ISSN 1563-8685




অভিমুখ

|| এক ||

চৈতীপর্ণার সঙ্গে দু’বছর তিনমাস এগারদিন হল আইনি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আর সেজন্যেই এইস্যা একখানা নিঃশ্বাস ফেলে একবুক শ্বাস গিলে নিয়ে এই অঞ্চলে এসে বাসস্থান নেওয়া। মধ্য কোলকাতার পৈতৃক বাড়িতে পোষাচ্ছিলনা অনেকদিন ধরেই। ভাড়াবাড়িতেও ঝামেলা—একবার মেট্রো, তারপর অটোরিক্সা ধরে নিকটবর্তী স্টেশন—সেখান থেকে পড়ি-কি-মরি করে লোক্যাল। উত্তর-চব্বিশ পরগনার প্রায় শেষ পর্যন্ত (যেখানে বিদেশের সীমা) যেতে হয়। সরকারের চাকর, লেট হলেও বুঝি অসুবিধে নেই! অজুহাত মাঝেমাঝে দিতে হয় বৈকি। খানিক সহানুভুতি কুড়োন...আহা, একা থাকে। বাদু ছাড়িয়ে আরো ভিতরে বাসা। ট্রেন থেকে নেমে শামুকগতিতেও মাত্র মিনিট দশে পাকা রাস্তা ছাড়িয়ে ইঁটের রাস্তা। পঞ্চায়েত থেকে প্রতি বর্ষাতে ইঁট বিছিয়ে দেয়, সঙ্গে আশ্বাস। ইঁটের রাস্তা খুব নিরাপদ নয় অন্তত জলের দিনগুলোতে। সাপুড়ের মত গন্ধ শুঁকে পা ফেলতে হয়। অবশ্য বিষধরদের সঙ্গে মোটামুটি বোঝাপড়া আছে। বছরে দু-চারজনের বেশি সর্পদষ্ট হয়েছে বলে শোনা যায়না। আর একটু এগিয়ে মাটির রাস্তায় পা ফেলতে ফেলতে বাসা। আলিশান বাড়িটা বোধহয় প্রত্নযুগের—একতলা-দোতলা মিলিয়ে। এখন ডুবন্ত। বাউণ্ডারির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জঙ্গলের শেষে পাঁচিলের চিহ্নমাত্রই আছে। ওপরতলাটা ভেঙে পড়েছে একপাশ থেকে। যে পাশটা অক্ষত সেদিকের দুটোর মধ্যে একটা ঘর ভাড়ায় শিলাদিত্য। অন্যটায় বাইরে থেকে তালা ঝোলে—ওটাও ভাড়া। সে শুনেছে, দেখেনি। তার ঘরটার লাগোয়া একটা বারান্দা আছে, ছোট ছাত মতন। তার এককোনে ঝুঁকে পড়েছে ঘন ঝুপ্‌সি পুরোন আমগাছটা। প্রতিবছর নাহলেও এক একবার প্রচুর আম ফলে। ছাতের একটা কোনায় টিন-ঘেরা তার স্বপাক-ব্যবস্থা। চুনকাম-খসা ফাটা দেওয়াল বিবর্ণ মেঝে নীচু তক্তপোষ, একফালি তক্তার টেবিল, একটা প্লাস্টিকের চেয়ার। অবশ্য আসবাব কিনতে হয়নি তাকে। শুধু দেওয়ালের পেরেক থেকে ঝোলে দোসর গীটার। যখন তখন সে চেয়ারটা নিয়ে ছাতের ভাঙন-ধরা বিপজ্জনক কার্নিশ ঘেঁষে বসে। ছাত ছুঁয়ে কাঁঠাল আর শিউলি গাছ। শিউলি গাছে বড়বড় রোঁয়াওলা শুঁয়োপোকা। কাঁঠাল পাকলে অভদ্র গন্ধ। ছাতের রেলিং জড়িয়ে উঠেছে অনাদরের মাধবীলতা। গন্ধরাজ লেবু হাস্নুহানা নিমফলের পাঁচমেশালি গন্ধ ঘুরে ফিরে বেড়ায় চৌহদ্দি জুড়ে। অদূরের ভাঙা পাঁচিল শেষে কলা আর নারকেলবন। দিঘির ঘাট। সিঁড়ি নজরে পড়ে কি পড়েনা, কিন্তু আছে। শিলাদিত্য ইচ্ছে করলে ওখানে নেমে স্নান করতে পারে। যায়না, অভ্যেসটা হয়নি এখনো। অল্প দূরে টিপকল আছে রঙ্গনগাছের পাশে। তার পাড়ে দাঁড়িয়ে বালতি বালতি জল ঢেলে স্নান সারে। পায়ের নীচে বাঁধান জায়গাটা নোতুন, ফাটলহীন। তার পাশটায় থিকথিক, কাদা-কাদা। জলজ পোকারা মুখ বের করে, তিরতির হেঁটে যায়। সিলিং ছোঁয়া হাল্কা আকাশি টাইলস-বসানো আট-বাই-আট বর্গফুটের নয়নসুখ সুগন্ধি বাথরুম হঠাৎ ভেসে উঠলে বিবমিষা হয়। সবল দুহাতে জলভর্তি দুটো প্লাস্টিকের বালতি বয়ে নিয়ে ছাতের ঘরে রেখে দেয়। রান্না, খাওয়া ইত্যাদি। পরিশ্রুত জলের বিস্বাদ ভুলে গেছে শিলাদিত্য। এক চোখে মাইনাস সাড়ে-পাঁচ অন্যটায় ছয়-পয়েন্ট-দুই পাওয়ারের চশমা ছাড়াই সে ছাতের কিনারে দাঁড়ায়। কেউ খবরদারি করেনা। অঞ্চল ঘিরে বাদাবন। চাষজমি। যেসব নিকটবর্তী বাড়িগুলো আপাত-ঝাপসা, নিশ্চিত বলা যায় সেগুলোর মধ্যে একটিও পাকা বাড়ি নেই আর। চোখ বুঁজে নিলে বাড়িগুলো আরও স্পষ্ট। পাঁচফুট-আটইঞ্চি সুঠাম ঈষৎ তামাটে ছত্রিশী খোলা শরীর ছুঁয়ে যায় বৃষ্টিমাখা হাওয়া। চুলগুলো বেড়ে গিয়ে বিসদৃশ বিষণ্ণতাবিলাসী চৌকোণা মুখ। দাড়ি-কামানো অনিয়মিত ইদানিং। গাল চুলকোয়। খোলা কাঁধের ওপরে চুলেরা সুড়সুড়ি দেয়। প্রচণ্ড তেষ্টায় ঠোঁট গাল গলা পুড়ে যায়। শরীর বেয়ে ঘামের সাথে গড়ায় কষ্ট বা সুখ। মাধবীলতার থোকা দলেপিষে দেওয়ার ইচ্ছেটা শেষ অবধি হাত বাড়িয়ে ধুয়ে নেয়। এই স্বর্গ...এটাই স্বর্গ। পিতৃদত্ত নাম আর পরিচয় তাকে বিব্রত করে। আসলে সে হাজু নীলু পঞ্চা বা রহিম। কিছুতেই শিলাদিত্য হতে পারেনা।


