বিখ্যাত ২৫শে বৈশাখের অনেক বছর পরে সেই তারিখেই কলকাতায় আর একজন মানুষ জন্মেছিলেন। একটু পরিণত বয়সে তিনি জন্মতারিখ নিয়ে কুণ্ঠাভরে একটি কবিতা লিখেছিলেন :
অধমরবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন
পঁচিশে বৈশাখ
সেই দিনে না হোক, সেই তারিখে
আমারো জন্মে বেজেছিল শাঁখ
পঁচিশে বৈশাখ!
কোথায় রবীন্দ্রনাথ!
ভালবেসে মূঢ় আত্মীয়বন্ধু গূঢ়
ভেবেছিল আমারো বা
বুঝি সেই ধাত।
কোথায় রবীন্দ্রনাথ!
কে খবর রাখে হায়
এই দিনে এ ধরায়
কত কোটি আরশুলা
কত লাখ টিকটিকি
পোকা আর মাকড়েরা
জন্ম নিল এ জগতে
দুর্গন্ধ নর্দমায়
একই দিনে আমাদের এ ধরায়
আমি পোকা মাকড়ের জাত
এতে ছিল না মোর হাত
তবু যদি পেয়ে থাকি
রবীন্দ্র জন্মদিনে তার
কিছু ছোঁয়া দিল, হোক ক্ষীণ মলিন
তারে আমি বুকে ধরে রাখি।জ্ঞান 13.9.87
জ্ঞান নামক এই ব্যক্তিটি প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। এই আশ্চর্য নামটি কে দিয়েছিলেন জানি না। কিন্তু তাঁর কথা ভাবলেই মনে পড়ে প্রাণোচ্ছল অদম্য আকুল আগ্রহে জ্ঞান অন্বেষণ আর অকাতরে স্বতঃস্ফূর্ত ফোয়ারার মতন সর্বদিকে সর্বস্তরে তা বিতরণ! বিশেষত সঙ্গীতের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানের কি নিপুণ গভীর প্রবণতা! সদাব্যস্ত কর্মচঞ্চল প্রাণশক্তিতে ভরপুর কণ্ঠে, নানা যন্ত্রে সতত সৃজনশীল! বিশেষতঃ বিশুদ্ধ ছন্দের শিল্প—তবলায়!
কী করে দেখা হল, এবং পরে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হল এই আশ্চর্য মানুষটির সঙ্গে?
ছেলেবেলা থেকে গানবাজনা শোনার, শেখার সখ ছিল আমার। পড়াশোনার ফাঁকে বিচ্ছিন্নভাবে মাঝেমাঝে কিছু শিখেছি। তখন স্কুলে পড়ি। এক দিদি বাড়িতে গান শিখতেন। সঙ্গে হীরুবাবুর এক ছাত্র তবলা বাজাতেন। একটু দেখে দেখে তবলা বাজাতাম। একটু একটু প্রাথমিক বোল জানলাম। তবলা বাজাতে ভালো লাগত। তারপর প্রধানত বিজ্ঞান পড়ে ১৯৫০-এ পদার্থবিজ্ঞানে এম. এস. সি পাশ করলাম। বিজ্ঞান কলেজে পড়ার সময় এক বোনঝির সঙ্গে সঙ্গীতগুরু যামিনী গাঙ্গুলীর কাছে গান শিখতাম। মনে বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা ছিল জ্ঞানবাবুর কাছে তবলা শেখার। কিন্তু কি ভাবে তাঁর নাগাল পাব তার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। সঙ্গীতজ্ঞ বিমলা প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আমার দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বিমলদা অগ্রজপ্রতিম আত্মীয়ের মতন ছিলেন। তাঁকে ছেলেবেলা থেকেই মাঝেমাঝেই বলতাম জ্ঞানবাবুর কাছে তবলা শিখতে চাই। তাঁর কাছে নিয়ে যেতে বলতাম। তিনি বলতেন "তুই মন স্থির কর ভালভাবে - তবে নিয়ে যাব। নানা জিনিস করতে গেলে কিছুই করা হয় না।" ভবিষ্যৎ বাণীটা ঠিকই ছিল। নানা শিক্ষা শুধু ছুঁয়ে ছুঁয়ে গিয়েছি। দক্ষ হতে পারিনি। কিন্তু ছাড়তেও পারিনি। বিমলদা নিয়ে গেলেন না। যামিনীবাবুকে তবলা শিখতে চাই বলার সাহস হল না। যদিও তাঁরা দুজনেই জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
সুযোগ ঘটলো অন্য পথে। ১৯৫৪ সালের শীতকালে Science Congress-এ প্রসিদ্ধ পদার্থবিজ্ঞানী P. A. M. Dirac সস্ত্রীক কলকাতায় এলেন। আমি তখন কলকাতা সায়েন্স কলেজে অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর তত্ত্বাবধানে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণারত। মাস্টারমশাই আমাকে ডিরাক-দম্পতির আতিথ্যের ভার দিলেন। ডিরাক পত্নী সঙ্গীতানুরাগী। সত্যেন্দ্রনাথও সঙ্গীতানুরাগী। জ্ঞানপ্রকাশ-প্রতিষ্ঠিত 'ঝঙ্কার' সঙ্গীত-সংস্থার সভাপতি। মাষ্টারমশাই বললেন জ্ঞানবাবুকে গিয়ে বল্ একটা গানবাজনার ছোট আসর করতে ডিরাকদের শোনার জন্য। ডিরাক মেমসাহেব গানবাজনা ভালবাসেন।
আমি একলাফে ঝড়ের বেগে সায়েন্স কলেজ থেকে 'প্রাচী' সিনেমার পিছনের গলি ডিক্সন লেনে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাসভবনে উপস্থিত হয়ে তাঁকে মাষ্টারমশায়ের বক্তব্য জানালাম। তিনি চট করে তাঁর বাড়িতে তাঁর প্রতিভাধর ছাত্র প্রসূন ব্যানার্জীর গান এবং প্রতিভাবান যুবক সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর বাজনার একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন!
