরিন? আমি তো সব করলাম — সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন। আচ্ছা তোমার কি মনে হয় ইনফার্টিলেটির চিকিৎসা করতে গিয়েই এটা হল?'
'না টুটুন। আমরা নানারকম অবস্থার মধ্য দিয়ে যাই, তার জন্য নানারকম ঝুঁকি নেবার দরকার পড়ে। তোমার বা অশোকের যা হয়েছে র্যান্ডম আনফরচুনেট ইভেন্ট হিসাবেই হয়েছে, আমরা যথাসাধ্য এই বিপদটার সঙ্গে লড়ব কিন্তু শেষ অবধি কখন কার কি হবে সেটা প্রেডিক্ট করা অসম্ভব। এই অনিশ্চয়তাটা শুধু তোমার ক্ষেত্রে সত্যি নয়, আমাদের সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। সাধারণত ওটা আমরা বেমালুম ভুলে থাকি। মহাভারতে বলেছে না কিমাশ্চর্য্যমতঃপরম।'
'বুবাই একটু বড়ো হয়ে গেলে তারপর আমার মরতে কোনো আপত্তি নেই অরিন। আচ্ছা ডক্টর তো বললেন এটা হেরেডিটারি নয়, ওইসব হরমোন নেবার ফলে বুবাইয়ের কোনো ক্ষতি হবে না বলো?'
'সম্ভবত না তবে ক্ষতি হলেও তো কিছু করার নেই, ওকে তাই নিয়েই বাঁচতে হবে।'
'আমারই কেন এমনটা হল অরিন? আমার কি সুন্দর একটা জীবন ছিল?'
অরিন্দম জড়িয়ে ধরল ওকে। অনেক আদর অনেক আশ্বাস, অনেক পাশে থাকার, ভালো করে তোলবার প্রতিজ্ঞা, কমপিউটারে নতুন আবিষ্কারের খোঁজ —ওদের ছুটির দিনগুলো এখন এভাবেই কাটবে। গড়িয়ে গড়িয়ে চলবে দিন, মাস, বছর।
'আমি কিছুতেই মরবো না, এখন আমার মরার সময় হয়নি, আমাকে বুবাইয়ের জন্য বাঁচতে হবে। তুমি দেখো ওর কিছু হবে না, হি উইল বি হেলদি। আই মাস্ট মেক সিওর অরিন। অরিন প্লীজ ডোন্ট লেট মি ডাই।'
কাফের বাইরে ঝিমঝিমে বৃষ্টি পড়ছে, ছাতাওয়ালাদের ভিড়, ভেতরটায় কুসুম কুসুম গরম আর টাটকা কফির গন্ধ। শুক্কুরবারের এই বিকেলবেলা, ইউনিভার্সিটির একগাদা ছেলেছোকরা তাদের ল্যাপটপ আর বইপত্র নিয়ে এখানে গুলতানি জমায়। দুকাপ ক্যাপাচিনো নিয়ে ওরাও একটা কোনায় বসেছে — অরিন্দম আর রিমলি।
'আচ্ছা রিমি তুমি মানুষটা কি সাবধানী টাইপের না ঝুঁকি নিতে ভালোবাসো?'
'হঠাৎ আজকে এই প্রশ্ন?'
