'চমৎকার!' — বলে চোখ বুজেছিলেন তিনি।
মনে হয় খানিকক্ষণ আগেই।
এইখানে।
এইভাবে।
সামনেই ছিল দীপ্ত চাঁদ।
যেন টগবগিয়ে ছুটে চলেছিল অগুণতি মেঘের অরণ্যে।
পৃথিবীর সব গল্প কি এভাবেই ভেসে যায় মেঘাবিষ্ট হয়ে?
নিজস্ব চাঁদের দিকে?
তাঁরই সামনে দিয়ে?
অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিলাম এ সমস্ত অবান্তর কথা।
কতক্ষণ ধরে কে জানে।
হয়তো কয়েক মুহূর্ত।
কিংবা সারারাত।
ঠিক তখনই টের পেলাম আমার বাঁ কাঁধটায় যেন হঠাৎ ভারভার লাগছে।
'লেখো....লিখে যাও....' কথাগুলো ভেসে এলো আমার বাঁদিক থেকেই।
তখনই বুঝলাম আমার কাঁধে—হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত আমারই কাঁধে এসে বসলেন ওই অদূরের ধর্মমতি শুক।
'এই শবই তোমার স্বামী। আমি ধর্মসাক্ষী করে এই শবের সঙ্গে তোমার বিবাহ দিলাম' — বলেছিলেন ধনেশ্বর।ধনেশ্বরের কথাগুলি ভাসছিল মধ্যরাত্রের অন্ধকারে অরণ্যের প্রতিটি পত্রশীর্ষে। আর কাজলরেখার সামনে ছিল সর্বাঙ্গে সূচবিদ্ধ সেই যুবাটির দেহ। এবং সেটি ঢেকে ছিল একটিমাত্র প্রদীপের যথাসাধ্য আলোয় ও অন্ধকারে। যদিও কাজলরেখার দৃষ্টি তখন অশ্রুভারে অস্পষ্ট। আর ধনেশ্বর কন্যা নির্বাসন দিয়ে সেই সময় পৌঁছে গেলেন অরণ্যের প্রান্তসীমায়।
অন্ধকারে অশ্রুমতী কাজলরেখা তখন স্থির বসেছিল নিশ্চল পাথরের মতো নির্জন মন্দিরকক্ষে।
যদিও সময় স্থির ছিল না। তাই সামান্য প্রদীপের ক্ষমতা নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল যথাকালে। তখন সেই যুবাপুরুষ ও কাজলরেখা ঢেকে গিয়েছিল একান্ত অন্ধকারে।
কিন্তু সাময়িকভাবে। কারণ খানিক বাদেই মন্দিরের দরজা খুলে গিয়েছিল। প্রবেশ করেছিলেন এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী। দিনের প্রথম আলোয়।
— এই পর্যন্ত বলেই থামলাম। ধর্মমতি শুক বললেন— 'বেশ। তারপর?'
বললাম —এটা প্রথম পরিচ্ছেদ শোনালাম। যদিও 'পরিচ্ছেদ' কথাটাই চালু, আমি এটা ব্যবহার করতে চাই না। বরং বলছি 'প্রথম আভাষ'। এরপর তাই 'দ্বিতীয় আভাষ'।
দ্বিতীয় আভাষ শুরু হচ্ছে এইভাবে—
'মা, আপনার শেষ সময় আগত। তাই মৃত্যুকালে আপনার এই মৃত সন্তানের ভবিতব্যটি জেনে যান'—সাধু হীরালালের মুমূর্ষু স্ত্রীর মাথার পাশে এসে কথাগুলি বললেন সেই আশ্চর্য সন্ন্যাসী।'আপনার স্বামীর পাপেই এই মৃত সন্তানের জন্ম হল। কিন্তু আপনি নিষ্পাপ। তাই আপনার সন্তান প্রাণ ফিরে পাবে নিশ্চয়ই।'
সন্ন্যাসীর কথায় সেই মৃতপ্রায় মাতা অতিকষ্টে চোখ খুললেন।
'আমি এই শিশুটির দেহে একশোটি মন্ত্রপূত সূচ বিদ্ধ করে দিলাম। এগুলি তার পিতার কৃতপাপের চিহ্নমাত্র।' সন্ন্যাসী একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন—'দক্ষিণাঞ্চলের গভীর অরণ্যে একটি মন্দির নির্মাণ করে সেখানে রেখে আসতে হবে এই সূচবিদ্ধ শিশুটিকে। কেউ থাকবে না সেখানে। ওই মন্ত্রপূত সূচের গুণে শিশুটি মৃত হয়েও ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে এবং একদিন নবযুবায় পরিণত হবে। কিন্তু তার দেহে কোনো প্রাণের চিহ্ন থাকবে না। যদি কোনোদিন কোনো নিষ্পাপ রমণী ....' সন্ন্যাসীর কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্তিম অন্ধকারে ঢেকে গেল হীরালালের মরণাপন্ন স্ত্রীর দৃষ্টিপথ। সন্ন্যাসীও নিষ্ক্রান্ত হলেন অজ্ঞাত অন্ধকারে।
—আবার থামলাম ইচ্ছে করেই। দেখি কী বলেন ধর্মমতি শুক। দেখলাম তিনি আগের মতোই চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলেন—'বলে যাও —বলে যাও—'
বললাম শুরু করছি তৃতীয় আভাষ—
এক ভয়ঙ্কর স্বপ্নে প্রায়শই ঘুম ভেঙে যায় ধনেশ্বরের। সেই স্বপ্নে সে দেখতে পায় এক প্রায়ান্ধকার মন্দিরের কক্ষে সে বসে আছে। মন্দিরকক্ষের সব দরজা বন্ধ। মন্দিরের ভিতরে কোনো বিগ্রহ নেই। কিন্তু একটি বেদী আছে। সেই বেদীটির সামনে ছোট্ট একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। তার সামান্য আলোয় দেখা যায় ওই বেদীর উপর শয়ান এক কুমারীর দেহ। নিস্পন্দ। এবং সারা গায়ে সূচবিদ্ধ। ধনেশ্বর সন্তর্পণে এগিয়ে যায় সেদিকে। সূচবিদ্ধ দেহটি হঠাৎ উঠে বসে এবং সোজা এগিয়ে আসে ধনেশ্বরের দিকে। এবং বলতে থাকে—'নিতে এসেছো? আমায় নিতে এসেছো? আমি কিন্তু কোথাও যাব না। কোত্থাও না। কোত্থাও না।' প্রবল আতঙ্কিত হয়ে ধনেশ্বর পিছিয়ে আসে এবং বুঝতে পারে এ তারই কন্যা কাজলরেখা! আর তখনই ঘুম ভেঙে যায় ধনেশ্বরের।জীবনের শেষার্ধে প্রভূত সম্পদ, সম্মান এবং প্রায়শই এই দুঃস্বপ্ন নিয়ে বেঁচেছিলেন ধনেশ্বর।'
এই পর্যন্ত বলার মাঝেই পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল—'তাই নাকি?' ঘুরে দেখলাম মধ্যরাতের জ্যোৎস্নার তলায় এক দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ।
—'আমি ধনেশ্বর। তুমিই বুঝি কাহিনীকার?' কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই ধনেশ্বর বলে উঠলেন—'এত মিথ্যা কথা কেন?' আমি উত্তর দেওয়ার আগেই ধর্মমতি শুক বলে উঠলেন—'মিথ্যা নয়। রচয়িত।'
ধনেশ্বর উত্তর দিলেন—'রচয়িত? তাহলে বাস্তব বলে কিছু নেই?'
ধর্মমতি শুক বললেন—'অবশ্যই আছে।'
—'সেই বাস্তবটা আমি সবাইকে জানাতে চাই।'
—'নিশ্চয়ই। অবশ্য বলুন।'
ধনেশ্বর বলতে শুরু করলেন— 'এক মৃতের সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে আমার একমাত্র কন্যার— এই কথা ভেবে রাতে ঘুম হত না আমার। কিন্তু আমি ধর্মবিশ্বাসী ছিলাম। তাই মন শক্ত করে রওনা দিয়েছিলাম গভীর অরণ্যের পথে।' এই পর্যন্ত বলে ধনেশ্বর একটু থামলেন। তারপর যেন এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন— 'শেষ পর্যন্ত যখন পৌঁছলাম মন্দিরটির সামনে তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। মন্দিরে ঢুকলাম মেয়েকে নিয়ে। বিস্তর পথ হেঁটে ক্লান্ত মেয়ে আমায় বলল, একটু খাওয়ার জল আনতে। আর সেটাই ছিল নিয়তির বিধান। তাই আমি জল আনতে যাওয়ার জন্য বাইরে যেতেই মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল আপনা থেকেই। এই ধরনের কিছু ঘটতে পারে ভেবেই মনকে শক্ত করে রেখেছিলাম।
বন্ধ মন্দিরের ভিতর থেকে ভেসে এলো মেয়ের সেই ভয়ঙ্কর আর্তনাদ—'বাবা!! বাবা! আমার সামনে একটা মরা ছেলে!' সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল সন্ন্যাসীর কথাগুলো, তাই তখনই চিৎকার করে বললাম —'এই মৃত কুমারই তোমার স্বামী। আমি ধর্মসাক্ষী করে এই মৃতকুমারের সঙ্গে তোমার বিবাহ দিলাম।' প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থের মতো হাঁফাতে লাগলেন ধনেশ্বর। তারপরই অদ্ভুত ধরা গলায় বলতে আরম্ভ করলেন—'উচিত কাজ করলাম। অবশ্যই উচিত কাজ করলাম। কারণ সেদিন আমার সর্বস্ব হারিয়েছে। নিজেরই দোষে। এককালে ছিল হাতিশালে হাতি। ঘোড়াশালে ঘোড়া। সিন্দুকভর্তি মণিমানিক্য। একে একে সব হারালাম। সবই ওই জুয়ার নেশায়। তাই শেষপর্যন্ত একমাত্র পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে রাস্তায় নামতে হল। মেয়ে আমার ছিল পরমা সুন্দরী। তখন সে সদ্যযুবতী। আমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে কুলোকের অভাব ছিল না তার আশেপাশে। আমি তাকাতে পারতাম না ওর মুখের দিকে।' একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন ধনেশ্বর—'সন্ন্যাসীর কথা মতো সেইদিন সকালবেলায় ওকে নিয়ে রওনা হয়েছিলাম গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। ও সমানে বলে যাচ্ছিল—'কোথায় নিয়ে যাচ্ছ বাবা?' তাকে তখন সত্যি কথাটা বলার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। মাথা নীচু করে ঘরে ফিরে এসেছিলাম ভোর রাতে। 'তারপর?'—বলে হঠাৎ চুপ করে গেলেন তিনি। ধর্মমতি শুক জিজ্ঞাসা করলেন—'কী হল, তারপর?'
