"তথাগতের ইচ্ছায় নগরীর শ্রেষ্ঠসুন্দরী সিরিমার মৃতদেহের কোনো সৎকার করা হবে না।"
— বিম্বিসারের এই কথায় বিস্মিত হলেন উপস্থিত সকলেই। "কিন্তু মহারাজ কি তার অপরাধ?" - বলতে যাচ্ছিলেন উপস্থিত একজন। কিন্তু নৃপতি বিম্বিসার তার আগেই বলে উঠলেন—
"সিরিমার অপরূপ সুন্দর দেহটি উপযুক্ত সজ্জায় শোভিত থাকবে এক বিশেষ শবাগারে। সময়ের দ্বারা দেহের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যও কত কুৎসিত হয়ে যায় তা প্রত্যক্ষ করবে সবাই। আমার প্রতিটি নগরবাসী বাধ্য থাকবে ওই শবাগার দর্শন করতে। অন্যথায় তার অর্থদণ্ড তিন স্বর্ণমুদ্রা"।
বিম্বিসারের কথায় স্তম্ভিত হলেন অনেকেই। কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করলেন না। তখন উপস্থিত জনসমষ্টির দিকে গভীরভাবে দৃকপাত করে বিম্বিসার বললেন —
"আমাদের দেহের প্রতি আমাদের এই যে এত মায়া ও মোহ, তা যে কত মূল্যহীন এবং অসার তা তোমাদের বোঝানোর জন্যই তথাগতের ইচ্ছায় এই ব্যবস্থা - যাতে তোমরা যথার্থভাবে ....."
কথাগুলি উপস্থিত পাত্রমিত্র অমাত্যদের নির্বাক মুখগুলির উপর দিয়ে ভেসে গেলো সহজেই।
মহারাজ বিম্বিসার প্রস্থান করলেন সগৌরবে। এবং উপস্থিত ব্যক্তিগণ গৃহমুখী হলেন নীরবে ও নতমুখে।
"ওঠো। এদিকে এসো। স্বয়ং মহারাজের ইচ্ছায় তোমাকে এই কাজে নিযুক্ত করা হোলো" — বিশালদেহী রাজপুরুষটির কথায় বিস্মিত হোলো বীরভদ্র।
"আমি এই রাজ্যের সেনাপ্রধান। মহারাজের আদেশে ঘোষণা করছি সবদিক বিবেচনা করে তোমাকেই এই দুর্লভ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হোলো। তোমার পারিশ্রমিক তোমার কাজের উপযুক্তই হবে। কিন্তু তোমার সর্বস্ব দিয়ে মহারাজের এই সিদ্ধান্তের মর্যাদা তোমায় রাখতে হবে। আশা করি তুমি তা পারবে।" — প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই সেনাধ্যক্ষ যথোচিত রাজসিক ভঙ্গীতে নির্গত হলেন।
আর বীরভদ্র ভাবছিলো যা ঘটছে তা সত্যি না স্বপ্ন! কারণ খানিক আগেই সে ছিলো জীবিকার সন্ধানে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো এক হতভাগ্য যুবক। ভোররাতে যাচ্ছিল রাজপ্রাসাদের সামনে দিয়ে। হঠাৎ দুজন সান্ত্রী এসে পিছন থেকে ধরলো তাকে। নিয়ে গেলো বন্দী করে রাজপ্রাসাদের ভিতরে। সে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল যে কি তার অপরাধ। কিন্তু অভুক্ত অশক্ত শরীরটা জ্ঞান হারালো কখন কে জানে। জ্ঞান ফিরলো সেনাধ্যক্ষের কথায়। বীরভদ্র বুঝতে পারলো রাজপথের ভবঘুরে থেকে ভাগ্যের আশ্চর্য বিধানে এখন সে সম্মানীয় রাজরক্ষী।
"কি দেখছো? অমনভাবে হাঁ করে কি দেখছো?"
