ISSN 1563-8685




তীর্থ

|| ১ ||


তীর্থ। শ্রীমান তীর্থপতি দাশ। সদ্য গ্রাম থেকে আসা রোগাসোগা কালোকোলো এক বছর বিশেকের তরুণ। থুতনিতে সদ্য দাড়ির ছোঁয়া, ভীতু ভীতু চাউনি। আমার চোখে তার এই রূপটাই ধরা আছে প্রায় তিন দশক ধরে, যখন আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়তুম।

স্কুল থেকে কলেজে উত্তরণ যে-কারোর জীবনেই একটা ঘটনা বটে। ফ্রক ছেড়ে শাড়ি তো তার বছর চারেক আগেই ধরেছি, তবে সে তো ছিল কাঁধে হাইস্কুলের লোগো দেওয়া ব্রোচ-সাঁটা নীলপেড়ে সাদা শাড়ি। মনোমত রঙচঙে শাড়ি বা সালোয়ার-কুর্তা পরে শিক্ষায়তনে আসবার স্বাধীনতা কলেজে উঠেই তো হল। তার ওপর আমাদের আবার ছিল কো-এড কলেজ। ছেলেরা আমাদের দিকে আড়চোখে দেখছে---এই বোধটাই না বয়ঃপ্রাপ্তির লক্ষণ। সেই মত ম্যাচ করা চুলের ক্লিপ, ঠোঁটে লিপগ্লস---এসব বয়ঃপ্রাপ্তির লক্ষণ গুলো তো দেখা গেলো কলেজে এসেই। আমাদের ক্লাসের ছেলেরাও সদ্য সিগারেট টানতে শিখে যত্রতত্র ধোঁয়া উড়াচ্ছে। ক্লাস বাঙ্ক, শিক্ষকদের অমুকবাবু তমুকদিদি না ডেকে পি কে এস বা টি আর বলে রেফার করা---‘বড়’ হয়ে যাওয়া নয় ? সে-সব ছিল আমাদের সদ্য তারুণ্যের গল্প । আজ এই প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় এসে হঠাৎ সে-সব কথা মনে পড়ে গেল খুব। কেন ? সে-গল্পই আজ লিখতে বসেছিঃ

বি.এ. ক্লাসে ঢুকে মাসখানেকের মধ্যে আমরা ক’জন বড্ড বন্ধু হয়ে পড়লুমঃ নন্দিনী, চয়ন, মালিক, তপোব্রত আর আমি। একসঙ্গে ওঠাবসা, ক্যান্টিনে আড্ডা মারা থেকে শনিবারের ম্যাটিনি শো। তীর্থ বা নির্মলের মত দু-একজন যদিও টিউটোরিয়াল ক্লাসে আমাদের দলেই ছিল, তবু ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব যাকে বলে, ঠিক জমেনি। ওদের মনের মধ্যের কোনো একটা আগলই ছিল এর কারণ। ওরা গ্রাম থেকে এসেছে, পরিবারের অবস্থাও হয়ত তত স্বচ্ছল নয়, পোষাক-আশাক মামুলি, মাথায় তেল দিয়ে পেতে আঁচড়ানো চুল---এসব গুলো শহুরে, ইংরিজি স্কুল থেকে আসা-দের থেকে ওদের আলাদা করে চিনিয়ে দিত। রিনরিনে গলায় কথা বলত তীর্থ। প্রথমদিন আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করায় হাসির হর্‌রা উঠেছিল, তাতে সে আরও কুঁকড়ে যায়। তারপর থেকে কোনোদিনই আমরা সহজভাবে মিশতে পারিনি। জনান্তিকে আমাকে ‘জজের বেটি’ বলে ঠেস দিয়ে কথা বলতো ওরা, শুনেছি।

