ISSN 1563-8685




যাযাবরের ডায়েরি

এক যাযাবর এর কাহিনি। যার কোনো প্রত্যাশিত শুরু অথবা শেষ নেই। কিছু মুহূর্তকে সম্বল করেই যাযাবরের যাত্রা শুরু কিছু দশক আগে। বলা ভালো, এক তরফা মানসভ্রমণ, ইতিহাস ও জীবনের মাঝখানে থেকে।

আজ থেকে বেশ কিছুদিন আগে কলকাতাস্থিত মার্কিন এমবাসিতে, ভিসা সংক্রান্ত সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েই নতুন কোনো ভাবনা আমাকে এই মানসভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছিল। আমেরিকার মত দেশে, পৃথিবীর কত মানুষ না জানি কত স্বপ্ন বুকে বেঁধে এই পরদেশে বাসা বাঁধতে চলে এসেছে। একলা হয়েছে, নাগরিক হবার প্রচেষ্টায় পরধর্ম, ঐতিহ্যকেই সহজে বরণ করেছে। বর্তমান জীবনের সঙ্গে মানানসই এই পরিবর্তন। যাহোক, মার্কিন দূতাবাসে সেদিন অনেকেই তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করছিল। নানারকম উচ্চারণ, আর বিদেশী প্রতিনিধিদের সন্তুষ্ট করার বিবিধ কলা পারদর্শিতা বুঝিয়ে দিচ্ছিল তাদের ভিসার গুরুত্বকে। নিজেদের সততার চূড়ান্ত প্রমাণ দিতে দিতে দিতে নানান সঙ্গতি ও অসঙ্গতি মিলিয়েই আমাদের অনেকেরই সেদিন ছাড়পত্র মিলেছিল। মজার কথা, প্রমাণ থাকা সত্বেও বিদেশী প্রতিনিধিরা বারবার সেদিন আমাকে ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশ-এর মাঝখানে এনে দাঁড় করাচ্ছিল। আমি একজন বাংলাদেশী, ইন্ডিয়ায় গবেষণা করছি, বৈবাহিক সূত্রে ভারতীয় হবার দাবি রাখি, এই ত্রিকোণ অবস্থান হয়ত এসব প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। পাঠক হয়ত এসবের সঙ্গে যাযাবর আর তার মানসভ্রমণের সংযোগ খুঁজছেন। আসলে সব কিছুই সংযুক্ত, কার্যকারণ সমন্বিত। অতীত আর বর্তমান মিলিয়েই নতুন কোনো ইতিহাসের প্রারম্ভ রচনা। আর ইতিহাস আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবন থেকেই প্রতি মুহুর্তে নিজেকে আবিষ্কার করে চলে। নতুন দেশভ্রমণ আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল সেদিন। বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়া এবং পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বের দেশে এসে অনেকগুলো ভাবনার জলসিঞ্চন আমাকে আপন অস্তিত্বের প্রতি প্রশ্নাতুর করে তুলেছে। এক মুহুর্তের জন্য নিজেই বিভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম কোথায় ছিলাম, আর এলাম কোথায়, আরো কত বার কোথায়ই বা যাব! কতদূরে আমার নিজের দেশ, নিজের শহর! এই মার্কিন মুলুক তো কখনো আপনার হবেনা, ইন্ডিয়াও কি হবে? বোধহয় নয়, আর আমার বাংলাদেশ? যেখানে জন্মেছি? সেখানেও কি ফিরতে পারব আমি আগের মতো করে, একই পরিচয়ে.........?

তারপর অনেক দিন কেটেছে, চলেও এসেছি নির্দিষ্ট গন্তব্যে একসময়। কিন্তু প্রশ্নটি আমাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়, কে আমি, কোথায় যেতে চাই? যার আপন কোনো সীমানা নেই, শুধু যার ছুটে চলা, পাসপোর্ট, ভিসা নম্বরেই আক্ষরিক থেকে যাওয়া!

মাত্র এক দশক পিছিয়ে গেলেই নিজেকেই দেখতে পাই নতুন করে। এক সামান্য মানুষ, একজন ছাত্রী। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বাংলাদেশের ঢাকা থেকে পড়তে এসেছে। বাংলাদেশ, শুধু নাম-মাহাত্ম্যেই সবার চোখে সেই ছাত্রীটি, অন্য গ্রহ থেকে আসা যেন বিস্ময়! সহপাঠী থেকে মেসবাড়ির কর্ত্রী, গা বাঁচিয়ে-চলা আত্মীয়েরা সকলেই কুশল না হলেও এটুকু নিশ্চয়ই সেদিন জিজ্ঞাসা না করে পারেনি যে-- "তোদের ওখানে অনেক মোহামেডান আছে, তাইনা? যাই বলিস, পাকিস্তানে 'মোসলমান' ছাড়া আর আছেই বা কি, বাঙালির যত দুর্দশা''! তোর মাইগ্রেশন আছে তো? মনে পড়ে, নতুন আর এক ইতিহাসের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি। বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে যে বাঙালি জাতি তা সবাইকে বোঝানো যায়নি। কারণ পুর্ববঙ্গ থেকে দেশভাগ বা দাঙ্গার সময়ে যে মানুষেরা কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা অস্পষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। তবু মাঝে মাঝেই মুসলমান, বাঙালি, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আমি, তুমি, আমরা, তোমরা ইত্যাদি নানান বোঝাপড়া আমাকে ভাবাত দীর্ঘদিন। এখনও ভাবায়। আর ভাবায় মাইগ্রেশন নামক শব্দটি। বাংলাদেশ-এর প্রশ্নে এসে পড়ত দেশবিভাজন-কালীন সাম্প্রদায়িকতার নানা প্রসঙ্গ। এসবের ভ্রান্তিই শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গে আমার স্থানীয় অভিভাবকের পূর্বপরিচয়ের সত্যতা যাচাইও একই বিষয়-কেন্দ্রিক হয়ে উঠত। অর্থাৎ সে কি আদৌ ভারতীয়? যথেচ্ছ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এসে যেত দেশবিভাগের সময়কার রিফিউজি প্রসঙ্গ, সে কি রিফিউজি ছিল? কিভাবে সে ভারতীয়? দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় জুড়ে প্রমাণের পর প্রমাণ যোগাতে গিয়ে যাযাবর হয়ে উঠেছি সেদিনের এই আমি। খুঁজে চলেছি সামগ্রিক কোনো ইতিহাস, যার নির্যাস রয়ে গেছে এই মানসিক প্রতিক্রিয়ার গভীরে।

বাঙালির আত্মপরিচয় আর দেশবিভাগ একাকার হয়ে মিশে আছে স্বাধীনতার অনুষঙ্গে। ষাটের দশকের অধিক সময় অতিক্রম করেছে দেশভাগ। অবিভক্ত বাংলায় আলাদা কোনো পরিচিতির প্রয়োজন ছিলনা মানুষের। তখন ইংরেজ এবং ভারতীয় এই ছিল প্রধান বিভেদ। মানুষ স্বাধীনতা চেয়েছিল, দাসত্ব থেকে মুক্তিই ছিল তাদের প্রথম এবং একমাত্র লক্ষ্য। সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে পরবর্তী কালে তিরিশ কিংবা চল্লিশের দশক জুড়ে লাগাতার আন্দোলন চলেছে বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে। সুভাষ বসু, তিতুমীর, চিত্তরঞ্জন দাস, মৌলানা আব্দুল কালাম আজাদ, প্রফুল্ল চাকি, ভগত সিং প্রমুখেরা যে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, তাঁদের সে স্বাধীনতার মানে ছিল ব্রিটিশ মুক্ত ভারতবর্ষ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দুশো বছরেরও বেশি সময় লেগে যায় ভারত স্বাধীন হতে। কিন্তু কি আশ্চর্য! দেশ স্বাধীন হবার মাত্র চল্লিশ বছর পূর্বেই স্বাধীনতার মানেই বদলে যায়। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের সঙ্গে জুড়ে যায় হিন্দুস্থান ও পাকিস্তানের প্রসঙ্গ। ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত লাগাতার ভূখণ্ড নিয়ে টানাটানি চলে। দেখা যায়, ব্রিটিশ নয়, দ্বন্দ্ব কংগ্রেস ও লীগের, ওরফে হিন্দু ও মুসলমানের। দেশভাগ হয়ে যায়। হিন্দু ও মুসলমানেরা বাধ্য হয় আপন দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে। যুগে যুগে জাতীয়তার ধারণা বদলে ধর্মীয় সংস্কার মানুষ কে 'স্থান' ও 'স্তানের' পৃথক স্বাধীনতা এনে দিলেও ইতিহাসের এই সহজ ও কঠিন যাত্রাপথ সাধারণ মানুষের জীবনকে তছনছ করে দেয়। পরিচয়হীন হয়ে ওঠে কোটি মানুষ রাতারাতি। দেশভাগের পাঁচ বছরের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। দেখা যায়, ভারতীয় স্বাধীনতার সূত্রেই আরো তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সূচনা হয়। আরো একবার মানুষ শরণার্থী হয়ে ওঠে, বাংলাদেশ জন্ম নেবার সময়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দুই বাংলার মানুষ অনাথ জীবন যাপনে বাধ্য হয়।

