ISSN 1563-8685




বিভ্রম কাহিনী

কোচবিহার পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। মানব চাইছিল সন্ধের আগেই পৌঁছতে। তার উপর যেন অলিখিত কোনো চাপ রয়েছে—এই যাত্রায় দার্জিলিং ছাড়া যা-যা দ্রষ্টব্যস্থল তার সব একটা প্লেটে সাজিয়ে অন্য ভ্রামণিকদের মুখের সামনে তুলে ধরার। ওরা যেহেতু দার্জিলিঙেই যেতে চেয়েছে, তার বাইরে সবকিছুই ওদের কাছে অস্থান। আর সেসব আলো না-পড়া জায়গায় মানবকেই তো নিতে হবে ক্রশবহনের দায়।

অথচ, এসব জেনেশুনেও মানব আগে থেকে কোথাও কোনো হোটেল বুক করে আসেনি, একমাত্র রাজাভাতখাওয়ায় সরকারি লজ ছাড়া। সোহিনীর টেনশন হচ্ছিল। যদিও সে ভ্রমণের প্রথম পর্বেই সেপারেশনের কথা উচ্চারণ করে দিয়েছে, তবু মানবের দায়ে, সে সংশ্লিষ্ট না হয়ে পারছিল না। পুলকদা আবার বলে রেখেছেন—
'কমোড না থাকলে কিন্তু আমি নেই। গত দুদিন, নো আউটগোয়িং, ওনলি ইনকামিং!'

সোহিনী পায়ের কাছে লাল পটিবক্সটি অনুভব করতে পারল। নিজের হৃৎপিণ্ড দেখলেও লোকে এত আশ্বস্ত হয় না। সে মৃদুস্বরে বলল,
'বাইরে কি আর বাড়ির মতো হয় পুলকদা?'

মানব গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল,
'তবু তো পুলকদার আবদার সামান্য কমোড, সেই ভীমতালের কথা তোমার মনে আছে দোয়েল? সেই লেক থেকে মাছ এল, কাটা হল, রান্না হল, ততক্ষণ সবাই হাঁ করে বসে,'

মাছের গল্প শোনার কারুর বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না। হয়তো দুপুরে খাওয়া মাছের বীভৎসতা চোঁয়াঢেঁকুরের মতো ওদের স্মৃতিকে বিষাক্ত অম্লরসে ভরে রেখেছিল। বরং ওদের বাণেশ্বর নিয়ে আগ্রহী দেখাল।

মহারাজ বীরনারায়ণের তৈরি মন্দিরের পাশে দীঘির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দীপাবৌদি চিৎকার করে উঠলেন, 'এত কচ্ছপ, আর কি বিশাল!'
'খুব পুরোনোও।' পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলল মানব।

কত প্রাচীন এই প্রাণীগুলো, এদের পিঠে কালচে সবুজ শ্যাওলার স্তর। তার নিচে নরম মাংসের নাড়াচাড়া অনুভব করে শিরশির করে ওঠে দীপাবৌদির শরীর। তিনি তাঁর কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা অর্ধেক খাওয়া বাদামের প্যাকেট বাবানের হাতে দিয়ে বলেন, 'নে, কচ্ছপকে খাওয়া।'

'কচ্ছপ নয়, মোহন।'
'মোহন! সে তো কৃষ্ণের নাম না?'
'যা কিছু মুগ্ধ করে, তাই মোহন।'

সোহিনী সিঁড়িতে বসে পড়েছিল। সে গুনগুন করে উঠল 'তোমার মোহনরূপে কে রয় ভুলে।' সবায়ের মনে পড়ে যায়, এই দলে সোহিনীই একমাত্র গাইতে পারে।

পুলকদা বলেন, 'কচ্ছপের ওপরও গান লিখে গেছে মালটা, ভাবা যায়!'