।। দুই।।

—বন্ধু হতে পছন্দ করবেন
—এটাই প্রশ্ন?!
—না। এটাই জানার ছিল শুধু। প্রশ্ন নেই।
—ব্যস!?
—আপনার কিছু থাকলে বলুন।
—দু’য়েকটা কথা...এই স্কুলের চাকরিটা আপনি এনজয় করছেন? আপনার এক্সেলেন্ট রেজাল্ট!
—করছি...। আর কিছু?
—আপনি...ও কে...থাক এখন। বাট ইয়্যু আর ভেরি হ্যাণ্ডসম।
—আপনিও সুন্দর...কিন্তু এটা বিয়ে হবার কারণ হতে পারেনা!...ভীমবেটকার গুহা দেখেছেন?
—উঁহু, নাঃ। আর......আমার অপছন্দের গুরুত্ব দেবেন নিশ্চয়ই!!
—বোধহয় না...।
—তাই? আচ্ছা!

চৈতীপর্ণা পরিশীলিত সুবিন্যস্ত হেসেছিল। অমোঘ আত্মবিশ্বাস।

প্রায় সমবয়সী চৈতীপর্ণা। মোটামুটি সুশ্রী, গ্রুমিং করে সুন্দরী। বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করে। ব্যস্ততার সময়ে টীশার্ট-ট্রাউজার, শাড়িতে সে নায়িকা। রোদ্দুর সানগ্লাসে, সানস্ক্রিন-মাখা চর্চিত ত্বকে ধাক্কা খায়। বেডরুমে চোখ জুড়োন ঘোর লাগান নরম আলো। বন্ধ বাথরুমে সাবানী ফেনার মায়ায় নির্গ্রন্থি রেশমী চৌত্রিশ-আঠাশ-ছত্রিশ। পাখির বুকের পালকের মত চুল। ছুটির দিনে নিয়ম করে ছাতের গাছগুলোয় জল দেয়। জারবেরা, কসমস—বিলাসী ঋতুপুষ্পের ঝাঁক। নরম গলায় মালির সঙ্গে আলোচনা করে। রান্না শেখে টিভি দেখে দেখে। অতুলপ্রসাদী আর পুরাতনী শিখেছে পাঁচবছর। চৈতীপর্ণা অনন্য আবিষ্কার। ম্যাট্রিমোনিয়াল দেখেদেখে শিলাদিত্যের জুড়ি মিলিয়েছেন অভিভাবকেরা—মা দাদা দিদি বৌদিরা। তাঁরা সব উচ্চকোটির মানুষ। পাত্রীপক্ষও। ডাক্তার প্রফেসর চাটার্ডেরা। পৈতৃক প্রাসাদ। আর অবলীলায় এম-এস-সিতে দারুণ রেজাল্ট নিয়ে সে বেকার ছিল কিছুদিন। গীটার বাজাত ভার্সিটি-চত্বরে বসে। জুতে গেল এক ব্যাণ্ডে। কাজ নেই কর্ম নেই, বিশেষ ভাবনা-চিন্তা না করে এস-এস-সির ফর্ম ভরে পরীক্ষায় বসে দেখল চাকরিটা তার। একটু চেষ্টা করলে হয়ে যেত শহরের কাছাকাছি কোথাও। বদলে, শস্তার ডিজি-ক্যাম কিনে পানাপুকুর, কাঁচারাস্তা, কুঁড়েতে ভরে ফেলল।

ফুলশয্যার রাতে চৈতীপর্ণা তাকে বিদেশী ক্যামেরা উপহার দিয়েছিল। অথচ ওর জন্যে সে কিছু কেনেনি। বড়বৌদির কিনে রাখা হীরের আংটির সুদৃশ্য বাক্স রেখেছিল সাইড টেবিলে।

—নিয়ম বলে কিনে রেখেছিল বড়বৌদি। পছন্দ না হলে...দেখা যাবে।
—এমনি করে দেয়?
—থ্যাংক্স ফর ইয়োর গিফট। ভালো লাগল।
—হুঁ। কিন্তু আমারটা পরিয়ে দাও!

