ISSN 1563-8685




হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে
প্রচেত গুপ্তর গল্প


প্রচেত গুপ্তর গল্প; প্রচেত গুপ্ত; প্রথম প্রকাশ: অগ্রহায়ণ ১৪১৮, মিত্র ও ঘোষ - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ৪১৬; ISBN: 978-93-5020-050-6
চাঁদ পড়ে আছে; প্রচেত গুপ্ত; প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী ২০১৩, পত্রভারতী - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ২৮৮; ISBN: 978-81-8374-185-9
রাতে পড়বেন না; প্রচেত গুপ্ত; প্রথম প্রকাশ: পৌষ ১৪২০, মিত্র ও ঘোষ - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ২৫৪; ISBN: 978-93-5020-116-9

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বিশেষতঃ ছোটগল্প ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রচেত গুপ্ত একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। গল্প ও উপন্যাস রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর ছোটোগল্পে প্রেম আছে, স্বপ্ন আছে, আনন্দ আর কান্না আছে। যুগমন ও মননকে অনায়াসে ছুঁয়ে যায় তাঁর গল্প। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ছোটোখাটো অথচ অব্যর্থ নানা কৌতূহল আর প্রশ্ন তাঁর গল্পের আনাচে কানাচে উঁকি দিয়ে যায়। তাঁর রচনা এক অখণ্ড সত্যের সংকেতবাহী, উজ্জ্বল এবং ইঙ্গিতধর্মী। প্রচেতের গল্পের উপাদান শহরমুখী। তাঁর গল্প পড়লে মনে হয় উপকরণ স্বল্প, আয়োজন সহজ অথচ গভীরতা বড়ো কম নয়। মনে হতে পারে nothing, nothing special আমিও তো লিখতে পারি এমন গল্প। আর পাঠক যদি একথা ভাবেন চোরাবালিতে পা বাড়াবেন অনায়াসে। মোহিনী মায়ার বাঁশি শুনে প্রতারিত হবে মন। সাদামাটা ভাষা আর নিত্যদিনের সহজ কথনভঙ্গী প্রচেতের গল্পের সম্বল। গুণীর হাতের জাদুর ছোঁয়ায় ভাঙা যন্ত্রে জলতরঙ্গের বাজনা বাজে, রুদ্ধ গৃহের দেওয়ালে পোড়া কাঠকয়লা দিয়ে পৃথিবীর সেরা ছবিটি তৈরি হয়, সিদ্ধ রূপকারের ছোঁয়ায় গল্পের যে কোনো উপকরণ শ্রীমণ্ডিত হয়ে ওঠে। রামধনুর সাতরঙা জাদু আছে প্রচেতের কলমে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মধ্যবিত্ত জীবনের ছাপোষা ছাঁচের বিবর্ণতার মাঝে আশ্চর্য সব সোনালি বিচ্ছুরণ তুলে আনতে পারেন প্রচেত। কাহিনীর ধূপ নিবে যায় কিন্তু ভাবের সৌরভটি মোহ বিস্তার করতে থাকে ধীরে ধীরে পাঠকের মগজে। প্রচেত গুপ্ত প্রচুর লেখেন কিন্তু তাঁর লেখার প্রাচুর্য গল্পের মাধুর্যকে ক্ষুন্ন করেনি। তাঁর গল্পে নিটোল ভিলেন চরিত্রের দেখা পাওয়া ভার। অসীম ক্ষমায় ভালোমন্দ মিশিয়ে তিনি চরিত্র গড়ে তোলার ভার নেন। খল চরিত্রের শঠতা লেখকের সৃজনশিল্পের নৈপুণ্যে দুর্বল। তাঁর বেশিরভাগ গল্প জুড়ে থাকে অস্তিবাদের আবহ। নাগরিক জীবন গল্পের পটভূমি হলেও নাগরিকতার সংকট ঘনীভূত হয় নি তাঁর গল্পে। ধ্বস্ত সময়, বিপন্ন সম্পর্কের অভিঘাতে বিপর্যস্ত দুরন্ত মেট্রোপলিসের ত্রস্ত সংস্কৃতি লাগামছাড়া হয়ে তাঁর ছোটোগল্পে ঝেঁপে