ধনেশ্বর অদ্ভুতভাবে ধর্মমতি শুকের দিকে তাকিয়ে বললেন—'তারপর? তারপর সন্ন্যাসীর কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল।'
কপাল ফিরল আমার। আবার বাণিজ্যে সোনা ফলল। আবার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, সিন্দুক ভর্তি মণিমানিক্য। সবকিছু আবার আগের মতো। কেবল আমার মেয়েটা....' বলে আবার কথার যেন খেই হারিয়ে ফেললেন তিনি। তারপর হঠাৎ মাটিতে বসে পড়ে মাথা নীচু করে পরম যত্নে হাত বোলাতে লাগলেন সামনের আধো অন্ধকার মাটিতে—আর নিজের মনেই বলতে থাকলেন—'তারপর সারাজীবন ধরে তোকে আমি খুঁজে বেড়িয়েছি সর্বত্র—শুধু এই কথাটুকু বলার জন্য—ওরে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম তোর দুর্ভাগ্য কাটানোর জন্য—রেখে এসেছিলাম ওই ভাঙা মন্দিরে—সূচ রাজকুমারের কাছে—রাজরানী হবি বলে—সন্ন্যাসীর কথামতো। আমি জানি সন্ন্যাসীর অন্যসব কথার মতো একথাটাও ফলেছিল। তুই রাজরানী হয়েছিলি। সূচরাজার রানী। তোর সঙ্গে আমার আর দেখা হল না কোনোদিন, কিন্তু তুই তো সুখী হলি। তাই আমার কোনো দুঃখ নেই। কোনো পাপ নেই। তাই না বল? তাই না?'
বলতে বলতে অন্ধকার ভূমিকণা থেকে মুখ তুলে দূর আকাশের কোন নির্দোষ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন ধনেশ্বর তা কে জানে! মনে হোলো ঘটনা ও রটনার কি আশ্চর্য অমিল! জীবনের অন্যতম ধর্ম কি শুধুই রহস্য? নাকি উপরের ভাসমান চন্দ্রমুখীন মেঘের মতো সর্বদাই চলেছে তার সহজ রূপান্তর? সম্বিৎ ফিরে এলো ধর্মমতি শুকের কণ্ঠস্বরে—চুপ করে আছো কেন? আবার পড়তে শুরু করো—
থতমত খেয়ে আবার পড়তে শুরু করলাম—এবার 'চতুর্থ আভাষ'।
জ্ঞান হওয়ার পর চোখ মেলে তাকাতেই তিনি দেখতে পেলেন এক মোহিনী মুখশ্রী। শুনতে পেলেন এক মায়াময় কণ্ঠস্বর 'কেমন বোধ করছেন? কেমন বোধ করছেন কুমার?' তিনি মোহিত হলেন এই কমনীয় সান্নিধ্যে। সামান্য সময়ের ব্যবধানেই তাঁদের স্বাভাবিক দূরত্ব ঘুচে গেল। তাঁরা অধরোষ্ঠে মিলিত হলেন প্রত্যূষের কুসুমিত আলোয়। এইভাবেই এই আশ্চর্য সম্পর্কের সূচনা। তারপর থেকেই তিনি দ্রুত মগ্ন হলেন ওই কলাবতী নারীর গহনে।
কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কে যেন গম্ভীর স্বরে বলে উঠল—'আশ্চর্য স্পর্ধা'। দেখলাম সামনেই দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘদেহী যুবাপুরুষ। 'আমার কিছু বলার আছে!' গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি। 'বেশ তো, বলুন'—অতি শীতল কণ্ঠে বললেন ধর্মমতি শুক।
'তার সঙ্গসুখে মগ্ন হয়ে আমি পরবর্তী জীবন কাটাইনি। যদিও জ্ঞান হওয়ার খানিকপরেই ওর সাথে আমি মিলিত হয়েছিলাম এক ঘোরের মধ্যে।' আমি বলতে যাচ্ছিলাম—'সে কি? ঘোরের মধ্যে?' কিন্তু আমার বলার আগেই তিনি বলতে শুরু করলেন—'অজ্ঞান অন্ধকারে কতকাল যে তলিয়েছিলাম কে জানে। জ্ঞান আসার পর দেখলাম এক রমণীর মুখ—আমার মুখের খুব কাছে কিন্তু যেন কতদূর থেকে বলছে—'কেমন আছেন কুমার?' তারপর স্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম—
—'আপনি এখানে মৃত অবস্থায় পড়েছিলেন...।'
—'আপনার সারা দেহ ছিল সূচবিদ্ধ...।'
—'আমি এক সন্ন্যাসীর নির্দেশে এখানে এসেছি....।'
—'সাতদিন উপবাসী থেকে আপনাকে সূচমুক্ত করেছি সন্ন্যাসীর কথামতো।'
—'আর এখনই দৃষ্টি দিলাম আপনার স্থির চোখ দুটিতে....।'
—'আর প্রাণ দিলাম আপনার মৃতদেহে...।'
—'আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী কঙ্কনরানী....।'
—'এইবার উঠুন জাগ্রত হন....।'
—'আমার সর্বস্ব অধিকার করুন কুমার...।'
'এইভাবে আমি এক গভীর অন্ধকার থেকে জেগে উঠেই ডুবে গেলাম আরেক অন্ধকার অদৃষ্টে।'
এইপর্যন্ত বলেই চুপ করে গেলেন সেই সৌম্যদর্শন দীর্ঘদেহী। ধর্মমতি শুক চোখ বন্ধ করেই বললেন—'তারপর?' তিনি উত্তর দিলেন—'ঘোর ভাঙতেই দেখলাম আমার সদ্য উপগতা নারীর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এক অপরূপা। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে সে বলল—'ওর নাম কাজলরেখা। আমার দাসী।' আমি দেখলাম। আর সেই মুহূর্তেই শুরু হল আমার আরেক ভাগ্যচক্র।
কেন জানি না, মনে হল এক্ষুণি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির মধ্যে কোনো গভীর রহস্য আছে। কয়েকদিন বাদেই নিশ্চিত হলাম যে, কাজলরেখা কখনও দাসী হতে পারে না। কি অগাধ রূপ তার! কি অপূর্ব দেহের ভঙ্গিমা। আমার সমস্ত মনপ্রাণ তাকেই নিবেদন করলাম। অবশ্য সবই তার অজান্তে।'
ধর্মমতি শুক হঠাৎ বলে উঠলেন—'সংক্ষেপে বলো। সংক্ষেপে বলো।'
তিনি বলতে শুরু করলেন—'আর কঙ্কনরানী? রানী হওয়ার কোনো যোগ্যতাই তো তার নেই। মিথ্যেবাসী! কুচক্রী। আমি অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম তার ব্যবহারে। তার নষ্টামি থেকে মুক্তি পেতে পালিয়ে গেলাম রাজ্যপাট ছেড়ে বহুদূরে। কিন্তু থাকতে পারলাম না। ফিরে এলাম কাজলরেখার জন্য—অথচ তাকেও ধরে রাখতে পারলাম না ওই ষড়যন্ত্রী কঙ্কনরানীর ফাঁদে পড়ে। কাজলরেখাকে চলে যেতে হল বহুদূরে'—এই অবধি বলে তিনি থামলেন। ধর্মমতি শুকও কোনও উত্তর করলেন না। অর্থাৎ এক আশ্চর্য নীরবতায় ঢেকে গেল চারদিক। সেই নীরবতার উপর যেন পূর্ণিমার আকাশ থেকে বিপুল জ্যোৎস্না চূর্ণ হয়ে পড়ছিল ক্রমাগত। এই অপরিমিত চন্দ্রিল স্তব্ধতা ছিন্ন হল তাঁর বিষণ্ণ কণ্ঠে—'এর কতকাল বাদে আবার সন্ধান পেলাম তার—কিন্তু কি ভয়ঙ্কর অবস্থায়। তোমার জন্য—শুধু তোমার কারসাজিতে।' ধর্মমতি শুক হঠাৎ চোখ খুলে সেই দীর্ঘদেহীর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন—'তাই নাকি? কিন্তু তারপর?' দীর্ঘদেহী বললেন,—'তারপর? মানে?' ধর্মমতি শুক একইভাবে তাকিয়ে উত্তর দিলেন—'তারপর আর কিছুই মনে পড়ে না—তাই না—সূচ মহারাজ?' কোনও উত্তর এল না। কেবল পাতা খসার অপর্যাপ্ত শব্দ ছাড়া। সামনেও আর সেই দীর্ঘদেহী সূচরাজাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম—'কী হল? কোথায় গেলেন সূচ রাজা?' ধর্মমতি শুক চোখ খুলেই আবার বন্ধ করলেন। এবং বললেন—'ফিরে গেছেন। নিজের জগতে।' বললাম—'কোথায়?' উত্তর দিলেন —'কাছেই। সত্যের থেকে সামান্য দূরে। যাকগে। তুমি পড়ো। পরের পরিচ্ছেদটা—না-না, 'আভাষটা' পড়ো।' হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম ধর্মমতি শুকের কথায়। তারপর পড়তে শুরু করলাম শুকের কথায়—
একি! একি! জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এই কথাটুকুই বলতে পেরেছিল কঙ্কনদাসী। তারপরেই মাটির তলায় ঢাকা পড়ে গেল সেই বিশ্বাসঘাতিকার দেহ।তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সূচরাজা বললেন—'এইবার আমরা...।'
হঠাৎ এক তীব্র আর্তনাদে পড়া থামিয়ে চমকে তাকালাম পিছনের দিকে। ধর্মমতি শুকও ডানা ঝাপটিয়ে উঠে বসলেন একটু উঁচুতে—আরেকটি গাছের ডালে—হয়তো চাঁদের আরেকটু কাছাকাছি—
সেই চাঁদের আলোয় দেখতে পেলাম—পাথরের মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক রমণী—যার মুখের প্রতিটি রেখায় অসংখ্য বিষাদবিন্দু ওই চন্দ্রাতপে স্থির।
ধর্মমতি শুক খুব আস্তে করে আমায় বলে উঠলেন—'ইনি কঙ্কনদাসী।'
আমি কিছু বলার আগেই সেই বিষণ্ণ নারী উত্তর দিলেন—'আমি কঙ্কনরাণী। সূচ রাজার কঙ্কনরানী।'
'বেশ তবে তাই। কিছু বলবেন কঙ্কনরানী?' অত্যন্ত কোমল স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন ধর্মমতি শুক।
