কোনো কোনো সময় মনটা যে কোন তালে থাকে হদিশ করা মুশকিল। মনে মনে ভাবলে অশোক। কোনো কারণ নেই হঠাৎই মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টিমেদুর দিনে কোমল-ঋষভের করুণ ঝংকার। অথচ এরকম হওয়ার কোনো কারণই নেই। কতো বছর বাদে আজ দেখা হবে উর্বশীর সাথে। রবিবারের সকালে উঠেছে বেশ একটু দেরিতেই। এরমধ্যে সবায়ের চা-ব্রেকফাস্ট খাওয়া শেষ। বৌদির কাছে এখন চা চাইলে নির্ঘাত গালাগালি খাবে। তবু হাল না ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে-শুয়েই নরম সুরে ডাকলে - বৌদি, ও বৌদি। বৌদি নীলিমা রান্নাঘরে কাজ করছিল। সেখান থেকেই উত্তর দিল—'এতক্ষণে বাবুর ওঠার সময় হোল। এবার চা চাই, তাই তো? ওসব এখন হবে না। দেখছো না রান্না চড়িয়েছি। মাংসটা পুড়ে গেলে তখন তুমিই গালাগালি দেবে।'
সত্তরের কলকাতার নিয়মমাফিক রবিবারের সকালে বাতাসে ছড়াচ্ছিল পেঁয়াজ-রসুন মশলার ঝাঁঝালো গন্ধওলা মাংসের স্বাদ। পাশের বাড়ির মেয়েটার গলা-সাধা প্রায় শেষ। অন্যদিকে রবিবারের অলস সকালে অল্প-সল্প গাড়ির আওয়াজ, রিক্সার টুং-টাং, ভজুয়া জমাদারের উচ্চস্বরে ডাক—মাইজী, নালা পরিষ্কার হো গিয়া, পয়সাটা দিয়ে দিন। নরম স্বরে অশোক বললে—'আ-হা বৌদি, একটু চা করে দেবে না। জানোই তো আজ আমার বিশেষ দিন।' নীলিমার এই অবিবাহিত দেওরটির সঙ্গে স্নেহমিশ্রিত ভালোবাসার সম্পর্ক। তাই মুখে গালাগালি দিলেও সংসারের কাজে অকর্মণ্য অশোকের খুঁটিনাটি, ফাই-ফরমাসের ঝামেলা নীলিমাই নেয়। সে খবর অশোক ভালোভাবেই জানে। তাই কিছুক্ষণ পর চা আর দুটো বিস্কুট হাতে নিয়ে নীলিমা অশোকের ঘরে ঢুকে দেখে সে বাসি মুখেই সিগারেট নিয়ে বসেছে। তাকে দেখেই অশোক বলে ওঠে—
—কি চমৎকার দিনটা বলোতো আজ। আকাশ-বাতাস যেন একেবারে ঝকঝক করছে। আচ্ছা, বলোতো কি প্যান্ট-শার্ট পরি আজ? নাকি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরবো?
—সে ব্যাপারে বাবুর চিন্তা করার কোনো কারণ নেই - ব্যবস্থা আগেই হয়ে গেছে। এখন ঘুম থেকে উঠে চান-টান করে আমায় উদ্ধার কর।
—আ-হা বৌদি চটে যাও কেন। কালিদাসের বিরহিনী মেঘের সাথে কথা বলতে-বলতেই দিন কাটিয়ে দিতো, আর আমি না হয় একটু দেরিতেই ঘুম থেকে উঠেছি। জানো বৌদি, আজ তোমায় বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।
নীলিমা একেবারে ঝল্সে উঠলো। 'থাক্-থাক্, আর বৌদিকে সুন্দর দেখতে হবে না। বৌদির মধ্যে যার রূপ দেখছো তার কথা ভাব, বৌদি তোমায় সুন্দর দেখাচ্ছে।' একটা কপট মুখ ভাংচানি দিয়ে নীলিমা চলে গেল।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অশোক আর একটা সিগারেট ধরালো। নাঃ, বৌদিটা বড় ভালো। মনে মনে খুশি হয়ে উঠলো অশোক। আচ্ছা, উর্বশীকে সে কেমন দেখবে। প্রায় বছর কুড়ি আগে শেষ দেখা। এই ভাবতে-ভাবতে অশোক আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নাঃ, এই শেষ-তিরিশেও সে বেশ সুপুরুষ। এককালে ব্যায়াম করত সে নিয়মিত। তাই পেটা ছিপছিপে চেহারা। সাদা আদ্দির পাঞ্জাবী পরলে পাতলা কাপড়ের মধ্যে দিয়ে পেশীগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। স্যাণ্ডো গেঞ্জির ফাঁক দিয়ে রোমশ বুকের পুরুষালি ছাপ সুস্পষ্ট। তবে আয়নার একটু কাছে যেতেই অশোক দেখলে কালো চুলের ভাঁজে বয়স বাড়ার চিহ্ন। ভাবলে কুড়ি বছর তো কেটেছে। চুল পাকাটাই স্বাভাবিক। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বেশ খুশি-খুশি লাগছিলো, হঠাৎ মনে হোল, আচ্ছা, উর্বশীর বয়সও বেড়েছে। ওকে এখন কেমন দেখতে হয়েছে, কে জানে। মনের মধ্যে সেই কুড়ি বছর আগের ছবিটাই ধরা আছে। তবে সেটা বাস্তবে সম্ভব নয়। এইসব ভাবতে-ভাবতে অশোক জানলার ফাঁক দিয়ে ছোট্ট আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল অপলকে।
উর্বশীর সাথে আলাপ হওয়ার মধ্যে কোনো বিশেষত্ব নেই। উর্বশীর দাদা শুভ আর অশোকের একই পাড়ায় থাকার সূত্রে ছিল একেবারে গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। সেই সুবাদে অশোক ওদের বাড়ি গেছে বেশ কয়েকবার। ওদের বাড়িতে উর্বশীর সাথে দেখা হয়েছে—কখনও দাদার বন্ধুর জন্য চা এনে দিয়েছে। কখনও হাসিমুখে বলেছে—'ভালো আছেন? দাদা তো এখন বাড়ি নেই।' কিছুই মনে হয় নি। কথায় বলে প্রথম দর্শনে প্রেম। অশোক আর উর্বশীর প্রেম-টা প্রথম দর্শন তো দূরের কথা, বহু দর্শনেও জমে ওঠে নি। তারপর বিধাতার এক অজ্ঞাত মুচকি হাসিতে অবস্থাটা পালতে গেল প্রায় রাতারাতি। সেদিন রবিবারের সকালে শুভোর বাড়িতে গেছে নিছকই আড্ডা মারার জন্য। কলিং বেলে চাপ দিতে উর্বশী দরজা খুলে দিল। আশ্চর্যের ব্যাপার অশোকের মুখের দিকে তাকিয়ে সে দ্রুত মুখ নামিয়ে নিল। কিন্তু সেই ক্ষণিক চাহনির মধ্যে কি যে একটা ছিল তা বলে বোঝানো মুশকিল। এতদিন সে উর্বশীকে বন্ধুর বোন বলেই জেনেছে, নেহাতই ফ্রক থেকে শাড়ি-ধরা একটা বাচ্চা মেয়ে। কিন্তু আজকে তাকে ছোটো মেয়ে বলে উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। পরে উর্বশীর কাছে শোনা যে তার নাকি অশোকের প্রতি আকর্ষণ অনেক দিন থেকেই ছিল, কিন্তু সেদিনই তার প্রথম প্রকাশ। অশোক পরে অনেক ভেবেছে, কেন সে উর্বশীর দিকে আগে নজর দেয় নি। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণে লম্বা, ছিপছিপে চেহারা। ডানাকাটা পরী না হলেও তাকে স্বচ্ছন্দে সুন্দরীর দলে ফেলা যায়। তাছাড়া তার আধো-ঘুমন্ত চোখের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে।
মাঝ-সত্তরের কলকাতায় প্রেম করাটা বেশ পুরোনো পন্থায় চলতো। এতদিন শুভোর বাড়ি যেতে-আসতে উর্বশীর সাথে দেখা হোত, কোনো অসুবিধেই ছিল না। কিন্তু এখন তাতে আর মন ভরে না। এদিকে উর্বশী ক্লাস ইলেভেনে পড়ে কমলা গার্লসে, সকালে স্কুলের বাসে যায় আর বিকেলে আসে। দেখা করার সুযোগ নেই। বিকেলে-সন্ধেয় আছে টেস্ট আর, ফাইনালের জন্য পড়াশুনো। সুতরাং সারাদিনে দেখা করার ভাগ্যে শূন্য। এদিকে ওর বাড়ি বেশ কন্সারভেটিভ। তাই পরীক্ষার আগে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি বলে লুকিয়ে দেখা করার সুযোগ কম। খুব অল্পই মাঝে-মাঝে দেখা হ'লে লুকিয়ে হাতে-হাতে ভাঁজ করা চিঠি, লম্বা দৃষ্টির আদান-প্রদান আর সবাইকে এড়িয়ে টেলিফোনে অল্পস্থায়ী কথাবার্তা দিয়ে তাদের প্রেম এগিয়ে চলছিল গুপ্ত-স্রোতা ফল্গু নদীর মতো। ইতিমধ্যে উর্বশীর হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা শেষ। এখন স্কুল বন্ধ আর ফলের জন্য অপেক্ষা। তার ফলে যেটুকু দেখা হোত তাও শেষ। প্রতিদিন কলেজ থেকে বাড়ি আসার পর অশোক তির্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, আর পিপাসু দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে উর্বশীদের দোতলার বারান্দার দিকে।
অশোক একদিন মরিয়া হয়ে ঠিক করল সে উর্বশীর সাথে দেখা করবেই। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে গেছে যে উর্বশী নর্থ ক্যালকাটার কোথায় এক পিসিমার বাড়ি থাকতে গেছে সপ্তাহখানেকের জন্য। অশোক শুভোর কাছে ঠিকানা জেনে নিয়ে কিছু বলা-কওয়া নেই হুট করে একদিন সেখানে গিয়ে হাজির। সেই পিসিমার ব্যাপারটা ধরতে খুব বেশি সময় লাগে নি। কিন্তু তিনি উর্বশীর বাবার বোন হলে কি হয় আদৌ তার মতো রক্ষণশীল নন। ওদের দু-জনকে বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখে উনি ভিতরে ঘরের কাজে গেলেন। প্রথমে চলল দু-জন দু-জনকে দৃষ্টি দিয়ে শুষে নেওয়ার পালা। তারপর অশোক মুখ খুলল।
—পরীক্ষার রেজাল্ট তো প্রায় বেরিয়ে এলো। কি করবে ঠিক করেছো?
