মাত্র কিছুকাল আগেই ‘সোনার দেশ’ ছেড়ে এসেছে দেবরূপ। নগরের ওই ম্লান প্রান্ত থেকে পৌঁচেছে নগরকেন্দ্রে এই উজ্জ্বল স্কুলে। তবু তার মনের মধ্যে গেঁথে আছে ‘সোনার দেশ’। কালের একটি পথচিহ্নের মতো। তার অনন্ত সময়ের হিসেব চলছে সেই চিহ্ন থেকে।
অতএব, ‘সোনার দেশ’ ছেড়ে আসার পরে এই দ্বিতীয় বর্ষা নামল। প্রথম বর্ষাটি স্মরণযোগ্য ছিল না। কিন্তু এবারে জমজমাট বর্ষা। সেই অবকাশে নগরের শতবিধ মলিনতা তাদের লুকোনো গহ্বর থেকে মুখ বাড়িয়েছে। জমাট বাঁধছে মাছের আঁশ, তরকারির খোসা, ছিন্ন খড়, অথবা পচে-যাওয়া বেড়ালের শব। এবং বৃষ্টির পৃথিবীতে ঘনিয়ে আসছে বিপুল নির্জনতা। ঘাসের সর্বাঙ্গে, গাছের মাথায় মেঘের মতো গাঢ় হচ্ছে সেই মেজাজ। নগরের খণ্ডিত বিশ্বে খণ্ড খণ্ড হয়ে জমে উঠছে সেই আবেশ। পাড়ার টলটলে পুকুরে এক খণ্ড, পানা-ঢাকা ডোবায় আর এক খণ্ড। এরা ছোটো ছোটো নির্জনতার মহল। তাদের ভিন্ন ভিন্ন ঘ্রাণ, ভিন্ন ভিন্ন ছায়ার রঙ। ব্যাঙের পুলকিত ক্রন্দনেও প্রদীপের মতো জ্বলে ওঠে নির্জনতা। কোনো ডাঙায় লাফিয়ে-ওঠা দলছুট ব্যাঙকে দেবরূপের হঠাৎ ভালো লেগে যায়। সে সৌহার্দ্য বোধ করে জীবটির প্রতি। লক্ষ্য করে কী করে লাফাতে লাফাতে সে ডুমুরগাছের পেছনে চলে গেল। তার মন ভরে ওঠে; তার রোমাঞ্চের নাড়িতে লাগে কম্পন।
বল্লভগড় উপনিবেশের বয়স এখন সাকুল্যে একুশ বছর। যে-সময় স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন সর্দার বল্লভভাই পটেল, সেই কালে এই অঞ্চলে প্রবেশ করছিলেন প্রায় দু’শোটি শরণার্থী পরিবার। তাঁরা আসছিলেন প্রধানত ঢাকা ফরিদপুর বরিশাল থেকে। বল্লভভাইয়ের অটল জেদের ফলে হায়দরাবাদ প্রদেশ ভারতের অন্তর্গত রইল। তিনি এভাবেই রক্ষা করতে চেয়েছিলেন এক অখণ্ড কাশ্মীর, কিন্তু দেশভাগের অপনায়ক জওয়াহরলালের হস্তক্ষেপে সেই উদ্যোগে বাধা পড়ল। অন্তত এরকমই বিশ্বাস করেছিলেন বাস্তুচ্যুত এই মানুষের দল। দেশের সুদূর অঞ্চলে বল্লভভাইয়ের উদ্যম তাঁদের আলোড়িত করেছিল। তারপর হঠাৎ তাঁর জীবনাবসান হল। নতুন উপনিবেশের নাম রাখা হল বল্লভগড়।
যাকে বলা হয় জীবনসংগ্রাম তা বিচিত্র নীচতার সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে। যাঁরা হয়তো এককালে ছিলেন স্ব স্ব পেশায় নিযুক্ত একান্ত সৎ গ্রামবাসী, নতুন পরিবেশে তাঁরাই হয়ে গেলেন বিচিত্র দালালির কারবারি। যেমন, দেবরূপের প্রতিবেশী শংকরনারায়ণ পাল হয়ে উঠেছিলেন জমির কারবারি, আর তাঁর কাছ থেকেই নগদমূল্যে জমি কিনেছিলেন দেবরূপের পরিবার। যে-জমি তাঁর নয় তা তিনি বিক্রি করেন কিভাবে, এই অত্যাশ্চর্য বন্দোবস্ত নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে নি। পল্লীর বাকিরা কেউ ধরেছিলেন দোকানদারি, কেউ ঠিকাদারি। একজন হাত পাকিয়েছিলেন ওষুধে ভেজাল দেবার কারবারে, একজন জাল পার্মিট বার করবার কাজে। গুণের কদর ছিল তাদের; গলার জোরও ছিল। সব প্রবর্তনাই চারিদিকে ছিল; শুধু বিদ্যায় অনুরাগ ছিল না কোনো ঘরে, যদিও কেউ কেউ ছিলেন স্কুলমাস্টার। বিদ্যালয়গমনের প্রচলন অবশ্য ছিল বালকবালিকাদের মধ্যে, চীৎকার করে পড়া করবার অভ্যেস ছিল। বেড়ার ঘরের জানালা দিয়ে পড়ুয়াদের ‘এঁ-এঁ’ ধ্বনি উপচে পড়ত রাস্তায়, গুরুজনেরাও ‘পড়্ পড়্, পড়স্ না ক্যান্?’ বলে শাসন করবার নিয়মটা বজায় রাখতেন। তবু পড়া মাত্রেই ছিল পাশ-ফেলের মোটা অঙ্কে বিচার্য একটা হিসেব, সরস্বতীর বিল্বপত্রে ছিল মেছোবাজারি গন্ধ।
এখানে বাড়িগুলো সব বেড়ার, তাদের মাথায় ছিল টিনের চাল। অনেক ক্ষেত্রে বাড়ির সামনের অংশটা পাকা দালান। শৌচালয় অবশ্যই মূল ভিটে থেকে বিচ্ছিন্ন একটা ঘুপচি ঘর, যাতে উঠতে হবে দু’তিন ধাপ সিঁড়ি ডিঙিয়ে। বালতি বা ফুটো টিনে জল ভরে নিয়ে যেতে হবে বাইরে থেকে। ‘আমরা গামছা পইরা পায়খানায় যাই’, অনেক পরিবারে এটাই ছিল কৌলীন্যের গর্ব। আর ছিল অসংখ্য ছোটো বড়ো পানাপুকুর, তাদের পাড়গুলো কচুঝোপে ঘেরা। ঘন বর্ষায় তার ভিতরে লুকিয়ে ‘মত্ত দাদুরী’ ডেকে যেত একটানা – পল্লীর বিভিন্ন স্থূল শব্দের মধ্যে এই ছিল একটা মন-কেমন-করা ধ্বনি।
আর, এরই মাঝখানে ছিল ‘সোনার দেশ’। সেই ভবনের দ্বারদেশে লেখা ছিল—
