সুধী পাঠকজন, আমার ভ্রমণকাহিনির লম্বা লিস্টি দেখে ভাববেন না যে ছন্দা যখন ইচ্ছে, যেখানে ইচ্ছে, টুক করে দিব্যি ঘুরে আসতে পারে। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু একদম সেরকম নয়। প্রায় প্রত্যেকটি জায়গাতেই আমাকে প্রচুর কাঠ-খড় পুড়িয়ে যেতে হয়েছে। ভিসা, পাসপোর্ট, টিকিটের জন্যে হন্যে হয়ে ঘোরা, দেরিতে পাওয়ার জন্যে ফ্লাইট মিস করা। অচেনা দেশে, বন্ধুহীন শহরে আটকে যাওয়া, সব মালপত্র হারিয়ে ফেলা, বিদেশ বিভূঁইয়ে বাজেরকম অসুখে পড়া--এসব তো আছেই। আমার একটু শিক্ষা হয়েছে--আজকাল আমি সব ট্রিপ-এই হাতে দু-তিন দিন বেশি রাখি এইরকম একটা কিছু বিপত্তির জন্যে।
শুধু এসবই নয়, রাস্তাঘাটে চলার জন্যেই অনেক বিপদের মুখে পড়তে হয়। যতোই দুগ্গা-দুগ্গা বলে, যতোই পাঁজি দেখে (সত্যি বলতে কি, এটা কিন্তু আমি করি না) যাত্রা শুভ করুন না কেন, বিদেশে রাস্তায় যাত্রা মানেই প্রাণ হাতে নিয়ে চলা--অনেকেই হয়তো জানেন না, রাস্তায় দুর্ঘটনা বিদেশযাত্রার সর্বপ্রধান বিপজ্জনক ব্যাপার ও তার জন্যে কপালের অদৃশ্য লিখন-নির্ভর হওয়া ছাড়া গতি নেই। অনেকে অবশ্য এটাকে ঠিক বেড়ানো বলেন না, কিন্তু কিছুদিন আগে অবধি ক্রুজ-এ (cruise) যাওয়া ছিলো বোধহয় সবচেয়ে ঝামেলাহীন ভ্রমণপন্থা। ইদানীং আবার হয় নোরোভাইরাস, নয়তো মাঝদরিয়ায় আরো বড়ো বিপত্তি এতো আকছার হচ্ছে যে সে গুড়েও লোনা জল!
আমার কপালেও রাস্তায় দুর্ঘটনা হয়েছে প্রচুর ও একমাত্র ভাগ্যফলেই প্রাণ হারাতে হয়নি। নেপালে পাহাড়ি রাস্তায় বাসের সঙ্গে টক্করে খাদে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি; করবেট পার্কের ঘোর জঙ্গলে পথ হারিয়ে বাঘের মুখে পড়িনি তা-ও ওই ভাগ্যের জোরেই। পেরুতে নিজের অজান্তে কার্ফুর জন্য এয়ারপোর্টে সারা রাত বন্দী হয়ে কাটিয়েছি--আমার নিরাপত্তার জন্যেই পুলিশ আমাকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রেখেছিল। পরে সকালে এসে খুলে দেয়। পোর্টো রিকোর জঙ্গলে পথ হারিয়ে পুলিশের হাতে পড়েছিলাম (তারা আমায় বেআইনি বেশ্যা ভেবেছিল; পাশের দেশ হাইতি থেকে ঢুকে পড়েছি যেন!) চীনে রাত্তিরে এক সাইকেল-যাত্রীকে ধাক্কা দেওয়ার জন্যে গণধোলাইয়ের হাতে পড়েও শেষ মুহূর্তে ছাড়া পেয়ে গেছি। এরকম অনেক কাহিনি যে-কোনো ভ্রমণার্থীর ভাগ্যে ঘটে, আমিও বাদ যাইনি।
