ISSN 1563-8685




নিশ্চিন্তে চিন্তা ফু

রাহুল মজুমদার



চিন্তা-ফু যাওয়ার একটি খসড়া ম্যাপ

নয়ই নভেম্বর দুহাজার তেরো, সকাল দশটা পঞ্চাশ -

মিরিক থেকে গাড়িবাহিত হয়ে এসে পড়েছি পশুপতি ফটক। নেপাল প্রবেশের এক ফটক। যদিও এর খ্যাতি দার্জিলিং বেড়াতে আসা পর্যটকদের 'ফরেন গুড্‌স্‌' কেনার আখড়া বলে। মেঘের মাফলার জড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা চিন্তিত মুখে বসে। গাড়ি আর মানুষের দঙ্গলের সেদিকে নজর নেই। পায়ে পায়ে কাকা ভাইপোতে এগিয়ে গেলাম চেকপোস্টের দিকে। চিন্তা-ফু যেতে গেলে এখান দিয়ে ঢোকাটাই সবচেয়ে সুবিধেজনক। চিন্তা-ফু নিয়ে চিন্তায় আছি। এমন একটা জায়গা আছে এই খবরটুকু, আধপাতা একটা লেখা আর দুর্দান্ত একটা ছবি, সম্বল বলতে এইটুকুই। ইলাম, মাইপোখরি, মাইমাজুয়া, গেরোওয়ালে এই কটা নাম জপতে জপতে এসেছি। আগে? রাম জানে। বিদেশ প্রবেশের বিধি সারতে না সারতেই হঠাৎ অর্জুনের গলা — 'রাহুল দা!'

ফিরে তাকিয়ে অর্জুনকে দেখে প্রাণে ফুর্তির জোয়ার খেলে গেল দু-জনের। একে তো বন্ধুর সঙ্গে বহু বছর পরে দেখা; তার ওপর অর্জুন শেরপা মানেভঞ্জ্যাংয়ের সেরা গাইড। ওরও গন্তব্য চিন্তা-ফু (ওর ভাষায় চিন্তাপুর) গোরা আর আদিত্য, দু-জনকে নিয়ে। ব্যস, চিন্তা-ফু নিয়ে চিন্তা ফুঃ হয়ে গেল। অর্জুন থাকতে চিন্তা-ফু-র কুরুক্ষেত্রে আমাদের জয় ঠেকায় কে?

বেলা এগারোটা আটত্রিশ -

পঞ্চপাণ্ডব ঢুকে পড়লাম অজ্ঞাতবাসে, থুড়ি অজ্ঞাত দেশে। নেপালের এ দিকটায় আমার কখনও আসা হয়নি। ইলমের শেয়ার গাড়িতে চড়ে বসলাম আমরা। কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিমানে মুখ লুকিয়েছে বাড়িঘরের আড়ালে।

ঠিক দুপ্পুরবেলা-

ছাড়ব ছাড়ব করেও গাড়ি আর ছাড়ে না। বসে বসে শেকড় গজিয়ে গেল যে! চারপাশের 'দৃশ্য'ও এমন কিছু আহামরি নয়।

দুপুর বারোটা দশ -

অবশেষে গাড়ি গা নাড়া দিল।

দুপুর বারোটা কুড়ি -

ফিকল। জব্বর গঞ্জ। পথে বার দুই উঁকি মেরে কাঞ্চনজঙ্ঘা গা ঢাকা দিয়েছে।

বেলা বারোটা চল্লিশ -

অ্যায়তাবারে — রোব্বারের হাট।

বেলা একটা একত্রিশ -

পাহাড়ী জঙ্গল মাখতে মাখতে, মাঈখোলার গান শুনতে শুনতে একেবারে তার ধারে। পথ এখানে ডাইনে মোচড় মেরে মাঈখোলাকে টপকেছে। এদিকে পেটেও মোচড় - একেবারে হাতি খাই, ঘোড়া খাই অবস্থা। অতএব গাড়ি খালি করে সব পেট ভরতে ঢুকে পড়ল দিদির দোকানে; মাঈখোলার মাছের নাকি ভারি স্বাদ।

বেলা পৌনে দুটো -

রান্না চড়েছে। সেই ফাঁকে আমরাও শান্ত, নির্জন, জীর্ণ পুলে মাঈখোলার দর্শন সারছি। কানাঘুষোয় শোনা গেল কাল নাকি বন্‌ধ্‌। খেয়েছে! আবার চিন্তা। বেলা আড়াইটে ভোজনের পর ওজন বাড়িয়ে সুজন হয়ে গাড়িতে এসে বসতেই গাড়ি গড়ালো, পুল পেরোলো।