—আমি আর পড়াশুনো করব না। নাচ করব।
—নাচ করবে, তার মানে? তুমি তো পড়াশুনোয় বেশ ভালো। ভালো কলেজে ঢুকতে অসুবিধে হওয়ার কোনো কারণ নেই।
—না, আমি নাচ শিখব ভালোভাবে। সেটাই আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য।
অশোক জানতো যে উর্বশী নাচ শেখে। পরীক্ষার জন্য কয়েকমাস বন্ধ আছে। চিঠিতে বা কথাবার্তায় উর্বশী নাচ শেখার কথা তুলেছে। কিন্তু প্রায় প্রত্যেকে বাঙালি মেয়েই বিয়ের আগে নাচ-গান ইত্যাদি শেখে। আর বিয়ের পর অধিকাংশই তা ভুলে যায়। এটা কোনো বড়ো ব্যাপার নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে যে উর্বশী এত সিরিয়াস সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না।
—তোমার যে নাচের ব্যাপারে এতো উৎসাহ সে কথা তো জানতাম না।
—আমি ছোটবেলা থেকে ওড়িশি শিখেছি গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের এক শিষ্যর কাছে। উনি চিরকাল বলেছেন - তোমার রক্তে নাচ আছে। তোমার নাচ দেখে আমার সেই পুরাকালের রম্ভা-মেনকা-উর্বশীর কথা মনে পড়ে। তাদের কিংবদন্তী নাচ তো দেখা সম্ভব নয়, কিন্তু আজও আমাদের দেশে কারোর নাচের প্রশস্তি করতে গেলে স্বর্গে ইন্দ্রের রাজসভার এই তিন নর্তকীর উদাহরণ দেওয়া হয়। আমি আমার গুরুর কাছে শেখা সবকিছুই তোমায় দিয়েছি। আর নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। তাই আমি চাই তুমি আরো ভালোভাবে শেখো। আরও এগোও। তোমার নামের যথার্থ মর্যাদা দাও।
অশোক চুপ করে শুনে যাচ্ছে। আবেগে উর্বশীর চোখ যেন আগুনের মতো জ্বলছে।
—আমি খোঁজ পেয়েছি পুরীর কাছে এক বহু পুরোনো গুরুকুলের। সেখানে আছেন ওড়িশির এক প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক। আমি তাঁর সাথে যোগাযোগ করেছি। আমার একার কথায় কিছু হত না। কিন্তু আমার বর্তমান গুরুজীর অনেক চেষ্টার পর উনি আমায় শিষ্যা করে নিতে রাজী হয়েছেন। আমাকে ওঁনার কাছে নাড়া বাঁধতে হবে। থাকতে হবে গুরুকুলে ওঁনার অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে, সেই পুরাকালের মতো। বাড়ির লোকেরা একেবারে খড়গহস্ত, অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছি।
বাতাসে কোথায় যেন পূরিয়ার সুর বাজছে, বেলা পড়ে এলো।
—কতদিন তোমায় ওখানে থাকতে হবে?
—জানি না। প্রথমে বছর দুয়েকের মতো। তারপর গুরুজী যদি চান, তাহলে আরো কতদিন, জানি না।
—তাহলে আমাদের কি হবে?
এ প্রশ্ন শুনে উর্বশী অনেকক্ষণ চুপ করে থেকেছে, কোনো উত্তর দিতে পারে নি।
—তাহলে আমার চেয়ে তোমার নাচ বড়?
এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব উর্বশী দিতে পারে নি। খালি মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে থেকেছে।
এর কিছুদিনের মধ্যে হায়ার সেকেণ্ডারির রেজাল্ট বেরিয়েছে। উর্বশী ভালোভাবে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। অশোক একটা দামী পেন উর্বশীকে পাঠিয়ে দিয়েছে শুভোর হাত দিয়ে। কোনো উত্তর নেই। এইভাবে সপ্তাহ দুয়েক কাটার পর একদিন ভোরবেলা উর্বশীর ফোন - 'কাল সন্ধে সাতটায় একবার আসতে পারবে রাসবিহারীর মোড়ে পাকড়াসীর দোকানের সামনে?'
—ডাকলে কেন? আমিতো ভাবছি তুমি ভুলেই গেছো। শুভোকে দিয়ে চিঠি পাঠালাম, উত্তর নেই, পেন পাঠালাম অভিনন্দন জানিয়ে। তাতেও কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
—তোমার কোনো দোষ নেই। তোমায় কিছুদিন আগে বলেছিলাম যে আমি নাচের জন্য জীবন উৎসর্গ করব। বলেছিলাম অনেকখানি আবেগের মাথায়। কারণ তখনও জানি না যে এর মানেটা কি। এখন সেই বাস্তবটা একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনের সপ্তাহে আমি চলে যাচ্ছি। মা-বাবা-ঘর-বাড়ি, আমার এতদিনের অভ্যস্ত শহুরে জীবন, সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাচ্ছি এক অজানা-অচেনার উদ্দেশে। তার ওপর আছ তুমি।
বেশ কিছুক্ষণ তারা চুপচাপ হাঁটল রাসবিহারী অ্যাভেনিউ ধরে। ল্যান্সডাউনের মোড় প্রায় এসে গেছে। ডানদিকে ঘুরলে ঢাকুরিয়া লেক, প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিভৃতে মেলা-মেশার জায়গা, আর বাঁ-দিকে ঘুরলে বাড়ি ফেরার রাস্তা। মোড়ে পৌঁছে তারা একটু থমকে দাঁড়িয়ে বাঁ-দিকে ঘুরল।
—তাহলে কি আমাদের যোগাযোগ এখানেই শেষ?