আমার অশুভ যাত্রাকাহিনির মধ্যে সবথেকে সিরিয়াস কাণ্ডটি ঘটেছিল ১৯৮৪ সালে। না, কোনো দুর্গম সুদূর অচেনা দেশে নয়, আমাদের একান্তই জানাশোনা ভারতবর্ষে। এ একেবারে 'ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া" অঘটন যতোটা হওয়া সম্ভব, তাই হয়েছিল।
প্রতি এনআরআই পরবাসী ভারতীয়দের মতো আমিও দু'তিন বছর অন্তর 'দেশে' ফেরার জন্যে ছটফট করি। মেয়েরা একটু বড়ো হয়েছে, তাদেরও স্বদেশের একটু জ্ঞান হওয়া দরকার, তাই অক্টোবর-নভেম্বরে প্ল্যান করলাম--দিল্লীতে দেওয়ালী, ভাইফোঁটা করব আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে, তারপর দিন দশেকের জন্যে বোম্বাই ও অজন্তা-ইলোরা দেখে ফের দিল্লীতে ফিরে আরাম করা। হাতে সময় কম বলে দিল্লী-টু-বোম্বাই প্লেনে যাওয়াই ঠিক হলো।
এ-পর্যন্ত সবই প্ল্যানমাফিক। বোম্বাইতে আমাদের চেনাশোনা কেউ নেই কিন্তু ভারতের প্রধান দ্রষ্টব্য হিসেবে মেয়েদের দেখানো উচিত। তাই কয়েকদিন এখানে ওখানে চৌপাট্টি, জুহু বীচ, মিউজিয়াম, আর্টগ্যালারি সবই দেখা হলো। প্ল্যান হচ্ছে শেষদিন নৌকা করে গিয়ে এলিফ্যান্টা গুহা। তার পরের দিনই দূরপাল্লার বাসে ঔরঙ্গাবাদ। সেখান থেকে ইলোরা ও অজন্তা দর্শন।
সারাদিন মহানন্দে এলিফ্যান্টা দেখে, পিকনিক করে বিকেলে নৌকা ধরেছি। বোম্বের জেটিতে নামামাত্র দেখি চারদিকে শোরগোল। লোকেরা জটলা পাকিয়ে উত্তেজিতভাবে কী সব বলাবলি করছে। অনেকের হাতে ট্র্যান্জিসটর রেডিও। সেদিনকার তারিখটা পর্যন্ত আমার মনে আছে--৩১শে অক্টোবর, ১৯৮৪।
আমাদের মাঝি জিজ্ঞাসাবাদ করে উত্তেজিত হাত-পা নেড়ে মরাঠী-হিন্দী মিশিয়ে যা বললো তার মর্ম--'আজ সকালে ইন্দিরা গান্ধীর ওপর গুলি চালিয়েছে তাঁরই দেহরক্ষীরা। তৎক্ষণাৎ তাঁকে AIIMS হাসপাতালে (আমাদের মেডিকাল কলেজ) পাঠানো হয়েছে। সার্জারি চলেছে অনেকক্ষণ। এখনো প্রাণ সংশয়।'
ডাক্তার হওয়ার দরুন আমরা চট করে বুঝে গেলাম যে অত কাছে থেকে গুলি চালালে বাঁচা অসম্ভব। হয়তো দাঙ্গাহাঙ্গামার ভয়ে সেটা সরকারীভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে না। রেডিওতেও বিবিসি-র ঘোষক বলছেন তাঁর মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। বুঝে গেলাম অচেনা জায়গায় বাল-বাচ্চা নিয়ে মুশকিলে পড়ব এবার।