বেলা দুটো চল্লিশ -

গোলখারা ভঞ্জ্যাং। দেখে তো চৌকোই মনে হলো। আর খাড়াও নয়, দিব্যি শোয়া।

বেলা দুটো পঞ্চান্ন -

ইলম জেলার সদর শহর ইলম। গায়ে গতরে মন্দ নয়! ইস্কুল কলেজ, দোকানপাট, পোস্টাপিস আদালত, মন্দির গুম্‌ফা সবই আছে। তবে বেশির ভাগই বন্ধ - নেপালে শনিবার ছুটি কিনা। ছোট্ট একটা 'চৌক'-ই ইলমের 'মল'। আজ এখানেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু — বড়ই দুঃসংবাদ দারা, থুড়ি দাদারা — কাল থেকে মাওবাদীদের ডাকা হপ্তাখানেকের বন্‌ধ্‌। অতএব, আজই মাইমাঝুয়া পৌঁছতে হবে। অর্জুন সত্যিই সব্যসাচী। একটা গাড়ি জোগাড় করে ফেলল, যা কিনা মালগাড়ি কাম প্যাসেঞ্জার কার — যাবে মাইমাঝুয়া। ব্যস — তোল মাল তোল, চল ভাগি ইলম ত্যাইগ্যা।

বেলা তিনটে বাইশ -

পঞ্চপাণ্ডবের মাইমাঝুয়া গমন পর্বের সূচনা।

বেলা সাড়ে তিনটে -

চুরেঘাটী উড়ে পেরোলাম।

বেলা তিনটে চৌত্রিশ -

বিপলাটে। বেশ ছড়ানো ছিটানো বাঁক খাওয়া জায়গা। বিপলাটেতে বিপদ - গাড়ির পদস্খলন - টায়ার পাংচার।

বেলা চারটে -

টায়ার বদল দেখতে দেখতে টায়ার্ড হয়ে পড়েছি। ভাগ্যিস সামনের বাড়ির দোতলায় একটা খিলখিলানো বাচ্চা আছে।

বেলা চারটে দশ -

বিদায় বিপলাটের ছোটে নবাব। বামপন্থী পথ এবারে কাঁচা এবং চড়াই। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দুলতে দুলতে নাচতে নাচতে চলেছি।

বেলা চারটে পঁচিশ -

একসঙ্গে দু দুটো দুর্দান্ত ঘটনা ঘটল। একটা আনন্দের, অন্যটা দুঃখের। দুঃখের ঘটনা হলো, ছবি তুলতে গিয়ে গাড়ির ঝাঁকুনিতে আঙুল ভুল জায়গায় লেগে সব ছবি delete হয়ে গেল। কিসের ছবি? আনন্দের ঘটনা সেটাই। কস্তুরি মৃগ — একেবারে পথের ওপর! দু মুহূর্ত মাত্র। তার পরেই বিদ্যুৎবেগে সোনার হরিণ মিলিয়ে গেল পাহাড়ের ঢালে। ওই দু মুহূর্তই মনে স্মৃতি হয়ে জমা হয়ে গেল চিরকালের জন্য।

বেলা চারটে চল্লিশ -

মাঈপোখরি। গুরুংদের এই গ্রামে আছে পবিত্র জলাশয় 'মাঈপোখরি' — মায়ের পুকুর। দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আজই পৌঁছতে হবে মাইমাঝুয়া। তার ওপর মেঘলা আকাশে এখনই আলোর অভাব। তাই মা রইলেন মাথায়, ঝাঁকুনি-গাড়ির সফর জারি রইল।

'সন্ধ্যা' পাঁচটা সাত -

মাঈপোখরি দেওরালি। চারিদিকে আঁধার খালি। এ কোথায় এলাম রে বাবা! পাঁচটাতেই আকাশে এক পোঁচ আঁধার।

'রাত' ছ'টা -

কোথায় চলেছি খোদায় আর ড্রাইভারে মালুম। হেডলাইটের আলোয় যেটুকু দেখছি, তাতে তো জঙ্গল বলেই মনে হচ্ছে। আর গাড়ির ঝাঁকুনি টের পাচ্ছি সর্বাঙ্গে। বার দুই বোধহয় ঝরনা পেরোলুম।

'রাত' ছ'টা একত্রিশ -


মাইমাঝুয়া


হঠাৎ গাড়ি বাঁয়ে মোচড় মেরে থেমে গেল। অর্জুনের আকাশবাণী হলো — 'মাঈমাঝুয়া'। গাড়ির হেডলাইট নিভতেই অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ে গিলে ফেলল আমাদের।