- প্রশ্ন করেছিলো পাশের সান্ত্রীটি। বীরভদ্র অপলকে তাকিয়েছিলো সেই শায়িত রমণীর দিকে। এমন অসামান্য কোনো সুন্দরীকে এত কাছ থেকে কখনো দেখেনি সে। এমনকি নিদ্রার ভঙ্গীটিও কতো অপরূপ। মুগ্ধ ও বাক্রুদ্ধ বীরভদ্র খুব অপ্রস্তুতে পড়ে গেলো সান্ত্রীটির কথায়। যা হোক কিছু একটা উত্তর সে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই চমকে উঠলো সান্ত্রীটির পরের কথায় — "উনি মৃত। বোঝাই যাচ্ছে না তাই না? মনে হচ্ছে যেন ঘুমিয়ে আছেন কত সুখে।" বীরভদ্র যেন সম্বিৎ হারালো। সান্ত্রীটি আবার বলে উঠলো - "এই মৃতদেহটিই পাহারা দিতে হবে তোমায়।" বীরভদ্র স্তম্ভিত হয়েছিলো। তারপর কোনোক্রমে বলতে পেরেছিলো - "তার মানে?"
"যথেষ্ট মজুরী পাবে তুমি। তোমার কপালে যাই হোক। ঘাবড়ে যেও না।" — এই কথা বলে হঠাৎই চলে গেল সান্ত্রীটি।
এক স্বল্পালোকিত কিন্তু অতি সুসজ্জিত রাজগৃহে ঐ রূপবতী মৃতার সামনে বীরভদ্র তখন একা। যদিও কেন যেন তার মনে হচ্ছিল যে ওই প্রাণহীনা অলোক সামান্যা নারী বুঝি এখনই চোখ মেলে উঠে বসবেন তার সামনে।
"হ্যাঁ স্পর্শ করো। ওর সর্বাঙ্গ স্পর্শ করো" —
চমকে উঠে বীরভদ্র পিছনে তাকিয়ে দেখলো এক দীর্ঘদেহী অতি সুদর্শন রাজপুরুষকে। "আমি রাজা বিম্বিসার। কি করছো তাই দেখতে এলাম" - আবার বললেন তিনি।
একটু আগেই এই কক্ষ থেকে বহির্গত হয়ে আবার যে কিসের আকর্ষণে সে এখানে ঢুকেছিলো কে জানে। কাছে এসে বড়ো গভীরভাবে দেখছিলো সেই অপরূপ মুখপদ্মটিকে। মৃত্যুর কোনো কালিমাই নেই সেখানে। বীরভদ্র অতি সন্তর্পনে স্পর্শ করেছিলো তার অধরোষ্ঠ। এবং অনুভব করেছিলো সেদুটি কি ভয়ানক শীতল এবং কঠিন! যেন পাথরের মতো! ঠিক তখনই সে চমকে উঠেছিলো পিছন থেকে আসা ঐ কণ্ঠস্বরে। ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানিয়েছিলো বীরভদ্র।
"লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। অনেক জিতেন্দ্রিয় পুরুষও মোহিত হয়েছিলেন এঁর রূপে। ইনিই নগরীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী সিরিমা। আজ মধ্যরাত্রি থেকে রক্ষিত হবেন এক বিশেষ শবাগারে। যার দায়িত্ব শুধু তোমার" — বিম্বিসারের কথাগুলি সসম্ভ্রমে শুনছিলো বীরভদ্র।। "সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অগণিত মানুষ আসবে সিরিমাকে দেখতে। শবাগারের চারিদিকে বিশেষভাবে বেষ্টনী দেওয়া আছে। সবাই দেখবে কিন্তু দ্বারের ওপার থেকে। বাকি কাজ তোমার।" — বীরভদ্র নিবিষ্ট মনে শুনছিলো নৃপতি বিম্বিসারের কথাগুলি। "এখন থেকে তুমিই সিরিমার নিকটতম ব্যক্তি" — কথাটি বলে রাজসিক চলনে নিষ্ক্রান্ত হলেন মহারাজা বিম্বিসার।
"সিরিমার নিকটতম ব্যক্তি" — কথাগুলি দেওয়ালগিরির শিখার সাথে সাথে কম্পিত হতে লাগলো বীরভদ্রের মনে।
"কখন দ্বার খোলা হবে?"