ইহাদের করো আশীর্বাদ ধরায় উঠেছে ফুটি শুভ্র প্রাণগুলি, নন্দনের এনেছে সম্বাদ ইহাদের করো আশীর্বাদ।সেখানে ছুটির ঘণ্টা বাজলে বাড়িটাকে সূর্যাস্তকালের একটা গাছের মতো মনে হত। তার ডালে ডালে পাতায় পাতায় গৃহপ্রত্যাশী কণ্ঠের আনন্দরব। আধা-নাগরিক স্থূলতার মধ্যে এই বিদ্যালয় ছিল এক নির্মল উজ্জ্বল চরাচর।
এখান থেকে বিদায়ের দিনে চার হাত-পায়ে হেঁটে আসছিল দেবরূপ। অধ্যক্ষ বিনয়ভূষণের ডাকে তার চতুষ্পদসুলভ ক্ষিপ্রতা নষ্ট হল। বাবা দেবরঞ্জন নিতে এসেছিলেন। তিনি বললেন, ‘সোনার দেশ’-কে প্রণাম করো।
একটা ব্যুগনভিলিয়া লতিয়ে উঠেছিল বারান্দার বাইরে বিদ্যুতের সার্ভিস পাইপ ধরে। ভিতরে থামের গায়ে মীটার বাক্স। ততোদিনে বিদ্যুৎ এসে গেছে বল্লভগড়ে, যদিও কোনো কোনো বাড়িতে তখনও জ্বলছে হারিকেন বাতি। বারান্দার ওই ব্যুগনভিলিয়া বালকের নিভৃত আশ্রয়। ওর বেগুনি ফুলগুলো রঙিন আলো ছড়ায় মেঝেতে। এক দুপুরে এখানে বসে সে শুনতে পায়, রাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে গেল কয়েকটি মোটরসাইকেল, তারপরে সাইকেল-রিকশার ভেঁপুর মেঠো ধ্বনি, আর তারপরেই বাতাস কেঁপে উঠল একটা উন্মাদ কান্নার শব্দে। দাউ দাউ করে কান্নায় পুড়ে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধা বিধবা, তাঁকে রিকশার আসনে ধরে বসে আছেন এক মহিলা। বৃদ্ধার শুভ্রবেশ আগুনের মতো চোখের সামনে দিয়ে ছুটে গেল। দেবরূপ সন্ত্রস্ত পাখির মতো ব্যুগনভিলিয়ার ছায়ায় লুকিয়ে পড়ল।
আসলে তখন পালটে যাচ্ছে কোলকাতা। খুনোখুনি শুরু হয়ে গেছে শহরের আনাচে কানাচে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল বোমা বাঁধতে জানে, বন্দুক চালাতে জানে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ফেলতে পারে মানুষকে। এবং সেই সঙ্গে সূচনা হয়েছে নজিরবিহীন পুলিসি হিংসার। বল্লভগড় ও সংলগ্ন অঞ্চলের ফাঁকা মাঠ, পুকুরপাড় ও নির্মীয়মাণ বাড়িগুলো বধ্যভূমি হয়ে উঠেছে। পুলিস ফাঁকা মাঠে নিয়ে ছেড়ে দেয় বন্দীদের। অফিসার বলে, ‘যাঃ, পালা।’ ওরা মুক্ত পৃথিবীতে হাঁটতে থাকে। কেউ নিরুত্তাপ, কেউ সৌজন্যবশে পুলিসকে ধন্যবাদ দিয়ে যায়। তারপর, দূরত্ব বাড়লেই ওদের পেছন থেকে বিদ্ধ করে বুলেট। লাশগুলো অচিরেই কুড়িয়ে তোলা হয় পুলিসের ভ্যানে। থানার খাতায় লেখা হয়, ওরা পালাবার চেষ্টা করেছিল।
পুকুরপাড়ে মাঝে মাঝে দেখা মেলে কাটা দেহের। নীল পুকুর, লাল পুকুর, বড়ো পুকুর, জোড়া পুকুর, সাতগাছিয়া পুকুর, বড়ো বটতলার পুকুর, এই ছ’টি পুকুর এ-অঞ্চলে। শেষোক্ত পুকুরটার পাড়ে বটগাছে-বাঁধা এক মৃত ব্যক্তিকে পাওয়া গেল একদিন। তার মুখ ঝলসে দেওয়া হয়েছে অ্যাসিড দিয়ে, অজস্র আঘাত সর্বাঙ্গে নিয়ে সে ঝুলে পড়েছে কোমরের বাঁধন থেকে, অন্তিম মুহূর্তে ভূমিতলের আশ্রয়টুকুও সে পায় নি। এই বড়ো বটতলার কাছেই তৈরি হচ্ছিল দেবরূপের মেজোকাকুর বাড়ি। তার মেঝেতেও পাওয়া গেল চাপ চাপ রক্ত, একরাশ উপড়ে-নেওয়া চুল, ভাঙা চুড়ি, হাতের বালা, আর একটা রক্তাক্ত বক্ষ-বন্ধনী।
বারান্দা থেকে দেখা সেই বৃদ্ধাটি ছিলেন কুখ্যাত রাজনৈতিক গুণ্ডা বাচ্চু ভট্চাযের মা। এই বাচ্চু দেবরূপের বাবার কাছে পড়তে আসত ছোটোবেলায়, কিন্তু সে-ই বছরখানেক আগে এ-বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে মোটা টাকার অঙ্ক দাবি করে। তখন ওসব মামুলি ঘটনা হয়ে উঠেছিল। বাচ্চুর গলা-কাটা দেহটা পাওয়া যায় রেল স্টেশনের পাশে একটি গুদামে। তার বুকে বুলেটের ক্ষত ছিল। পুলিস না গুপ্তঘাতক, কে তাকে খতম করল জানা যায় নি।
কয়েকটা কাকের ছানা সেদিন কলরব করছিল আম গাছের কোটরে। তাদের আধ-খোলা ঠোঁটের ভিতরটা টকটকে লাল। কার্নিশের সঙ্গে শরীর মিশিয়ে শুয়ে দেবরূপ তাদের নিরীক্ষণ করছিল একদৃষ্টিতে। মাঝে মাঝে ঘাড়টা টানটান বাঁকিয়ে তুলছিল সেই প্রাণীটির ভঙ্গিতে যাকে এ-অঞ্চলে বলে রক্তচোষা। নিজেকে ভাবছিল আবদুল মাঝির গল্পের দানো-গিরগিটি। সকাল এগারোটা বেজে গিয়েছিল। একটু পর পর মায়ের ডাক আসছিল, ‘নেমে এসো, স্কুল যেতে হবে।’
