|| এক ||
'আউটসোর্সিং ইজ এনারমাসলি পাওয়ারফুল ওয়ে টু গ্রো আওয়ার বিজনেস, বুস্ট আওয়ার প্রফিট। দিস ইয়ার আউটসোর্সিং উইল বি আওয়ার কি ফোকাস এরিয়া।'
'থিঙ্কট্যাংক' কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট মিঃ জিম কলিন্স-এর এই একটা কথায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুমে উপস্থিত ম্যানেজারদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হল। আবছা আলোয় ডুবে থাকা বিশাল ঘরের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত জুড়ে বয়ে গেল আলোচনার ঢেউ। কোন ডিপার্টমেন্টকে আউটসোর্সিং করার প্ল্যান ভাঁজছেন বড়কর্তারা? পিঙ্ক স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হবে না অন্য কোনো অপশান থাকবে? চাপা ভয়, উত্তেজনায় অনেকেরই মুখে কালো উৎকণ্ঠার ছাপ।
মেধা ধারের দিকে এক চেয়ারে বসে চুপচাপ উপভোগ করছিল আমজনতার এই প্রতিক্রিয়া। ঠোঁটের কোনে একটা বাঁকা হাসি খেলে যায় তার। এতগুলো মানুষের ভবিষ্যৎ তার একটা প্ল্যানিং-এর আঁচড়ে আজ টলোমলো। মাস দুই আগে একটা ক্লোজড এনভেলাপ সার্ভে করা হয় কোম্পানীতে। সবাইকে বলা হয়, কোম্পানীর লাভ বাড়ানোর জন্যে তাদের নিজস্ব সৃজনী শক্তি দেখাতে। তখনই রাত জেগে অনেক মাথা খাটিয়ে বার করেছিল এটা। আজ হাতেনাতে সেই পরিশ্রমের ফল পেয়ে সে রোমাঞ্চিত। এতদিনে হায়ার ম্যানেজমেন্টের ডিসিশান মেকিং-এ সে একটা গভীর দাগ কাটতে পেরেছে। এখন তার প্রোমোশন ঠেকায় কার সাধ্য! এই একটা চালেই সে সবাইকে টপকে যাবে ইঁদুর দৌড়ে। তিনদিন ব্যাপী কনফারেন্সের শেষ দিনেই ঘোষণা করা হবে সব প্রোমশান। মেধা মুখার্জী হবে থিংকট্যাংক বেজিং-এর সিইও। সফার ড্রিভেন বি এম ডব্লু, বিশাল রাজকীয় ধাঁচের বাংলো, চাকর বাকর, লাক্সারী। সাফল্য আর ক্ষমতার সুগন্ধ নেশাতুর করে তোলে মন-মেজাজ।
প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্য রেখে চলেছেন, 'ম্যানেজার হিসেবে ডিসিশান মেকিং শুড বি ইয়োর কোর কম্পিটেন্সি। ডিসিশান নিতে হবে টাইমলি, ওয়াইজলি এণ্ড রেসপনসিবলি। আমাদের নতুন স্ট্রাটেজি নিয়ে আমরা আশাবাদী। আউটসোর্সিং শুড ইনক্রিজ আওয়ার আরওআই।' আরওআই মানে রিটার্ন আন ইনভেস্টমেন্ট, সাদা বাংলায় যাকে বলে লাভ। লাভ বাড়ানোর স্ট্রাটেজি আলোচনার জন্যেই বেজিং-এ গ্রেটওয়ালের গা ঘেঁষে তৈরি হওয়া ফাইভস্টার রিসোর্টে চলছে বিশাল কনফারেন্স। পৃথিবীর একশোর বেশি ব্রাঞ্চের সব ম্যানেজার ও তার ওপরের পদমর্যাদার লোকেরা জড়ো হয়েছে এখানে। চীন এখন পৃথিবীর সব থেকে হ্যাপেনিং প্লেস। অসম্ভব ভালো মারকেট ইকোনমি। জিডিপি হু হু করে উঠছে। ইকোনমিক রিসেশান একটুও কবজা করতে পারেনি এদের। পৃথিবী বিখ্যাত বড় বড় কোম্পানী এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এখানে। এত জনসংখ্যা, এত বড় দেশ, এত দ্রুত বেড়ে ওঠা বাজার। যদি সামান্য এক শতাংশ জনগণকেও ধরতে পারে তাহলেই ব্যবসা জমে উঠবে। 'থিঙ্কট্যাংক'-এর কাজই হল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রোডাক্ট-এর সুনাম ছড়িয়ে দিয়ে তার বিপণন ও লাভ বাড়াতে সাহায্য করা।
।। দুই।।
'হাই মেধা! ডু ইউ রিমেম্বার মি!'