হোটেলে ফিরে দেখলাম অবস্থা আরো গুরুতর। দিল্লীতে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। বোম্বেতেও উত্তপ্ত অবস্থা। সরকার আগে থেকেই ট্রেন, প্লেন সব বন্ধ করে দিয়েছে। হাজার-খানেক ট্যুরিস্ট হোটেলে আটক। যাবার রাস্তা নেই, থাকবার জায়গাও নেই। ঔরঙ্গাবাদের বাসও বন্ধ। সেদিন বিকেলে লাস্ট বাসটা যাচ্ছিল। আমাদেরও হোটেলে ঘর নেই। তাই ভাবলাম ওই বাসটা ধরে অজন্তা ইলোরায় কটা দিন কাটিয়ে আসি, ততদিনে শহরের অবস্থা শান্ত হয়ে যাবে নিশ্চয়। তাছাড়া এতদূর এসে অজন্তাটা মিস করারও ইচ্ছা ছিল না। গোলমালের মধ্যে আমাদের কারুরই দিল্লীতে আত্মীয়দের ফোন করার কথা খেয়াল হয়নি। পরে সেটা একেবারেই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
আমাদের সৌভাগ্য যে দাঙ্গার ঢেউটা তখনো ঔরঙ্গাবাদের দিকে পৌঁছয়নি। দু'দিন ওখানে বেশ নির্বিঘ্নে কাটল। বিরাট হোটেল, লোকজন প্রায় নেই। খুশিমনে রাঁধুনিরা আমার মেয়েদের পছন্দমতো খাবার বানাতো। অজন্তা-ইলোরাতে শুধু একদল জাপানী ট্যুরিস্টদের দেখা পেলাম। তারা ভালো ইংরেজি জানে না, তাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করা গেল না। কোনো খবরের কাগজও পাইনি। রেডিও ও দূরদর্শন টিভিতে শুধু সরকারী শোকগাথা চলছে অবিরাম। দেশের অবস্থা যে কেমন সেটা বলার দায় নেই। তাই চিন্তিত হলেও আমরা তখন জানতাম না যে সারা দেশ জুড়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা চলছে।
দু'দিন পর ওই বাসে করেই বোম্বাইতে ফেরত। এসেই বুঝতে পারলাম যে কপালে ভোগান্তি আছে। আমাদের আগের হোটেলে গিয়ে দেখি 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই'। লবিতে হাজারখানেক দেশি-বিদেশি মানুষ ঠেলাঠেলি করছে। কেউ কেউ মাটিতেই চাদর বিছিয়ে বাচ্চা-টাচ্চা সমেত শুয়ে। একেবারে শিয়ালদা স্টেশনের মতো অবস্থা। আমাদের সঙ্গেও বাচ্চা। তাদের নিয়ে যাই কোথায় এখন? সব হোটেলেই একই অবস্থা। প্লেন, ট্রেন, বাস--যাতায়াতের সব রাস্তাই বন্ধ। কবে খুলবে কেউ জানে না, কারুরই বোম্বে ছাড়ার উপায় নেই। এই চরম বিপদে মনে পড়ল আমাদের এক খুব দূর সম্পর্কের আত্মীয়াকে, যিনি নাকি বোম্বেতেই থাকেন। অনেকদিন আগে পারিবারিক কেচ্ছাকলহে তাঁকে পরিবার থেকে দূর করে দেওয়া হয়। তারপর কেউই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। একটি ছোটো হাসপাতালে ডাক্তারি করতেন এটুকুই শুধু জানতাম। ডিরেক্টরি ঘেঁটে, তাঁর ঠিকানা বের করে মাঝরাতে দুই মেয়ের হাত ধরে তাঁরই দোরগোড়ায় শরণার্থী হলাম। তাঁর অশেষ সৌজন্য ও দয়া যে আমাদের দেখামাত্র ঘরে তুলে নিলেন পরম আদরে। অতীতের তিক্ততার কোনো উল্লেখ করলেন না। ফ্ল্যাটটি খুবই ছোটো--এক বেডরুমে তাঁরা তিনজন থাকেন। এখন ঠাসাঠাসি করে আমরা সাতজন হলাম। তবু তো মাথার ওপর একটা ছাদ পাওয়া গেল আর পেটে কিছু খাবার!