মধ্যরাত্রের সানাই। ঘরে রাতবাতির ভ্রান্তিকর সবজে আবছায়া। চৈতীপর্ণা তার শরীর-সংলগ্ন হয়ে বসেছিল। কাঁধের ওপরে রেখেছিল নিজের চিবুক। মৃদু শ্বাস। কাতান সিল্কের ঘনসবুজ জমিতে ছোটছোট লাল রেশমি ফুল। অসম্বৃত আঁচলের পাশ দিয়ে সংগুপ্ত ঔদ্ধত্য স্পর্শ করছিল শিলাদিত্যের পিঠ। অচেনা সৌরভ ছেয়ে শয্যায়। তার নাকের ডগা কান গরম হয়ে উঠছিল। ভূমিকাহীন আকস্মিকতায় বিশুদ্ধ আনাড়ি সে বিছানায় আছড়ে ফেলেছিল তার নবোঢ়াকে, যার সঙ্গে তার ততটা পরিচয় হয়নি তখন পযর্ন্ত। অনাস্বাদিত শীর্ষমুহূর্তে আধবোঁজা চোখে আবিষ্কার করেছিল মুঠিতে পিষ্ট উষ্ণ লোভ—সুদৃঢ় কিন্তু নরম। অবচেতনে নিজেকে মনে হয়েছিল ধর্ষকমাত্র। অথচ চৈতীপর্ণা তেমনভাবেই অপেক্ষা করেছিল তার ঘুমিয়ে পড়া অবধি। তারপর উঠে চাদরে ঢেকে দিয়েছিল শরীর। নিজের বিক্ষত নগ্নতাকে গুছিয়ে নিয়েছিল রাতপোশাকে। সারারাত পাশে বসে অপলক চেয়ে চোখে এসেছিল নরম জল। বিছানা ছাড়ার আগে আলতো করে ঘুমন্ত কপালে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল। পরবর্তী পরিচ্ছন্ন সকালে চৈতীর দিকে তাকাচ্ছিল না শিলাদিত্য। তার এলোমেলো চুলে-ঢাকা কপালের একখানে সিঁদুরের সংরাগ।

হনিমুনে উড়ে গেল গোয়ার উপকূলে। বিয়েতে তার ছোড়দির উপহার। দামী রিসর্ট। তারা কাছাকাছি বসল পাশাপাশি হাঁটল আকাশের নীচে নির্বাধ। শিলাদিত্য আকাশের ঔদার্যে নিস্পৃহ হয়ে রইল। চৈতীপর্ণা কত কথা বলে গেল তাকে। কিছু সে শুনতে পেল কিছু পেলনা। ফেরার প্লেনে পাশাপাশি সীট। সে বলেছিল,
—বোর হয়েছ, না? জানি। এখানে আসাটা ছোড়দির প্ল্যান।......যা খুঁজেছি, নেই।

কেমন যেন হয়রান দেখাচ্ছিল শিলাদিত্যকে।

—তা হলে কোথায়?......কী খুঁজছ?
—যেতে চাইলে নিয়ে যাব। আচ্ছা, প্যালিওলিথিক এজ….ওঃ, না থাক।

ছুটি ফুরোনর দেরি ছিল। কিন্তু আর ভালো লাগছিলনা ঘরের মধ্যেকার একান্ত নিবিড়তা। চৈতীপর্ণার সঙ্গে বাকি সকলের বেশ ভাব। বেশ মেয়ে, চমৎকার, ভাবল সে।

এই কয়েকদিন চলছিল দুজনের বুদ্ধিগত সমঝোতার পাঠ। অন্য কিছু নয়।


।। তিন।।

—না জানিয়ে কেন এলাম?
—তোমাকে আসতে দিতনা এখানে।

ভোরের প্রথম লোক্যাল। ভীড়, ঝোড়াঝুড়ি, আঁশটে গন্ধ, অপরিচ্ছন্ন পরিধান। চৈতীপর্ণার জগতে এত কাছ থেকে এইসব কিছু প্রথমবার। মন্দ লাগছিলনা অথচ। শিলাদিত্যকে আড়চোখে দেখল। কেমন নিবির্কার, ভাবলেশহীন। মাঝেমাঝে তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টি। তার ভালো লাগছিল। তবে সেখানে কতটা মুগ্ধতা কতটা অনুসন্ধান বোঝা শক্ত। কিসের খোঁজ কে জানে। জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলনা। ট্রেন প্রায় খালি। কী একটা স্টেশন—রোগা খালি প্ল্যাটফর্মে দুচারজন মানুষ। ফাল্গুনের সোনালি নৈঃশব্দ। রোদচশমা, চাপা পোশাকটাও শাড়ি নয়—অস্বচ্ছন্দ লাগছিল। প্রথমবার। সড়ক ছাড়িয়ে কাঁচা রাস্তা। তারপরে তেপান্তরের মাঠ—থেকে থেকে অদ্ভুত বাতাস।

—কোথায় যাচ্ছি আদি? রিসর্ট বুক করেছ?
—কোথাও না।

মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। চৈতীপর্ণার দমবন্ধ লাগছিল। ছোট ব্রিফকেসটা বইতে হাঁফ ধরছিল। ক্ষেতের আলে মাথার ওপরে দুহাত ছড়িয়ে উর্দ্ধমুখী শিলাদিত্য। পরনে টীশার্ট-বারমুডা। কণ্ঠলগ্ন দুলছে নতুন ক্যামেরা। অনবদ্য, ভাবছিল চৈতীপর্ণা।
—আদি, প্লিজ...। বলোনা কোথায় উঠব? গেস্টহাউস?