— বীরভদ্র চমকে উঠে দেখলো এক শীর্ণদেহ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। রাত এখনো গভীর। এবং নিঃশব্দ। বীরভদ্র সতর্ক কিন্তু অন্যমনস্ক ছিলো। কারণ তার মনে হচ্ছিল যে দিনের আলো ফোটার সাথে সাথে কিভাবে শুরু হবে তার প্রথমদিনের কাজ — সিরিমার দর্শনার্থীরা এক এক করে এসে দাঁড়াবে শবাগারের সামনে - লৌহজালিকার ওপার থেকে দেখতে পাবে কিভাবে সিরিমার দেহ শায়িত আছে অপূর্ব বেশভূষায় - মৃদু আলোয় - শবাগারের অভ্যন্তরে। কিন্তু তার অনেক আগেই এসে গেছে এই ব্যক্তিটি।
বীরভদ্র উত্তর দিলো - 'প্রত্যুষের ঠিক পরেই'।
আগন্তুক কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো শবাগারের রুদ্ধদ্বারের সামনে। তারপর হাঁটু গেড়ে বসলো সেই দ্বারের সামনে। কয়েক মুহূর্ত সে যেন পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইলো সেখানে। এরপর খুব সন্তর্পনে কিছু একটা রেখে দিলো দ্বারের সামনে। তারপর চলে গেলো সেই অন্ধকারে যে অন্ধকার ভেদ করে সে এসেছিলো।
এর খানিকবাদে দিনের প্রথম আলোয় বীরভদ্র দেখতে পেলো শবাগারের দ্বারটি উদ্ভাসিত হয়ে আছে একগুচ্ছ শ্বেতপুষ্পস্তবকে - যা অবশ্যই ওই শীর্ণ ব্যক্তিটির নিবেদন।
"রাণী ক্ষেমার নাম শুনেছো তো? রাজা বিম্বিসারের রানী ক্ষেমা?" — দিনশেষের হীনমান আলোয় বৃদ্ধের মুখটি বড়ো মায়াময় বলে মনে হচ্ছিল বীরভদ্রের।
"বোধিসত্ব বিম্বিসারের প্রাসাদে এসে দেখলেন রাণী ক্ষেমার বড়ো রূপের অহংকার। তাই তখন তিনি সৃষ্টি করলেন আরেক নারী যিনি ক্ষেমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী - বুঝতে পারছো তো?" বীরভদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন বৃদ্ধটি। বীরভদ্র মাথা নাড়লো কিন্তু তখন তার চোখে ভাসছিলো তার প্রাণের পুতুল শান্তার মুখটি।
"এর পর অবাক হয়ে ক্ষেমা দেখলো সেই সুন্দরী তার চোখের সামনে ক্রমশ বয়স্ক হতে হতে থুত্থুড়ে বুড়ি হয়ে গেলো। তখন ক্ষেমা বুঝলেন কতো অসার আর অনিত্য এই দেহ - বুঝলে তো?" - কথাগুলি বলে বৃদ্ধটি বীরভদ্রের মুখের দিকে গভীরভাবে তাকালেন। বীরভদ্রের চোখের সামনে তখন ফুটে উঠছে - একটি ছোট্ট ঘর - সেখানে সে আর তার শান্তা একান্তে বিভোর হয়ে আছে। তাই সে লক্ষ্য করলো না কিভাবে ক্রমাগত অন্ধকারে ঢেকে গেলো সিরিমার শবাগারের প্রথমদিনের শেষ দর্শকের বলিরেখাময় প্রাচীন মুখটি।
"তোমার ক্ষমতা আছে বটে" - বীরভদ্র মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো কে বললো কথাটা। সেই প্রথম দিনের সান্ত্রীটি। তার সঙ্গে জুটেছে তার আরেক সহমর্মী।
"এই ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধে সারাক্ষণ থাকা। এর চেয়ে নরকে যাওয়া ভালো" - বললো দ্বিতীয়জন। বীরভদ্র ওদের কথার কোনো উত্তর দিলো না। অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রইলো দূর আকাশের দিকে।
"আমাদের মহারাজকে একশোবার প্রণাম করতে হয় ঠিক লোককেই বেছেছিলেন এই কাজের জন্য।" -বললো প্রথম সান্ত্রীটি।
"যা বলেছো।"
"তা কতো বেতন ধার্য হোলো? কতো সহস্রমুদ্রা জমা হোলো তোমার এই কদিনে?"