'রাত' সাতটা -

মণিকা রাই-দের অতিথিনিবাসে চৌকি চেপে শুয়ে আছি। গাড়ি থেকে নামার পর আঁধারে খানিক হাতড়িয়ে, খানিক হোঁচট খেয়ে আলোর দেখা পেলাম। সেটা লক্ষ করে লক্ষ্যে পৌঁছলাম। এক কাপ করে চা হয়ে গেছে। এবার খাবার পালা।

রাত সাড়ে আটটা -

ভুরিভোজে ভুঁড়ি বাড়ালাম। স্নেহ আর আন্তরিকতায় তৈরি বাড়ির খাবারে অ্যাত্তোখানি ঘি মেখে খাওয়া — আ হা হা হা।

রাত ন'টা কুড়ি -

নিদ্রাসুন্দরীর ডাক এড়ানো ভারি মুশকিল হয়ে পড়ছে। তাই আলো নিভিয়ে বাকি মাইমাঝুয়ার সঙ্গী হওয়া যাক।

দশই নভেম্বর ভোর পাঁচটা পঞ্চান্ন-

পাঁচশো পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। বাইরে বেরোতেই লাজুক সুন্দরী মাইমাঝুয়া মন কেড়ে নিল। পাহাড়ঘেরা মাইমাঝুয়া তার রংবেরংয়ের বাড়িঘর আর বাগানের ফুল বসানো ঢেউ খেলানো সবুজ আঁচলখানা বিছিয়ে শুয়ে রয়েছে। শয়ে শয়ে পাখি গান গেয়ে তার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে।

সকাল ছ'টা ছাপ্পান্ন -

পুবদিক থেকে সূর্যকিরণ এসে চিন্তা-ফু-র মাথায় সোনালী টিপ পরিয়ে দিল। তারপর সেই সোনা তার গা বেয়ে গলে গলে নামতে থাকল। মাইমাঝুয়ার কন্যেরা তাদের আদরের গ্রামকে ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করতে লেগে পড়েছে, আজ আমরা যাব গোরোওয়ালেভঞ্জ্যাং। অর্জুন গাড়ির ব্যবস্থা করেছে।

সকাল আটটা চল্লিশ -

মাইমাঝুয়ার মায়া কাটানো গেল আপাতত।

সকাল পৌনে ন'টা -

হঠাৎ বাঁয়ে মোচড় মেরে গাড়ি স্বর্গমুখী।

সকাল ন'টা সতেরো -

ঝালমুড়ি ঝাঁকানির মধ্যেই ফুরসে (অথবা ফুসে) পোখরির দর্শন।

সকাল দশটা -


গোরোওয়ালেভঞ্জ্যাং


এ কী পথ রে বাবা! চমকাতে চমকাতে পিলেও হাঁপিয়ে উঠেছে। তবে গাড়ি থেকে নেমেই মনটা খুশ হয়ে গেল। গভীর অরণ্যের মাঝে পাঁচরাড়ির গোরোওয়ালেভঞ্জ্যাং যেন একটুকরো মুক্তো। তিনদিকে পাহাড়ী জঙ্গলে ঢাকা গোরোওয়ালের (কিংবা গোরওয়ালেও হতে পারে) যেদিকটা খোলা, দৃষ্টি সেদিকে গড়াতে গড়াতে হারিয়ে যায় দিগন্তে। পাখিরা ছাড়া প্রাণী বলতে গোটা দুই কুকুর, জনাকয় গরু, দেড়খানা শুয়োর, একটা মোরগ, দুটো মুরগি, ডজনখানেক মুরগিছানা আর অজস্র প্রজাপতি ছাড়া দশবারো জন মানুষ, যাদের মধ্যে জনা চারেক নেহাৎই দুগ্ধপোষ্য।

সকাল এগারোটা সতেরো -


গোরোয়ালির জঙ্গল


গ্রামের ধার ঘেঁষে জঙ্গল ভেঙে চড়াই পথে পা। উদ্দেশ্য খাবার তৈরি হওয়ার ফাঁকে হিমালয় দর্শন সেরে নেওয়া।

সকাল এগারোটা চল্লিশ -

কী চড়াই রে বাপু! হেঁপ্পে গেলুম যে। দাঁড়াও বাপু, এট্টুস দম নিয়ে গোঠের ধার ঘেঁষে 'পুকুর' পাড়ে।