বসেনি। গল্পের চরিত্র নিয়ে কোনো বৌদ্ধিক ব্যায়াম কিংবা দেশকাল আর সমাজ নিয়ে ভারী তত্ত্বকথার অবতারণা নেই। দুরুচ্চার্য শব্দ কিংবা জটিল চিত্রকল্প ব্যবহারে তাঁর অনীহা। তাঁর গল্প পড়তে অভিধানের সাহায্য লাগেনা। গল্পকার হিসেবে তিনি মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী অপেক্ষা বৃহত্তর সাধারণ পাঠকের বোধবুদ্ধির উপর ভরসা রাখেন বেশি। গল্প বলার কৌশলে পাঠককে বেঁধে রাখেন অনায়াসে, অক্লেশে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যৌনতার সুড়সুড়ি দিয়ে জনপ্রিয়তা আদায় করতে তিনি রাজী নন।

১৪ই অক্টোবর ১৯৬২ খ্রীঃ প্রচেত গুপ্তর জন্ম। মা জ্যোৎস্না গুপ্ত গল্প লিখতেন নিয়মিত। মাত্র বার বছর বয়সে 'আনন্দমেলা'য় তাঁর গল্প ছাপা হয়। লেখকের কথায় 'স্কুলে পড়বার সময় বাবার (অধ্যাপক ক্ষেত্র গুপ্ত) সম্পাদনায় আমরা পারিবারিক ভাবে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলাম। হাতেলেখা, রঙীন পত্রিকা। নাম হা হা হি হি। চার নম্বর খাতার পাতায় পাতায় ছবি, ছড়া, গল্প। হা হা হি হি পত্রিকাতেই আমার জীবনের প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়।' স্কটিশ চার্চ কলেজের স্নাতক এই সুসাহিত্যিক, স্বল্পভাষী, লাজুক মানুষটির সাহিত্যজীবনের গোড়ার দিকে ছোটোদের জন্য লেখায় বিশেষ ঝোঁক ছিল। প্রথম শিশুদের জন্য উপন্যাস 'লালরঙের চুড়ি'। তাঁর 'চাঁদের বাড়ি' উপন্যাসটি তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় সিনেমা হয়েছে। 'চোরের বৌ' উপন্যাসটি শেখর দাসের পরিচালনায় ফিল্ম হয়েছে। তাছাড়া হিন্দী, ওড়িয়া এবং মারাঠী ভাষায় অনূদিত তাঁর গল্পের সংখ্যা নেহাত কম নয়।

এই তরুণ লেখকের অন্যতম জনপ্রিয় গল্পসংকলন 'প্রচেত গুপ্তর গল্প' - ২০১১ সালে প্রকাশিত। সুখ, দুঃখ, রাগ, অভিমান, বিষাদ, প্রেম, ভালবাসা - সবমিলিয়ে এ বইয়ের গল্পগুলি টক মিষ্টি স্বাদে ভরা। এই বইয়ের ভূমিকায় লেখক বলেছেন — 'গল্প কেন লিখি স্পষ্ট করে বলতে পারব না। দশ বছরের বেশি সময় ধরে লেখার পরও মনে হয়, যা লিখতে চাই তা এখনো লেখা হয় নি। আমি পারছি না। শুনেছি, লেখকের ভেতর এই অতৃপ্তি থাকা ভালো। আমি অত ভালো মন্দ বুঝি না। যা সত্যি তাই বললাম।' এই বইটির গল্পগুলো পড়লে মনে হয় — লেখক গল্প তৈরি করেন নি, তা নিজের মতো গড়ে উঠে ছড়িয়ে পড়েছে। সমস্ত গল্পগুলো যেন লেখকের নিজের শক্তিতে বেড়ে উঠেছে। দাম্পত্য সম্পর্কের বিচিত্র রঙ ও রেখা স্থান করে নিয়েছে এই বইতে। 'লোডশেডিং' গল্পে আছে বিবর্ণ অন্ধকারে সুখী দাম্পত্যের রং বদলের সুস্পষ্ট ছবি। আবার 'নিতি কেন বৃষ্টি ভালোবাসে না' নারীর রহস্যময় চরিত্রের উন্মোচনের বিবৃতি। সমাজ, সময় আর জীবনের ক্ষুরধার সংকটকে উপভোগ করে গল্প বোনার ম্যাজিক জানেন প্রচেত। পঞ্চাশ বছর পর দুই বন্ধুর সাক্ষাতে 'স্মৃতি' গল্পের সূচনা। এই গল্পসংগ্রহে রবীন্দ্রনাথের গান, গল্প ও কবিতার সুপ্রচুর ব্যবহার লক্ষণীয়। পাত্রীর রুচি বুঝতে পাত্রপক্ষের কন্যার পিতাকে রবীন্দ্র ক্যুইজ জিজ্ঞাসা কিংবা পকেটমারদের নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করতে মোবাইল এর রিংটোন ব্যবহার অভিনব পরিকল্পনা। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের গানের নানা পঙ্‌ক্তির ব্যবহার তো আছেই। 'সেলোনোফোবিয়া' চন্দ্রাহত নারীর উপাখ্যান। প্রচেতের পূর্বতন গল্প সংগ্রহ 'পঞ্চাশটি গল্প'-তে 'চন্দ্রাহত' এরকম একজন মুন লাভারের কাহিনী। জ্যোৎস্নায় সে পাগল হয়ে যায়। প্রাকৃত পৃথিবী থেকে অপার্থিব জগতে যাত্রা করে তাঁর কোনো কোনো গল্প। 'মিনু ও বিনু' এরকমই একটি কাহিনী। দুই বোন মিনু ও বিনু গ্রামের মেয়ে। শহরের ছেলে তথাগত চাকরির সূত্রে গ্রামে বদলি হলে মিনু তার বাড়ির কাজকর্ম করে। একদিন তার দিদি বিনু আসে সংগে। দুজনেই রোগাভোগা, একমাথা জট পাকানো চুল, মলিন বসন। বিনু কলকাতা যেতে চায়। ওরা ফিরে গেলে তথাগত দেখে বারান্দা, উঠোন পার হয়ে রক্তমাখা পায়ের ছাপ চলে গেছে পথে। তথাগত পরে জানতে পারে বিনু দুবছর আগে কলকাতায় গিয়ে ধর্ষিত এবং মৃত। পরের দিন ভোরে মিনু যথারীতি আসে ঘরের কাজে। মোপাসীঁয় রীতিতে চমক দিয়ে তখনই গল্প শেষ হয় যখন তথাগত ভোরবেলা দরজা খুলে দেখে কাজে এসে মিনু নিতান্ত স্বাভাবিকভাবে রক্তমাখা পায়ের ছাপ মুছে ফেলে জল ঢেলে বারান্দায় আর উঠোনে। 'বকুল', একটি ক্রাইম স্টোরি। এখানে অপরাধীর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা পাঠকের কাছে উন্মোচিত হয়েছে ধীরে ধীরে। এই বইটির কাহিনীতে প্লটের নতুনত্ব, লেখকের মৌলিক উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং কৌতুকবোধ দেখে পাঠক বিস্মিত হবেন। রাজনীতিতে ক্ষমতার খেলায় অভ্যস্ত কিছু মানুষের কীর্তির কথা ফাঁস হয় 'বৃংহতি' গল্পে। পরমেশ্বর সান্যাল, 'উপমন্ত্রী, পশু' জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে পড়া হাতিদের জনগণের মধ্যে বিক্রির উদ্দেশ্যে লটারীর বন্দোবস্ত না করে লিখিত পরীক্ষার এলাহি বন্দোবস্ত করলেন। বেশী নম্বর পাওয়া প্রার্থীরাই কিনতে পারবে হাতি। গল্পে শেষ পর্যন্ত হাতির দল বাঁকুড়া, হুগলি, হাওড়া পেরিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্র গুলির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। পরমেশ্বর পালানোর জন্য গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পরপরই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাতির ডাক ভেসে এল। সেই ডাক গা হিম করা। এই লেখায় মজা আছে সুপ্রচুর, বক্তব্যও কম নয়। এ গল্পের কোনো কোনো পঙ্‌ক্তি এক ঝলকে সমকালীন সমাজটার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। যেমন - 'আজকাল যে কোনো ব্যাপারে এন. আর. আই. কোটা রাখা একটা নিয়ম। এতে জিনিসের কদর বাড়ে। যে জিনিসের জন্য এন. আর. আই. কোটা নেই, সে জিনিসের কোনো কদর নেই।' কিংবা 'পরীক্ষা নিয়ে ছোটোবেলা থেকেই পরমেশ্বরের একটা দুর্বলতা আছে। ..... পরীক্ষার কথা উঠলেই তিনি বলেন, "ভাইরে, জীবনে স্কুল কলেজে পরীক্ষা দেওয়ার সময় পেলাম কই? সেই সময়টাতো জেলে অনশন করছিলাম। দেশ আগে না পরীক্ষা আগে রে ভাই?"' লেখকের বক্তব্যরীতির মুন্সিয়ানাকে কদর না করে উপায় নেই। দেবব্রত ঘোষ-কৃত এ-বইয়ের প্রচ্ছদপট অনবদ্য।