এই প্রশ্নে উর্বশী মাথা তুলে অশোকের দিকে তাকালো। ল্যান্সডাউন রোডের সেই বহুদিনের পুরোনো চাইনিজ রেস্তোরাঁটার সামনে অল্প আলো এসে পড়েছে ফুটপাথে। তার সামনে মাথায় ফেজ টুপি-পরা একটা লোক টুলে বসে ঝিমোচ্ছে। খরিদ্দার এসে দাঁড়ালেই সে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকে লাল দরজাটা খুলে ধরছে, আর ভেতর থেকে এক ঝলক আলো ছিটকে এসে পড়ছে বাইরে। সেই স্বল্প আলোয় অশোকের মনে হল উর্বশীর চোখ-ভরা জল। একটু ধরা গলায় সে বলল।
—না, না, তা নয়। চিঠি লিখো। আমি ঠিক উত্তর দেব। তোমার যা ব্যাপার। হয়তো একদিন সেই পিসির বাড়ি চড়াও হওয়ার মতো গিয়ে হাজির হবে। ও রকম পাগলামি এক্কেবারে নয়।
সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ অশোকের। কি দরকার ছিল উর্বশীর পেছনে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানোর। নিজের কি কোনো প্রেস্টিজ বলে কিছু নেই। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে শরীর ভাল নেই অজুহাত দেখিয়ে না খেয়ে-দেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিল। পরের দিন ছিল রবিবার। অনেক বেলা করে উঠে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগল। মজার কথা হল, মাথাটা ঠাণ্ডা হওয়ার পর দেখল যে মনে মনে সে উর্বশীকে এর মধ্যেই ক্ষমা করে দিয়েছে। সত্যিই তো, সে যদি ভালো নাচে, ভবিষ্যতে নাচ করে নাম করতে চায়, তাহলে এইভাবে মন-প্রাণ দিয়ে তালিম নেওয়া ছাড়া আর উপায় কি। তবে উর্বশীর মনের জোর দেখেও সে কম আশ্চর্য হল না। বাড়ি-ঘর, সম্ভবতঃ ভালো কেরিয়ার থাকবে, কি খাবে তার কিছুরই ঠিক নেই। খালি আছেন কে এক গুরুজী। মনে মনে সে উর্বশীকে শ্রদ্ধা না করে পারল না। ঠিক আছে এইভাবেই চলুক না তাদের দূরপাল্লার প্রেম।
উর্বশীর চিঠি এল প্রায় মাসখানেক বাদে।
প্রিয় অশোক, এ এক অদ্ভুত জায়গা। গুরুজীর বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। তা সত্ত্বেও উনি রোজ ভোর পাঁচটায় ওঠেন। পুজো-টুজো সেরে শিষ্যদের নিয়ে নাচ শেখাতে বসেন। সারাক্ষণ খালি নাচ আর নাচ, সারাক্ষণ শুধু তবলা আর মুখে তালের বোল, আর গান। এসব কবে কোথায় রচিত হয়েছিল কে জানে। হয়তো এ গানের সঙ্গেই ইন্দ্রের সভায় রম্ভা-মেনকা-উর্বশীরা নাচতো, এখনও নেচে চলেছে। এই নাচ-গানের মধ্য দিয়েই বোধহয় মন্দিরের দেবদাসীরা ভগবানের কাছে নিজেদের উৎসর্গ করতেন। আমরা আছি মুষ্টিমেয় কয়েকজন মেয়ে। থাকি বোর্ডিং স্কুলের মতো, একসাথে। খাওয়া-দাওয়া, ওঠা-বসা সবই একসাথে। এখানে আমি ছাড়া বাঙালি আর কেউ নেই। গুরুজী অল্প-স্বল্প হিন্দি বলতে পারেন। আমিও তথৈবচ। প্রথম প্রথম অসুবিধে হলেও তাই দিয়েই আমি এখন দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছি। আসলে ভাষার বিশেষ কোনো দরকার নেই। সারাদিন চলে নাচের তালিম। আমরা ভুল করলে গুরুজী নিজেই নাচের মুদ্রা দেখিয়ে দেন। এইভাবেই চলে দুপুর পর্যন্ত। তারপর দুপুরের খাওয়া, আর একটু বিশ্রাম, তারপর বিকেলের চায়ের সাথে অল্প কিছু জলখাবার খেয়ে নিয়ে আবার নাচ। তারপর রাতের খাওয়া খেয়ে সেদিনের মতো ছুটি। একমাত্র রাত ন-টার পরই কিছুটা সময় হাতে পাওয়া যায়। তাও দশটার মধ্যে সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে হয়। আবার পরের দিন ভোর ছ-টার মধ্যে ওঠা। এখানকার ডিসিপ্লিন খুব কঠোর।এতদিন আমি যে পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছি, তার সাথে এই জগতের কোনো সংযোগ তো দূরের কথা, কোনো সাদৃশ্যই নেই। এক গণ্ডগ্রামে গুরুজীর আশ্রম, কয়েকটা ছোট ছোট বাড়ি নিয়ে। বাড়ি বলতে কুঁড়ে ঘরের একটু ভালো এডিশন। গ্রামের অন্য লোকজনের অবস্থাও প্রায় একই। এখনও অনেক ঘরে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। এই গ্রামের সাথে বাইরের পৃথিবীর একমাত্র সংযোগ কিছু দূরে একটা রেল স্টেশন যেখানে দিনে দু-তিনটে গাড়ি থামে, আর একটা পোস্টঅফিস। আমাদের আশ্রমে রেডিও, টি.ভি. কিচ্ছু নেই, খালি প্রতিদিন একটা খবরের কাগজ আসে, তাও ওড়িয়ায়। তবে দিনে একবার করে ডাক আসে। যার-যার মেল আসে তাদের সেদিন ভারি খুশির দিন।
এখানে এসে যে কোনো অসুবিধে হয় নি বললে মিথ্যে বলা হয়। প্রথম-প্রথম মনে হত ছুটে চলে যাই এখান থেকে, এইভাবে কি থাকা সম্ভব। যেতে পারি নি কেন জানো? আমার নাচ। আমার নাচই আমায় এখানে আটকে রেখেছে। তাছাড়া গুরুজী এর মধ্যেই মেয়ের মতো আমায় কাছে টেনে নিয়েছেন। ওঁর মতে আমার রক্ত-মাংস-মজ্জায়, শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে মিশে আছে নাচের ছন্দ। এখন আমার জীবনটাই শুধু নাচ, শুধুই নাচের ছন্দ, ঘুঙুরের আওয়াজ আর তালের বোল। হয়তো আমার আগের গুরুজীর কথা অনুযায়ী আমার নামের সার্থকতা অর্জন করতে চলেছি।
একমাসে অনেক পালটে গেছি, তাই না? যদি এর মধ্যে আমায় ভুলে না যাও, আর আমাকে ক্ষমা করে থাক তাহলে চিঠি দিও তাড়াতাড়ি।
তোমার উর্বশী
চিঠিটা হাতে পেয়ে অশোক বেশ ধাঁধায় পড়ল। উর্বশীকে সে ক্ষমা করে দিয়েছে। ভুলেও যায় নি। আর চিঠি পড়ে উর্বশীর প্রতি ওর শ্রদ্ধা বেড়েছে, বই কমে নি। কিন্তু, এই সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে আছে কিনা, তা সে জানে না। মনের এই দোটানা নিয়ে চিঠির উত্তর দিতে বেশ দেরি হল।
নৃত্য সম্রাজ্ঞী, তোমাকে এ ছাড়া আর কি নামে ডাকি বল। তুমি তো এই সম্মান অর্জন করার পথেই এগিয়ে চলেছ। তোমায় যে ভুলি নি তার প্রমাণ এই চিঠি। আর, একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতেই বুঝতে পেরেছি তোমায় ক্ষমা করার কিছু নেই। তুমি তোমার প্যাশন চরিতার্থ করতে চাও, সেতো কোনো অপরাধ নয়। তুমি জীবনে যা চেয়েছ তাই পেতে যাচ্ছ, তা নিয়ে আমি খুশি ও গর্বিত। একবিন্দু বানিয়ে বলছি না, বা রাগ করে বলছি না। পুরাকালে শবরী রামের জন্য অনন্ত অপেক্ষায় বসেছিল ফল-হাতে। আমাদের ক্ষেত্রে চরিত্রগুলো একটু উলটে-পালটে গেছে। তবে এটা পুরুষ-শাসিত সমাজ তো, তাই আমার ভূমিকাটা লোকে মোটেই গৌরবের চোখে দেখে না। বরং উলটে বলে - তোর মাথা খারাপ আছে। তুই পুরুষ-মানুষ হয়ে একটা মেয়ের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছিস। তোর নির্ঘাৎ মাথা খারাপ। এই চাপ কতদিন সহ্য করতে পারব জানি না। আর যদি না পারি তখন তোমাকেই আমায় ক্ষমা করতে হবে। ভালো থেকো।অশোক
পু: তোমার সেই পিসিমা, যার বাড়ি আমি বিনা নোটিশে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম, তাঁর সাথে সেদিন রাস্তায় দেখা। ঠিক চিনতে পেরেছেন। আমি স্বাভাবিক কারণেই একটু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। উনিই নিজে এসে আমায় চেপে ধরলেন। সেদিন ভাল করে আলাপ হয়নি। কিন্তু এখন দেখলাম তোমার পিসি হলে কি হয়, ব্যবহারটা একেবারে বন্ধু মতো। এ-কথা - সে-কথার পর আমায় বললেন খুকুর জন্য অপেক্ষায় থেকে আর কি করবে, অন্য গার্ল ফ্রেণ্ড খুঁজে নাও। তাই নেব না কি?
প্রিয় অশোক, অন্য গার্ল ফ্রেণ্ড খুঁজে নেবে মানে, নিশ্চয়ই নেবে। তবে আমার কাছে অ্যাপ্রুভাল নিতে হবে মশাই। অল্প হলেও অধিকার তো কিছুটা আছে। সে কথা ভুলো না কিন্তু। বাড়িতে বাবার অসুখ, এই নিয়ে একটু চিন্তিত আছি। এতো দূর থেকে কিছুই করতে পারি না।উর্বশী
নৃত্য সম্রাজ্ঞী, গার্ল ফ্রেণ্ড-ট্রেণ্ড জুটলো আর কোথায়! সুতরাং তোমার অ্যাপ্রুভাল নেওয়ার এখনও কোনো প্রয়োজন হয় নি। তবে সেদিন কলেজের একটা মেয়ে একটু উঁকি-ঝুঁকি মারছিল। কি, লেগে যাবো নাকি?তুমি এখানে থাকার সময় যা পারিনি তাই করলাম। সেদিন তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তোমার মা দেখলাম আমায় চেনেন, অর্থাৎ আমাদের ব্যাপার জানেন। দুঃখ করছিলেন কোথায় কোন বন-বাদাড়ে পড়ে আছে। কি, না নাচ শিখবো। এই কলকাতা শহরে কি নাচ শেখাবার লোকের অভাব আছে। আমাকে অনুরোধ করলেন যদি আমি তোমার মত ফেরাতে পারি।
তোমার বাবা এখন ভালো আছেন। ভালো ডাক্তার দেখছেন। তোমার চিন্তার কারণ নেই।
অশোক
প্রিয় অশোক, তুমি দেখতে-শুনতে ভাল। ভাল স্টুডেন্ট। আমার কপাল পুড়ল বলে। ও, বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম - আমাদের গুরুকুলে বছরের শেষে অ্যানুয়াল প্রোগ্রাম হয়। চারপাশের গ্রাম থেকে বড়-বড় লোক, জমিদার ইত্যাদিরা আসেন, নাচ ভালো লাগলে প্রাইজও দেন। সামনের মাসেই সেই অনুষ্ঠান। এখানে সাধারণত উঁচু বিভাগের মেয়েরাই সোলো নাচ করার সুযোগ পায়। গুরুজীর আদেশে আমাকেও একটা করতে হবে। এটা প্রায় অভুতপূর্ব ব্যাপার। অনেকেই আমায় খুব উৎসাহ দিচ্ছে, আবার কারোর কারোর যে ঈর্ষা হচ্ছে তা বুঝতে পারি।তোমার উর্বশী
পুঃ অনেকদিন তোমার চিঠি পাই নি। আমায় কি ভুলে গেলে?