###


আমরা ঢোকার দু’মাসের মধ্যেই কলেজের গোল্ডেন জুবিলি অনুষ্ঠান এসে পড়ল। জেলাশহরের মস্ত বড় এক ইভেন্ট। শুনলুম, ভারতের উপরাষ্ট্রপতিকে নাকি আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে প্রধান অতিথি হতে! বিধায়ক, সাংসদ, জেলাশাসক তো থাকবেনই। কলেজের মান-ইজ্জতের প্রশ্ন ! অতএব সাজ সাজ রব পড়ে গেল--নাটকের দলের রিহার্সাল থেকে, নৃত্যনাট্য থেকে স্কিট, সুভেনিরের জন্য বিজ্ঞাপন তোলা এটসেটেরা এটসেটেরা। আমরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে লেগে গেলুম ‘টু মেক দ ইভেন্ট আ গ্রান্ড সাকসেস’!

আমরা ছিলুম ‘ওয়েলকাম কমিটি’তেঃ আমি, জয়িতা, নন্দন, তীর্থ আরও কয়েকজন। ‘ওয়েলকাম গেট’-খানি তৈরি করার দায়ও তাই আমাদের ঘাড়েই পড়েছিল। ওসব আঁকাটাঁকা আমার আবার বিশেষ আসে না। আমি-জয়িতা তাই কার্ড-ব্যাজ-রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি নিয়ে পড়ে রইলুম (আমি অবশ্য সামনের আলপনাটা দিয়েছিলুম) আর তীর্থপতির ওপর পড়ল অভ্যর্থনা-ফটকখানি প্রস্তুত করার দায়িত্ব। আজকালকার এই সব ‘থিম-প্যান্ডাল’ ইত্যাদি শব্দ তখন আমরা শুনিনি, কিন্তু তিনদিন তিনরাত খেটে আমাদের শ্রীমান তীর্থপতি লালসবুজের কোলাজে যে গেটখানি খাড়া করল, সত্যি, পঞ্চাশ বছরের শিক্ষা-আন্দোলন যেন মূর্ত হয়ে ওঠে প্রথম দর্শনেই। উপরাষ্ট্রপতি যদিও আসেননি, রাজ্যপাল মহোদয় গাড়ি থেকে নেমে সব এটিকেট ভুলে দু’মিনিট থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন গেটটার সামনে, চোখে প্রশংসার ঝিলিক!

তারপর গোল্ডেন জুবিলির সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান তো চলল নিজের পথে। তার মাসখানেক পরের সময়কাল ধরেও কলেজে আর জুবিলি-জুবিলি ছাড়া আর কোনো গল্প-আলোচনাই নেই। মুখরোচক ও নট-সো-মুখরোচক গল্পের ফাঁকে তীর্থর তৈরি করা ওয়েলকাম গেটখানির প্রশংসা রয়ে গেল, কারণ সেটার ফোটো কলকাতার কাগজে কাগজেও বেরিয়েছিল। আর এতেই শ্রীমান তীর্থপতি আরও গুটিয়ে যায়। এমনিতেই লাজুক ছেলে, তার ওপর ওকে নিয়ে এতো আলোচনা, পারলে সে কলেজ ছেড়ে পালায়। তবে ওর শিল্পী-হাতের ছোঁয়া তাকে এক বিশেষ উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করে গেল, বিশেষতঃ তাদের কাছে, যারা এর কদর করতে জানে।

|| ২ ||


শ্রীমান তীর্থ দাশ বলতে কলেজের ঐ জুবিলির ঘটনা প্রথম হলেও প্রধান নয়। প্রধান যেটি মানা উচিৎ, সেটি কেন জানিনা, আমি ভুলে যেতে চাই—আমার মনে তা সুখস্মৃতি জাগায় না।

গোল্ডেন জুবিলির মাস পাঁচ-ছয়ের মধ্যে এসে গেল কলেজের আরেক বড় এনুয়াল ইভেন্টঃ কলেজ পিকনিক। শিক্ষক-অশিক্ষক-ছাত্রীছাত্রদল মিলে প্রায় শ’খানেক লোকের এক বিরাট দল চলল চারটি বাস ভরে। শহরের অনতিদূরে নদীর ধারে কোন্‌ এক মস্ত বাগানবাড়ি ঠিক করা হয়েছে। অতএব পড়ে গেল সাজোসাজো রব।