স্কুল যেতে হয় সরকারি বাসে চেপে। ড্রাইভারের হাতের ছোঁয়ায় বাসটা কেমন সুপ্তি ভেঙে গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে, দেবরূপের মনে পড়ে যায় পাশের বাড়ির জ্যাঠার গলা ঝাড়ার শব্দ। তারপর গোঁগোঁ থেকে থর্থর্, তা থেকে ঝর্ঝর্, পুনরায় গোঁগোঁ (ভিন্ন সুরে), এবং মাঝে মাঝে ঘোঁৎ ঘোঁৎ - বাস-যাত্রার পুরো ধ্বনিপরম্পরাটা দেবরূপ কণ্ঠে তুলে নেয় হরবোলার মতো। সে ভুলে থাকতে চায় সেই মন্তব্যগুলো, সেই অস্বস্তির আবহাওয়া, যা তাকে ঘিরে তখন জমে উঠেছে। অফিসযাত্রী কেরানিকুল, অসংখ্য কেজো বা অকেজো সরকারি বিভাগের কর্মচারী যাঁরা দেরিতে অফিস যাচ্ছেন অথচ ন্যায়বোধের গরিমায় উজ্জ্বল, অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন এই বালককে নিয়ে। কেউ বলছেন, ‘এইসব স্কুলে গ্রামার শেখায় না’; কেউ বলছেন, ‘মেয়ে টিচাররা ওইখানে প্রপার ড্রেস পরে না’; কেউ বলছেন, ‘ছেলে মেয়ে একসাথে বসলে আর ভালো কী হবে’; এবং যিনি বিদগ্ধতম ব্যক্তি তিনি বলছেন, ‘দেশের ঐতিহ্য না জানলে লম্পট হয়’। বালক এই জটিল পীড়ন ভুলতে মাঝে মাঝে হাঁটু দিয়ে টোকা মারছে বাসের গায়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীরা সর্বস্ব পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তাঁদের ইংরেজিভাষার ঝাঁপি খুলে, এক-কড়ি দু’কড়ি ইংরেজিতে বলছেন তাঁদের একটা কোশ্চেন আছে, স্টেট প্রপার্টিতে লাথি মারা কি সঙ্গত, স্কুলে কি ম্যানার্স শেখায় না, ইত্যাদি।
আজ দেবরূপের কার্নিশ থেকে নামা হল না। সে রুদ্ধশ্বাসে দেখল একটি লোক বেড়ালের মতো গুড়ি মেরে চলে যাচ্ছে তাদের দেয়াল বরাবর, আশ্রয় নিল একটা ইট-বোঝাই ঠেলাগাড়ির নিচে। এই গতি ও স্থিতির মধ্যকার কয়েকটি মাত্র মুহূর্ত অনন্তকাল বলে মনে হল তার কাছে। এইমাত্র সে টের পেল দূরে কোথায় গুম্গুম্ শব্দ হচ্ছে। দূরে নয়, রীতিমতো কাছেই। কাকের ছানাগুলো এক্কেবারে চুপ করে গেছে। ওইতো পানাপুকুরের মধ্যে কিছু একটা পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে বিপুল শব্দে ফাটল; অনেকটা জল ও কিছু জ্বলন্ত কচুরিপানা ঝপাং করে লাফিয়ে উঠল। পাশের গলি দিয়ে অনেকগুলো লোক বেরিয়ে এসেছে, এতোক্ষণ ওদের চটির দ্রুতগামী খরধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। ওদের কয়েকজন খালি-গা, কারও জামার বোতাম খোলা, ওদের মধ্যে একজন চশমা-পরা লোকও আছে। সকলেরই হাতে কিছু-না-কিছু, ধারালো বা ভোঁতা বা বাঁটওয়ালা, একজনের হাতে চটের থলে। বোঝাই যাচ্ছে ওরা ওই গুড়ি-মারা লোকটাকে খুঁজছে – দেখতেও পেল তাকে নিমেষের মধ্যে – একজন বজ্রমুষ্টিতে ওর গোড়ালিটা গিয়ে ধরল, একটা চাপা আর্তনাদ উঠল। চারপাশে তখন অতলান্ত নীরবতা – তারপর কী হল দেবরূপ দেখতে পেল না।
সেদিন গভীর রাতে রাস্তা ধরে বৃষ্টি ছুটে এল প্রবল বেগে। দেবরূপের ঘুম ভেঙে গেল। ফোঁটায় ফোঁটায় ফট্ফট্ শব্দগুলো দূর থেকে জোরালো হতে হতে কেমন এগিয়ে আসছে। যেন অনেকগুলি দুরন্ত যোদ্ধা, তাদের জুতোর ক্ষুরে আওয়াজ তুলে কোনো লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পেছনে মেঘপুঞ্জের মধ্যে চলেছে গুম্গুম্ রণন।
সেই আর্ত বৃদ্ধার হাহাকারে যেমন শঙ্কিত হয়েছিল সে, সেরকম কিছুই হল না এবার। বরং কিছু না বুঝেই বেশ রোমাঞ্চিত হল দেবরূপ। ওই পা টিপে টিপে আসা, অতর্কিত আক্রমণ, এক দল আততায়ী যাদেরকে যোদ্ধা বলে ভ্রম হয় – হিংসার স্বরূপটা ধরা পড়ল না তার মনে। যুদ্ধ বলতে তার কাছে সচিত্র মহাভারতের যুদ্ধ যেখানে অভিমন্যু ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি ঝংকারবহুল নাম; যেখানে বীরের রথ মাটিতে বসে যায়, তাঁর মুকুট খসে পড়ে; যেখানে বাণে বাণে আকাশ ঢেকে যায়; এবং দীর্ঘ যুদ্ধের অবসানে হতাশ্বাস দুর্যোধন ভীমের হুংকারে উঠে আসেন দ্বৈপায়ন হ্রদ থেকে, তাঁর শরীর বেয়ে টপটপ করে পড়ছে জলের ফোঁটা।
কোনো একটি যুদ্ধের কথা সে শুনতেও পাচ্ছে কিছুদিন ধরে। খবরের কাগজে বেরিয়েছে একটি বিকটরূপী যুদ্ধযানের ছবি যার নাম ট্যাঙ্ক। তার মুখ থেকে কামান তাক করা, অনেকগুলো চাকা বেড় দিয়ে একটা বেল্টের মতো; আবার পুরো গাড়িটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে কোনো জলার মধ্যে, সেটা নাকি শত্রুপক্ষের চাতুরী। পাশে দাঁড়িয়ে যে সৈনিকটি, যার টুপি হাতে ধরা আছে, সে আধুনিক রণসাজে সজ্জিত। রোজই রেডিয়োতে শোনা যাচ্ছে একটি মানুষের কণ্ঠ: ‘কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। ... প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম...এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম... জয় বাংলা... ’ - বাবা বলছেন, ওই শোনো যুদ্ধের আহ্বান। ... বাবা বলছেন, ওরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে; একদিন আমরাও এই লড়াই করেছিলাম; ওরাও বাঙালী, ওদের জয় আসন্ন।
