ISSN 1563-8685




নিশিজেঠুর বন্ধু

জ সে এসেছেন আমাদের বাড়িতে। সে আসবেন আমি জানতাম। সে আমার নিশিজেঠুর বন্ধু। আজই প্রথম আমি তাঁকে নিজের চোখে দেখব! নিচের বৈঠকখানার ঘরে বসে নিশিজেঠুর সঙ্গে গল্প করছেন। মা একটু আগেই কফি দিয়ে এসেছে। ব্ল্যাক কফি খুব পছন্দ করেন। কফি খেতে খেতে দু'বন্ধুতে খুব গল্প হচ্ছে। হাসি-মজা হচ্ছে। আমি ম্যাজেনাইন ফ্লোরের আমার পড়ার ঘরে বসে কান পেতে রয়েছি। খুব জোরে জোরে সে হাসছেন। হো হো করে হাসছেন। খুব হাসতে পারেন তো!...

নিশিজেঠুর কাছে ওঁর কথা অনেক শুনেছি। উনি বিখ্যাত এক পর্বতারোহী। পাঁচ ফুট ন'ইঞ্চি উচ্চতার ছিপছিপে একজন মানুষ। মাথায় চুল অল্প। দাড়িগুলো সব পাকা। খুব বেশি পাহাড়ে চড়লে, এক্সপিডিশন করলে চুল-দাড়ি নাকি পেকে যায়! দু'বছর আগেই মাউন্ট এভারেস্ট জয় করে ফিরেছিলেন। এবছর কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করে সবেমাত্র কলকাতায় ফিরে এসেছেন। খবরের কাগজে খবর, টিভিতে সাক্ষাৎকার, সরকারের সংবর্ধনা কত কিছুই না তাঁকে নিয়ে হচ্ছে। আজ সেই বিখ্যাত পর্বতারোহী আমাদের বাড়িতে এসেছেন!

নিশিজেঠুও সারাবছর পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। জেঠু জঙ্গলে যেতে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। ভারতবর্ষের প্রায় সব জঙ্গলেই দু'তিনবার করে গেছেন। আফ্রিকার জঙ্গলেও ঘুরে এসেছেন। কেনিয়া, কিলিমাঞ্জারো, জিম্বাবোয়ের কত গল্প আমি জেঠুর কাছে শুনেছি। মাসাইমারাদের ছবি, ওদের শিকারের গল্প শুনতে শুনতে আমারও খুব ইচ্ছে হয়েছে, বড় হয়ে একবার যাবই যাব আফ্রিকার সেই সব দারুণ দারুণ জঙ্গলে। জেঠুর লেখা একটা সুন্দর বইও আছে। আমার জেঠু, নিশিকান্ত গুহ। পাহাড়-জঙ্গল প্রেমী মানুষের কাছে খুবই পরিচিত নাম। জেঠুর সেই বইতে দেশ-বিদেশের কত জঙ্গলের কথাই না আছে। আর আছে সুন্দর সুন্দর সব ছবি। বেশিরভাগ ছবিই জেঠুর আরেক ভ্রমণসঙ্গী আদিত্যকাকুর তোলা। ওরা দুজনে জুটি বেঁধে খুব ঘুরে বেড়ায়।

জেঠুর বন্ধুর তালিকায় কত গুণী মানুষ যে আছেন। তাঁদের কথা শুনতে শুনতে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। তাঁরা কেউ বিখ্যাত দাবাড়ু। কেউ সাঁতারু। কেউ ইংলিশ চ্যানেল পার করে ফিরেছেন। কেউ তীরন্দাজ। কেউ দৌড়বিদ। কেউ বিখ্যাত ট্রেকার। পায়ে হেঁটে হেঁটে হিমালয়ে ঘুরে বেড়ান। একজন তো আছেন লাদাখ স্পেশালিস্ট। সে নাকি শুধুই লাদাখ ঘুরে বেড়িয়েছেন সতেরোবার। সুযোগ পাই তো লাদাখ যাই! এটা নাকি তাঁর নিজের কথা।