বীরভদ্র যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলো এই কথায়। তার মনে হোলো - সত্যি তো তাহলে কতো মুদ্রা সঞ্চিত হোলো বিগত কটা দিনে! তার চোখে ভেসে উঠলো একটা সুসজ্জিত ঘরের ছবি যেখানে রাজারাণীর মতো বসে আছে তার শান্তা - উজ্জ্বল হাসি নিয়ে তার সুদীপ্ত মুখশ্রীতে।
"এবারের মতো তোমায় ক্ষমা করে দিলাম কিন্তু এ প্রচেষ্টা আর কখনো কোরো না" - বীরভদ্র মাথা নীচু করে শুনছিলো সেনাধ্যক্ষের কথাগুলি। একটু আগেই সে ধরা পড়েছে পালাতে গিয়ে। শবাগারের বাইরে যে বিশাল বাগান তা লম্বা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তার প্রকাণ্ড দ্বার বন্ধ থাকে বাইরে থেকে। বীরভদ্র এই স্বর্গোপম বাগানে কার্যত বন্দী ঠিক এক বছর ধরে - সিরিমার শবাগারের রক্ষী হিসেবে। এই এক বছরে সিরিমার মৃতদেহ ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে অস্থিসার হয়ে গেলো। একসময়ে শয়ে শয়ে লোক এসেছিলো তা দেখতে। তারপর একজন ছাড়া কেউ আসতো না ভুলেও। তাই দিনে একা এবং রাতে নিঃস্ব হয়ে কাটছিলো তার অনন্ত সময়। এই শ্রাবণী পূর্ণিমার রাতে প্রকাণ্ড চাঁদের সামনে হঠাৎ তার মনে পড়ে গিয়েছিলো ঠিক এক বছর আগের এমন এক চন্দ্রিল রাতের কথা - যখন সে তার শান্তার জ্যোৎস্নামাখা মুখটিকে স্পর্শ করে বলেছিলো - "ফিরে আসবো তো কদিন বাদেই কিছু রোজগারপত্র করেই আর তারপরেই আমরা ...."। অতএব দূর আকাশের সহসা মোহিনী শোভায় বীরভদ্রের মাথাটা যেন হঠাৎ দপ্দপ্ করে উঠেছিলো - মনে হয়েছিলো তার শান্তার তন্দ্রাচ্ছন্ন মুখটি যেন ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার চোখের সামনে।
'তার সঙ্গসুখে মগ্ন হয়ে আমি পরবর্তী জীবন কাটাইনি। যদিও জ্ঞান হওয়ার খানিকপরেই ওর সাথে আমি মিলিত হয়েছিলাম এক ঘোরের মধ্যে।' আমি বলতে যাচ্ছিলাম—'সে কি? ঘোরের মধ্যে?' কিন্তু আমার বলার আগেই তিনি বলতে শুরু করলেন—'অজ্ঞান অন্ধকারে কতকাল যে তলিয়েছিলাম কে জানে। জ্ঞান আসার পর দেখলাম এক রমণীর মুখ—আমার মুখের খুব কাছে কিন্তু যেন কতদূর থেকে বলছে—'কেমন আছেন কুমার?' তারপর স্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম—
অতএব বীরভদ্র পাঁচিল টপকালো এবং সহজেই গ্রেপ্তার হোলো বাইরে পাহারারত সান্ত্রীদের দ্বারা।
"এ কাজের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু তোমার এতদিনকার কাজের ধারা বিবেচনা করে...."