পাড়ার দু’প্রান্তে কর্পোরেশনের দুটো প্রাইমারি স্কুল। দুটোই টিনের চালওয়ালা, এক অফিসঘর, বারান্দা ও উঠোন-সম্পন্ন। এক রাতে ঘন ঘন পুলিসের গাড়ি যাতায়াত করতে লাগল, কয়েকবার হুইস্ল বাজল বুক হিম করে দিয়ে। বাড়ির জানালায় ছিল ভেনিশিয়ান খড়খড়ি, তার ফাঁকে চোখ এঁটে দেবরূপ বসে রইল। পরদিন সকালে দেখা গেল রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে একজন হেলমেট-পরা লোক জলবিয়োগ করছে। জ্যেঠিমা রুদ্ধশ্বাসে বললেন, ওই-যে ওই-যে! – লোকটা পেছন ফিরে তাদের বাড়িতে খবরের কাগজ চাইতে এল। বড়োরা সকলেই জানতেন গত রাতে কালীবাড়ি স্কুলে সিআরপি-র ক্যাম্প বসে গেছে। সবাই খুব সাবধান করে দিল। ওরা নাকি পিচাস (পিশাচ), যত্র তত্র হাগে মোতে, আর ছোটো ছেলে দেখলে তুলে নিয়ে যায়। তাকে কুচিকুচি করে কাটে নতুন ব্লেড দিয়ে, তারপর লেবুর রস আর নুন ছিটিয়ে দেয়।
বাইরে বেরোনো বারণ হল। দেবরূপের মন আনচান করে। তার যে নতুন বন্ধু হয়েছে সেদিন। প্রথমে বুব্না, যে একটা খেলনা হাঁস নিয়ে এসেছিল; তারপর ছোট্ট বোনু টিয়া। এদের সে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে। এবং এদের মধ্যেই ব্যক্ত হয়েছে জীবনের প্রথম অঙ্গীকার, ‘কাল আবার আসিস’। কী গভীর আশ্বাস! সেই কথার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র জীবন যেন হাত মেলে দিয়েছে ভবিষ্যকালের দিকে, এমন একটা অনুভূতিতে অভিষিক্ত হয়ে গেছে দেবরূপ।
এই রাস্তা, এই তাদের খেলাঘর, রক্তস্নাত হয়ে ওঠে। ঝর্ঝর্ শব্দে ছড়িয়ে পড়ে ওগুলো কিসের কণিকা? ওগুলো ‘স্প্লিন্টার’। সেই কবে, অন্য কোনো নগরে অন্য এক বিদ্রোহের অবসানে, বাঙালী কবি লিখেছিলেন:
দিন রেখে গেল বোম্বাইয়ে বারুদের গন্ধ
রাস্তায় রক্তের ছিটে —
সেভাবেই দিন থেকে দিনে রক্ত আর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। অমীমাংসিত যুদ্ধের শেষ নেই। খণ্ডযুদ্ধ যখন তখন বেধে যায়। যারা স্টেনগান পাইপগান হাতে ছোটাছুটি করে অনুক্ষণ, তারা কারা? এরা কেউ আদর্শবাদী, কেউ পেশাদার ঘাতকের দল। আর এরা সকলেই নেতৃহীন।
তবে যুদ্ধের বিষয়ে বাবার মতো উৎসাহী আর কেউ নয়। কেউ নয় তাঁর মতো মর্মাহত। কোথা থেকে খবর এসেছে, নিরপরাধ নরনারীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘাতকের দল, একেবারে হাজারে হাজারে – তিনি মর্মান্তিক আবেগে ছারখার হয়ে যাচ্ছেন। ভদ্র মধ্যবিত্ত ঘরে, চমৎকারা অন্নচিন্তার তাগিদে তাড়িত জীবনে, এতোটা আবেগ যেন বিরাট বালাই। প্রতিদিন তিনি হাহাকার করে উঠছেন। পুত্রকে মহাভারতের কথা শোনাতে শোনাতে কখনও তিনি বলছেন, ‘জগন্নাথ হলের ছেলেগুলোর কী হল? এতো বড়ো ঘটনাটা – হায় - ।’ পুত্র ভাবছে, কোথায় এই জগন্নাথ হল? কোনো সিনেমা হল বুঝি। এভাবে একদিন এই গৃহের ওপরই আছড়ে পড়ল একটি খবর। জ্যেঠিমার দুই আত্মীয়কে ময়মনসিংহ থেকে তুলে নিয়ে গেছে ওরা। জীপের পেছনে বেঁধে খেতের ওপর দিয়ে আছড়াতে আছড়াতে টেনে নিয়ে গেছে তাঁদের। তাও কয়েক মাস আগের ঘটনা। এই ভরা বর্ষায় তার সংবাদ কোনো গোপন কুবাক্যের মতো নানা মুখ ঘুরে এসে পৌঁছল।
অচিরেই এক দুপুরে দেবরূপের স্কুলে উদ্ভ্রান্তের মতো উপস্থিত হলেন বাবা। অধ্যক্ষার সঙ্গে দেখা করে বললেন, বাড়িতে দুঃসংবাদ আছে, ছেলেকে নিয়ে যেতে চাই। তাঁকে কিঞ্চিৎ অপেক্ষা করতে বলা হল। তখন পিয়ানো বাজিয়ে মিউজিকের ক্লাস চলছে। লাজুক দেবরূপ এক কোণে দাঁড়িয়ে কোনোরকমে বিড়বিড় করছে। বাধা অমান্য করে দেবরঞ্জন ঢুকে পড়লেন সেই কক্ষে। তাঁর ধুতি পাঞ্জাবি কাদায় লেপটালেপটি। আত্মপ্রত্যয়রিক্ত দুর্বল তাঁর মূর্তি সেখানে বেমানান। তাঁকে দেখে লজ্জায় লুকিয়ে পড়ল দেবরূপ। বাড়ি যেতে যেতে শুনল দুঃসংবাদের কাহিনি। দেবরঞ্জনের দুই পিতৃব্য ও এক উন্মাদ ভ্রাতা রয়ে গেছেন দেশের বাড়িতে। সেখানে লেখা তাঁর চিঠি বিচিত্র ডাকঘরের ছাপ সমেত ফেরত এসেছে। তবে কি তাঁরা আর নেই? এই চিন্তায় তিনি অব্যবস্থিত হয়েছেন। রাস্তায় পড়ে গেছেন আছাড় খেয়ে। সব শুনে বেশ অস্বস্তি হল দেবরূপের। একটা অনুমানের ক্ষীণ সূত্রকে এতোটা গুরুত্ব দেওয়া যথার্থ কিনা প্রশ্ন জাগল। মনে হল কোথাও যেন বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
