আরে! কেমন আছো? অনেকদিন পর দেখা!
জানো, আমি না গত কয়েকদিন যাবৎ তোমার কথাই ভাবছি বিশেষ একটা কারণে। ঠাট্টা না। .. বলছি। আগে বল তো, কী ব্যাপার। তুমি এত স্মার্ট! বাড়ির সব? পৌঁছে দিয়ে হাওয়া? দারুণ!...
আচ্ছা, কী করছি আমরা বল তো? কেবল বকবক, না? বেশ লাগছে। মাঝে মাঝে কাজের কথার চেয়ে বাজে কথায় কাজ হয় বেশি। ছকে বেঁধে তোমায় বোঝাতে পারতাম কি, কী বলতে চাই আমি?
তবু ধরা ছোঁওয়ার মতো ভিত্তি চাই একটা - কী বল, না? হুঁ, ঠিক ধরেছি। মেয়েলি প্রচেষ্টা আর কাকে বলে। রবি ঠাকুরই ঠিক বুঝেছিলেন তোমাদের। ঐ যে 'শেষের কবিতা'য় আছে না - 'সব জিনিসকে একটা রক্তমাংসের রূপ দেওয়ার প্রবণতা ওদের মজ্জায় মজ্জায়...' - আরে, আরে! ক্ষেপেছো দেখছি। বাদ দাও, বাদ দাও বাবা। ...
আচ্ছা! মনে পড়ে তোমার? - আমরা কজন - তুমি, আমি, উজ্জ্বলা আর দোলা ... মাঝে-মাঝে কলেজ ছুটির পর রোজকার ফটকটা দিয়ে না বেরিয়ে অপর ফটকটা দিয়ে বেরোতাম আর পাশাপাশি হাঁটতে - হাঁটতে, কলকল করতে করতে সোজা চলে যেতাম ডানদিকের রাস্তাটা ধরে। একে একে কলা মহাবিদ্যালয় এর স্নাতক আর উত্তর-স্নাতক ভবন, দর্শনের উচ্চানুশীলন কেন্দ্র— পেরিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই পেরোতাম মহাবিদ্যালয় গুলির সামনের ভীড়-ভীড় রাস্তাটা। যাই বল, ভীড় আমি পছন্দ করিনা মোটে। ... ইয়ারকি কোরো না। ছেলেদের আদেখলাপনা আমার বাজে লাগে। নিশ্চয়ই! যেহেতু আমি নিজেও ছেলে।... আচ্ছা যাক, কথাটা বলতে দেবে কিনা?
ছাত্রাবাসগুলির সামনে পড়া পর্যন্ত রাস্তাটা কিন্তু বেশ পাওয়া যেত, না? ভীড় থাকত না। আচ্ছা, একদিন যেতে যেতে উজ্জ্বলার আর তোমার মধ্যে কেমন ঝগড়া বেধে গিয়েছিল.. না-না, সে অর্থে নয়, মানে .. হ্যাঁ, ওই। কেন! দোলার পেছনেই কি আমরা কম লেগেছি! .. এ্যাই! তুমি লাগোনি বলতে চাও? - ওকে নিয়ে তুমি ঠাট্টা করোনি? কী বলেছিলে? মনে নেই! হুঁ-হুঁ! বলোনি, ক্লাসে তোকে দেখতে না পেয়ে একজন আজ খোঁজ করছিল? তারপর আমি দোলাকে নিয়ে শ্রীরাধার রূপবর্ণনায় লেগেছিলাম। যাই বল, দোলাটা ছিল ভারি ভালো। কখনো রাগ করেনি।
যাক গিয়ে, আসল কথাটা শুরু করতে না করতে তুমি টুকে-টুকে কেটে দিচ্ছো। হ্যাঁ, তুমি ছাড়া এখানে কার সঙ্গে কথা হচ্ছে! ..
আচ্ছা, একটা কথা তখন থেকে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, বুঝছি না ঠিক - তোমার দাদা তোমায় রেখে চলে গেলেন ... এটা কিরকম হল! তোমার তো বাড়িও একখানা ...ও! আত্মীয়? কে? কন্যাপক্ষ? তাই বল। .. তা ওঁরা? রাত দশটায়? কেন? যাক, সে তোমাদের ব্যাপার। হাতে দেড়ঘন্টা সময় আছে। আমরা একটু পরে খেতে উঠবো, এ্যাঁ? তোমার সঙ্গে তো দেখাই হয়না। ..