ডিরাক-দম্পতি ও মাষ্টারমশাইয়ের সঙ্গে আমিও জ্ঞানবাবুর বাড়িতে বসে মহানন্দে সেই অনুষ্ঠান শুনলাম। সেই থেকে শুরু। আর কোনও বাধা রইল না। জ্ঞানবাবুকে আমার তবলা শেখার আকাঙ্ক্ষা জানালাম। কয়েকদিনের মধ্যেই শিক্ষা শুরু হল।
১৯৫৫ সালে—তখন আমার সাতাশ বছর পূর্ণ হয়েছে। আলাদা করে বসিয়ে দিলেন। জোড়াসনে বসলাম মাঝখানে তবলা বসিয়ে বাঁদিকে বাঁয়া বসিয়ে; নিজে সামনে আর একজোড়া তবলা বাঁয়া নিয়ে বসলেন। অবর্ণনীয় কৌশলে অতি যত্নে আমার হাতের পাতার মাপ অনুযায়ী তবলা বাঁয়ার উপর ঠিকভাবে হাত রাখতে শিখিয়ে দিলেন। বললেন "দেখ - তবলার তিনটে অংশ - কিনার (কানি), মাঝ ও গাব।" প্রধানত তর্জনি ও মধ্যমা দিয়ে কিভাবে আঘাত করলে বাণীর সঠিক স্পষ্ট ধ্বনি উৎপন্ন হবে নিজে বাজিয়ে দেখিয়ে দিলেন। গাবের উপর মাঝে মাঝে তিনটি বা চার আঙুল ফেলে, কোন কোন বাণী উৎপন্ন হবে দেখালেন। বললেন, "যতবার আঘাত করছ, আঙুল যেন ঠিক জায়গায় পড়ে ধ্বনি যেন perfect হয়।" পরে পুরো হাতের পাতা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠর চলনে ধেরে ধেরে কি করে বাজাতে হয় দেখালেন। তবলাতে ত, ব, ক, ট আর বাঁ হাতে ক, ঘ, গ। বাঁয়াতে বাঁ হাতের তর্জনি আর মধ্যমা অনামিকা জুড়ে কি করে ধী ধী-র বেশি বা কম জোরে বাজবে দেখালেন। গাবের ওপর তর্জনী ও মধ্যমা জুড়ে আঘাত করেই তুলে কী কী করে সুর বাজবে—বিশদভাবে শেখালেন। অনেকদিন অনেককে শেখাবার অভিজ্ঞতালব্ধ সেই শিক্ষাদানের পারদর্শিতা অর্জিত। খাতার উপর প্রথম বোল দিলেন—
ঘেঘে তেটে ঘেঘে তেটে, তাগে তেটে তাগে তেটে, কতেটে ঘেতেটে ঘেঘে,
তেটে কতা ঘেঘে তেটে। ঘে ঘে-র তলায় ২, ১ লিখে কখন দু'আঙুল কখন এক আঙুল পড়বে বুঝিয়ে দিলেন। সুর, স কানি কি বোলের নিচে লিখে দিলেন। এই প্রথম বোলে সব কটা আঙুল এর অনুশীলন সম্ভব, বাঁয়ার আঘাতের জোর আর হাল্কাও বোঝা যায়। প্রথম দিনই মনটা উদ্দীপিত হয়ে উৎসাহে ভরে উঠল। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রথম পর্ব-এর মতো পদ্ধতি। প্রাকটিকাল। Precise!
গুরুভাইরা ছিলেন পরবর্তীকালের খ্যাতনামা তবলিয়া কানাই বাবু, শ্যামল বোস, শঙ্কর ঘোষ, দিলীপ দাস, সর্বকনিষ্ঠ মানস দাশগুপ্ত, যে পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর তবলার অধ্যাপক হয়েছে। সকলের সঙ্গেই খুব ভাব হয়ে গেল। ২, ১ করে দু'আঙুল এক আঙুল বোঝানো, বোল লেখা দেখে, বয়োজ্যেষ্ঠা প্রথম শিক্ষার্থী ছাত্রীকে কিভাবে গুরু ধ্বনি ফুটিয়ে তুলছেন দেখে ওরা মজা পেত। বলতো "কি স্পষ্ট ধ্বনি! ওস্তাদের নিজের হাতে ফেলা তো!" ওদের সকলকে শেখানোর সময় আমি বসে দেখতাম, শুনতাম। আগে অন্য গুরুর কাছে শেখার ফলে দক্ষ অভিজ্ঞ কানাইবাবুর হাত যে তফাৎ হয়েছে--তাঁকে নতুন পথে বিশেষভাবে শেখাতেন। ধেরে ধেরে শেখানোর জন্য কাঠের উপর নিজের হাতের চলন দেখিয়ে--কাগজের উপর আঙুলে কালি মাখিয়ে ছাপ দিয়ে হাতের পাতার অবস্থান ও চলন পদ্ধতি দেখিয়েছিলেন। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্য বুঝে সেই অনুযায়ী শিক্ষাপদ্ধতি নির্ধারণ করতেন। এবং অক্লান্ত ভাবে নিজে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাজিয়ে যেতেন। প্রত্যেকদিন ক্লাস দেখাটা একটা উৎসব উপভোগ করে শিক্ষা লাভ। আমাকে ধারাবাহিক ভাবে বোল দিতে লাগলেন যাতে ক্রমশ ধ্বনি স্পষ্ট হয় হাতের চলন সাবলীল হয় লয় বোধের উন্নতি হয়। সেই পরিবেশের প্রভাবে আমি নেশায় মেতে গেলাম। ভোর ছ'টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খাওয়া ও অন্য কাজের বিরতি ছাড়া তবলা অভ্যাস করতাম। সায়েন্স কলেজে কাজের পর ডিক্সন লেনে চলে যেতাম। অবারিত দ্বার। ঘরে উৎসাহী ছাত্রদের দিয়ে ভরা ঘর। মধ্যে ততোধিক উৎসাহী গুরু! ছুটির দিনেও যেতাম। 'ঝঙ্কার' এর সভ্য হয়ে নানা গুণী গায়ক বাদক ও তবলিয়াদের অনুষ্ঠান শুনতে লাগলাম ঘরোয়া পরিবেশে। তাছাড়া, রেডিওতে, টেপ-এ নানা শিল্পীর গানবাজনা শুনতাম জ্ঞানবাবুর সঙ্গে বসে। তিনি শিল্পীদের নানা খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলতেন—মন্তব্য করতেন। আর সমালোচনা করে যেতেন মজার মজার কথা বলে।
এক মহিলা শিল্পী গাইছেন--বললেন "উঁহু, এখনই গোলাম আলির মতন গাইতে চেষ্টা করলে চলবে কেন? ওঁর এত বড় গোঁফ, সেটা পাবে কোথায়?" কখনও বলতেন, "একবারেই সিন্দুকে যা আছে সব বার করে দেখিয়ে দিলে চলবে কেন?--তারিয়ে তারিয়ে একটু একটু করে দেখাতে হবে।" বলতেন "গানে maturity আসতে দেরী হয়। এটা প্রেসার কুকারে রান্না নয়, কাঠের উনুনে অল্প আঁচে ধীরে ধীরে রাঁধতে হয়। তার স্বাদই আলাদা।" কিন্তু ক্লাসে সব বয়সের সকলকে উঁচু স্তরের গানবাজনা শুনিয়ে যেতেন।