'সত্যি চমৎকার হলিডে হোম। শহরের ভিড় থেকে দূরে। নির্জন, একা। এখন সন্ধে হব হব। ঝকঝকে শান বাঁধানো উঠোনে, কুয়োর পাশে, মাদুর পেতে শুয়ে আছি চিৎ হয়ে। অপেক্ষা করছি। একটু পরেই জ্যোৎস্না ভাসিয়ে চাঁদ উঠবে। সেই চাঁদের ছায়া দেখা যাবে কুয়োর টলটলে কালো জলে। মনে হবে, অনন্ত কুয়োর নিস্তরঙ্গ জলে চাঁদ এসে পড়েছে। তাকে চুমু খাচ্ছে উন্মাদের মতো, আর বিড় বিড় করে বলছে 'ভুলে যেয়োনাকো তুমি আমাদের উঠানের কাছে / অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে।' আমি এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি।'

এটি 'চাঁদ পড়ে আছে' গল্পের অন্তিম পরিচ্ছেদ। এই নামেই গল্প সংগ্রহটির নামকরণ। এই গল্প পড়লে অনেকের মনে ভেসে উঠবে জীবনের পুরনো স্মৃতি, নিকোনো উঠোন, গভীর কালো জলে পরিপূর্ণ অতলান্ত কুয়ো আর ছেলেবেলায় দেখা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া পূর্ণিমার রাতে কুয়োয় মুখ বাড়িয়ে জলে চাঁদ পড়ে থাকার অপার্থিব ছবির কথা। প্রচেতের দেখার চোখ, বলার ভাষা এবং জীবনপ্রতীতি পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। গল্পের মধ্যে জীবনের নানা তুচ্ছতার ছবি নিবিড় মনোযোগে আঁকেন তিনি । তাঁর কলমে আঁকা প্রতিটি ছবি জীবন্ত, বিশ্বাসযোগ্যতায় কোথাও চিড় ধরায় না। তাঁর গল্প নিয়ে আলোচনা করা সমালোচকের এক বিশেষ প্রাপ্তি একথা নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে। এই সংগ্রহে গৃহীত তেরোটি গল্পই লেখকের অত্যন্ত প্রিয়। এই বইটির নামকরণের একটি ইতিবৃত্ত আছে। তার খোঁজ পাওয়া যাবে লেখকের 'ভূমিকার বদলে ঝামেলা' শীর্ষক নিবেদনে। 'কেন লিখি' সে প্রসঙ্গে তিনি এই বইটিতে লিখেছেন — 'বোধের তাড়না, দার্শনিক চিন্তা, জীবনের ব্যাপ্তি বেঁচে থাকবার জটিলতা বা দিনযাপনের যন্ত্রণার কারণে লিখি না। এত কঠিন জিনিস বুঝিও না।' এই বইটিতে সমকালীন জীবনের অনৈতিকতা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংহত শ্লেষ, মোলায়েম ব্যঙ্গ আর মৃদু বিদ্রুপ পাঠক খুঁজে পাবেন। অথচ সবটাই আশ্চর্য প্রসন্নতার মোহময় আবরণে ঢাকা। আজ যখন বাস্তব পরাবাস্তব, লৌকিক অলৌকিক বিশ্ব আর মহাবিশ্বের অসংখ্য বিষয় নিয়ে সেমিনার ওয়র্কশপ কনফারেন্স আর বিতর্কসভার বাণিজ্যিকরণে নানা মানুষ ব্যস্ত, সেই পরিপ্রেক্ষিতে 'পাতিলেবু' গল্পটি পুরোপুরি সময় উপযোগী। এই গল্পটিতে লেখকের ভাষায় — 'টিভি চ্যানেল গুলোতে এখন 'গেস্ট'দের চাহিদা তুঙ্গে। বড়, ছোটো, মেজ, সেজ, রাঙা, ন - আঠারো-উনিশটা চ্যানেলে সারাদিন আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা, হাতাহাতি, মারামারি লেগেই রয়েছে। বিষয়ের শেষ নেই। রাজনীতি থেকে দুর্নীতি, ধর্ষণ থেকে বর্ষণ, হাসি থেকে