'হ্যাঁ বলব। সব বলব।'—সেই রিক্ত স্বর উত্তর দিল—'তাঁকে দেখামাত্রই বড়ো মায়া হয়েছিল আমার—কি সুন্দর মুখ—কি সুন্দর চেহারা—কিন্তু কি ভয়ঙ্কর শীতল—আর চোখ দু'টিতে কোন নিষ্ঠুর বিঁধিয়ে দিয়েছে দুটি তীক্ষ্ণ সূচ। আমি অতি সন্তর্পণে সেই সূচ দুটি বের করে আনলাম। তারপর সেই ওষুধটি লাগিয়ে দিলাম তাঁর চোখে। প্রাণ এলো তাঁর শরীরে। চোখ মেললেন তিনি। আশ্চর্যভাবে তাকালেন আমার দিকে। তখনই মনে হল—উনি একান্তভাবেই আমার। তাই আমার সর্বস্ব দিলাম তাঁকে। সহজেই। প্রাণ থেকে ভালবেসে। তারপরেই আমি হয়ে গেলাম কঙ্কনরানী।' একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন—'কিন্তু আমি যে তাঁর রানী হওয়ার অযোগ্য, পাশে থাকার অযোগ্য—তা বুঝতে পারলাম কদিন বাদেই।' বলতে বলতে তাঁর দু'চোখ বেয়ে ঝরতে লাগল জ্যোৎস্নাসামান্য জলের ধারা। 'তাই প্রতিনিয়ত আমার পরীক্ষা আর হেনস্থা। গরিব ঘরের মেয়ে আমি। আমায় রাঁধতে বলা হল। যা সব তাতো চোখেই দেখিনি আমি। ঘর সাজাতে বলা হল, যা দিয়ে তার কিছু কি জানি আমি! কাজলরেখা জানত। আমার চোখের সামনে কত সুন্দর করে আলপনা দিত। কত রকমের রান্না রেঁধে আনত। আমি তো ভিখারীর মেয়ে। যা পারতাম তাই করতাম। আমার যা বিদ্যেবুদ্ধি। আর তাই নিয়ে কত হাসাহাসি। কত অপমান। তাও মন সহ্য করেছি মুখ বুজে।'
'আমার সামনেই তিনি কাজলরেখার কত প্রশংসা করতেন—তার রূপের—গুণের—ব্যবহারের। এমনকি যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হতেন যখন-তখন—বলতে বলতে নিঃশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়লেন কঙ্কনরানী।
এরপর আবার চুপ করে গেলেন তিনি। ধর্মমতি শুকও চুপ করেই রইলেন। তখন এই নীরব জ্যোৎস্নাসর্বস্ব মুহূর্তগুলি বড় দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে উনিই খুব আস্তে করে আবার বলতে শুরু করলেন—'জানি-জানি—আমি পাপ করেছি—ঠকিয়েছি কাজলরেখাকে। কিন্তু কেন? কেন করেছি এইসব? অতি গরিব ঘরের মেয়ে আমি। পেটের দায়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়েছিল আমার বাবা। গভীর জঙ্গলে ভোর রাতে দেখা হল কাজলরেখার সঙ্গে। সেই বিরাট দীঘিটার সামনে। কাজলরেখাকে বড়ো ঘরের মেয়ে বুঝতে পেরেই বাবা জোর করে আমায় বেচে দিলেন কাজলরেখার হাতে। একটি মাত্র সোনার কঙ্কনের বিনিময়ে আজীবনের দাসী হিসেবে আমি বিক্রি হয়ে গেলাম। আমারই বয়সী আমারই মতো একটি মেয়ের কাছে। শুধু গরিব বলে, অক্ষম বলে। সেই মুহূর্তেই ঠিক করলাম—এর শোধ নেব আমি। যেমন করেই হোক। আর সুযোগও এসে গেল সাথেসাথেই। কাজলরেখাই বলল—মন্দিরের কোথায় শোয়ানো আছে সেই মৃত যুবার দেহ—কীভাবে কাজলরেখা রাত জেগে একটি একটি করে তুলেছে সবকটি সূচ—কেবল চোখের দুটি বাদ রেখে। আমার হাতে দুটি পাতা দিয়ে সে বলেছিল যে—চোখের সূচদুটি বের করে সেখানে ওই পাতার রস লাগালেই তিনি প্রাণ ফিরে পাবেন। এই জন্য যেন ওই পাতার নির্যাসটা তৈরি করে রাখি। স্নান করে শুদ্ধ হয়ে এসেই কাজলরেখা এই কাজটি করবে। কিন্তু সেটি আর ঘটল না। কারণ সেটি আমিই করলাম। তিনি প্রাণ ফিরে পেলেন। এরপরেই আমার সবকিছুই দিলাম তাঁকে। আমার পরিচয় দিলাম কঙ্কনরানী বলে। আর কাজলরেখা ফিরে এলে নির্দ্বিধায় বললাম—'মহারাজা ও আমার দাসী—কঙ্কনদাসী।' কাজলরেখা কোনও প্রতিবাদ করল না। কিন্তু কেন, তা আমি জানি না আজও। মনে হয় এটাই ছিল তার ধরন। বড়ো এই ভয়ঙ্কর এই ধরন। এই মুখ বুজে সহ্য করে যাওয়া। আমার মনে হত দেখি আর কত সহ্য করতে পারে। ও সহ্য করল সব। কিন্তু আমার সূচ রাজাই পালিয়ে গেলেন। রাজ্যপাট ছেড়ে। বহুদূরে। অবশ্যই আমার জন্য।
'তখনই আমি ঠিক করলাম এবার চরম প্রতিশোধ নেব। সূচরাজার সদাগর বন্ধুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করলাম। তিনি তো যে কোনও উপায়ে কাজলরেখাকে পেতে সর্বদাই রাজি। প্রতিদিন কাজলরেখার ঘরে সদাগর বন্ধুকে পাঠাতাম। আর মনেপ্রাণে চাইতাম এইবার একটা কেলেঙ্কারি হোক। এর কিছুদিন বাদে সূচরাজা ফিরে এলেন। ওই কাজলরেখার জন্য। আমারই ষড়যন্ত্রে দু'জনেই ধরা পড়ল একরাতে। দু'জনকেই নির্বাসন দিলেন তিনি। আমার ঘাড় থেকে পাপ নামল।'—এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেলেন তিনি।
ধর্মমতি শুক মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করলেন—'তারপর?'
'তারপর? তারপর অনেকদিন কাটল—অনেক বছর কাটল—আমার সূচরাজার সঙ্গে'—এই কথা বলে আবার চুপ করে গেলেন সেই বিষণ্ণ নারী।
'আর কিছু বলবেন কঙ্কনরানী?' যেন খুব সাবধানে প্রশ্ন করলেন ধর্মমতি শুক।
'না?'— বলে আবার বললেন তিনি—'একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?'
'বলুন'—উত্তর দিলেন ধর্মমতি শুক।
'আচ্ছা—ওটা কি দুর্ঘটনা ছিল? না ষড়যন্ত্র?'—বলে খুব আস্তে করে যেন নিজেকেই বলতে লাগলেন তিনি—
'আমার অনেক দোষ ছিল—অনেক পাপ ছিল আমি জানি—কিন্তু ওনাকে তো আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম—ভালোবাসতাম—কোনোদিন ভাবতেও পারিনি যে ওনাকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকব—উনি আমাকে বরাবরের জন্য ওঁর জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চাইবেন তাও কি হয়? কিন্তু কি যে হল বুঝতেই পারলাম না—যদি জানতাম এই ঘটনা ঘটবে—তাহলে কখনওই যেতাম না ওখানে। স্পষ্ট মনে পড়ে—সেই সন্ধ্যার কথা—উনি এলেন—আমায় বললেন—'চলো—আমার সঙ্গে চলো।' আমি বললাম, 'কোথায়?' উনি বললেন— 'আমাদের পালাতে হবে ওই গুহার মধ্য দিয়ে—এসো—চলো' —আমি বললাম—'দাঁড়ান আমার গহনাগুলি নিয়ে আসি'—উনি বললেন—'তাড়াতাড়ি করো।' শুধু সেই গহনাগুলি যেগুলি আমার বড়ো প্রিয়— সেগুলিকে একটা কাপড়ে মুড়ে এসে হাজির হলাম ওনার সামনে। উনি বললেন—'এগিয়ে চলো—আমি তোমার পিছনেই আছি।' 'তারপর'—বলেই চুপ করে গেলেন তিনি। ধর্মমতি শুক জিজ্ঞাসা করলেন—'তারপর? তারপর কী হল বলুন?' আরও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি উত্তর দিলেন—'তারপর সবকিছু ঘন অন্ধকার হয়ে গেল। বরাবরের মতো।'
এই বলে আবার নিশ্চুপ হলেন সেই বিষাদময়ী। একটু পরে নিজেই সেই নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন—'সেই থেকে ওই অন্ধকার নিয়েই আমি আছি—জানো ওই অন্ধকারে থেকেই আমি ভাবি—আমি তো আছি—সর্বদাই আছি—ওনার খুব কাছেই—যেমন এখন—ওনার পিছু পিছুই তো এসেছি—কেউ জানে না— অন্ধকারে একাকার হয়ে'—এই কথার সাথে সাথে চারদিকে কেমন আঁধার হয়ে এলো—দূরের ওই পূর্ণ চাঁদ ঢেকে গেল কালো মেঘে—ধর্মমতি শুক যেন মিলিয়ে গেলেন ওই আবছায়ায়—দমকা হাওয়ায় আমার খাতার পাতা সশব্দে আছড়ে পড়ল। তাহলে?— তাহলে কী হবে? কীভাবে পড়ব আমার পরবর্তী আভাষ? ভাবতে ভাবতেই আবার চাঁদের আলোয় ভেসে গেল চারদিক। দেখলাম সামনেই ধর্মমতি শুক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। 'কী হল পড়ো—পড়ো এর পরের আভাষ—'
'হ্যাঁ হ্যাঁ পরবর্তী আভাষ— সদাগরের কথা—এই তো ষষ্ঠ আভাষ—নাতো এতো অষ্টম আভাষ— আসলে একটু আগে সব এলোমেলো হয়ে গেলো অন্ধকারে—'
'আরে দূর! ষষ্ঠ আভাষ—না অষ্টম আভাষ! বাদ দাও। বাদ দাও। পড়ে ফেলো।হাতের কাছে যা পাচ্ছো পড়ে ফেলো— রাত শেষ হয়ে এলো'—খুব বিরক্ত হয়ে বললেন ধর্মমতি শুক।
পড়তে শুরু করলাম—
এতক্ষণ বাদে বজরা আবার দুলে উঠল। বাতাসে ফুলে উঠল বজরার পাল। একের পর এক জলের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল বজরার গায়ে। বজরা আবার চলতে শুরু করল চমৎকারভাবে।আর ঠিক তখন সূর্যাস্তের আলোয় রূপবান মেঘের নীচে পড়ে রইল এক পরিত্যক্তা অভাগিনী। একটু আগেই যাকে মাঝি মাল্লারা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বজরা থেকে নদীর শুকনো চরে।