তবলা শেখাতে গিয়ে বললেন মুখে স্পষ্ট উচ্চারণে বোলের বাণী বলো, লজ্জা করবে না। মুখে স্পষ্ট উচ্চারণ না হলে তবলাও ঠিকভাবে ধ্বনি উচ্চারণ করবে না। তবলাকে ঠিকভাবে বলালে, তবে তবলা কথা বলবে। একথা বার বার বলেছেন। ছোট বড় সব ছাত্রছাত্রীকে সব কিছু শোনাতেন, শেখাতেন। বলতেন--"যে যা পারে নেবে--আগে ওস্তাদরা দিতেন না। কিন্তু চারদিকে ছড়িয়ে দিলেই ক্রমশ বাড়বে।" সব ছাত্রছাত্রী মিলে তাঁর তবলায়, গানে নিজের কত কম্পোজিসন--বড় ওস্তাদদের কাছ থেকে কালেকশন শুনতে পেতাম। 'ঝঙ্কার' এর সভ্য হয়ে গেলাম; সেখানে কত বড় বড় গুণী শিল্পীদের অনুষ্ঠান শুনলাম ঘরোয়া পরিবেশে। সব গুণী শিল্পীদের সঙ্গেই জ্ঞানবাবুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক--তাঁরা সকলে কত শ্রদ্ধা করেন--কিন্তু মানুষটা লাজুক ছিলেন। নিজের অনুষ্ঠান বেশী করতেন না এবং অনুষ্ঠানের আগে নার্ভাস হতেন, কিম্বা নিজেকে নিয়ে মজা করতেন। বেনারসে কবীর চৌড়াতে গিয়ে দেখেছি বড়ে মতি, গিরিজা দেবী, কণ্ঠে মহারাজ, শাম্তাপ্রসাদদের ঘরে ঘরে জ্ঞানবাবুর প্রশংসা এবং তাঁর খবর জানার আগ্রহ।
সেই সময়ে সপ্তাহে একদিন সঙ্গীতশাস্ত্রজ্ঞ সুরেশ চক্রবর্তী শাস্ত্রীয় সংগীতের বিভিন্ন দিকের তত্ত্ব আলোচনা করতেন এবং জ্ঞানবাবু practical demonstration দিতেন। আমরা শুনতাম। জ্ঞানবাবু সকালে বললেন "গলাটা শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষার মতন খারাপ আছে--কিছুই গাইতে পারব না", সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুনলাম অচেনা এক বাদ্যযন্ত্রে অপূর্ব গানের মতন সুন্দর বাজিয়ে শোনালেন। পরদিন জানতে চাইলাম কী বাজালেন, বললেন "এই তানপুরার ওপর গীটারের স্টীল দিয়ে বাজিয়ে দিলাম।" ম্যাক্সমূলার ভবনের অধ্যক্ষর আমন্ত্রণে তাঁর বক্তৃতা দেবার খবর শুনে আমার স্বামী সুরজিৎ সিংহের সঙ্গে আগে গিয়ে সামনের সিটে বসেছি। ঢুকে বললেন, "তোমরা এসেছ কেন? এসেছ তো সামনের সিটে বসেছ কেন?" বক্তৃতা শুনলাম অপূর্ব সুন্দর। আর একদিন বললেন "রাশিয়াতে গানবাজনা করতে যেতে হয়েছিল--স্টেজে উঠে 'জনগণমন' গাইতে গিয়ে ভয়ে হাঁটু এমন কাঁপতে লাগল--পাশের লোককে ধরে কোনমতে দাঁড়ালাম।" কেবল মজা করা, মাতিয়ে দেওয়া। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গুরুগম্ভীর ভাব নেই বন্ধুর মতন হৈ হৈ করে আনন্দ দেওয়া!
দু'বছর ডিক্সন লেনের অপূর্ব সাঙ্গীতিক পরিবেশে শিক্ষালাভ করার পর ১৯৫৯-এ নাগপুরে ছিলাম আমার সহপাঠী বন্ধু সুরজিৎ সিংহের সঙ্গে বিয়ের পর। শিক্ষায় ছেদ পড়ল তবে তানপুরা তবলা সঙ্গে ছিল--তবলার খাতাও ছিল। যা শিখেছিলাম নিজের মনে বাজিয়ে আনন্দ পেতাম। এক বছর পর কলকাতায় ফিরে আবার তবলার ক্লাসে যেতাম--তখন রাসবিহারী রোডের 'বাণীচক্র' স্কুলে। সেখানেও ক্লাসভর্তি গানের, তবলার ছাত্রছাত্রীতে ভরা সাঙ্গীতিক পরিবেশ।
১৯৬১-৬৪ আমেরিকায় ছিলাম। যাবার আগে জ্ঞানবাবু তখন পর্যন্ত যা শিখেছি টেপ-এ সবগুলো বাজিয়ে বোলগুলো নির্দেশ সহ বলে রেকর্ড করে দিলেন। আজও তা আছে আমার কাছে। ওখানেও বাড়িতে প্র্যাকটিস করতাম, কোনো কোনো বন্ধুকে শোনাতাম। তবলা ও গানের অন্যদের ক্লাসগুলিরও টেপ রেখেছি পরবর্তীকালেও যখন যেতে পেরেছি। সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমি (SRA)-তে তার কপি দিয়েছি তখনকার দিনে যেভাবে রেকর্ড করা সম্ভব ছিল সেইভাবে। ইঞ্জিনিয়র বললেন, "এরকম রেকর্ড সংরক্ষণ করে কি লাভ?" বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ছিলেন, বললেন "পঞ্চাশের দশকে জ্ঞানবাবুকে শোনার জন্য এগুলি অমূল্য।" যাইহোক, দিয়ে এসেছি। ১৯৯২ পর্যন্ত তাঁর কাছে যেতে পেরেছি।
ডিক্সন লেনের এক অতি মজার অভিজ্ঞতা। প্রায় দশ জন ছাত্রসহ জ্ঞানপ্রকাশের উদ্ভাবিত 'তবলার ড্রিল'! চৌতালের ১২ মাত্রার ঠেকা বাজছে - সঙ্গে সরল সুরের ধুন --
সা সা জ্ঞ স স সাম জ্ঞা স, স স স ম জ্ঞ জ্ঞ স স
। । । । । । । । । । । । ধা ধা ধিন ধা, কৎ ধাগে ধিন ধা, তেটে কতা গদি ঘেনে
এই সুরে ধুন চলেছে! সমবেত ভাবে ঠেকার ফাঁকে নানা বোলের প্যাটার্ন বাজিয়ে চলেছে। সারা ঘরে একটা অনাবিল আনন্দের ধারা বয়ে চলেছে। সবাই শুনে মজা পাচ্ছি। রেডিওতে প্রোগ্রামটা হয়েছিল। রেকর্ডও হয়েছিল। তখন শুনেছি আর শোনা যায় না। রেডিওতে নিশ্চয়ই সংরক্ষিত আছে। নিজের বিখ্যাত কম্পোজিশনে 'নিতাই খুড়োর ..', ও 'নগেনের গিন্নির ...' এছাড়াও 'আবোলতাবোল' এর 'গন্ধবিচার' দারুণ সঙ্গতিপূর্ণ সুর দিয়ে গেয়েছিলেন - তখন শুনেছি, আশাকরি সংরক্ষিত আছে। তাছাড়া 'বুড়ো বুড়ি দুজনাতে, মনের মিলে সুখে থাকত'-টাও সুর দিয়ে গেয়েছিলেন। হয়তো এসব মাঝে মাঝে রেডিওতে বাজে।