শিলাদিত্য হাসল, না-সূচক মাথা নাড়ল। চৈতীপর্ণার বুকের ভিতরে গুরগুর অনিশ্চয়তা। হাঁটতে হাঁটতে মাঝবেলা। ভাঙনধরা নদীর শুকনো চরে বাসন্তী উত্তাপ। বেলগাছের পেটে শিবমন্দির—সব শুটিং স্পটের মত। দিনটা কেটে গেল এধার-ওধার। অর্ধভুক্ত, ধূসরিত।
—বাড়ি চলো আদি। একটুও ভালো লাগছেনা।
—না...কয়েকদিন থাকি।

খুব ভয় করছিল চৈতীপর্ণার। গোটা ষাটপঁয়ষট্টি পরিবারের সশঙ্কিত দিনযাপন। কোনো বন্যায় তাও হয়তো অনস্তিত্বের খোলসে। নদীতীরবর্তী পরিত্যক্ত ছ্যাঁচাবেড়ার ডেরা। ভাঙা ছাত গলে ঘরে ঢুকে পড়েছে আকাশ। জড়াজড়ি গাছগুলো। খাবার পরে খোদলানো মাটির মেঝেতে অতিথির জন্যে নারকেলপাতার চাটাই পেতে দিয়ে গেল ওরা। অদিনের সম্বল তেলটুকু জ্বালিয়ে দিল ছোট্ট লম্ফ। এইটুকুই পারল অর্ধাশনক্লিষ্ট মানুষগুলো।

—একটু দেখেশুনে থাইকবেন দিদি।

ভাঙা দরজার ঝাঁপ ভালমত বন্ধ করা গেলনা। রাত কত বোঝা মুস্কিল। থেকেথেকে কাঠচাঁপার, আরো কী মিশ্র ভেষজ গন্ধ। চৈতীপর্ণা শক্ত মেয়ে। পার্স থেকে রুমাল বের করে চোখমুখ মুছল। শিলাদিত্য উঠে দাঁড়িয়েছিল। যদিও সে বিশেষ দীর্ঘায়তন নয়, ঘরের ছাত মাথায় ঠেকেছিল। সে খুলে রেখেছিল তার পোশাক। দরজার আগল সরাচ্ছিল। চৈতী আঁকড়ে ধরল তার হাত। সমস্তটা একটা শিল্যুটের পরিভাষা। দপদপ করছিল লম্ফ।
—কোথায় যাচ্ছ?

কি যেন বলল সে গোঙানির মত। বোঝা গেলনা পরিষ্কার। এখন মানুষের চেয়ে ছায়া বৃহৎ। বিশালকায় গুহামানব। চৈতীপর্ণা জাপটে ধরে ঝাঁকাল তাকে,
—কী হল আদি! প্লীজ... ওঃ ভগবান। কোথায় যাচ্ছ তুমি এই রাতে?

অন্ধকার। লম্ফ নিভে গিয়েছিল। কখন যেন তারা বেড়িয়ে এল গুহা থেকে। চৈতীপর্ণা বৃথাই চেষ্টা করেছিল ওকে আটকাবার। নদীর চরে আধিভৌতিক আলোয় উবু হয়ে বসা চতুষ্পদ সঙ্গমলিপ্ত হয়েছিল। তার শরীরের নীচে অসহায় ক্রন্দনরতা মানবী। তার আপাদমস্তক লেহন করে সেই চতুষ্পদ খুঁজে যাচ্ছিল পাগলপ্রায়। অদূরে ছলছলে অশরীরি জল। পাড় ভাঙছিল ঝপাস ঝপ।
—না...না.....না.!

সেই হাহাকার শুনতে পেল নিসর্গ। পাশ দিয়ে যেতে যেতে মুখ উঁচিয়ে তাকাল গোটাদুই সরীসৃপও। পরের ভোরের নমনীয়তা ঢুকে পড়ছিল ঘরসংলগ্ন মহানিম গাছটার ফাঁকফোকর বেয়ে। একফালি চাটাই-এ নিঃশব্দ নিদ্রায় দুজন। পুরুষটি অধিকার করেছিল প্রায় সমস্তটা জায়গা। একপাশে কোনওক্রমে গুঁড়ি মেরে মেয়েটি। কি করে এঘরে ফিরে এসেছিল, পরে চৈতীপর্ণা কোনোদিন ভাবতে চাইতনা। আলো ফুটলে সে চলে যেতেই পারত। অথচ গুটিয়ে বসে রইল অবসন্নের মত। তার ম্যানিকিওর-পেডিকিওর করা নখের কোলে মাটি। চোখের জল শুকিয়ে কালো দুই গাল। মোবাইলে একবার কল এসেছিল বাড়ি থেকে। সে শুধু বলল, তারা নিরাপদ।

শিলাদিত্য নিজের সঙ্গে ঘুরে বেড়াল আদাড়ে, স্নান করল। নদীর কোল ঘেঁষে ঘুমোল। ডিঙি বাইল। ফোটো তুললনা। চৈতীপর্ণার পায়ে দার্ঢ্য। ভাবছিল, কতদূর, দেখা যাক! তীক্ষ্ণ রাগ হচ্ছিল, ঘৃণা এবং দুঃখও। শিলাদিত্য সাথে ডাকলে যেত সে। খুব ইচ্ছে করেছিল, যতই কেননা বিতৃষ্ণা জন্মাক। কিন্তু একবারও মনে হয়নি যে সে প্রতারিত। সে নীরবে অপেক্ষা করছিল কবে শিলাদিত্য ফিরে যেতে চাইবে। দিনদুয়েক পর সকালে শিলাদিত্য নিজেই বলেছিল,
—ফিরব আজ। তুমিও তো?
—ফিরতে তো হবেই। এভাবে কি থাকা যায় না কি?
—তাও ঠিক।