বল্লভগড়ের অবশ্য কিছু এসে যায় না এইসব ঘটনায়। এই যে হাজার হাজার মানুষ প্রবেশ করছে সীমান্ত পেরিয়ে তারা নিছকই জয়-বাংলার লোক। এইখানে মরতে আইসে। সেখান থেকে সদ্য এসেছে নির্মল সমাদ্দারের শ্যালক। সেদিন রাস্তার ক্রিকেট খেলায় সে তিনবার ক্যাচ মিস করল। সেই নিয়ে হাসাহাসির অন্ত রইল না। সমঝদারেরা কেউ বললেন না, যেমন তাঁরা বলে থাকেন, ‘ব্যাড লাক্’। বরং সেই ছেলেটি খেলা শেষে যখন ফিরে যাচ্ছে মুখ লুকিয়ে তখন উপস্থিত ছেলেবুড়োর মধ্য থেকে কেউ ডেকে উঠল – ‘রাজাকার!’ সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে ধ্বনিত হল একই শব্দ। যে যার মতো গলা বিকৃত করল, কেউ বলল ‘ওর ফেস-কাটিংটারে দ্যাখ্', কেউ বলল, ‘ওর ট্যাক্চারটা (স্ট্রাকচার, শরীরের গড়ন অর্থে) দ্যাখ্সশ্?’ – এবং প্রায় সকলেই ‘মাক্কালী’ (মা কালী) বলে হাততালি দিল। সেই দিন ‘রাজাকার’ শব্দটি তার অর্থ হারিয়ে একটি আধ-গেঁয়ো টিটকিরিতে পরিণত হল।
সেখান দিয়ে ফিরছিল দেবরূপ। সামনে উদ্ভ্রান্ত বাবা। বাপের এক-পোলা হওয়ায় এবং পাড়ার বাইরের স্কুলে পড়তে যাবার যুগল অপরাধে দোষী ছিল সে। তাই নতুন টিটকিরির জন্মক্ষণে তাকে দেখতে পেয়ে বর্ধনদের সাতটি ছেলে, আলোর সপ্তবর্ণের মতো যাদের বিচ্ছুরণ, ইতর সুরে অবিরাম পরম্পরায় সাতবার ডেকে ঊঠল ‘রাজাকার’।
এই অখণ্ডতা ভঙ্গ করে উদিত হলেন পাড়ার ভণ্ডোত্তম ব্যক্তি হিতাংশু মজুমদার। জল সপ্সপ্ শরীরে নামাবলী জড়িয়ে তিনি চলেছেন। কাউকে নজরে পড়লেই আত্মমগ্ন ভাবে হেঁকে উঠছেন, অং বং কাইশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্। এই ব্যক্তিটির সঙ্গে বাক্যালাপ করেন না দেবরঞ্জন। কিন্তু তাঁকে দেখতে পেয়ে হিতাংশু ঢুকে পড়লেন বাড়িতে; গলা তুলে বললেন, ‘ইণ্ডিয়া তো নাইমা পড়সে, শুন্ছেন নাকি?’ দেবরঞ্জন বললেন, ‘না, শুনি নি।’ হিতাংশু বললেন, ‘পেপারে নিশ্চই জানাইব।’ এবং এই সময়ই অনেক গড়িমসির পরে শয্যা ছেড়ে উঠে পড়ছে দেবরূপ।
আজ খুব খুশি দেবরঞ্জন। আয়েসে ধূমপান করবেন বলে একের পর এক দেশলাই কাঠি জ্বালছেন, প্রত্যেকটাই নিভে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে প্রতিদিনকার মতো রেডিয়োতে চলছে সেই ভাষণ – ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো – এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম - ’। রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছে তারা বলাবলি করছে – ‘ওই যে শুরু হইল জয়-বাংলার ভাষণ’। এই ইতর কৌতুকটা এই প্রথম উপভোগ করছেন দেবরঞ্জন। কারণ তিনি যে এইমাত্র বেতার ও সংবাদপত্র মারফত নিঃসংশয় হয়েছেন হিতাংশুর খবরটা এক অর্থে ঠিক। ভারতবর্ষ প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে না নামলেও নৈতিক সমর্থন যুগিয়ে চলছে বাঙালীর সংগ্রামকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য গোপন ব্যবস্থা করেছে ভারতীয় বাহিনী। সেরকম একটি শিবির ঘুরে এসে বিশেষ সংবাদদাতা দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখেছেন। দেবরঞ্জনের মনের মধ্যে যে দংশন চলছিল – ঘরের পাশে এই যে মরণপণ যুদ্ধ, এই যে কোটি কোটি আর্ত ভাইবোন, তার পাশে আমরা এই মহান্ দেশ নিষ্ক্রিয় কেন? – তা কেটে গেছে। মহৎ কর্তব্য সম্পাদনের স্বস্তিতে যেন স্নাত হয়ে উঠেছেন তিনি। অটল হয়েছে তাঁর প্রতিজ্ঞা, স্ফুরিত হচ্ছে অধর; তিনি ভাবছেন, এ-কর্তব্য শুধু ভারত সরকারের নয়, সেনাবাহিনীর নয়, এ-কর্তব্য তোমার আমার সকলের। সেতুবন্ধের কাঠবিড়ালিটার মতো আমিও সামান্য সেবার দান রেখে যাব, আমি তো তার বেশি কিছু নই। এভাবে দীনতার কূলপ্লাবী আবেগে তিনি বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন।
মনের এই অবস্থায় একটা রামায়ণী উপলক্ষ্যও তিনি পেয়ে গেলেন নাগালের মধ্যে। উপেন্দ্রকিশোরী রামায়ণ খুলে দেবরূপ পড়ছিল — ভারি চমৎকার এই পঞ্চবটী বন, নানা রঙে ফুল ফল, দেখে ভরে মন। দুলিয়া সুন্দর পাখি খেলে ডাল ধরি, কুলকুল করি বয় নদী গোদাবরী।