১৯৬৬-তে আমার সাত বছরের কন্যা সুকন্যাকে নিয়ে গেলাম 'বাণীচক্র'তে জ্ঞানবাবুর কাছে গান শেখাতে। তার ভালো গানের ক্ষমতা ছিল। আমিও আবার তবলা শিখতে শুরু করলাম, একটু একটু গানের ক্লাসে যোগ দিতাম। সুকন্যাকে 'তুমতো হো সাহিব'-এর মতো কঠিন কাজের টপ্পা তুলিয়ে দিলেন। অনেকেই গাইছিল। ছাত্রছাত্রীতে ভরা জমজমাট পরিবেশ।
সত্তরের দশকে আমার দশবছরের কনিষ্ঠা কন্যা সুপূর্ণাকে নিয়ে গেলাম তবলার ক্লাসে। যত্ন করে শেখালেন 'একটি গোলাপ গাছে ফুটিয়াছে কত ফুল...'। গানের ছন্দে তবলা শেখালেন। এমনি করে যোগাযোগ ছিল তাঁর শেষ জীবন পর্যন্ত।
'সৌরভ'-এও যেতাম। সব ক্লাসের টেপ করতাম। তখন তৈরি হচ্ছে নতুন গুণী ছাত্র অনিন্দ্য। এমনি করে ছাত্রধারা বয়ে চলেছে অনির্বাণ।
তাঁর গভীর স্তরের সৃজনী শক্তির নাগাল পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এমন বিচ্ছিন্ন অনুশীলনে দক্ষ তবলিয়া হবার ক্ষমতাও আমার নেই। উদ্দেশ্যও ছিল না। শুধু নিজের মনে আনন্দ পেয়েছি। সঙ্গীতের রসগ্রহণ করা, রসবোধ পরিশীলিত হয়েছে কিছুটা - এবং এই আশ্চর্য সঙ্গীতগুরুর সাঙ্গীতিক ব্যক্তিত্ত্ব এবং জীবনকথা জানার আগ্রহ হয়েছে। সেজন্য যথাসম্ভব দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তার ফলে সঙ্গীত সমালোচক জ্ঞানপ্রকাশের কিছু পরিচয় পেয়েছি। যা পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গীতানুরাগী মানুষদের কাজে লাগতে পারে ভেবে লিপিবদ্ধ করছি।
বার্ধ্যকে অনেকটা অশক্ত হয়ে যাবার পর ১৯৯৩ সালের ২৫শে বৈশাখ তাঁর জন্মদিনে 'হেমছায়া'তে তাঁর সঙ্গে প্রায় শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেদিন বাড়িটা ফাঁকা ছিল। কিছুক্ষণ আলোচনার পর তাঁর ঘরে বসে হাত বাক্সে রাখা অজস্র ডায়েরীর মধ্যে একটি তুলে আমার হাতে দিয়ে সুরজিৎকে বললেন "পূর্ণিমা আমার জীবনী লিখতে পারবে"। ডায়েরী জেরক্স করে রেখে ফেরৎ দিয়েছিলাম।
কাজটি অত্যন্ত দুরূহ। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে আলোচনার টেপ - সঙ্গীত শিক্ষা ক্লাসের টেপ ডায়েরীর পাতাগুলির কিছু সম্বল করে এই বিশিষ্ট মানুষটির কিছু পরিচয় তুলে ধরার প্রচেষ্টা করব। গুরুর এত যত্ন করে শিক্ষাদানের মর্যাদা দিতে পারিনি, নিষ্ঠাভরে চর্চা না করে। এটুকুও না করলে গুরুর ঋণভার দুর্বহ হয়ে উঠবে। আজ নিজে বিরাশি বছর সম্পূর্ণ করে বুঝতে পারছি তাঁর পক্ষে শেষ দিকে আলোচনা করা কত কঠিন হয়েছিল। তাঁর মন ও কর্মক্ষেত্রের বিচরণ অতি বিস্তৃত পরিসরে। ধারাবাহিক ভাবে সেই জীবনকথা না লিখে, কিছু টুকরো ঘটনা, ডায়েরীর পাতার নানা চিন্তার কথা, যে-সাক্ষাৎকারে অল্প বয়সের কথা বলেছেন সে কথাগুলি লিখে তাঁর ব্যক্তিত্ত্বের কিছু পরিচয় দেবার প্রচেষ্টা করব।
১৯৭৫-৮০তে সুরজিৎ যখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য ছিলেন, জ্ঞানবাবু অতিথি অধ্যাপক রূপে একবছর সেখানে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কিছু কথা:
১৯৭৭-৭৮-এ সঙ্গীতের একটা সেমিনারে আমন্ত্রিত কয়েকজন সংগীত শিল্পীকে আমাদের বাড়িতে অর্থাৎ উপাচার্যর কোয়ার্টার 'পূর্বিতা' বাড়িতে আমরা নিমন্ত্রণ করেছিলাম। অমলাশঙ্কর, কপিলা বাৎসায়ন, শান্তিদেব ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, মানস ও মমতা দাশগুপ্তর উপস্থিতিতে আমাদের অনুরোধে জ্ঞানবাবু তাঁর বিখ্যাত রচনা 'নিতাই খুড়োর মুখে দিনরাত তত্ত্বকথা' এবং 'নগেনের গিন্নীর দাঁত কনকন' আবৃত্তি করে তবলায় বাজালেন। ঘরে হাসির হুল্লোড় শুরু হল - অমলাদি বললেন - 'word গুলো না বললেও তবলাতে সব কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।' আমরা সকলের মন্তব্যসহ পুরো অনুষ্ঠান টেপ করলাম। মাঝে মাঝে বন্ধুদের শুনিয়ে প্রভূত আনন্দ পাই।
তাঁর ডায়েরীর পাতাগুলির বিন্যাস অপরিবর্তিত ভাবে রেখে পড়লে বিস্তৃত ক্ষেত্রে তাঁর সতত সৃজনশীল বিচরণের চিত্রটা ফুটে ওঠে। আমাদের ক্লাসগুলিও তেমনি হত। কিছু তবলার কম্পোজিশন - কয়েকটা গানের রচনা। কিছু প্রচলিত, কিছু স্বরচিত বন্দিশ, কবিতা, বাংলা ও ইংরিজী - নানা বিষয়ে নানা চিন্তা - ইত্যাদি লেখায় ভরপুর। তারিখ এবং স্থান গুছিয়ে লেখা। তাঁর ক্লাসগুলির টেপ-এও একই রকম উত্তেজিত ভাবে গান, তবলা, কথাবার্তা!
