ISSN 1563-8685




“পুবে” নয়, চলো “দক্ষিণে” যাই

সেদিন যখন এ প্রান্তের “পাহাড়তলিতে অন্ধকার মৃত রাক্ষসের চক্ষুকোটরের মতো জমাট বেঁধেছিল”,“স্তূপে স্তূপে মেঘ” যখন “আকাশের বুক চেপে ধরেছে;” আর সত্যিই যখন “দিগন্তে একটা আগ্নেয় উগ্রতা” [১] ঠিক সেই সময় দূ-রে,‘দক্ষিণের’ এক কোণে একদল পূজারী তাদের অর্ঘ্য সাজিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছিলেন আলোর সন্ধানে। এ-প্রান্তে যুদ্ধের কোলাহলে মানুষের কানে আসেনি তাঁদের শঙ্খধ্বনি। আজ যুদ্ধক্লান্ত ‘পৃথিবী’ চেয়ে দেখছে সেই ‘আনন্দযজ্ঞের’ আয়োজন। ‘দক্ষিণের’ সেই ঋত্বিকেরা আহ্বান করছেন সবাইকে “আর যুদ্ধ নয়। এস, সকলে মিলে বেঁচেবত্তে থাকা যাক, হ্যাঁ, সকলে মিলে একসাথে ভাগ করে নি পৃথিবীর সম্পদ। আর তারই সঙ্গে গভীর কৃতজ্ঞতায়, পরম যত্নে লালন করি মা বসুন্ধরাকে--নইলে রেহাই নেই কারো!”— আশ্চর্য সহজ ভাষা, ছন্দ, সহজ যুক্তি: ‘Vivir Bien’ [২] :‘Living Well’, অর্থাৎ, সকল মানুষের, আর মানুষকে ঘিরে থাকা প্রকৃতির কল্যাণে গড়ে ওঠা যে জীবন-অভ্যাস।

‘VivirBien’

প্রাক্‌ধনতন্ত্রী দুনিয়ার মানুষের জীবন-অভ্যাস, দর্শন, আজ নতুন করে যেন উঠে আসছে ইতিহাসের কোন অতল থেকে, বিত্ত বৈভবে মত্ত দিশাহীন সভ্যতাকে পথের হদিস দিতে। আমাদের উপমহাদেশের আদিবাসীদের মতই দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী সমাজও আশ্চর্য উপায়ে প্রাচীন মানবিক বোধ, যা শাশ্বত, তাকে ধরে রেখেছে নিজেদের জীবনে। গোঁড়ামি নয়, তার সুস্থতাকে ধরে রেখে, মানুষের প্রয়োজন আর প্রকৃতি-সংরক্ষণ—এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার বিচক্ষণতাকে জাগিয়ে রেখে। 'পশ্চিমী' মানুষের কাছে নতুন শোনালেও প্রাচ্যের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের কানে একেবারে অপরিচিত নয়। বহুকাল আগে এক গৃহত্যাগী রাজপুত্রের এমনই কোনও মন্ত্রে আপ্লুত হয়েছিল আসমুদ্র-হিমালয়। “বহুজনহিতায়, বহুজন সুখায়”- সেই প্রেম পেরিয়ে গিয়েছিল জাতীয় সীমারেখা, তা সে যীশুখৃষ্টের জন্মেরও বেশ কিছুকাল আগে। সমাজকে মানবিক, শোষণমুক্ত করার প্রয়াস থেকে মানুষকে সরানো যায় নি কখনো। বিভিন্ন যুগে ভিন্ন-ভিন্ন প্রান্তে সেই উদ্যোগ গড়ে উঠেছে। আর মানব-সভ্যতা এক-পা এক-পা করে এগিয়েছে, ত্রুটি-বিচ্যুতি পাশে ফেলে রেখে। দক্ষিণ আমেরিকার সাম্প্রতিক সামাজিক-রাজনৈতিক নিরীক্ষা তেমনই এক উদ্যোগ। আপাতত: মানব-সভ্যতার একমাত্র ভরসা—এমনও দাবী করছেন অনেকেই। সম্ভবত এই অনুমানের সবচেয়ে বড় ভিত্তি বোলিভিয়ায় ইভো মোরালেস এবং ভেনেজুয়েলায় উগো শ্যাভেজ আর ইকুয়াডোর-এর রাফায়েল কোরেরা-র মত নেতৃত্বের উত্থান, যা একদিনে ঘটে নি। আফ্রিকার মতই ল্যাটিন আমেরিকারও তো দীর্ঘ যন্ত্রণার ইতিহাস আর তার বিরুদ্ধে লড়াইও অনেক কালের। আজ এতদিনে সে লড়াই যেন একটা শুভক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে মানব উন্নয়নের নতুন পরীক্ষার সুফল হাতে নিয়ে।

ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হল পৃথিবী জুড়ে পশ্চিমী উপনিবেশের সমাপ্তিতে আর বিংশ শতাব্দী শেষ হল যেন ধনতন্ত্রের, ভোগবাদের বিশ্বায়নের মধ্যে দিয়ে। দেশগুলি পরস্পরের কাছাকাছি চলে এল অর্থনৈতিক নির্ভরতার মধ্যে দিয়ে। কিছু কল্যাণকর প্রযুক্তি ইত্যাদির সঙ্গে মূলত উগ্র ভোগবাদ আর তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ধ্বংস আর হিংসা--ভেসে গেল সভ্যতা। আবার, ধনতন্ত্রের লাগামছাড়া প্রসার আর তারই অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের আদিবাসী সমাজের বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে যেন সূচীত হল একবিংশ শতাব্দী। একদিকে মূলস্রোত সমাজ আর তার ‘উন্নয়ন’, যে ‘উন্নয়ন’ আর গণহত্যা--এক ‘জৈবিক সম্পর্ক’ বলে দাবি করেছেন অরুন্ধতী রায়। তারই বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার কোণঠাসা ‘আদিবাসী’ সমাজ, যারা বরাবরই সরে থেকেছে মূলস্রোত সমাজ থেকে দূরে। সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যাদের জীবন নির্ভর করে আছে আজও সরাসরি প্রাকৃতিক সম্পদের উপর, আজ তারা মূলস্রোত সমাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে দাঁড়িয়ে। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে ল্যাটিন আমেরিকার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাবলী রীতিমতো বিস্ময়কর। মানব-উন্নয়নের চলে-আসা পশ্চিমী মডেলের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা নিদর্শন সে সমাজ নাড়াচাড়া করে দেখছে। একবিংশ শতাব্দীর নতুন সমাজতন্ত্র গড়ে উঠছে সেই অঞ্চলের মানুষের এবং নেতৃত্বের হাতে। বলাই বাহুল্য একদিনে হয় নি। গত পাঁচশ বছরের একটানা লড়াই পশ্চিমী আগ্রাসনের (নানা চেহারার) বিরুদ্ধে সে অঞ্চলের মানুষের। সেই লড়াই থেকেই উঠে এসেছে তাদের সামাজিক ন্যায়বোধ, সমাজতন্ত্রের বোধ, কোন পুঁথিগত বিদ্যার ওপর নির্ভর করে নয়। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ব্যক্তি-মালিকানাই যে সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতির মূল বাধা সে-কথা ল্যাটিন আমেরিকার গরীব মানুষ বুঝেছেন নিজেদের জীবন দিয়ে, কয়েকশো বছর ধরে--প্রথমে পশ্চিমী উপনিবেশ আর তার পরের অধ্যায়ে মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদের আধুনিক ‘হাতিয়ার’‘নয়া উদারনীতির’ (কেবলমাত্র আর্থিক লাভ যার মূল দর্শন) বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে।

