দ্বীপের শরীরের কোনো এক কোণে হঠাৎ একদল হাসিখুশি বদ্রীপাখি ডেকে উঠল। হুমদো জ্যাকেট, টুপি আর দস্তানায় আপাদমস্তক ঢেকে সবে ডিপার্টমেন্টের কাচের সদর দরজা ঠেলে বাইরের উৎপটাং ঠাণ্ডায় পা রেখেছে দ্বীপ। বিন্দুমাত্র ধারণা নেই সেল ফোনটা তার অজস্র পকেটের ঠিক কোনটায় বাজছে, তাই সেটা খোঁজার কোনো চেষ্টাই করল না সে। যখন পার্কিং লটে রাখা গাড়ির কাছে পৌঁছল, পাখিরা ততক্ষণে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে চুপ করে গেছে। ডানহাতের দস্তানা খুলে এ পকেট সে পকেট হাতড়ে, জিনসের বাঁ পকেটে সিগারেটের প্যাকেটের তলায় চাপা পড়া ফোনটাকে দু আঙুলে টেনে বের করে দেখল মিস্ড কলে বৈশাখী বৌদির নাম। ততক্ষণে ভয়েস মেলের চিহ্নটা ফুটে উঠেছে।
গাড়ির ভিতরটা বাইরের চেয়ে কিছু কম ঠাণ্ডা নয়, তাই দ্বীপের ইচ্ছে ছিল গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে হিটার চালিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট খাবে। কিন্তু শিকাগোর কুখ্যাত হিমেল হাওয়ার দাপটে সে সাহস হল না। তাড়াতাড়ি গাড়িতে ঢুকে স্টার্ট দিয়ে টুপি দস্তানা পরেই বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ফোন করল বৈশাখী বৌদিকে। বৌদি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ধরেই বললেন :
— এক্ষুনি তোমায় মেসেজ রাখলাম। আসছ তো আজ সন্ধেয় এখানে?
— আজ আমায় বাদ দিন বৌদি। প্রচুর কাজ পড়ে আছে। দ্বীপের গলায় ক্লান্তি।
— আরে দূর! শুক্রবার সন্ধেয় আবার কাজ কী? চলে এসো তো! আরো অনেকে আসছে। সপ্তাহে একটা দিন একটু আড্ডা দেবে, তা না কাজ দেখাচ্ছে! সাতটার মধ্যে পৌঁছে যেও কিন্তু।
দ্বীপ জানে বৌদির সাথে তর্ক করে লাভ নেই। যেতে তাকে হবেই। তাই সম্মতি দিয়ে ফোন ছেড়ে দিল। তারপর বিকেলের বিরক্তিকর শ্লথ ট্রাফিকের মধ্যে ঢুকে বাড়ির পথে রওনা দিল। একঘেয়েমি কাটাতে চন্দ্রবিন্দুর 'ডাকনাম' সিডিটা পুরে দিল স্টিরিওতে।
দ্বীপের পুরো নাম স্বপ্নদ্বীপ। স্বপ্নদ্বীপ লাহিড়ি। কলকাতায় ইতিহাসে এম এ করার পর দুটো মার্কিন ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাচীন ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বে এম এ আর পিএইচডি করে সে এখন শিকাগোর এক নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ায়। এম এ পাশ করার পর বছর কয়েক দক্ষিণ কলকাতার একটা ট্যাঁশ স্কুলে পড়িয়েছিল। লিটল ম্যাগাজিনে নানা বিষয়ে দুচারটে প্রবন্ধও লিখেছিল। সত্যি বলতে কি, সে এতে একরকম খুশিই ছিল। তারপর একদিন কলকাতার মিউজিয়ামে খ্যাতিমান মার্কিন প্রত্নতাত্ত্বিক মাইকেল কো-এর লেকচার শুনতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ জমে যায়। কো-ই তাকে প্রস্তাব দেন আমেরিকায় তাঁর কাছে পড়াশুনা করার। গররাজি থেকে নিমরাজি হয়ে, অবশেষে এক সময় সে পাড়ি দেয় বিদেশে। দ্বীপের গবেষণা মধ্য আমেরিকার প্রাচীন সমস্ত সংস্কৃতি নিয়ে, বিশেষত ঐ অঞ্চলের মায়া সভ্যতা। সেই সুবাদে সে মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, হন্দুরাস প্রভৃতি দেশে ঘুরেছে আখছার। প্রখ্যাত মেক্সিকান ও মার্কিন প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে শিক্ষানবীশি করেছে প্রাচীন ভগ্নস্তূপ খোঁড়ার কাজে। স্প্যানিশ আর মায়া ভাষার কয়েকটা শাখায় তার দখল যথেষ্ট। ইদানিং সে মায়া জীবনদর্শন ও রণনীতির সম্পর্ক নিয়ে একটা বই লিখছে।
কলকাতায় সুকিয়া স্ট্রিটে দ্বীপদের পৈতৃক বাড়ি। দ্বীপের বাবা অরণি লাহিড়ি উত্তর কলকাতার নামজাদা ডাক্তার। মা তনুশ্রী স্কুল শিক্ষিকা, সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। সাত বছরের ছোট বোন রিনি বাবার পেশা নিয়েছে, হাজরায় তার শ্বশুরবাড়িতেই তার চেম্বার। রিনিই ওর ভালোনাম, যে কারণে দ্বীপ বরাবরই ওকে হিংসে করে এসেছে, কেন না নিজের নাম নিয়ে দ্বীপের হেনস্থার শুরু সেই ছেলেবেলায়। আর কোনো বাঙালি নামে তিন-তিনটে যুক্তাক্ষর আছে বলে তার জানা নেই। ইংরাজিতে লিখলে দুটো ডবল-ইউ। মার্কিন সহকর্মীদের কাছে প্রথম থেকেই এখানে তার ডাকনাম হয়ে গেছে 'ড্যুইপ'। দ্বীপ বেশ কয়েকবার সিরিয়াসলি ভেবেছে এফিডেভিট করে নামটা বদলে ফেলবে, নিদেন 'স্বপ্নদীপ' করে ফেলবে। একাধিকবার ভেবেছে, কিন্তু পারেনি, কারণ নামটা কাকাই, মানে দ্বীপের একমাত্র কাকা অশনির দেওয়া।
অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দরজার পাশের ছোট টেবিলটায় চিঠিপত্র আর চাবির গোছা নামিয়ে একে একে জ্যাকেট, টুপি, দস্তানা মাফলার, ভারি জুতো খুলে ক্লোসেটে রেখে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল চাপাল দ্বীপ। তারপর জুতো জামা খুলে বসার ঘরের সোফায় পা তুলে বসল। বুকসেফের ওপর কিছু পাথরের ছোট মূর্তি ও অন্যান্য প্রাচীন সামগ্রীর আশেপাশে স্ট্যাণ্ডে রাখা কয়েকটা পারিবারিক ফটো। মা, বাবা, রিনারা। তারই মাঝে মলিন হয়ে আসা একটা বড় সাদাকালো ছবি, যা অন্যগুলোর পাশে বেশ বেমানান। পুরীতে সদ্যভাঙা ঢেউয়ে কোমরজলে দাঁড়িয়ে এক হাসিমুখ ঝকঝকে যুবক। পরনে কেবল শর্টস। ছিপছিপে শরীর, একমাথা ভিজে কোঁকড়া চুল, চাপ দাড়ি, দীঘল চোখ। অবিকল দ্বীপ। তার কাঁধে তারস্বরে চিৎকাররত, আতঙ্কিত এক শিশু। দ্বীপ বরাবরই শুনে এসেছে কাকাইয়ের সঙ্গে তার চেহারার মিলের কথা। আর বছর-দুয়েক বয়েসে পুরী গিয়ে কাকাইয়ের কাঁধে চড়ে তোলা এই ছবির গল্পও বহুবার শুনেছে মায়ের কাছে। ঢেউয়ের গর্জনে সে ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করলে অশনি তার ভয় ভাঙানোর জন্য তাকে কাঁধে তুলে জলে নেমে গিয়েছিল। তবে তাতেও যে আদৌ তার আতঙ্ক কাটেনি তা ছবিটা দেখলেই মালুম হয়।
আনসারিং মেশিনের আলোটা দপদপ করছে। ভয়েস মেল শোনার বোতামটা টিপে দিয়ে, একটা সিগারেট ধরিয়ে মোড়ার ওপর পা তুলে সোফায় গা এলিয়ে বসল দ্বীপ। মেসেজে মায়ের গলা: 'নিশ্চয় বেরিয়েছিস। কাল সকালে একবার ফোন করিস বাবা! আর সাবধানে গাড়ি চালাস! বড় চিন্তা হয়! রাখছি।' আমেরিকায় ড্রাইভিং নিয়ে মায়ের বরাবরই দুশ্চিন্তা। বহু বুঝিয়েও ফল হয়নি। প্রত্যেকবার এই সাবধানবাণী দেবেনই। কাল শনিবার, ১৩ই জানুয়ারি। দ্বীপের ছত্রিশতম জন্মদিন। বহু বছর আগে, তার ছোটবেলাতেই তা পালন করা বন্ধ হয়ে গেছে। ঐদিন সে পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, মা-বাবাকে একবার ফোন তাকে করতেই হয়।
কাকাইয়ের এই চেহারাটা তার মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু আছে। ছেলেবেলার কিছু কিছু ঘটনা আশ্চর্য স্পষ্টভাবে মনে আছে, যা বললে অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা কোনো সিনেমার অসংলগ্ন ক্লিপের মতন। মনে পড়ে কাকাইয়ের মুখটা। ভীষণ ভালোবাসত তাকে। কিন্তু হঠাৎ একদিন কোথায় চলে গেল কাকাই। মা বাবা ঠাম্মাকে জিজ্ঞাসা করলে বলত 'কাজে গেছে'। তারপর একটা রাতের কথা দ্বীপের পরিষ্কার মনে পড়ে। তার বয়স বোধহয় তখন চার। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখে কোঁকড়া চুলওয়ালা এই মুখটা, ঠিক ছবির এই মুখটা তার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। কেবল এই ছবির মতো সেটা এত প্রাণবন্ত নয়, বরং খুব রোগা আর ক্লান্ত। একদৃষ্টে তাকে দেখছে আর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। স্বপ্ন না সত্যি তার তোয়াক্কা না করেই সে উত্তেজনায় উঠে বসেছিল, 'কাকাই! কোথায় গেছিলে তুমি?' উত্তরে একটু হেসে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে তাকে আবার শুইয়ে দিয়ে কাকাই বলেছিল, 'ঘুমো বাবা।' মনে হয় যেন এই সেদিনের ঘটনা। চায়ের জলের কেটলি সিটি মারায় সম্বিৎ আসে দ্বীপের। উঠে রান্নাঘরে গিয়ে গরম জল কাপে ঢেলে। তাতে টি-ব্যাগ চুবিয়ে চা তৈরি করে। তারপর চায়ের কাপ আর গোটা দুয়েক বিস্কুট নিয়ে আবার এসে বসে সোফায়। আবার একটা সিগারেট ধরায়।
দ্বীপ এখানকার বাঙালিদের মধ্যে খুব বেশি লোকের বাড়ি যায় না। তবে বৈশাখী ও সুখময় মিত্রের বাড়িতে খুবই যায়। এখানকার বাকি সকলের সঙ্গেও তার ওদের ওখানেই আলাপ। বৈশাখী বৌদি এক বলার মতো চরিত্র। পঞ্চাশের এপাশ ওপাশ বয়স। দারুণ সুন্দরী নন মোটেই, তবে ঈষৎ ভারি হয়ে গেলেও চেহারায় এমন একটা চার্ম আছে যা একঘর লোকের মাঝেও নজরে পড়ে। চওড়া কপালে ইয়াবড় এক টিপ পরেন মহিলা, এবং তাতে তাঁর চেহারা যে আরও বেশ কিছুটা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে তিনি ভালোরকম সচেতন। আড়ালে তাঁকে অনেকেই বিন্দিরানি বলে। অনর্গল কথা বলেন, ভালো অভিনয় করেন। চাকরি সামলে পিকনিক, রবীন্দ্রজয়ন্তী ইত্যাদির উদ্যোগ নেওয়া ছাড়াও প্রায়ই পার্টি দেন নিজের বাড়িতে অকারণেই, এবং সব রান্না নিজে করেন। বছর পাঁচেক আগে চাকরি নিয়ে শিকাগোতে আসারা পর এখানকার দুর্গাপুজোর আসরে যখন নির্বান্ধব দ্বীপ একা একা বসেছিল, তখন উনিই যেচে আলাপ করেছিলেন তার সঙ্গে। নিজের কাছে অস্বীকার করে না দ্বীপ, যাকে এ দেশে বলে ক্রাশ, প্রথমদিকে বৈশাখী বৌদির প্রতি সেরকম একটা রোম্যান্টিক ভালো লাগা ছিল তার। প্রায়ই চোরাচোখে তাঁকে দেখত সে। বৌদির চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ো সুখময়দা তুলনায় অনেক শান্ত মানুষ, এক তাঁর বাড়ি কাঁপানো অট্টহাসিটা ছাড়া। শ্যামবর্ণ, সুদর্শন চেহারা, অসম্ভব সাদাসিধে আর রসিক লোক। একটা ফুটো লুঙ্গি পড়ে সোফায় পা মুড়ে বসে বাটিতে করে মুড়ি চানাচুর মাখা চিবোতে চিবোতে যখন আড্ডা মারেন আর হা হা করে হাসেন, তখন বিশ্বাস করা কঠিন যে উনি বেশ নামকরা একজন কার্ডিওলজিস্ট। উনি নিজে অবশ্য নিজেকে বলেন হৃদয়গুরু। রবিনসন ক্রুসোর গল্পের সঙ্গে দ্বীপের নামকে জড়িয়ে তাকে তিনি ডাকেন ক্রুসো বলে। চমকে দেওয়ার মতো গানের গলা সুখময়দা'র। ওঁদের একমাত্র মেয়ে তিত্লি, মানে বর্ষা নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে জার্নালিসম নিয়ে পড়ছে।