ডায়েরীর পাতা : (তবলার বোল):
তা ক্রা-ন ধা তেরেকেটেতাক ধেরেধেরে ধেরেধেরে তা ক্রা-ন ধেরে ধেরে তে - ধেরে ধেরে ধে - ধা ধিন ধিন ধা (ত্রিতালের এই কম্পোজিশন মজা করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বারবার বাজাতেন। তার পরেই তারানা গান) —
তা না-দেরে না- তা-না-দেরে না- (তারপরে ভাটিয়ার রাগে)উচট গয়ি .. (বড় ছাত্রছাত্রীরা গাইতেন)
(ক্লাসে হারমোনিয়ম নিয়ে তারসঙ্গে অপূর্ব বাজনা কিছুক্ষণ। পরে ছোটদের জন্য ইমন রাগে - গুরু বিন ক্যায়সে ...) ঘন্টার পর ঘন্টা অক্লান্ত গেয়ে চলেছেন।
তার পরে তবলা প্রসঙ্গে লেখা। ১৯৮৭ অক্টোবর:
"পৃথিবীর সব দেশেই সভ্যতার আলো প্রকাশ পেয়েছে প্রথম ভাষার উচ্চারণে। এবং লেখাপড়ার পূর্বেই মানুষ অনুভব করেছে ছন্দের দোলা বা তার শিরায় শিরায় তন্ত্রে তন্ত্রে এবং আনন্দ অনুরণন। আবৃত্তি আসে আগে, তার পরে চাক্ষুষ লেখাপড়া।"গদ্যের পূর্বে আবৃত্তি এবং ছড়া। কবিতা, সাহিত্যে প্রথম পদক্ষেপ। -- নৃতত্ত্বে আমাদের এই কথাই বলবে। তাহলে আমার বক্তব্য দাঁড়াচ্ছে, এই, যে মানুষ সভ্যতার আলোয় প্রথম যে দোলা অনুভব করেছে দৃশ্যের নড়াচড়ার ভিতরে বা শব্দ বা নাদের অনুরণনে। Visual movement এর মধ্যে বা sound movement-এর মধ্যে - অর্থাৎ impact চাক্ষুষ বা শাব্দিক?
"কারণ নৃত্যের মধ্যেও পাওয়া যায় ছন্দ এবং নাদের মধ্যেও ছন্দ প্রতীয়মান। যাইহোক, ক্রমশঃ প্রথমে ছড়া, কাব্য এবং পরে সাহিত্যর উপর মানুষের যখন অখণ্ড অধিকার এসে গেল এবং সঙ্গীতে কণ্ঠের সঙ্গে যখন সুরের যন্ত্র এবং চামড়ার বা মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ, মাদল, খোল, তবলা ইত্যাদি percussion বাদ্যযন্ত্রের বিভিন্ন উন্নততর যন্ত্রের উদ্ভাবন স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটতেই থাকল।
"পৃথিবীর মধ্যে নানা দেশেবিদেশে অসভ্য অবস্থা থেকে সভ্য এবং কৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে এসে পর্যন্ত মানুষ তার সৃষ্ট সঙ্গীত সমাজে চামড়ার বাদ্যযন্ত্র নানা আকারে প্রকারের তৈরি করেছে এবং বাজিয়ে চলেছে। Culture বা সংস্কৃতির ধারার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক দেশের বা অনেক জাতির চিন্তাধারার মধ্যে প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় চামড়ার বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ও ছন্দের রূপায়নে মানুষের কণ্ঠনিসৃত ধ্বনি থেকে উৎসারিত স্বরকে কাজে লাগিয়ে একটা একটা বাদ্যরীতি প্রবর্তন করার চেষ্টা করে থাকবেন হয়তো কোনো কোনো দেশের বাদকেরা। শব্দের টুকরো নিয়ে ছন্দের লঘুগুরু বা হ্রস্ব ও দীর্ঘ ছন্দ ব্যঞ্জনার আবৃত্তির দ্বারা ছন্দ সৃষ্টির একটা আনন্দ উদ্ভাবনার ধারা সৃষ্টি হল - যার উৎস সাহিত্যে এবং কবিতা এবং ছড়ার সংস্কৃতি থেকে উৎপন্ন বলা যায়।
"কিন্তু মৃদঙ্গ বা তবলার যে বোল ক্রমে ক্রমে আজকের দিনে পুরাতন কাল থেকে বহু বিবর্তনের ভিতর থেকে প্রকাশমান হচ্ছে তার ভিতরের গভীরে স্বরোচ্চারণের সৃষ্টির ধারার মধ্যে যে নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছন্দ উদ্বেলিত হয়ে চলেছে কালে কালে তা একটা বিশেষ discipline বা শাস্ত্রের প্রস্তুতির অপেক্ষা রাখে। যার জন্য লয়-তাল-ছন্দ ইত্যাদির বিশেষজ্ঞদের seminar বা আলোচনা সভার সুষ্ঠু প্রয়োজন।
জ্ঞান 13.10.87"
...."মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ বোধহয় আনন্দ।
"উপনিষদেও আশাকরি এই কথাটারই আভাষ আছে। এই যে 'আনন্দ' সেটা হৃদয়ের অনুভূতির ব্যাপার। অন্য কোনও ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণে একে ব্যক্ত করা যায় না। কারণ, এ জিনিস বস্তুগ্রাহ্য নয় বাহ্য নয় বলে।"... ইত্যাদি অনেক কথা।
"তবলা শেখানোর ব্যাপারে আমি বলি যে আমি যখন ওস্তাদদের কাছ থেকে পাখোয়াজ বা তবলা শিখেছি এবং নানা বর্ণ সম্বলিত শব্দ বাণীর ব্যবহারে রচনা করেছি, তখন শুধু আঙ্কিক চিন্তার দ্বারা আমার রচনাকে গঠিত বা গ্রন্থিত করি নি। আমার রচনার মধ্যে প্রধান লক্ষ্য চিরকালই শব্দ-বাণী-ধ্বনির আক্ষরিক উৎকর্ষ এবং তার থেকে উদ্ভুত আনন্দের দিকেই থেকেছে। এ আনন্দ শ্রুতি এবং মন এবং এদের সমন্বয়ে ছন্দবোধের সূক্ষ্ম রসানুভূতির দ্বারা পরিপুষ্ট হয় সন্দেহ নেই। অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে মহাশূন্যে অবস্থিত অনন্ত আকাশকে ছন্দ বিভাজনে খণ্ডিত করে তবলার বোল রচনার মধ্যে একটা আঙ্কিক বা calculative বা mathematical কার্য আছে। যুগে যুগে calculative factor-টাই বিজ্ঞানভিত্তিক সমস্ত চিন্তায় ও ক্রিয়ায় মানুষের ক্রিয়াত্মক প্রবৃত্তিকে আচ্ছন্ন করে রাখে, তা রাখুক। কিন্তু আমি দেখেছি এবং অনুভব করেছি যে বায়ুস্তরের যে কোনো ধ্বনির তরঙ্গসৃষ্টি কোটি কোটি মানুষের কানের ভিতর দিয়ে সেখানকার যন্ত্র মারফৎ যে মস্তিষ্কের মধ্যে যে অনুভূতির অবস্থায় পৌঁছে যায় শব্দের প্রকৃত অনুভূতির প্রকৃতি সব ক্ষেত্রে এক নয়। চোখ, কান, নাক, জিভ, গাত্রচর্ম ইত্যাদির বা সাম্যিক একত্ব থাকে। কানের দ্বারা যে অনুভূতি মাথার মধ্যে কাজ করে তার অনুভূতির প্রকৃতি বোধহয় একটু বেশি রকমের সূক্ষ্ম এবং পৃথক।"
(Visual artist বলতে পারেন রামধনুর সাত রঙের মাঝে অনেক সূক্ষ্ম রঙ আছে। কিন্তু তার প্রয়োগ স্বরের মতো আঙ্কিক নিয়মে চলে না। - পূর্ণিমা সিংহ)
পরের পাতায় :
"Tabla flourish