'ডাইনী! ডাইনী! ওকে এখনই ছুঁড়ে ফেলে দাও ওই চরে'—একটু আগেই চিৎকার করে বলেছিল ওরা। এরপর সত্যিই মাঝিমাল্লারা মিলে মেয়েটিকে বজরা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সামনের চরে। এবং কী আশ্চর্য—তারপরেই চলতে শুরু করল বজরাটা! বজরার লোকজন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল দিগন্তের অবশিষ্ট আলোয়। সদাগরও আসন্ন সন্ধ্যার নম্রনীল বাতাসে বুকভরে শ্বাস নিয়ে ভাবলেন—'কী আশ্চর্যভাবে বেঁচে গেলাম।'
'থামো থামো।'
'থামো হে কাহিনীকার।'
তোমার কলম আছে বলে মনে কোরো না যা ইচ্ছে তুমি লিখতে পারো। তোমার লেখার অধিকার যেমন আছে, জেনে রেখো সেগুলো আগুনে ছুঁড়ে ফেলার ক্ষমতাও আমার আছে। কারণ'—
পিছন থেকে তীব্রস্বরে একটানা বলে যাচ্ছিলেন যিনি, তাঁকে থামিয়ে দিলেন ধর্মমতি শুক—'ক্ষমতার কারণ দর্শাতে হবে না সদাগর। অক্ষর অতি নিরীহ জিনিস। তাকে পুড়িয়ে দেওয়া সবচেয়ে সোজা। সে তো কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু কথা থেকে যায়। যতদিন মানুষ থাকে। গল্প থাকে, কথা থাকে ততদিন। তাকে কোনওদিন পোড়ানো যায় না। অবশ্য তোমারও অধিকার আছে বলার। তাই বলো—যা বলতে চাও বলো'—
'আমি চেয়েছিলাম যেন আমাকেও নামিয়ে দেওয়া হয় কাজলরেখার সঙ্গে—বজরা থেকে—চেয়েছিলাম যেন দু'জনেই একসাথে থাকি জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত। কিন্তু তা হল না—ওরা আমায় আটকে রাখল জোর করে—আর আমার চোখের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিল কাজলরেখাকে! বজরাও চলতে শুরু করল হঠাৎ—তখন আমার আর কিছু করার ছিল না।'
—এই পর্যন্ত বলে সদাগর একটু থামলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন—'এরপর কীভাবে আমি দিন কাটিয়েছি কেউ জানে না। দেশে ফিরিনি। ঘরে ফিরিনি। সংসার করিনি। ভবঘুরের মতো এখান থেকে ওখান আর ওখান থেকে এখান করে বেড়িয়েছি। কোথাও শান্তি পাইনি। সর্বদা ভাবতাম সেই পুরোনো দিনগুলোর কথা'। সদাগর থামলেন।
তারপর আমার দিকে অদ্ভূতভাবে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন—
'সেই প্রথম যখন দেখি কাজলরেখাকে—তখন সে সূচরাজার দাসী। কিন্তু দেখেই বুঝেছিলাম যে সে কখনও দাসী হতে পারে না। কি অপূর্ব ছিল তার রূপ আর কি আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব। সেই আকর্ষণে রোজ যেতাম তার কাছে। রাত্রিবেলায়। সবার চোখের আড়ালে—মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য। ভাগ্য আমার সহায় ছিল বরাবর। তাই কঙ্কনরানীর প্রশ্রয় পেয়েছিলাম এ ব্যাপারে। আসলে সূচরাজাও অন্য চোখে দেখতেন কাজলরেখাকে। তাই কঙ্কনরানী চেয়েছিলেন কাজলরেখাকে দূরদেশে বিদেয় করতে। আর এই সুযোগটাই আমি নিলাম। কিন্তু অন্তর থেকেই তাকে বরাবর পাশে পাওয়ার জন্যই এতো কিছু। এর জন্য আমি যে কোনও কাজ করতে প্রস্তুত ছিলাম। তাই কঙ্কনরানীর সঙ্গে চক্রান্ত করলাম। একরাতে কাজলরেখাকে ডাকা হল আমার ঘরে। পরদিন তার পায়ের ছাপ দেখিয়ে দেওয়া হল সূচরাজাকে। তারপর বিচারসভা বসিয়ে আমাদের দুজনকেই নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হল। সবই কঙ্কনরানীর জন্য সম্ভব হল। আর আমিও এটাই চেয়েছিলাম।' এই পর্যন্ত বলে সদাগর থামলেন। তারপর যেন কোন দূর নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন—'বজরায় বসে কত কথাই না বলেছিলাম কাজলরেখাকে। তাকে নিয়ে আমার কত সাধ। কত স্বপ্নের কথা। সে কিন্তু আমার কোনও কথাই মানতে চাইছিল না। সে বারবার বলেছিল—'আমায় ক্ষমা করুন—আমায় ত্যাগ করুন—আমি বড়ো সর্বনাশী।' সারারাত ধরে তাকে আমি বোঝালাম যে তাকে ছাড়া আমার জীবন কতটা নিরর্থক। সে শুধু মাথা নীচু করে চোখের জল ফেলে যেতে লাগল। আর ভোর রাত থেকে এলো প্রবল ঝড়। আমাদের বজরা দিকশূন্য হয়ে কোথায় যে ভেসে গেল কে জানে। শেষপর্যন্ত সেই বজরা গিয়ে আটকালো এক নির্জন চরে। তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা কোনো জোয়ার নেই। বাতাস নেই। চারদিকের সমস্ত কিছু যেন স্থির হয়ে গেছে অনন্তকালের জন্য। তখন ওরা চিৎকার করে উঠল—'সর্বনাশী! মেয়েটা সর্বনাশী। ওকে ছুঁড়ে ফেলে দাও ওই চরের মাঝে। না হলে....' এই পর্যন্ত বলে আবার চুপ করে গেলেন তিনি।
বলতে শুরু করলেন একটু বাদেই—'তারপর— তারপর যা ঘটেছিল'— বলে কিরকম ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। নিঃশব্দে।
অর্থাৎ আবার যেন এক নিথর সময়কাল। খানিকবাদে অধৈর্য হয়ে বললাম—'তারপর? তারপর কী বলুন এবার—'
'তারপর আর একটা কথাও লেখা হবে না এ ব্যাপারে'—সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলেন সদাগর। ধর্মমতি শুক বললেন—'কেন?' আবার সেই তীব্র কণ্ঠে উত্তর এলো—'পুড়িয়ে দেবো। সব পুড়িয়ে দেবো। সব লেখা। যে লিখছে আর যে শুনছে তাদের সমেত।' চোখ বন্ধ করেই ধর্মমতি শুক বললেন—'বেশ তো! পোড়াও। কিন্তু পোড়াবার আগুন কোথায়? যাও। আগে আগুন আনতে যাও। আমরা তোমার প্রতীক্ষায় রইলাম।' তারপর আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,— 'তুমি আবার থামলে কেন? পড়ো।' সভয়ে বললাম—'তাহলে আবার শুরু করি?' ধর্মমতি শুক চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।
আমি বলতে শুরু করলাম, সপ্তম আভাষ:
'যখন উষার আলোয় ক্রমশ আলোকিত হল সেই অচৈতন্য অর্ধবস্ত্রা নারী তখন রত্নেশ্বরের মনে হল এ এক কনকমূর্তি কিংবা স্বর্ণলক্ষ্মী, নদীতীরে পড়ে আছে তারই অপেক্ষায় বহুযুগ ধরে। রত্নেশ্বর সেই চেতনারহিত অনুপমাকে নিয়ে এলেন রাজপ্রাসাদে। এবং পরদিনই ঘোষণা করলেন যে, তিনি ওই দিব্যসুন্দরীর পানিগ্রহণ করতে চলেছেন।কিন্তু জানা গেল, সেই পরমা রমণীর এক শর্ত আছে। তার জীবনবৃত্তান্ত বলবেন এক বৃদ্ধ শুকপক্ষী। সেই বৃত্তান্ত শুনে যদি রাজা রত্নেশ্বর সম্মত হন বিবাহে। তবেই তা সম্ভব হবে। অতএব সর্বাগ্রে এই বিশেষ শুকপাখিটিকে খুঁজে আনা আবশ্যক। অর্থাৎ বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং হয়তো অনিশ্চিত। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, সেই বিশেষ শুকপাখিটিকে পাওয়া গেল ক'দিন বাদেই। এইবার চূড়ান্ত ঘটনার প্রতীক্ষা। কারণ পরদিন প্রত্যূষে রাজসভায় শুকপাখি বলবেন সেই আশ্চর্য বৃত্তান্ত। তাই দিগবিদিক থেকে জড়ো হয়েছে কতশত লোক। এসেছেন কতো রাজা-রাজড়া মন্ত্রীসান্ত্রী এবং অজস্র সাধারণ মানুষ। এইবার মহারাজ রত্নেশ্বরের সভায় সবার সামনে শুরু হবে শুকের বচন।'
এতদূর পড়ার পর যেন মনে হল পাশে কে যেন এসে দাঁড়াল। থেমে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে। ধর্মমতি শুক বললেন—'কী হল পড়ো!' বললাম—'মনে হল কে যেন এসে দাঁড়ালো পাশটায়।' ধর্মমতি শুক চোখ মেলে তাকিয়ে বললেন—'ঠিক বলেছো।' চমকে উঠে পাশে তাকাতেই মনে হল কে যেন হঠাৎ সরে গেল। ব্যাপারটা বলতে যাবো, কিন্তু তার আগেই ধর্মমতি শুক বললেন—'ও রত্নেশ্বর। সামনে আসতে সংকোচ করছে।'
পিছন থেকে বিধ্বস্ত গলায় কে যেন বলে উঠল—'না, না। সংকোচ কিসের? আমার আবার সংকোচ কিসের? আমি তো গর্হিত পাপী। চরিত্রহীন।'
ধর্মমতি শুক নিরুত্তর রইলেন। সেই বিধ্বস্ত কণ্ঠ আবার বলে উঠল—'লেখো—এইভাবে—ঠিক এইরকম সোজাসুজিভাবে— রাজা রত্নেশ্বর এতদূর লম্পট ও ব্যাভিচারী ছিলেন যে নিজের ভগ্নীকে নদীতীরে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তাকে নিজের প্রাসাদে নিয়ে এসে শয্যাগত করেন।'
