ISSN 1563-8685




শীতের জোংরি

একুশে ফেব্রুয়ারি, সকাল ন-টা -

রাবাংলা ছেড়ে চলেছি য়োকসমের উদ্দেশে। আপাতত লেগশিপ। সেখান থেকে গাড়ি বদল। আমার সঙ্গী নামি ইলাস্‌ট্রেটর দেবাশিস দেব। সকালেই ওর করা রাবাংলার স্কেচ হাঁ করে দেখেছি। দিব্যি ঠাণ্ডা। পাহাড়গুলো সব বরফের সোয়েটার পরে বসে আছে।

সকাল এগারোটা দশ -


লেগশিপ


লেগশিপে আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি বাকিদের নিয়ে টা টা করে চলে গেল। এবার য়োকসমের গাড়ির অপেক্ষা।

সকাল সাড়ে এগারোটা -

এক ধাক্কায় হলো না। চেপে বসেছি তাশিদিং-য়ের গাড়িতে। সেখানে নাকি য়োকসমের গাড়ি মিলবে।

ঠিক দুক্কুরবেলা -

গাড়ি গড়ালো।

বেলা একটা -


তাশিদিং


তাশিদিং। এখানকার গুম্‌বা নাকি ভারি পবিত্র। বুমছু উৎসবে যোগ দিতে দেশ বিদেশ থেকে বৌদ্ধভক্তরা আসে।

বেলা একটা পঁচিশ -

রক্তচাপ বাড়িয়ে অবশেষে গাড়ি এলো, মিলল ঠাঁই। এবার যাই — য়োকসম।


য়োকসম


বেলা দুটো কুড়ি -

ফামরং প্রপাতকে হাত নেড়ে, পাহাড়ের ধার ঘেঁষে, শেষমেষ ডাইনে মোচড় মেরে য়োকসম (৫৫০০ফুট), সিকিমের প্রথম রাজধানী। এখানেই ১৬৪১ সালে ফুন্‌সোক নাম্‌গিয়ালকে চোগিয়াল (ধর্মরাজা) পদে অভিষিক্ত করেন তিনজন তিব্বত থেকে আসা লামা। সেই সিংহাসন আজও বর্তমান।

বেলা চারটে -


কারথোক লেক, য়োকসম


কারথোক লেকের ধারে এসেছি। ঘুরে এসেছি নরবুগাং গুম্‌বা। এই হ্রদও নাকি ভয়ানক পবিত্র।

সন্ধে সাতটা -

কাল জোংরি যাত্রা শুরু। শীতকালে এই প্রথম। সঙ্গী হিসেবে পাওয়া গেছে স্বর্ণবাহাদুর সুব্বাকে, আমাদের 'পথপ্রদর্শক'।

বাইশে ফেব্রুয়ারি, সকাল সাড়ে ন-টা -

নানারকম পারমিশান যোগাড় করে পা রাখা গেল পথে।

সকাল দশটা -

এক নম্বর ব্রিজ পেরোলাম। কুড়ি বছর আগেকার মতোই উত্তেজনা হচ্ছে।

সকাল সোয়া এগারোটা -

দু-নম্বর ব্রিজটাই হাওয়া! পাথরে পা রেখে পেরোনো।

বেলা বারোটা পাঁচ -

তিন নম্বর ব্রিজের কাছে ধসের তাণ্ডব; লক্ষ লক্ষ টন দানবাকৃতি পাথর নিয়ে কে যেন ছেলেখেলা করেছে। সদ্যগড়া কাঁচা সাঁকো আর পায়ে পায়ে গড়ে ওঠা পথের নমুনা বেয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে পেরিয়ে এলাম।

বেলা একটা দশ -


সাচেন


সাচেন। ঘনবনের মাঝে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। ভেবেছিলাম আজ রাতে এখানে থাকব, কিন্তু বিধি বাম। সায়েবরা আগেই দখল নিয়েছে সাচেন হাটের।

বেলা দুটো বারো -

অতএব — চলো মুসাফির, বাঁধো গাঠরিয়া। আবার চড়াই ভাঙো। আমাদের পায়ের শব্দ ছাড়া পাহাড়ী ঝিঁঝির ডাক ঠাসবুনোট বনের মধ্যে বেশ একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করেছে।

বেলা তিনটে -

চলি, চলি, চলি, পথের যে নাই শেষ —

বেলা তিনটে সতেরো -


প্রেকচু ব্রিজ


অবশেষে চার নম্বর ব্রিজ — প্রেকচু। একবার এর ধারেই তাঁবু খাটিয়ে ছিলাম। এবার তাঁবুর বালাই-ই নেই। এবার চড়াই, শুধুই চড়াই। একেবারে জোংরি পর্যন্ত 'ধর তক্তা মার পেরেক' চড়াই। আমরা অবশ্য বাখিম তক।