শেষ-ডিসেম্বরের মিঠেকড়া শীতের রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এই গাছের নিচে নয়তো নদীর ওই ঘাটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল আড্ডা দিচ্ছে, কারা অন্তাক্ষরির আসর বসিয়েছে তো নবীনদারা বাইরের মাঠটাতে ক্রিকেট নিয়ে মেতেছে। এপাশে ব্যাডমিন্টন খেলা চলছে, ওদিকে মস্ত উনুন থেকে মাংস কষার সুবাস।

নমিতা আমায় বলল, “চল, বিবি, নদীর জলে পা-ডুবিয়ে বসি।”

“না বাবা, আমার ভয় করে। সাঁতার-টাতার জানিনা।”

“তোর সবেতেই ভয়। কোন্‌ ইংলিশ চ্যানেলটা তুই পেরোতে যাচ্ছিস শুনি? নদীর এতো কাছে এসে তাকে স্পর্শ না করেই চলে যাবি? চল্‌চল্‌।” বেলা তখন একটা বাজে বোধহয়।

শীতকালের শান্ত নদী। অলরেডি দু-তিনটে ছোটছোট দলে ছেলেমেয়েরা ঘাটের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। দু-একজন সাঁতারও কাটছে। আমাদের আসতে দেখেই সুমিতা-জ্যোতিষ-যশোধরারা কলকল করে উঠলো, “এই নমি, আয় আয় এ’দিকে আয়। কী সুন্দর কনকনে জল দেখ। গা শিরশির করছে।” ওরা হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে হৈ হৈ করছে। দূরে কয়েকটি নৌকা মাছ ধরছে। ওপারে সবুজ বনানী। ছবির মত দৃশ্য।

এরপর আমরা মেতে গেলুম নদীর সঙ্গে খেলায়। হৈ হৈ, এ-ওর গায়ে জল ছিটোনো, সমস্বরে গান, “ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা...।”

ওই দল থেকে চুমকি চেঁচিয়ে বললো, “বিবি, দেখ্‌ দেখ্‌, একটা লাল রঙের ঝিনুক!”

“ঝিনুক? নদীতে? একি পুরীর সমুদ্দুর পেয়েছিস নাকি?”

“নারে, সত্যি। দেখ্‌, নড়ছিল আমার পায়ের তলায়, তুলেছি।”

হাঁটুজলে চুমকি আমার থেকে হাত পাঁচ-সাত দূরে। ওর দিকে এগিয়ে যেতে গেলুম আমি। হঠাৎ জলের তলায় যেন এক মস্ত সূঁচ মাড়িয়ে ফেলি আমি ভয়ঙ্কর জোরে। ‘উঃ’ বলে যন্ত্রণায় আমি বসে পড়তে গেলুম, চোখ থেকে চশমাটা ঠিক এই মুহূর্তেই ঠিক্‌রে জলে পড়ে গেল। চোখে অন্ধকার। জলে হাবুডুবু খেয়ে ভেসে যেতে যেতে পরে কেবল একটি কালো মাথা চোখে পড়েছিল, কী যেন বলছে চেঁচিয়ে। আমি প্রবল জোরে তার গলাটা জড়িয়ে ধরতে যাই, পারিনা । আমার নাকে সে প্রচণ্ড জোরে এক ঘুঁষি মারে। গলায় নোন্‌তা তরলের স্বাদ। এরপর আমার আর কিচ্ছু মনে নেই।

জ্ঞান যখন ফিরলো, ঘাসের ওপর শুয়ে আছি। আকাশের গায়ে অনেক কালো কালো মাথা, অনেকের অনেক কথা, ‘ঐ তো ঐ তো জ্ঞান ফিরেছে, চোখ খুলেছে। ডাক্তারবাবুকে দেখতে দে...’। তারপর যা যা হবার তা-ই হল। বাবা-মা এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গেই গাড়িতে বাড়ি ফিরি বিকেলের আগেই। পথে আর একটাও কথা হয়নি। মা হাতটা চেপে ধরে বসেছিলেন।