আস্তে আস্তে, মেয়েদের কান বাঁচিয়ে ও গুজবের খোসা ছাড়িয়ে যে খবরটুকু পেলাম তাতে চিন্তা আরো বেড়ে গেল। কতোদিন আর মাসির দয়ায় থাকা যায়? দিল্লীতে কোনো প্লেন বা ট্রেন যাচ্ছে না, কবে যে যাবে আবার কেউ জানে না। বোম্বাইকারদের মতে দিল্লী যেন এক অস্পৃশ্য পাড়া। ওর ধারেকাছেও যাওয়া যাবে না। চিঠি লেখা অসম্ভব, ডাক বন্ধ, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, সব বন্ধ। আমরা চিন্তায় আছি, দিল্লীতে আমাদের আত্মীয়স্বজনরা কেমন আছে তার কোনো খবর নেই। বেশ ভালোই জানি যে ওরা আমাদের জন্যে আরও চিন্তিত। এদিকে বোম্বেতেও থাকা মুশকিল। খাবার ইত্যাদির দাম আগুন, সব্জী তরকারি কিছুই বাইরে থেকে আসছে না। সব জায়গায় নাকি বন্ধ। কতোটা যে তা সত্যি সেটা যাচাই করাও মুশকিল।
দুদিন বা তিনদিন ছিলাম বোম্বেতে। একে ওকে ধরে জানবার চেষ্টা করতাম কোনো ট্রেন যাচ্ছে কিনা ও তাতে জায়গা পাবার আশা আছে কি। তৃতীয়দিন শুনলাম বিকেলে একটা ট্রেন 'সাবধানে' ছাড়া হচ্ছে। কতোদূর যাবে কেউ জানে না। এটা পরীক্ষামূলক ও মিলিটারি সৈন্যে ভর্তি। বেগতিক দেখলে ফিরে আসবে বোম্বেতে। ট্রেনের নাম--পঞ্জাব মেল! নাম শুনেই আমাদের বুক দমে গেল। কর্তৃপক্ষ কি ইচ্ছে করেই ওই নাম লাগিয়েছেন না অজান্তে?
তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে 'অশুভ' নামের পঞ্জাব মেল-এ আমাদের যাত্রায় মাসির ভীষণ অমত। তবু, আর কোনো উপায় না দেখে আমরা টিকিট কাটলাম। তখনও পুলিশ, সাংবাদিক ইত্যাদি ছাড়া আর বিশেষ কাউকে দেখিনি। পরিবার সমেত যাত্রী বোধহয় একমাত্র আমরাই ছিলাম।
আমরা কয়েকজন পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিরস্ত হলাম। ওদেরও আমাদের দেখাশোনার ভার নিতে অনিচ্ছা। গোমড়া মুখে একজন আমার স্বামীকে উপদেশ দিতে শুরু করল, "আপকা তো থোড়া অকল হোনা চাহিয়ে থা," ইত্যাদি। সেই সময়ে আমার স্বামীর বেশ জমাট গোঁফ ও দাড়ি। পুলিশরা একবাক্যে মাথা নেড়ে বলল, চলবে না, চলবে না--দাড়ি-গোঁফ কামাতে হবে, নইলে সর্দার বলে ভুল হবার আশংকা।
আমরা তখন বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে স্টেশনে। মাসি বাড়ি ফিরে গেছে। ট্রেন কখন ছাড়বে কেউ জানে না। আমাদের কাছে কামাবার ক্ষুর, কাঁচি সাবান কিছুই নেই। সেই আধো আলো, আধো অন্ধকারে, ওয়েটিং রুমে মরচে পড়া আয়নায় আমার ব্যাগের ছোট্ট নেল-কাটার দিয়ে সেই দাড়ি-গোঁফ কাটা হোল। মুখখানির চেহারা যা হোল তা নিয়ে কোনো মন্তব্য না-করাই ভালো।