প্রবাসে দেশওয়ালিদের সাথে সম্পর্ক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশের সম্পর্কগুলোর তুলনায় অগভীর হয়। এখানকার সম্পর্কে পারস্পরিক সহিষ্ণুতার সীমারেখা সহজেই নজরে পড়ে। একটা পর্যায়ের পর প্রত্যেকে নিজের পরিবার, ব্যক্তিগত আবর্তে ঘোরে। বলা যায়, দেশের বন্ধুত্বে যদি ডুব দেওয়া যায়, এখানে হাঁটুজলেই স্নান সারতে হয়। প্রথম প্রথম এতে দ্বীপের বেশ অসুবিধা হত, কিন্তু ক্রমে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন সে এখানকার এই অলিখিত নিয়ম মেনেই চলে, মিত্র পরিবারের ক্ষেত্রেই যার একমাত্র ব্যতিক্রম। সুখময়দা আর বৌদির মাই ডিয়ার স্বভাব আর বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহের জন্য দ্বীপের ভালো লাগে এই দুজনকে। তাঁরাও ওকে যথেষ্ট স্নেহ করেন।
বিস্কুট আগেই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। এখন সিগারেটটায় সুখটান দিয়ে আগে সেটা অ্যাশ ট্রের মধ্যে ভালো করে ঘষে ঘষে নেভায় দ্বীপ। তারপর এক চুমুকে চায়ের বাকিটা শেষ করে উঠে পড়ে রওনা হয় বাথরুমের দিকে। শীতের সময় বাইরে থেকে ফিরলেই বড় গা ম্যাজম্যাজ করে তার, তাই উষ্ণ জলে ভালো করে একটা শাওয়ার নিয়ে ফ্রেস হতে হবে। তারপর বেরোতে হবে বৈশাখী বৌদিদের বাড়ির উদ্দেশে। স্নানে ঢোকার আগে নিজের ওয়াইনের স্টক থেকে একটা ভালো বোতল আলাদা করে রাখল নিয়ে যাবে বলে। এখানকার নিমন্ত্রণে এ ধরনের একটা কিছু নিয়ে যাওয়াটাই রেওয়াজ।
স্নান সেরে সাড়ে ছটা নাগাদ তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল দ্বীপ। শহরের একেবারে অন্য প্রান্তের শহরতলীতে মিত্রদের বাড়ি। ঘন্টাখানেকের রাস্তা, কিন্তু শুক্রবারের সন্ধের ট্রাফিকে সেটা কতক্ষণে দাঁড়াবে কেউ বলতে পারে না। আজ শিকাগোর শীতের মার্কামারা ওয়েদার, অর্থাৎ মেঘলা আকাশ আর হাড় হিম করা হাওয়া। আজ রাতে বৃষ্টি হবেই। আর দেরি না করে দ্বীপ ঝাঁপ দিল ট্রাফিকে, এগোতে লাগল স্বাভাবিক গতির চেয়ে অনেকটাই আস্তে।
এক সময় দ্বীপ ভেবেছিল পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে কোথাও পড়াবে। কিন্তু এখন ফেরা শব্দটার অর্থই বদলে গেছে তার কাছে। মানুষ যেখান থেকে যাত্রা শুরু করে সেখানে ফেরে, আর যেখান থেকে ফেরে সেটা একটা সাময়িক গন্তব্যমাত্র। সে যখন এখানে এসেছিল, তার ফেরার কথা ছিল কলকাতায়। আর এখন সে কলকাতায় যায় বটে, ঘন ঘনই যায়, কিন্তু ফেরে সে কলকাতা থেকে এখানে। অথচ ঘর, মানে হোম বলতে যা বোঝায়, যা নাকি মানুষের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি, সে কি কখনও আমেরিকাকে ঠিক সেভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে? মাঝেমাঝে দ্বীপের সন্দেহ হুয়, লাতিন আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতায় স্পেশালাইজ করলে যে ভারতবর্ষে চাকরি পাওয়ার কোনও আশা নেই তা তো সে জানত, তবু কেন সে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে কাজ করল না? তাহলে কি অবচেতনে তার দেশে না ফেরারই একটা বাসনা ছিল? আবার এও মনে হয়, দেশ মানে ঠিক কি? সে তো আজীবন ছিল কলকাতায়। তা ফিরে গিয়ে কলকাতার বদলে দিল্লি বা বম্বেতে চাকরি পেলে সেটা কি তার কাছে ঠিক ঘরে ফেরা হত? উল্টোদিকে, এই বিশ্বায়নের দুনিয়ায় কে কোথায় থাকল তাতে কী আসে যায়? তাত্ত্বিকরা তো এসব ইস্যুকে ডিকনস্ট্রাক্ট করে ভুষ্টিনাশ করে দিয়েছে। পনেরো বছর ধরে মার্কিন শিক্ষাজগতে থাকার পর দ্বীপ এই আসল-নকলের প্রশ্নে নিজেকে ঠকায় না। নিশ্চয় তার কলকাতার প্রতি টান আছে। সুকিয়া স্ট্রিটে তার জন্মভিটে। দুর্বলতা, নস্ট্যালজিয়া থাকবে না? তার সত্ত্বার একটা বড় অংশের সঙ্গে কলকাতা অবশ্যই জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু নাড়ির টান, মাটির টান, ইত্যাদি প্যাচপ্যাচে ক্লিশে তার একেবারেই ধাতে সয় না। এতদিনে মার্কিন কালচারের একটা অংশও যে তার আচরণে, চিন্তায়, মূল্যবোধে মিশে গেছে তা অস্বীকার করার কোনো অর্থই হয় না। এই দুইয়ের সমন্বয়েই তার আত্মপরিচয়। শিকড়সংক্রান্ত প্যানপ্যানানি, কলকাতার প্রসঙ্গে উথলে ওঠা আবেগ দ্বীপের বস্তাপচা রোম্যান্টিক সেন্টিমেন্ট বলে মনে হয়। জাপানী জুতো, ইংরাজি পাৎলুন আর রুশি টুপির পরেও বুক ঠুকে তার দিল হ্যায় বাঙালি, এমন দাবি করার লোক নয় সে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে পৌঁছে গেল দ্বীপ। ফ্রিওয়ে ছেড়ে শহরতলীর ছিমছাম পাড়াটায় ঢুকে এ রাস্তা সে রাস্তা করে যখন সে বড় দোতালা বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছল তখন পৌনে আটটা বাজে, অর্থাৎ তেমন বাড়তি সময় লাগেনি। বাড়ির অত বড় ড্রাইভওয়েটা একগাদা গাড়িতে ভর্তি, রাস্তাতেও এখানে ওখানে গাড়ি পার্ক করা। তার মানে প্রায় সবাই এসে গেছে। অগত্যা দ্বীপকে বাড়ি থেকে একটু দূরেই পার্ক করতে হল। এখানকার বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ থাকলে বাইরে থেকে বোঝার জো নেই ভিতরে কতগুলো লোক আছে। কেবল একবারে কাছাকাছি গেলে কিছু চাপা গুঞ্জন কানে আসে। সদর দরজাটা ঠেলে খুলতেই সেই মৃদু কথা আর হাসির শব্দ নিমেষে পাঁচগুণ বেড়ে গেল। জনা ত্রিশ লোক বাড়ির নানা জায়গায় একাধিক জটলায় ছড়িয়ে রয়েছে, গোটা দশেক বাচ্চা বাড়িময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আর বিভিন্ন কোণে বসানো স্পিকারে মৃদুস্বরে বাজছে আধুনিক বাংলা গান।