'জানার দরকার আছে। আমি বিজনেস ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক, কারো সাথে কাজ করতে হলে আগেই বুঝতে হয় যে সে হার্ম-অ্যাভয়ডেন্ট না রিস্ক-টেকার। পাগল আর কবি-আর্টিস্টদের বাদ দিলে, দুনিয়ার বাকি সবাইকেই এই দুভাগে ভাগ করা যায় কিনা।'
'যাব্বাবা। আমি আবার কবে ব্যবসা শুরু করার কথা বললাম।'
রিমলি মাথা ঝুঁকিয়ে কফি খাচ্ছিল, এবার চোখ তুলে হাসলো একটু। ব্যথাবিদ্ধ হাসি। অরিন্দম এটারই অপেক্ষায় ছিল।
'সবই ব্যবসা রিমি। সারা হপ্তার কাজ, মর্বিড আশঙ্কা আর একঘেয়েমির পর এই যে শুক্রবার বিকেলে আমরা বাচ্চাদের কারাটে ক্লাবে জমা করে কফি খেতে বসি— এটা একটা ব্যবসা। আমরা দুটো স্বাভাবিক কথাবার্তা লেনদেন করি। অশোক আর নিজে নিজে ওর ইনসিওরেন্সের কাগজপত্র দেখতে পারেনা, ওগুলো বুঝতে তোমায় সাহায্য করি, ওর পোর্টফোলিওগুলো দেখে দিই — একটা ব্যবসা। তুমি রান্নাকরা খাবার নিয়ে আসো টুটুনের জন্য কিন্তু খেয়াল রাখো যে আমি কি খেতে ভালোবাসি— এও একটা ব্যবসা বইকি। যা কিছু এই জীবন-যন্ত্রটাকে চালু রাখে তার সবটাই কি দেওয়া-নেওয়া নয়।
'আমি তো জানতাম এটা বন্ধুত্ব, ফেলো ফিলিংস।'
'বন্ধুত্বই তো। কিন্তু শুধু শখের বন্ধুত্ব নয়, যত দিন যাচ্ছে, ওরা যত অসুস্থ হয়ে পড়ছে, আমরা পরস্পরকে আরো বেশি করে ব্যবহার করছি। তাই এটা পার্টনারশিপ।'
আমরা আর ওরা, দুজন সুস্থ আর দুজন অসুস্থ— সম্পর্কগুলোর মাঝখান দিয়ে এমন একটা শ্রেণীবিভাগ অরিন আগেও দু-একবার করেছে কি? ভাবার চেষ্টা করে দেখল রিমলি। করলেও ও বরাবর চুপ করে থেকেছে বোধহয়। আজকাল পার্টিতে, জমায়েতে ও চুপচাপ থাকতেই ভালোবাসে। কোনো হাসির কথায় হেসে উঠতে গিয়েও থমকে যায়। ও লক্ষ্য করেছে যে হাসলে চারপাশের লোকেরা অনেক সময় ফিরে তাকায়। যার স্বামীর এখন-তখন অবস্থা তার হি হি করে হেসে ওঠাটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। অশোক তো কোথাও যেতেই পারেনা, হুইলচেয়ারে বসে ঝিমিয়ে আর কম্পিউটারে খুটখাট করেই দিনগুলো কাটে ওর। অরিন্দমও আগের তুলনায় অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে কিন্তু সুলগ্নাকে দেখে অসুস্থ বোঝাই যায়না, বরং আগের চেয়েও যেন বেশি হুল্লোড়ে, হাসিখুশি, সবসময়ে ইয়ার্কি দিচ্ছে। কতবার কেমোথেরাপি নিয়ে চুল পড়ে গেল, আবার চুল উঠলো, ওর চালচলনে কোনো পরিবর্তন হলনা, এমনকি রিল্যাপস করার পরেও নয়। ওর মুখে সবসময় একটাই কথা— আমি এখন মরছিনা, বাচ্চাটাকে বড়ো করে তবে মরবো, দেখে নিস তোরা।
'তুমি চুপ করে আছো মানে কথাটা পছন্দ হয়নি। আচ্ছা উইথড্র করছি। তার চেয়ে বলো তানিয়ার স্কুল কেমন চলছে, অশোকের নেক্সট অ্যাপয়েন্টমেন্ট কবে?'
'আই অ্যাম আ রিস্ক টেকার অরিন। আর ইউ?'
খুব আস্তে বলা কথাটা বাউনসারের মতো মুখের ওপর এসে পড়লো, অরিন্দম ডাক করার সময় পেলনা। ঘায়েল হওয়া ব্যাটসম্যানের মতো তাকিয়ে থাকল পরের বলটার অপেক্ষায়।
'কেউ অসুস্থ হয়ে বা দুর্ঘটনায় মারা গেলে, সমাজ তার প্রিয়জনদের জন্য একটা শোকের নিয়ম বেঁধে দিয়েছে— এখানে সাহেবরা যাকে বলে বিরিভমেন্ট। সেই সময়টার পরে সে আস্তে আস্তে স্বাভাবিকতার দিকে যাবে এটাই সবাই আশা করে তাইনা? আমাদের প্রিয়জনেরা, তোমার স্ত্রী, আমার স্বামী— এরা তো বেঁচেই আছে কিন্তু সেই বেঁচে থাকার ডাইমেনশন আলাদা। আমাদের ক্ষেত্রে সমাজ কি আশা করে অরিন? কিসের ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকি নিতে চাও তুমি?'