গাড়ি ছাড়ল রাত দশটা নাগাদ। সবাই মনে মনে দুর্গা, গণপতি, আল্লাহ্র নাম বলেছিল নিশ্চয়ই। আমরা স্লীপার কোচের টিকিট নিয়েছিলাম। কিন্তু গাড়ি চলতে দেখা গেল যাত্রীদের সুবিধার কোনো ব্যবস্থাই নেই। খাবার নেই একটুকরো, নেই কোনো বিছানা, কম্বলের ব্যবস্থা। চা-সামোসার ফিরিওয়ালা?--সে তো স্বপ্নেই সম্ভব। এমনকী টিকিট কালেক্টরও নেই। কামরায় আমরা একদম একা চারজন। এমনিতে বেশ মজা করেই যেতাম কিন্তু এখন অবস্থা সেরকম নয়।
প্রথম রাত্রে মাসির দেওয়া খাবারই চলল। কিন্তু তারপর আর কিছুই নেই সঙ্গে। খাবার জলও নেই। গাড়ি চলছে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে। যেন নিতান্ত অনিচ্ছায়। প্রতিটি স্টেশনে, ছোটো-বড়ো যাই হোক না কেন, দাঁড়াচ্ছে। পুলিশরা স্থানীয় লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আর তাদের উত্তরে যাত্রা নিরাপদ মনে করলে তারপর গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। এদিকে রাত্তিরে মধ্যভারতের ধূ ধূ খোলা প্রান্তরে নভেম্বরের শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। গাড়ির ভেতরেও সব হিম। সঙ্গে গরম কিছুই আনিনি, তাই আমার সব শাড়িগুলি বের করে মেয়েদের তাই দিয়েই জড়িয়ে দিলাম। আমার পাঁচ-বছরের ছোটো মেয়ে তখনো অবুঝ, ভাবলো এও একটা মজার খেলা। কিন্তু আট-বছরের বড়ো মেয়ে বেশ পাকা। তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন। সে এ-কদিনে বেশ বুঝে গেছিল যে কোনো অজানা কারণে আমাদের অবস্থা সঙ্গীন। কোনো প্রশ্নও করেনি, শুধু ভীষণ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।
দুই রাত কাটল এইভাবে। প্রত্যেকটি স্টেশন জনশূন্য, নিস্তব্ধ, শুধু দু-একজন পুলিশ ছাড়া প্ল্যাটফর্মে আর কিছু নেই। নেই খাবারের স্টল, নেই খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, নেই চা-গ্রাম হাঁকা চা-ওয়ালা! এমনকী ভিখিরিরাও বেপাত্তা। সবই যেন জাদুমন্ত্রে শূন্যে মিলিয়ে গেছে। আমার চোখে ভারতীয় ট্রেন স্টেশনের এই অবস্থাই সবচেয়ে আশ্চর্য করেছিল এবং সেই সঙ্গে উদ্বিগ্নও করেছিল। ডালির আঁকা ছবি দেখলে যেমন মনে হয়।
খাবার এবং খাবার জলের অভাবে দুটি বাচ্চা সঙ্গে আমরা বেশ মুশকিলে পড়েছিলাম। মধ্য ও উত্তর ভারতের প্রতি শহরে তখন কার্ফ্যু চলছে। এই পঞ্জাব মেল ছাড়া আর কোনো ট্রেন নেই। আমরা ততক্ষণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছি। কোনো স্টেশন এলেই আকুলভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করি। একজনকে দেখলাম, সে কয়েকটা কালচে রঙের কলা হাতে যাচ্ছে। দুগুণ পয়সা দিয়ে তক্ষুনি কিনে ফেললাম সেগুলো। ভাগ্যিস সে বিক্রি করলো! একজনের কাছে সেদ্ধ ডিম দেখে, সবকটা, মানে ৬-৭টা, কিনে নিলাম--আর কারো লাগতে পারে কিনা সে তোয়াক্কা না-করেই। সেই দুই দিন রাত্রি আমরা অনেকটা পশুর মতোই হয়ে গিয়েছিলাম প্রায়। মাথায় তখন শুধু ভাবনা মেয়েদের কী খাওয়াব? বিংশ-শতাব্দীর এই সভ্যজগতে যে এই নিয়ে চিন্তা করতে হবে তা কখনোই ভাবিনি।