সকাল এগারোটা পঞ্চাশ -


গোরোয়ালে টপ


গোরোওয়ালে টপ। গাছের ফাঁকে অবাধ হিমালয়ের বিস্তার।

ভরদুপ্পুর -


গোরোয়ালে টপ থেকে


হাঁ হয়ে হিমালয়ের পাগল করা রূপ দেখছি। পূর্বে ভুটানের পাহাড় থেকে পশ্চিমে চামলাং — ভগবানের প্যানারোমিক ছবি।

বেলা বারোটা কুড়ি -

ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন — গোরোওয়ালে। পেটে গণ্ডারেরা হাডুডু খেলছে।

বেলা একটা -

পাহাড়প্রমাণ খাবার পলকে পেটের ব্ল্যাকহোলে অদৃশ্য। এবার রোদ পোয়ানো।

বেলা চারটে চোদ্দো -

বনের সঙ্গে আলাপ করতে বেরিয়ে পড়া গেল। নিঝুম বন নীরবে জড়িয়ে ধরল। তার আদর মাখতে মাখতে আলস্য জড়িয়ে হাঁটার অভিনয় করে চললাম। দেখে তো ছোট্ট জলধারা খিলখিলিয়ে হেসে রাস্তা পেরিয়ে ঝাঁপ দিল ছোট্ট নদীর বুকে।

বেলা পাঁচটা -

বনের আশ্চর্য নীরব শান্তি নেশা ধরিয়ে দিল। সেই নেশায় চারজনে এগিয়ে দিয়ে দেখা পেলাম কুম্ভকর্ণের, মানে জানু-র। পাশ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা বলল 'টুকি'।

'সন্ধ্যা' সাড়ে পাঁচটা -

অস্ত যাবার মুখে সুয্যিমামা আকাশে, পাহাড়ে আবির ছড়িয়ে দিলেন। সেই আবির মেখে তুষারশৃঙ্গেরা রাঙা হয়ে উঠল। আমরা গাছের আড়াল থেকে তাদের সেই লাজুক ছবি দেখতে লাগলাম।

'রাত্রি' সাড়ে-ছটা -

রাত্রি তার তারার চুমকি বসানো কালো আলোয়ানটা দিয়ে চরাচর ঢেকে দিল। তারপর সেই ভুসো আঁধারে ঘাবড়ে গিয়েই বোধহয় তাড়াতাড়ি চাঁদের ফ্লাডলাইটটা জ্বেলে নিল। আমরা সবাই হাঁ হয়ে গেলাম।

রাত ন'টা -

কাঠের মেঝের ওপর পাতা ঢালাও বিছানায় লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমবুড়ির অপেক্ষা। আধখোলা দরজা দিয়ে মহানন্দে ঢুকছে ঠাণ্ডা। পাহারাদার সোলার ল্যাম্পের ভয়ে আঁধার থমকে আছে দরজার বাইরে। লুকিয়ে চুরিয়ে যেটুকু ঢুকে পড়েছে, তারা আশ্রয় নিয়েছে ঘরের ওই দিকটায় আর জড়ো করা চৌকির নিচে। তাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে ঘুম। গোরাচাঁদের অপেক্ষায় সবাই ঢুলছে।

এগারোই নভেম্বর, রাত তিনটে -

রাই দিদির হাঁকে ঘুম বাবাজি দুদ্দাড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে পগার পার। কিন্তু আলস্যবাবাজির নড়ার নাম নেই। জোর ধমক দিয়ে তাকে ভাগাতে হলো।

রাত সাড়ে তিনটে -

'মাইনাস ওয়ান' প্রকৃতিতে 'রাতকৃত্য' (এই ঘোর আঁধারকে কিছুতেই প্রাতঃ বলা যায় না) সমাপনান্তে উষ্ণ চা পান ঠাণ্ডাকে খানিকটা চাপা দিল। সঙ্গে কিঞ্চিৎ 'টা' পেটে পড়ায় বেশ চাঙ্গা হওয়া গেল।

রাত চারটে দশ -

ইয়েতি সেজে ঝুমুরকাকুকে লেপমুড়ি অবস্থায় পরিত্যাগ করে নিশ্চিন্তমনে চিন্তা ফু জয়ে বেরিয়ে পড়া গেল দেড়খানা টর্চ সম্বল করে। পথপ্রদর্শক অর্জুন, তারপরে আমি, গোরা আর আদিত্য - শেষে সবাইকে সামলে অন্তরে।

