দিনটা আরম্ভ হয়েছিল ভালোভাবেই। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ অনন্ত যথারীতি রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে কাজে যাচ্ছে। বাইরে একটা ভারি চমৎকার সকাল। বসন্ত আসব-আসব করছে। আকাশ হালকা নীল। রাস্তার দু-ধারে মস্ত-মস্ত ম্যাগ্নোলিয়া গাছগুলো সাদা আর গোলাপী রঙের বড়-বড় ফুলে ভর্তি। চেরী গাছেও ফুল আসব-আসব করছে। আর গাছগুলোর তলায় সার-সার ফরসিথিয়া ঝোপ উজ্জ্বল হলুদ ফুলে একেবারে মাখামাখি। অনন্ত ঠাণ্ডার শাসন উপেক্ষা করে গাড়ির কাচ নামিয়ে ম্যাগ্নোলিয়ার সুগন্ধ-মাখা হাওয়া প্রাণভরে নাকে টেনে নিল। মন ভরে উঠল খুশিতে। হঠাৎ দেখে রাস্তার ধারে কচি ঘাসের সবুজ লনে দুটো রবিন ঘাস থেকে পোকা খুঁটে খেতে ব্যস্ত। এদের দেখতে দেশের শালিক পাখির মত, খালি পেটটা একটু মোটা। সঙ্গে-সঙ্গে তার মনে পড়ে গেল সেই কবে ছেলেবেলায় শোনা — ওয়ান ফর সরো, টু ফর জয়। ছোটবেলায় একটা নিঃসঙ্গ শালিক দেখতে পেলেই ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেলত সে, কে জানে কোন দুঃখ কোথা থেকে উড়ে আসে যদি। অন্যদিকে একসাথে একজোড়া শালিক দেখলেই মনটা খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠত — টু ফর জয়! সেই ছেলেভুলনো ছড়ার আরো একটু রেশ ছিল - থ্রী ফর লেটার, ফোর ফয় টয়। তার মতো ছোট ছেলেকে কে আবার চিঠি পাঠাবে! আর চারটে শালিক দেখতে পেয়েছে বটে, কিন্তু কেউ তার জন্য খেলনা দিয়েছে বলে মনে পড়ে না।
আজও দুই রবিন দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। কিন্তু শীগগিরই সে মনে-মনে হেসে উঠল নিজের ছেলেমানুষিতে। এসব কুসংস্কারের কোন মানে হয়? — মানুষের ভালো-মন্দর সাথে শালিক বা অন্য কোন পাখির কি সম্পর্ক! কিন্তু সে যে এখনো সেই ছেলেবেলার কুসংস্কার মনে রেখেছে, এমন কি তাতে তার মন খুশি হয়ে উঠেছে এই ভেবেই তার মন যেন প্রস্তরীভূত হয়ে গেল। সে এসব কী ভাবছে! এ ধরনের কুসংস্কারের আভাষও তার যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান-শিক্ষিত মনের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত। এ সব ভাবতে-ভাবতে সে বস্টনে তার অফিসের পার্কিং গ্যারাজে পৌঁছে গেছে, কিন্তু মনের মধ্যে 'ওয়ান ফর সরো, টু ফর জয়' বেজে চলেছে যেন পুরোনো দিনের একটা ক্যাসেট প্লেয়ার - যার 'অটো রিভার্স' বাটনটা চেপে রাখা আছে, ফলে একই গানের সুর বারবার ঘুরে-ফিরে আসছে। শেষ পর্যন্ত তার মনের মধ্যে জমে থাকা সংস্কারেরই জয় হল - ঠিক আছে, দুটো রবিনই সে দেখেছে, তাই তার দিনটা ভাল যাবে। সে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল - মনের দ্বন্দ্বের আপাতত ছুটি।
আশি দশকের মাঝামাঝি অনন্ত দাস ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান থেকে পি.এইচ.ডি ও এম.আই.টি-তে পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনিং শেষ করে বস্টনে নিউ ইংল্যাণ্ড ইউনিভার্সিটির বায়োলজী ডিপার্টমেন্টে জুনিয়ার ফ্যাকালটি হিসাবে যোগ দেয়। তারপর পড়ানো, নিজের ল্যাবরেটরির জন্য রিসার্চের টাকা জোগাড় করা, আণ্ডারগ্রাজুয়েট, গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট থেকে পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনী ও জুনিয়ার ফ্যাকালটিদের রিসার্চের কাজ শেখাতে-শেখাতেই জীবনের পনেরোটা বছর কেটে গেছে। সে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর থেকে ফুল প্রফেসর হয়েছে, কিন্তু কাজ-কর্মের ধারা একটুকুও পালটায়নি। তাই, আজ অফিসে গিয়ে একটু হাত-পা ছড়িয়ে বসতে বসতেই তার ল্যাবে রিসার্চের কাজ করে এমন পোস্টডক, স্টুডেন্ট, টেকনিসিয়ানরা এক এক করে এসে দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। অনন্তর প্রতিদিনের কাজ হল প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা করে বসে কথা বলা — তারা কোনো নতুন তথ্য পেল কি না, এর পরের কাজ কি, ইত্যাদি। অনন্তর হাতে থাকে দুধ-চিনি ছাড়া কালো কফি-ভরা মস্ত একটা কাপ - তার গায়ে আঁকা একটা কার্টুন - কয়েকটা ইঁদুর পায়ে জুতো পরে প্রাণপনে দৌড়চ্ছে — তলায় লেখা — ওয়েলকাম ট্যু দ্য র্যাট রেস! সপ্তাহে ছ-দিন এইরকম চলে, রবিবার ছুটি।