দেবরঞ্জন শুনে বললেন, ‘অরণ্যকাণ্ড, কিন্তু এখানে তো বর্ষার কথাই নেই।’ তখন পাত্রাপাত্রভেদ ভুলে ছয় বছরের বালকের কাছে তিনি বলতে লাগলেন — বর্ষোদকাপ্যায়িত শাদ্বলানি প্রবৃত্তনৃত্যোৎসব বর্হিণানি বনানি নির্বৃষ্ট বলাহকানি পশ্যাপরাহ্ণেষ্বধিকং বিভান্তি। ‘বর্ষার জলে আপ্যায়িত কচিঘাস, বর্হিণ মানে ময়ূর’ – এই অবধি বলে থমকে গেলেন তিনি। আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন বোধ করলেন না; এবং তারপর, ‘ক্বচিৎ প্রকাশং ক্বচিদপ্রকাশং’ থেকে শুরু করে আদিকবির বিচিত্র পঙ্ক্তিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ছেলে কখন কোমরে লেজ লাগিয়ে পবনপুত্রের সাজে বেরিয়ে গেছে সে-খেয়াল তাঁর রইল না।
সেদিন দুপুরের পরে দেবরঞ্জন ‘কোলকাতায় যাচ্ছি’ বলে দ্বিগুণ উৎসাহে বেরিয়ে গেলেন। গন্তব্য শেয়ালদা স্টেশন, যেখানে তিনি প্রায়ই যাচ্ছেন। শরণার্থী ত্রাণের উদ্যোগ তখন গড়ে উঠছে দিকে দিকে। ভারত সেবাশ্রমের স্বামীজী আসেন চাঁদা নিতে; এবারে তিনি তাঁর ঝোলায় চাল ডাল আর আলু নিয়ে গেছেন। দেবরূপের স্কুল থেকেও বলে দিয়েছে, স্কুলের রিলীফ ফাণ্ডে শিক্ষার্থীরা সাধ্যমতো অর্থ ও আহার্য দান করবে। সেই মতো মা তাকে দিয়েছেন এক বোতল হরলিক্স। আজ প্রথম দেবরঞ্জন গিয়ে ফেস্টুনে হাত লাগালেন। তাতে বিজ্ঞাপিত আছে ‘অধ্যাপক সংঘ ত্রাণ প্রচেষ্টা’। তবে এখানে তিনি অনাহূত, কারণ এই আয়োজন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। সেখানে দলীয় স্বার্থের হিসেবনিকেশ আছে, সৎ কর্মের অঙ্গভঙ্গি আছে, কিন্তু সরল মানবপ্রেমের স্থানটা কিঞ্চিৎ অনিশ্চিত। আজ এই দলে দেবরঞ্জন মিশে গেলেন।
শেয়ালদা মেইন ও সাউথ স্টেশনের মধ্যে যে এক টুকরো রাস্তা তার একপাশে চট বিছিয়ে সকলে বসেন। তাঁদের পেছনে রেলিঙে বাঁধা থাকে ফেস্টুন। সব মিলিয়ে জনা চল্লিশ কলেজ শিক্ষক, যাঁদের অনেকেই আর্ত-ত্রাণের উৎসাহে শিক্ষকতার মায়া কাটাতে পেরে খুশি। লেখাপড়া মাথায় ওঠাতে ছাত্রেরাও কেউ কেউ চলে এসেছে। তাদের দেখে এক অধ্যাপক বলছেন, ‘Education can wait, Swaraj cannot.’ তারাও কৃতার্থ হয়ে স্যরদের ফাইফরমাশ খাটছে। সকলের সামনে চাঁদার বাক্স রাখা থাকে। পথচারীদের দক্ষিণা টাপুরটুপুর করে পড়ে। নানা তামাশা জমে ওঠে। জনৈক অমিয়বাবু বলেন, “বলুন তো, ‘প্রণামী বাক্সে রাখিবেন’ ইংরেজি কী?” তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বলেন, “আপনি বলুন তো, ‘জল ফেলিবেন না’ ইংরেজি কী?” এক অধ্যাপক এসে বসেন, তিনি নস্যিতে আসক্ত। যোগী যেমন ভাতকে বলে অন্ন, তিনি তেমনি নস্যিকে বলেন নস্য। তাঁর পেছনে লুকিয়ে আর এক অধ্যাপক খৈনি ডলতে থাকেন – অধ্যাপককুলে বেশ অনন্য চিত্র বটে। বিজাতীয় গন্ধে চমকে উঠে নস্যির পূজারী বলেন, ‘এ উনিশ শতকী অভ্যেস, ভাই – নস্য। তোমার ওটা কী হে?’ খৈনি-সেবী বলেন, ‘আমারটা? আমারটা সাব্অল্টার্ন অভ্যেস।’ এঁদের মাঝখানে উদ্ভাসিত মুখে দেবরঞ্জন বসে থাকেন। শরণার্থী, অথবা দীনবেশী কাউকে, দেখলেই ডাকেন, ‘জ-য় বাংলা!’ তারা বিমূঢ় হয়ে চলে যায়, কেউ কখনও জবাব দেয় না। এই যে প্রতীকটিতে দেবরঞ্জন আশিরনখর শিহরিত, তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত কিনা তাদের মন, এ নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন নন। তাঁর উচ্ছ্বাসকে আদিখ্যেতার মতো লাগে। একবার এক বৃদ্ধ বলে, ‘রাখেন, আর কইয়েন না ওইসব।’
একদিন এদের মধ্যে তিনি খুঁজে পান কমলা আর শিবুকে। সেদিন তাঁর মন বিশেষ দ্রব অবস্থায় ছিল। লক্ষ শরণার্থীর স্রোতে এ-দেশে ঢুকে পড়েছে ওই দম্পতি। প্রথমে মাটি ফুঁড়ে উঠে এল কমলা। কান্নায় আছড়ে পড়ল তামাশায় মশগুল অধ্যাপকদের সামনে। তার মুখের ভাষা দুর্বোধ্য। সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। হঠাৎ দেবরঞ্জনের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। এ যে তাঁর স্বভাষা! মেয়েটি বলছে, ‘হ্যারে হারায়া ফাল্চি।’ কাকে হারিয়ে ফেলেছ? ‘তাইন্ কই গেলাইন্ কী জানি।’ দেবরঞ্জন দোভাষী হয়ে সকলকে বোঝালেন, মেয়েটি বোধহয় তার স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছে না, আর এ কথা বলছে আমাদের ময়মনসিংহের ভাষায়। আবেগে তাঁর কণ্ঠরোধ হয়ে গেল। এরা যে আমার জন্মান্তরের ভাইবোন। - কোত্থেকে আসছ, বুইন (বোন)? তোমার স্বামীর নাম কী? – ‘বাড়ি ন্যাত্রকুনা (নেত্রকোণা)। স্বামীর নাম শিবেন দাস।’ মাইকে নাম ঘোষণার পরে শিবেন দাসকেও পাওয়া গেল। এমন কিছু বিপত্তি ঘটে নি। সে ‘ফাহানাৎ’ (পায়খানায়) গিয়েছিল। সেখানে লম্বা লাইন থাকায় ফিরতে দেরি হয়। - কোথায় গন্তব্য তোমাদের? – ‘আমরা যাইবাম যাদবপুর।’ সেখানে গ্রামসম্পর্কের এক মামা আছে, এক বাড়িতে রান্দে (রাঁধে)।