ইতিহাসের এ পরিণতির জন্য দায়ী ছিলনা দুই বাংলার কোনো সম্প্রদায়। তবু বিশ্বাস ভেঙে যায়, পর হয়ে যায় চেনা ঘর, প্রতিবেশী, হিন্দু মুসলমান পরস্পরের সৌহার্দ্যের মিলিত সংসার! নতুন নতুন শব্দ আসে দেশে, রিফিউজি, শরণার্থী, বাঙাল, বিহারী ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি আরো কত কিছু বদলে যেতে থাকে সহজে। আজ বিংশ দশকে এসে সাম্প্রদায়িকতার বুকে আঙুল বুলিয়ে আমরা সুখে ঘুমোতে যাই। কারো নিজ দেশে ঘুম না পেলে অন্য দেশে ঘুম খুঁজতে যাই!! এ এক অদ্ভুত পালাই পালাই খেলা সকলের। একবার মনে আছে, কলকাতা থেকে দুরে বনগ্রামের পেট্রাপোল সীমান্তে কোনো এক উদ্বাস্তু পরিবারের সঙ্গে আলাপকালে, গৃহকর্তা বৃদ্ধের ''দেশ" সম্পর্কিত নিরাসক্তি ও পরিচয়জনিত হতাশা সাম্প্রতিক এই পালিয়ে বাঁচার সংকটকেই যে তুলে ধরেছে, সন্দেহ নেই। আমি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক, জীবনে কখনো পরাধীনতার যন্ত্রণা বুঝিনি, এর পেছনের রাজনীতি, কূটনীতি, কিছুই আলাদা করে বুঝিনি, বাঙালি হিসেবে মুসলমানদের কখনো আলাদা করে দেখিনি, হিন্দু হিসেবে নিজেদের কখনো বিশেষ বলে মনে হয়নি এখনো মনে আছে, ঢাকার বেইলী প্রিপারেটরী স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ধর্ম ক্লাস-এ অর্ধেক সময় আরবি পড়েছি। শ্রেণী শিক্ষক হুজুর আমাদের বাড়িতে আসতেন, হিন্দুধর্ম বিষয়ক আলোচনা করতেন আমার দাদুর সঙ্গে। প্রতি ঈদ, বড়দিন, পুজো আমাদের বাড়িতে খুব আনন্দের সঙ্গেই উদ্‌যাপিত হত। ফলত, কলকাতায় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেকে অনেক বার অসহায় হতে দেখেছি। এখন যে পরিস্থিতির কথা শুনতে ও দেখতে পাই তাতে আমি ও আমার ফেলে আসা দেশের অনেক ঘটনা, এখন বিধর্মীর বিস্মৃতি ছাড়া আর কিছু নয়! কিন্তু তাতে আমার ভাবনা অপরিবর্তনীয়ই থেকে যায়। কেবল আমি আমার দেশ খুঁজি ভিসা, পাসপোর্টে আর অলিখিত কিছু প্রশ্নের নিয়ম ভেঙে। দেশভাগ পেরিয়ে গেছে অনেকদিন, তবু দুই বাংলার মাঝখানে আজ তুচ্ছ ও বিরাট তফাৎ। এই ব্যবধান মূলত মূল্যবোধ ও মানসিকতার। এই ভেদ যদি না থাকত তাহলে এই অস্তিত্বহীনতার কোনদিন জন্ম হতনা, অথবা মানুষ ভুলে যেতে পারতো। কোনো নতুন দেশে পাড়ি দেবার সময় নিজেকে উদ্বাস্তু মনে হতনা অন্তত। কিন্তু