1. Phonetically 2. Rhythmically 3. Musically 4. That is technologically"
"সংস্কৃতি
"সংস্কৃতি হচ্ছে কতকগুলি শুভ সত্যের সম্মেলন। যে চারুকলাত্মক সৃষ্টির বা fine art-এর মধ্যে সেই সৃষ্টিরই মাহাত্ম্য বেশি যার আনন্দ অপরিমিত। যার পরিমাপ বোধহয় অসম্ভব।" 20.9.87
"'নগেনের গিন্নী' আর 'নিতাই খুড়ো' বোল রচনার তাল-oriented চেষ্টার খুব একটা প্রচার না হলেও দেশ বিদেশে সমাদৃত হওয়ায় আমি খানিকটা খুশী নিশ্চয়ই। বিশেষ করে দুটি ঘটনার আমি উল্লেখ করতে চাই —
"একটা হল বহুদিন আগে পাটনা থেকে আমার ডাক আসে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে সঙ্গীত শাখায় সভাপতিত্ত্বের জন্য। উদ্যোক্তা ছিলেন পরম আশীর্বাদক রঙীন হালদার মহাশয়। যেতে হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে একটি সাংস্কৃতিক তথা সাঙ্গীতিক জলসায় ঁ রাধিকা মোহন মৈত্রের সঙ্গে আমি তবলা বাজিয়েছিলাম। এবং 'নগেনের গিন্নী' এই গল্পটা বাজিয়ে শুনিয়েছিলাম। চিরকাল মনে রেখেছি সেদিন ঁ তুলসী লাহিড়ী-র প্রশংসা আমার রচনা শোনার পর।
"দ্বিতীয় ঘটনা হল বড়ে গুলাম আলী খাঁ কিছুদিন আমার পিতৃভবন ২৫ ডিক্সন লেনে দয়া করে অবস্থান করেছিলেন। হয়তো ১৯৫৫র পরে কোনো এক সময়। সেই সময়ের আমার রচনা 'নগেনের গিন্নী'র বর্ণনা ও তবলা বাজানো বিশেষ করে 'গণ্ডা গণ্ডা খোকাখুকু'(র) জায়গায় গুলাম আলী খাঁ সাহেব অট্টহাস্যে এমন লুটিয়ে পড়লেন যে আতঙ্কে আমার প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায় আর কি। খাঁ সাহেব হাসি সম্বরণ করলেন - আমি বাঁচলাম।
"এবার তৃতীয় স্মরণীয় ঘটনা - আমাদের গুরুদেবকে তাঁর তদানীন্তন অবস্থানে রূপালী বোনের বাড়িতে তাঁকে শোনাতে হয়েছিল তবলায় 'নিতাই খুড়ো'র বোলটা পড়ে এবং বাজিয়ে। তেহাই এর সময়ে উনি 'গুরু দক্ষিণা দে' বাণীটি শুনে ঠাট্টা করে বললেন "এটা কি আমি ব্যাটা গুরুকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে?" কি নির্মম রসিকতা গুরু সুদিন মিত্রের।"
(এই পাতার নীচে ডায়েরীর পাতায় দুটি কবিতা লিখেছেন)
"কবিতা তো ছন্দের রানী গদ্য কিন্তু তার রাজা আমি জানি জ্ঞান 20/9/87
যে দান জোর করে দেয় পিছনে রয় আশা - প্রশংসা তো আসেই না আসে অপভাষা।"(টেপ থেকে রচনা দুটির বাণী লিখে দিচ্ছি)
"নিতাই খুড়োর মুখে দিনরাত তত্ত্বকথা ধরে ধরে খদ্দের কানে কানে মন্তর দেন তারিনী-তারো মা দীনে তক্ষুনি ধরে ঘাড় ট্যাঁকে মেরে টান হেঁকে কয় গুরু দক্ষিণা দে গুরু দক্ষিণা দে গুরু দক্ষিণা দে
"নগেনের গিন্নীর দাঁত কনকন্ মাড়ি টন্টন্ মাথা ঘোরে দিনরাত কর্ত্তাকে ঠোকে খ্যাঁদা নেকো মর্কট গণ্ডা গণ্ডা খোকাখুকু ঢ্যাঁকে কানাকড়ি নেই ডাক্তার ডাকা নেই মরি খেটে খেটে নগেনের গিন্নীর দাঁত কন্কন্ মাড়ি টন্টন্ মাথা ঘোরে— দিনরাত কর্ত্তাকে ঠোকে— খাঁদানেকো মর্কট গণ্ডাগণ্ডা খোকাখুকু ধেনো তাড়ি টেনে ঢুকুঢুকু দিনরাত নাকডাকা? ট্যাঁকে কানাকড়ি নেই ডাক্তার ডাকা নেই— মরি খেটে খেটে দুর দুর ধুত্তোর— ধেঁড়ে মদ্দর গর্দান ধর গোটা দুই তিন ধাঁই ধাঁই দে—" (তেহাই)আজকের যে ক'জন বাঙালী তবলিয়া ভারতে এবং দেশ বিদেশে খ্যাতিলাভ করেছেন তাঁদের প্রায় সকলেই জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের শিষ্য প্রশিষ্য। শুধু ভারতে নয়, বিদেশেও জ্ঞানপ্রকাশ সমাদৃত।
কলকাতায় জ্ঞানবাবুর কাছে তবলা শিখতে এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে তবলায় ডক্টরেট করতে এলেন আমেরিকা থেকে রবার্ট গউলিব। তিনি পশ্চিমী সঙ্গীতে শিক্ষিত দক্ষ শিল্পী। দু'বছর গবেষণার পর তাঁর কাছ থেকে অনেক বোল শিখলেন এবং তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে ডক্টরেট করে একটা বড় বই লিখলেন। বইয়ের পিছনের পাতায় আলোচনা ও বোলগুলির পাতলা রেকর্ডও রাখা ছিল। তিনি জ্ঞানবাবুর এক বন্ধুর বাড়িতে বাজালেন এবং তাঁর কিশোরী কন্যা দু'বছরে ভরতনাট্যম শিখে নাচল। জ্ঞানবাবুর সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলাম। বইটি দেখলাম। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি সমস্ত বোলগুলি staff notation-এ লিখেছিলেন। আমাকে পদ্ধতিটা শিখিয়ে দিলেন। জ্ঞানবাবুর কাছে শেখা একটা 'টুকড়া' (ত্রিতালের) আমার খাতায় staff notation-এ লিখে দিয়েছিলেন। টুকড়াটা ছিল :
কৎতেটে থুনতেটে গদিঘেনে নাগতেটে ঘেনতেরেকেটেতাক তাতেরেকেটেতাক তাককড়ান ধা তেরেকেটে ঠেৎ তাকেন্নে ধা ধাতেরেকেটেধেৎ তাকেন্নেধা ধাতেরেকেটেধেৎ তাকেন্নেধেৎ তাকেন্নে ধা
মাত্রা দিয়ে লিখতে গেলে যে অসুবিধাটা হয় staff notation-এ তা কি সুন্দর ভাবে বোঝানো যায় দেখলাম। যদিও আমাদের সাবেক বাংলা নিয়মটাতেই আমরা অভ্যস্ত। যেমন চিনা জাপানী লেখা দেখে আমরা ভাবি বড় গোলমেলে কিন্তু তাদের কাছে কোনও অসুবিধা নেই। জ্ঞানবাবুর দেশ বিদেশে ব্যবহৃত সব পদ্ধতি বিষয়ে সদা আগ্রহী মন। তাঁর সান্নিধ্যে মন সদা উৎসাহী থাকে। এই উৎসাহভরা পরিবেশে থেকে আনন্দ উপভোগ করেছি। যথাসাধ্য তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। কিন্তু কতদিনই আর তা সম্ভব! ক্রমশঃ তাঁর শরীর অশক্ত হয়ে যেতে লাগল। সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমীর শিক্ষার্থীদের গানের সঙ্গে তবলা না বাজিয়ে হাতে তালি দিয়ে বাজাচ্ছিলেন।
(পরের কিস্তিঃ সাক্ষাৎকার দিয়ে শুরু)
সাক্ষাৎকার (টেপ থেকে): কলকাতায় সঙ্গীতে প্রাথমিক শিক্ষা:
পূ : কবে থেকে শিখতে শুরু করলেন?