বলতে আর দিচ্ছো কই? মাঝে-মাঝে যত আটপ্কা কথা। .. হ্যাঁ। তা ঠিক। আসল মজাটা ছাত্রাবাসের পথটাতে এসে পড়া থেকে নিয়ে বাকিটা আর সবচেয়ে বেশি যে জায়গাটার জন্য মন কেমন করে, সে ওই রাস্তাটা পেরিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য মেলতে মেলতে যাওয়া।
তুমি তা জানো, আমি কেমন অতীত-কাতর। বিশেষ করে আমাদের ওই বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার দুবছর, আমার ছাত্র জীবনের বোধহয় সবচেয়ে .. সবচেয়ে .. কী বলি .. মানে তুমি তো বুঝতেই পারছো। .. ওই হাঁটতে হাঁটতে শেষ প্রান্তে গিয়ে অধ্যাপক নিবাসের ভিতর দিককার পথটাও ছাড়িয়ে 'কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়' -এর সীমানার প্রাচীর ঘেঁষা পথটা ধরে ডঃ সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষাল-এর আবাসে যাওয়া। হ্যাঁ, মাস্টারমশাই 'বি. এইচ. ইউ' থেকে চলে যাওয়ার আগের কথাই তো হচ্ছে। তার আগে আর আমরা কোথায় গেলাম ওঁর কোয়ার্টারে। আমি? আরে হ্যাঁ, আমি যাব না কেন? অনেকবার। আরেবাবা আমরা একসঙ্গে তো আর যাইনি।
সবশুদ্ধ বোধহয় তিনবার, না? একবার উজ্জ্বলা ছিল না। (একবার, না দুবার?) শুধু তুমি, আমি আর দোলা। যাই বল, আমাদের তিনজনের দলটাই ভালো ছিল। খাপ খেতো বেশ।
আমি ভারি অন্যমনস্ক হয়ে যাই সেইসব মনে পড়লে। .. মাষ্টারমশাই কিন্তু খুশী হয়েছিলেন খুব আমরা যাওয়াতে, না?
আমার না, তারপর থেকে আমাদের ওই অভিযান, পথচলা আর মাষ্টারমশাইকে মিলিয়ে একটা সঞ্চয় হয়ে গিয়েছে দিব্যি। একলা একলা যখন যাই ওইসব জায়গা দিয়ে, কেমন নিজেকে হারিয়ে দিতে ভালো লাগে ওই সময়ে। ওই রাস্তাটা, আগাগোড়া চোখ বোলাই, তাকাই, আস্তে-আস্তে হাঁটি .. সাইকেলে গেলে .. ও হ্যাঁ, তোমাকে তো বলাই হয়নি, সুসংবাদ আছে একটা - আমি একটা সাইকেল কিনেছি। এই অল্প কিছুদিন। .. র্যালে। হ্যাঁ। .. না, হাঁটায় ইতি দেব কেন! সময় বাঁচানো। হাঁটি তো এখনও। হাঁটবো।
ওই দিকের রাস্তাগুলোয় বেড়াতে আমার ভালো লাগে, সে তো জানোই। তার পর এখন আবার সাইকেল হওয়ায় প্রায়ই ওখান দিয়ে বেড়াতে যাই সুপ্রকাশদার কাছে।
সেদিনও সুপ্রকাশদার কাছে গিয়েছিলাম। গিয়ে শুনি উনি নেই। শহরে এসেছেন। একটা বই ছিল। দিয়ে দিলাম মিকু, ওঁর ছেলের হাতে। তারপর ঠিক ওই রাস্তাটা ধরেই ফিরতে লাগলাম। ঠিক সেই বিশেষ জায়গাটায় এসে কী হল জান ...
তখন রাত হয়ে গেছে। আর রাত হলে 'বি. এইচ. ইউ'-র যা রূপ খোলে না! .. সে .. তুমি না দেখলে বুঝবে না। .. নিঝুম চারিদিক। স্বপ্নের মতো বাতিগুলি জ্বলছে। হাল্কা-হাল্কা হাওয়ায় কাঁপছে গাছের পাতাগুলি। ঘুম-ঘুম রাস্তারা রাত্রির বালিশে মাথা রেখে শুয়েছে।
এক জায়গায় এসে হঠাৎ পিছনে চাইতেই দেখি, — ঠিক মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সেই মোড়টা আর তারপর না, আমিও যেন কেমন মাতাল হয়ে পড়লাম। আমার চেতনার পা টলতে লাগল। সাইকেলের গতিটা কমে গেল। আর .. আমি না, স্মৃতির ডাকে নিশির মায়ায় আমাদের সেই রাস্তাটা ধরে ফিরে চললাম। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির দিক থেকে সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়-এর 'ভারতীয় ভাষাবিভাগ'-এ আমাদের 'বাংলা বিভাগ' -এর দিকে। ..
যেন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে লাগলাম - ওই তো .. তুমি, আমি আর দোলা হাঁটতে-হাঁটতে হাত দোলাতে-দোলাতে বিভাগের দিক থেকে আসছি। .. সঙ্গে কি উজ্জ্বলাও আছে? .. তোমার আর আমার ছবিটাই স্পষ্ট। আরগুলি মেঘলা।
কতবার আমাদের স্মৃতিশরীর আমাকে ছাড়িয়ে মাস্টারমশাইয়ের আবাসের দিকে এগিয়ে গেল। আমি পিছন ফিরে আমাদের দেখলাম। আবার সামনে ফিরতেই - ওই তো আমরা আসছি ...। স্মৃতির শরীরে শব্দ ওঠে না। জানানবিহীন পায়ে আমরা আবার এগিয়ে আসছি। .. পেরিয়ে চলে গেলাম। .. আবার আসছি। ..