'হাই ধী! হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!'
ধী! স্যুট টাই-এ সুশোভিত ক্লীন শেভড সুপুরুষ স্মার্ট ঝকঝকে পারসোনালিটির এই ধীমানকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাসই হতে চায়না। ধী মানেই তো ফেডেড জিনস, বুকের বোতাম খোলা টিশার্ট, খোঁচা দাড়ি, উসকুখুশকো চুল। ধী মানে ঘাসের মাঠ, গীটার, অবিরাম আড্ডা, কলেজ ক্যান্টিন। হাত ফসকে মনটা যেন এক চোরা স্রোতে নস্টালজিক অতীতে হারিয়ে যায় কিছু মুহূর্তের জন্যে। কতদিন পরে দেখা!
'একজন একমপ্লিসড এণ্ড সাকসেসফুল লেডি লাগছে তোকে। নট এ ভ্যাগাবণ্ড লাইক মি।'
'আই এম আ সাকসেসফুল লেডি। কিন্তু তোকে মোটেই ভ্যাগাবণ্ড লাগছে না। মনে হচ্ছে জীবনে যা পেয়েছিস তাই নিয়ে খুব সন্তুষ্ট।'
'যে নিজের অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকে তার জীবনের থিম সং - এমনি করে যায় যদি দিন যাক না। অর্থাৎ জীবনে কিছু এচিভ করার খিদেটাই নেই। সুতরাং কেরিয়ারে উন্নতিরও কোনো আশা নেই। তাই বলছিস তো?'
'এখনও কথায় কথায় গান কবিতা টেনে আনার বদভ্যাসটা তোর গেলনা!'
ধীমান নিঃশব্দে হাসে। মেধা প্রসঙ্গ পালটায়। 'তুই থিংকট্যাংকে কতদিন? কোথায় আছিস?'
'মাত্র ছ'মাস হল মুম্বাই-এ জয়েন করেছি। তুই কতদিন?'
'আট বছর হয়ে গেছে। বছর দুই লণ্ডনে ছিলাম। তারপর বেজিং-এ।'
'বহু বছর! নিশ্চয় হাই ফাই পজিশানে আছিস?'
'হবু সিইও। প্রোমশানটা নাকের ডগায় ঝুলছে। পরশু ডিক্লেয়ার হওয়ার কথা।'
'মাই গড! এই বয়সে থিংকট্যাংকের সিইও পজিশানে! রিয়েলি এন এচিভমেন্ট। কি করে পারলি?'
'তোকে বলব কেন?'
'লেট মি গেস। এক, তুই ট্যালেন্টেড। দুই, সুন্দরী। তিন, হার্ডওয়ার্কিং। ঠিক বললাম?'