এই ধরনের জমায়েতে এমন কিছু লোকের সাথে দেখা হয় যাদের সঙ্গে কোনোদিন দেখা না হলেও দ্বীপের কিছু যায় আসে না। এদেশের সিংহভাগ বাঙালি সায়েন্স বা টেকনোলজির লাইনে কাজ করে। দ্বীপের পেশা শুনে হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। বোধহয় ভাবে কেন মরতে লোকে এই লাইনে যায়। কেউ কেউ আবার নিজের অজ্ঞতা ঢাকতে তার কাজের ব্যাপারে উৎসাহ দেখায়, তারপরেই মায়া সভ্যতার নাম শুনে হকচকিয়ে যায়। তারা যে মায়া কথাটার বাংলা মানে ছাড়া আর কিছুই জানে না সেটা স্পষ্ট ধরা পড়ে। বহুদিন যাবৎ এ হেন লোকেদের করুণা করাও ছেড়ে দিয়েছে দ্বীপ।
বড় লিভিংরুমটায় সুখময়দা জনা দশেককে নিয়ে জমিয়ে বসেছেন। দ্বীপ ঢুকতেই তিনি হাঁক পাড়লেন, —'আরে ক্রুসোভায়া! এসো এসো! এত দেরি যে?' —'কী করব দাদা, স্কুল থেকে বাড়ি গিয়ে আবার এতটা রাস্তা আসা....... বোঝেনই তো! দ্বীপ ধরাচুড়ো খুলে ক্লোসেটে রাখতে রাখতে বলল।
সুখময়দার আশপাশ থেকে আরও দু-চারজন তার দিকে হাত নাড়ল। 'দাঁড়ান, ভিতর থেকে আসছি', বলে সে রান্নাঘরের পাশে ছোট বসার জায়গায় গেল ওয়াইনের বোতলটা রাখতে ও বৈশাখী বৌদির সাথে দেখা করতে। বৌদি সেখানে একদল মহিলার সঙ্গে আসর জমিয়েছেন। দ্বীপ লক্ষ্য করেছে অনেকদিন বিদেশে থাকা সত্ত্বেও বাঙালিদের জমায়েতে কিভাবে পুরুষ আর মহিলাদের আড্ডা আপনা থেকেই আলাদা হয়ে যায়।
—'এই যে এলিজিবল ব্যাচেলার! এত দেরি করে আগমন কেন?' দ্বীপকে দেখেই মন্তব্য বৌদির। দ্বীপ জানে বৌদি তাকে ঐ নামে ডাকা মানেই বিয়ের কথা তুলবেন ও কারও সাথে ঘটকালি করার চেষ্টা করবেন, যেমন আগে কয়েকবার করেছেন। তাই কোনোমতে দেরির সাফাই দিয়ে সেখানে থেকে সরে পড়ল দ্বীপ। কিন্তু পালাতে গিয়ে আর এক বিপত্তি। একেবারে মুখোমুখি উদয়নের সাথে।
উদয়ন ভট্টাচার্য দ্বীপেরই সমবয়সী। এমবিএ করে একটা ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে। কিন্তু মূল কেরিয়ারের চেয়ে তার অনেক বেশি মনোযোগ নাটক করায়। মনোযোগ বললে ভুল হবে, সে নাটক নিয়ে অবসেস্ড। সমবয়সীরা তার নাম দিয়েছে আঁতলা খ্যাপা। এমন নাটকপাগল লোক দ্বীপ এ দেশে আর একটাও দেখেনি। এমন কি সে তার ছেলের নাম রেখেছে রুদ্র। উদয়নের মতে, আমেরিকায় বাঙালিদের আস্ত একটা প্রজন্ম বড় হয়ে উঠল, অথচ সে তুলনায় তাদের সাংস্কৃতিক দিকটা অতীব নিকৃষ্ট রয়ে গেছে। পুজোর ফাংশনে সেই বেসুরো গান আর অখাদ্য ভাঁড়ামির নাটক সমানে চলেছে। সে মনে করে এখানে প্রয়োজন ইমিগ্র্যান্ট কালচারের নতুন একটা ধারার, যা থেকে তরুণ প্রজন্ম শিক্ষা নেবে। নাটকের ব্যাপারে দ্বীপের নিজের উৎসাহও কম নেই, বার দুয়েক উদয়নের সাথে করেওছে নাটক, কিন্তু উদয়নের প্যাশনের সঙ্গে সে ঠিক তাল রাখতে পারে না।
দেখামাত্রই উদয়ন তাকে একতলার স্টাডি রুমে টেনে নিয়ে গেল, যেখানে আরও জনাতিনেক নাট্যোৎসাহী আগে থেকেই বসেছিল।
—'বস্! অনেক কষ্টে কলকাতা থেকে 'ফ্যাতাড়ু'র স্ক্রিপটা আনিয়েছি। এবার এটা নামাব ঠিক করেছি!'
—'ফ্যাতাড়ু? মানে নবারুণ ভট্চাযের?' দ্বীপের চোখ কপালে।
—'হ্যাঁ রে বাবা! ফ্যাতাড়ু আবার কজনের আছে? আগামী সামার নাগাদ স্টেজ করব। তোমাকে কিন্তু পুরন্দর ভাটের রোলটা করতে হবে।'
—'তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?' দ্বীপের কপালে ভাঁজ, কিন্তু গলায় কৌতুক। 'ঐ সব ভাষা শুনলে এন আর আই বাঙালির আমাশা হয়ে যাবে! মেরে স্টেজ থেকে নামিয়ে দেবে!'
—'আরে গুরু, সে ধরনের একটা ধাক্কাই তো দরকার! দেখি না কেমন রিঅ্যাক্ট করে! এদের এই ক্যালানে কালচারের কোনো অলটারনেটিভ তৈরি করতে গেলে প্রথমে একটু বাওয়াল তো হতেই পারে! হোক না কন্ট্রোভার্সি! আমরা আগে থেকেই জানিয়ে দেব যে এই নাটকে এক্সক্লুসিভ ভোকাবুলারি আছে। চিলড্রেন নট অ্যালাওড।'
দ্বীপ হেসে বলল, —'সে তুমি যতই আগে থাকতে জানাও। যখন স্টেজে আবৃত্তি হবে 'আকাশ হইতে গুখেগো শকুন হাগিতেছে তব গায় / বাঙালি শুধুই খচ্চর নয়, তদুপরি অসহায়', তখন দর্শকের, এবং সেই সূত্রে আমাদের কী হাল হবে ভাবতেও ভয় হয়!' উদয়ন ছাড়ার পাত্র নয়। চোখ মিটমিট করে একটু ভাবল, তারপর একগাল হেসে বলল, —'ঠিক আছে, তাহলে আজই একটা টেস্ট হয়ে যাক! স্ক্রিপটা আমার গাড়িতেই আছে। আজ রাতে ডিনারের পর সকলের পারমিশন নিয়ে আর ছোটদের সরিয়ে দিয়ে এখানেই তার কিছুটা অন্তত পড়া হোক! তাহলেই বোঝা যাবে বঙদের টলারেন্স লেভেল! ফ্যাৎ ফ্যাৎ সাঁই সাঁই!'
