নির্বাচিত অসমীয়া কবিতা
মূল অসমীয়া থেকে অনুবাদ
অমিতাভ

কবি: হেম বরুয়া
(১৯১৫-১৯৭৭)

দুটি কবিতা




আলোর থেকে আঁধার ভালো

সময়ের বালুকাবেলায় পদচিহ্ন আঁকা
উন্মাদ বাসনা আমার নেই। আমি
ইতিহাসের শিলাখণ্ডে জীবন্ত ফসিল

হে শকুন্তলা, তোমার চোখের শিউলিদলে
দুষ্ম্যন্তের চুম্বনের রেশ। কোরিয়ায় জরাসন্ধের কংকাল,
এশিয়ার আকাশে অগ্রণী শকুনের দল।
আমরা বেঁচে আছি যুগের সীমান্তে
প্রাচীন নাবিকের কঙ্কাল। কালিদাস তুমি কোন
অলকার পলাতক কবি? মেঘ দেখে পাগল?
তোমার কাব্যবেদীতে আমার জীবন-অর্চনা
ঝরে পড়া মাদারের ফুল! (গুরু বা গোঁসাই,
কারো কাজেই আসে না, মাটিতে ঝরে পড়ে থাকে)

রাজায় রাজায় যুদ্ধ, দীপ্ত আস্ফালন। আমরা খাণ্ডবদাহে
অগ্নিশিখায় পুড়ে ছাই হওয়া অজানা ফুল। আমাদের
পিরামিড হিরোশিমা নাগাসাকি
শকুন্তলা তোমার আঙুলের অগ্নিকণায় নিবিয়ে দেয়
রাজপ্রাসাদের সলতের শিখা। দুষ্ম্যন্তের পলাতক স্বপ্ন।
আলোর থেকে অন্ধকার ভাল
জীবনের অগ্রগতিতে রামেশ্বরের সেতুর বাঁধ
শঙ্কা
নতুন সকালের নতুন আলোর আশার কণা জ্বাল
চোখে আমাদের তীব্র শান।



মমতার চিঠি

If you are coming down through the narrows of the river Kiang
Please let me know beforehand,
And I will come out to meet you

                                        As far as Cho-fu-sa.
                                        Ezra Pound

প্রিয়,
একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়েছি। আজ বহুদিন
পর তোমাকে চিঠি লিখবো বলে। বাইরের দমকা হাওয়া এসে
মোমবাতি নিবিয়ে দিচ্ছে। ...যাই, জানালাটা
বন্ধ করে দি। ...
সাত বছর আগের কথা কি তোমার
মনে আছে? আমরা যে নতুন জীবনের পত্তন
করেছিলাম। ...... সেই অজানা নেশা আমাকে বেশ
পেয়ে বসেছিল।
সে ছিল কার্তিকের কুয়াশা ছড়ানো এক কোমল ভোর।
উঠোন ঢাকা ছিল ঝরে-পড়া শিউলি ফুলে। আর সাঁঝের বেলা,
আমার তোমাদের বাড়িতে প্রথম আসার দিন, আকাশের
মেঘের মোহনা থেকে হলদে রঙের চাঁদ নৌকো হয়ে আমাকে যে
উদ্দাম ডেকেছিল তারার দেশে। ...
আমার পরনের লাল শাড়ির দিকে তুমি এমন করে
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে কেন গো?
আমার কেমন লাগছিল, জানো? তুমি যেন কোন সুদূর
বিদেশের স্বপ্নাতুর আলোর মানুষ। আর আমি? আমি যেন
ঝরে-পড়া এক শিউলি।
সেদিন মন-সাগরে আমার ভেঙে-পড়া ঢেউ আর
জেগে-ওঠা ঢেউ অসংখ্য কম্পন তুলছিল। তোমার বুঝি
এসব কথা মনে নেই?
আমার বাবা যে চিঠিতে লিখেছিল : "মা'রে, তুই নতুন
বাড়িতে হেসে-খেলে থাকিস"।

এসব সাত বছর আগের কথা। আমার যে সবকিছুই
পুরাণের কথার মতো মনে হয়। ... জৈষ্ঠ্য মাসে বাবার
বাৎসরিক হয়ে গেল। তোমার বাবুল এখন বড়ো হয়েছে।
তার উপর পাটিতে একসার ডালিমদানার
মতো দাঁত উঠেছে। সে আমাকে একটু আড়াল
হতে দেয় না। (কখনও কখনও আমার এমন রাগ করে--
তুমি যে নেই, সে কারণে।)

আচ্ছা, সে আমার সাদা কাপড়ের দিকে এভাবে বিস্মিত
তাকিয়ে থাকে কেন? তার জন্মথেকেই এই সাজটিই
চেনা,-- সে কারণে—তাই না? বাবুল এখন বড়োটি
হয়েছে, বুঝলে? (আরেকটু বড়ো হলেই তাকে স্কুলে
দিয়ে দেব। তার স্কুলে থাকার সময়টুকুতে
আমার যে বুকটা ফাঁকা হয়ে যাবে গো।)

আর কী লিখব। বিশেষ কিছু বলার নেই। আমার দিব্যি,
তুমি যেদিন ফিরে আসবে, আমাকে আগে থেকেই জানিও
গো। আমি ভোগদৈ নদী-দিয়ে ভেসে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের
বুক থেকে তোমাকে ডাক দেব, -- তুমি যেদিন
ফিরে আসবে। আমাকে আগে থেকে জানাতে ভুলোনা
গো। ভালবাসা নিও। ইতি
                       তোমার
                       মমতা

পুনঃ বুঝলে, এবারে মাঘবিহুর মেজির আগুন টকটকে
রাঙা হয়ে জ্বলেছিল। ... আমাদের বুড়িমার নতুন ছাগলীটির
দুটো ছানা হয়েছে। একটা নিখুঁত সাদা।
আর অন্যটি চিতল।


(পরবাস-৫২, অক্টোবর, ২০১২)