সেই কথা হাওয়ায় উড়ে মুড়ির মতো ছড়িয়ে পড়ে দীঘির জলে, জলের স্বচ্ছতা নষ্ট করে। সোহিনী চুপ করে থাকে। টুয়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে মন্দিরপ্রাঙ্গন ছাড়িয়ে রাস্তায় গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মুখে একটা চিকলেট ফেলে। এতগুলো কচ্ছপ দেখে তার শরীর কেমন করছে।

কচ্ছপকে খাওয়াতে খাওয়াতে থলি যখন উজাড় হয়ে গেল, তখন ওরা ঘাট থেকে উঠে এল। মানবের কষ্ট হচ্ছিল। কোচবিহারের দিকে যত এগোচ্ছে তত তার মনে পড়ে যাচ্ছে রসিয়া বাপই-এর কাহিনী।

সেই যে বাড়ির অকর্মণ্য ছোটো ছেলেটা, বাপ-মা-ভাইয়ের তাড়নায় ঘর ছাড়তে হল যাকে, সেই পেল রাজার মেয়েকে, পরে ফিরে এসে হত দরিদ্র বাপ-মার দায়িত্ব নিল — মানবকেও কি রসিয়া বাপই বলা যায়? এটা তো সত্যি, তারও দিন কাটত বাঁশি বাজিয়ে, বরাত জোরে সে-ও এক রাজকন্যাপ্রতিমকে বিয়ে করেছে, আর এই কোচবিহারে আসা তো তার দরিদ্র বাবা-মার কাছে ফিরে আসার মতন।

তফাত অনেকই আছে, সবচেয়ে বড় তফাত বোধহয় এই, রাজকন্যাটিকে এ যাত্রা ধরে রাখা। এই মুহূর্তে তার অবশ্য এ-নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আপাতত তার সমগ্র ধ্যান এই শহরে। সাগরদিঘি, জেনকিন্স স্কুল, মদনমোহন তলা, বৈরাগী পুকুর ছাড়িয়ে লাল ইঁটের একতলা কোয়ার্টারগুলো — বড়ো কোয়ার্টারটার সামনে তার নিজের হাতে পোঁতা রাবার গাছ, মনের মধ্যে কালচে সবুজ পাতাগুলোয় মর্মরধ্বনি নয়, সোহিনী চাপা গলায় তাকে বলছে, 'শালবাড়ি যাবে নাকি?' মানব স্বতস্ফূর্তভাবে বলে উঠল 'পাগল!' এখান থেকে শালবাড়ি কম করে দুঘন্টার রাস্তা। দল ফেলে বা দল নিয়ে কোনভাবেই সেখানে যাওয়া চলে না। তবু সোহিনী বলতে ওর মনে পড়ল, চকচকে রুপোর মতো টিনে ঘেরা সে-বাড়ির বিশাল চৌহদ্দি। বাঁধানো উঠোনে মেলা লাল লঙ্কার রাশ। একপাশে কল দিয়ে অবিশ্রান্ত জল পড়ে যাচ্ছে। এই একজন একরাশ বাসন মেজে গেল, এই একজন দু-বালতি কাপড় কেচে গেল। সাবানের ফেনা-মেশা জল যেমন বাঁধানো উঠোনের নালি দিয়ে গড়িয়ে চলে যায়, তেমনি ও বাড়ির জীবনযাত্রা। একবার শীতে, সে গিয়ে পড়ায়, ও বাড়ির মেয়ে-বৌরা সারারাত পিঠে করেছিল। মাঝরাতে তাদের কলহাস্যে তার ঘুম ভেঙে গেল। বিশাল রান্নাঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সে দেখল, ওপারে এক আশ্চর্য জগত। কুশল রমণীরা কেউ সিরা জ্বাল দিচ্ছে, কেউ ক্ষীরসা পাক করছে, কেউ চালগুঁড়ো করছে, কেউ বিউলিডাল বাটছে। দুধের গন্ধ, নারকোলের গন্ধ, ছোট এলাচের গন্ধ মিলে বাতাসে এক স্বর্গীয় সুঘ্রাণ। সেই অনাস্বাদিত পৃথিবীর এক অগ্নিকুণ্ডের ধারে সে বসেছিল। বাদামী শালে শরীর জড়িয়ে, কপালে ছোট্ট মেরুন টিপ, ঘুম-ঘুম দুটি চোখে আগুনের আঁচ পড়ে কি অপরূপ দেখাচ্ছিল!

সোহিনী কেন মনে করাল? সে তো আর শালবাড়িতে থাকে না। সে এখন যেখানে থাকে, সেখানকার দিন-রাত এখানকার উল্টোদিকে ঘোরে। যদি সে কখনো ফিরে আসে, মানবের সময়-বৃত্তে, তারও কি অনাস্বাদিত পৃথিবীর বিভ্রম হবে না, সেই অলৌকিক রাতের মতো?