'আমার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটাকে বাদ দিয়ে দিলি।'
'হুঁ, এসব পারিনা বলেই আমার কিস্যু হয় না। ভাগ্যিস কলেজে থাকতে আমায় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কেটে পড়েছিলি।'
কলেজ জীবনে ধী ছিল তার সব থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ক্রমশঃ মুগ্ধ প্রেমিক। একেবারে মানিকজোড় ছিল দুজনে। টগবগে ঘোড়ার মতো প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা, বুদ্ধি, ব্যাক্তিত্বে উজ্জ্বল দুটো মানুষ। দুজনেই যেমন ভালো বাসকেট বল, ব্যাডমিন্টন খেলতো, তেমন জমিয়ে বক্তব্য রাখতে পারতো যে কোনো বিষয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি, কলেজ কেটে সিনেমা। মেধা বুকের ভেতরে কুল কুল বয়ে যাওয়া এক নদীর শব্দ পায়।
'কতদিন পরে দেখা হল তোর সাথে। বেশ জমিয়ে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে সেই পুরোনো দিনের মতো।'
'আমারও। কিন্তু তুই তো ভয়ানক ব্যস্ত।'
'এখনি জরুরী একটা মিটিং আছে। চীনের দুধ কেলেংকারীর খবর তো জানিস। থিংকট্যাঙ্ক সারা চায়না জুড়ে টোটাল মিল্কের মারকেটিং করে। হংকং-এ টোটাল মিল্কে মেলামিন পাওয়া গেছে বলে ওরা সব প্রোডাক্ট বাজার থেকে তুলে নিয়েছে। এপাশে তাইওয়ানের হেলথ মিনিস্টার বিবৃতি দিয়েছে হেইলংজিয়াং প্রভিন্সের ফ্যাক্টরিতে তৈরি টোটাল মিল্কেও নাকি মেলামিন পাওয়া গেছে। ফলে মাস খানেকের মধ্যে আমাদের সেলস যাচ্ছেতাই রকমের কমে গেছে।'
'সত্যিই মেলামিন আছে, নাকি সব অপপ্রচার?'
'আছে। কিন্তু এত কম যে সেটাকে নিয়ে হৈচৈ করার কোনো মানেই হয়না। নোংরা পলিটিক্স। এখন ইন্টারনেট, কাগজ, টিভি সব মিডিয়াতে এই খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেটার প্ল্যানিং নিয়েই আলোচনা হবে। আমরা অলরেডি ইন্টারনেটের সব ব্লগিং সাইট মনিটরিং করা শুরু করেছি। বাজে সমালোচনা মুছে দিয়ে, ভালো কথা বলে ভাবমূর্তি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।'
'চল, আজ তাহলে তোকে আর বিরক্ত করব না।'
।। তিন।।
সারাদিন খুব ব্যস্ততায় কেটে যায় মেধার। মিটিংটা খব সাকসেসফুল হয়। 'ক্লোজড এনভেলাপ সার্ভে-র রেজাল্ট ঘোষনা করা হয়। সেখানে 'গোল্ডেন ঈগল এওয়ার্ড' আর একটা বড় অংকের চেক পায় মেধা। 'বেস্ট টেকনিক্যাল প্ল্যানিং'-এর জন্যেও একটা অভাবিত পুরস্কার জোটে। হাই হিল জুতোতে ও যখন ঠকাঠক শব্দ তুলে স্টেজে উঠল সেই সময় আশেপাশে ঝুলে পড়া মুখগুলো দেখে উৎফুল্ল হয়ে গিয়েছিল মনটা। বিজয়ীর হাসিটা অজান্তেই সেঁটে গিয়েছিল ঠোঁটের কোনায়।