উদয়নের অন্যান্য চেলারা এই প্রস্তাবে একটু অস্বস্তি প্রকাশ করলেও দ্বীপের ভুরু কুঁচকে হাসা দেখেই বোঝা গেল তার এতে সায় আছে। আজ রাতে একটা মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা হবে, ভাবল দ্বীপ। এরপর তারা সকলে গিয়ে বসল সুখময়দাকে ঘিরে জমে ওঠা আড্ডায়। যাওয়ার আগে দ্বীপ রান্নাঘর থেকে একটা বীয়ার নিয়ে নিল।
আসরে তখন জোর আলোচনা চলছে হালফিলের কলকাতা নিয়ে। কলকাতা থেকে সদ্য ঘুরে আসা প্রসূন দত্ত হাত পা নেড়ে সেখানকার গল্প শোনাচ্ছে। দ্বীপ যতক্ষণে এসে বসল ততক্ষণে উদয়নের সঙ্গে প্রসূনের তুমুল তর্ক শুরু গেছে। প্রসূন বলছে,
—'আজকাল কলকাতায় লোকজন সবসময় কিরকম তেরিয়া হয়ে থাকে! ভদ্রভাবে কথা বলতেই যেন ভুলে গেছে লোকে! গায়ে ধাক্কা লাগলেও সরি বলে না।'
উত্তরে উদয়নের চটপটে জবাব, —'তিন বছর পর তিন সপ্তাহের জন্য ট্যুরিস্টের চশমা পরে কলকাতায় গেলে ওরকম অনেক কিছু মনে হয়।' উদয়ন ঠোঁটকাটা, যা বলার সোজাসুজি বলে, যার জন্য অনেক সময়েই সে লোককে অস্বস্তিতে ফেলে। ওর এই হাজির জবাবে দ্বীপ মুখ টিপে হাসল। প্রসূন দত্তর লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে বোঝা গেল মন্তব্যটা তার গায়ে লেগেছে। সে বলল,
—'এই হল মুশকিল! ওখানকার সমস্যা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই সব ডিফেন্সিভ হয়ে পড়ে। আরে বাবা, ধুলো ঝাঁট দিয়ে খাটের তলায় পাঠালেই কি ঘর পরিষ্কার হয়?' উদয়নও ছাড়ার পাত্র নয়। প্রসূনের কথা শেষ হতে না হতেই সে বলল,
—'না, তা হয় না। তবে ঝাঁটটা কে দিচ্ছে সেটা দেখতে হবে। কলকাতার লোকজন স্ট্রেসড আউট হয়ে থাকতেই পারে। কিন্তু তা নিয়ে যদি সমালোচনা করতে চান তো সেখানে যাওয়াটা আগে অভ্যেস করুন, তাদের পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটুন, তারপর করবেন। এখানকার ফুরফুরে জীবনযাত্রা থেকে নস্ট্যালজিয়ার তাগিদে কালে ভদ্রে ওখানে গিয়ে ওখানকার সমস্ত কিছুকে স্টিরিওটাইপ করবেন, সেটা কি ঠিক?'
চলতে লাগল তুমুল তর্ক। উদয়নের কাছে খাপ খোলা মুশকিল। সে দ্বীপের মতোই ঘন ঘন কলকাতায় যায়, অনেক সময় একাই। গিয়ে সমস্ত চলতি নাটক দেখে আর রাজ্যের নাটকের বই কিনে আনে। প্রসূন দত্ত উদয়নের সঙ্গে আপ্রাণ লড়তে লাগল তার মত আরও দুয়েকজনের সাহায্যে। তাদের একজন বলল, —'কলকাতা থেকে গাড়িতে মেদিনীপুর গেলাম, পথে একটাও রেস্ট এরিয়া নেই। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মহা সমস্যা।' সুখময়দা মাঝেমাঝে স্মিতমুখে একেকটা টিপ্পনী দিতে লাগলেন। উদয়নের মতো এ সবের মধ্যে সটান ঝাঁপিয়ে পড়া দ্বীপের স্বভাব নয়, তাই সে অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে রইল।
তর্কাতর্কি শুনতে শুনতে বোধহয় একটু ঝিমিয়েই পড়েছিল দ্বীপ। প্রসঙ্গ কখন যেন এসে ঠেকেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। হঠাৎ কানে এল প্রদীপ চক্রবর্তীর গলা,
—'আরে, গ্রামের সংগঠন নিয়ে তোমাদের যদি অতই বড়াই, তাহলে আজ রাজ্যে এত ম্যাওবাদী অসন্তোষ কোত্থেকে আসে বাওয়া? এও কি কেন্দ্রের চক্রান্ত বলতে চাও?'
এরপরই আড্ডার হাওয়া বদলে গেল। বোঝা গেল সবারই এ ব্যাপারে কিছু না কিছু মতামত তো আছেই, সেগুলো সবই আসছে একটা অদ্ভুত ভীতির জায়গা থেকে। কেবল সুখময়দা বললেন,
—'গ্রামাঞ্চলের এই ক্ষোভে তেমন আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বছরের পর বছর ধরে করাপশান, ডেপ্রিভেশন আর দাদাগিরি মানুষের পিঠ একেবারে দেওয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে।'
কিন্তু উৎপল খাসনবিশ তা মানতে নারাজ।
—'সে যে অবস্থাই হোক, এরকম টেরোরিস্ট অ্যাক্টিভিটিকে কোনোভাবেই সাপোর্ট করা যায় না।'
রাহুল চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে তার সাথে একমত হয়। চিন্তিতভাবে বলে,
—'এ কিন্তু এক নতুন আপদ! আমার তো ভয় হয় কোনদিন কলকাতাতেই না হামলা করে!'
—'করতেই পারে, এবং আমার ধারণা একসময় করবেও।' উৎপলের সাফ জবাব। তারপর সে আরও বলে,
—'আরে বাবা! এর পথ তো সেই আমাদের ছাত্রবয়সেই তৈরি হয়ে আছে! আমরা তো দেখেছি, এক সময় বিপ্লবের নামে কী চ্যাংড়ামি হয়েছে! বই পোড়ানো, বোমাবাজি আর খুন!'
দ্বীপ একদৃষ্টে উৎপল খাসনবিশকে দেখতে থাকে। লোকটার বয়স ষাট হবে, পেশায় ইনকাম ট্যাক্সের উকিল। সত্তরের প্রথমদিকে এ দেশে এসেছিল মামা না কার স্পনসরশিপে। কিছুদিন আগে কাকে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে সাহায্য করার অভিযোগে ওর ওকালতির লাইসেন্স হারাতে বসেছিল। দ্বীপ যতদূর জানে এখনও সে ব্যাপারে তদন্ত চলছে। উৎপল সোৎসাহে বলেই চলে,
—'আরে গ্রাম দিয়ে নাকি শহর ঘিরবে! কী হল? মাঝখান থেকে একগাদা ছেলের জীবন নষ্ট হল! এই যেমন সুদীপ্ত ঘোষ, কলেজে আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ছিল। মেধাবী ছাত্র ছিল, কিন্তু কী ভাবে বেঘোরে মরল ছেলেটা! সঙ্গে আরও দুজন.... কী যেন নাম.... তাদের মধ্যে একটা মুসলিম ছেলে.....'