পরদিন খাবার টেবিলে বাবা মা-কে বললেন, “ছেলেটিকে তো প্রাইজ দেওয়া উচিৎ। ওই রোগা ডিগডিগে ছেলে, তোমার এই ভারিভুরি কন্যাকে জল থেকে টেনে তুলল কী করে? ও’ আগে ঝাঁপিয়ে না পড়লে...মাঝিমাল্লাগুলো তো পরে হেল্প করতে এসেছিলো, যা শুনলুম। ওকে একদিন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াও, রাণু। জেলেবাড়ির ছেলে কিনা। জলে বড্ড দড়। গ্রামে ওর মামাদের কাছে লোক পাঠিয়েছি...”

বাড়ির নেমন্তন্নে অবশ্য তীর্থপতিকে আনা যায়নি। পরের সপ্তায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমি কলেজে জয়েন করতে সবাই হৈ হৈ করে উঠল, ‘বেঁচে ফিরেছে, বেঁচে ফিরেছে। ঐ তো আসছে...। একটা মস্ত পার্টি দে, বিবি...।’

আমি খুঁজছিলুম তীর্থকে। বিকেলের আগে তার মুখোমুখি হওয়া গেলনা, কারণ আমাকে দূর থেকে দেখেই সে পালাচ্ছে, ক্লাসও করেনি। বিকেলে শুনি ক্যান্টিনের কোণের টেবিলে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে তীর্থপতি, সামনে তার দুই শ্রোতা। আমাকে ঢুকতে দেখেই পালাতে যাচ্ছিল তীর্থ। আমি এক্কেবার হাতেনাতে ধরি ওকে। মুখের দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলো। হাত চেপে ধরে কী বলব ওকে, মাত্তর একটা ‘থ্যাঙ্ক ইয়ু’? ব্যাস্‌? বড্ড খেলো হয়ে যাবে বলে চুপ করে রইলুম। হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালালো সে। পরের দিন ক্যান্টিনবয় প্রমোদ একটা খাতার-পাতা-ছেঁড়া-চিঠি দিলো আমার হাতে, তাতে দু’টো লাইন, “তোমার নাকটা এখনও ফুলে আছে, ওষুধ লাগিয়ো। সরি, সেদিন জলে তোমায় ওইভাবে অবশ না করে দিলে বাঁচানো যেতো না।” কোনো নাম নেই। এর অনেকদিন পরে নমিতা আমায় একদিন বলেছিলো, “বিবি, জানিস্‌, তীর্থর খাতার পাতায় পাতায় কেবল তোর ছবি আঁকা। চিবুকের তিলটি ঠিক আছে। এই দ্যাখ্‌, খাতাটা পেছনের ডেস্কের তলায় কুড়িয়ে পেয়েছি।”

|| ৩ ||


এবার এই আমাদের বদ্রিকাশ্রমে বেড়াতে আসাটা অনেকটাই মেয়েজামাইয়ের, তার চেয়েও বেশি, নতুন বেয়াই-বেয়ানের আগ্রহাতিশয্যে। বালানন্দ ব্রহ্মচারী আশ্রমের সঙ্গে ওঁদের বিশেষ যোগ আছে। থাকা, পুজো দেওয়ার কোনো অসুবিধেই হবে না। তাই চলুন। তো চলুন।