ফাটল-ধরাটা বোঝা যাচ্ছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল দুপক্ষের বাড়ির। মনের সঙ্গে অবিরল বোঝাপড়া করছিল চৈতীপর্ণা। কোন কারণ নেই, তবু পরিণতিহীনতার আশঙ্কা। আর ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল সে। সন্দেহ করেছিল, এরপর তার বাড়ি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য চাপ আসতে চলেছে। সে বাঁচতে চাইছিল, বাঁচাতেও—জেনে বুঝে, যে রাস্তা ক্রমশঃ অমসৃণ হয়ে পড়বে দুদিক থেকেই। বিনিময়ে যা ছাড়তে হতো তা সে জন্ম থেকে কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। তাতে সে রাজী ছিল।
—আদি...প্লিজ বায়োডাটা দাও...দারুণ কম্পানী—ল্যুক্রেটিভ অফার—ফরেন যাবার অপর্চুনিটি!
—না। আমি তো চাইনা...!
—কেন ট্যালেন্ট নষ্ট করছ? তুমি কি চাও আদি? দ্যাট রাস্টিক রিমোট এরিয়া—কী যেন নাম! আদি, সব্বাই বেটার কিছু এক্সপেক্ট করছে।
—ওটা তাদের প্রবলেম। আমি...।
—জব স্যাটিসফ্যাকশন ম্যাটারস আদি! গোঁয়ার্তুমিতে কি হয় বলো?
—বিষয়টা পুরোপুরি ব্যক্তিগত।

অনেক কিছুই বোঝানো যায় না। বেড়ে বেড়ে যাচ্ছিল ফাটল। হয় সবটা ভেঙে দিয়ে নোতুন খোলসে যেতে হত, আর নাহয় ফাটলকে বাড়তে দিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান। শেষদিন কোর্ট থেকে বেড়িয়ে সামনেই কাঁদল চৈতীপর্ণা। হার হল কিম্বা হারাল—অথবা দুইই। অন্যদিকে স্তব্ধ উদাস মুখ। কেমন বিষণ্ণও।


।। চার।।

পিঁচুটি-চোখো কঙ্কালসার বুড়ো হাঁটু অবধি লুঙ্গি গুটিয়ে বসে ঝিমোচ্ছিল ভাঙ্গা রোয়াকে। চুরচুরে ফাটা চশমা দিয়ে শিলাদিত্যকে দেখেছিল আপাদমস্তক—পোশাক, আভিজাত্য, পালিশ। অবিশ্বাস নিয়ে বলেছিল,
—অ! আপনেই থাকবেন ভাড়ায়? দেখেন কদ্দিন পারেন! মালিকেরাই আসেনা কত বচ্ছর!

তার এঘরে একটা জীব থাকে। কদাচিৎ বেরোয়, সেঁটে থাকে চটা-ওঠা দেওয়ালে, ঘুরে চলে যায়। জিভ বের করে পোকা খায়। ভেঙায়ও। সম্ভবত ওটা টিকটিকির বন্য সংস্করণ। হঠাৎ দেখলে অন্য কিছু ভ্রম হয়। প্রথমদিকে অস্বস্তি হত। আজকাল না দেখলে মনে হয়, গেল কোথায়? তক্তপোষের পায়ায় ঘুণ। মৃদু আওয়াজ হয় সারারাত ধরে। সকালে কোণে হলুদ কাঠের গুঁড়ো। ঘরে একটা ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলে কারেন্ট থাকলে। ফ্যানের পয়েন্ট আছে—ইচ্ছে করলে ফ্যান লাগানো যেত। সে আর এসব নিয়ে মাথা ঘামায়না। যা আছে, যা নেই সবই তার গ্রাহ্য। বাড়ি থেকে মা-দিদিদের ঘনঘন ফোন আসত বলে একদিন স্টেশনের পথে গোরস্থানে ফেলে দিয়েছে মোবাইল। সিম আর চার্জার পুকুরে। অনেক আগে সে মেসেজ জমাত। এখন স্টেশনের কাছের বুথ থেকে কালেভদ্রে বাড়িতে ফোন করে। বাড়ির লোকের এখানে আসাটা প্রায় অবিশ্বাস্য। সে দুঃস্বপ্নেও শেভ্রলে কিম্বা ইণ্ডিকার একটাকেও এখানে দেখতে চায়না। কয়েকদিন ধরে ফাণ্ডামেন্টাল রাইটস-এর বাংলাটা মনে করার চেষ্টা করছে! অভিধান নেই তার কাছে। ইঁটভাঁটায় লেগে-থাকা সাপের খোলস থেকে ফ্যান-বিহীন চ্যাটচ্যাটে গরমকাল সবটাই বিশিষ্ট। দিঘি থেকে গোসাপ উঠে এসে রোদ পোহায় কখনও টিউবওয়েল-এর চাতালে। একতলায় কটি ঘর, কজন সদস্য সেসব সে কিচ্ছু জানেনা। গায়ে-পড়া আত্মীয়তা স্নায়ুর গতি বাড়িয়ে দেয়। সেসব দিনে তুমুল গীটার বাজায় সে।

—আপনে কাঞ্জিলালদের বাড়িখানায় ভাড়া থাকেন? আলিশান বাড়িখানের আছে কিছু? মালিকেরাই সব সহরে গিয়া থাকে। রেলগাড়ির সহযাত্রীর অনেক জ্ঞান এবিষয়ে।
—অখন যে কেয়ারটেকার, হারান পাড়ুই— তার পরিবারের কিস্যাখান শুনছেন নাকি? আগে জানলে ভালো একখান বাসা দেখে দিতাম আপনেরে।

সে চুপ করে অন্যদিকে চেয়ে রইল। আগ্রহ নেই। অথচ চারপাশে কৌতূহলি কানগুলি।
—অল্পবয়সী মাইয়ামানুষ আছে, দ্যাখছেন নাকি তারে? অ ভাই!
—নাঃ।
—বড়ব্যাটার বৌ, ছোট ছেলে তারে ফুসলাইয়া...নষ্ট করছিল। হারান পাঁচজনের ভয়ে বড়ডার সাথে হের বিয়ে দিছে। বড়ডায় ন্যালাখেপা, বৌ পেয়ে খুশি। ছোটটা কই যেন থাকে—খুবই স্যায়না...।

একসময়ে বক্তা থামল। দম নেওয়ার সময় দিল শ্রোতাদের।
—মাইয়াটাও এমন ওদ্ভূত! দ্যাখবেন নজর করে— কচুপাতাডার মত চকচইক্যা। জল পিছলাইয়া যায়—এমন......