হয়তো সেদিন, অথবা এরকমই একদিন, বাড়ি ফেরার পথে এক খণ্ডপ্রলয়ের মধ্যে পড়ে গেলেন দেবরঞ্জন। বিধানগড় বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনের পাশে সবুজ মিয়াঁর প্রাচীন পুকুর। এক পাশ ঘিরে পায়ে চলার রাস্তাটা বেঁকে গেছে, তারই একটা বাঁকের মুখে সেই একাকী অশ্বত্থ যার ডালে ভূত আছে। সেই গাছের তলা থেকে স্টেনগানধারী এক যুবক তেড়ে এল তাঁর দিকে। - ‘এদিকে। এদিকে। চোখে চশমা লাগিয়ে দেখতে পাচ্ছেন না অ্যাকশন চলছে?’ তাঁকে সে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল দুটো বাড়ির মাঝখানের সংকীর্ণ প্যাসেজে, আর ঘাড়ে রদ্দা মেরে মাটিতে বসিয়ে দিল। সেই অবস্থা থেকে তিনি শুনলেন প্রচুর গোলাগুলির আওয়াজ, কারও পপাত হবার শব্দ, কাদের চপ্পলের অপসৃয়মাণ ধ্বনি, তারপর নৈঃশব্দ্য।
তিনি গুড়ি মেরে বেরিয়ে এলেন। কে যেন বলল, ‘কাকু, চলে যান। অল ক্লিয়ার। আর ভয় নেই।’
অদূরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সেই যুবক, তার গোড়ালির ওপরের ধমনী রক্তে ভেসে যাচ্ছে। দেবরঞ্জন ব্যাকুল হয়ে ছুটে গেলেন তার কাছে, ‘কিন্তু তোমার কী হবে, ভাই?’
—‘আমার আর কী হবে? আমাকে মামারা নিয়ে যাবে।’ – বলতে বলতে সে বমি করল; তার নিস্তেজ মাথাটা এলিয়ে পড়ল এক পাশে।
সেই সময় ভারি বুটের শব্দ আর তীক্ষ্ণ হুইস্ল শোনা গেল।
শিবু মাঝে মাঝে বেরিয়ে যায় তার মামাকে খুঁজতে; কমলা এক কোণে বসে থাকে বুক চেপে। তার অঙ্গ আতঙ্কে কালো। কিন্তু বুক চাপে কেন দু’হাত দিয়ে? - ‘বুক ভরা দুধ গো।’ – সে কবুল করল জ্যেঠিমার কাছে। তখন জানা গেল তার বেদনার ইতিহাস। রাজাকার বাহিনী অবতরণ করে তাদের গ্রামে। ঘর ছাড়ার সাত দিন আগে তার প্রসব হয়। সীমান্ত পেরোবার হুড়োহুড়িতে শিশুটি খোঁচা খায় কাঁটাতারে। তারপর তার প্রচণ্ড জ্বর ওঠে। দু’দিনে পরে তার শরীর শক্ত হয়ে যায়। কমলা আর শিবু নেমে পড়ে ট্রেন থেকে। স্টেশনের নাম ছিল কাঁচরাপাড়া। সেখানে মৃত শিশুকে সমাধিস্থ করে তারা পৌঁছয় শেয়ালদায়।
কমলা দেখে অবাক যে এ-বাড়ির লোকে তাদের ভাষাতেই কথা বলে। সে খালি বলে, ‘আফ্নেরা তো দেহি আমরার ভাষাই কন।’ তাদের চলে যাবার কোনো তাড়া নেই। শিবু দেশে থাকতে ছিল একজন গাছি। এখানে ঘরে ঘরে নারকেল আর খেজুর গাছ, তার কাজের অভাব হয় না। কমলা এ-বাড়ির ধোয়ামোছা মশলা-বাটার কাজ করে।
দেবরঞ্জনের আবেগ আর ধরে না। যুদ্ধের কারণে পরিকল্পনা-মাফিক নিষ্প্রদীপ করে ফেলা হচ্ছে শহরকে, তার নাম ব্ল্যাকআউট; সেইসব সন্ধ্যায় তিনি শিবুকে নিয়ে বসেন। স্মৃতিবিস্মৃতির ছায়া থেকে তিনি উদ্ধার করেন পুরোনো গ্রামকে, যেন হারানো প্রিয়াকে অন্তরীক্ষ থেকে ফিরিয়ে আনছেন অর্ফিয়ুস। তাঁর কণ্ঠে আনন্দবেদনার যে বাঁশি বাজে তা অতীতের সেই হারানো ভাষার সুরে। পথের বাঁকে সেই নিমগাছটা, অথবা সেই ছাতিম, যা ছিল অকালমৃত এক পূর্বপুরুষের স্মৃতি – ‘আমার ভবনদ্বারে রোপণ করিলে যারে’ – বলতে বলতে তিনি মুহুর্মুহু ভেঙে পড়েন। আবার হাসির দমকে তাঁর কথা হারিয়ে যায় যখন মনে পড়ে বিরাট জামবাটিতে মুড়ি, নাড়ু, কিংবা কাঁঠালের অগণন কোয়ার স্বাদ। বাল্যকালে ‘নাওয়ে কইর্যা’ তাঁরা যেতেন স্কুলে। জলমগ্ন খেতে ধানের ডগাগুলোতে টান দিলেই নৌকো দুলে উঠত; বাড়ির ভৃত্য নগেন হাঁক দিত, ‘আঃ, চুদুর্বুদুর্ করো ক্যারে?’ আর, এই নৌকো কিনতে গিয়েই এক বর্ষায় বিফল হয়েছিলেন তাঁর কাকা, এবং এক গারো ব্যক্তি তাঁকে বলেছিল, ‘যদি ভং যাইতে তবে নাও ফাইতে’। ভং সে-দেশের একটি বাজারের নাম। এখনও আছে কি? গারো পাহাড়ের পাদমূলে আমাদের গ্রামটি ছিল। আমাদের নদীর নাম ছিল কংস। কতোদিনের সেইসব, অথচ “কেমন মন’ অয় যাইন্ হিদুঙ্গা—”, অর্থাৎ, মনে হয় যেন সেদিনকার কথা।
আমাদের এই গ্রামের গলি-’পরে আমের বোলে ভরে আমের বন। ... আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা, — রবীন্দ্রনাথ আসলে পূর্ব-বাংলার কবি, বুঝ্লা?