স্তম্ভিত হলাম। ধর্মমতি শুক দেখি নির্বিকার। রত্নেশ্বর আবার বলতে শুরু করলেন—'নাহ্। ওভাবে নয়। এইভাবে লেখো তো দেখি—'রত্নেশ্বরের রাজসভায় সেই বৃদ্ধ শুকপাখির কথা শেষ হওয়ার পর দেখা গেল, রাজা রত্নেশ্বর মাথা নীচু করে বসে রয়েছেন সেই সভাগৃহে। এর পরদিন থেকে রত্নেশ্বরকে আর কখনও প্রকাশ্য রাজপথে দেখা যায়নি।' আমি অবাক হয়ে রত্নেশ্বরের দিকে তাকালাম।
ধর্মমতি শুক আগের মতোই চোখ বন্ধ করে ঘাড় গুঁজে বসে রইলেন। রত্নেশ্বর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— 'আচ্ছা— এইভাবে যদি লেখো—'রত্নেশ্বর ছিলেন অতি দুর্ভাগা। সে চিনতেই পারল না আপন ভগ্নী কাজলরেখাকে। তাই শুধু ভাগ্যের দোষে এতবড় অপরাধী হয়ে সে....' বলে আবার চুপ করে গেলেন রত্নেশ্বর।
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু দেখলাম রত্নেশ্বর হঠাৎ সামনের দেবদারু গাছটার পিছনে চলে গেলেন। 'কোথায় যাচ্ছো রত্নেশ্বর? দাঁড়াও। এখনই যেও না'—বললেন ধর্মমতি শুক। কোনো উত্তর এলো না। রত্নেশ্বরকেও দেখা গেল না। কেবল দেখতে পেলাম সামনের নির্বিকার দেবদারু গাছটি থেকে আরো কয়েকটি শুষ্কপত্রের অসামান্য পতন।
'অত ভাবুক হলে কাব্য লিখো অবসরে—কিন্তু এখন সময় অতি অল্প। তোমার বৃত্তান্ত সাঙ্গ করো শীঘ্রই—সহজ কথায়'—ধর্মমতি শুক আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে যেন কঠোরভাবেই বললেন কথাগুলি। অষ্টম আভাষটা চট করে এবার খুঁজে বের করে পড়ে ফেলি। 'আরে হাতের কাছে যা পাচ্ছো তাই পড়ো—আগেই তো বললাম কথাটা।' আবার মন্তব্য করলেন ধর্মমতি শুক। থতমত খেয়ে গিয়ে হাতের কাছে যা পেলাম—তাই পড়তে শুরু করলাম—
এবং শেষকালে তিনি এলেন।কাজলরেখার সামনে।
অবশ্যই স্বপ্নে।
যেমন তিনি এসেছিলেন বহুকাল আগে।
অযাচিতভাবে।
সর্বস্বান্ত ধনেশ্বরের সামনে।
বলে গিয়েছিলেন কিছু কথা।
ধনেশ্বরকে।
অপ্রত্যাশিতভাবে।
এবং ঘটিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন কিছু ঘটনা।
যা অভাবিত।
অথচ অবধারিত।
এবং তা স্বপ্নে নয়। বাস্তবে।
যদিও এরপর থেকে তিনি এসেছেন শুধু স্বপ্নে কাজলরেখার সামনে।
যথাকালে।
—'অভ্রান্ত'। চমকে উঠলাম। এ কার গম্ভীর কণ্ঠস্বর?
এ কণ্ঠস্বর তো ধর্মমতি শুকের নয়! সামনে তাকিয়ে দেখলাম এক জটাধারী শীর্ণ বৃদ্ধ। মনে হল তাহলে ইনিই কি সেই সন্ন্যাসী?
'তারপর'—একই কণ্ঠে প্রশ্ন এলো তখনই।
পড়তে শুরু করলাম—
তারপর তিনি দেখা দিলেন স্বপ্নে। কাজলরেখার সামনে। যখন রত্নেশ্বর তাকে সম্পূর্ণরূপে ভোগ করার আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। সেই ঘোর রাত্রিতে। সেই স্বপ্নে তিনি কাজলরেখাকে বললেন 'তোমাকে এই ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে কেবল একজন। যিনি তোমার সব জানেন। তিনি সেই বৃদ্ধ শুকপাখি। রত্নেশ্বরকে বলো সেই শুকপাখিকে খুঁজে আনতে। সে বলবে তোমার জীবনবৃত্তান্ত। সর্বসমক্ষে। রত্নেশ্বরের রাজসভায়। তখন দেখবে সেখানে....' এরপরই ঘুম ভেঙে গেল কাজলরেখার।কি দেখবে? কি দেখবে সে রত্নেশ্বরের রাজসভায়? এই প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু দেখতে পেল আকাশে শেষ রাতের নম্র চন্দ্রাভাস। কাজলরেখার মনে হল যে, সে এতক্ষণ যা দেখল তার কতটা সত্য কিংবা কতটা মায়া। তা সে সত্য হোক বা মায়া, সন্ন্যাসী কিন্তু অন্তর্হিত হয়েছেন কাজলরেখাকে দিনের প্রথম আলো দেখিয়ে।
'তারপর?'—প্রশ্ন করলেন সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
'তারপর নয়, তার আগে'—উত্তর দিলাম। এবং পড়ে যেতে লাগলাম—
এই ঘটনার দশ বছর আগে তিনি এসেছিলেন। সে রাতেও কাজলরেখার কাছে ছিল শুধু অন্ধকার আর অশ্রুকণা। এবং তিনি এসেছিলেন। যথারীতি স্বপ্নেই। আর কাজলরেখাকে বলেছিলেন—'কোনো কথা বলো না নিজের স্বপক্ষে। নিজের পরিচয়ও দিতে যেও না কখনো। তাহলেই সর্বনাশ। বরং নীরব থাক। সময়ই সবকিছু নির্ধারণ করবে যথাকালে। এমনকি যাকে সবচেয়ে বিশ্বাস করো, সেও যদি বিরূপ হয়....'
এরপর তিনি স্বভাবতই অদৃশ্য হয়েছিলেন।
সেও যদি বিরূপ হয় তাহলে? কে সে? কিরকম বিরূপ? এই সব অজস্র প্রশ্নের উত্তরের জন্য কাজলরেখা পাগলের মতো খুঁজেছিল তাঁকে। কারণ কাল ভোররাতেই তার বিচার। সূচরাজা ও কঙ্কনরানীর সামনে।
কিন্তু ততক্ষণে তিনি অদৃশ্য হয়েছেন। আর কাজলরেখার জন্য রেখে গেছেন আসন্ন সকালের আলোকাভাস।
'বেশ! তারপর?' — আবার গম্ভীর স্বরে মন্তব্য এলো সেই কৃশকায় মানুষটির দিক থেকে।
এবারেও তারপর নয়। তার আগে। তার কিছুকাল আগে। বলে পড়তে শুরু করলাম—
এর মাত্র কিছুকাল আগেই তিনি এসেছিলেন। ওই কাজলরেখারই সামনে। ঘোরতর অন্ধকার সরিয়ে। দিনের প্রথম আলো নিয়ে। কাজলরেখার সামনে। সেই বন্ধ মন্দিরের দরজা খুলে ভিতরে এসে মৃত সূচরাজার পাশে দাঁড়িয়ে কাজলরেখার দিকে তাকিয়ে অদ্ভূত কণ্ঠে বলেছিলেন—'এই মৃত যুবা হয়তো হতে পারেন তোমার স্বামী...। যদি সম্পূর্ণ উপবাসী থেকে পবিত্র মনে এই সূচগুলি যুবার দেহ থেকে নির্গত করতে পারো.... তবেই প্রাণ পাবে এই যুবা.... কিন্তু মনে রেখো এই কাজ করতে গিয়ে কোনও অঘটন ঘটলে তাকে শোধরানোর চেষ্টা করতে যেও না... কোনো অসত্য উপস্থিত হোলে তার প্রতিবাদ করতে যেও না.... আর কোনো অবস্থাতেই নিজের পরিচয় দিতে যেও না—যাই ঘটুক তাকে ভবিতব্য বলে মেনে নীরব নিরুচ্চার থেকো.... আগামী দশটি বছর.... তারপর....'তারপর কী? তারপর কী? এই প্রশ্নের উত্তরে কাজলরেখা লক্ষবার মাথা খুঁড়লেও কোনো উত্তর আসেনি। কারণ সন্ন্যাসী স্বভাবতই অন্তর্হিত হয়েছিলেন। এবং কাজলরেখার সামনে ছিল এক অবধারিত উষালগ্ন।
এই পর্যন্ত বলে আমি থামলাম। দেখলাম সেই বৃদ্ধ আর কোনও মন্তব্য করেন কিনা। কিন্তু এই বার তিনি নিরুত্তর রইলেন। আমি আবার পড়তে শুরু করলাম—
এইভাবেই তিনি প্রতিবার এসেছিলেন।অযাচিতভাবে।
অপার অন্ধকারে।
সর্বপ্রথমে ধনেশ্বরের কাছে।
সর্বস্বান্ত ধনেশ্বরের সামনে এসে বলেছিলেন 'এই আংটি আর এই শুকপাখিটি তুমি নাও। আংটিটি বিক্রি করো ঠিক একমাস বাদে। তাতে যে অর্থ তুমি পাবে, তা দিয়ে আবার বাণিজ্য শুরু কোরো। দেখো একবছরে যে ব্যবসা তুমি করবে, তা দিয়ে পরের দশবছর ঘরে বসে খেতে পারবে।'
ধনেশ্বর অবাক হয়ে শুনছিলেন সন্ন্যাসীর কথা। সন্ন্যাসী আরও বলেছিলেন 'এই শুকপাখিটি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। এর কথার কখনও অন্যথা কোরো না। তাহলেই সর্বনাশ। কিন্তু সময় বিশেষে এর আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় পাবে।'
ধনেশ্বর মাথা নীচু করে শুনছিলেন আর ভাবছিলেন এই সব কথার কি কোনো মূল্য আছে এই মুহূর্তে তার কাছে? তারপর মুখ তুলে দেখলেন সন্ন্যাসী কখন অদৃশ্য হয়েছেন আর রেখে গেছেন একটি হীরের আংটি ও একটি শ্বেতশুভ্র শুকপাখি।
সন্ন্যাসী অন্তর্হিত হলেন, কিন্তু তাঁর কথাগুলি প্রতিটি অক্ষরে প্রতিষ্ঠিত হল ক্রমশ। কারণ আংটি বিক্রি করে ধনেশ্বর প্রত্যাশার বহুগুণ বেশি অর্থ লাভ করলেন। এবং নতুন উদ্যমে আবার বাণিজ্যে নামলেন। সেই সময়েই দেখা গেল শুকপাখিটিরও এক আশ্চর্য আত্মপ্রকাশ। কারণ ভবিষ্যতে আমরা দেখতে পাবো যে এই শুকপাখিটিই এই কাহিনীর নেপথ্যনিয়ন্তা।
'যথার্থই। যথার্থই।' কথাটা ভেসে এলো সামনে থেকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল এতো সন্ন্যাসীর কণ্ঠস্বর নয়। এতো ধর্মমতি শুকের স্বর! সামনে তাকিয়ে দেখলাম ঠিক তাই। ধর্মমতি শুকই কথাটা বলেছেন। সন্ন্যাসীর কাঁধে বসে। কিন্তু আমার সামনে ইনি কি সেই সন্ন্যাসী? না জ্যোৎস্নাভারে নত এক নিষ্পত্র বৃক্ষ?