নৃ. স, নাঃ, নাঃ। পরীক্ষা-টরীক্ষা নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম, তাই চিঠি দেওয়া হয় নি। তা ছাড়া আজকাল চিঠি লিখতে গেলে কেমন আলসেমি এসে যায়। তোমার জন্য আমি সত্যি খুব গর্বিত। তোমার বিগ পারফরমেন্স তো এসে গেল। খুব প্র্যাকটিস করছো নিশ্চয়ই। আশা করি শীগগিরই একদিন তোমায় কলকাতার স্টেজে নাচ করতে দেখব, বড় বড় আর্টিস্টদের সাথে।কলেজের সেই মেয়েটা উঁকি-ঝুঁকি দেওয়া বন্ধ করেছে। বোধহয় অন্য কাউকে পেয়েছে।
অশোক
নৃ. স., ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেল প্রায়। পড়াশুনো করছি। দেখা যাক কি হয়। তবে আর পড়াশুনো করার ইচ্ছে বিশেষ নেই। একটা চাকরী পেলে নিয়ে নেব ভাবছি। তোমার নাচের কেরিয়ারে প্রমোশনের কথা জেনে খুব ভালো লাগল। এই যে তুমি একটা জিনিষ নিয়ে লেগে আছো, এটা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই। তাই চাকরি-বাকরিই বোধহয় ভাল। তুমি কি বল?
অশোক
প্রিয় অশোক, বেশ অনেকদিন চিঠি দেওয়া হয় নি। তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগেভাগে। আসলে সেই প্রোগ্রামটা নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলাম। রোজ তার জন্য লম্বা প্র্যাকটিস। গুরুজীর হুকুম, একেবারে পারফেক্ট হতে হবে। এই গুরুকুলে এটা একটা বিশাল ব্যাপার। এটা তো কলকাতা শহর নয় যে স্টেজ-ফেজ থাকবে। ঠাকুর-দালানের সামনে একটা মঞ্চ মত তৈরি করা হয়েছে। সেটা সাজানো হয়েছিল ফুল-পাতা দিয়ে, সেখানেই আমাদের নাচ। সেই মঞ্চের একধারে গায়ক-বাদকের দল, তার মধ্যেই গুরুজী বসে, মুখে নাচের বোল। স্টেজের অন্যদিকে একটা জগন্নাথ আর একটা নটরাজের মূর্তি। ওড়িশিতে সাধারণত জগন্নাথের মূর্তিই থাকে, কিন্তু এখানে নটরাজেরও সমান প্রতিপত্তি।এখানে না এলে বোঝাই যাবে না যে আমরা বিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষে এসে পৌঁছেছি। সেই পুরাকালের ভারতবর্ষের হাবভাব এখনও এখানে বোধহয় কিছুটা পাওয়া যাবে। আজ এখানে সবায়ের অবারিত দ্বার। মঞ্চের সামনে মাটিতে সতরঞ্চি পাতা সেখানে চারপাশের গ্রামের লোকজনের ভিড়। আর দু-পাশে মান্যগণ্য লোকেদের বসার জন্য চেয়ার পাতা। শুনলাম এখানে এখনও জমিদরি প্রথা চালু আছে ভালোভাবেই। তারা সব সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এসেছে নাচ দেখতে। ও বলতে ভুলে গেছি - নাচের শেষে অল্প জলযোগেরও ব্যবস্থা ছিল। তার আকর্ষণও নাচের চেয়ে কম নয়।
একেবারে প্রথমে আমরা পাঁচ-জন মেয়ে ওড়িশি নাচের সাজ-পোশাক করে মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, দুরুদুরু বুকে। বাইরে ভীমরুলের চাকের মত আওয়াজ উঠছে। হঠাৎ গুরুজী মঞ্চ থেকে হাত তুলতেই সব শব্দ থেমে গেল। আমরা লাইন করে ঢুকে প্রথমে জগন্নাথ ও নটরাজের মূর্তি ও তারপরে গুরুজীকে প্রণাম করে ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই শুরু হল গায়কের গানের সাথে বীণার তান আর মৃদঙ্গের দ্রিমি-দ্রিমি বোল - শুরু হল সমবেত বন্দনা। এর মধ্যেই থেকে থেকে চলল গুরুজীর মুখে নাচের বোল আর লয়কারী। আমার একার নাচ ছিল শেষের দিকে। আমি তো ভয়ের চোটে ঘেমে-নেয়ে একাক্কার। আমার সময় আসতেই মঞ্চে ঢুকতেই দেখলাম অন্যদিকে গুরুজী, মুখে একটা মৃদু হাসি, আর কানে এল গানের সুর আর মৃদঙ্গের তাল। ব্যস, তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। নাচ শেষ হতেই হাততালির পর হাতলতালি। এ সব আমার জন্য! আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে আছি দেখে আমাদের একটি মেয়ে আমায় ভিতরে নিয়ে গেল। অনুষ্ঠানের শেষে গুরুজীকে প্রণাম করতে গেছি, উনি আমায় দু-হাতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দেখি ওঁনার চোখে জল। একটু সামলে নিয়ে উনি বললেন এক স্থানীয় জমিদার আমার নাচ দেখে খুশি হয়ে কিছু টাকা উপহার দিয়েছেন।
চিঠিটা বেশ লম্বা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তোমায় সবকিছু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। তাছাড়া কাকেই বা আর বলি বলো! যাইহোক, সেই প্রোগ্রামের পর থেকে গুরুজী আমায় অন্য চোখে দেখতে আরম্ভ করেছেন। সেদিন আমায় পাশে টেনে নিয়ে ভাঙা-ভাঙা হিন্দীতে বললেন—আমার বয়স আশি ছুঁই-ছুঁই। এতবছর ধরে আমি একজনকে খুঁজছিলাম যাকে আমার গুরুর কাছে শেখা সবকিছু দিয়ে যেতে পারি। এতদিন অপেক্ষার পর আমি তোমায় পেয়েছি। তোমায় সবকিছু শিখিয়ে, এ জায়গার ভার তোমার হাতে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে পারব। বল, তুমি নেবে তো? স্বর্গ থেকে দেবতারা তোমার মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করবেন। লোকে ইন্দ্রের সভায় রম্ভা-মেনকা-উর্বশীর সাথে এই মর্তের উর্বশীর নাম করবে। বলো, তুমি থাকবে তো?