শিবেন মাঝে মাঝে মশা মারে, এবং অটল মৌনে নিশ্চল হয়ে থাকে। দেবরঞ্জন অবশেষে বর্তমানে পৌঁছন। জানতে চান, ‘বঙ্গবন্ধুরে তোমরার কেমন লাগে?’
এতোক্ষণে মুখ খোলে শিবেন। নির্বিকার গলায় বলে, ‘তাইন্রে আমরা দেহি নাই, কাক্কু। আমরার ঘরসংসার সব গেছে।’
ওই মানুষটিকে ঘিরে দেবরঞ্জনের চোখ মায়াঞ্জনে ঢাকা। বঙ্গবন্ধু তাঁকে এখানে কেউ বলে না, বলে ‘মুজিবর’। একমাত্র দেবরঞ্জন তাঁকে হৃদয়ে ও বাক্যে বঙ্গবন্ধু বলে বরণ করেন। তাই শিবেনের নিরুত্তাপ ভাব তাঁর আশ্চর্য মনে হয়।
ক্রমে ক্রমে কমলার আতঙ্ক কাটল। সেদিন পাড়ার লোকে পুকুরের কচুরিপানা তুলেছে আঁকশি দিয়ে। বেরিয়ে পড়েছে টলটলে জল। তা দেখে প্রায়-বিজাতীয় ভাষায় কমলা গেয়ে উঠল গান। মা-জ্যেঠিরা ছেঁকে ধরলেন তাকে, গান শোনাতে হবে। সে বলল, “এই দ্যাশ’ গান শুনায়া কী হইব?” তার উদাস উক্তির ভাবটা যেন – আমার সংগীত-সরস্বতীকে আমার সর্বস্ব-হারানো গ্লানির ভিতর কোন্ মুখে ডাকব?
ওপারের যুদ্ধ ও এপারের হানাহানিকে ঘিরে কিছু বিভীষিকার কথা আজকাল শোনা যাচ্ছে। যেমন, নিশির ডাক। রাতে কেউ নাম ধরে ডাকলে বাইরে যাবেন না, কারণ তার পরিণাম অজ্ঞাত। আবার অনেকে দেখেছে, নিশুতি রাতে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে এক নারী। তার মাথার চুল ক্রমাগত লম্বা হতে হতে একসময় মাটি ছুঁয়ে ফেলল; সঙ্গে সঙ্গে সে হেসে উঠল পৈশাচিক হাসি। আর, রাতের আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক অলৌকিক শস্ত্রপাণি পুরুষমূর্তি, তার চোখদুটো রক্তিম তারার মতো জ্বলছে নিভছে, এ তো নাকি প্রতিদিন দেখা যায়।
কাজেই দেবরূপের ভয় বাড়ছে। মাঝরাতে তার হিসু পেয়ে যায়। বারান্দার বাইরে পেয়ারাগাছতলা তার হিসু করবার স্থান। কখনও কখনও সে শুনতে পায় বারান্দায় একটা হাঁসফাস শব্দ, আর নারীকণ্ঠের ক্ষীণ গোঙানি। মা ওখান দিয়ে গাছতলায় যেতে বারণ করেন। বাইরের আমগাছে অসংখ্য শুঁয়োপোকা। জিজ্ঞেস করলে মা বলেন, ‘কমলার শুঁয়োপোকা লেগেছে বোধহয়।’
কমলা বাটনা বাটতে বাটতে কলতলায় বমি করল একদিন। তারপর একদিন রাস্তার ড্রেনে। মা জ্যেঠিকে বললেন, ‘কমলার অবস্থা তো বুঝছ। বাচ্চার ঝামেলা কে নেবে, বড়দি?’ জ্যেঠিমা বললেন, ‘তাই তো। ওদের এইভাবে আনাই উচিত হয় নাই।’
মাত্র দু’টি সপ্তাহের প্রচণ্ড যুদ্ধ। একদিন ভোরের কুয়াশা ফাটিয়ে ন’টার ভোঁ বাজল। পাড়ায় ছোটাছুটি। জোরে জোরে রেডিয়ো চলছে। একটি বাঁদরওয়ালা বাঁদরনাচের ডুগডুগি বাজিয়ে পথ ধরে চলে যাচ্ছে। দেবরূপের বাবা কাকারা জোরে জোরে কথা বলছেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শুঁটকি মাছ রান্নার গন্ধে পাড়াটা ভরে গেল। অসময়ের কালীপটকায় বায়ু হিল্লোলিত হল। স্ত্রী ও পুরুষ বাঁদর দুটো দড়ির আগায় নাচতে লাগল। এক বাক্স জয়নগরের মোয়া কিনলেন কাকা। বানর দম্পতির দিকে কয়েকখানা ছুঁড়ে দিলেন।
খবরের কাগজ এসেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনাবাবু পড়ে শোনাচ্ছেন। পাগড়ি-বাঁধা এক সামরিক অফিসারের পাশে আর এক সামরিক অফিসারের ছবি। দ্বিতীয় অফিসারটি কিছু লিখছেন। তার আগের দিন জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন লেফটেনান্ট জেনারেল নিয়াজি। তিরানব্বই হাজার যুদ্ধবন্দী ভারতের হাতে। পাকিস্তান পরাজিত। নবীন বাংলার জন্ম আসন্নপ্রায়। এবারে বিপুল জয়ধ্বনি উঠল।
এর ক’দিন পরেই দেখা গেল শিবু জিনিসপত্র বাঁধাছাদা করছে। যাকে দেখছে তারই পায়ের ধুলো নিয়ে বলছে, ‘যাইবাম গিয়া। আর বালা (ভালো) লাগে না।’ সে নাকি খবর পেয়েছে তার সেই গ্রামসম্পর্কীয় মামা আছেন রানাঘাটে, সেখানে তার দেশের আরও অনেক ঘর আছে। তারা প্রথমে যাবে সেই কলোনিতে। তারপর সেখানে পোষাক আর নাই পোষাক, কমলার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার আগে তাদের ফিরতেই হবে স্বগ্রামে। নবীন জাতক চোখ মেলবে সেই মাটিতে।
(পরবাস-৫৪, জুন ২০১৩)