দ্বীপের গা-টা ঘুলিয়ে উঠল। আশ্চর্য! একটামাত্র বীয়ারে তো তার এরকম হাওয়ার কথা নয়! কিন্তু মাথাটা এত ঘুরছে কেন খামোখা? আর এত ঘামছেই বা কেন? সে শুধু উৎপল খাসনবিশের মুখ নড়তে দেখল, একটা কথাও কানে ঢুকল না। শুধু মনে হল এক্ষুণি এদের সামনে থেকে একটু সরে যেতেই হবে। বহুক্ষণ সিগারেট খায়নি সে। শরীরে নিকোটিনের অদম্য দাপাদাপি। তাই নিঃশব্দে সবার অলক্ষ্যে সোফার কোণ ছেড়ে উঠে ক্লোসেট থেকে দ্রুত জ্যাকেটটা বের করে পায়ে জুতো গলিয়ে সদর দরজার বাইরে চলে এল।
দ্বীপের সিগারেটের অভ্যাস নিয়ে বৈশাখী বৌদি বকাবকি করলেও কার্ডিওলজিস্ট সুখময়দা কিন্তু কিছু বলেন না। বরং সদর দরজার বাইরে এক কোণে তার জন্য একটা অ্যাশ ট্রের ব্যবস্থা রেখেছেন। ভয়ানক ঠাণ্ডা হাওয়ার চাবুক পড়ল মুখে, অথচ তাতেই দ্বীপের একটা গভীর আরাম বোধ হল। জ্যাকেটের হুডটা টেনে দিয়ে, দরজার বাইরের চাতালে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাওয়া আড়াল করে একটা সিগারেট ধরাল সে। তারপর একটা লম্বা টান দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড সেটা ভিতরে ধরে রেখে, নাকমুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ল। অনুভব করল প্রথম টানটার আমেজ। হিমেল হাওয়ার ভিজে গন্ধ বলে দিচ্ছে যে কোনও মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। সে বাইরে পা দেওয়া মাত্রই বাড়ির বাইরের মোশান সেন্সার দেওয়া আলোটা আপনা থেকেই জ্বলে উঠেছে। আলো পড়ে ঝকমক করছে ড্রাইভওয়েতে ভিড় করে থাকা অতিথিদের গাড়িগুলো। দ্বীপ আনমনে চেয়ে রইল সেদিকে।
দ্বীপের সাথে কস্মিনকালেও কোনো মাওবাদীর পরিচয় ছিল না। সে শুধু চেনে মার্কোসকে। মেক্সিকোর কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামের চাষী মার্কোস। দক্ষিণ মেক্সিকোর চিয়াপাস দেশের সবথেকে দরিদ্র রাজ্য। আমেরিকায় আসার বছরতিনেক পর দ্বীপকে একবার সেখানে যেতে হয়েছিল কাজে। এক বিকেলে সাইটে কাজ সেরে জঙ্গলের পথে ফিরছিল, সঙ্গে শুধু এক মার্কিন সহকর্মী আর মেক্সিকান ড্রাইভার। হঠাৎ তাদের ল্যাণ্ড রোভার বিগড়াল। ড্রাইভার হুড খুলে সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করছে, এমন সময় নিঃশব্দে জঙ্গল ফুঁড়ে হাজির হল ছ'জন মানুষ। প্রত্যেকের মুখ ঢাকা স্কি মুখোশ বা রুমালে, হাতে রকেট লঞ্চার, এলএমজি, একে ফর্টি-সেভেন, কোমরে ম্যাগাজিন আর হ্যাণ্ড গ্রেনেড। দ্বীপ দেখল নিমেষে তার সঙ্গীদের মুখ রক্তহীন। ড্রাইভার কেবল কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলতে পারল, 'জাপাতিস্তা!'
মায়ারা নিজেদের দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ভেবেছিল। যুদ্ধ করে বশে এনেছিল মধ্য আমেরিকার বিশাল এক অঞ্চল, তৈরি করেছিল আশ্চর্য এক নগরভিত্তিক সাম্রাজ্য। আবিষ্কার করেছিল নিজেদের লিপি, ক্যালেণ্ডার, জ্যোতির্বিদ্যা, অঙ্কে শূন্যের ব্যবহার। বহু আঞ্চলিক শাখায় ভাগ হয়ে গড়ে উঠেছিল মায়া ভাষার এক বিচিত্র সম্ভার। অথচ আজ সেই সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট কেবল বিস্তীর্ণ সব ভগ্নস্তূপ: চিচেন-ইৎজা, তিকাল, বোনামপাক, কোপান, প্যালেঙ্কে। আজ মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা আধুনিক মায়ারা হতদরিদ্র, নিপীড়িত, অপমানিত একদল মানুষ। ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত দেশী শাসকদের সঙ্গে তাদের অনেকদিনের বিরোধ। নব্বইয়ের দশকে চিয়াপাস অঞ্চলে বহুকালের দুর্নীতি আর বঞ্চনার প্রতিবাদে এই মায়ারা সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন গড়েছিল মেক্সিকোর সরকারের বিরুদ্ধে, তৈরি করেছিল মুক্তাঞ্চল। একদিকে তাদের প্রেরণা ছিল প্রাচীন মায়া জাত্যাভিমান, অন্যদিকে মেক্সিকোর ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহের কিংবদন্তী নেতা এমিলিয়ানো জাপাতার নামে তারা নিজেদের নাম দিয়েছিল জাপাতিস্তা। মেক্সিকোর সরকার ও সেনাবাহিনীর দুঃস্বপ্ন এই দলকে আমেরিকা টেরোরিস্ট আখ্যা দিতে দেরি করেনি।
তার সঙ্গীরা আতংকে আধমরা হলেও দ্বীপের কিন্তু কোনো ভয় করেনি দলটাকে দেখে। কেন এই বিশ্বাস, কিসের ভিত্তিকে একদল সশস্ত্র ভিনদেশী বিদ্রোহীর প্রতি তার এই আস্থা তা দ্বীপ জানে না। কিন্তু তার মনে হয়েছিল তার বা তার সঙ্গীদের কোনো ক্ষতি হবে না। দলের নেতার নাম মার্কোস। একমাত্র সে-ই খুলেছিল তার মুখোশ, যার নিচে থেকে বেরিয়েছিল বছর পঁচিশের এক গ্রাম্য যুবকের পোড়খাওয়া মুখ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ড্রাইভারকে নিয়ে গাড়ি সারাতে লেগে গিয়েছিল দলের একজন, দুজন দাঁড়িয়েছিল পাহারায়। মার্কোস ও বাকি দুজন দ্বীপ আর তার মার্কিন বন্ধুকে চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল তাদের জঙ্গলের আস্তানায়। সেখানে চোখ খুলে দেওয়ার পর মগে করে তাদের তিতকুটে কফি খেতে দিয়েছিল, আর শুনিয়েছিল তাদের গল্প।
চিয়াপাসের বহু মানুষই স্প্যানিশ বলে না, কিন্তু মার্কোস বলত। আর মায়ার যে শাখা তার মাতৃভাষা সেই ৎসেলটাল দ্বীপেরও কিছুটা জানা ছিল। তাই দুই ভাষাতেই কথা হয়েছিল তাদের। মার্কোস তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের ছবি দেখিয়েছিল দ্বীপকে, বলেছিল তার পরিবারের কথা, গ্রামের কথা। শুনিয়েছিল প্রবঞ্চক প্রশাসনের কিস্সা, জমি চুরি, জাতিবিদ্বেষ, গ্রামে গ্রামে ঢুকে মেক্সিকোর পুলিশ মিলিটারির নির্বিচারে খুন আর গণধর্ষণের কাহিনী। 'সিস্টেমের মধ্যে থেকে লড়লে তুমি অবিচারেই ভেড়া হয়ে যাবে, নয়তো ভেড়ার ভক্ষক', বলেছিল মার্কোস। 'আর সিস্টেমের বাইরে থেকে লড়তে গেলে তোমার তকমা হবে টেরোরিস্ট।' ভারতবর্ষ কোথায় সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না মার্কোসের, কিন্তু এক বিদেশীর মুখে তার অবহেলিত ভাষা শুনে আপ্লুত হয়েছিল সে।
ঘন্টাখানেক পর গাড়ি সচল হওয়ার খবর এলে আবার চোখ বেঁধে দলটা তাদের ফিরিয়ে এনেছিল। 'গ্রাসিয়াস আমিগো! আদিয়োস!' স্প্যানিশে বিদায় নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল দ্বীপ। জমি চষা হাতে তার হাতে চাপ দেওয়ার সময় হাসিতে উজ্জ্বল হয়েছিল মার্কোসের গেঁয়ো মুখ। তারপর দ্বীপ যখন গাড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়িয়েছে, তখন পিছন থেকে ডেকেছিল সে, 'সেন্যর!', দ্বীপ ফিরে তাকাতে ৎসেলটালে বলেছিল, 'ওদের গিয়ে বোলো আমরা বোকা নই। আমরা জানি আমাদের পূর্বপুরুষদের আধিপত্য আর ফিরবে না। আমরা লড়ছি আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য। যাতে তারা মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে। এছাড়া আমাদের আর কোনো রাস্তা নেই।'
কোনো বিদেশীর পক্ষে এক জাপাতিস্তা বিদ্রোহী সম্পর্কে কৌতূহল দেখানো যারপরনাই বিপজ্জনক, তাই পরে আরও দুবার চিয়াপাসে গেলেও মার্কোসের খোঁজ করেনি দ্বীপ। খোঁজেনি, কিন্তু ভুলতেও পারেনি তাকে। আজও প্রায়ই মনে পড়ে রকেট লঞ্চার কাঁধে তার বলিষ্ঠ চেহারা, কফির মগ এগিয়ে দেওয়া হাত, সপ্রতিভ বাচনভঙ্গি। কে জানে কোথায় সে আজ। হয়তো জলে জঙ্গলে লড়ে চলেছে এখনও, বা কবেই মেক্সিকান মিলিটারির বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, অথবা মেক্সিকো সিটির জেলের কোনো অন্ধকার সেলে পচছে। কিংবা হয়তো সে ফিরে গেছে তার গ্রামে, হেরে গিয়ে মেনে নিয়েছে চিরাচরিত শোষিতের জীবন। বুঝেছে যে গুটিকয় বন্দুক, হ্যাণ্ড গ্রেনেড আর বুকভরা সদিচ্ছা দিয়ে শক্তিমান সরকারের গায়ে টোল ফেলা যায়, কিন্তু তাকে ধরাশায়ী করা যায় না।
যেমন মেনে নিয়েছে দ্বীপদের পাড়ার অতুলকাকা। অল্প বয়েসে মেডিক্যাল রিপ্রেসেনটেটিভ ছিল সে, আর দৌড়বাজির জন্য ছিল পাড়ার গর্ব। রাজ্য চাম্পিয়নশিপ জিতেছিল। এশিয়াড অলিম্পিকের স্বপ্নও দেখত। তারপর লালবাজারের মারে একটা পা আর হাত চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলে সে সব স্বপ্নের অবসান হয়। এখন অতুলকাকা পাড়ার লোকের ট্রেনের টিকিট কেটে আনা, ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়া ইত্যাদি ফাই ফরমাশ খাটে। এই কি জীবন? কি হল সেই রক্তাক্ত লড়াইয়ের?