আমি তখন কোনো উত্তরই দিতে পারি নি। ভেবেছিলাম আর বছর-দুয়েক তালিম নিয়ে ফিরে আসবো। গুরুজী এ কি বাঁধনে আমায় জড়ালেন! আমি কি করি বল তো? চিন্তায়-চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছে না।
তোমার নৃঃ সঃ
পু: তুমি এত ভালো স্টুডেন্ট, এক্ষুনি চাকরি করবে কি! ও সব আইডিয়া মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
চিঠি পেয়ে অশোক একেবারে হতভম্ব। এর কি উত্তর দেয়! উর্বশীর জন্য সে পথ চেয়ে বসে আছে এ মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু মনের মধ্যে কোথায় ধারণা ছিল যে ও তো আর কয়েক বছর বাদেই ফিরে আসবে, তখন আবার সেই পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়া যাবে। কোনো তাড়া নেই। কিন্তু এর জন্য সত্যিই তার কোনো মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। অনেক কষ্টে মনকে শান্ত করে চিঠি লিখতে বসল।
প্রিয় উর্বশী, আমাদের সম্পর্কের মধ্যে চিরকালই একটা ছাড়া-ছাড়া ভাব আছে। তাতেই আমরা দু-জনে অভ্যস্ত। কিন্তু এখন সময় এসেছে সেই ভাবটাকে স্থায়ী করার। আমি চিরকালই তোমার উদ্যম, তোমার মেধা, তোমার পরিশ্রমী স্বভাবকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এসেছি। হয়তো এ সব আমার মধ্যে বেশ একটু কম বলে। আমি মনে করি এখন তোমার সামনে এক সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ায় কোনো মানেই হয় না। আমি জানি যে এর মানে আমার সাথে তোমার সম্পর্কের এখানেই শেষ। কিন্তু সামনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে এ কিছুই নয়। আমি রাগ-অভিমান করে এ কথা বলছি না, অনেক ভেবে এ কথা বলছি। তুমি অনেক বড় হবে, সারা দেশে সবাই তোমায় এক বাক্যে চিনবে। আর আমি ভাবব এক সময় আমি তোমাকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনতাম। কলকাতায় নাচতে এলে যদি খোঁজ পাই, তাহলে দেখতে আসব। দূর থেকে তোমায় দেখে, তোমার নাচ দেখে খুশি হয়ে হাততালি দেব। ব্যাক স্টেজে তোমার সাথে দেখা করতে যেতেও পারি। তখন তুমি অনেক লোকের ভিড়ে ব্যস্ত। আমায় দেখে দূর থেকে হাত নেড়ে কাছে ডাকবে। আমি কিন্তু সে ডাকে সাড়া দেব না। অতীতকে মনে রাখলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি হয়। আমি কিছুতেই তা করতে পারি না। তুমি আমায় খুঁজবে। কিন্তু আমি ততক্ষণে ভীড়ের মধ্যে হাওয়া। বেশ একটু ইমোশনাল হয়ে পড়ছি, কি বল?ভালো থেকো।
অশোক
এই চিঠির উত্তর আসতে বেশ অনেক সময় লেগে গেল। ছোট্ট একটা চিঠি।
প্রিয় অশোক, তোমার উপদেশটাই মেনে নিলাম। মাঝে-মাঝে যখন বাড়ি আসবো তখন কি তুমি দেখা করবে? ভালো থেকো।উর্বশী
এর পরে স্বাভাবিকভাবেই ওদের চিঠি চালাচালি বন্ধ। অশোকের মনে উর্বশীর প্রতি রাগের বিন্দুবাষ্পও দেখা দেয় নি। হতাশ হওয়ারও সে কোনো কারণ খুঁজে পায়নি। আসলে অশোকের স্বভাবটাই এ রকম। কোনো কিছুতেই যেন তার কোনো আঠা নেই। কোনো উচ্চাশাও নেই। তাই ভালো রেজাল্ট করে কলেজ থেকে বেরিয়েও একটা সাধারণ না হলেও কিছু আহামরি না-করার মতো একটা চাকরিতে ঢুকেছে। এতেই সে সন্তুষ্ট। মা-বাবা হারিয়েছে অনেক ছোটবেলায়। ভেসে যেতে পারতো, কিন্তু যায় নি প্রধানত ওর থেকে বেশ কিছুটা বড় দাদা আর বৌদির জন্য। মা-বাবা একটা ছোট বাড়ি রেখে গেছেন। সেখানে দাদা-বৌদির সংসারে থাকা। এরকম অবস্থায় সংসারে কতরকম গণ্ডগোল হয় - বাড়ির ভাগ নিয়ে ঝামেলা, ভায়ে-ভায়ে ঝগড়া, মুখ দেখা-দেখি বন্ধ ইত্যাদি। কিন্তু অশোকের এ সব কিচ্ছু হয় নি। বাড়ির একটা ঘরে তার পার্থিব যা সম্পত্তি তা নিয়ে থাকে। এ নিয়েও সে পরম নিশ্চিন্ত। কোনো অভিযোগ, কোনো অনুযোগ তার নেই। যেন এইভাবেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলেই হয়। বিয়ে-থা করার চিন্তা মাথায় আসে নি। মাঝে-মাঝে বৌদি কপট অনুযোগ করেছে—'এবার একটা বিয়ে করে ফেল, কতদিন আর আইবুড়ো কার্তিকঠাকুর হয়ে থাকবে।' কিন্তু এর বেশি কিছু এগোয় নি।
এইভাবেই প্রায় বছর কুড়ি কেটেছে। হঠাৎ একদিন কোথা থেকে একটা উড়ো চিঠি এসে হাজির। খামে কিছু লেখা নেই, খালি অশোকের নাম বাইরে লেখা। মনে হয় কেউ লেটারবক্সে ঢুকিয়ে দিয়েছে। খুলবে কি খুলবে না ভাবতে ভাবতে খামটা ছিঁড়ে খুলতেই বেরোলো এক টুকরো ভাঁজ করা চিঠি। তাতে বহুদিনের পরিচিত হাতের লেখা —
প্রিয় অশোক, আমায় কি মনে আছে? কতদিন তোমায় দেখি নি। কেমন আছো? খুব কি পালটে গেছ? একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করে বুকটা কিছুটা হালকা হল। আমি কলকাতায় এসেছি দু-একদিনের জন্য। হঠাৎই ঠিক হয়েছে। তাই আগে থেকে জানানোর কোনো সুযোগ ছিল না। ফোন করবো, সে সাহস হয় নি, যদি তুমি কথা না বল। একজন পরিচিতকে দিয়ে তোমাদের বাড়ির মেলবক্সে চিঠিটা পাঠিয়েছি। যদি ওখানে তুমি আর না থাকো, অথবা যদি কোনো কারণে এ চিঠি তুমি না পাও, তাহলে তোমার সাথে বোধহয়ও আর এ জীবনে দেখা হবে না।আগামী রবিবার রবীন্দ্রসদনে আমার নাচ আছে। যদি পারো তাহলে সন্ধে সাতটা নাগাদ ওখানে চলে এসো।
নৃত্য সম্রাজ্ঞী (দেখেছো, এতদিনেও তোমার দেওয়া নামটা ভুলি নি)
এর পর থেকেই বৌদির খুনসুটি আরম্ভ - কি কার্তিক ঠাকুর, এতদিনে আবার প্রেমটা বেশ জমে উঠল বলে মনে হচ্ছে। দেখো, তোমায় আবার গলায় দড়ি দিয়ে নাচের দলে না ঢুকিয়ে দেয়, ইত্যাদি।
অশোক বেশ একটু তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেল। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ছ'টা বেজে পাঁচ। আশ্চর্য হল যে এর মধ্যেই বেশ কিছু লোক জড়ো হয়েছে। নন্দনের সামনে আর ময়দানের দিকে দেওয়ালের গা ঘেঁষে দুটো মস্ত হোর্ডিং। তাতে উর্বশীর নৃত্যরতা ছবি, লেখা ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রতিভাশালী নৃত্যশিল্পী কুমারী উর্বশী। টিকিট ঘরের সামনে ইতিমধ্যেই বেশ একটা লম্বা লাইন পড়েছে। সেই লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেনার পর দেখে হাতে তখন মিনিট পনেরো সময় আছে। একটা সিগারেট খেলে হয়। কিন্তু, পকেটে হাত দিয়ে দেখলো ফাঁকা। লম্বা-লম্বা পা ফেলে অ্যাকাডেমির দিকে এগোলো অশোক। সেখানকার দেওয়ালের গায়ে সার দিয়ে চা-বিড়ি--সিগারেট-ফুচকা-ভেলপুরির দোকান। এ-সবের ওপর দিয়ে অ্যাকাডেমির বাগানের ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া খেজুর গাছের পাতা দেখা যায়। একপাশে আনতমুখে দাঁড়িয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথের প্রতিমূর্তি, এত বছরের ধুলোধোঁয়া, যানবাহনের কালিঝুলি, কাক-শালিখের বিষ্ঠা—সব মিলিয়ে এক বিচিত্র রূপ নিয়েছে।
নাচ-টাচ সম্বন্ধে অশোকের কোনো উৎসাহ নেই। সুতরাং এ-সব ব্যাপারে কিছুই জানে না। কিন্তু প্রতিটি নাচের শেষে যখন দর্শকদের হাততালি আর থামতেই চায় না, তখন অশোকের বুক গর্বে ফুলে-ফুলে উঠছিল। সত্যিই কি সম্পর্কটা এতদিনেও শেষ হয়ে যায়নি! আশ্চর্য! কিন্তু ও সবচেয়ে আশ্চর্য হল উর্বশীকে দেখে। বেশ খানিকটা দূর থেকে দেখা। কিন্তু ওর মনে হল এই কুড়ি বছরেও উর্বশীর কোনো পরিবর্তন হয় নি। সেই লম্বা ছিপছিপে চেহারা। সেই আকর্ষণীয় মুখশ্রী। তবে এ নিশ্চয়ই মেক-আপের কৃতিত্ব। মনে মনে ভাবল অশোক।
ড্রেসিং রুমেও ভিড়ে-ভিড়াক্কার, সে ভিড় ঠেলে এখনই ঢোকা তার সাধ্য নয়। বাইরে বেরিয়ে নন্দন চত্বরের বাইরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো অশোক। তখন নজর পড়ল একটা থামের ওপর কার যেন একটা ছোট আবক্ষ মূর্তি। কাছে গিয়ে পড়ে দেখল লেখা আছে 'বাবা আলাউদ্দিন খাঁ'। এ নামটা কোথায় যেন সে শুনেছে, ঠিক মনে করতে পারল না। আচ্ছা, সাংস্কৃতিক জগৎ সম্বন্ধে ওর এত কম উৎসাহের জন্যই কি উর্বশী ওকে ছেড়ে নাচকে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল!
এতক্ষণে ড্রেসিং রুমে ভিড় বেশ পাতলা হয়ে এসেছে। অশোক একে-ওকে সরিয়ে উর্বশীর দিকে এগিয়ে গেল। একটু এগোতেই সামনে তার প্রার্থিত জন। অশোককে দেখে উর্বশী মুখ তুলে তাকালো। হঠাৎ এই ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হলেও বোধ হয় অশোক এতটা আশ্চর্য হত না। পরনে নাচের জামা-কাপড়, কিন্তু মুখে মেক-আপ নেই। এ সেই কুড়ি বছর আগের দেখা উর্বশী, এক বিন্দুও পরিবর্তন হয়নি! সেই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের আকর্ষণীয় মুখশ্রী, সেই টানা টানা চোখ, সেই টান-টান মেদহীন চেহারা। এটা কি করে সম্ভব! তার নিজের তো চুল-টুল পেকে প্রায় আধবুড়ো চেহারা। না, এ অবিশ্বাস্য। উর্বশী অশোকের দিকে তাকিয়ে একটু মিষ্টি হেসে বলল—'একটু দাঁড়াও এদের শেষ করে দিই'।
অশোক বাইরে চলে এল উর্বশীর অপেক্ষায়, আর মনে ভিড় করে এল নানান চিন্তা। আজতো ওর বয়স প্রায় চল্লিশ। কিন্তু এখন ওকে সহজেই ষোল-সতেরো বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কারো কারোর বয়স বোঝা যায় না। কিন্তু এতটা কি সম্ভব! অশোক এই সব আকাশ-পাতাল চিন্তায় ব্যস্ত, হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো যৌবন ছুঁই-ছুঁই ভারী সুশ্রী এক মেয়ে। ঠোঁটের ওপর আঙুল চাপা দিয়ে সে বলল—'সবাইকে বিদায় করে দিয়েছি। বলেছি আমি নিজেই বাড়ি চলে যাবো। তবে এখানে কোনো কথা নয়। চলো, কোথাও কিছু খাওয়া যাক, ভীষণ খিদে পেয়েছে।'
চাং-ওয়া-র নামে উর্বশী ঠিক ছোট একটা মেয়ের মতো খুশি হয়ে উঠল—'কতদিন চাইনিজ খাই নি। সত্যি, ওখানে খাওয়াবে?'