ট্রেন আটকে ছিল সিগন্যালে। দুধারে ধানক্ষেতের সবুজ। আর শোনার সময় ছিলনা তার। লাফিয়ে নেমে পড়েছিল মাঝরাস্তায়, তারপর হাঁটা। টানটান হয়ে উঠেছিল সংবেদনশীল পেশী। সেদিন ঝড় তুলেছিল গিটারের তার। অথচ আজকাল কবে-কেন-কখন-কারা এসবে ইদানিং তার বিন্দুমাত্র উত্তেজনা জন্মায়না। যে কোনো ঘটনাতেই মনে হয় যেন ওইরকমটাই স্বাভাবিক ছিল।

শিলাদিত্য বারকয়েক তাকে দেখেছিল। দিঘির ঘাট থেকে মাথায় জড়ানো গামছার উপরে কচুশাকের বোঝা বা একরাশ বাসন। ভিজে লেপ্টানো একফেরতা শাড়িটা নেমেছে হাঁটুর সামান্য নিচে। আচ্ছন্ন অন্ধকার কলাবনের মধ্যে দিয়ে সন্ত্রস্ত অশরীরি চলন। দেখেছিল, লক্ষ্য করেনি। সাঁতার সে জানেনা একেবারে, তবুও কিছুদিন ধরে আগাছা-ঘেরা পর্দানশীন দিঘিটা ডাকছিল তাকে। কোন এক সকালে যখন বৃষ্টি নেমেছে সবে, সে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই ভাঙনধরা ঘাটের সিঁড়িতে। নিঃসীম নির্জন সবুজের ঘেরাটোপ। কেউ কোথায় নেই। নিস্তরঙ্গ জলে শেফালি-বৃষ্টির ফোঁটা। মুষলধার নয় কিন্তু বাঁধনছাড়া, ছন্দিত। জলের ঝরোখার আড়ালে দিঘির জলে অনায়াস নিরাবরণ ভাসছিল যে, ঘাটে রাখা ছিল তার কাপড়চোপড়, গামছা, পেতলের ঘড়া। সম্ভবত ওই সময়ে শিলাদিত্যর অপ্রত্যাশিত উপস্থিতি তার জল থেকে উঠে আসাটা বিলম্বিত করছিল। কতক্ষণ পরে ঘরে এসেছিল শিলাদিত্য নিজেই খেয়াল করতে পারেনি। তার কিছু মনে ছিলনা। তারপর অনেকক্ষণ গীটার সঙ্গত করেছিল বৃষ্টির সাথে। উপশিরায় রক্তস্রোতের উথালিপাথালি। দুঃখের ছোটো ছোটো দানাগুলো মুখে, মাথায় বা বুকের চারপাশে। ঘুমের ভিতরে রান্নাঘরের টিনের চালে বৃষ্টিগান টুংটাং। বর্ষা কিন্তু তখনো তেমন করে আসেনি। বৃষ্টিরা লুকোচুরি খেলে যায়। ছোটবেলায় পড়া আলোছায়ার রূপকথা মনে পড়ে। সত্যিকারের অরোরা-বোরিয়ালিসে কেমন সবুজ, দেখতে ইচ্ছে করে তার।


।। পাঁচ।।

মনই কোনো একদিন তার ছুটি ছিল। ভাতের ছোট্টো ডেকচি স্টোভে বসিয়ে ভাঙা ছাতে বসে সুর বাঁধছিল অবেলায়। হঠাৎ কী একরকম ঘ্রাণ টেনেছিল তাকে। পিছন ফিরেছিল তাই। হাতে একটা বাটি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, তার কাপড় সিক্ত ছিলনা তখন। মাথার চুল পরিপাটি। জলজ উদ্ভিদের মতন ত্বক। কপালে ঘাম। গোলাকার অস্থির দুটি পাখির চোখ। শ্বাসের সঙ্গে উদ্বেল অচর্চিত সুপক্ব নারীত্ব। যৌনতা। আকর্ষণ। শিলাদিত্য একদৃষ্টিতে দেখছিল আপাদমস্তক। তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ ধরে। হয়তো কিছু বলার কথা ভেবেছিল সে। মনে পড়েনি। প্লেটে-ঢাকা হাতের ছোট্ট বাটিতে কিছু ছিল। মেয়ে ফিসফিস করেছিল—
—কচুর শাগ। শ্বশুর কইছিল দিয়ে যেতে।

শিলাদিত্য বাটিটা নিতে হাত বাড়িয়েছিল। আচমকা ছুঁয়ে গিয়েছিল তার হাত। ঝটকা লেগেছিল বৈদ্যুতিন স্পর্শের— হয়তো বা গরম বাটিটা থেকেই! কিন্তু তাতে চেনা, লক্ষ বছরের চেনা স্পর্শ। সে অত্যধিক চমকে উঠেছিল।

ইদানিং সে কাজে যায় অনিয়মিত। নেহাত সরকারী স্কুল, ছুটিও অনেক। স্পৃহা হয়না আরো অনেক কিছুতেই। অভ্যস্ত সকাল থেকে সন্ধে কেটে যায় চমৎকার। ঘুরে বেড়ায় এধার ওধার। ভারী ভালো আছে শিলাদিত্য একেবারে নিজের সাথে। সে এখন দত্যি—দিত্যর অপভ্রংশ। বর্ষার চটচটে কাদায় দ্রুত হাঁটলেও পা পিছলোয় না তার। পুকুরের জলে মুখ দেখে হুমড়ি খেয়ে। এখন সে দারুণ সাঁতার দিতে পারে। তার পাশে গা লাগিয়ে ভেসে চলে জলঢোঁড়া। সে খুশি হয়ে বলে,
—আরে বাঃ!বাঃ! হারিয়ে দিবি নাকি?