মানব সে-রাতে ভেবেছিল, রান্নাঘরের কেউ-ই তাকে লক্ষ্য করেনি। সবাই কুটতে, বাটতে, গড়তে, ভরতে, হাসতে এত ব্যস্ত ছিল। সে আবার নিজের ঘরে ফিরে লেপের মধ্যে ঢুকে পরেছিল। শালবাড়ির টিনের চালে তখন হিম পড়ার টুপটাপ শব্দ। সে শব্দ জ্যোৎস্নার উচ্চারণের মতো মনে হচ্ছিল তার। শীতরাতে যদি জ্যোৎস্না ওঠে, তবে কালচে সবুজ বনাঞ্চলও বরফের গুঁড়োর মতো দেখায়, তেমন মিহি। লেপের তলায় সে হঠাৎ সেইরকম মিহি বনদেশ অনুভব করল। কিন্তু এ শীতের জ্যোৎস্না নয়, এর উত্তাপে কাঠের আঁচ, নারকোল, দুধ আর গুড়ের সুঘ্রাণ। সেই উত্তাপ একবার তাকে গলিয়ে দিল, পরক্ষণেই টুপটাপ হিমের মতো ভিজিয়ে দিল। সে ভয়ানক বিভ্রান্ত হয়ে গেল। শীতলতা ও উষ্ণতার অনুপাত বুঝে দেখার জন্যে সে জ্যোৎস্নার ভিতরে প্রবেশ করতে গেল। অথচ, পরিণামে, জ্যোৎস্নাই তার ভিতরে ঢুকে এল। তাকে হাওয়া-লাগা মানুষের মতো এতোল-বেতোল করে চলে যাবার সময়, সে তার মুখে কি একটা গুঁজে দিয়ে বলল — 'নারকোলের ছাঁই!'

ছাঁই না ছাই! অথচ অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই সময়, গুড় নারকোলের পাক করা সেই মাধুর্যই তার শরীরে বল জুগিয়েছিল। পরের দিন, সবাই ওঠার আগেই সে চলে আসে। শালবাড়িতে সেই তার শেষ রাত্রি। তার বিয়ের চিঠি পেয়েও সে যায়নি। আজকাল বিয়েবাড়িতে কি সব হাবিজাবি খাওয়ায়। উত্তরবঙ্গের বিয়ের মেনুতেও ডাল মাখানির পর কাশ্মীরি আলুর দম, চিলি ফিশের সঙ্গে নবরত্ন পোলাও। গুলাবজামুনের পরেই আসে ফিরনি। সেসব খেয়ে নারকোলের ছাঁইয়ের স্বাদকে সে বরবাদ করতে পারবে না।

সোহিনী একবার জিগ্যেস করেছিল 'শালবাড়ি মানে?' রিডিফমেলে মানবের অ্যাকাউন্ট শালবাড়ি-অ্যাট-রিডিফমেল-ডট্‌-কম দেখে তার এই কৌতূহল। মানব বলেছিল, 'কোচবিহারের কাছে একটা জায়গা।' 'তোমরা প্রপার টাউনে থাকতে না? কোয়ার্টারসে?' 'শালবাড়িতে হসপিটালের এক স্টাফের বাড়ি ছিল, আমরা কখনো কখনো সেখানে গেছি।'

কখনো কখনো! কোচবিহার বাসের চার বছরের প্রতিটি সরস্বতী পূজো, দোল, পৌষসংক্রান্তি সেখানে কেটেছে। শুধু কি পালাপার্বণ? কারণে অকারণে সে শালবাড়ি গেছে। শিবপুরে পড়ার সময়, অনেকবার এমন হয়েছে, ফেরার পথে প্রথমে সে শালবাড়ি গেছে, পরে বাড়ি। সোহিনীর কাছে শালবাড়ি একরৈখিক একটা অস্তিত্ব, সে কিছু জানে না, আর, সে আরো জানে না; শালবাড়ি রিডিফমেলের পাসওয়ার্ড। সে তো আরো প্রহেলিকা। দোয়েল ডি-ও-ই-এল। দোয়েল ছাড়া সে শালবাড়ি ঢুকবে কি করে?