আমি তৃষ্ণার্ত ট্যান্টালাসের মতো একবার চারপাশের নম্র প্রকৃতির মধ্যে ডুব দিয়ে আবার আকুলতার ঠোঁট তুলে নিয়ে করুণভাবে মনে করতে লাগলাম - ওগো! এই যে আমি। আমায় চিনতে পারছো না? এই তো আমি। .. কই, আমি যখন তোমাদের বুকের কাছ দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গিয়েছি .. মন মুঠো ভরে তোমাদের তুলে তুলে নিতে চেয়েছি, .. তখন তো তোমরা জানাওনি যে, তোমরা আমায় চিনতে পারবে না! তোমরা কি আমায় কিছুতেই চিনবে না? ...
জান, পথ যত পাতা নেড়ে নেড়ে বলতে লাগল - না .. না.. আমি তত অবুঝ হয়ে উঠতে লাগলাম। শেষে খেই হারিয়ে ফেললাম। ছাত্রাবাস সরণিতে পড়ার আগে দুপাশের অনন্য প্রাসাদ আমায় কেমন শব্দহীন নম্রতায় নীলচে আলোর নরম অভ্যর্থনায় সম্ভাষণ জানাল। আমি ছাত্রাবাস সরণিতে পড়েও আচ্ছন্নের মতো সাইকেলের কাছে কাকুতি জানালাম। নতুন প্রেমের মতো চকচকে সাইকেল নরম সমবেদনায় মুখ ঘুরিয়ে ছাত্রাবাস-সরণি আর মহাবিদ্যালয়-সরণির মাঝের রাস্তায় বেড়াতে নিয়ে গেল আমায়। আলোছায়ার অবাস্তব পটভূমিতে পত্রমর্মরের ব্রাস-বাজনা, হাওয়ার ঘুম-পাড়ানি গান, মাথার উপরে অসীম নীলিমার শূন্যতার ফিস্ফিসানিতে আমি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ...
তারপরের কথা ভালো মনে নেই। সাইকেল না থাকলে আমি বোধহয় 'সার্সাপেরিলার গন্ধ'-এর নায়কের মতো স্মৃতির স্বপ্নপুরীর হঠাৎ-খোলা দরজার মধ্যে মিলিয়ে যেতাম। ছায়া-ছায়া অবাস্তব পুরাতত্ত্ব বিভাগ আর দর্শনের উচ্চানুশীলন কেন্দ্রের নীলচে-সাদা অশরীরী আলোগুলি আমায় 'ক্ষুধিত পাষাণ'-এর মেহের আলি করে ছেড়েছিল। চেতনার শেষ ধাপে নামতে নামতে শুনতে পাচ্ছিলাম হাইড্রেন-এর তলায় জলের স্রোতের উচ্ছলতান, .. ফুলের কেয়ারিতে রবার পাইপের 'লোরী', .. তারাদের দোলনা-দোলা আর বাতাসের ঝুমঝুমি ...। জোর করে বুজে আসা চোখ খুলে দেখেছিলাম - নিয়তি আমায় এনে ফেলেছে 'কলা মহাবিদ্যালয়'-এর স্নাতকোত্তর, স্নাতক-ভবন ছাড়িয়ে আমাদের সেই 'সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গণ'-এর মোহানায় .. 'বাংলা বিভাগ' নামের ধূপ-ধুনো মেশা জায়গাটায়। আর, ওই তো - সামনে থেকে বরাবর এগিয়ে আসছি - তুমি, আমি, দোলা ...
শেষ মুহূর্তে চোখটা বুজে যাবার আগে অনুভব করতে পেরেছিলাম - 'সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়' ঘুমের ফোয়ারা ছড়াতে ছড়াতে আমায় ডাকছে। আমি তার নিঝুম নিতল শান্তিসরোবরে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সাইকেল মুখটি বুজে আমায় হঠাৎ সেই বিপজ্জনক সীমানা থেকে তুলে নিয়ে বিন্দুমাত্র দেরী না করে চালিয়ে দিল 'অশোক মার্গ'-এর জাগরণের এলাকায়। আমার সমগ্র চৈতন্য জুড়ে কারা যেন হাহাকার করে উঠলো। ঘুমের অতল থেকে ভেসে উঠতে উঠতে দেখলাম - 'সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়' তার নীলচে বাতির ফোয়ারা নিয়ে জাগরণের ওপারে ঝিলিমিলি কাটতে-কাটতে, রিমঝিম অবসাদ ছড়াতে-ছড়াতে ডুবে যাচ্ছে। সাইকেল আমার হাত ধরে একটু দোলা দিয়ে বলল - ভয় কী মিতা! এই তো আমি! ...
... অলকা! নতুন 'ব্যাচ' যাচ্ছে। যাব আমরা?
(পরবাস-৫৫, অক্টোবর, ২০১৩)