বিকেলের দিকে ধীমানকে ডেকে নেয় মেধা। সরু পাকদণ্ডী একটা শর্টকাট রাস্তা বেয়ে হাঁটতে থাকে গ্রেট ওয়ালের দিকে। গ্রেট ওয়ালের এই অংশটার বেশ জরাজীর্ন দশা। মেরামত হয়নি কতকাল কে জানে। চড়াই-এ উঠতে দমে কুলোচ্ছে না তার। তারওপর এই হাই হিল জুতো! কে জানত ধীর সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে! বারবার পিছিয়ে পড়ছে সে। অথচ ধীমান কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে মহানন্দে জোরকদমে এগিয়ে চলেছে। মেধা চেঁচিয়ে বলে, 'একটু আস্তে হাঁট।'
হাঃ হাঃ করে প্রান খোলা হাসি হাসে ধীমান। 'জীবনের দৌড়ে তুই অনেকদিন আগেই আমাকে টপকে গেছিস। এখানে কোনো কম্পিটিশান নেই। তুই তোর গতিতেই ওঠ। নো টেনশান। আর মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। আমি ওপরে অপেক্ষা করছি তোর জন্যে।'
ওপরে গিয়ে ঘাসের ওপর চুপচাপ বসে আছে ধী। প্রায় ধ্যানমগ্ন হয়ে দূরের এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে থাকা পাহাড় দেখছে। 'মনে হচ্ছে পাহাড়ের ওপর বিশালাকায় বয়স্ক এক ড্রাগন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে রয়েছে। তার গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে হাজার হাজার ভ্রমণার্থী। একদিন কত কর্মকাণ্ড চলত এই ড্রাগনটাকে ঘিরে। কত চিন্তা, প্ল্যানিং, ঘটনা, দুর্ঘটনা। কত সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে রোজ ঘুরে বেড়িয়েছে এর ওপর দিয়ে। কত শ্রমিকেরা এই প্রাচীর বানাতে বানাতেই মৃত্যু বরণ করেছে। তাদের প্রিয়জনেরা দিনের পর দিন তাদের কথা ভেবে চোখের জল ফেলে গেছে। কত প্রেম ব্যর্থ হয়ে গেছে শুধু এই ড্রাগনটার জন্যে।'
'তোকে গ্রেটওয়াল দেখাতে আনাটা সার্থক। প্রবাদ আছে চীনে এসে চীনের প্রাচীর না দেখলে ইউ আর নট এ কমপ্লিট ম্যান।'
প্রাচীরের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে দুজনে। সিঁড়ির পর সিঁড়ি। একবার চড়াই একবার উৎরাই আবার চড়াই আবার উৎরাই। ক্যারিয়ারের চড়াইয়ে কি অনায়াসেই না এগিয়ে চলেছে মেধা আর এখানে বারবার হোঁচট খাচ্ছে আজ। সংকোচ কাটিয়ে হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধীর হাত ধরে।
'কল্পক কোথায় এখন?'
'অস্ট্রেলিয়া। ও সানি স্মাইলের ভাইস প্রেসিডেন্ট।'
'মাই গড। তোরা দুজনে দুই বিগ শট মিডিয়া কোম্পানীতে বিগ শট হয়ে বসে আছিস। কিন্তু দুজন দুদেশে এভাবে কতদিন আছিস?'
'ছ'বছর! লণ্ডন থেকে আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখানে মুভ করে এলাম, ও অস্ট্রেলিয়া চলে গেল।'
'একা সব ম্যানেজ করছিস কি করে?'
'আউটসোর্সিং ডিয়ার! মা-বাবাকে কাছে এনে রেখেছি। ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা লেখাপড়া সব তাদের হাতে। আর এক সর্বক্ষনের কাজের মেয়ে আছে। ঘর-সংসারের কাজকর্ম দেখে।'
'এখানে কাজের লোক পাওয়া যায়?'
'হ্যাঁ। থার্ডওয়ার্ল্ড কান্ট্রির তো এটাই সুবিধে।'
'আউটসোর্সিং-এ তুই তাহলে রীতিমতো পি এইচ ডি করে ফেলেছিস। কল্পকের অনুপস্থিতিজনিত বিরহটা কি ভাবে ম্যানেজ করিস? সেটাও আউটসোর্স করিস নাকি?'