স্ত্রীর নামের পাসওয়ার্ড দেওয়া ই-মেল অ্যাকাউন্ট থেকে কখনো তাকে মেল করেনি মানব। মানব তো জানেই না, তার মেল আই. ডি., বা আদৌ কোনো আই. ডি. আছে কি না, জানার চেষ্টাও করেনি কোনদিন। ঠিকানা না, ফোননাম্বার না। সে রাতে যেমন বিছানা থেকে উঠে সে বাইরের অন্ধকারে, হিসে(??) মিলিয়ে গেছিল, তেমনভাবেই তাকে মিলিয়ে যেতে দিয়েছে।

সোহিনী কেন মনে করাল আবার? সে বিদীর্ণ-হৃদয় নিয়ে সোহিনীর দিকে তাকাল। সোহিনী শিউরে উঠল। যেন, অন্য নারীতে উপগত মানবকে দেখে ফেলেছে। সে-ও, বিষন্ন চোখে হাসি টেনে বলল, 'নৈনিতালের কাণ্ডটা বলি?'

ওদের গাড়ি তখন অন্ধকার রাজবাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আলো জ্বালানো নিয়ে কি যেন একটা রেষারেষি চলছে। সে অভ্যেসবশে বাবানকে দেখাল—'ঐ দ্যাখো রাজবাড়ি'। বাবান তাকিয়ে দেখল অনেকখানি ফাঁকা জায়গায় বিছানো অন্ধকার। গোটা শহরটাকেই তাদের অন্ধকার মনে হল। হয়তো সন্ধের মুখে এর আগে কোথাও ঢোকেনি বলে।

পুলকদা বললেন 'ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড, আমরা এখানে অ্যাট অল এলাম কেন?'

দীপাবৌদি বললেন 'রাতটা তো কোথাও কাটাতে হবে।'

শহরের অন্ধকার গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। হঠাৎ মদনমোহনতলার আলোর গাছ দেখে সবাই খুশি হয়ে উঠল। আর ঠিক তারপরেই একটা হোটেল পেয়ে গেল ওরা। হোয়াইট টাওয়ার। দোতলার টানা বারান্দায় পাশাপাশি দুটি ঘর। ২০২, ২০৩। ঘরগুলো যতক্ষণ রেডি করা হচ্ছিল, ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। নিচে ব্যস্ত রাস্তা, সাইকেল রিক্সার ফাঁকহীন সারি, উল্টোদিকের হোটেলে লোক ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। খাওয়ায় সেই অবিচ্ছিন্ন স্রোত দেখে মানব নৈনিতালের গল্পটা শোনানোর তাগিদ অনুভব করল।

'বুঝলেন পুলকদা, সারাদিনের কনডাকটেড ট্যুরে গেছি, সাতটা তাল দেখব। তাল মানে লেক। ভীমতালে লাঞ্চ-ব্রেক। একটা হোটেলে গাড়ি দাঁড় করাল। আমাদের বাঁধা মেনু। আমার ভাত-পনির, সোহিনীর রুটি-পনির। পনির না থাকলে তড়কা। বেড়াতে গেলে, নন-ভেজ কেবল রাতে। আমাদের খাবার এসে গেছে। খেতে শুরু করেছি। অন্য একটি বাঙালি দল তখনো হাঁ করে বসে। তারা মাছ খাবে। আমাদের খাওয়া শেষ। চোখের সামনে দিয়ে তখন লেক থেকে মাছ ধরে আনল। সেই মাছ কাটা হবে, ধোয়া হবে, ভাজা, তারপর ঝোল, ভাবুন একবার! এই হচ্ছে বাঙালির ভ্রমণ।'

মানবের শেষ কথাটা অতর্কিতে হাওয়ায় একটা গর্ত তৈরি করে ফেলল। পুলকদা আচমকা হোঁচট খেয়ে ... সোহিনী পুলকদাকে একটু একটু করে মিলিয়ে যেতে দেখল। তারপর সে মানবের বাহু ছুঁয়ে বলল, 'ঘর তো রেডি। বাবান ঘুমিয়ে পড়েছে। ভিতরে আসবে না?'



(পরবাস-৫১, জুন-জুলাই, ২০১২)