জ্ঞা : কবে থেকে আরম্ভ করলাম? - তা বছর ২২-২৩ হবে। তার আগেও হতে পারে। ২০-২১ বছরে হবে। এদিকে একটা ঝোঁক হল। আর শিখতে আরম্ভ করলাম। ২১-২২ থেকে ২৪-২৫ পর্যন্ত আমি তবলা পাখোয়াজ - এই গুলো। খেলার খুব সখ ছিল। স্কুল থেকে আমাদের ক্লাব ছিল। টুরনামেন্ট হত। কলেজে যখন পড়তুম, কলেজেও খেলতুম। ১৯৩১ থেকে সেসব বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খারাপের জন্য। চোখে ফুটবল লেগে after effect-এ অন্য চোখেও দেখতে পাচ্ছিলাম না! ১৯৩১-৩৩ তে যখন আমি খেলাধূলো ছেড়ে দিয়েছি, আর গানবাজনা seriously আরম্ভ করিনি, তবলা পাখোয়াজ এমনি বাড়িতে বাজাতুম। মাঝে মাঝে কিছু অনুষ্ঠান হল - বাজাতুম, এইরকম। পাখোয়াজ শিখেছিলুম কিছু আমাদের বাড়িতে। ডিক্সন লেনের বাড়ি তখন হয়নি। ক্রীক রো-তে একটা বাড়িতে অর্থাৎ আমার জন্মস্থানের বাড়িতে। দানিবাবু আসতেন। খুব নামকরা লোক ছিলেন! আমি তাঁর সঙ্গে রেয়াজ করতুম। তারপরে actually আমি দুচোখেই তখন দেখতে পেতুম না - বাঁ চোখটা comparatively কম ছিল। Clearup করেওনি তখন আমি আজম খাঁর কাছে শিখতে আরম্ভ করলাম। সেটা হবে '৩১, তারপর আজম খাঁ চলে গেলেন। বছর খানেক কি বছর দুয়েক কাটার পর আমি মসীদ খাঁর কাছে শিখতে আরম্ভ করলাম। সেটা '৩৩-৩৪ সাল হতে পারে। কারণ, একটা বছর চলে গেছে আজম খাঁর পর। তখন আমি লিখছি। দেখতে পাচ্ছি না ভাল, কিন্তু খাতা ছিল। তখন আমি পড়তে পারি। পড়াশোনা তখন বন্ধ। আমি MA দিতুম বোধহয় '৩১-এ। দিতে পারলুম না চোখের জন্য।
পূ: জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র সহপাঠী ছিলেন কি?
জ্ঞা: তিনি আমার contemporary ছিলেন। কিন্তু আমি প্রেসিডেন্সিতে পড়তুম তিনি স্কটিশ-এ পড়তেন।
পূ: কলেজে সে যুগে গানবাজনা কি হত?
জ্ঞা: কলেজের যুগে তখনকার দিনে হয়তো নাটক-টাটক হত। আমাদের সিনিয়র যাঁরা ছিলেন সুশীল দে, হুমায়ূন কবীর এঁরা গাইতেন। আমরা শুনতুম। তবে আমি তখন কলেজে ঢুকিনি হয়তো। তখনও ওঁদের সঙ্গে পরিচয় ছিল। ওঁরা তখন প্রেসিডেন্সিতে পড়তেন। তখন সম্মিলনী বলে একটা স্কুল ছিল, সেখানে সুরেন বাঁড়ুজ্যে শেখাতেন। সত্যকিঙ্করবাবু ও আমার বোনেরা সেখানে শিখত।
পূ: আমি যখন ওয়ান-টু তে পড়ি, আমাদের স্কুলেও সুরেন ব্যানার্জী শেখাতেন, বড়দের।
জ্ঞা: ব্রাহ্ম গার্লস স্কুল?
পূ: না, লেক স্কুল।
বোঝো তাহলে তোমার তখন ৫/৬ বছর হবে। আমি যখনকার কথা বলছি তার অনেক পরে তোমার পাঁচ বছর হবে। সুরেন বাঁড়ুজ্যের কাছে আমার বোনেরা শিখতো। আমি শিখতাম না। ওরা সুরেনবাবুর কাছে শিখতো। কোনও কোনও function হলে আমি তবলা বাজাতুম। আমার বোনেরা গাইতো। ওরা সত্যকিঙ্করবাবুর কাছেও শিখতো। মিসেস বি. এল. মুখার্জী ছিলেন অর্গানাইজার। যেহেতু আমার বোনেরা গাইছে বা অন্য কোনও গ্রুপ গাইছে - আমাকে তবলা বাজানোর জন্য ডাকতেন। হয়তো হুমায়ূন কবীর বা সুশীল দে এবং মৃগেন মিত্তির জজ ছিলেন, তাঁর ছেলেও আছেন, তাঁদের সঙ্গে আমি তবলা বাজাতাম।
পূ: হুমায়ূন কবীর গান করতেন?
জ্ঞা: (একটু হেসে বললেন) ওই আরকি। গান করতেন, খুব উৎসাহ ছিল, গাইতে পারতেন না। একদিন অনেকদিন পরে একটা জায়গায় উনি চিফ গেস্ট ছিলেন, আমি প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আমি বললুম যে, উনি গাইতেন। উনি বিনয় করে বললেন, "আমি গানটান করতে পারতাম না।" যাইহোক, ওঁদের সঙ্গে তবলা বাজাতুম।
পূ: আপনাদের বাড়িতে বাবা উৎসাহ দিতেন?