ততক্ষণে প্রায় রাত ন'টা বাজে। আলো ঝলমলে পার্ক স্ট্রীটে কিন্তু ভিড়ের অভাব নেই। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে ওরা রেস্তোঁরায় ঢুকল। লোকজন কমে এসেছে, তাই ওরা বেশ নিরিবিলিতে একটা টেবিল পেয়ে গেল। এতক্ষণ পরে অশোক উর্বশীর দিকে ভালো করে তাকানোর সময় পেল।
—কি দেখছো হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে?
—তোমায় দেখছি, আর ভাবছি এটা কি করে সম্ভব!
—দাঁড়াও, দাঁড়াও, আগে খাবারে অর্ডার দাও। বলছি না, ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। তোমার যা ভালো লাগে তাই দাও।
অশোক ওয়েটারকে মেনু দেখে খাবারের অর্ডার দিল। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর উর্বশী মুখ খুললো।
—তুমি কি জানতে চাও তা আমি জানি। কিন্তু তার উত্তর দেওয়ার আগে তোমায় আমার একটা প্রশ্ন আছে। তুমি পুরাকালে ইন্দ্রের সভানর্তকী উর্বশীর গল্প জানো?
—জানি না। কিন্তু তা দিয়ে কি হবে?
—কি হবে তা আস্তে আস্তে বুঝবে। তার আগে গল্পটা একটু ধৈর্য ধরে শোন।
—ঠিক আছে। তবে শেষ হতে হতে খাবার না ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
—আঃ, শোনই না। সেই পুরাকালে মর্তে নর ও নারায়ণ নামে দু-জন খুব বিখ্যাত ঋষি ছিলেন। একবার তাঁরা তপস্যায় বসেছেন পৃথিবীর জনগণের কল্যাণে। দিন কাটে, মাস কাটে, বছর ঘুরে যায় তাদের তপস্যা আর থামে না। এই খবর স্বর্গে মহারাজ ইন্দ্রের কানে গিয়ে পৌঁছেছে। ইন্দ্র স্বভাবতই একটু ঈর্ষাকাতর, উনি ভাবলেন নর-নারায়ণ হয়তো আমার আসন টলিয়ে দেবেন। তাই তিনি মদনদেবকে পাঠালেন মর্তে খোঁজখবর নিতে। মদন তো বেশ কিছু অপ্সরী নিয়ে মর্তে এসে হাজির, আর তাদের নৃত্য-গীতে ঋষিদের তপস্যা ভঙ্গ হল। তাতে কিন্তু তাঁরা রাগ করলেন না। বরং মদনদেব যখন স্বর্গে ফিরে যাবেন তখন ঋষি নারায়ণ তাঁকে বললেন - আপনাকে কি আমরা খালি হাতে স্বর্গে ফেরত যেতে দিতে পারি। আমরা মহারাজ ইন্দ্রের জন্য একটা উপহার দিতে চাই। এই বলে ঋষি নারায়ণ নিজের উরুর ওপর একটা থাপ্পড় মারতেই এক পরমা সুন্দরী মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।
এর মধ্যে খাবার এসে হাজির। গল্পের স্রোতে বাধা পড়লো। প্লেটে খাবার নিয়ে খেতে-খেতে আবার গল্প শুরু।
—নারায়ণ বললেন—উরু থেকে এর জন্ম, তাই এর নাম উর্বশী। আমরা একে মহারাজ ইন্দ্রকে উপহার দিলাম। উনি খুব খুশি হবেন। এ খালি অসামান্য সুন্দরী তাই নয়, নৃত্য-গীতে এর সমান স্বর্গ-মর্তে আর কেউ নেই। তাছাড়া, এর আর এক গুণ আছে। এ চিরযৌবনা, মহাকাল একে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারবে না।
অশোক হাঁ করে গল্প শুনছে। সামনে যে খাওয়া-দাওয়া জুড়িয়ে জল হয়ে যাচ্ছে, তার কোনো খেয়াল নেই। চোখে একটা না-জানা, না-বোঝা অবিশ্বাসী দৃষ্টি। মনে মনে একটা সমীকরণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু অঙ্কটা ঠিক মিলছে না।
উর্বশী অশোকের হাতে একটা মৃদু ছোঁয়া দিয়ে বলল—
—এবার বলি আমার কথা, উর্বশী গাঙ্গুলীর কথা। তার আগে খেয়ে নাও। রাত হয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় যেতে-যেতে কথা হবে।
তাড়াতাড়ি খেয়ে, বিল মিটিয়ে দিয়ে ওরা হাঁটতে আরম্ভ করল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোড ধরে। রাত প্রায় দশটা, কলকাতা শহরটা ঝিমোতে আরম্ভ করেছে। কয়েকটা বাস, গাড়ি, ট্যাক্সি এ-দিক, ও-দিক ছোটাছুটি করছে। বাড়ি ফেরার তাড়ায়। তবে সকাল-সন্ধের মতো ঘাড়-পেট বোঝাই হয়ে নয়। পানের দোকানগুলোর ঝাঁপ টেনে দিয়ে দোকানদার ফুটপাথে বিছানা করে শোওয়ার যোগাড়-যন্তরে ব্যস্ত। রাস্তার আলোগুলোর অস্তিত্ব এমনিতেই বোঝাই যায় না। চোখ অভ্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু এখন অনেক দূর পর্যন্ত রাস্তার দু-ধারে আলোর মালার সারি। যদিও উড়ালপথের দাপটে দৃষ্টি আটকে যায়। একটা ট্যাক্সি ওদের সামনে এসে গতি কমালো। সর্দারজী জানলা দিয়ে মুখ বার করে জিজ্ঞাসা করলো—'কোথায় যাবেন?' ওদের হাতের ভঙ্গি দেখে গতি বাড়িয়ে এগিয়ে গেল।
এতক্ষণে উর্বশী মুখ খুলল।
—তোমায় আমি লিখেছিলাম যে প্রায় প্রথম থেকেই গুরুজী আমায় মেয়ের মতো স্নেহ করতে শুরু করেন। তারপর সেই বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমার নাচ দেখার পর উনি আমায় এক অদ্ভুত চোখে দেখতে আরম্ভ করলনে। সেই অনুভূতি তোমায় আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না। একদিন বললেন তুমি স্বর্গের উর্বশী মর্তে নেমে এসেছো। এ আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি তোমায় শিষ্যা হিসাবে পেয়েছি। আর একদিন আমি নাচ প্র্যাকটিস করছি আপন মনে। চারদিকে কি হচ্ছে কোনো হুঁশ নেই। হঠাৎ দেখি উনি অপলকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার অস্বস্তির একেবারে একশেষ। সে দিন সন্ধেবেলায় খাওয়ার পর নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে যাব, দেখি উনি সামনে দাঁড়িয়ে।।
—এ যে দেখি রহস্য-গল্পের মতো শোনাচ্ছে।
—রহস্যর এখনও কিছুই হয় নি। আমায় বললেন - বেটি, আমার ঘরে একবার আসবে? এ রকম অদ্ভুত প্রস্তাব শুনে তো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার অবস্থা। কিন্তু গুরুজীকে 'না' বলি কি করে। ধীরে ধীরে ওঁনাকে ফলো করে ওঁনার ঘরে গেলাম। ওখানে সবায়ের যাওয়া নিষেধ। সুতরাং বুঝতেই পারছো আমার মনের তখন কি অবস্থা। একটা ছোট ঘর, একপাশে একটা খাটিয়া, একটা দড়িতে ওঁনার কিছু কাপড়-জামা ঝুলছে। এই হচ্ছে আসবাবপত্র। আর অন্যদিকে মস্ত জায়গা। নানারকম দেব-দেবী আছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে চোখে পড়ে একটা মস্ত নটরাজ-শিবের পিতলের মূর্তি। আজ বোধহয় কোনো বিশেষ পুজোর দিন। সেই মূর্তির সামনে ধূপ-ধুনো জ্বলছে। উনি আমায় ভিতরে ঢুকতে বলে বললেন - 'প্রণাম করো'।
হাঁটতে হাঁটতে ভালো করে কথা বলা যায় না। কখন ওরা নিজেদের অজান্তেই রাস্তার ধারের একটা রেলিং-এর গায়ে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুরু করেছে। আকাশে গম্ভীর আওয়াজ করতে করতে একটা এরোপ্লেন উড়ে গেল। দিনের বেলায় শহরের হট্টগোলে কিছুই প্রায় বোঝা যায় না। এখন আওয়াজটা অনেকক্ষণ ধরে আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেল। একটা নেড়ি কুকুর রাস্তার ধারে কুণ্ডলি পাকাচ্ছিল, ওদের দেখে মাথা তুলে দেখে নিয়ে আবার চলে গেল কুণ্ডলির মধ্যে।
—আমি ঠাকুর প্রণাম করার পর উনিও করলেন। তারপর যা করলেন তা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি না। হঠাৎ উনি আমার পায়ের সামনে সটান মাটিতে শুয়ে পড়ে আমায় প্রণাম করলেন। আমার অবস্থা তখন দেখে কে! আমি পা সরিয়ে নিতে উনি দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে খাটিয়ার এক ধারে বসালেন। এতদিনে ওঁনার ভাঙা-ভাঙা হিন্দীতে আমি পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মা, তোমার মতো শিষ্যা পেতে আমার মতো গুরুরা সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজী। আমার পরম সৌভাগ্য আমি তোমায় পেয়েছি।
—ওরে বাবা, এ যে দেখি সত্যজিৎ রায়ের দেবীর মতো ব্যাপার। তোমাকে কি এবার পুজো-টুজো করেন নাকি?
