রঙি ঘুরে ঘুরে সব দ্যাখছিল,---‘হাই বাপ্পাআ---ক-ত্তো বড় বড় ঘর গো, আর তার মাঝে জ্বলজ্বল, জ্বলজ্বল----করতেছে ওই কি যেন বলে—হঁ, সংসদ ভবনই তো’। হঠাত কি এট্টা ভেবে গায়ের চাদরটা আর একটু টেনেটুনে লিল রঙি। জামাটা ওর লতুনই, এইতো গত পূজায় আইটি কাকু (রঙিরা আই, আই, টিকে আইটিই বলে)দিয়াছিল, কিন্তুক ঘরে এত মুসা, এট্টুখান কাটে দিয়াছে, তাই ঢাকতেই আর কি-----।চাদরটা নিজের লয়---পঞ্চুর, ধারে দিয়াছে। আবার পঞ্চাশ টাকার একটা লোটও নিয়া রাখছে। বন্ধু না আর কিছু----। ভা--রি চসম খোর। পঞ্চুটার সাজও কম লয়, এট্টা মোবাইলও নিছে হালে, গেরামে সকলকে দেখাই বেড়ায়।----রঙিরও সাধ যায়, কিন্তুক এত পয়সা কুথায়? বলে মাসের চালই কুলায় না!
পা দুটা বেথা বেথা করছে, লতুন চটি----। তা হোক। আজ মাসের পনেরোই----ই মাসের ই দিনাই দেশ স্বাধীন হইছিল, ইসকুল বাড়ির মাঠে ই দিনা সাদা কমলা সবুজ ঝাণ্ডা ওঠে, দিদিমণি ওদের খই বাতাসা দেন। ইবার পরধান মনতিরি মশায় সারা দেশের গেরামের আটজনা ছেলেমেয়ে, যারা খাটে নিজেদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারেছে, তাদের ডাকেছেন। উয়াদের সাথে কথা করবেন, চা খাবেন একসাথে। রঙিও তাদের একজনা। আহা---গরবে রঙ্গির জামাটাই যেন আঁটো আঁটো লাগতেছে। কত কাঠ খড় পোড়াই তবে তো রঙি আজ দিললি দ্যাখছে। তবে হঁ! ওতো শুধু ঘুরতে আসে নাই, মাথা আজ অর উঁচা। যা সেই সিদিন ভাবেছিল আজ কবচ্ছরে তা ও করে ফ্যালাইছে। গেরামের সকলেই একবেলা খায়, ও আরও কম খায়ে রোগা হইছে, কিন্তুক ঢ্যাঙাও হইয়েছে অনেকটা আর চোখ দুটা ইচ্ছা পূরণের সফল স্বপনে ঝিকমিক করতেছে। সেই স্বপন যা তিনি আইটিতে আসার দিন থাকেই রঙ্গি দ্যাখতে শেখছিলো।
সব ছেলেমেইয়াদের সাথে ও-ও দাঁড়াইছিল গেটের লগে। আর আধা ঘণ্টা দাঁড়াইতে হবে, সিকিরিটি বাবু তাই বলতেছেন। ‘ম্যয় হুঁ, ম্যয় হুঁ, ম্যয় হুঁ ড-ন’ গুন গুন করতে করতে রঙি কবছর আগের সেই সেদিনটায় ফিরে গেল নিজের অজান্তেই।
—রঙি আজ কাজে যায় নাই, কালুদার চায়ের দোকানের রঙচটা বেঞ্চিটায় বাবু হইয়ে বসে রইছে। পাশে ঘাস কাটা ফন্নাটা রাখছে, কুকুরগুলান ভাগাবার জন্যি।
আজ বড় খুশির দিন গো রঙির। কালুদা ওর জন্যি তেবড়ানো কালো প্যানটায় দিয়াছে দুটা পিস পাঁউরুটি—ওই যা তেল লাগে আছে তাতেই বেশ ভাজা ভাজা হইয়ে যাবে।আর ওই কি যেন বলে আপ আপ না কি যেন ডিম ভাজা? হঁ, হঁ, মনে পড়ছে-ছানি ছাইড আপ। রঙির খুড়ি আই টি বাবুর বাড়ি কাজ করে আর রঙি ঠিক জানলার নীচে বসে ঘাস বাছতে বাছতে শোনে ছোড়দি বলে ‘শান্তদিই---আমার জন্য একটা সানি সাইড আপ’। খুড়িকে ধরে ব্যাপারটা প- রিষ্কার করে নিয়েছে রঙ্গি। আর সেই আপ ডিম ভাজা কালোদাকে ভালো করে বুঝিয়েছে ও। তাই রান্নাই হচ্ছে আজ ছোট টিন চালার চা ঘরটায়।
আজ যে দেশের পরধান মনতিরি মশায় আসবেন আই, টিতে দাদাদের পাশের কাগজ হাতে হাতে দিতে। উনি তো রঙিরও নিজের দেশের মানুষ। ও জানে। কাজ সারে যখন ও সবেদা গাছটার তলায় বসে চা-মুড়ি খায়, তখন গাছে বেঁধে রাখা চারা গাছ চাপা দেওয়ার পুরনা খবর কাগজগুলানের দিকে কেন জানি ওর চোখ চলে যায়, একটা দুটা পড়তেই থাকে।–রঙি ছ কেলাস অব্দি পড়েছে, ও তাই বলে। আসলে দু কেলাসে তিন বচ্ছর ছিল, কিন্তুক রঙি হিসাবে পাকা তাই করাই ফেলছে তিন দুগুণে ছ কেলাস---বচ্ছরগুলান কি ফ্যালনা নাকি! আর ইস্কুল বাড়ির দাওয়ালে ও যে মা সরস্বতী আঁকছিল, যিটা ফি বচছর পূজা হয় সিটাও কি কম কাজ?