'এরপর কি লিখেছ পড়ো'—কথাটা ভেসে এলো ধর্মমতি শুকের কাছ থেকে। শেষ আভাষ—
'এরপর কাজলরেখার কথা'—বলার সাথে সাথেই লক্ষ্য করলাম ধর্মমতি শুক মাথা তুলে আমার চোখে চোখ রাখলেন।
'তাড়াতাড়ি পড়ো'—বলে আবার চোখ বুজলেন তিনি।
'এখুনি পড়ছি'। বলে খুঁজতে লাগলাম লেখাটা।
'অত খুঁজতে হবে না। হাতের কাছে যা পাচ্ছো পড়ো। সময় আর নেই'—যেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন ধর্মমতি শুক।
বাধ্য হয়ে যা মনে পড়ছিল তাই বলতে শুরু করলাম —'ইহার পর তাহারা সুখে সংসার করিতে লাগিল। তাহারা অর্থাৎ সূচরাজা ও কাজলরেখা।' এই পর্যন্ত বলার পরই দেখলাম ধর্মমতি শুক যেন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কেন জানি না ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ফেললাম—'না না। এভাবে নয়। এভাবে নয়। শেষ আভাষের শুরু এইভাবে'— এই বলে, বলতে শুরু করলাম ওনার চোখে চোখ রেখে—
'জীবের পাপের কোনো কারণ বা ভিত্তি নেই। তারা বিনা হেতু বা ভিত্তিতেই পাপী হয়। জীবের পুণ্যেরও কোনো ভিত্তি নেই। তারা হেতু বা ভিত্তি ছাড়াই পুণ্যবান হয়। মানুষের কোনো কর্ম, কোনো শক্তি, কোনো সাহস বা শৌর্য নেই, যা দিয়ে সে তার নিয়তিকে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থাৎ সেই সব জীব, যাদের নিঃশ্বাস পড়ে, যাদের জন্ম হয়, বৃদ্ধি পায় এবং জন্ম নেয়, তারা সবাই শক্তিহীন, ক্ষমতাহীন, গুণহীন নিয়তির কাছে।'
ধর্মমতি শুক তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—'এটা নিশ্চয়ই তোমার শেষ আভাষের সর্বশেষ অংশ'।
চোখ সরিয়ে নিয়ে নীচের দিকে তাকাতেই দেখি সামনেই তো রয়েছে লেখাটা—'কাজলরেখার কথা কিংবা একটা বর্ণময় অন্ধকার ও কয়েকটি আশ্চর্য আলোর কাহিনী।' ধর্মমতি শুকের দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে পড়তে শুরু করলাম—
'কাজলরেখার প্রথম অন্ধকার ও এক আশ্চর্য আলো'।এই আশ্চর্য আলোয় বসে কাজলরেখা ভাবছিল তার জীবনের প্রথম অন্ধকারের কথা—অর্থাৎ বিগত দিনটির কথা। কি আনন্দেই না সে উঠেছিল তার বাবা ধনেশ্বরের সঙ্গে সেই নৌকায়। নৌকায় চলছিল গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে।
'ওটা কী পাখি বাবা? ওই যে হলুদরঙের।'
'ওগুলো কী গাছ? কী বিরাট বিরাট পাতা....।'
'এটা কী নদী? কী সুন্দর জল...।'
'এই মন্দিরটা কিসের? এখানে বুঝি পুজো দেবো আমরা....'
—সমস্ত কথাগুলি মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। সেই ভোরবেলায় রওনা হয়ে নদীপার হয়ে গভীর জঙ্গল পার হয়ে বিকেলের শেষে এক পোড়ো মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সে আর তার বাবা ধনেশ্বর—তার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ।
—'এই মন্দিরেই আসার কথা বুঝি আমাদের? ভিতরে কি ঠাকুর আছে? কীসের পুজো দেবো আমরা?'
—সব বলব, সব বলব। একটু জিরিয়ে নিই....।'
—'একটু জল আনবে বাবা? বড়ো তেষ্টা পেয়েছে....।'
—'এখুনি আনছি। তুই মন্দিরের ভিতরে গিয়ে বোস....।।'
—'বাবা। বাবা! এ কোথায় আনলে আমায়। সামনে একটা মরা মানুষ....।'
—'এই মৃত কুমারই তোমার স্বামী। আমি ধর্মসাক্ষী করে....।'
সে বসেছিল পাথরে মতো—একটা ছোট্ট প্রদীপের আলোয়—
—ওই সূচবিদ্ধ মৃতের সামনে—কিন্তু সেই সামান্য আলোও নিভে গেল একটু বাদেই। অন্ধকারে গিলে ফেলল চারদিক।
এইভাবেই এসেছিল কাজলরেখার জীবনের প্রথম অন্ধকার। কিন্তু এরপর—
'থাক। এরপরের কথা থাক।' —যেন আমার হাতে হাত রেখে কেউ খুব আস্তে করে বলে উঠল কথাটা। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। শুধু অনুভব করলাম এক মায়াময় স্পর্শ। তারপর বিপুল জ্যোৎস্নায় মিলিয়ে গেল সেই বিষণ্ণ কণ্ঠ।
বুঝলাম কে এসেছিলেন। বললাম—'তা কী করে হয়? কারণ এরপরেই তো সেই আলো এলো। আবার পড়ছি ওই নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে মন্দিরের দরজা ঠেলে ঢুকেছিলেন তিনি—দিনের সদ্য কুসমিত আলো নিয়ে। এবং বলেছিলেন—এই মৃত কুমারই হবেন তোমার স্বামী, যদি তুমি....' ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই হল কাজলরেখার জীবনের সেই আশ্চর্য আলো।' —এই পর্যন্ত বলে আমি থামলাম। ধর্মমতি শুক বললেন—
'বেশ! তারপর?'
বললাম তারপর—কাজলরেখার কাঙ্ক্ষিত অন্ধকার ও অনাকাঙ্ক্ষিত আলো।
ধর্মমতি মন্তব্য করলেন—'দুর্বোধ্য।' তাঁর বিদ্রুপ অগ্রাহ্য করেই পড়ে যেতে লাগলাম—'দীঘিটির ধারে সেই মলিন মেয়েটিকে দেখেই এক অন্ধকার ছায়া পড়েছিল কাজলরেখার মনে। এরপর স্নান করে এসে সে দেখেছিল যে তার কল্পনার জগৎটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সদ্যপ্রাণিত মৃতকুমার অঙ্কশায়িনী হয়েছেন সেই মেয়েটির। নিয়তির এই নিষ্ঠুর অবলীলায় যে বর্ণময় অন্ধকার কাজলরেখা তা গ্রহণ করল সহজেই। কিন্তু সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত অন্ধকার অর্থাৎ নিয়তির মহাকূট অবশ্য এসেছিল আরো কিছুদিন বাদে।' এবার থামলাম। দেখলাম ধর্মমতি শুক চোখ তুলে তাকালেন এবং বললেন—'অতি দুর্বোধ্য।' প্রত্যুত্তর না করে পড়ে যেতে লাগলাম—'কাজলরেখা জানতো যে সূচরাজা তার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত। তাই রাজ্যপাট ছেড়ে চলে গিয়েও তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন কাজলরেখারই টানে। এদিকে সদাগরকে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তিনি ওই দুষ্কর্ম করলেন। বিনা দোষে মহাকলঙ্ক অভিযুক্ত হয়েও কাজলরেখা বিচারসভায় আলোর আশা করেছিল। আর সেইসময়ে তার সবচেয়ে আপনজন, প্রকৃত সত্যের একমাত্র সাক্ষী তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন না। কাজলরেখার জীবনে এলো সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত অন্ধকার। কিংবা নিয়তির আঁকা সবচেয়ে বর্ণাঢ্য অন্ধকারও বলা যায়।' দেখলাম ধর্মমতি শুক চোখ মেলে তাকালেন আমার দিকে। 'অতএব কাজলরেখাকে নির্বাসিত হতে হল সদাগরের সঙ্গে। একই যাত্রায়। একই বজরায়। সারারাত ধরে সদাগর যখন তার সঙ্গ প্রার্থনা করছেন, কাজলরেখা তখন প্রার্থনা করছিলেন এক নির্বিকল্প অন্ধকারকে। এবং কি আশ্চর্য! ঈশ্বর তার কথা যেন শুনলেন। ভয়ঙ্কর অন্ধকারে, বিধ্বংসী ঝড়ঝঞ্ঝায় দিকশূন্য হয়ে এক বিস্তীর্ণ শুকনো চরে এসে আটকালো সেই বজরা। এবং দুর্লক্ষণা বলে তাকে নিক্ষেপ করা ওই অন্ধকার নদীতীরে। মুক্তি পেলেন কাজলরেখা তার কাঙ্খিত অন্ধকারে। এরপর—
—আর নয়—আর নয় এই অন্ধকারের পর আর কিছু দেখতে যেও না।—সেই একই বেদনার্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো খুব কাছ থেকে। বললাম—'জোর করে দেখতে হয় না—আবার পড়তে শুরু করলাম—সেই পরিত্যক্ত নারী কি আশ্চর্যভাবেই না উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হিরন্ময়ী প্রতিমার মতো—যখন দিনের প্রথম আলো নিজে থেকেই খুঁজে নেয় তাকে—ঢেকে দেয় তাকে তার যথাসাধ্য বৈভবে—অর্থাৎ পরদিন ভোরবেলায় ওই নদীচরের উপর রত্নেশ্বরের চোখের সামনে যখন কাজলরেখাকে দেখতে পাওয়া যায় শায়িত অবস্থায়। এই আলো কাজলরেখার কাছে অবশ্যই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।'— এই পর্যন্ত বলে ধর্মমতি শুককে জিজ্ঞাসা করলাম—'কি? খুবই দুর্বোধ্য কি?'