জ্ঞা: বাড়িতে খুবই উৎসাহ দিতেন। ভাইদের মধ্যে আমার বড় দাদা খুবই মেধাবী ছিলেন। Western music করতেন। বেহালা বাজাতেন। তাছাড়া খুব বই পড়তেন, পড়াশোনা করতেন। তিনি বড় ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে উনি যা করতেন সে সম্বন্ধে আমার মোটামুটি একটা আইডিয়া হয়েছিল। তবে উনি continue করেন নি। আমি করলাম। আমার অন্য ভাইদের মধ্যে আমার ছোটভাই বেহালা বাজাতো। সঙ্গীত সম্মিলনীতে মিহিরবাবুর কাছে শিখত এস্রাজ! বোনেদের মধ্যে চর্চা ছিল। বোনেরা খুবই ভাল গাইতে পারতো। তবে তখনকার দিনে সমাজে বেশীদূর আমল দেওয়ার বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে, রেওয়াজ ছিল না। ওরা দুই বোনই continue করলে খুবই ভাল গাইতে পারত। এস্রাজও বাজাতো, গানও করত।
পূ: বাবা গাইতেন?
জ্ঞা: বাবা শুনেছি গাইতেন। আমি শুনিনি। ঠাকুরদার গলা খুব ভাল ছিল। গান গাইতেন - ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতেন। বাবা খানিকটা পরে, যখন দেখলেন আমি তবলা টবলা শিখছি - তারপর চোখ যখন খারাপ হয়ে গেল - কিছুই করার নেই, তখন উৎসাহ দিতেন। তারপর আমি গানও শিখতে আরম্ভ করলাম। যখন মুসলমান ওস্তাদরা আসতেন, সারেঙ্গীয়ারা আসতেন, তখন থেকেই আমি গানের দিকে ঝুঁকলুম। গানটা আমাকে আকর্ষণ করত। আমি গাইতুম ছেলেবেলায় আমার গলা ভাল ছিল। কিন্তু শিখিনি। তবে ওইরকম গাইতুম, রবীন্দ্রসংগীত-টংগীত। বোনেদের কাছে শিখে broadcast করতুম।
কলেজে যখন ঢুকেছি, তখন থেকেই। গীটার-টিটার বাজাতুম। আর আমাদের নিজেদের অর্কেস্ট্রা ছিল। নাটক হত থিয়েটারের গানটান হত।
পূ: Public performance কখন করলেন?
জ্ঞা: Public performance এর আমার খুব একটা ইচ্ছাই ছিল না। ছেলেবেলায় এমনি যা করতাম, public performance বললেও চলে, তবে তখনকার দিনে সেটা ছোট scale-এ হত। প্রফেসনাল standard এর কথাই ছিল না। গাইয়ে বাজিয়ের চেহারা দেখতাম না তখন। Whole setup-টাই অ্যামেচারের মতন ছিল। হয়তো গোপেশ্বরবাবু বর্ধমানে গাইতেন - কিন্তু কোথাও গাইতে গেলে এমনি নেমন্তন্ন করে করা হত। মুসলমান ওস্তাদ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা শেখাতেন। তারপর তো রেডিও এসে গেল। রেডিও আসার পরে হল কি আমাদের আরও সখ বাড়ল। আর রেডিওর সঙ্গে আমাদের খানিকটা যোগাযোগ ছিল। আমাদের Dwarkin and Sons যে বাদ্যযন্ত্রের দোকান - পুরানো ভারতবর্ষের মধ্যে বোধহয়, প্রথম Indian owned, সবচেয়ে পুরানো দোকান। বাবা সেখানে ছিলেন। তারপর বাবার সঙ্গে কিছুদিন গোলমাল হওয়াতে, - রেডিও তখন তো experimental stage এ ছিল - বাবা রেডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করে রেডিওর ব্যবসা আরম্ভ করলেন। তা - ওই ব্যবসাটা থাকার জন্য আমার শেখার খানিকটা সুবিধা হল। কারণ বাবার হোটেলে থাকতাম তো! যদিও তখনকার দিনে টাকাপয়সাগুলো এখনকার দিনের মতন অত দামী ছিল না। যদি কাউকে পঞ্চাশ টাকা দিতাম - তো gladly ওস্তাদ বাড়িতে এসে শেখাতেন। এখন যেখানে দুশো, পাঁচশো লাগবে।
তখন তো বিলিতি আমল, কলকাতা প্রথম হয়, তারপর বম্বে, তারপর ম্যাড্রাস, তারপর দিল্লী। কর্তারা যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সাহেব। তবে তারা Indian music support করতেন - প্রোগ্রামের জন্য। Director General সাহেব ছিলেন, কিন্তু Indian musical cultural activity চালু রেখেছিলেন। কিন্তু সেটা বন্ধ করে দেবার উপক্রম হল। তখন গভর্নমেন্ট হয়নি; registration হল। তার আগে অনেক কথা - যাইহোক, রেডিও বন্ধ হয়ে গেল। কোম্পানী লাটে উঠে গেল। কারণ লাইসেন্স ফাইসেন্স কিছুই লাগতো না। করা কী? খরচা তো আছে। উঠে যাচ্ছিল - উঠে গেলে আমাদের খুবই ক্ষতি হবে। বাবা খুব উঠে পড়ে লাগলেন। আরও কয়েকজন ছিলেন। স্যার বীরেন মিত্তির ছিলেন High Commissioner। তাঁদের ধরে টরে গভর্নমেন্টের হাতে তোলা হল। গভর্নমেন্ট থেকে আপত্তি ছিল। কী হবে রেডিওতে? নানা ভাবে বুঝিয়ে বলা হল। এটা একটা বড় নতুন সংস্থা publicityর জন্য বড় মিডিয়াম ইত্যাদি, গভর্নমেন্টের অনেক কাজে আসবে, অনেক কথা বলে বোঝাতে হয়েছে। তারা কোনও খবর রাখত না - যে এটা একটা কতবড় ব্যাপার! সে বুদ্ধি হয় নি।
ঠাকুরদা মশাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাবা রেডিওর দোকান খুললেন। দেখালেন এটা business এর দিক দিয়ে, culture এর দিক দিয়ে, সবকিছুর দিক দিয়ে একটা বিরাট সম্ভাবনাপূর্ণ। তারা দয়া দাক্ষিণ্য করে রেডিও take up করলেন। গভর্নমেন্ট বুঝলো লাভ হবে।
(১৯৬৪ সালে আমেরিকা থেকে ফিরে রেডিও স্টেশনে জ্ঞানবাবুর সঙ্গে দেখা হল। তবলা, গান শিক্ষার ক্লাসে, যেমন দেখেছি তেমনি অনেককে নিয়ে সঙ্গীত অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে সদাব্যস্ত। হিন্দি, বাংলা গান, তবলা, দলে দলে অনুষ্ঠানের জন্য আসছে। যাঁরা নিয়মিত রেডিও শোনেন তারা নিশ্চয়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর প্রত্যক্ষ অনুষ্ঠান এবং ছাত্রছাত্রী শিল্পীদের নির্দেশ দিয়ে প্রস্তুত করার নিদর্শন দেখেছেনঃ একক জমজমাট উপস্থিতি প্রাণশক্তিতে ভরপুর। হারমোনিয়ম, গীটার এ অপূর্ব বাজানো। মনে পড়লো দিলীপ রায় উমা বসুর গানের সঙ্গে তাঁর গীটার সঙ্গতের রেকর্ডের কথা।)
(পরবাস-৫৪, জুন ২০১৩)