হঠাৎ চমকে যায় মেধা। ধীমানও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, 'সরি, কিছু মনে করিস না। আমি মজা করছিলাম।'
'আরে না না, কিছু মনে করারা নেই। ইনফ্যাক্ট আমি এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছি। এভাবে বছরের পর বছর আলাদা থাকলে এটুকু আউটসোর্সিং করাতে কোনো দোষ দেখি না আমি।'
ধীমান অবিশ্বাসের চোখে তাকায়।
'এত অবাক হচ্ছিস কেন? এরকম ভাবাই কি লজিক্যাল নয়? ছ বছর ধরে আলাদা থাকলে অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক তো গড়ে উঠতেই পারে।'
'লজিক্যালি হয়তো ঠিক। কিন্তু সেটা বাস্তবে মেনে নেওয়া অসম্ভব।'
'তুই বড্ড পুরোনোপন্থী ধী। পৃথিবী অনেক দ্রুত ছুটছে। তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলে দিন দিন পিছিয়ে পড়বি। আমি আর কল্পক দুজনেই খুব প্র্যাকটিক্যাল ও খোলা মনের। সত্যি কথা বলতে কি, আমি খুব লাকি যে কল্পককে হাজব্যাণ্ড হিসেবে পেয়েছি। ও এতটা একোমোডেটিং না হলে আমি আজ সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছতে পারতাম না।'
মনে পড়ে যায় কলেজের সেই দিনগুলো। বাড়ির লোকে চেয়েছিল ও রিসার্চ করুক, সায়েন্টিস্ট হোক। ও জানত ওর লক্ষ্য আরো অনেক উঁচু তারে বাঁধা। ঐ কয়েক হাজার টাকা মাইনে ওকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না কোনোদিন। ধীমান ছিল একেবারে উলটো। ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই। টিপিক্যাল আঁতেল টাইপের ছেলে। কবিতা, গীটার, গান এসব নিয়েই ব্যস্ত। ওর বাবা মা দুজনেই ভালো চাকরী করতেন। চাইতেন ধীমান ম্যানেজমেন্ট পড়ুক। কিন্তু স্কুল মাস্টার হবে আর বেশ একটা সুখী নিস্তরঙ্গ জীবনযাপন করবে এই ছিল ওর স্বপ্ন। কিন্তু শেষে বাড়ির চাপে ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হয়। কিন্তু ক্যারিয়ারিস্টিক হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। ওকে উজ্জীবিত করার জন্যে কত জ্ঞান দিত মেধা।
'ধী, তোর মনে আছে আমি তোকে ক্যারিয়ার নিয়ে জ্ঞান দিলেই তুই আমাকে একটা কবিতা শোনাতিস।'
কোনো উত্তর না দিয়ে গোটা কবিতাটা আবৃত্তি করে দেয় ধীমান।
'চূড়োয় পৌঁছতে পৌঁছতে পাহাড়টি একা হয়ে গেল / সমস্ত বিস্তার ফেলে যেতে হল তাকে, আর / এখন নিঃসঙ্গ শীর্ষে যে রোমাঞ্চিত মেঘ/তা-ও খুব দীর্ঘস্থায়ী কিছু নয়।/অতএব আমি যাবো না, বরং/শীর্ষস্থানীয় নিঃসঙ্গতার পরিবর্তে/বাহুল্য ও বিস্তার সমেত তোমার কাছেই থাকবো।'
ধীর স্মৃতিশক্তি দেখে হতবাক হয়ে যায় মেধা। কিন্তু সেই সময় এই কবিতাটা শুনলেই এক বিজাতীয় রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠতো সে। ধীমানকে নিজের ইচ্ছে মতো চালাতে পারতো না কোনোদিন। অনুভব করত ধীমানের সঙ্গে প্রেম করা যায় কিন্তু বিয়ে করে ঘর বসানো যায় না। কিন্তু ওর ঐ কেয়ারলেস এটিচিউড আর রোমান্টিক কথাবার্তার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ কাটিয়ে ওঠা খুব শক্ত ছিল। সেই সময় কাকাতালীয় ভাবে একটা ঘটনা ঘটে যায়। কলেজ থেকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। বেশ অনেকটা টাকা