ল্যাটিন আমেরিকার এই একটানা দীর্ঘ সংগ্রামের কালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে-সমাজে চলেছে নানা পালাবদল। ‘দক্ষিণের’ রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টি ছিল সজাগ, চোখ রেখেছিলেন তাঁরা ইতিহাসের দিকে, আর কান ছিল পাতা মাটির বুকে, সমাজের হৃদয়ে। আশির দশকের শেষে ‘সমাজতান্ত্রিক’ পূর্ব ইউরোপের পতন এবং তারই অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে দুনিয়া জুড়ে মার্কিনী ধনতন্ত্রের একচ্ছত্র দাপট। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে এল ‘সমাজতান্ত্রিক’ চীন তার নতুন আয়ত্বে আসা বৈভবের দম্ভ নিয়ে। কিছু অদূরদর্শী পণ্ডিত তড়িঘড়ি ঘোষণা করে বসলেন: মার্কিনী ধাঁচের ধনতন্ত্রই হল সবচেয়ে মজবুত অর্থনীতি। বিধাতা বুঝি অলক্ষ্যে হেসেছিলেন--দেখতে দেখতে এসে পড়ল ২০০৮ সাল, বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক ধ্বস। সে ভূকম্পনের ‘এপিসেন্টার’ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যে ধনতন্ত্রের ‘হাতিয়ার’ ‘নয়া উদারনীতি’র বিশাল ‘পরীক্ষাগার’ ল্যাটিন আমেরিকার মানুষের কাছে, বিশেষ করে নেতৃত্বের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র, তার প্রক্রিয়া ইত্যাদি। তাই প্রত্যক্ষ লড়াইটাও অনেকদিনই দাঁড়িয়েছে IMF ঋণের বিরুদ্ধে (এ-বিষয়ে আমরা পরে ফিরে আসব)।

নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকার-নিয়ন্ত্রিত সমাজতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী পতন, আধুনিক চীনের আগ্রাসী উত্থান আর যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক ধনতন্ত্রের গভীর সমস্যা--এই সব ঐতিহাসিক ঘটনাই ঋদ্ধ করেছে ল্যাটিন আমেরিকার সংগ্রামকে, তার নেতৃত্বকে। তাঁরা বুঝেছেন যে ‘সমাজতন্ত্রের’ (তথাকথিত ‘actually existing socialism’) অভ্যস্ত ধারা থেকে সরে আসতে হবেই। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধিকারের প্রশ্নটিকে জড়িয়ে নিতেই হবে; গণতন্ত্রকে খর্ব করে সমাজতন্ত্র গড়ে উঠতে পারলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। একবিংশ শতকের ‘সমাজতন্ত্র’ তাই তাঁদের গড়তে হচ্ছে পুরোনো নিরীক্ষার সীমাগুলিকে মনে রেখে। আর তার ফলে প্রচলিত মার্কসীয় ভাবনার (মূলত তার ভুল প্রয়োগ) বেশকিছু রদবদলও ঘটছে।

নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ভিন্নতা সত্বেও ল্যাটিন আমেরিকার এখনকার বাম প্রগতিশীল প্রয়াসের ক্ষেত্রে (যেমন, বোলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়াডোর ইত্যাদির) বর্তমান নিরীক্ষায় বেশ কিছু সাদৃশ্য লক্ষণীয়। যেমন, লড়াকু শ্রেণী সম্পর্কে পুরোনো যে ধারণা, অর্থাত্‍ সংগঠিত শ্রমিক ‘ব্যানারে’ একটা সমসত্ব গোষ্ঠী, এককথায় ‘প্রলেতরিয়েত ডিকটেটরশিপ’-এর প্রচলিত ধারণার সীমাকে উত্তরণের ঝোঁক দেখা দিয়েছে। সমাজের অন্যান্য ‘আইডেনটিটি’-র (identity) প্রান্তিক গোষ্ঠীর বিশেষ সমস্যা, দাবী ইত্যাদিকে স্বীকৃতি দিয়ে এক মস্ত খোলা শামিয়ানার তলায় নিয়ে আসা হচ্ছে--আদিবাসীদের নিজস্ব দাবী, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের বিশেষ সামাজিক অবস্থান এবং তার সমস্যা, বিভিন্ন সংখ্যালঘুগোষ্ঠীর দাবী ইত্যাদি। অর্থাত্‍ এই নতুন নেতৃত্ব বুঝেছেন যে কেবল এক-মাত্রিক শ্রমিক-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সমস্ত প্রান্তিক গোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, প্রত্যেকটি সামাজিক বৈষম্যকে আলাদা-আলাদা করে রুখতে হবে বৃহত্‍ লড়াইয়ের অংশ হিসেবেই। বলাই বাহুল্য এ-চৈতন্য অনেকটাই গত কয়েক দশকের আদিবাসী এবং ‘নারী-বাদী’ আন্দোলনপ্রসূত।