সেই সময়ে ভুলে গেছিলাম যে আমরা ডাক্তার, আমেরিকায় বাড়ি গাড়ি আছে, আমরা সুশিক্ষিত, মার্জিত ইত্যাদি ইত্যাদি। শিক্ষা-দীক্ষা অর্থ-কৌলীন্য মার্জিত রুচিবোধ সে সব কিছু কেমন এক নিমিষে মিলিয়ে গেল -- মাথা গোঁজার নিরাপদ একটু আশ্রয় ও পেটে দেবার মতো একটু খাবার, ব্যস্--আমাদের সব চেতনা শুধু এ দুই লক্ষ্যেই কেন্দ্রীভূত হল কী অনায়াসে! কেউ তখন বাধা দিলে তার সঙ্গে লড়াইয়েও পিছু হতাম না।
দুই দিন ও রাত আমরা শুধু কলা ও ডিম খেয়ে কাটিয়েছিলাম। মেয়েদের খাওয়ানোর পরে আর বেশি কিছু খাওয়ার ছিলও না। কিন্তু ভয়ে ও উদ্বেগে খিদের কথা মনেও পড়েনি। ট্রেনের ছন্দ সেই একঘেয়ে--প্রতি স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ায়, পুলিশরা নেমে পরামর্শ করে পরের স্টেশনের দিকে এগিয়ে যাওয়া নিরাপদ কিনা। তারপর আবার ট্রেন চলে দ্বিধাভরে। কেউই জানেনা এমনভাবে কতোদূর যাওয়া যাবে, দিল্লী আদৌ পৌঁছবে কিনা ট্রেন। কতক্ষণ বা কতোদিন যে লাগবে তার ঠিক নেই--আর রাস্তায় আটকে গেলেই বা কী অবস্থা হবে।
এইসব চিন্তা নিয়েই গাড়িটা একসময় দিল্লীর উপকন্ঠে পৌঁছল। তারপর খুব ধীর গতিতে, যেন একান্ত অনিচ্ছায় চুপি চুপি এগুতে থাকল নিউ দিল্লী স্টেশনের দিকে। রাস্তাঘাট সব ফাঁকা। আমারা তাকাচ্ছিলাম ভয়ে ভয়ে--কী জানি কী চোখে পড়বে। কিন্তু বেশ কতকগুলো পোড়া বাড়িঘর ছাড়া কোনো দাঙ্গাবাজী বা মৃতদেহ চোখে পড়ল না। আমার ভয় ছিল যদি মেয়েদের চোখে পড়ে এসব।
নিউ দিল্লী স্টেশনে পুলিশের ভিড়, কিন্তু যাত্রী নেই বললেই চলে। বালবাচ্চা সমেত আমাদের দেখে সবাই অবাক। তারপর সবাই আমাদের সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। সেইসঙ্গে আমার স্বামীটিকেও একটু পুরোনো বকুনি খেতে হোল, 'আপকো তো থোড়া অকল হোনা চাহিয়ে থা!" আমরাও ভালোমানুষের মতো তর্ক না করে সব হজম করে নিলাম। দিল্লী তো পৌছেছি, যে করেই হোক।
কিন্তু স্টেশন থেকে বাড়ি যাওয়াও কম দুশ্চিন্তার নয়! একদিক দিয়ে দেখলে অনিশ্চয়তা একটু বেশিই। দিল্লীতে সব ট্যাক্সি উধাও--হয় পুড়িয়ে ফেলেছে, নয় পোড়ানোর ভয়ে লুকিয়ে ফেলেছে--আর ট্যাক্সি চালাবে কারা! কিন্তু মানুষকে তো খেতে হবে, একটা স্কুটার যাহোক করে পেলাম। তাতে চেপেচুপে বসলাম সাব মালপত্র নিয়ে। পুলিশ খুব ভয় দেখালো ড্রাইভারকে--নম্বর ইত্যাদি নিয়ে নিল--যাতে সে আমাদের নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যায়। স্পেশ্যাল ছাড়পত্র দেওয়া হোল--যাতে কার্ফ্যুর মধ্যে যেতে পারি। এখানে সেখানে পুলিশ গাড়ি থামিয়ে জেরা করছে। আমি তো তৈরিই ছিলাম, কোনো মৃতদেহ দেখলেই মেয়েদের চোখ ঢেকে ফেলব। কিন্তু সেরকম কিছু দেখিনি। আমাদের পাড়ায় বেশ কিছু পাঞ্জাবিদের বসতি ও দোকানপাট। সেসব ভেঙেচুরে আগুন ধরিয়ে শেষ করেছে গুণ্ডারা। দেখে ভীষণ খারাপ লাগল--ওরা সবাই আমাদের প্রতিবেশী ও বন্ধু। আগুন লেগেছে খবর দেবার পরেও একটি দমকল নাকি আসেনি পাড়ায়। শুনলাম হিন্দু-পাঞ্জাবি প্রতিবেশিরাই বালতি-ব্রিগেড করে আগুন নিভিয়েছে। অন্তত কেউ প্রাণ হারায়নি।
দিল্লীতে আরও দুদিন আমরা ছিলাম। কিন্তু সে একরকম না-থাকার মতোই। কোনো যানবাহন না থাকায় কোথাও যাতায়াত করার উপায় ছিল না। দোকান, ব্যাঙ্ক, স্কুল, অফিস সব বন্ধ। রেডিও ও টিভিতে শুধু শোকসঙ্গীত ও ইন্দিরা গান্ধীর জীবনকাহিনি। শুধু ফোনেই বন্ধু, আত্মীয়দের সঙ্গে "সাক্ষাৎ" সেরে নিলাম। কতো কিছু করার ও দেখার প্ল্যান ছিল, সব বাতিল হোল।
এরপর ফেরার পালা। অন্তত এয়ারপোর্টটা চালু ছিল কিন্তু কার্ফ্যুর জন্যে আবার পুলিশ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এ যেন জঙ্গী শাসন! সেই প্রথমবার দেশ ছাড়তে আমি বিষাদের চেয়ে স্বস্তিই বেশি অনুভব করেছিলাম। আর তারপর তার জন্যে ভীষণ মনখারাপও হয়েছিল।
এর পরেও আমরা গেছি, ভারতে ও অন্যান্য দেশে। পরেরবার যখন ভারতে যাই, আমরা চেন্নাইতে আটকে গেলাম। এবার মারা গেলেন এম. জি. রামচন্দ্রণ, তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এবং ভীষণ জনপ্রিয় নেতা। আবার সারা প্রদেশ জুড়ে হপ্তাখানেক সবকিছু বন্ধ্। কোনো মজার বা আনন্দের কাজ বা আনন্দ দেখানোও মানা। তারমধ্যে পড়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, সিনেমা দেখা, নাচগানের আসর; এমনকী মেরিন-ড্রাইভের সমুদ্রতীরে ঘুরে বেড়ানোও বারণ--আনন্দ দেখানো হচ্ছে! উনি শ্রমিকদের প্রিয় বলে ট্যাক্সি, বাস ইত্যাদির ড্রাইভাররা হরতাল করলেন। কোত্থাও যাতায়াতের উপায় নেই। সেবার অবশ্য আমরা এক বন্ধুর বাড়িতে অতিথি ছিলাম। দুই মেয়ে নিয়ে থাকার কথা ছিল দু'দিন। থেকে গেলাম এক সপ্তাহ। তার উপর গৃহিণীর কাজের লোকেরা সব ধর্মঘটে যোগ দিয়েছে। নিরুপায় মহিলাকে রান্না, ঘর সাফ করা সব কিছুই নিজের কারতে হোল। সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও।
এরপর থেকে আত্মীয়-বন্ধু মহলে আমাদের দুর্নাম হয়ে গেল। কোথাও যাবার নাম করলেই তাঁরা চোখ কপালে তুলে বলেন, "ওরে বাবা! এবার কাকে মারতে যাচ্ছ তোমরা?"
তবুও বেড়ানোর নেশাটা মদ বা জুয়ার মতোই শক্ত নেশা। বেশিদিন এক জায়গায় থাকলেই পায়ের তলায় সেই সর্ষেদানাটি কুট কুট করতে শুরু করে। মনে হয় বেরিয়ে পড়ি--হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্খানে!
(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)