চাই। মা বাবা চাইলেও দেবে না। তখন হঠাৎ দু বছরের সিনিয়র কল্পক বলল সে মেধাকে টাকাটা দিতে পারে। ব্যাংকে টাকা তুলতে যাওয়ার সময় ও সঙ্গে যায়। পাসবই-এ টাকার অংক দেখে মেধার চক্ষু চড়ক গাছ - স্টুডেন্ট লাইফেই এত ব্যাংক ব্যালান্স এই ক্যাবলা দেখতে ছেলেটার! সেই দিনই ও ঠিক করে বিয়ে করলে কল্পককেই করবে। কল্পকের সাহিত্য অনুরাগী মিষ্টি ঘরোয়া এক কোমল স্বভাবা গার্লফ্রেণ্ড ছিল। তাকে সরাতে বেশী সময় লাগে নি। তারপর তো সবই ইতিহাস। যত মিশেছে কল্পকের সঙ্গে তত বুঝেছে তার সেদিনকার সেই সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল। কল্পক ছিল ওর পোষা বিড়ালের মতো। একটু সময়ে অসময়ে গায়ে পড়া প্রেম করলেই খুশী। ম্যাও শব্দটা পর্যন্ত করত না।
।। চার।।
ঘরের এক দিক জুড়ে বিশাল বুফে লাঞ্চের ব্যবস্থা। চীনা, কন্টিনেন্টাল আর ভারতীয় তিন রকমের খাবার। ড্রিংকের ঢালাও ব্যবস্থা। সারা ঘর জুড়ে সুন্দর করে সাজানো বড় বড় গোল গোল টেবিল। টেবিলের মাঝখানে ঘূর্ণায়মান কাঁচের টেবিল-টপ। প্রত্যেক টেবিলে দশ জনের বসার ব্যবস্থা। চীনা কাঠির পাশাপাশি কাঁটা চামচ। সারা ঘর জুড়ে লোকজনেরা হাতে গ্লাস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করছে।
লাঞ্চের পরে উপস্থিত হল সেই সময়। একের পর এক আনাউন্সমেন্ট চলতে থাকে। কে কোন ব্রাঞ্চের এমডি হচ্ছে, কোন এমডি সিইও হচ্ছে, কে হচ্ছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করে থাকে মেধা। ওর কাছে আগাম খবর আছে তাও না আঁচালে বিশ্বাস নেই। সেকেণ্ডের পর সেকেণ্ড, মিনিটের পর মিনিট কেটে যায়। একসময় ডিক্লেয়ার হয়। প্রচণ্ড হাততালিতে ভরে ওঠে চারিদিকে। উঠে দাঁড়ায় মেধা। কনগ্রেচুলাশান্স-এর বন্যায় ভেসে যায় খানিকক্ষণ। খবরটা এক্ষুনি কল্পককে দেওয়া দরকার। ফোন করে। কল্পকের মোবাইল বন্ধ। হয়তো মিটিং-এ আছে। এস এম এস কারে জানিয়ে দেয়। তারপর একে একে ফোন করে বাবা, মা দাদা, দিদি সবাইকে। আনন্দে বুকের মধ্যে অদ্ভুত লাগছে। চোখে জল এসে যাচ্ছে। তার জীবনের একটা মাইলস্টোন আজ।
কোম্পানীর সাফল্য উদযাপন করতে সবাই এখন নাইটক্লাবে যাবে। মেধা ফিরে যায় হোটেলে নিজের ঘরে। অফ সোলডার ডিজাইনার ড্রেসটা হাতে নিয়ে একটু ভাবে। সাদা চামড়ার কোনো মহিলা পরলে কেউ কিছু মনে করত না। এক ভারতীয় পরলেই অনেক জোড়া চোখের উৎসুক চাহনির সামনে পড়তে হবে। শেষপর্যন্ত মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ড্রেসটা পরে ফেলে। চোখে মুখে প্রসাধনী মেখে হয়ে ওঠে মোহময়ী। নাইটক্লাবে পৌঁছনোর পর হৈ হৈ পড়ে যায়। সবাই ভূয়সী প্রশংসা করে ওর ড্রেসের।
নাচ গান আনন্দে মধ্যরাত পার করে হোটেলের রুমে ফেরে মেধা।
।। পাঁচ।।
ঘুমাচ্ছিল ধীমান। পরদিন সকালে তার ফ্লাইট। ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে রাত্রেই। হঠাৎ দরজায় প্রচণ্ড ঠক ঠক আওয়াজ। তাড়াতাড়ি উঠে আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে যায়। মেধা। রাতের পোশাকে।
'আজ আমি তোর সঙ্গে থাকবো।'
'ভেতরে ঢুকে বোস।' মেধাকে সরিয়ে দরজা বন্ধ করে ধীমান। জিগ্যেস করে, 'তোর মাথাটা খারাপ হয়েছে?'