‘দক্ষিণের’ নতুন সমাজতন্ত্রের ধারায় এবার নাস্তিকতার সঙ্গে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক ধর্মবিশ্বাস এবং পালনের অধিকারকেও স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, পুরোনো ‘সমাজতন্ত্রে’ যে সহবাস প্রায় অসম্ভব ছিল। [আসলে, মানুষের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে মহামতী মার্ক্স-এর বক্তব্য বিষয়ে একটা মস্ত ভুল ধারণা প্রচলিত। মার্ক্স-এর মতে ধর্ম দলিত মানুষের কাছে কেবল ‘ওপিয়াম’-ই নয়, ধর্মকে আঁকড়ে ধরার মধ্যে মিশে থাকে সে মানুষের দীর্ঘশ্বাস—এই অত্যন্ত জরুরী দ্বিতীয় অংশটি বেশিরভাগ সময়েই উল্লেখ করতে আমরা ভুলে যাই]। ল্যাটিন আমেরিকার নিজস্ব ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য এক্ষেত্রেও কাজ করেছে। যীশু খৃষ্টকে দলিতের ‘প্রতীক’ হিসেবে ব্যবহার করে, সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার মধ্যে দিয়ে সে অঞ্চলের ক্যাথলিক ঐতিহ্য এক বিশেষ রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, যা ‘লিবারেশন থিয়োলজি’ (Liberation Theology) নামে পরিচিত। বঞ্চিত মানুষের লড়াই এই লিবারেশন থিয়োলজি’র দ্বারা নানাভাবে অনুপ্রাণিত। মানবকল্যাণ বা দরিদ্র-সেবার ক্ষেত্রে আস্তিক-নাস্তিকের দ্বন্দ্ব আপনিই গেছে মুছে; এমন কী বর্তমান নেতাদের অনেকেই ঘোষিত ‘ক্যাথলিক’।

নতুন বাম প্রগতি-বাদীরা আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান, প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে না গিয়ে বরং তাকে জড়িয়ে চলায় বিশ্বাসী। অর্থাত্‍ খোলা নির্বাচন, রেফারেণ্ডম, আইন-সংস্থা—এই সবকে মেনেই। বোলিভিয়ার ইভো মোরালেস, ভেনেজুয়েলার উগো শ্যাভেজ, কিংবা ইকুয়াডোরের রাফায়েল কোরেরা--এঁরা সকলেই ক্ষমতায় এসেছেন সাধারণ মানুষের বিপুল রায় নিয়ে, তাঁদের বৈপ্লবিক পরিকল্পনায় অধিকাংশ মানুষের পূর্ণ সায় এবং ভরসার ওপর ভিত্তি করে।

পরিবর্তনের এই ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাষ্ট্রচালনা এবং রাজনৈতিক দলের ভেতরের গঠনে গণতান্ত্রিক বোধকে গেঁথে তোলার প্রচেষ্টাও শুরু হয়েছে। সরকারী কাজে কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের অভিভাবকত্বের প্রশ্ন নেই। বাম দলের ভেতরে মতাদর্শের পার্থক্যকে যে কেবল মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে তাইই নয়, বরং তা আজ আকাঙ্ক্ষিতও বটে।

আরেকটি অভিনব বিষয় হল রাষ্ট্রচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের ঝোঁক। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বৃহত্‍ উত্পাদনের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নটিকে মনে রেখেও এই নতুন বাম নেতৃত্ব চেষ্টা করছেন ক্ষুদ্র উত্পাদনের উদ্যোগের ওপরেও জোর দিতে। তাঁরা মানেন যে পার্থিব জীবনের (material life) সমস্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত একটা আড়ষ্ট কাঠামোয় পর্যবসিত হয়, আরেক ধরনের সামাজিক স্তরভেদও দেখা দেয় তার থেকে, আর দায়গ্রহণের প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়ে ওঠে ('ঘোষ')।

মানুষের পাশাপাশি ‘প্রকৃতি’র নিজস্ব অধিকার, বেঁচে থাকার দাবীর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি (রীতিমতো সাংবিধানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে) একবিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির সঙ্গে সমাজের নিবিড় সম্পর্কটি মনে রেখে। পুরোনো ধারায় (সমাজতন্ত্রের) ঝোঁক ছিল বৃহত্‍ শিল্প গঠনে, জাতীয় সম্পদ সংগ্রহ এবং উপার্জন সমাজের সর্বস্তরে সরবরাহের প্রশ্নটিকে মাথায় রেখেই। প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ এবং তাকে ব্যবহার করে বিশাল উত্পাদনের তাড়ায় পরিবেশের ক্ষতির প্রশ্নটি প্রায়শই অবহেলিত হয়েছে পুরোনো সমাজতন্ত্রে (এক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিখ্যাত “The Northern River Reversal” পরিকল্পনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য, তাছাড়া “চেরনোবিল” তো সকলেরই মনে আছে)। আজকের নিরীক্ষায় তাই বৃহত্‍ এবং ক্ষুদ্র উত্পাদনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