পাড়ার মোড়ে রাস্তার কোণে বসানো একসময়কার জমকালো শহীদ বেদীটার পলেস্তারা খসে, ইঁট বেরিয়ে কদর্য চেহারা নিয়েছে আজ। লোহার রেলিং কবেই খুলে নিয়ে গেছে চোরে। মার্বেলের ফলকে লেখা নামগুলো এখন প্রায় পড়াই যায় না। বেদীর নিচে একটা চায়ের দোকান, যার ত্রিপলের প্রান্ত বাঁধা থাকে বেদীর গায়ে পোঁতা পেরেকে। সবাই জানে রাত্রে দোকানটা বাংলা মদের ঠেক হয়ে যায়। ল্যাপটপ কাঁধে, সেল ফোন পকেটে যে নবীন প্রজন্ম পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, তাদের এতে বিন্দুমাত্র আসে যায় না। কলকাতার আনাচেকানাচে অমন আরও অনেক সৌধের গায়ে লেখা দিন বদলানোর এক ব্যর্থ চেষ্টার কাহিনী তাদের কাছে ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম ফুটনোট হওয়ারও যোগ্য নয়।
আর কেনই বা যাবে আসবে তাদের? এই প্রজন্মের? দ্বীপের প্রজন্মের? অতীতের কোনো ব্যর্থ বিপ্লবের জন্য তারা তো দায়ী নয়! তারা তো কোনো অসম্পূর্ণ লড়াইকে সম্পূর্ণ করার অঙ্গীকার করেনি কারো কাছে! যে বিশ্বায়নরত দুনিয়াকে দ্বীপরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে, সেই দুনিয়ার শর্তে না বেঁচে তারা করবেই বা কী? যে বিকল্পের দিকে তাকিয়ে অতুলকাকারা লড়েছিল, সমতার জয়গান গাওয়া সেই সমাজব্যবস্থাই তো সারা পৃথিবীতে এখন এক বিকট রসিকতা। দ্বীপ তো কাউকে প্রতিশ্রুতি দেয়নি যে সে দেশে ফিরবে এবং বলি দেবে নিজেকে! আত্মহত্যার ফলে কবে কোন সমাজ বদলেছে? দ্বীপ প্রাণপণ চেষ্টা করে তার নিজের সঙ্গে প্রসূন দত্ত বা উৎপল খাসনবিশের একটা তফাৎ খুঁজে বের করতে। আর ওর এবং তাদের মাঝখানে রকেট লঞ্চার কাঁধে করুণামাখা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে মার্কোস।
সুখময়দার বাড়িতে ভিতর এখন গানের পর আবৃত্তি চালানো হচ্ছে। দ্বীপ যেখানে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার ঠিক পিছনে ঘরের মধ্যে বসানো একটা স্পিকার থেকে ক্ষীণ ভেসে আসে প্রদীপ ঘোষের গলায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা কবিতার লাইন, '....... রাত গভীর হলে, গোপনে নিজের সন্তানের ছিন্নশির ভেট দিই দিল্লিকে / তারপর গঙ্গাজলে হাত ধুয়ে ভোরবেলা বুক চাপড়ে কেঁদে উঠি / হায়! আত্মঘাতী শিশুগুলি রক্তে আছে শুয়ে!' ...... কান পেতে শুনছিল দ্বীপ, কিন্তু তাতে ছেদ পড়ল হঠাৎ। 'দ্বীপবাবা! ও দ্বীপবাবা!' কে যেন ডেকে উঠল দ্বীপের একেবারে কানের কাছে। চমকে চারদিকে তাকাল দ্বীপ, 'কে?! ভেকুদাদা?!'