—ব্যাপারটা কিছুটা তাই। আমি খাটিয়ায় বসে আছি, আর উনি আমার সামনে মাটিতে বসে হাতজোড় করে কথা বলে যাচ্ছেন। আমার অবস্থা বুঝতেই পারছো। তারপর উনি যা বললেন তা যতটা রহস্যময়, ততটাই অবিশ্বাস্য। কিন্তু তার আগে তুমি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি কি এখনো আমায় ভালোবাস?
হঠাৎ ঘটনার মোড়টা অন্যদিকে ঘুরতে অশোক একটু অস্বস্তিতে পড়লো।
—এখন সে কথা কেন? বেশতো তোমার গুরুজীর গল্প হচ্ছিল।
—না, না, দরকার আছে। সে কথা পরে বুঝবে।
—প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল, এখনও তোমার প্রতি আমার সেই আগের অনুভূতি আছে কিনা বলা সত্যিই কঠিন। তবে আমার জীবনে এখনও পর্যন্ত আর কোনো মেয়ে আসেনি। বৌদির সাথে খুনসুটির সম্পর্কটাকে তো আর ভালোবাসার বলা যায় না। তবে এতদিন দেখা হওয়ার পরও তোমার প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করছি সে কথা অস্বীকার করি কী করে। তাছাড়া তোমার নাচ দেখে বেশ একটা গর্ব হচ্ছিল, যেন এতে আমারও কিছুটা কনট্রিবিউশন আছে। একেবারে অবান্তর চিন্তা।
—না, না, একাবারেই অবান্তর নয়। আমার অনুভূতি এত বছরেও পাল্টাবার কোনো সুযোগই হয়নি। যাই হোক, আবার পুরোনো গল্পেই ফিরে যাই।
গল্প করতে করতে ওরা কখন আবার হাঁটতে আরম্ভ করেছে। প্ল্যানেটোরিয়াম ছাড়িয়ে প্রায় এলগিন রোডের মুখে। রাত প্রায় এগারোটা বাজে। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু, রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কোনো কোনো গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে ওদের দেখছে। একজন একটা কটু মন্তব্য করতেও ছাড়লো না।
—উনি বলে চললেন - আমার জন্ম এক মস্ত পুরোহিত বংশে, বংশ পরম্পরায় আমরা পুরীর জগন্নাথের মন্দিরের প্রধান সেবায়েত। তাই ছো্টবেলা থেকেই পুজো-অর্চনা, ভগবানে আমার অবিচলিত ভক্তি। অনেক ছোটবেলায় মন্দিরে এক দেবদাসীর নাচ দেখে নাচ শেখার প্রতি আকর্ষিত হই। তারপর আমার গুরু খুঁজে নেওয়া। তখনকার দিনে সে সব গুরুও ছিলেন! তাঁদের শিক্ষা, তাদের নৃত্যকলার প্রতি নিবেদিত প্রাণ এখন কল্পনাও করা যায় না। যাই হোক, এইরকম এক গুরুর কাছে আমি তালিম নিতে আরম্ভ করলাম, ও খুব সহজেই ওঁনার প্রিয়তম ছাত্র হয়ে উঠলাম। একিদন উনি আমায় পাশে ডেকে বললেন যে - এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আমার দিন শেষ হওয়ার মুখে। তার আগে আমি একটা গুপ্ত মন্ত্র তোমায় দিয়ে যাব। তুমি এই মন্ত্র তোমার প্রিয়তম ও সুযোগ্য ছাত্র ও ছাত্রীকে দিয়ে যাবে। আর যদি কাউকে না পাও তাহলে মন্ত্রটা তোমার সাথেই শেষ হয়ে যাবে।
—বাবা, এ যে সত্যজিৎ রায়কেও ছাড়িয়ে যায় দেখছি। কিন্তু এ গল্প শেষ হতে হতে যে রাত ভোর হয়ে যাবে।
উর্বশী একটু রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল - না, তা হওয়ার সুযোগ হবে না।
—যাইহোক, গুরুজী আমার দুই হাত ধরে বললেন আমার জীবনও তো শেষের দিকে। তার আগে আমি তোমায় সেই মন্ত্রটা দিয়ে যেতে চাই। সেজন্যই তোমায় এই বিশেষ দিনে এখানে ডাকা। আজ নটরাজ শিবের পুজোর দিন। তুমি সে মন্ত্র নেবে তো?
হঠাৎ অশোক রাস্তার অল্প আলোতে দেখতে পেল উর্বশীর চোখ দুটো যেন জ্বলছে, মুখের অবস্থা অবর্ণনীয়।
—কি হল তোমার, ঠিক আছো তো?
নিজেকে সামলে নিয়ে উর্বশী আবার নিজের কথায় ফিরে গেল - 'চল, কোথাও বসা যাক'। একটু খুঁজতেই রাস্তার ধারে একটা বাড়ির রোয়াক পেয়ে গেল। কাছেই পুলিশের থানা, সুতরাং ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আবার আরম্ভ হল উর্বশীর কাহিনি।
—আমি আর কি বলি। কী মন্ত্র, কেন মন্ত্র কিছুই জানি না। তাই বোকার মতো কোনোরকমে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে উনি যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। তারপর হাত ধরে আমায় সেই মূর্তির কাছে নিয়ে গিয়ে বসালেন। সামনে ধূপ-ধুনো জ্বলছে। আমায় হাত জোড় করে বসতে বলে গুরুজী পুজো আরম্ভ করলেন, আর আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে পুজো শেষ হওয়ার পর উনি আমার দিকে তাকালেন, চোখের দৃষ্টি প্রশান্ত, মুখে পরম শান্তি। আমার চোখের দিকে নিষ্পলকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বললেন - এই মন্ত্র নেওয়ার পর প্রথমবার উচ্চারণ করলে তুমি যা চাইবে তাই পাবে। আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণে ইচ্ছামৃত্যু, এই মরজগত ছেড়ে চলে যাবে একেবারে স্বর্গে। আমার গুরুকে তাই দেখেছি, এবার আমার পালা। আমি মন্ত্র উচ্চারণ করছি তুমি মনের মধ্যে গেঁথে নাও। অল্প কয়েকটি শব্দ। উনি বলে গেলেন আর আমি মনে মনে টুকে নিলাম।
অশোক একেবারে হতভম্ব হয়ে উর্বশীর কথা শুনছিল হঠাৎ যেন কি মনে পড়েছে এইভাবে পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট প্যাকেটটা বার করে একটা সিগারেট ধরালো - 'মগজে একটু ধোঁয়া না দিলে মাথায় এসব কিচ্ছু ঢুকছে না। আজকালকার যুগে এসব কি সম্ভব। যতসব গাঁজাখুরি গল্প চালাচ্ছো।'
—গাঁজাখুরি? এ ঘটনার তিনদিনের মাথায় গুরুকুলে একেবারে হৈ-হৈ কাণ্ড - গুরুজী হঠাৎ মারা গেছেন। ওঁনার ঘরে গিয়ে দেখি উনি শান্তভাবে খাটিয়ায় শুয়ে আছেন। মুখে-চোখে গভীর প্রশান্তি। এই ঘটনার পর গুরুজীর প্রধান শিষ্যা হিসাবে আমাকেই সেই গুরুকুলের ভার নিতে হয়। সঙ্গে অবশ্য আর একজন মহিলা ছিলেন যিনি আগে থেকেই এর অ্যাডমিনিসট্রেশনের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। আশ্চর্য আমি যে এসব পারবো তা কোনোদিন ভাবিনি। কিন্তু গুরুজী অবশ্যই জানতেন, তাই আমায় এই ভার দিয়ে গেলেন। প্রথম প্রথম পালাই পালাই মনে হলেও শেষ পর্যন্ত তাও সহ্য হয়ে গেল। এদিকে আমার নাচের খ্যাতিও বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই মাঝে-মাঝে এখানে ওখানে পারফর্মও করতে যেতে হয়। সুতরাং ব্যস্ততার কোনো শেষ নেই।
অশোক ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো—তোমার বাড়ির লোকেরা এ ব্যাপারে কি বলেছেন? তাদের মতামতের কি কোনো দাম নেই?