হরিদ্বার থেকে বারো ঘন্টার সুমো-জার্নি করে সন্ধে সাতটা নাগাদ পৌঁছে আমি তো কাহিল। এতো হাইটে উঠে অক্সিজেনেরও অভাব বোধ হয়। তার ওপর এই শেষ-মে মাসের সন্ধ্যায় ঠাণ্ডার ঠকঠকানিও কম নয়। তবুও স্থানমাহাত্ম্য আছে বলতে হবে। এখানে এসে থেকে এক তূরীয়ভাব বোধ করছি মনে। তাই হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশট্রেশ হওয়ার পর বেয়ানদিদি যখন এসে বললেন, “ঐ তো মন্দির দেখা যাচ্ছে। এতো কাছে এসেও একবার দোরে মাথাটা ঠেকিয়ে আসবেন না? পুজো দেওয়া না হয় কাল হবে। এখন তো চলুন একবার," তখন সদলবলে বেরিয়ে না পড়ে আর উপায় ছিল না।

বদ্রিনাথ মন্দিরের সামনে দোকানপাট বহু। আর চারিদিকে ভিখারি-সন্ন্যাসীদের ভিড়, প্রায় আঁচল ধরে টানাটানি, “মা, জরা ভোজন করা দো। রাত হো গয়া। দীন ভুখা হৈ।”

এই চলটা হরিদ্বারেও দেখে এসেছি। সন্ধে হতে-না-হতেই ভোজনশালার চারপাশে অভুক্ত একাহারী সন্ন্যাসীদের ভিড়। তাঁদের দিনান্তের আহার করিয়ে দেওয়াটাকে পুণ্য মানা হয়। অনেক দোকানীও লোক ডাকে, ‘আও সাব, আও। সাধুজনোঁকো ভোজন করা দো। শিবজী কা আশীর্বাদ মিলেগা’। আমার কত্তাটি অবশ্য বলেন, এসব দোকানিদের ব্যবসা বাড়ানোর ছল।

যাহোক্‌, আমার বেয়ানের অবশ্য এসবে খুব মতি। তীর্থক্ষেত্রে এসে প্রতি সন্ধ্যায় পাঁচজন সাধুকে তাঁর ভোজন করানো চাই-ই। দেখাদেখি মেয়েও আমায় বলে, “মা, তুমিও একজনকে খাইয়ে দাও না রাতে। এই ঠাণ্ডায় এই উঁচুতে বেচারিরা অভুক্ত থাকবে...”

বলতে বলতে এক গেরুয়াধারী যাচ্ঞে, “দীন ভুখা হৈ। আজ ভোজন করা দো...”

“বসো, মানে।, বসুন আপনি,” আমার বলা শেষ হতে না হতেই সন্ন্যাসীটি সামনের ভোজনশালে পাত পেড়ে বসে গেছে, এবং দোকানি ‘দুঁ?’ জিজ্ঞাসা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে।

দাও।

এবার পরম আগ্রহে গপ্‌গপ্‌ করে পুরী-সব্জি খেতে থাকে একাহারী সন্ন্যাসীটি। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলুম। ওঁরা সকলে ধর্মশালায় ফেরার তাড়া করছিলেন। আমার কিন্তু একজনকে খেতে বসিয়ে দোকানিকে টাকা দিয়ে দিয়ে চলে যাওয়াটা বড় অশালীনতা বলে মনে হল। তাই ‘আপনারা ফিরুন, আমি আসছি’ বলে সাগ্রহ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকি তাঁর পরম তৃপ্তির ভিক্ষান্নগ্রহণ। ভাবি, উনি বা ওঁরা কি সারা বছর এইভাবেই কাটান? ভিক্ষান্নে? যেদিন পান সেদিন খান, যেদিন পাননা সেদিন উপবাস? চলে এতে? অসুস্থ হয়ে পড়েন না? এতো উঁচু হাইটে হেঁটেই ওঠেন-নামেন? গাড়িতে আসতে আসতেও তো দেখলুম কত গেরুয়াধারী পদব্রজে পুণ্যক্ষেত্রে উঠছেন-নামছেন, একেলা বা দলে দলে। এনারা অসুস্থ হয়ে পড়লে কে দেখে? এঁরা সকলেই অসহায়, ভিক্ষু? নাকি কেউ কেউ স্বেচ্ছায়ও এই জীবন বেছে নিয়েছেন?

