ISSN 1563-8685




ছাতিমতলার তাল

ধুপ! ধুপুস!

একটা নয়, দু'দুটো তাল গাছ থেকে ডাইরেক্ট থ্রোতে একদম মাটিতে। থ্রোটা অবশ্য কেউ করে নি। পাকা তাল বোঁটা খসে ধুপ! ক্যাচ ধরার কেউ ছিল না। তাই অগত্যা মাটিতেই ধপাস!

বংকা-লংকা দু'ভাই তখন ছাতিমতলায় দাঁড়িয়ে। ওদের বুজুম ফ্রেণ্ড টিংকা আসবে। তাই ওয়েট করছে দুভাই। টিংকা এলেই ওরা 'থ্রি ইডিয়টস্‌' হয়ে যাবে। তারপর ছুটতে ছুটতে চলে যাবে দোলতলার মাঠে। সেখানে নাকি সার্কাসের তাঁবু পড়েছে। হাতি এসেছে। ভাল্লুক এসেছে। জোকার এসেছে। কি মজা! সার্কাস শুরু হবে শনিবার।

বংকা লংকার দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে কি করবি?

কি আর করব? লংকা চোখ গোল গোল করে বলল, চল তালদুটো কুড়িয়ে নিয়ে ধা হয়ে যাই। পাকা তালের বড়া যা খেতে হবে না!

- কিন্তু টিংকা এসে যদি দেখে আমরা নেই!

- নেই তো নেই। ও অলরেডি লেটে রান করছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে লেট আসাটা মোটেই ঠিক নয়। আমরা বলব, তুই দেরি করছিলিস তাই আমরা চলে গেছি।

দোলতলার মাঠে তাহলে যাবি না? বংকা ফিসফিস করে জানতে চায়, হাতিকে চান করানো দেখবি না?

যাব তো। দেখব তো। লংকা এক নিঃশ্বাসে বলে যায়, ঠাকুমার হাতে পাকা তালদুটো দিয়ে বলব, ঠাকুমা তুমি কিন্তু আজই তালের বড়া করবে। রাতে তালের বড়া খেতে খেতে তোমার কাছে ভূতের গল্প শুনব। তারপর চলে যাব দোলতলার মাঠে।

ঠিক বলেছিস তো। দারুণ আইডিয়া। টিংকা আমাদের না দেখতে পেয়ে একাই যদি চলে যায় দোলতলার মাঠে, তো দেখা হয়ে যাবে। বংকাকে বেশ খুশি খুশি দেখায়।

পাকাতাল দুটো মাটিতে পড়ে রয়েছে। তালের গন্ধে বাতাস কেমন মিষ্টি, মধুর হয়ে গেছে। দু'চারটে মাছি কাছাকাছি ঘুর ঘুর করছে। বংকা-লংকা আর দেরি না করে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় তাল কুড়োতে।

অ্যাই! অ্যাই! খবরদার, ওই তাল কুড়োস নে খোকারা! কে যেন হঠাৎ পিছন থেকে সাবধান করে হাঁক দিল। ভয় দেখিয়ে বলল ওই তালগাছে দুটো 'ঘাড় মটকা ভূত' আছে। লোকে বলে, ওরা নাকি বর-বউ। ওরা মানুষের ঘাড় মটকে দিতে ওস্তাদ। এ গাছের তালের বড়া খেলেই মরবি। একদম ঘাড় মটকে মেরে ফেলবে তোদের। দেখছিস না আমিও তো দেখেছি, কিন্তু কুড়োতে তো যাই নি।

বংকা-লংকা বেদম ঘাবড়ে যায়। শিউরে ওঠে দু'ভাই। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ছাতিমতলায়। আর এক পা-ও এগোতে সাহস করে না। লোকটা এক রোগা-প্যাংলা রিক্সাওয়ালা। একটু দূরে একটা গাছভর্তি হলুদ রঙের কলকে ফুল। সেই গাছের ছায়ায় রিক্সা রেখে তার উপর বসে দিব্যি পা দোলাচ্ছে। ল্যাতপ্যাতে চেহারার মানুষটার গলায় ঝুলছে একটা লাল গামছা। লোকটা বেশ অদ্ভুত। কেমন মিটিমিটি হাসছে।