এবার যে প্রশ্নটি অনিবার্য ভাবে এসে পড়ে তা হল সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকার-অনধিকারের বিষয়টি। অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে যে রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের পরীক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ বিপুল উত্সাহে স্বাগত জানালেও বেশকিছু ত্রুটি কবির নজর এড়ায় নি। ব্যক্তিমানুষকে অস্বীকার করার মত ভুলের সঙ্গে আরেকটি যে মস্ত ভুল তাঁর চোখে পড়েছিল সেটি হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে অস্বীকার করার অদূরদর্শিতা। কবির মতে, “নিজের সম্পত্তির প্রতি নিজের মমতা, ওটা তর্কের বিষয় নয়, ওটা আমাদের সংস্কারগত। নিজেকে আমরা প্রকাশ করতে চাই, সম্পত্তি সেই প্রকাশের একটা উপায়.....আর তার চেয়ে বড় উপায় যাদের আছে তারা মহত, তারা সম্পত্তিকে গ্রাহ্য করে না। সমস্ত খুইয়ে দিতে তাদের বাধা নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে আপন সম্পত্তি আপন ব্যক্তিরূপের ভাষা।...”

এ বিষয়টি সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা এখনো তত স্পষ্ট নয়, অধ্যাপক জয়তী ঘোষের মতে।


বিশেষ সাংগঠনিক উদ্যোগ:

নতুন নেতৃত্ব সজাগ তাঁদের প্রতিপক্ষের ক্ষমতা সম্পর্কে। এতকালের ‘পশ্চিমী দাপট’(Western hegemony) মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় ‘অস্ত্র’ হিসেবে বেশ কিছু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ব্যাংক অফ দ্য সাউথ’ (Bank of the South)। মূল উদ্দেশ্য ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলির নিজস্ব পরিকল্পনার আর্থিক প্রয়োজন মেটান IMF-এর সাহায্য ছাড়াই। কিউবা থেকে শুরু হয়েছে Operación Milagro (Operation Miracle) ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দেশগুলির গরীব নাগরিকদের চিকিত্সার সুরক্ষার প্রয়োজনে। সমাজের ‘তলার’ স্তর থেকে আসা অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের কিউবা এবং ভেনেজুয়েলায় প্রশিক্ষনের জন্য পাঠান হচ্ছে। UNESCO-র একটি রিপোর্টে দেখা গেছে এই ধরনের প্রকল্পের কারণেই আবার অশিক্ষার হার যাচ্ছে কমে। সব প্রচেষ্টাই চলেছে অ-ব্যবসায়িক ভাবে, আঞ্চলিক দেশগুলির পারস্পরিক সহযোগিতায। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির মত বিষয়গুলি যেকোনো নাগরিকের মানবিক অধিকার--এই দর্শন সামাজিক কাঠামোয় গেঁথে নিয়ে। এছাড়া তৈরী হয়েছে CLAC, Community of Latin American and Caribbean States, উদ্দেশ্য দেশগুলির নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে CLAC-এর আওতা থেকে ক্যানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে ‘হাইতি’, কিউবা-র মত ক্যারিবিয়ান রাষ্ট্রগুলিকে এই সংস্থার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।