বাঁশি। আজ আলোচনার বিষয় বজ্রপাত তো কাল বিষয় চিটিংবাজ। আজ নারীমুক্তি তো কাল ছেঁদো যুক্তি। আজ পকেটমার তো কাল সাহিত্য পুরস্কার। আজ হাঁচিকাশি তো কাল খুনির ফাঁসি। আজ সংগ্রাম তো কাল ল্যাংড়া আম। আজ কালোবাজারি তো কাল আন্না হাজারি, আলোচনায় এক্সপার্ট চাই। তাঁরা কথা বলবেন। চিৎকার করে গলার শির ফোলাবেন উলটো দিকে কেউ থাকলে ঝগড়া করবেন। না থাকলেও ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। সব মিলিয়ে আলোচনা জমিয়ে দেবেন।' নিরাপত্তাহীন বার্ধক্যে অন্ধকারের পথে যাত্রী হয় না প্রচেতের গল্পের বৃদ্ধবৃদ্ধারা, নতুন প্রজন্ম তাদের হাতে হাত রাখে স্নেহে ও ভালবাসায়, মায়া ও মমতায়। ‘ছায়া' গল্পটিতে আছে বিদেশে দীর্ঘদিন বসত করেছে শিবশম্ভু। রিয়েল এস্টেট নিয়ে গবেষণা করেছে সে, আর এসবের ন্যায্য পাওনা হিসেবে স্বদেশে আপন বাবা-মাকে বাড়ি থেকে উৎখাত করতে চায়। আপাত অর্থে বেকার, অলস, অকর্মণ্য, টাকাপয়সা সম্পর্কে উদাসীন নায়ক এসব অন্যায়ের প্রতিকার করে। প্রচেতের গল্পে নারী ও পুরুষের প্রথাগত সম্পর্ক অনেক সময়ে উলটো পথে হাঁটে। গল্পের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে পুরুষ নয় নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিপরীত স্রোতে নতুন পথে হাঁটে তাঁর গল্পের চরিত্ররা। 'মিছিল' গল্পে আছে প্রতিবাদী একটি মেয়ের কথা। কিন্তু অন্যরূপে, অন্যভাবে। শহরের মিছিলে আটকে পড়া নিরুপায়, পথক্লান্ত একটি মেয়ে সেঁধিয়ে যায় তাতে। আর বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার ছবি ছাপা হয়। নিরুপায় ভাবে মিছিলে যোগদানের জন্য আসন্ন বিবাহার্থী এই মেয়েটি প্রত্যাখ্যাত হয় সব জায়গায়, অপমানিত হয় তার পরিবার। অথচ এই মিছিল অন্য ভাবনায় দেখা দিয়েছে ভিন্ন বইতে আর একটি গল্পে। নারীমুক্তি আন্দোলনে নেতৃস্থানীয়া অতি আধুনিকা এক মহিলার কাছে দূর গ্রাম থেকে আগত অসহায় আত্মীয় তাঁর তরুণী কন্যার জন্য একটি রাতের আশ্রয় প্রার্থনা করে নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। রাতের অন্ধকারে মেয়েটি বাবার সঙ্গে বাড়ি ফেরার জন্য পথে বেরিয়ে অবাক হয়ে দেখে মোমবাতি মিছিল বেরিয়েছে কোনো এক নির্যাতিতার সমর্থনে। প্রচেতের গল্পে দমচাপা কোনো বড় ঘটনা নেই, মনস্তত্ত্বের কোনো তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ নেই, মহামুহূর্ত সেখানে - গল্পের মধ্যে হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে যেখানে। তার গল্পের আয়োজন সহজ অথচ গভীর। মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ।