মিনিট দশেক কেটেছে। দোকানিকে টাকা দিয়ে বেরিয়ে আসছি, সাধুটিও হাতটাত ধুয়ে “মাঈ কী জয় হো” বলতে বলতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দাড়িগোঁফের ফাঁকে তার ফিক্‌করা হাসিটি দেখে বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার মাথায়। “তীর্থ! তীর্থপতি!!” আমার উচ্চৈঃস্বরে আশপাশের লোকজন ঘুরে তাকিয়েছিল, রেয়াৎ করিনি। খপ্‌করে চেপে ধরেছি ওর হাতটা।

একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করল না। তারপর সারামুখে তেমনি হাসি ছড়িয়ে বলল, “বিবি! অনিন্দিতা!!”

আমার চোখে জল এসে গেছে। বলি, “তীর্থ, এ কী রূপ তোর? তুই সন্ন্যাসী হয়েছিস? গেরুয়া বাস তোর? কোন্‌ দুঃখে ভিক্ষা করে খাস তুই?” এবার আরও প্রশস্ত হল তীর্থপতির হাস্য। বলল, “তুমি কেমন আছো, অনিন্দিতা?”

বাল্যবন্ধুকে তিনদশক পরে এইভাবে এইরূপে দেখতে পাওয়ার আকস্মিকতাটা তখনও আমার কাটেনি। অনেক কিছু জিজ্ঞাস্য আছে যে আমার, শুধোই, “কেন তুই ভিক্ষাবৃত্তি নিয়েছিস, বল্‌। কী তোর দুঃখ?”

এবার আলগাভাবে হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে বলল তীর্থপতি, “কার সঙ্গে এসেছো তুমি, অনিন্দিতা? তোমার ছেলেমেয়েরা? কর্তা কোথায়?”

“তুই কথা ঘোরাসনে, তীর্থ। ঘরে থাকলে কী তোর দু’বেলা দু’মুঠো জুটতো না? এইভাবে বেঁচে থাকা...যেদিন ভিক্ষা জুটলো খেলি, অন্যথা...”

“শান্ত হও, শান্ত হও, অনিন্দিতা। আমার কোনো দুঃখ নেই। বৃথা তুমি আক্ষেপ করছ। আমি মহা সুখে আছি।”

“একে সুখে থাকা বলে? এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় একটা এই পাতলা চাদর। কোনোদিন অনাহারে কোনোদিন অর্ধাহারে...”

“সুখ তাহলে মাত্র পেট ভরে খাওয়াতেই আছে, বল?” স্মিত হেসে তীর্থ বলল, “গঙ্গোত্রী-গোমুখ পেরিয়ে তিনদিনের হাঁটা পথ। সেখানে আছে তপোবন। তার সৌন্দর্য দেখলে তোমারও মনে হবে সেখানেই থেকে যাই। আর এই বদ্রিনাথের পথেই ডাইনে পড়ে হেমকুণ্ড সাহেব। তার পাশে ফুলবন। কী যে সেই অপরূপ রাজ্য, বিবি, অনাহারের ক্লেশ ভুলে যেতে হয়।”

“তাহলে তুই নৈসর্গিক দৃশ্য দেখেই পেট ভরাচ্ছিস, বলতে চাস্‌? একটা অসুখ-বিসুখ করে গেলে...চল্‌ তুই, তীর্থ, আমার সঙ্গে ঘরে ফিরে চল্‌...”

“করেছিল, গত বছর বড্ড ভুগেছিলুম। একদল সাধুভাইয়ের সেবাযত্নে বেঁচে ফিরি। বেরিয়ে পড়লুম ফের গোমুখের উদ্দেশে। হ্যাঁ, গত সাত-আট বছর আমি এই চারধামের পথে পথেই রয়েছি। রয়েছি বড্ড আনন্দে রে।” পরম তৃপ্তিতে বলে তীর্থপতি।

আমার চোখ আবার জলে ভরে ওঠে। এই সেই আমাদের কলেজের বন্ধু তীর্থপতি দাশ, যার করা থীম-গেট দেখে রাজ্যপাল মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাঁশি বাজাতো, ছবি আঁকতো—সেই তীর্থ!