কিন্তু এমন এক শৃঙ্গজয়ী সফলমানুষ আমি এর আগে কখনো দেখিনি বা জেঠুর কাছে গল্পও শুনিনি। দু'দিন আগেই জেঠু, আমায় প্রথম বলেছিল, মাদল, রোববার সকালে আমাদের বাড়িতে হেমন্ত আসছে। আমার বহুদিনের পুরনো বন্ধু। আমরা একসাথে থালাই সাগর, শিবলিং অভিযানে গিয়েছিলাম। ও এলে তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। ওর নিজের মুখে শুনবি, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপিডিশনের টাটকা গল্প। কি থ্রিল! কি অ্যাডভেঞ্চার। বাহাত্তর দিন ধরে এই রুদ্ধশ্বাস অভিযান। অবশেষে ওরা সফল হয়ে ফিরে এল। এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর স্পর্শ করে ফিরে আসা মানুষ তোর চোখের সামনে এসে দাঁড়াবে। তোর সঙ্গে কথা বলবে। দেখবি তুই নিজেও কত চার্জড হয়ে যাবি!

আমি সেদিন থেকেই শুধু সময় গুনেছি। কবে তিনি আসবেন! আমি তাঁকে নিজের চোখে দেখতে চাই। তাঁর মুখের গল্প শুনতে চাই। আজ সেই তিনি সত্যিই এসেছেন। জেঠুর সঙ্গে গল্প করছেন। জেঠু কখন যে আমায় ডাকবে। আলাপ করাবে জানি না। জেঠু কি ভুলে গেল? আর একটু পরেই আমাকে কোচিং ক্লাসে যেতে হবে। আজ অমলস্যারের মান্থলি টেস্ট। আমি পড়ার ঘরে বসে ছটফট করছি।

মা জেঠুদের দ্বিতীয়বার কফি দিয়ে এসে বলল, মাদল, তুই পড়তে যাবি না?

যাব তো! আমি একটু দুঃখ দুঃখ মনে বললাম, জেঠু বলেছিল আলাপ করাবে। কই ডাকছেই না তো আমাকে?

তাই বলেছিল! মা হেসে বলল, জেঠু নির্ঘাৎ ভুলে গেছে।

তুমি তো ওঁকে দেখলে। আমি কৌতূহল দেখিয়ে বললাম, কেমন গো?

অত বিখ্যাত মানুষ। কিন্তু খুব সিমপিল। একটু লাজুকও বটে। মা খুশি খুশি মনে কথাগুলো বলল।

সিঁড়িতে পদধ্বনি শুনতে পেলাম। জেঠু উঠে আসছে কথা বলতে বলতে, হেমন্ত, আমার ছোটে ওস্তাদের ঘরে এবার তোকে নিয়ে যাচ্ছি। ও তোর সাথে আলাপের জন্য মুখিয়ে আছে।

জেঠু আমাকে আদর করে ছোটে ওস্তাদ বলে ডাকে। সেই নামটাই কেন যে সবাইকে বলে কে জানে! সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। ওঁরা উঠে আসছেন। তিনি হাসতে হাসতে বলছেন, তোমার যখন ছোটে ওস্তাদ, তাহলে তো তাকে দেখতেই হয়!...

আমার ম্যাজেনাইন ফ্লোরের ছোট্ট পড়ার ঘরে জেঠু ও তাঁর বিখ্যাত বন্ধু এসে ঢুকে পড়লেন। ওঁরা ঢুকতেই মা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমি তো অবাক। জেঠু যে হঠাৎ আমার ঘরেই ওঁকে নিয়ে চলে আসবে বুঝতে পারিনি। আমার ছোট্ট পড়ার ঘর। ঘরে একটা পুঁচকে ডিভান। পাশে পড়ার টেবিল-চেয়ার। তার পাশে কমপিউটার। গ্লোব। আর রং-তুলি-ক্যানভাস-ইজেল সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেয়াল জুড়ে পেন্টিং পোস্টার। উনি আমার ঘরে ঢুকেই বললেন, তুমি তো খুব সুন্দর ছবি আঁকো শুনেছি। তোমার আঁকা ছবি দেখব বলেই চলে এলাম।

আমি তো খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। জেঠু আবার এসবও বলেছে বন্ধুকে। আমি সত্যিই ছবি আঁকতে ভালবাসি। মনে মনে স্বপ্নও দেখি, একদিন শুধুই ছবি আঁকব। ছবি এঁকে জীবন কাটাব। উনি আসবেন শুনে আমি ওঁকে উপহার দেব বলে একটা ছবি এঁকেও রেখেছি। জেঠু জানে না সে কথা।

আমি লজ্জা কাটিয়ে প্রথমেই বললাম, আপনাকে দেব বলে একটা ছবি এঁকে রেখেছি।

তাই? ফ্যানটাসটিক। উনি হো হো করে হাসলেন।

জেঠু বলল, এতো দারুণ সারপ্রাইজ রে!