- বীরভদ্রের কানে যেন কিছুই ঢুকছিলো না আর। তীব্র হতাশার গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিলো সে।
"কেমন আছো বীরভদ্র? তোমায় কিছু বলার ছিলো আমার" — নৃপতি বিম্বিসার! কোথা থেকে এলেন উনি? এত রাতে? বীরভদ্র অবাক হয়ে তাকালো তাঁর দিকে।
"তুমি যে কাজ করেছো তা সত্যিই অসাধারণ। তোমার নিষ্ঠার তুলনা নেই। এতগুলো বছর তুমি যেভাবে এই শবাগারের দ্বার রক্ষা করেছো তা সত্যি দুর্লভ।" - বললেন বিম্বিসার। বীরভদ্র বলতে যাচ্ছিল — "কিন্তু কতো দিন? আর কতোদিন মহারাজ?" কিন্তু কিছুই সে বলে উঠতে পারলো না। বিম্বিসার বলতে থাকলেন — "কতো সহস্র মানুষ এলো সিরিমার এই পরিণতি দেখতে - কিন্তু তারা যা দেখলো তা কয়েক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু তুমি - তুমি তো প্রতিটি মুহূর্তে দেখেছো এই পরিবর্তন।" নির্বাক বীরভদ্র একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো তাঁর দিকে। "তাই আমার বিশ্বাস - তুমি- অন্তত তুমি- বুঝতে পেরেছো আমার উদ্দেশ্য - অর্থাৎ তথাগতের কথার মর্ম - মানে এইসব সুন্দরতা- এইসব ভালোলাগা আর ভালোবাসা কতো যে অসার.." বীরভদ্রের কানে আর কিছুই ঢুকছিলো না। সে মনে করতে চাইছিলো শান্তার মুখটা - কিন্তু দীর্ঘ দশ বছরের অদেখায় সে মুখের আশচর্য কারুকার্যগুলি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
"ওঠো ওঠো। শবাগারের দরজা খোলো। ভিতরে যেতে দাও। মহারাজের নির্দেশ" —এক দীর্ঘকায় ব্যক্তি অতি কর্কশভাবে এসে ডাকলো ঘুমন্ত বীরভদ্রকে। তখন মধ্যরাত্রি। বীরভদ্রের চোখে ঘুম নামে এই সময়েই। সে হতচকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো ওই ব্যক্তিটিকে — "কেন? কি কারণ? ভিতরে যাবে কেন?"
— "রাজার নির্দেশ - শবাগার আজ রাতেই খালি করে দিতে হবে"।
— "তার মানে?"
— "তার মানে রাজাকে জিজ্ঞেস কোরো। আমি শুধু হাড়গোড় যা পড়ে আছে সেগুলো সাফ করতে এসেছি - রাজার নির্দেশে" বলতে বলতে বীরভদ্রকে ধাক্কা দিয়ে তার হাত থেকে চাবিটা কেড়ে নিয়ে শবাগারের ভিতরে ঢুকলো সেই ব্যক্তি। বীরভদ্র হতভম্বের মতো বসে রইলো দূরতর নক্ষত্রগুলির দিকে তাকিয়ে। আর ভাবতে লাগলো - 'কতো বছর? পনেরো? বিশ? না পঁচিশ? রাজার এঘরের কথা মনে পড়লো?' খানিক বাদে একটা কাপড়ের পেটিকা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলো সেই ব্যক্তি।
বীরভদ্র দৌড়ে শবাগারের ভিতরে ঢুকলো। এবং দেখতে পেলো শবাগারের বেদীটি সম্পূর্ণ ফাঁকা! তার মুখ দিয়ে একটিই শব্দ উচ্চারিত হোলো - "একি!"
"কখন দরজা খুলবেন?"
— বীরভদ্রের মনে হোলো যে সে স্বপ্ন দেখছে না তো? হুবহু একই দৃশ্য সে যেন দেখছিলো বহুবছর আগে। সেই একই লোক। একইভাবে এসে দাঁড়িয়েছে শেষরাতের অন্ধকারে। সিরিমার শবাগারের সামনে!