গণতন্ত্র নিয়ে বিভ্রান্তি আজও বেশ ব্যাপক। নির্বাচনী প্রক্রিয়া (ত্রুটিমুক্তি না হলেও) অনুসরণ করলেই আমরা তাকে গণতন্ত্র বলে দাবী করে বসি, সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও চলে। আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে দেখা যাচ্ছে ‘ধনী’ দেশগুলিতেও দারিদ্রের হার কমার বদলে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যান্য সামাজিক বৈষম্যও দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। দক্ষিণ আমেরিকার নতুন প্রগতিশীল রাষ্ট্রগুলিতে এই প্রচলিত গণতন্ত্রের কাঠামোগত সমস্যাটিকে নানাভাবে দূর করার প্রয়াস চলেছে সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টিকে একেবারে মূল কাঠামোয় গেঁথে দেয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে। ‘ইকুয়াডোর’-এর প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেরার প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থার প্রচলনের মধ্যে দিয়ে প্রায় রাতারাতি এক শান্ত বিপ্লব ঘটিয়েছেন, ছোট্ট দেশ ইকুয়াডোর এই কিছুদিন আগেও ছিল নগণ্য এক ‘বানানা রিপাবলিক’ (Banana Republic) মাত্র; আজ সে ওই অঞ্চলের স্থায়ী নির্ভরযোগ্য ‘অর্থনীতি’। ভেনেজুয়েলার ‘তেল-সম্পদ’ এতকাল ছিল ধনী কিছু করপোরেট উদ্যোগের নিয়ন্ত্রণে, লাভের সিংহভাগ চলে যেত দেশের বাইরে, সেই প্রাকৃতিক সম্পদের জাতীয়করণের মধ্যে দিয়ে প্রেসিডেন্ট শ্যাভেজ এক মস্ত পরিবর্তণ এনেছেন। তেলের পয়সা কাজে লাগিয়ে শুরু হয়েছে নানা সামাজিক উদ্যোগ। দারিদ্রের হার রাতারাতি নেবে গিয়েছে। দরিদ্রতম অঞ্চলে সরকারী উদ্যোগে নিয়মিতভাবে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গরীব মানুষের জন্য তৈরী হচ্ছে পরিচ্ছন্ন বাসস্থান। নতুন ভেনেজুয়েলায় প্রাথমিক শিক্ষা ও চিকিত্সার সুযোগ যেকোনো নাগরিকের মানবিক অধিকার। প্রাকৃতিক সম্পদে (রূপো, টিন এবং প্রাকৃতিক গ্যাস) ভরা বোলিভিয়াও ছিল ‘পশ্চিমী ধনতন্ত্রের’ অন্যতম উত্স। আবার এই বোলিভিয়াতেই ‘আদিবাসী’ সমাজ অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় বড় (গুয়াতেমালা ছাড়া), আর তাই সেখানকার ‘আদিবাসী’ আন্দোলনও বেশ শক্তিশালী। আজকের নেতা ইভো মোরলেস সরাসরি উঠে এসেছেন আদিবাসী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, যা Movimiento al Socialismo (MAS -- movement toward socialism) নামে পরিচিত। দীর্ঘদিনের ‘নয়া উদারনীতি’র চাপে অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে জমির মালিকানাও চলে গিয়েছিল বড় ব্যবসায়ীদের (স্বদেশী-বিদেশী) দখলে। মোরালেস নেতৃত্ব সেই জমির ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষকে জমি-সংস্কারের (land reform) মধ্যে দিয়ে। একসময় খনিজ শিল্পে মন্দা দেখা দেয়। সেই সময় বেকার শ্রমিকরা দলে দলে কোকা চাষে যোগ দেয়। যে কোকা (তামাক পাতার মত) বোলিভিয়ার আদিবাসী সংস্কৃতির প্রায় প্রতীক সেই কোকা উত্পাদন হঠাত্‍ বেআইনী ঘোষণা করে বসে পুরোনো সরকার। বলাই বাহুল্য এই ঘোষণা আদিবাসী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। আজকের রাষ্ট্রনেতা ইভো মোরালেস নিজেই একসময কোকা (coca) চাষী ছিলেন। নতুন বোলিভিইয়ায় কোকার স্বল্প/নিয়ন্ত্রিত উত্পাদন এখন আর বেআইনী নয়।

সামগ্রিক অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা—এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার প্রতিশ্রুতিকে ধরে রাখাই সম্ভবত আগামী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ল্যাটিন আমেরিকার পরীক্ষা অবশ্যই এক্ষেত্রে মস্ত অনুপ্রেরণা।