ওঁরা দুজন আমার পুঁচকে ডিভানে বসেছেন। আমি ওঁর জন্য আঁকা ছবিটা খুঁজে এনে বললাম, ছবিটা আমি পেপার থেকে দেখেই এঁকেছি।

উনি দু'হাত বাড়িয়ে ছবিটা নিলেন। তারপর অবাক হয়ে অনেকক্ষণ দেখে বললেন, বিউটিফুল। কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াটা ঠিক অনেকটা তোমার এই ছোট্ট ঘরটার মতই সমতল। টেবিল টপ বলা যায়। সেখানে আমরা প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ছিলাম। খুব আনন্দ করেছি। ছবি তুলেছি। আর দেখেছি কত রঙের খেলা! কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় সূর্যের আলো পড়ে তার কিরূপ। কি রঙ। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ নিয়ে আমি আর আশিস দাঁড়িয়ে আছি, এই ছবিটাই সব জায়গায় দেখছি। জানো, এই ছবিটা তুলে দিয়েছিল থামবাহাদুর শেরপা। খুব ভালো লোক। ওদের কথা কেউ জানতে পারে না। অথচ এই শেরপারা ছাড়া এতবড় এক্সপিডিশান করতেই পারব না। আমাদের দলে পাঁচজন শেরপা ও উনিশজন পোর্টার ছিল। বাহাত্তর দিনের এই সকল অভিযানে ওঁদেরও অনেক অবদান! থ্যাঙ্ক য়ু মাদল। এটা একটা দারুণ উপহার আমার কাছে।

আপনি এবার নতুন কোথায় যাবেন? আমি ভয়ে ভয়ে কথাটা জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম।

উনি হাসছেন। মাথা নাড়ছেন। জেঠু বলল, কেন তুই যাবি নাকি?

আমি তো লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেললাম। জীবনে একটা পুঁচকে ট্রেকও করি নি। আমি যাব এক্সপিডিশনে!...

মাদল, জানো তো আমরা কেউ ঠিক জানি না, আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে কতটা শক্তি আছে। আমি কতটা পারব। উনি ধীরে ধীরে বলছেন, কোনওদিন যে এভারেস্ট জয় করে ফিরব স্বপ্নেও ভাবি নি। একদিন কাঞ্চনজঙ্ঘাও জয় হয়ে যাবে তাও ভাবি নি। তবু হল তো! আসলে খুব গোপনে স্বপ্নটা দেখতাম। দেখাটা শুরু করেছিলাম। ইচ্ছেটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। তাই বলব, যে কাজটা করতে চাও, মন দিয়ে করবে। শেষ পর্যন্ত লড়বে।

আমার পড়তে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। যেতেই হবে। আজ মান্থলি টেস্ট। আমি এবার আমার নিজের হাতে বানানো সুদৃশ্য অটোগ্রাফের খাতাটা ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, একটা অটোগ্রাফ দিন।

উনি খাতাটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টে উল্টে দেখছেন। আমি অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষদের অটোগ্রাফ নিয়ে রেখেছি। তাঁরা কেউ খেলোয়াড়। কেউ গায়ক। কেউ বাদক। কেউ লেখক। কেউ কবি। চিত্রকর। বিজ্ঞানী। উনি সবার অটোগ্রাফগুলো দেখলেন। তারপর খাতার সাদা পৃষ্ঠাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে একদম শেষ পাতায় গিয়ে লিখলেন, 'যা কিছু করতে চাও, তার আগে স্বপ্ন দেখাটা জরুরী। শুভেচ্ছা সহ - হেমন্ত সিংহ চৌধুরী।'

জেঠুর সাথে এবার উনি বেরিয়ে গেলেন। একদিন - আবার আসবেন, বলে গেলেন। উনি চলে যাচ্ছেন। লম্বা বারান্দাটা দিয়ে ঋজু একজন মানুষ হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছেন। থালাইসাগর, শিবলিং, মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁয়ে আসা মানুষটা আমাকে মুগ্ধ করে স্বপ্নের তরী বাইবার কথা বলে কেমন সুন্দর চলে যাচ্ছেন!

আমি একজন চিত্রকর হতে চাই। সেই স্বপ্নই তো দেখি। আমাকে বুঝি আরও অনেক অনেক স্বপ্ন দেখতে হবে!....



(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)