বেলা তিনটে পঞ্চাশ -

অগত্যা গাত্রোত্থান। স্বর্গের সিঁড়িতে পদক্ষেপ।

বেলা পাঁচটা পাঁচ -


বাখিম


'মাগো, বাবাগো' করতে করতে একহাত লম্বা জিভ নিয়ে বাখিম। সোজা ঢুকে পড়লাম কেয়ারটেকারের ঘরে। দেবাশিস, স্বর্ণবাহাদুরকে ঠেলে ধাক্কে জায়গা করে নিলাম আগুনের আওতায়। বাইরে ঠাণ্ডা রীতিমতো হুমকি দিচ্ছে।

'রাত' সাড়ে সাতটা -

একেবারে খেয়ে দেয়ে টর্চ জ্বালিয়ে হুমড়ি খেতে খেতে উঠে এলাম বনবাংলোয়। চাঁদমামা বনের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছেন।

রাত আটটা -

গোটা বাংলোয় আমরা তিনটি প্রাণী। ফাঁকা পেয়েই বোধহয় শীত এবং ঘুম দুটোই দখল নিল ঘরটার।

তেইশে ফেব্রুয়ারি, সকাল সাড়ে আটটা -


ছোকা


বিদায় বাখিম। আজ অবশ্য ছোকা পর্যন্ত — মেরেকেটে এক দেড় ঘন্টা।

সকাল ন-টা পঞ্চান্ন -

ছোকা। এ পথের শেষ গ্রাম। পথেই বরফের দেখা মিলেছে। আমাদের আস্তানার সামনে বেশ পুরু বরফের ফুটপাথ। যেখানেই ছায়া, সেখানেই বরফ। গোটা ছোকা জুড়ে বরফের লুকোচুরি। এখান থেকেই দেখা যায় পাণ্ডিম, তিনচেং কাং-দের। কিন্তু আজ তারা মেঘের লেপের আড়ালে।

বিকেল চারটে পঞ্চাশ -


ছোকা থেকে দৃশ্যমান পর্বতশৃঙ্গরাজি


মেঘেরা হঠাৎ হাই তুলে নড়েচড়ে বসল — উঁকি মারল পাণ্ডিম, তিনচেংকাং, ছুপোনুরা। শেষবেলার আলো মেখে সেজেগুজে। নয়ন সার্থক হলো।

চব্বিশে ফেব্রুয়ারি, সকাল সোয়া সাতটা -

আজ জোংরি। জয় বাবা জোংরিনাথ। সূয্যিমামা মিটিমিটি হাসছেন।

সকাল সাতটা চল্লিশ -


ছোকা ছাড়িয়ে


গুম্‌বার সামনের টলটলে জলের পুকুরটা (সত্যিকথা বলতে কি, ডোবা) পেরিয়ে আসতেই সেই ষাঁড়াষাঁড়ি খাড়াই। এটা চড়তে পারলেই ফার-পাইনের বনের মাঝে হালকা চড়াইয়ের পথ।

সকাল আটটা -

বনের বুকে পা রাখতেই বরফের ছড়াছড়ি। গাছের গোড়ায়, গাছের পাতায়, পথের বুকে। পায়ে পায়ে চড়াই ভাঙা।

বেলা এগারোটা চল্লিশ -

আমাদের চড়াই ভাঙা দেখতে নিচে নেমে এল মেঘেরা। নাকি, আমরাই ওদের দেশে উঠে এলাম! চড়তে চড়তে, হাঁপাতে হাঁপাতে ফেদাং পৌঁছেই ধপাস করে পেতে রাখা ম্যাটে চিৎপাত। স্যাকটা পাশে কাদা বরফ মাখতে থাকল। খিদেয় পেটে ছুঁচোরা ছক্কা হাঁকাচ্ছে। ১২৩০০ ফুটে T20-র গতিতে রুটি তরকারি উদরস্থ করলাম।

বেলা বারোটা পঞ্চান্ন -


দেবাশিস দেব


খেয়ে দেয়ে গড়িয়ে খানিক মানুষ হওয়া গেল। এবার দেওরালি পেরোতে পারলেই কেল্লাফতে। এবার গাত্রোত্থান করতে হয়। দেবাশিস দিব্য আছে।

বেলা দুটো -


দেওরালি


ঘন মেঘের মধ্যেই দেখতে পেলাম দেওরালির কেয়ার্নের নিশানা। মনটা খুশ হয়ে গেল। মেঘের মধ্যেই খানিক গড়িয়ে নিলাম। দুপাশে বরফের পাহারা।