গ্রামশেষের পরিত্যক্ত কবরখানায় বসে থাকে অসময়ে। ভিতরে তোলপাড় অস্থিরতা, অস্বস্তি, যার কারণ খুঁজে খুঁজে হয়রান সে। দ্রুতগামী ট্রেনের অভ্যস্ত তীব্র হুইসেলে এখন সে অদ্ভুত চমকে ওঠে অবুঝ জানোয়ারের মত। বুকের মধ্যে কিছু যেন ফালাফালা হয়ে কাটে। অনেক সময়ে অনুভব করে যেন বিশাল হয়ে উঠছে তার আকৃতি। বারে বারে মনে হয়, ফিরতে হবেই।
—নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাচ্ছি! নিশ্চয়ই।

আপন মনে বলে। তারপর নিজেই জবাব দেয়,
—মোটেই না। রাইট টু লিভ-বাঁচো-সব্বাই বাঁচো— চৈ-তী-প-র্ণা! তুমিও। ওঃ সেই ক্যামেরাটা আনা হয়নি। সে যাক!

সে মাঝে মাঝে নিজে থেকেই আসে। কখনো তরকারির বাটি হাতে, কখনো অকারণে। ঘরে ঢোকেনা। দত্যি তার নাম জানতে চায়না। কথাবার্তাও হয়না কিছু। নীরবতার অর্পূব আমেজে ভাসতে থাকে। মেয়ে কোন ফাঁকে শেষ সন্ধেয় এসে নিশ্চুপ সেঁটে থাকে দোতলায় ওঠার ভাঙা সিঁড়ির গা ঘেঁষে সরীসৃপের মত। দাঁড়িয়ে কিম্বা উবু হয়ে বসে। ঘরের টিমটিমে ইলেকট্রিক বাতিটা অসমান আলো ছিটকায়। অথবা লোডশেডিং-এ মোমের একপেশে সংক্ষিপ্ত আলোয় ঘরটা বৃহদাকার প্রাগৈতিহাসিক গুহা। ছাতের ওপরে ঝুলে থাকা ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁক গলে আসা আলো ফুরিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় সময়ও। দু-এক সময়ে উড়োজাহাজের আওয়াজ ভেসে এলে সে দুহাতে কান ঢেকে থাকে। তার অচেনা ঠেকে, ভয়-ভয় করে। দূরাগত দীর্ঘ শঙ্খধ্বনি শাব্দিক মোহ নির্মাণ করে রাখে কিছুক্ষণ। সে পিড়িংপিড়িং গীটারে নেশাধরানো বেখেয়ালি সুর বাজায়। কিম্বা চেয়ার পেতে নিথর বসে থাকে ভেঙে পড়া কার্নিশ ঘেঁষে। ঝিঁঝিঁরা শব্দায়িত হয়, বেতালা হাওয়া চুঁয়ে আসে, ছুঁয়ে দিয়ে যায়। মেয়েটা কী যে গুনগুন করে অস্ফুটে। সে শোনে। সেই অশরীরি সুরটুকু পাক খেয়ে ঘুরতে থাকে। মেয়েটার চুল, অপরিষ্কৃত বাহুমূল বা বুকের অসহ্য সুন্দর খাঁজের বন্য অশোধিত শরীরি গন্ধ তাকে অস্থির অস্থির করে জ্যোৎস্নারাতে কিংবা নিঃসীম অমাবস্যায়। খোঁজে সে। ফিরে যেতে চায়। সেই মুহূর্তে কখনো নীচ থেকে বয়সিনীর ককর্শকণ্ঠ শোনা যায়,
—অরে অ বৌ...অ হারামজাদি! গেছিস কই?

—হে আত্মবিস্মৃত অমৃতের সন্তানসকল!......
......ফেরো...এখনও হয়তো সময় চলে যায়নি।

তারপর সেই উন্মুক্ত আকাশের নীচে মুখের দুধারে দুহাত রেখে চিৎকার করে ডেকে বলেছিল সে। সেই ডাকে প্রচলিত কিম্বা অপ্রচলিত কোনো ভাষা ছিলনা। তরঙ্গায়িত শব্দসংকেত ধরতে পেরেছিল শুধু নিকৃষ্ট পশুরা। কিন্তু বোঝার মত প্রজ্ঞা তাদের নেই বলে অর্থ বুঝতে পারেনি। গোটা দুই জংলী কুকুর মুখে মুখ লাগিয়ে আদর করছিল পরস্পরকে। খুশি হল তারা। কয়েকটি হরিন জল খাচ্ছিল নিকটবর্তী জলাতে। বানরীরা বুকের ভিতর বাচ্চা আগলাতে আগলাতে উৎকর্ণ শুনেছিল লক্ষ বছরের বিস্মৃত কিন্তু পরিচিত ডাক। কখনো কখনো কিছু এমন ঘটনা ঘটে যায়। নির্ঘুম জোনাক-জ্বলা নিশুতি রাতে সেই অখ্যাত ভগ্নস্তূপের প্রসারিত চৌহদ্দিতে একা ঘুরে বেড়াত দত্যি। পায়ের নীচে খসখস করত ঝরা পাতারা। দিঘির অস্বচ্ছ ঘুমন্ত জলে নারকেল বা কলাপাতা পড়ার শব্দ উঠত। সে ক্রমশঃ বদলে যাচ্ছিল—আরো আরো আরো। কোন্‌ এক অবিশেষ মধ্যরাত্রে বর্ষাঋতু তখন প্রায় শেষ, সবুজ কার্পেটে বড় বড় কাশফুলের নক্সায় পরিবর্তনের নিশান। এক সময়ে গোলার্ধের কোথাও কোথাও মৃগয়ায় যেতেন অধিপতিরা এই ঋতুতে এবং আজও সৃষ্টির তাগিদে মিলিত হয় মনুষ্যেতর। তেমন একদিন অশ্রুত দুবোর্ধ্য সঙ্কেতে সে ডেকেছিল তার প্রার্থিতাকে। সে অনন্য মুহূর্ত ছিল। অস্ফুট আলোতে আকাশে অসামান্য ছাইছাই রঙ। কোটি বছরের চাঁদ তখনো জেগে ছিল। তারারা নীরবে ঝুলছিল ঘুমোতে যাবার আগে।

—এখন ফেরার সময়......
—তৈরি আছি সেজন্যে...
—তাহলে চল...