লংকা বলল, আচ্ছা কাকু, তালদুটো তাহলে কি হবে? পাকা তাল তো।

কি আর হবে। মিটিমিটি হেসেই রিক্সাকাকু বলে, একটু পরেই ভূতের ছেলেপুলেরা এসে কুড়িয়ে নিয়ে যাবে।

ভূতের ছেলেপুলে? ভূতের আবার ছেলেপুলে হয় নাকি! দু'ভাই একসাথে চোখ কপালে তুলে বলল।

রিক্সাকাকু এবার রিক্সা থেকে নেমে এসে বলল, হয় রে, ভূতেরও ছেলেপুলে হয়। সংসার হয়। বউ হয়। নাতি-নাতনি হয়। ওরা ইসকুলে যায়। ওরা তো এখন ইসকুলে গেছে। এই এল বলে!

ইসকুল! লংকা বলল, ভূতেদের স্কুল আছে নাকি?

- আছে তো।

- কোথায় গো রিক্সাকাকু? বংকা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল।

- ওই যে গাজিবাবার মাজার আছে না, তার পাশে ইয়া মোটা ঝাঁকড়া যে তেঁতুল গাছটা, তার তলাতেই নাকি ওদের ইসকুল বসে। তবে কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ম নয়। কি মিডিয়ম তা অবশ্য আমি বলতে পারব না। অত জ্ঞানগম্যি আমার নেই।

তেঁতুলতলায় ভূতের স্কুল? লংকা ঘাবড়ে না গিয়ে প্রশ্ন করে, কই শুনি নি তো আগে?

- তুমি শোন নি বলে কি নেই! রিক্সাকাকু এবার বেশ মিষ্টি মিষ্টি করে হেসে বলছে, তুমি কি ভগবানকে দেখেছো? দেখ নি তো! কিন্তু আমরা তো সবাই জানি, ভগবান আছে। আমরা মন্দিরে যাই। পুজো দিই। ঠাকুরকে প্রণাম করি। ঠিক তেমন ভূত আছে। ভূতের বউ আছে। ছেলেপুলে আছে, সংসার আছে। নাতি-নাতনি আছে। ওরাও ইসকুলে যায়। কলেজে পড়ে। তবে চাকরি করে কিনা তা অবশ্য আমি বলতে পারব না। অত জ্ঞানগম্যি আমার নেই!

দু'ভাই এবার একদম চুপ। নো টক। নো বকবক।

বাতাসে পাকা তালের কি মিষ্টি সুগন্ধ। নাক ভরে শ্বাস নেয় দু'ভাই। এদিকে মাছির সংখ্যাও বাড়ছে, পাকা তালের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া রসের চারপাশে।

সরি। সরি। টিংকা কোথা থেকে হঠাৎ ছুটতে ছুটতে এসে বলল, দেরি হয়ে গেল রে। চল। চল।

বংকা-লংকা এক পা-ও নড়ে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। টিংকা বলল, কি রে যাবি না?

রিক্সাকাকু হাসতে হাসতে এবার জানতে চায়, তোমরা কোথায় যাবে?

দোলতলার মাঠে। টিংকা স্মার্টলি বলে, সেখানে সার্কাসের তাঁবু পড়েছে। হাতি এসেছে। ভাল্লুক এসেছে। জোকার এসেছে। দেখতে যাব সে সব।

ওমা তাই! যাও যাও। শিগগির যাও। খুব উৎসাহ দেয় রিক্সাকাকু।

বংকা তাকায় লংকার দিকে। লংকা তাকায় বংকার দিকে। টিংকা অবাক হয়ে বলে, কি হল রে তোদের?