নিজের লেখা সম্পর্কে একটা কথা বলেছেন প্রচেত গুপ্ত - 'মাঝেমধ্যে এমন কিছু আমার গল্পে চলে আসে যা আমাদের যুক্তিবুদ্ধি এবং চেনা জগতের নয়। কোন্‌ জগতের জানি না। শুনেছি, আমার গল্প পড়ে পাঠকের যেমন আনন্দ হয়, দুঃখ হয়, তেমন মাঝেমধ্যে এক ধরনের গা ছমছমে অস্বস্তিও হয়। এ অস্বস্তিটাই কি ভয়? পাঠক বলতে পারবেন।' তাঁর এ ধরনের ভীতিপ্রদ, ভৌতিক আবহ সম্বলিত গল্পগুলির প্রেক্ষাপটে নদীর ধারে আসশ্যাওড়ার জঙ্গলের মধ্যে ছায়াময় শ্মশান, লম্বা লম্বা ঝুরি নামানো ঝুপসি বটগাছ, দীঘির পাড়ে ছায়াঢাকা সরু অন্ধকার জংলি পথ কিংবা বাঁশ গাছের ঝাড়ের শনশনানি শোনা যায় না। বাংলা সাহিত্যে ভূতের এসব অতি পরিচিত আড্ডাস্থল 'রাতে পড়বেন না' বইটিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং তাঁর ভৌতিক গল্পে অশরীরীরা ফ্ল্যাট বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। লম্বা হাত বাড়িয়ে মানুষের মোবাইল চুরি করে নাকী সুরে মানুষী প্রেমে মগ্ন হয়। অশরীরী কিশোরীর পড়ার ঘর সযত্নে গুছিয়ে দিয়ে গল্পের নায়ক ভুতুড়ে বাড়ি ছাড়ার কথা ভাবে। অতিপ্রাকৃত গল্পগুলির গা ছমছমে ভাবের মধ্যেও আছে সৌন্দর্যের শিল্পরূপ এবং মানবিকতাবোধ। এমনকি ‘সহকারি’ গল্পে জাদুকরের সাহায্যকারী মৃত্যুর পরেও জাদুকরকে সাহায্য করার জন্য শো চালিয়ে যায়। অতি প্রাকৃতের প্রতি মানুষের একটা সহজাত আকর্ষণ আছে। দেশ কাল জাতি ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের মনে অল্পবিস্তর অজ্ঞাতের প্রতি আতঙ্ক আছে। লেখকও হয়ত তা বোধ করেন। সম্ভবতঃ তাই তাঁর গল্পে এমন কিছু বিষয় চলে আসে যা আমাদের যুক্তিবুদ্ধির বাইরে। লেখক সম্ভবের জগত থেকে যে অসম্ভবের জগতের দিকে যাত্রা করেন তা তার গল্পের গঠন কৌশলের নিপুণতায় বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। 'পেরেক' গল্পে জুতোর পেরেক মূর্তিমান শয়তানের মতো পরিবারের সকলের পা কেটে রক্তারক্তি করে। ভিন্ন বইয়ে আর একটি গল্পে একটি পেরেক অলঙ্কৃত চেয়ার সমস্ত বাড়িতে দমচাপা ভীতিজনক পরিবেশ তৈরি করে। অচেতন পদার্থে এভাবে চেতনা আরোপিত হয়ে যায়। বিচিত্র মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা প্রতিফলিত হয় কয়েকটি গল্পে। যে অনুসরণকারী আর যাকে অনুসরণ করা হয় যেন একই সত্তার এপিঠ আর ওপিঠ, (অনুসরণকারী)। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই শান্তার বৈচিত্র্যহীন, বিস্বাদ জীবনে কেনাকাটার সময়ে রাস্তার সামান্য হকারের কাছ থেকে চিরুনী চুরি করা, তা নিয়ে তীব্র মানসিক সংকট, অনুশোচনা, পাপবোধ — এসব নিয়ে 'গোলমেলে' গল্প। 'রাতে পড়বেন না' বইটি সুখপাঠ্য। প্রচ্ছদে ঘন কালো আর উজ্জ্বল হলুদ রঙের ব্যবহার এই বইটির ভৌতিক আবহকে গাঢ়তর করেছে।

পাঠকের প্রত্যাশা এই যে গ্রামীণ জীবন, দুঃখ দারিদ্র্যগ্রস্ত মানুষের অসহায়তা, হাসি-কান্না আর জীবনযন্ত্রণা তার গল্পে ফিরে ফিরে আসুক। কেননা যে কোনো বিষয় নিয়ে গল্পের তরী বেয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা প্রচেতের অসাধারণ। 'যা লিখতে চাই তা এখনো লেখা হয় নি' লেখকের এই তীব্র অতৃপ্তিবোধ তাঁকে আরো আরো গল্পরচনায় প্রণোদিত করবে নিশ্চয়ই। আমরা অর্থাৎ গোত্রহীন পাঠক-পাঠিকারা ভবিষ্যতের সেই চমৎকার গল্পগুলির আশায় অপেক্ষা করে রইলুম।



(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)