মনোরম এক ১৩ই জানুয়ারির সকালে ঘুম ভেঙে যায় দ্বীপের। জানালা দিয়ে এসে পড়া শীতের নরম রোদ আর কার্নিশে কতগুলো চড়াইয়ের ঝগড়া এক নিমেষে তার মনটাকে খুশি করে দেয়। কিন্তু তারপরেই খেয়াল হয় ভেকুদাদা তাকে ধরে নাড়া দিচ্ছে আর গম্ভীর গলায় ডাকছে, 'ওঠো দ্বীপবাবা, মাসির বাড়ি যেতে হবে।' বাড়ির পুরোনো কাজের লোক ভেকুদাদা তার সাথে দিনরাত মজা করে, তাই ঘুমচোখেও এই গলাটা দ্বীপের যেন কেমন কেমন লাগে। তাছাড়া আজ না তার জন্মদিন! আজ সে পাঁচে পড়বে, বিকেলে বন্ধুরা আসবে, খাওয়াদাওয়া হবে, একগাদা উপহার পাবে সে। তো এখন বালিগঞ্জে মাসির বাড়ি গেলে সে সবের কী হবে? ভেকুদাদাকে প্রশ্ন করতে সে দায়সারাভাবে জানিয়ে দেয় মাসির বাড়িতেই নাকি তার জন্মদিন হবে। তাতে দ্বীপের সেরকম কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এই পাড়ার বন্ধুরা কি অতদূরে যাবে? আশপাশে মা, বাবা, ঠাম্মাকেও দেখা যাচ্ছে না। তাই সে একটু চিন্তিতভাবেই উঠে ভেকুদাদার নির্দেশে হিসি করে, মুখ ধুয়ে, দুধ খেয়ে তৈরি হয়ে নেয়।
সে কোলে চড়ার পক্ষে যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে, তাই আবারও অবাক হয় যখন ভেকুদাদা তাকে কোলে নিয়ে অতিদ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর দরজার দিকে এগোয়। বসার ঘরের সামনে থমথমে মুখে পাড়ার বেশ কিছু লোকের জটলা। সেই ভিড় ঠেলে যাওয়ার সময় এক ঝলক চোখে পড়ে, ঠাম্মা ডিভানের ওপর নিথর হয়ে পড়ে আছে, আর মা মাথার কাছে বসে হাওয়া করতে করতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওদিকের সোফায় বসে বাবা, হাঁটুতে রাখা দু হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে। তাদের চারপাশে পাড়ার মনু জেঠু, জেঠিমা, একজন পুলিশের পোশাক পরা লোক, আরও দুএকজন। তখনও দ্বীপের ঘুম পুরোপুরি কাটেনি, তাই পুরো ব্যাপারটা তার কাছে কেমন স্বপ্নের মতো বোধ হয়। দৃশ্যটা ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই ভেকুদাদা তাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।
বাইরেও ইতিউতি অনেকের জটলা, একটা পুলিশের গাড়ি, অথচ কোনো চেঁচামেচি নেই। কেবল নিচুস্বরে গুঞ্জন আর ফিসফাস। চেনাদের কেউ কেউ ভেকুদাদার কোলে দ্বীপকে দেখে অদ্ভুতভাবে তাকায়। তখন সবে রাস্তা ধুয়েছে, সবদিক ফিটফাট, তবুও ভেকুদাদা তাকে কোল থেকে নামায় না। এরকম দৌড়েই একটা ট্যাক্সি ধরে দ্বীপকে একেবারে গাড়ির সিটে বসিয়ে দেয়, যেন ঐ মুহূর্তে তাকে নিয়ে সে ঐ পাড়া ছেড়ে পালাতে চায়। শিয়ালদা হয়ে ট্যাক্সি দক্ষিণের দিকে যেতে থাকলে এক সময় মুখ ফিরিয়ে দ্বীপ দেখে ভেকুদাদা নিঃশব্দে কাঁদছে। পুরো ব্যাপারটার একবিন্দুও বোধগম্য হয় না তার, কিন্তু সে এটা বোঝে যে সময়টা কোনো প্রশ্ন করার পক্ষে মোটেই উপযুক্ত নয়। তাই সে চুপচাপ গলা বাড়িয়ে অলস চোখে বাইরে চেয়ে থাকে। সকালের ঠাণ্ডা হাওয়ায় অল্পক্ষণের মধ্যেই তার চোখ বুজে আসে।
খবরটা এসেছিল দ্বীপের ঘুম ভাঙার ঘন্টাদুয়েক আগে, একেবারে ভোরের দিকে। দ্বীপদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথে বেলেঘাটার পচাখাল। শেষরাতে সেখানে প্রাতঃকৃত্য করতে গিয়ে এক ঠেলাওয়ালা একেবারে পাড়ের কাছে দেখতে পায় ওদের তিনজনকে। প্রত্যেকের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, পরনে শুধু জাঙিয়া, শরীরে অজস্র ক্ষতচিহ্ন। পাঁকের মধ্যে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা রফিকুল মণ্ডল আর সুদীপ্ত ঘোষের মাথার পিছনে বুলেটের গর্ত। শুধু চিৎ হয়ে দীঘল দুটো ঘোলাটে চোখে কলকাতার রাতের আকাশে চেয়ে থাকা অশনির পেটটা ভোজালিতে এপাশ থেকে ওপাশ ফেঁড়ে দেওয়া। তার রক্ত আর নাড়িভুঁড়ি মিশে পচাখালের কদর্য পাঁক আরও বীভৎস।
পাড়ার মোড়ের ভাঙা শহীদ বেদীটায় পাথরে লেখা তিনটে নাম মলিন হয়ে গেলেও শেষেরটা চেষ্টা করলে এখনও পড়া যায় : 'কমরেড অশনি লাহিড়ি (১৯৪৭-১৯৭২)'। ওয়াশিংটন ডিসিতে দ্বীপ দেখেছে ভিয়েৎনাম স্মৃতিসৌধের পালিশ করা কালো গ্র্যানাইটের দেওয়ালে খোদাই করা হাজার হাজার মৃত মার্কিন সৈনিকের নাম। লোকে সেখানে তাদের মৃত স্বজনের নাম খুঁজে নেয়, তারপর সেই নামের অক্ষরে হাত বোলায়, কাগজ চেপে ধরে পেন্সিল ঘষে ছাপ তোলে। দ্বীপ কখনও হাত বোলায়নি বেদীর ফলকে লেখা কাকাইয়ের নামের ওপর। ইচ্ছে হয়েছে কয়েকবার, কিন্তু পেরে ওঠেনি। ভয় হয়েছে পাড়ার লোকে পাগল বলবে। তাছাড়া, কতগুলো অক্ষরকে ছুঁয়ে কারও উপস্থিতিকে অনুভব করা সত্যিই কি সম্ভব?
চড়বড় করে বৃষ্টি নামল। হাতের সিগারেটের শেষটুকু অ্যাশ ট্রেতে গুঁজে দিয়ে আরেকটা ধরাল দ্বীপ। কিন্তু তারপরেই বুঝল ঠাণ্ডায় তার নাকের ডগা জমে যাওয়ার দাখিল। এবার ভিতরে যেতেই হবে। ডিনারের পর ফ্যাতাড়ূর স্ক্রিপ্ট পড়ার কথা, উদয়ন তাকে খুঁজবে। দুটো টান মেরে, অ্যাশ-ট্রেটাকে উপেক্ষা করে বুড়ো আঙুল আর মধ্যমায় ক্যারামের ঘুটি ছোড়ার ভঙ্গিতে দ্বীপ সিগারেটের বাকিটা ছুঁড়ে দিল সুখময়দার ড্রাইভওয়ের ধবল কংক্রীটের ওপর। জলের ফোঁটাগুলো বেশ ফাঁক রেখে পড়ছিল, তাই আশপাশের জমি ভিজে গেলেও, বাড়ির ভিতরে আড্ডারত কোনো এন আর আইয়ের ঝাঁ-চকচকে গাড়ির হাতখানেক দূরে একচিলতে শুকনো ডাঙায় পড়ে আধখাওয়া সিগারেটের আগুনটা অবাধ্য গোঁয়ারের মতো জ্বলতেই থাকল। তারপর হঠাৎ একটা নির্মম ফোঁটা পড়ল সিগারেটটার সাদা অংশে। আগুনটা তখনও জ্বলছে। দ্বীপ একদৃষ্টে দেখতে থাকল, সাদা অংশটার আর্দ্রতা দ্রুত ছড়াচ্ছে বাকি টুকরোটায়। কিন্তু তা আগুনে পৌঁছনোর আগেই এক অতিকায় ফোঁটা সটান এসে পড়ল আগুনটার একেবারে ঘাড়ের ওপর। অমনি সেটা নিমেষে নিভে গেল। তারপর আরও গোটা দুই ফোঁটার আঘাত খাওয়ার পর বস্তুটাকে দেখাতে লাগল একটা কুৎসিত, ন্যাতানো, মরা পোকার মতো। সেদিকে অল্পক্ষণ তাকিয়ে রইল দ্বীপ, তারপর ভিতরে যেতে যেতে আরও একবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, সিগারেটটা এবার সত্যিই ছাড়া দরকার।
(রচনাকালঃ ২০০৩)
(পরবাস-৫১, জুন-জুলাই, ২০১২)