ধর্মমতি শুক চোখ বন্ধ করেই উত্তর দিলেন—'সংক্ষেপে বলো। সংক্ষেপে বলো।' সময় প্রায় শেষ।
'অবশ্যই।'— বলে বলতে শুরু করলাম—
'কাজলরেখার অন্তিম অন্ধকার ও অশেষ আলো।'এতক্ষণে অন্ধকার পরিপূর্ণ হল কাজলরেখার সামনে। দেওয়ালগিরির আলোর শিখাটি নিভে যাওয়ার সাথে সাথেই। কাজলরেখা নিজেই নিভিয়ে দিলেন। কারণ এই অগ্নিশিখার সুবর্ণতা বড়ো অসহ্য বলে মনে হচ্ছিল তার। এর চেয়ে আঁধার ভালো। যে আঁধার তার নিত্যসঙ্গী। এবং শেষসঙ্গী। এই সঙ্গীকে সাথে নিয়ে সহজেই বহুদূরে চলে গেল কাজলরেখা।
সেখানে সে অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সেই আশ্চর্য সকালটিকে যখন সে পড়েছিল অর্ধচেতনায় সেই শুকনো নদীর চরে—সারা গায়ে জড়িয়ে ছিল অসংখ্য বালুকণা আর অসহ্য ক্লেদ। কিভাবে যে সে রত্নেশ্বরের রাজপ্রাসাদে এলো—তার কিছুই মনে পড়ছিল না। কিন্তু সেই প্রাসাদে ঢুকতেই তার মনে হয়েছিল এই প্রাসাদের বহু কিছু তার খুব চেনা। তারপর বিদ্যুৎচমকের মতো তার উপলব্ধি হয়েছিল—এটাই তো তার জন্মস্থান—তার পিতা ধনেশ্বরের প্রাসাদ! এই প্রাসাদ ছেড়ে তো রাস্তায় নামতে হয়েছিল তার পিতাকে। আর তাকে চুপি চুপি রেখে আসতে হয়েছিল গভীর জঙ্গলে। রত্নেশ্বর তখন বোধহীন শিশু। তাই তার আপন বোনকে চিনতে না পেরে কি ভয়ঙ্কর অত্যাচারকে প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে। অথচ সে নিরুপায়। সন্ন্যাসীর সেই নির্দেশে কারণ নিজের পরিচয় দিলেই 'সর্বনাশ'।
এইভাবে জীবনের অন্যতম কলঙ্কের মুখে দেওয়ালগিরির আলোকশিখাকে নিজে হাতে নির্বাপিত করে কাজলরেখা আহ্বান করে নিলেন তার জীবনের অন্তিম অন্ধকার।
এই পর্যন্ত বলে আমি থামলাম। ধর্মমতি শুকের দিকে তাকালাম।
'বোঝা গেল। কিন্তু তারপর?' —মন্তব্য করলেন ধর্মমতি শুক।
বললাম—'তারপর? আবার পড়তে শুরু করলাম—'তারপর এই ঊষাকাল। এবং এক অশেষ আলোর প্রতীক্ষা।'
'বুঝলাম না।'
—উত্তর না দিয়ে পড়ে যেতে লাগলাম।
'এরপর সেই সন্ন্যাসী এসেছিলেন। কাজলরেখার সামনে। অবশ্যই স্বপ্নে। সন্ন্যাসীর কথা মতোই কাজ করেছিল কাজলরেখা। যার পরিণাম এই প্রত্যূষের রাজসভা। যেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন এক বৃদ্ধ শুকপাখি। তিনি বলবেন এক চমৎকার বৃত্তান্ত। যাতে আলোকিত হবে সবাই। অর্থাৎ রাজা রত্নেশ্বর, সূচরাজা। তাঁর সদাগর বন্ধু। আরো কত পাত্রমিত্র অমাত্য। এমনকি নিজস্ব অন্ধকারে থাকা কাজলরেখাও।'
এই কথার পরই মনে হল এখুনি নিশ্চয়ই শুনতে পাবো সেই আর্ত কণ্ঠস্বর—
'আর নয়! আর নয়!'—স্পর্শ পাবো সেই আশ্চর্য মায়াময় বিষণ্ণতার।
কিন্তু এমন কিছুই হল না। শুধু এক শীতল নিঃশব্দ বাতাস বয়ে গেল আমার চোখ মুখের উপর দিয়ে।
ধর্মমতি শুক বললেন—'এরপর?'
বললাম—'এরপর তো আর কিছু নেই।'
—তাহলে তোমার কাহিনীর এখানেই ইতি?
—'তাই তো হওয়া উচিত।'
ধর্মমতি শুক এবার আমার দিকে তাকিয়ে সোৎসাহে বললেন—'চমৎকার!'
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনলাম—'না। এখনও চমৎকার নয়।'
দেখলাম এক তিলোত্তমা আমাদের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন।
'এইবার চমৎকার হবে। এই পাতাটি পড়ে ফেললেই।'
দেখলাম তাঁর হাতে আমারই লেখা একটি কাগজের পাতা।
—'উড়ে চলে গিয়েছিল। খেয়াল করোনি কাহিনীকার। এই নাও। পড়ো। এই পরমবন্ধুকে বাদ দিয়ে কি করে এই কাহিনী চমৎকার হবে?'—
কি অনুপম ভঙ্গিমায় বললেন তিনি কথাগুলি।
দেখলাম—হঠাৎ যেন পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছেন ধর্মমতি শুক। লেখাটি নিয়ে পড়তে শুরু করলাম—
'এই পরমা সুন্দরী কন্যাই তোমার সর্বনাশের কারণ হবে। অতএব একে যত শীঘ্র পার নির্বাসনে পাঠাও। বহু দূরে। নির্জন জঙ্গলে। যেখানে আমি নির্দেশ করছি....' —এই ভয়ঙ্কর ঘোষণা করেই আত্মপ্রকাশ করেছিল সেই শুকপাখি অর্থাৎ আমাদের কাহিনীর ধর্মমতি শুক।ধনেশ্বর আর্তনাদ করে বলেছিলেন—'না। কখনোই না। আমি ধনেপ্রাণে মরব তাও আমার একমাত্র কন্যাকে এইভাবে বিসর্জন দিতে পারব না।'
ধর্মমতি শুক বলেছিলেন—'এতে তুমি নিজে তো ধ্বংস হবেই, তার সাথে তোমার কন্যাকেও ধ্বংস করবে। কারণ আমার কথা মিথ্যা হয় না।'
ধনেশ্বর স্তম্ভিত হয়েছিলেন। ধর্মমতি শুক ধনেশ্বরকে বলেছিলেন—'সন্ন্যাসীর কথা বিস্মৃত হোয়ো না। তাঁর কথা মেনেই তুমি আবার বাণিজ্য শুরু করতে পেরেছো। সন্ন্যাসীর শেষ কথাটা স্মরণ আছে তো?'
সন্ন্যাসীর শেষ কথাটি স্মরণ করেই ধনেশ্বরের পক্ষে সম্ভব হয়নি ধর্মমতি শুকের আদেশ অমান্য করা। কন্যা বিসর্জন দিয়ে ধনেশ্বর ফিরে এলেন নিজগৃহে। ধর্মমতি শুক ততক্ষণে উড়ে চলে গেছেন অন্য আকাশে। অবশ্য ফেলে দিয়ে গেছেন গভীর অন্ধকারে— এক অনন্যা বিষাদপ্রতিমাকে।'
মনে হল ধর্মমতি শুক যেন মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে চাইলেন। কিন্তু তারপর আবার সেই স্থির দৃষ্টি।
ফের পড়তে শুরু করলাম—
কিন্তু সম্পূর্ণভাবে চলে যাওয়ার পাত্রও তিনি নন। তাই তিনি ফিরে এসেছিলেন আবার। সেই বিষাদপ্রতিমার কাছে। তার ঘোরতম সংকটকালে। অর্থাৎ কাজলরেখার সূচরাজার সভায় বিচারের দিন। মূল সাক্ষী হিসেবে।'মহারাজ প্রকৃত সত্য বলে কিছু নেই। প্রকৃত মিথ্যা বলেও কিছু নেই। কারণ সত্যমিথ্যা মূলত আপেক্ষিক। তাই সত্যাসত্যের কূটতর্কে না গিয়ে বর্তমান স্থান কালপাত্রের বিচারে কাজলরেখার অবিলম্বে এই স্থান ত্যাগ করাই কর্তব্য বলে আমার মনে হয়।'
শুকের এই বক্তব্য কাজলরেখাকে নিঃক্ষেপ করেছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অন্ধকারে। এবং সেই শুকপাখি চলে গিয়েছিলেন কোনো দূরতর অজ্ঞাতপুরে।'
মনে হল ধর্মমতি শুক এইবার চোখ তুলে স্পষ্ট তাকালেন আমার দিকে। তখন ওই দৃষ্টিটাকে বড়ো কুৎসিত বলে মনে হল আমার। মনে হল এখনই অন্ধ করে দিই ওই চোখ দুটি। মনের ভাব অতিকষ্টে সংযত করে পড়ে যেতে লাগলাম—
কিন্তু অজ্ঞাতপুরে থাকা এই শুকপাখিটির ধর্ম নয়। তাই আবার প্রকাশ্য হতে হল তাকে—যথাকালে।
'যথাকালে'—যথাকালে—ঠিক—ঠিক— ধর্মমতি শুকের কণ্ঠ আবার শুনতে পেলাম!
তাঁর কথা অগ্রাহ্য করেই পড়ে যেতে লাগলাম—
'এইবার শোনা যাবে এক আশ্চর্যবৃত্তান্ত। সেই বৃদ্ধ শুকপাখির মুখ থেকে। যে বৃত্তান্ত শোনার জন্য রত্নেশ্বর থেকে সদাগর পর্যন্ত সবাই উন্মুখ। একজন বাদে। তিনি কাজলরেখা। নিজস্ব আঁধারে তিনি বসে আছেন একা।'
এই পর্যন্তই লেখা ছিল। পড়া শেষ করে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের সামনে সেই দিব্যসুন্দরীর কোনো চিহ্নই আর নেই! আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই ধর্মমতি শুক বলে উঠলেন—'উনি চলে গেছেন।' বললাম—'কোথায়?' উনি উত্তর দিলেন—'দিনের এই ক্রমাগত আলোর থেকে দূরে।' বললাম—'কী আশ্চর্য।' উনি বললেন 'কিসের আশ্চর্য?'