চারদিকের বাতাবরণ বড়ই অশান্ত হয়ে উঠছে দিন দিন। ২০১৩ সালের পটভূমিতেও উপমহাদেশের নানা প্রান্তে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়ে ওঠার নানা ইঙ্গিত, নানা দাবি প্রকট হয়ে উঠছে ক্রমশ। আজও অমীমাংসিত কাশ্মীর, বিভক্ত হতে ব্যস্ত গোর্খাল্যান্ডের অধিবাসীরা, এমনকি পৃথিবী জুড়েই কোনো না কোনো প্রান্তে মানুষ তার আপন জগৎ, স্বাধীনতাকে খুঁজে চলেছে। পৃথিবীতে বারবার বিভিন্ন স্থানে ভাঙাগড়ার মাঝখানেই লক্ষকোটি উদ্বাস্তু মন আশ্রয় চাইছে। অনেকটা ইতিহাসের শালপ্রাংশুর গভীরে হারানো কোনো অনুষঙ্গকে ফিরে পাওয়ার মতো। আমিও আবিষ্কার করছি আমাকে প্রতিদিন। বর্তমানে আমেরিকায়, প্রবাসী ভারতীয় ও বাংলাদেশীদের জীবনভাবনায় ছেড়ে আসা দেশ, নানা বিকল্ল্পে খুঁজে পেতে দেখছি। মাঝে মাঝে কোনো শপিং মলে কানে ভেসে আসছে: ''ইন্ডিয়া যায়সা, হ্যয় না?" অথবা বাংলাদেশের কোনো স্টোরে গেলে 'আপা, এক্কেবারে দেশী মাছ, খাইয়া দ্যাখেন, দ্যাশের স্বাদ পাইবেন'! এরা নিজের দেশকেই তুলে আনতে চাইছে যেন যোজন যোজন ব্যবধানের সীমানা পেরিয়ে। যখন দেশ সম্পর্কে জানতে চাই, প্রবাসী ভায়েরা যেন অতল গর্ভ থেকে কিছু তুলে আনার মতো উত্তর জানান। মুখ থেকে মুখে দেশের গল্প 'আছে' থেকে 'ছিল' তে পরিণত হয়ে চলে ক্রমশ। এরা, আমরা সকলেই, নিজেদের সীমানাকে প্রত্যহ বাড়িয়ে চলেছি। আর তাইতো শিকড়ের টান মনে করিয়ে দিচ্ছে ইতিহাসকে। মনে পড়ছে দেশভাগ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। আমার দাদু অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অবিভক্ত বাংলার আন্দোলনের উত্তাপ তিনি অনুভব করেছেন, বাবার কাছে শুনেছি, পাক সেনাদের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে যশোর হয়ে পায়ে হেঁটে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি যুদ্ধের সময় ৭১-এ। আমি তো সবারই অংশ, জানিনা কিভাবে অনায়াসে মনের গভীরে শব্দ করে আমার দেশ। কোথায় তা? সব থেকেও না থাকার অধরা জীবনে আমি নিজেই এক সংখ্যালঘু যাযাবর, যার মনের দেশ আছে। অথবা মনটাই যার নিরুদ্দেশ হয়ে, প্রান্তিক মানুষ হয়ে বেঁচে আছে। দুই বাংলার মাঝখানে কিছু খাতা কলমের প্রমাণ ছাড়া যাকে খুঁজে পাওয়া যায়না, কিছুতেই না।



(পরবাস-৫৫, অক্টোবর, ২০১৩)