অশ্রু মুছে বলি, “তুই তো আমাদের বড্ড দোষী করে দিলি রে, তীর্থ।”

“দোষী? কেন? কী করেছি আমি?”

“এই কেমন আমরা খাচ্ছিদাচ্ছি ঘরসংসার করছি। আর তুই ভিক্ষান্নে রয়েছিস পথে পথে।”

“আয়, বিবি, এ’দিকটায় আয় ফাঁকায়। ঊর্ধে দেখ্‌ ঐ কেমন চাঁদ উঠেছে। আজ বুদ্ধপূর্ণিমা। বহুকাল পূর্বে পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ মহামানব আজকের দিনে জন্ম নিয়েছিলেন এই হিমালয়ের পায়ের তলায়। রাজপাট ছেড়ে পথে পথে...ঐ ঐ দেখ্‌, বিবি, ঐ হল নীলকন্ঠ আর ঐ নারায়ণ শৃঙ্গ। কোমল জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে পুরো হিমালয়। তাকিয়ে দেখ্‌, তাকিয়ে দেখ্‌...কোনো দুঃখ কোনো তাপ কোথাও আছে এতোটুকুও?...” গেয়ে ওঠে তীর্থপতিঃ
“গানে গানে তব বন্ধন যাক্‌ টুটে
রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জেগে উঠে
....................................
........................................
ছন্দ তোমার ভেঙে গিয়ে দ্বন্দ্ব বাধায় প্রাণে
অন্তরে আর বাহিরে তাই তান মেলে না তানে...”

কোনো যন্ত্রানুসঙ্গ তো নেই, উদার চন্দ্রালোকে খোলা গলায় গাইছে তীর্থপতি; তবু আমার কানে কোথা হতে যেন শত মৃদঙ্গ-মন্দিরা বেজে উঠছে। কণ্ঠের উদ্গত অশ্রু ছাপিয়ে আমিও গলা মেলাই তার সঙ্গেঃ
“সুর হারা প্রাণ বিষম বাধা---, সেই তো আঁধি সেই তো ধাঁধা---
গান-ভোলা তুই গান ফিরে নে, যাক্‌সে আপদ ছুটে।”

আবার ফিরে ধরে তীর্থঃ
“বিশ্বকবির চিত্তমাঝে ভুবনবীণা যেথায় বাজে
জীবন তোমার সুরের ধারায় পড়ুক সেথায় লুটে”

ফিরে ফিরে গাই আমরা সেই কঠোর শীতের রাতে হিমালয়ের পায়ের তলার মহাতীর্থে দাঁড়িয়ে। প্রবল হিম হাওয়া কখন অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে গেছে। যেন কোন্‌মায়ামন্ত্রবলে সেই হিমপর্বতের পদে রেণু রেণু হয়ে মিশে গেছি--- যেখানে কোনো দুঃখ নেই, নেই কোনো বাধা সেই পরমে লীন হতে।

বাস্তবে ফিরে চোখ খুলে দেখি সামনের উত্তুঙ্গ নীলকণ্ঠ শৃঙ্গ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। হিমেল হাওয়ায় অদ্ভুত প্রশান্তি।

আর তীর্থ কখন চলে গেছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, নেই, কোথাও নেই তীর্থপতি। একবার ইচ্ছে হল প্রাণপণে চীৎকার করে ডাকিঃ “তীর্থ! তীর্থ!! তীর্থপতি!!!” পরমুহূর্তে ভাবি, ডেকে কী হবে? তীর্থ তো আছে, ছড়িয়ে আছে এখানে। এ-ই তো তীর্থ। তীর্থেই তো রয়েছি আমি।

শুধু কেবল গান ভেসে বেড়ায় এ’হিমশৃঙ্গ থেকে ও’শৃঙ্গেঃ
“গানে গানে তব বন্ধন যাক্‌ টুটে
রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জেগে উঠে.....”



(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)