অরিন্দমের বুক দুরুদুরু করে উঠলো। পরের বলটা কি নিয়ে আসছে কে জানে।
'তুমি কি জানতে চাও তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগে কিনা। তুমি জানো লাগে, জানো ওই সময়টুকুর জন্য আমরা দুজনেই মুখিয়ে থাকি। আমাদের সব কমিটমেন্ট, সব ক্লান্তি আর অপরাধবোধ ঘাড়ে নিয়েও এই কফিশপের কয়েক ঘন্টা আমরা এনজয় করি। আমরা নদীর পারে বসে আছি কিন্তু জলে তো এখনো নামিনি। অনুভূতি জিনিসটা কেউ মাপতে পারেনা, কিন্তু দুটো শরীর কাছাকাছি হলেই সমাজের টিকি খাড়া হয়ে ওঠে। ভালোমন্দের ক্যালিব্রেট করা মাপকাঠি তৈরি হয়ে যায়, তখন থেকে সবকিছু ওয়েল-ডিফাইণ্ড। স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতার দেওয়া যে সোজা নয় তা তুমি বেশ জানো। ভেবে দেখো, পালিয়ে যাচ্ছিনা, কিন্তু কষ্টও আর বাড়াতে চাই না অরিন।'
'থ্যাঙ্ক ইউ রিমি। আমিও কষ্ট বাড়াতে চাইনা। কিন্তু কথাটা বলতে পেরে ভালো লাগল। জলে যদি কখনো নামি, সাঁতার কাটতে ভয় পাবনা, স্রোত যেদিকেই থাকুক না কেন।'
'ছোট আলোটা জ্বেলে দাও রিমি। সারাদিন অন্ধকারে ভূতের মতো বসে আছি।'
'কি করবে বল দিনটাই মেঘলা। বাইরে যাবে। চল বারান্দায় নিয়ে যাচ্ছি।'
'না ঠাণ্ডা লেগে যাবে। জ্বর হলে ওরা যদি আবার ওষুধটা বন্ধ করে দেয়।'
'তাহলে বসে টিভিতে একটা ভালো সিনেমা দেখি এসো। নতুন বাংলা সিনেমাগুলো বেশ ভালো হচ্ছে। তানিয়া খেয়েছে? ওর হোমওয়ার্ক দেখে দিলে কিছু?'
'নাঃ আমি ওসব পারিনা, বিরক্ত লাগে মাথা ধরে যায়। তুমি এত দেরি করে ফেরো আজকাল যে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ে।' অশোকের গলা শুকনো ফ্যাসফ্যাসে।
'কাজ থাকে গো। দাঁড়াও আমি দেখছি ও কি করছে।'
'কাজ মানে তো অরিন্দমের বাড়ি গেয়ে গপ্পো করা।'
'আমি আর ওদের বাড়ি যাইনা খুব একটা অশোক। তুমি তো জানো টুটুন রিল্যাপস করেছে, সি ইজ ভেরি আপসেট।'
'ও তাহলে বাড়ির বাইরেই দেখা হচ্ছে আজকাল।'
'দেখা করি যদি কাজ থাকে। তুমি না চাইলে আর করব না।'
'ঠাট্টা করছিলাম'। অশোক একটা দুর্বোধ্য হাসি হাসলো। 'যাকগে ওসব ফালতু কথা, আমার ফাইলগুলো সব ঠিক করে রেখো। কালকে ফলো-আপ আছে। হয়তো নতুন কোনো এক্সপেরিমেন্টাল ড্রাগ— কম্পিউটারে অবশ্য কিছুই দেখছিনা। এখানে কিছু না হলে আর একবার হিউস্টনে যেতে হবে।'
বাঁহাত দিয়ে হুইলচেয়ার ছেঁচড়ে মানুষটা আবার কম্পিউটারে গিয়ে বসল। শরীরের ডানদিকটা অদ্ভুতভাবে গুটিয়ে আছে। কম্পিউটারের পর্দায় হাজার রকম ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আর নতুন ওষুধের খবর। অনেক রাত অবধি ওইভাবে থেকে হুইলচেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়বে ও, তখন রিমলি ওকে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাবে, ওষুধ খাওয়াবে, তারপর গুঁজে দেবে বিছানায়। প্রায় রাত্তিরেই ও উঠে গিয়ে মেয়ের কাছে শোয়। ঘুম জড়ানো গলায় দু-একটা কথা হয়, তারপর মেয়ের গায়ে লেগে থাকা হালকা সুগন্ধটায় নিঃশ্বাস নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়ে রিমলি। আজকে অবশ্য ঘুম আসতে চাইছেনা, রিমলি ওর আইপ্যাড নিয়ে বসল। যে ফোনটার আশা করেছিল সেটা এল রাত একটা নাগাদ, বাড়িটা ততক্ষণে নিঝুম। নাইটস্ট্যাণ্ডের ওপর নিঃশব্দে হামা দিয়ে বেড়াচ্ছে ওর মোবাইল।
'ঘুম ভাঙালাম, সরি।'
'তোমার যেমন ঘুম হচ্ছে, আমারও ওইরকম।'
'তানিয়া জেগে গেল না তো'।
'না আমি ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম।'
'তার মানে ফোনটা আশা করেছিলে।'
'হয়তো।'
'অশোক কেমন আছে?'