চারটে পঁচিশ -

ভোরের সাথে আঁধারের লড়াই চলছে, আমরা চলেছি টর্চের আলো সম্বল করে ব্যালান্সের খেলা দেখিয়ে হোঁচট খেতে খেতে পাকের পর পাক ঘুরে চড়াই ভেঙে। দেড়খানা টর্চের আলোর বৃত্তের বাইরে আঁধার রাক্ষস ওৎ পেতে আছে খাদে ফেলে দেবে বলে। একেবারে অন্ধের মতো চলেছি অর্জুন-ভরসায়। মনে আশা অর্জুন আছে যখন, লক্ষ্যভেদ হবেই।

ভোর পাঁচটা কুড়ি -

হুই ওপর থেকে কালচে নীল আকাশটা খবর পাঠালো - রাতের রাজত্ব শেষ। তবে চড়াইয়ের শেষ নেই। ইদিকে দম কিন্তু শেষ।

ভোর পাঁচটা তেত্রিশ -

গাছপালাদের দেশ ছাড়িয়ে আসতেই দেখা পেলাম কাঞ্চনজঙ্ঘার শীত মেখে অপেক্ষা করছে সূর্যোদয়ের। সামনেই নির্জন এক গোঠ। তার পাশে এক জলাশয় চুপটি করে বসে আছে। পুব আকাশে রংয়ের ছোঁয়া লেগেছে। এবার বরফকুচিমাখা নুড়ি মাড়িয়ে খাড়া উঠে যাওয়া। চিন্তা ফু-র চুড়ো ভুরু কুঁচকে দেখছে আমাদের। এখন আমি একেবারে ব্যাকবেঞ্চার।

ভোর পৌনে ছ'টা -


চিন্তা ফু থেকে এভারেস্ট মাকালু ইত্যাদি শৃঙ্গ


জিভ বার করে হাঁফাতে হাঁফাতে লালচে ঝোপ এড়িয়ে হলদে ঘাস মাড়িয়ে উঠে এলাম চিন্তা ফু-র চূড়োয়। এক্কেবারে সামনে থেকে এভারেস্ট বলল - স্বাগতম। তার সঙ্গে যোগ দিল মাকালু, লোৎসে, নুপ্‌ৎসে, সামদাংরা। এমনকী দূর থেকে গৌরীশঙ্করও আশীর্বাদ জানালো। থ্রি সিস্টার্স তিব্বতের আশীর্বাণী বয়ে আনল। আর সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা তো হেসেই রয়েছে।

সকাল ছ'টা -


চিন্তা ফু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা


শুরু হলো সাজবদল। প্রথম টিপটা পরল কাঞ্চনজঙ্ঘা। তারপর জানু, কাব্রু, পাণ্ডিমরা। এবার মাকালুর পালা। মাকালুর মাথায় টিপ দিয়েই সূর্যকিরণ সাজাতে বসল বিশ্বজননী চোমোলাংমাকে - যাকে নেপালবাসীরা আদর করে ডাকে সাগরমাথা বলে; সায়েবরা আর আমাদের মতো সায়েবদের পোঁ-ধরার বুলি এভারেস্ট। দ্যাখ না দ্যাখ সকলেই সেজেগুজে আহ্লাদে আটখানা। হিমবন্তকে সাজিয়ে সুয্যিমামা এবার নেকনজর দিলেন আমাদের দিকে। তাঁর উষ্ণপরশ পাঠিয়ে শীতবুড়িকে তার হাঁকডাক কমাতে বাধ্য করলেন। আমাদের দাঁতের কত্তাল বন্ধ হলো।

সকাল ছ'টা ষোলো -

নির্জন চিন্তা-ফু হাটকে পিছনে ফেলে এবার ফেরার পালা।

সকাল ছ'টা বাইশ -

সেই গোঠকে কাঞ্চনজঙ্ঘার জিম্মায় রেখে নামতে থাকলাম।

সকাল সাতটা পাঁচ -

রাতের সেই ভয়ঙ্কর দানব পথটাকে আর ততটা ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। গোটা পাহাড়টা সোনা রোদ মেখে হাসছে।

সকাল সাতটা পঁচিশ -

গোরোওয়ালের প্রাণচঞ্চল (অবশ্য জনা কুড়ি প্রাণীর পক্ষে এই ঠাণ্ডায় যতটা প্রাণচঞ্চল হওয়া সম্ভব) আঙিনায়। মিঠে রোদে হাত পা ছড়িয়ে অন্যদের জন্য অপেক্ষা।

সকাল দশটা -

চিন্তা ফু পর্ব সঙ্গে হলো নিশ্চিন্তেই। এবার পায়ে পায়ে নেমে যাওয়া মাইমাঝুয়ায়। তারপর — সে অন্য গল্প।




(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)