"ও দরজা আর খুলবে না" — কোনোক্রমে মাথা তুলে অস্ফুটে বলতে পারলো বীরভদ্র। "রাজার লোক এসে সব পরিষ্কার করে দিলো আজ" — কিন্তু কথাটা কাকে বললো বীরভদ্র? কারণ সেই ব্যক্তি তো তার কথার অপেক্ষা না করে ঠিক প্রথমদিনের মতো দরজায় মাথা ঠেকিয়ে - দোরগোড়ায় একগুচ্ছ ফুল রেখে নেমে গেলো নিশ্চুপে।
"শুনছেন? একটা কথা বলবো?" - বীরভদ্রের নিজেরই খুব অস্বস্তি লাগলো নিজের কণ্ঠস্বরে। লোকটি ঘুরে দাঁড়ালো বীরভদ্রের দিকে। তাকালো বীরভদ্রের মুখে। সরাসরি।
বীরভদ্র লক্ষ্য করেছিলো - এতগুলি বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সময়ে লোকটি আসতো এই শবাগারে। একইভাবে একইভঙ্গীতে মাথা ঠেকিয়ে নীরবে রেখে যেতো একগুচ্ছ ফুল।
"আপনি কি ওনার-" বীরভদ্রের দ্বিধাজড়িত এই প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই ব্যক্তিটি উত্তর দিলো — "সবচেয়ে কাছের মানুষ হতে চেয়েছিলাম"। এই কথা বলে নিঃশব্দে অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলো সেই ব্যক্তি।
বীরভদ্রের মনে হোলো এক নিবিড় আত্মীয়তা বরাবরের জন্য হারিয়ে গেলো ওই অন্ধকারে।
"বীরভদ্র, তোমার কাজ শেষ। এই নাও তোমার পারিশ্রমিক। এইবার তুমি অন্য কোথাও চলে যাও। পারলে দুএক দিনের মধ্যেই" — বীরভদ্র অবাক হয়ে দেখলো এক দীর্ঘকায় রাজপুরুষ একটি পেটিকা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন শবাগারের দ্বারে। তিনি বীরভদ্রের হাতে ধরিয়ে দিলেন সেই পেটিকাটি এবং বললেন - "আশাকরি তোমার প্রত্যাশার অনেক বেশিই আছে এতে। এদিয়ে তোমার জীবনের যে কোনো ইচ্ছেই পূরণ করতে পারবে তুমি। অতএব আর সময় নষ্ট কোরো না"। এই বলে নিষ্ক্রান্ত হলেন সেই অজ্ঞাত রাজপুরুষ।
বীরভদ্র পেটিকাটিকে হাতে নিয়েই বুঝলো যে সেটি যথেষ্ট ভারী। শবাগারের মেঝেয় সেটিকে রেখে ধীর পায়ে বাইরে এলো সে। বাইরে অর্থাৎ সংলগ্ন বাগানে। যেটিকে একটি প্রকাণ্ড জঙ্গল বলাই সমীচীন। আন্মনা হয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করতে গিয়ে তার চোখে পড়লো ঝোপের মধ্যেই এক জায়গায় একটা নাম না জানা গাছে ফুটে আছে একটা গাঢ় হলুদ ফুল। যেন মহাগর্বে তাকিয়ে আছে সদ্য সকালের উজ্জ্বলনীল আকাশের দিকে।
আর তার ঠিক পাশেই একটা কাঁটাওলা শুকনো ফলের গায়ের ফাটলে লেগে রয়েছে কেঁচোর মতো লম্বা উজ্জ্বল সোনালী রঙের একটি পোকা।
বীরভদ্র অতি সন্তর্পনে সেটিকে তুলে এনে ওই ফুলের পাপড়ির উপর রাখতে গেলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেটি কুঁকড়ে গিয়ে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে।
বীরভদ্রের মনে হোলো - পোকাটির কি সহ্য হোলো না বাইরের এত আলো-বাতাস রঙের স্পর্শ?
কোথায় চললে বীরভদ্র?
কোথায় চললে হে?