'মনে পড়ে তুই কলেজে পড়ার সময় একদিন আমার সঙ্গে রাত কাটাতে চেয়েছিলি। আমি মত দিইনি। আজ সেই রাতটা আমায় ফিরিয়ে দিতে পারিস না? পারিস না আমার সব নেশা চুরমার করে দিতে?'
'কিসের নেশা?'
'ক্ষমতার নেশা, সাফল্যের নেশা।'
'নেশা কাটানোর কি দরকার? তুই নিজের যোগ্যতায় সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছতে পেরেছিস। সেলিব্রেট কর। বাড়িতে সবাই তোর জন্যে কত গর্বিত ভেবে দেখ একবার।'
'তুই আমায় থাকতে দিবি না। তাই না?'
'তুই জানিয়েছিস কল্পককে?'
'তুই কি তোর বৌকে ভয় পাচ্ছিস?'
'ভয় পাওয়ার ব্যাপার না মেধা। তুই তো জানিস আমি মনেপ্রানে নিতান্তই এক মধ্যবিত্ত। তোর মতো ঝাঁ চকচকে উচ্চবিত্ত জীবন যাপন করিনা।'
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মেধা, 'কেমন নাটক করলাম বল। তোকে পরীক্ষা করছিলাম। তোর বৌটা সত্যি লাকি।'
'তুই একেবারে যাতা। তোর কাণ্ডকারখানা দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।'
'ভেবেছিলি আমায় ভূতে ধরেছে? নাকি তোর ঐ প্যানপ্যানে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে পদস্খলন হওয়ার ভয়ে অক্কা পাচ্ছিলি?'
।। ছয় ।।
ভোরবেলাই বেরিয়ে গেছে ধী। হোটেলের গেটে ওকে হাসি মুখে সি অফ করে মেধা। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে যায় গ্রেট ওয়ালের দিকে। হাই হিল জুতোটা খুলে হাতে নিয়ে নেয়। পাকদণ্ডী রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে চড়াই-এর দিকে। কেমন একটা ঘোরে যেন উঠে যেতে থাকে আজ। গ্রেট ওয়ালের ওপর কিছু দূর ছাড়া একটা করে ওয়াচ টাওয়ার। এখানে বসে প্রহরীরা পাহারা দিত। শত্রুর চিহ্ন পেলেই ফাঁকা গুলি চালিয়ে বা ধোঁওয়া করে জানান দিত। সে খবর এক ওয়াচ টাওয়ার থেকে আর এক টাওয়ারে রিলে করে পৌঁছে যেত ঠিক জায়গায়। কতবার গুলির আওয়াজ হল বা ধোঁওয়া দেখা গেল তার ওপর নির্ভর করে রাজার লোকেরা জেনে যেত শত্রু সংখ্যা। সাবধান হয়ে যেত সবাই। কিন্তু মানুষ যখন তার শত্রু কে সেটাই বুঝতে পারে না তখন সাবধান হবে কি করে?