'ভালো। কাল তো তোমরা নিউইয়র্ক যাচ্ছ, তাই না?'
'যাচ্ছি বটে কিন্তু টুটুনের শরীরটা একদম ভালো নয়। শ্বাসকষ্ট বেড়েছে, ব্যথার ওষুধের মাত্রা বাড়াতে হয়েছে। সবচেয়ে চিন্তার কথা ও একেবারে নিশ্চিন্ত যে এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ও কোয়ালিফাই করবে, আর নতুন ওষুধটা নিলেই এক্কেবারে ঠিক হয়ে যাবে। ওর এই অপটিমিজম দেখে সবাই ধন্য ধন্য করে, ওর বাবা-মা'র দৃঢ় বিশ্বাস ও সেরে উঠবে কিন্তু--'
'তুমি জানো এটা ডিনায়াল। তোমার ভয় হয়, জানি অরিন। কিছু করার নেই।'
'কমপ্যাশন জিনিসটা কতখানি পাওয়ারফুল রিমি? এই অবসাদ, কেমন একটা নেগেটিভ ফিলিংস, এটা কি ইনহিউম্যান নাকি এটাই স্বাভাবিক?'
তোমার কথা জানি না। তবে যে অশোককে আমি জানতাম তাকে নিয়ে আমি বোধহয় ক্লান্ত হতাম না। সেই মানুষটা তো আর নেই। এখন ওই নামের যাকে নিয়ে আমার দিন কাটে সে একেবারে আলাদা লোক। অসুখ, চিকিৎসা, মৃত্যুভয়, বিরক্তি, সন্দেহ, অসহায় ক্রোধ — এইসব নিয়ে ও এক অন্য অশোক। প্রতিদিন সেই মর্বিড আধাখেঁচড়া অস্তিত্বটাকে রবারের মতো টেনে লম্বা করা। আমি কিন্তু ওকে দোষ দিচ্ছি না। হয়তো ওর অবস্থায় পড়লে আমিও ওইরকম হয়ে যেতাম। কে জানে? তবে আমার মনে হয় সহানুভূতির চেয়ে কর্তব্যবোধ বেশি পাওয়ারফুল। আবার কর্তব্যবোধের চেয়েও পাওয়ারফুল প্যাশন। কিন্তু প্যাশন তো ভূমিকম্প বা সুনামির মতো অরিন, ওটা ওয়ার্নিং দিয়ে আসেনা, যুক্তির ল্যাবরেটরিতে ওকে বানিয়ে তোলা যায়না। তার চেয়ে এসো অপেক্ষা করি, আরেকটু সময় — আরো কিছুক্ষণ।
এত কথা গুছিয়ে বলতে পারল না রিমলি। চুপ করে থাকা তার চেয়ে অনেক সহজ।
'নিউইয়র্ক থেকে ফিরে ফোন করব। রাখছি।'
'তুমি আজকাল রিমলিদের সাথে অনেক সময় কাটাও তাই না।'
'নতুন কিছু তো নয়। অশোক এখন পুরোপুরি ডিসএবলড, রিমলির নতুন চাকরি, বাচ্চাটা বড় হচ্ছে। দে নিড আ লট অফ হেলপ।'
'আরো তো বন্ধুবান্ধব আছে। একজনের ওপর পুরোপুরি ডিপেণ্ড করা কি ভালো?'
'তোমার বাবা-মা আসার পর থেকেই তুমি রিমলিদের ব্যাপারে একটু বেশি সেনসিটিভ হয়ে পড়েছো না।'
'এর মধ্যে বাবা-মাকে টানছো কেন?'