তোমার কাছে তো এখন অঢেল অর্থ - চলো না অনেক দূরে - কোনো এক বিলাসবহুল নগরীতে - একটা রাত - অনেক ফূর্তি - নাকি তোমার গ্রামের বাড়িতেই ফিরে যাবে? কিন্তু কারাই বা আছে সেখানে? তোমার বৃদ্ধা মা নিশ্চয়ই এতোদিনে গত হয়েছেন - তোমার দাদারা কি আর আছেন সেখানে? তবুও বাস্তুভিটে বলে কথা —
তাহলে শান্তার বাড়ি? কোন্ মুখে যাবে? সে তো আর তোমার অপেক্ষায় আজ বসে নেই। তাহলে কি আর আছে সেখানে? তবুও যাওয়া তো উচিত সেখানেই এবং প্রথমেই —
নাহ্। থাক্। বরং এই নগরীতেই ঘুরে বেড়াও ইচ্ছেমতো। কতো সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে এখানেই - ঘোরার - থাকার - দেখার - সেসব কিছুই তো দেখলে না কোনোদিন -
অন্তত বাইরের আকাশটার দিকে মুখ তুলে ভালো করে তাকাও - বাইরের বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নাও - বাইরের আলোয় নিজেকে একবার দ্যাখো -
এইসব অজস্রকথা বীরভদ্রকে স্থির বসিয়ে রাখলো সেই শবাগারের দ্বারেই। আর দিনের আলো ক্রমশ প্রখর হতে থাকলে তার বয়স্ক মুখের রেখায়।
"সন্ধে হোলো। আলো জ্বালাই। রোজকার মতো।"
"এতকাল প্রদীপটা রাখতাম পাথরের বেদীটার নীচে। সিরিমার মাথার দিকটায়। আজ বেদীটাতেই রাখি। যেখানে ও নিশ্চিন্তে শুয়েছিলো এতকাল।"
"মাথাটা একটু টলে গেলো নাকি? নাকি পা'টাই একটু বেসামাল হয়ে গেলো? না পুরোটাই মনের ভুল?"
"যাক্গে। একটু সাবধানে ধরি প্রদীপটাকে। যাতে পড়ে না যায়। দমকা হাওয়া দিচ্ছে আবার। আরো সাবধান। শিখাটা যেন না নেভে।"
"আবার টলছে। যাহোক করে এসে গেছি বেদীটার সামনে। প্রদীপটা আগে রাখি বেদীর উপর।"
"এখন কি করবো সিরিমা? এতবছর ধরে তোমার সবচেয়ে কাছের লোক এবার কিভাবে—"
এই পর্যন্তই বলতে পেরেছিলো বীরভদ্র। তারপরেই পড়ে গিয়েছিলো ওই বেদীটির উপর। জ্বলন্ত প্রদীপটির পাশে।
— "এমনই হবে আনন্দ। কারণ এটাই অবধারিত।"
— "কেন প্রভু?"
— "আমার পরিনির্বাণের সময় পৃথিবীর কোথাও তো একটু অস্থিরতা আসবেই। ভূমিকম্প হবে সেইসময়। হবে বজ্রবিদ্যুৎপাত।"
— "পরিনির্বাণ? আপনার? সেকি? তাহলে আমাদের কি হবে? আমাদের আর কে আলো দেখাবে?"
— "অতো উদ্বিগ্ন হোয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এবার আমাকে একা হতে দাও। আমায় প্রস্তুত হতে হবে এই যাত্রার জন্য।"
কথাগুলি বলেছিলেন বোধিসত্ত্ব। তাঁর প্রিয়তম শিষ্য ও সহচর আনন্দকে। হিরণ্যবতী নদীর সন্নিকটে। কুশীনারার উপবর্তী শালবনে। একান্ত নির্জনে।
যথাকালে তথাগত মহাপরিনির্বান প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সেই সময়ে অবশ্যই কিছু কিছু স্থানে তীব্র ভূকম্প হয়েছিলো। হয়েছিলো ঘোর বজ্রপাত। এবং পৃথিবীর সমস্ত আলো নিভে গিয়েছিলো সেইসাথে।
কিন্তু তখনই অপূর্বভাবে আলোকিত হয়েছিলো একটিমাত্র স্থান — সিরিমার শবাগার।
— ভূকম্পে ধূলিসাৎ হওয়ার ঠিক আগে।
— অন্য আলোয়।
— বীরভদ্রের শেষপ্রদীপে।
(অর্থাৎ এটিও অবধারিত ছিলো)
তথ্যঋণ :
(১) মহাপরিনির্বাণের কথা : সুকুমার দত্ত
(২) বৌদ্ধরমণী : বিমলাচরণ লাহা
(৩) Women under primitive Buddhisim : I. B. Horner
(পরবাস-৫৫, অক্টোবর, ২০১৩)