চুপ করে বসে থাকে মেধা। হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। যত দূর চোখ যায় গোটা প্রাচীরটা জনমানবহীন। ঠিক ওর মতোই একলা। এখনও ভালো করে সকাল হয়নি। সব মানুষ এখনো ঘুমিয়ে আছে যে যার প্রিয়জনের সান্নিধ্যে। ধী ফিরে গেল বাড়িতে। ওর স্ত্রী, সন্তান অপেক্ষা করে আছে ওর জন্যে। বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ওর জন্যে কোথাও কেউ অপেক্ষা করে নেই। ও নিজের সুবিধের জন্যে বাড়ির সমস্ত কাজ এমন সুচারু ভাবে আউটসোর্স করে দিয়েছে, যে সব কিছু ওকে ছাড়াই এক অনায়াস ছন্দে চলে। ও আজ বাড়ি ফিরল কি এক সপ্তাহ পরে ফিরল তাতে কিছু যায় আসে না কারো। সবাই জানে মেধা এত বড়মাপের চাকরী করে যে ওর থেকে বাড়ির ছোটখাটো জিনিষ কারো আশা করাই উচিত নয়। ওর কাজ শুধু ক্যারিয়ারের পাকদণ্ডী বেয়ে ওপরে আরো ওপরে উঠে যাওয়া। তার জন্যে কোনো পিছুটান, কোনো কনুই-এর গুঁতোকে সে সহ্য করেনি কোনোদিন। আজ ও সাফল্যের চূড়োয়। আজকের সব খবরের কাগজে বড় বড় করে ছাপা হবে ওর নাম, ওর ছবি।
ধী-র বলা কবিতাটা কেবলি গুনগুনিয়ে বেড়াচ্ছে মনের মধ্যে। এই এক পাহাড় নিঃসঙ্গতা, এক মেঘ রোমাঞ্চ আর এক আকাশ খ্যাতির আলো ফেলে ও কি এখনও বাহুল্য আর বিস্তার সমেত ফিরে যেতে পারে না পাহাড়ের তলদেশে? প্রিয়জনেদের কাছাকাছি? না, কিছুতেই পারে না। সেদিন রাত্রে ধীর কাছে একবার ভেঙে পড়েছিল। যদিও নিজেকে সামলে নিয়েছিল শেষ মুহূর্তে। ধীকে বলেনি সেই কাহিনী।
সেদিন পার্টি শেষ হওয়ার পরে হোটেল রুমে ফিরে গিয়ে দেখে প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। কল্পকের ওপর ভয়ানক রাগ হয়। একবার ফোন করল না? সামান্য ম্যানার্স পর্যন্ত জানে না। নাকি কমপ্লেক্স কাজ করছে এর পেছনে। ভেবেছিল সে একাই সিইও হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে। মোবাইল বন্ধ। আশ্চর্য। বাড়িতে ফোন করে। একটা মেয়ে ঘুম জড়ানো গলায় সাড়া দেয়। রঙ নাম্বার ভেবে ফোনের লাইন কেটে দেয় সে। তারপর মনে হয় - নাম্বার ভুল হবে কি করে। তাহলে কে এই মেয়েটি? এত রাত্রে? আবার ফোন করে। এইবার কল্পক ধরেছে ফোন। কল্পককে কিছু কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেধা, 'হু ইজ দ্যাট লেডি?'
বরফের মতো শক্ত আর ঠাণ্ডা গলায় উত্তর আসে, 'আমি তোমার কাজটা আউটসোর্স করে দিয়েছি।'
মাথার মধ্যে বজ্রপাত হয়। মাথা ঠাণ্ডা করে এক্ষুনি একটা ডিসিশান নেওয়া উচিত। অফেন্সিভ খেলবে না ডিফেন্সিভ। কিছুই ঠিক করতে পারে না। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা কোথায় হারিয়ে ফেলল সে! বুকের ভেতরে কেন এত শূন্যতা!
শূন্যতাটা যেন একটা ব্ল্যাকহোলের মতো নিঃসীম এক অন্ধকার গহ্বরে পুরে ফেলছিল ওকে। বদলা চাই। ছুটে গিয়েছিল ধী-র কাছে। কিছু চাইলেই পাওয়ার এমন বদভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে ভেবেছিল ধীকে চাইলেও পেয়ে যাবে। কিন্তু পুরোনোপন্থী ধীর মধ্যবিত্ত সংস্কার ওকে এক রক্ষাকবচের মতো ঘিরে থাকে। মেধার ভেতরের অন্ধকার ছুঁতে পারে না তাকে। মনে হয় বুকের ভেতরের সব আলোকে ও আউটসোর্স করে দিয়েছে। এই অন্ধকার থেকে বুঝি আর মুক্তি নেই।
দিনের প্রথম সূর্যের লালাচে আলো এসে লাগে প্রাচীরের গায়ে। মেধা ওয়াচ টাওয়ারের অন্ধকার গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসে ভাঙাচোরা প্রাচীরের ওপর সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়।
(পরবাস-৫১, জুন-জুলাই, ২০১২)