রঙির বড় সাধ হইছিল লাল, লীল ঝান্ডা হাতে পরধান মনতিরি মশায়রে হাত লাড়বে। এঁচে রাখেছিল মার আটার টিনা থাকে আটা নিয়া লেই বানায়ে রাখবে, এট্টুখানই লিবে। খাবার জিনিস তো, লষ্ট করতে নাই, মা শিখায়েছে, আর মাচানে তো ঘুড়ির কাগজ সরানো রাখাই আছে বিশ্বকর্মা পূজোর জন্যি। কিন্তুক দুদিন আগে থাকতেই তো সকল গেটে পাহারা। ওদের অনেককেই ছবি সাঁটা হলুদ টিকেট দেওয়া হইছিল গেটে ঢুকে যাতে উরা কাজ করতে পারে। তা রঙি নেয় নাই, একটা দিন ছুটিই নিছে। আর সারা আই টিতে সি কি---সাজের ঘটা! মাথায় পাখা দিয়া পেলেন লামবে, কদিন থাকতেই আমগাছগুলানের মাথার উপর দিয়া উড়তে শুরু করেছিল তারা। আর আইটির ইস্টিডিয়ামগুলায় কত যে ইঁটা পড়ছিল পেলেন লামার উঠান বানাইতে! এক জাগায় বরষার কাদায় ইঁটা জাঁকে গিয়া হল নি তো আর এক অন্য মাঠে। রঙি ছোটদিদি আর কাকীমার মুখে শুনেছিল এক এক মনতিরির দেখাশুনা করবেক এক এক কাকুরা যারা আই টিতে পড়ান ----আহা কি হৈ হুল্লোড় গো!
পরী, রঙির ভাইটা তো খেলার ধরনটাই পাল্টাই ফেলছিল কদিনা থাকতে। সারাদিন বাঁশের লগা দিয়া বন্দুক বানায়ে উঠানের এ মাথা ও মাথা গ্যাট ম্যাট করে চালছিল আর একটা খুঁটায় গামছা জড়াই পরধান মনতিরি বানাইয়ে থাকে থাকে লিচু হইয়ে প্রনাম করছিল। অরা দু ভাই আঁচে রাখছিল ঘরের চালায় মইটা লাগায় উঠে পেলেন গেলেই হাত লাড়বে, যদি উনি দ্যাখেন, দ্যাখে তো ফ্যালতেও পারেন! কিন্তুক বাপু শাসায়ে রাখছিল-‘পরী, রঙি, চালে উঠবিক লাই, এবচ্ছর ভারি বরষায় সব খোঁটা লড়বড় করতেছে, এখনও লতুন খড় দিতে পারি নাই, চাল ভাঙলে পিটাবো তোদের দু লোককেই’। অগত্যা----।
তিনি আসেছিলেন—। মাতরো দু ঘণ্টার জন্যিই হবেক। পরদিন রঙি ছোড়দি আর কাকীমারে শুধাইছিল, মন দিয়া শুনছিল তিনি বলে গেছেন স্বপ্ন স- কলকেই দেখতে হবে। আর সেই স্বপ্ন সত্যি করতে খাটতে হবে খুউব।---রঙির বড়ো ভাল লাগেছিল কথাগুলান। ও-ও যে স্বপন দ্যাখে, মনে ওর ইচ্ছে জাগে বাপু যে জমিনটা পুলিন কাকারে দিয়া টাকা নিছিল মার ঔষদ বানাইতে সিটা ও ছাড়ান করবেই আর তারপর মাথা উঁচা করি একদিন দিললি গিয়া পরধান মনতিরি মশায়রে পরনাম করে আসবে। ঠিক ঠিক পারবে। পরী যদি ঘুমের ঘোরে বেশি লাথ না মারে উয়াকেও সাথে লিবে। ধান কাটা আর আইটি কাকুর বাগানে জল ঝাঁটা দেওয়ার মাইনা থাকতে কিছু কিছু বাঁচায়ে চিঁড়া মুড়ির পোঁটলা নিয়া রঙি লিশ্চয় লিশ্চয় পৌঁছাই যাবে তাঁর কাছে।
—সিকিরিটি বাবু আর একবার নামগুলান ডাকতেছেন। ডাকছেন ‘রঙিল কোটাল---!’ (জনমের সময় মার আদর করি দেওয়া নামটাই রঙি পরথম কেউ জিগাস করলে বলে থাকে, গেরামের লোকে, চিনা জানারা রঙি বলে তো কি!)----গেট খুলে গ্যাছে, কি সুন্দর বাগান গো, রঙি যদি অমন বাগানে কাজ পায়! পরীরে একবার আনতেই হবে, ইবার আনা গেল নি। আর ---আর-ওই তো উনি, শান্ত মানুষটি, পেতে রাখা চেয়ারে আসে বসলেন। খুশীতে রঙির বুকে হাজারো রেলগাড়ি সিটি বাজাই ঝকঝক করি আগাই গেল।
(পরবাস-৫৫, অক্টোবর, ২০১৩)