'কারণ ওঁরা সবসময়ে আমাকে মনিটর করছেন। কিছুতেই যেন তোমার যথেষ্ট কেয়ার নেওয়া হচ্ছে না। তুমি জান তোমার ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে আমার কোনো গাফিলতি কোনোদিন ছিলনা, এখনো নেই।'
'তুমিও আজকাল খুব সেনসিটিভ হয়ে পড়েছ অরিন। বাবা-মা'র কষ্টটা বোঝার চেষ্টা কর। ওদের বয়েস হয়েছে, সবসময়ে হয়তো লজিক মেনে কথা বলতে পারেন না। তাছাড়া লোকেও নানা কথা বলে।'
'জানি। বিশেষ করে তোমার বাবা-মা'র কাছে এসেই সেসব কথা হয়। কিন্তু তুমি তো এসব আগে পাত্তা দিতেনা, এখন বুঝি আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছ।'
'এখনো শুরু করিনি, আশাকরি বাকি জীবনটুকু না করেই কাটাতে পারব। অরিন দিস ইজ নট মাই ফলট। আমি একটা বাচ্চা চেয়েছিলাম। সবাই চায়। কিন্তু তোমার এই অস্বাভাবিক জীবন, হাসপাতালে দৌড়দৌড়ি, সারাদিন একটা অসুস্থ লোককে নিয়ে থাকা। এসব তো আমি ইচ্ছা করে তোমার ওপর চাপাইনি। সেবা করতে করতে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছো আমি বুঝতে পারি।
'পুরোপুরি ডিনাই করছি না। কিন্তু ক্লান্ত হওয়াটাও আমার ফল্ট না টুটুন। শরীরের নিয়ম মেনেই ওটা হয়। ক্লান্ত হওয়া মানে বিশ্বাস ভাঙা বা কর্তব্যে অবহেলা করা নয়। তার জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে এটাও ঠিক নয়।'
'ওরা প্রাণপণে আমাকে আগলে রাখতে চাইছে, তোমাকে জ্বালাবার জন্য ওরা এখানে থাকতে চাইছেনা। তুমি কেন বুঝতে পারছ না যে বাবা-মা আমার মস্তবড় সাপোর্ট, ওরাও আমার মতো বিশ্বাস করে যে আমি সেরে উঠব। হয়তো নতুন কোনো ওষুধ বেরোবে। আমি জানি তুমি আর বিশ্বাস কর না। তুমি অপেক্ষা করে আছো কবে আমি মরে যাব। কিন্তু আমি মরব না দেখো, আই উইল প্রুভ এভরিওয়ান রং। বুবাইকে এত ছোট রেখে আমি মরবনা, ওকে সৎমায়ের হাতে মানুষ হতে দেবনা।'
সুলগ্না কান্নায় ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থায় অরিন্দম আর তর্ক চালায় না বরং যেভাবে পারে ওকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। চেষ্টা করতে করতে অরিন্দমের মনে হল রবীন্দ্রনাথের মালঞ্চ নাটকটা ওকে একবার পড়তে দেয়। তারপরেই নাটকের শেষটা মনে করে শিউরে উঠল— ও কি সত্যিই কারো মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে আজকাল?
জীবন যদি দিনেরবেলা হয় আর মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা হয় রাত্রির, তবে তাদের আগে-পিছনে রয়ে গেল উষা আর গোধূলি। এই দুই জায়গার খবর রাখেন দার্শনিক এবং ডাক্তারবাবুরা কিন্তু বাকি সবাই বাস করতে চায় দিনের আলোর নিশ্চিন্ততায়। আজকাল জটিল রোগের ততোধিক জটিল চিকিৎসা আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে এক নতুন অস্তিবাদী সংকট। অনেকেই বেঁচে আছে ফাঁসির আসামীর মতো, যার মৃত্যুদণ্ডের দিনটি শুধু ঠিক হয়নি, আপীলের পর চলেছে আপীল। তারা বসে আছে গোধূলির আবছায়ায় ডাক্তার আর প্রিয়জনদের হাত আঁকড়ে। তাদের রয়েছে দিনের আলোয় ফেরার তীব্র আকুতি, অজানা অন্ধকারের বিভীষিকা আর ঠুঁটো জগন্নাথের মতো অসহায় একঘেয়ে সন্ধ্যাবেলা।
আমাদের এই গল্পের মানুষেরা এখনো সেই সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে পথ খুঁজছে।
(গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক)
(পরবাস-৫১, জুন-জুলাই, ২০১২)