—ওরা কোনোদিনই আমার নাচের প্রতি ভালোবাসা বা ডেডিকেশনের ব্যাপারে কিছুই বুঝতে পারেন নি। খালি বলেছেন এই তো অনেক শিখেছিস, আর কি দরকার। এবার বিয়ে-থা করে ঘর-সংসার করাই তো ভালো। আমার পক্ষে বোঝানো সম্ভব হয়নি। শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আমি বেশ কিছুদিন অন্তর আসি অল্প দিনের জন্য। কিন্তু সম্পর্কটার আর বোধহয় বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া আর একটা ব্যাপারে ওঁনারা খুবই বিচলিত।
—সেটা আবার কি?
—সেটাতো তোমারও প্রশ্ন।
—কোনটা আবার? এত প্রশ্ন মনের মধ্যে আসছে, যে কোনটা আগে আর কোনটা পরে তা বোঝার ক্ষমতা আর আমার নেই।
—শোন। গুরুজী মারা যাওয়ার কয়েক বছর পরের ঘটনা। ইতিমধ্যে গুরুকুলের অবস্থা বেশ স্টেবল হয়ে এসেছে, আমারও বাজারে নর্তকী বলে বেশ নাম-টাম হতে আরম্ভ করেছে। একদিন আমার গুরুজীর কথা মনে পড়লো - প্রথমবার সেই মন্ত্র উচ্চারণ করলে আমি যা চাইব, তাই পাবো। এতদিন যে আমি নাচের ব্যাপারে স্বর্গের উর্বশীর নেম-সেক তা গুরুজীর মুখে বহুবার শুনেছিলাম। একবার পরীক্ষা করে দেখলে কি হয়। আরো ভালো নাচতে পারবো। মন স্থির, চোখ বন্ধ করে মন্ত্রটা উচ্চারণ করলাম।
অশোক উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে উঠলো—তারপর, তারপর কি হোল?
—কিছুই নয়। আমি যা ছিলাম তাই রয়ে গেলাম। ভাবলাম সবটাই বুজরুকি। কিন্তু গুরুজীর কথা মনে পড়তে তা মেনে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তবে পরিবর্তনটা বুঝতে পারলাম কয়েক বছর পর। আমাদের গুরুকুলেরই একটি মেয়ে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে দিল্লীতে তার বাড়ি চলে যায়। আমার সাথে যদিও চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। একদিন তার কাছ থেকে একটা চিঠি এসে হাজির। সে কাছেই কোথায় আসছে। আমার সাথে দেখা করতে চায়। সেখা হতেই সে অনেকক্ষণ ধরে হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। 'ইত্না সাল বীত গয়ে, লেকিন তুম্হারা কুছ ভী পরিবর্তন নেহি হুয়ে। হাউ ইস দিস পসিবল, বাতায়ো'।
অশোক উত্তেজিতভাবে বললো—তাহলে আমার দেখায় একটুও ভুল নেই?
—না নেই। আমি আমার নাচ দিয়ে স্বর্গের উর্বশী হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভুলে গেছিলাম যে উর্বশী অজর-অমর। তার নাচের মতো তার শরীরের চিরযৌবনও আমি পেয়েছি।
বলতে বলতে উর্বশীর গলা আবেগে ধরে এল।। আর অশোক উত্তেজনায় ওর হাত চেপে ধরে বললো—সে তো ভারী সুখের কথা। এ পেলে লোকে তো সব কিছু ছেড়ে দিতে পারে।
আস্তে আস্তে অশোকের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে উর্বশী শান্ত গলায় বললো—তাদের চিরযৌবন নেই বলে তারা এর দায়িত্বের ভার জানে না। আর সেই জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে আমি ঠিক করেছি আমি দ্বিতীয়বার সেই মন্ত্র উচ্চারণ করব। আর সেই জন্যই তোমায় ডাকা।
—জ্বালা কেন?
এ প্রশ্নে উর্বশী সোজা অশোকের দিকে তাকালো।
—তোমার চুলে অল্প পাক ধরেছে। বয়সোচিত চেহারা। এখন যদি আমি তোমায় বলি - আমায় বিয়ে করবে? তুমি রাজী হবে?
—কেন নয়? আমি তো খুব খুশিই হব। হয়তো আমার এতদিনের প্রতীক্ষা সফল হবে।
—তাই? আর যদি অন্যেরা তোমায় বলে বুড়ো বয়সে একটা ছুঁড়িকে বিয়ে করলি। তখন কি বলবে? যখন তোমার বয়স আরো বাড়বে আর আমি ছোট্ট খুকিটি থেকে যাবো, তখন কি করবে?
—অতদূর ভেবে বলিনি। সত্যি তো। এটা ভবিষ্যতে সমস্যা হতেই পারে।
—জানো, আমি কোনোদিন মা হতে পারবো না। আমার সন্তানের বয়স বেড়ে যাবে, কিন্তু আমি পাল্টাবো না। এবার জ্বালাটা কোথায় বুঝতে পারছো।
অশোক নিরুত্তর। গভীর চিন্তায় মগ্ন।
—কাল বাড়ির সবার সাথে দেখা করে এসেছি। খালি তোমার সাথেই দেখা করা বাকি ছিল। তুমি আমার সাথে স্বর্গে যাবে? ওখানে আমরা দু-জনে ঘর বাঁধবো। ওখানে কারোর বয়স বাড়ে না। তোমারও বাড়বে না। যাবে? আমি তোমার হাত ধরে যদি সেই মন্ত্র উচ্চারণ করি, তাহলে হয়তো তুমিও আমার সাথে যেতে পারবে। বলোনা গো, যাবে?
এই প্রশ্নের আকস্মিকতা ও অবিশ্বাস্যতায় অশোকের একেবারে বাক্রোধ হয়ে গেল। রোয়াক থেকে মুখ বাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানে নক্ষত্রদের মেলা। কেউ কেউ উজ্জ্বল হয়ে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করছে, আবার কারা অনেক দূর থেকে যেন হাতছানি দিচ্ছে। স্বর্গ কি ওখানে কোথাও? গেলে তো বোধহয় আর ফিরে আসা যায় না। তখন কি হবে? কয়েকটা বন্ধু-বান্ধব আছে, তাদের সাথে দেখা হবে না। বৌদিটাকে একবার টা-টা বলে আসারও সময় হল না। কাল সকালে এখানে ওখানে খোঁজ করবে, তারপর পুলিশে খবর দেবে কি হল তার প্রিয় দেওরের। আবার কিছুদিনের মধ্যেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে - এখানে অশোক মল্লিক বলে যে একজন চল্লিশটা বছর কাটিয়ে গেল, সে খবর ভুলতে লোকের একটুকুও সময় লাগবে না। তাছাড়া, এই প্রিয় কলকাতা শহরটা। একে আর কোনোদিনই দেখতে পাবে না। সেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথার কালো পরীটা, সেটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। সেই কালিঘাট থেকে ময়দানমুখী ট্রামটা আলিপুর হয়ে গান্ধীমূর্তি ডানদিকে রেখে ডালহৌসির দিকে এগিয়ে যাবে অন্যদিনের মতো। কত রবিবারে অশোক এই ট্রামে করে শহরের এ মাথা থেকে ও-মাথা করেছে স্রেফ নিরুপদ্রব মজার জন্য। হয়তো সেই চেনা কণ্ডাকটারটা অশোককে খুঁজবে। সেই শীতের অলস দুপুরে গায়ে একটা আলোয়ান জড়িয়ে দেশপ্রিয় পার্কে ক্রিকেট লীগের খেলা দেখা। কলকাতা শহরের এই সমস্ত ছোট-ছোট আনন্দগুলো অশোকের বড় প্রিয়। সেগুলোকে নিয়ে কি স্বর্গে যাওয়া যায়। এইসব আজগুবি চিন্তা করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে, হঠাৎ অশোক দেখে তার পাশে কেউ নেই। সে কি মেয়েটা গেল কোথায়। পাশেই তো বসে ছিল। এই প্রায় মাঝরাতে একা কোথাও যাওয়া বিপদজ্জনকও বটে। রোয়াক থেকে উঠে আসেপাশে একটু ঘুরে দেখে এল অশোক। কোথাও উর্বশীর টিকিও নেই। তাহলে গেল কোথায়। তাহলে কি এ সবই তার কল্পনা! সেই রোয়াকেই ফিরে গেল অশোক। চাঁদের আলোয় চারদিক একেবারে ঝকঝক করছে। আর তারা যেখানে বসেছিল সেখানে একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ চাঁদের আলো পোয়াচ্ছে। কাগজটা হাতে নিয়ে অশোক দেখে ওটা ছোট্ট একটা চিঠি।
প্রিয় অশোক, নিশ্চয়ই মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে যে আমার সাথে তোমার দেখা হয়েছিল। তোমার সাথে দেখা না করে কি আমি যেতে পারি! জানি এ জীবন ছেড়ে যাওয়াটা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু আমি আর পারছিলাম না গো। তাই চলে যেতে হল। আমায় কি মনে রাখবে? প্লীজ, রেখো। আমি দূর থেকে তোমায় দেখবো। তোমার বয়স বাড়বে, আর আমি তোমার ওয়ালেটে রাখা আমার ছবিটার মতো (কায়দা করে দেখে নিয়েছি মশাই) একই থেকে যাব।ভালো থেকো।
তোমার, উর্বশী (নৃত্য সম্রাজ্ঞী)
(পরবাস-৫৪, জুন ২০১৩)