বেলা দুটো পঁচিশ -

এসে গেছে দেবাশিস। আবার এগোবার পালা।

বেলা দুটো পঁয়ত্রিশ -

বরফের ওপর ব্যালান্সিংয়ের কসরত। আছাড় খেতে খেতে চলা।

বেলা তিনটে -

প্রায় হাতড়ে হাতড়ে নড়তে নড়তে জোংরির হাতায়। বাংলো গোরাচাঁদের দখলে। অতএব আরও শ-খানেক ফুট বরফি চড়াই ভাঙা। ১৩২০০ থেকে ১৩৩০০ ফুটে।

বেলা তিনটে দশ -

দেড় কামরা হাফ-পরিত্যক্ত হাটে জুটে গেল আশ্রয়। বাইরে এখনই ৪-৫ ডিগ্রি।

বিকেল চারটে -


জোংরি


নেমে এলাম জোংরি ট্রেকার্স হাটে চায়ের আশায়। চতুর্দিকে মেঘের দেওয়াল!

রাত সাতটা -

মোমবাতি আর টর্চ সহযোগে বিচিত্র নৈশাহার। ঘরের ভেতরেই এখন ২ ডিগ্রি।

পঁচিশে ফেব্রুয়ারি, ভোর চারটে -

ঘুম ভেঙেছে ঘন্টা দুই আগেই — ঠাণ্ডায়। থার্মোমিটার বলছে - ২ডিগ্রি। কাদা-বরফে ভেজা জীন্‌স্‌টা খুলে রেখেছিলাম — সেটা এখন ঠাণ্ডা পাথরের।

ভোর চারটে কুড়ি -

জীন্‌স্‌ জুতোকে কোনোমতে দুরস্ত করে দেবদূত স্বর্ণবাহাদুরের আনা গরম চায়ের ওমে তৈরি হয়ে নিলাম।

ভোর পাঁচটা -

বাইরে আঁধার কাটার আভাস। পা রাখা গেল জোংরি টপের নুড়ি বরফভরা চড়াইয়ে।

ভোর পাঁচটা দশ -

জুতোর পালিশ হয়ে যাওয়া সোল আমার বুকে হাফসোল মেরে দিল। হড়কাতে হড়কাতে পুরোপুরি হড়কে গেলাম। দেবাশিস বলদৃপ্ত ভঙ্গিতে সায়েব মেমদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠে চলল। আমার অধঃপতন হলো জোংরিতেই।

সকাল প্রায় ছ-টা -

সূর্যের প্রথম কিরণ পড়ল পাণ্ডিমদের মুকুটে। কাঞ্চনজঙ্ঘা আমার দৃষ্টির আগোচরেই রয়ে গেল। আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস বরফ হয়ে করে পড়ল। না, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। নিঃশ্বাসটা বরফ হয়ে গোঁফ থেকে ঝুলতে লাগল।

সকাল পৌনে সাতটা -

দেবাশিস বিশ্বজয় করে ১৪১০০ ফুটের জোংরি টপ থেকে নেমে এলো।

সকাল আটটা -

বরফে রোদ ঠিকরে চোখ ঝলসাচ্ছে। এবার ফেরার পালা। মেঘেরা আকাশ দখলের ধান্দা করছে। কোকতাং আর রাতোং আমাদের দেখতে। কাব্রুও উঁকিঝুঁকি মারছে।

সকাল সাড়ে দশটা -

ফেদাংয়ে বসে হাঁফাচ্ছি। বার দুই আছাড় খেয়ে সারা গায়ে বরফ কাদা মেখে এসে পৌঁছেছি। পথে কালিজের দল নাচ দেখাল।

সকাল এগারোটা -

একে ঘনবনের বরফপথ, তায় আবার মেঘের চক্রব্যূহ, বুকে কাঁপন ধরছে।

সকাল সাড়ে এগারোটা -

ছোকা। গ্রামের নিশ্চিন্ত আশ্রয়।

ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি, সকাল আটটা -

বিদায় ছোকা। বিদায় জোংরি। আজ য়োকসমে ফেরা।

শেষবেলা -


য়োকসম


প্রায় টলতে টলতে এসে পৌঁছলাম য়োকসম। প্রায় পুরো পথটাই ঠিকঠাক এসে শেষটায় দম ছুটে গেল। স্বর্ণবাহাদুর এগিয়ে এসে স্যাকটা নিয়ে নিল।

সাতাশে ফেব্রুয়ারি, বেলা তিনটে -

আজ এখানে হাট। কতরকম মানুষ! কতরকমের জিনিসপত্র কেনাবেচা হচ্ছে। আমরা সিকিমের অন্যতম প্রাচীন (১৭০১ খ্রি.) দুব্‌দি গুম্‌বা দেখে এলাম। আজই শেষ দিন। কাল ফেরা। এখনও চোখে শীতের জোংরির স্বপ্ন।



(পরবাস-৫২, অক্টোবর, ২০১২)