হয়ত এভাবেই সম্মতি চেয়েছিল সেই মানুষ কোন যুগান্তের ভাষাতে। কেউ বোঝেনি। বোঝা যায়নি। তারা নিঃশব্দে দ্রুত পার হয়ে চলছিল সভ্যতার সমস্ত হিসেব-হদিস— সমগ্র দুর্গন্ধ অন্ধকার, নগ্ন প্রতিদ্বন্দিতা। অবশেষে, যখন ভোর, তখন আলোকিত পৃথিবীর অনবদ্য চিরকালীন সবুজের মধ্যে দাঁড়িয়ে বুক ভরে অমল শ্বাস নিয়েছিল দুজনে। এখানে আকাশরেখায় অনন্ত সবুজ। উদার ও অফুরন্ত। তারা দুই প্রাণী এখন পরিশ্রান্ত, কিন্তু উচ্ছ্বসিত। তারা এখন নির্মোকহীন এবং সভ্যতার সবশেষ চিহ্ন তাদের পরিধেয় থেকে সদ্যমুক্ত নারী ও পুরুষ। অদূরে জলাশয়ে যেখানে মুখ ডুবিয়ে হরিণেরা জল খায়, সেখানে কচুরিপানার গাঢ় সবুজ আস্তরণে হাসিমুখের বেগুনি ফুল। তার নীচে সাপেরা লুকোচুরি খেলে। পিপাসার্ত পুরুষ দুহাতের অঞ্জলি ভরে জলপান করল তৃপ্তিতে। হয়তো হাসল। জল ছিটিয়ে দিতে লাগল সঙ্গিনীর লজ্জাবোধহীন নির্বাধনগ্নতায়। পরস্পরের আপাদমস্তকে কাদামাটি মাখিয়ে দিয়ে নিরত হয়েছিল খেলায়। লুব্ধ শরীর-বোধ ছিলনা, তবু তারা উত্থিত হয়ে উঠছিল আলোর সাথে সাথে। সহজ স্বভাবসিদ্ধ অনুগমন। আশ্রিত বনজ লতারা সাবলীল দুলছিল বড় গাছ থেকে। ভাসছিল সজীব শালুক ফুল। তারপর একসময়ে পুরুষ সবুজ গালিচায় তার শরীরের নীচে কোমলতা পেষণ করতে করতে ডুবে গেল অন্যতম আদিম ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায়। হয়তো বা অসচেতনতায় অথচ বিবর্তিত সৃষ্টির তাগিদে, অনাগত কিন্তু সম্ভাব্য ধ্বংসের পরে। মুহূর্তে যেন সে স্পষ্ট দেখেছিল ব্যথিত ক্লিষ্ট সপ্রতিভ মুখ এক, খুব পরিচিত কিম্বা একেবারেই নয়। আর, সম্পূর্ণ বিস্মৃত হওয়ার আগে সে শেষবারের মত সানন্দিত উচ্চারণ করছিল সভ্যতার ভাষায়,
—...ফিরে যাচ্ছি......।


।। শেষকথা ।।

রাজর্ষি উঠতি আর্টিস্ট। বেশ কয়েকটি প্রশংসিত একজিবিশন হয়ে গেছে তার। আপাতত প্রিমিটিভ-আর্ট স্টাডি করতে স্পেন এসেছে গত সপ্তাহে। একই সঙ্গে হনিমুন। আলতামিরার স্বল্পালোকিত গুহার ভিতরে নানা এঙ্গেলে পেন্টিং দেখতে দেখতে প্রয়োজনীয় নোট নিচ্ছিল। চৈতীপর্ণার হাতের পাওয়ারফুল ক্যামেরা আপাতত শান্ত। ফ্ল্যাশ অফ।
—জাস্ট ওয়াচ চৈতী...ইউজ অব কালার! সব ন্যাচারাল— চারকোল— উঃ, ব্রিলিয়ান্ট। এইসব কবেকার জানো? আঠের হাজার বছরের পুরোন! প্যালিওলিথিক - আপার প্যালিওলিথিক এজ-এর! মধ্যপ্রস্তর যুগেরও অল্প আগে। দ্য ডন অব সিভিলাইজেশন...ওয়াও, টেরিফিক এক্সপ্রেশন। সাঙ্ঘাতিক!
—প্যা-লি-অ-লি-থি-ক?

বিড়বিড় করল চৈতীপর্ণা। হঠাত শিরশির করে উঠল কেন সমস্ত শরীর! দমবন্ধ।
—সে ফিরতে চেয়েছিল? ই-লি-উ-শ-ন! ই-লি-উ-শ-ন ! ওঃ মাগো।

মাথা ঘুরছিল তার। টলে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। বাইরের ঝকঝকে আলোয় এনে সযত্নে বসিয়ে তার বর বলল,
—এখানে বোসো। আমার কাজ খানিকটা বাকি। শেষ করেই আসছি। টেক কেয়ার। ঠিক আছে?

চৈতীপর্ণা নিস্পন্দ চেয়ে রইল সামনের দিকে। অবাধ দিবালোকে ভেসে যাচ্ছে চারিপাশ। পিছনে অন্ধকার।



(পরবাস-৫১, জুন-জুলাই, ২০১২)