বললাম—'এই যে সবাই এলো। আবার চলেও গেল। শুধু আপনি আছেন। সেই শুরুর থেকে। এই শেষ পর্যন্ত।'
—'কেন আছি জানো?'
—'জানি। শেষ কথাটি বলার জন্য। সর্বদা এবং সর্বত্র।' ধর্মমতি শুক কোনও উত্তর দিলেন না। শুধু অদ্ভুতভাবে তাকালেন। বেদনায়? না বিতৃষ্ণায়?
বললাম—'কিন্তু কেন? কেন এইভাবে হাজির হন সব জায়গায় প্রতিবার?
—'ওই যে বললে—বোধহয় না জেনেই বললে—আমায় যে বাধ্য করে যথাকাল।
—চিরকাল হেঁয়ালি কথার জাল বুনে কি পেলে ধর্মমতি শুক?
—আমার প্রাপ্য কিছু হতে নেই। আমি নির্বান্ধব। নির্ভার। এবং নিরুপায়।
স্পষ্ট দেখলাম ধর্মমতির চোখের তারায় কোটি বছরের বিগত নক্ষত্রের আলো। ধর্মমতি আবার বলতে শুরু করলেন—
—'আমায় অনেকে বলে অমোঘ। অনেকে বলে নিয়তি।'
বললাম—'বেশ তো। সেই জন্য নিজেকে অন্ধকারে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে? অশ্রুভারে চিহ্নিত হতে হবে?'
—'তার মানে?'
—'আপনি ধনেশ্বরকে দিয়ে এতো বড়ো পাপকাজ করালেন— কাজলরেখার জীবনে অকারণে সমস্ত দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে এলেন—ধনেশ্বর থেকে রত্নেশ্বর, সবার চোখের জলের কারণ আপনিই। কারণ আপনি এক দূষিত আত্মা। ঘুরে বেড়ান মানুষের দুর্বল মুহূর্তের সন্ধানে—কতক্ষণে তার ঘাড়ে এসে বসবেন সাধুবেশে—
একটানা এতগুলো কথা বলে ফেললাম উত্তেজনার বশে। দেখলাম ধর্মমতি শুক নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রয়েছেন দূর আকাশের কোণে।
দেখে আমার অসহ্য মনে হল। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলাম না—বলে উঠলাম—'যান যান। বিদেয় হোন। বিদেয় হোন বিদেয় হোন এখান থেকে।'
'আমি বিদেয় হলে তোমার কী হবে ভেবে দেখেছো?'— যেন শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন তিনি।
উত্তর দিলাম—'তার মানে?'
'আরে তুমিই তো বললে এখুনি—আমিই সঙ্গে করে নিয়ে আসি যত অন্যায় অবিচার অনিয়ম। ঠিক কথা। তাই আমাকে নিয়েই তো যন্ত্রণার তীব্র নীলরঙ, বিষাদের অপূর্ব অন্ধকার। অর্থাৎ কাহিনীর গহনরূপ। এবং শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।'—এই কথা বলে কেমন যেন রহস্যময় নাকি কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ধর্মমতি শুক।
আমি বলে উঠলাম—'প্রয়োজন নেই—কোনো প্রয়োজন নেই—কোনো উৎকৃষ্ট কাহিনীর ও কাহিনীকারের এই অসংখ্য অনুচিতের বিনিময়ে—বরং ধরিত্রী অমলিন হোক—নিষ্ঠুর গল্পহীন সহজ সুন্দর....'।
'থামো থামো।' তীব্রস্বরে বলে উঠলেন ধর্মমতি শুক। 'সৃষ্টির শুরুতেই আছে বিপুল অন্ধকার—আলোয় নয়— অন্ধকারেই সমস্ত জীবনের রহস্য—যাবতীয় কাহিনী।
আমি চুপ করে রইলাম এই কথার পর। আমার বলার পালা তো শেষ। অতএব এখন বিস্তৃত নিস্তব্ধতা এবং প্রত্যুষের প্রথম আলো। আর সেই আলো মেখে স্থির ওই অদূরের ধর্মমতি শুক। মনে মনেই বলছিলাম—'চলে যান—চলে যান মানুষজনের থেকে অনেক দূরে।' যেন আমার মনের কথাটা বুঝেই বলে উঠলেন ধর্মমতি শুক—
'বুঝলে হে কাহিনীকার—মানুষের থেকে বিযুক্ত হতে আমি পারি না কখনো—প্রতিটি মানুষের কাঁধে এসে বসতে হয় আমায় কোনো না কোনো সময়ে—মুক্তি নেই আমার—সময়ের বয়সী আমি—আর অন্ধকারের মতো একা'—
এই কথা বলার সাথে সাথেই দিনের আলো দ্রুত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল—সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ধর্মমতি শুকের চেহারাটা। সেই শুষ্ক, বিদীর্ণ, জরাগ্রস্ত অশক্ত শরীরটা যেন কেমন থরথর করে কেঁপে উঠে বললো—
'আমি সত্যিই সমস্ত অনর্থের মূল—আমি চলে গেলে তুমি তাকে অর্থপূর্ণ করো—তোমার নিজস্ব শব্দে আর নিঃশব্দে।' একটু থেমে আবার বললেন—এই নতুন দিনের আলোয় আবার আমায় উড়ে গিয়ে বসতে হবে অন্য কারো কাঁধে— আমি যে অদৃষ্টের সর্বনাম—সারা পৃথিবীটাই তো আমার খাঁচা'—দেখলাম এই কথা বলতে বলতে কি আশ্চর্যজনকভাবে রঙিন হয়ে উঠছেন ওই ধর্মমতি শুক! আর তারপরেই সেই সমস্ত রঙ যে মিলেমিশে একাকার হয়ে এক ঘন তরল কালো ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ল আমার চোখে—আর আমি—আর আমি ক্রমশ তলিয়ে যেতে লাগলাম সেই গভীর কালোয় কিংবা অন্ধকারে—
একটু বাদেই সেই অন্ধকার যেন সামান্য হালকা হোলো। সেই আবছায়ায় বুঝলাম কেউ দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। চেহারাটা খুব চেনা। আস্তে আস্তে সে যেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
আরে! এতো কঙ্কন! ওকেই তো মনে মনে চাইছিলাম আমি! ওর দিকে দু'হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি। কঙ্কনও নির্ভুলভাবে এসে দাঁড়ালো আমার হাত দুটোর মধ্যে।
এরপর ওই আবছায়ার মধ্যেই কঙ্কনকে নিয়ে কি আশ্চর্যজনকভাবে উঠে এলাম আমার বাড়ির ছাদে। ছাদের কিনারায়। চারদিকের আধো অন্ধকারে আমরা তখনও ঘনিষ্ঠ। কঙ্কন সামনে। আর আমি পিছনে।
কঙ্কন জিজ্ঞাসা করল—'কোথায় যাচ্ছি আমরা?' আমি বললাম—'সুখ দেখতে।' কঙ্কন বলল—'সত্যি?' আমি বললাম —'হ্যাঁ সত্যি। তাকাও। সামনের দিকে তাকাও।' কঙ্কন অতি আগ্রহে মুখ বাড়িয়ে তাকালো সামনের গভীর অন্ধকারে। সঙ্গে সঙ্গে এক ধাক্কা মেরে ওকে ফেলে দিলাম নীচে। ওই গভীর অন্ধকারে। যেখানে ও সুখ খুঁজেছিল।
মুখ ঘুরিয়ে নেমে আসতে যাবো, দেখলাম পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে কাজলরেখা! যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিল! কাজলরেখার হাত ধরে নীচে নেমে এলাম। তারপর বেরিয়ে এলাম বাড়ির বাইরে। রাস্তায়।
সেখানে দেখি চাপচাপ রক্ত। কঙ্কনের। সেই রক্তকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লাম সামনের গলিতে। দেখলাম কঙ্কনের রক্তের ধারা বইছে সেই গলিতেও। কাজলরেখার হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম—'তাড়াতাড়ি চলো। আমাদের অন্য কোথাও যেতে হবে।'
দু'জনে দ্রুত হেঁটে ঢুকে পড়লাম পাশের ছোটো গলিটায়। দেখলাম সেই রক্তের ধারাটা আমাদের পিছু পিছু আসছে। দৌড়ে অন্যদিকের গলিটায় ঢুকলাম। দেখলাম রক্তের ধারাটা সেদিকেও গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। রক্তের ধারাটাও দাঁড়িয়ে গেল।
আমি দু'হাতে কাজলরেখার মুখটা ধরে গভীরভাবে তাকে চুম্বন করলাম—আর সেই চুম্বন করতে করতেই টের পেলাম পায়ের পাতায় কেমন চটচটে স্পর্শ—অর্থাৎ আবার সেই রক্ত!
এইবার টের পেলাম সেই রক্তটা কি আশ্চর্যজনকভাবে আমার শরীর বেয়ে উঠে আসছে ক্রমশ—আর আমার গায়ে ফুটে উঠছে একটি একটি করে অসংখ্য সূচ। তীব্র বেদনায় আমার রক্ত মিশে যাচ্ছে সেই রক্তের সাথে—আর জমাট বাঁধছে সেই সূচগুলির বিদ্ধ মুখে—একে একে—বিন্দুতে বিন্দুতে। আর তখনই শুনতে পেলাম—
—'চমৎকার'!
—'বড়ো চমৎকার!'
অর্থাৎ ধর্মমতি শুকের কণ্ঠস্বর।
সাথে সাথেই যেন সমস্ত অন্ধকার কেটে গেল নিমেষেই। দেখলাম সামনেই কুসুমিত সূর্যাভাস।
আর সদ্য আলোকপ্রাপ্ত সেই দেবদারু শাখা। কিন্তু সেখানে কোনো ধর্মমতি শুক নেই।
—কথাগুলি ভেসে এলো আমার বাঁদিক থেকে। বুঝলাম আমার কাঁধে—হ্যাঁ শেষপর্যন্ত আমারই কাঁধে এসে বসেছেন ওই অদূরের ধর্মমতি শুক!
(কাহিনীটি দীনেশচন্দ্র সেন সংকলিত পূর্ববঙ্গ গীতিকার অন্তর্গত 'কাজলরেখা' নামক গাথাটি অনুসরণে রচিত।)
(পরবাস-৫৪, জুন ২০১৩)