বংকা বলে, ওই পাকাতাল দুটো কুড়িয়ে নেব ভাবছিলাম।

ইশ্‌ তাল! টিংকা নাক সিঁটকিয়ে বলে, তোরা তাল খাস? আমাদের বাড়িতে তাল অ্যালাউই করবে না মা।

তালের বড়া জীবনে খেয়েছিস কোনদিন? লংকা তেড়ে-ফুঁড়ে বলে, একবার খেলে লাইফে আর ভুলতে পারবি না। এমনই মনে রাখার মত ব্যাপার বুঝলি।

হ্যাঁ। হ্যাঁ। একবার খেয়েছিলাম। আমার দিদা বানিয়েছিল। টিংকা মুখ বেঁকিয়ে বলে, আমার একদম ভালো লাগে নি। তার চেয়ে মালপোয়া অনেক ভালো।

আমার ঠাকুমার হাতের তালের বড়ার স্বাদই আলাদা। বংকা বুক ফুলিয়ে বলে, গাঙ্গুরামের যেমন দই -মিষ্টি, আমার ঠাকুমার তেমন সৃষ্টি - তালের বড়া। একবার তোকে খাওয়াব। তখন বলিস।

ঠিক আছে। ওকে। অলরাইট। টিংকা তাড়া লাগায়, চল চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। হাতিকে চান করানোটা আর দেখা হবে না।

বংকা-লংকা-টিংকা ছাতিমতলা ছেড়ে এবার এগিয়ে যায়। রিক্সাকাকু রিক্সায় গিয়ে বসল। প্যাসেঞ্জার পেলেই হয়তো চলে যাবে। শেষবারের মতো দু'ভাই মায়াভরা চোখে পাকাতাল দুটোর দিকে চাইল। নাক টেনে বাতাস থেকে মিষ্টি গন্ধ নিল। কিন্তু বুকে ভরে গেল সে গন্ধে নয়, কেমন এক টনটনে ব্যথায়! ভুতুড়ে তাল হলেও তাল তো!

বড় বড় পা ফেলে তিনবন্ধু হাঁটছে। বেশ কিছুটা পথ চলে এসে রাস্তাটা বাঁক নেবার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে লংকা বলল, এক সেকেণ্ড। একটু দাঁড়া তো। ওয়েট করি। দেখি তো ভূতের ছেলেরা কখন আসে?

ভূতের ছেলে? টিংকা ঘাবড়ে গিয়ে বলে, কি বলছিস রে! ...

- হ্যাঁরে ভূতের ছেলেরা নাকি স্কুলে গেছে। ওরা এখন ফিরবে। ওই পাকা তাল দুটো নিয়ে যাবে।

বলিস কি? টিংকা মুখ কাচুমাচু করে বলে, আমার তো সত্যি ভয় করছে রে। ভূতের জ্যান্ত বাচ্চা আমরা দেখব!

বংকা ওই দেখ, দেখ! লংকা চিৎকার করে ওঠে, ঐ দেখ রিক্সাকাকুই তালদুটো কুড়িয়ে নিচ্ছে।

ওমা! তাই তো। বংকা চোখ বড় বড় করে বলল, দেখ, দেখ কেমন আবার রিক্সার সিটের তলায় লুকিয়ে রাখছে। এদিক-ওদিক দেখছে।

কি সব্বোনাশ্‌! লংকা এবার দৌড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, চল তো তাড়া করি। ঠিক ধরে ফেলব।

রিক্সা নিয়ে রিক্সাকাকু এবার পোঁ-পোঁ দৌড়চ্ছে। ম্যারাথন রানার মনে হচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা। রাস্তাও খুব সুন্দর। মসৃণ। রিক্সা ছুটছে যেন পক্ষীরাজের বাচ্চা ঘোড়ার মতো দুরন্ত বেগে।

বংকা-লংকা টিংকা তিনবন্ধুও ছুটছে রিক্সার পেছন পেছন। মিথ্যুক। পাজি। ভূতের ভয় দেখিয়ে আমাদের ঠকাচ্ছো। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা। তোমাকে ধরে ঠিক ফেলবই। পুলিশে দেব। জেল খাটাব। পুলিশ তোমার ঘাড় মটকে দেবে। ঘাড় মটকা ভূতের ভয় দেখিয়েছো আমাদের। তোমাকে আমরা ছাড়ছি না। চিৎকার করে করে ওরা এসব বলছে আর প্রাণপনে ছুটছে।

রিক্সাও ছুটছে জোরে। ওরাও ছুটছে জোরে। আরও জোরে! ...

বাতাসে পাকা তালের মিষ্টি গন্ধ ম ম করে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আঃ কি সুগন্ধ!



(পরবাস-৫৪, জুন ২০১৩)