নতুন নিরীক্ষায় বেশকিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে সে কথা বলাই বাহুল্য। আবার সেই অন্তর-দ্বন্দ্ব থেকেই মিলবে পরবর্তী বিবর্তনের সুযোগ। তবে, সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে ভাঁটা তো দূরের কথা নতুন জোয়ার এসেছে-–একথা ল্যাটিন আমেরিকার দিকে তাকিয়ে বোধহয় নি:সন্দেহে দাবী করা যায়।

বহু নাটকীয় পরিবর্তন সত্বেও সমাজতন্ত্রের মূল মানবিক বার্তা আজও অবশ্যই অপরিবর্তিত: ধনতন্ত্রের শোষণ, পীড়ন এবং অসাম্যের বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখা, আর তারই সঙ্গে মানুষের, প্রকৃতির সার্বিক কল্যাণে সামাজিক ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতাও যে মানুষের আছে সে বিশ্বাসকে অটুট রেখে প্রগতির পথে এগনো।

পেরুর বিখ্যাত ইনকা সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ সম্পর্কে দরদী কবি পাবলো নেরুদার প্রতিক্রিয়া ধরা আছে তাঁর বিখ্যাত কবিতা “Heights of Macchu Picchu”-তে:

“Point out to me the rock on which you stumbled,
the wood they used to crucify your body.
Strike the old flints
to kindle ancient lamps, light up the whips
glued to your wounds throughout the centuries
and light the axes gleaming with your blood.

I come to speak for your dead mouths.”

শাসকের সুউচ্চ্চ অহংকারের সামনে দাঁড়িয়ে কবি কেবল দেখলেন সহস্র মানুষের শ্রম, তাদের ঘাম, রক্ত, চোখের জল। এই বোধ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, দক্ষিণ আমেরিকার সাধারণ মানসে এই চৈতন্য গভীরে গাঁথা সে অঞ্চলের বিশেষ ইতিহাসের কারণে। সেই আঞ্চলিক ইতিহাস, অভিজ্ঞতা ল্যাটিন আমেরিকার সভ্যতাকে আজ পৌছে দিচ্ছে বিশ্ব-মানবের দরবারে, যে দরবারে ভারতবর্ষেরও আসন পাতা ছিল বরাবর। আজ কী হল সেই ভারতবর্ষের? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সমুদ্রমন্থন থেকে উঠে এল যে গণতান্ত্রিক সমাজ, গোষ্ঠী-নিরপেক্ষ আন্দোলনের (Non-Aligned Movement) অন্যতম শরিক? আজ কেন সে ভেসে গেল পশ্চিমী বাজারসভ্যতায়? অস্পৃশ্যতা-বর্ণাশ্রমের মত হাজার বছরের অভিশাপ আজও কেন জমে রইল মজ্জায়-মজ্জায়?! কাশ্মীর, মণিপুর, জঙ্গলমহল-এর মত গভীর অন্তর-দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও কেন এতদিনেও কোনও আত্মোপলব্ধিতে উত্তরণের আভাস মিলল না?


এই রচনাটি লিখতে বিশেষভাবে যেসব বই, প্রবন্ধ সাহায্য করেছে:

1. Broillet, Emmanuel. “Latin America: The Advent of an Alternative to Neo-Liberalism and Authoritarian Socialism”. Current Concern: An International Online Journal for ethical standard, independent thoughts, moral responsibility and the promotion and respect of public international law, human rights and humanitarian law. No. 8, May, 2010

2. Engler, Mark. “Latin America Unchained: Will the U.S. Lose its Influence Over Countries That Have Paid Off Their IMF Loans? CommonDreams.org. March 17, 2006

3. Galeano, Eduardo. “Open Veins of Latin America” : Five Centuries of the Pillage of a Continent. Monthly Review Press. 1971

4. Ghosh, Jayati. “The Emerging Left in the "Emerging" World”: Ralph Miliband Lecture on the Future of the Left, London School of Economics, London, U.K., 28 May 2012. Mr. Zine, Monthly Review. June 26, 2012

সূত্রনির্দেশ :

[১] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার প্রথম দু-তিনটি লাইন ভেঙে ব্যবহার করা হয়েছে।

[২] ‘Vivir Bien’: ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন ‘আদিবাসী’ (‘আণ্ডিস’ পাহাড়ের এবং ‘আমাজন’ অঞ্চলের) মানুষের জীবনদর্শন, প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দ বা rhythm-এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলা।



(পরবাস-৫৫, অক্টোবর, ২০১৩)