প্রতিদিন সকালের এই মিটিংগুলো অনন্তর খুবই প্রিয়। আসলে তার কাছে রিসার্চ করা অনেকটা যেন একটা মস্ত বড় ম্যুরাল আঁকার মত। একটা খালি ক্যানভাসে শুরু হয়, পেনসিলের আঁকার ওপর চাপতে থাকে নানান থীম, নানা রঙ। আস্তে আস্তে ক্যানভাসটা ভরে ওঠে। এখানেও একটা আইডিয়া নিয়ে শুরু, তারপর নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন-নতুন তথ্য দিয়ে প্রথম দিকের ফাঁকা-ফাঁকা, আলো-আঁধারি ধারণাগুলো ভরে উঠতে থাকে। এই দুয়ের পিছনেই একই গ্রাণ্ড লজিক কাজ করে। আর এর মধ্য দিয়েই নতুন আইডিয়া, নতুন আবিষ্কার বেরিয়ে আসে।
আজ সবাইয়ের সাথে কে কী করবে সে ব্যাপারে কথা হল, খালি তার ইণ্ডিয়ান পোস্টডক্টরাল ট্রেনী ডাঃ কুমারস্বামী বাদে। কে বলল যে সে ডেস্কে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। সে জাগাতে সাহস করে নি। অনন্তের মনটা আজ বেশ খুশি - সব রিসার্চ প্রজেক্টের কাজই বেশ ভালোভাবে এগোচ্ছে। বিশেষ করে একটা প্রজেক্ট এতদিন আদৌ এগোচ্ছিল না - সেটা হঠাৎ রেসের ঘোড়ার মত এগিয়ে চলেছে। অবশ্য সেটা আপনা-আপনি কিছু হয় নি। যোগ্য ঘোড়সওয়ারের হাতে লাগাম তুলে দিতে হয়েছে। এতদিন কাজটা একটা গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট দেখছিল। সেটা তার হাত থেকে তুলে নিয়ে কুমারস্বামীর হাতে তুলে দিতেই পালে হাওয়া লেগেছে। তরী তর্-তর্ করে এগোচ্ছে - অর্থাৎ যে তথ্যের জন্য ও এতদিন অপেক্ষা করে ছিল কুমারস্বামীর হাতের ছোঁয়ায় তা যেন ম্যাজিকের মত সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
খুব খুশি-খুশি মনে অনন্ত ফোন তুলে কুমারস্বামীকে অভিনন্দন জানাতে যাবে হঠাৎ মার্লা নামের নতুন গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট মেয়েটা প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে ঘরে ঢুকল। তার মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট —
'ডাঃ ড্যাস। ইয়্যু মাস্ট কাম অ্যাট ওয়ানস।'
মার্লার হাব-ভাব দেখে অনন্ত চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠে মার্লার সাথে ছুটতে আরম্ভ করল। অনন্তর অফিস একটা লম্বা করিডোরের এক প্রান্তে, আর তার ল্যাবরেটরি অন্য প্রান্তে। কি হতে পারে — আগুন, বিস্ফোরণ, অ্যাক্সিডেন্টাল পয়সনিং? ল্যাবেতে এ সবের সম্ভাবনা সব সময়ই থাকে। তাহলে 'টু ফর জয়' ব্যাপারটা কুসংস্কার ছাড়া সত্যিই কিছু নয়! আর এই নিয়েই সে সব যুক্তি ভুলে মনের আনন্দে ছিল! নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করল অনন্তর।
ছুটতে ছুটতে ল্যাবের দরজার কাছে পৌঁছে অনন্ত দেখে সবই স্বাভাবিক - কোথাও গণ্ডগোলের কোন চিহ্ন নেই। অনন্তের মনের মধ্য থেকে যেন একটা ভারী পাথর নেমে গেল। কিন্তু দরজা দিয়ে একটু ভিতরে ঢুকতেই দেখে যে কুমারস্বামী মাটিতে চিৎপাত হয়ে শুয়ে রয়েছে — একেবারে নিষ্কম্প-নিঃসাড়। তার পাশে ড্যানিয়েল নামের নতুন আণ্ডারগ্রাজুয়েট ছেলেটা দাঁড়িয়ে।
"কি হয়েছে?" অনন্তর ভয়ার্ত প্রশ্ন।
ড্যানিয়েল বলল —
"আমাদের সকালের মিটিঙের পর ডাঃ কুমারস্বামী আর আমি ল্যাবে ছিলাম। মার্লা ও কেলী কোথায় গিয়েছিল। আমি একা নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছি হঠাৎ একটা অদ্ভুত খস-খসানির আওয়াজ শুনে মাথা তুলে দেখি ডাঃ কুমারস্বামী আস্তে আস্তে মাটিতে শুয়ে পড়ছে। আমার ডাকাডাকিতে কোনো সাড়া না দিয়ে সে মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে মার্লা ফিরে এসেছে। আমি তাকে তক্ষুনি আপনার কাছে পাঠিয়েছি।"
"কেউ কি ৯-১-১ ফোন করেছে?" — অনন্তর উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।
"হ্যাঁ, আমি করেছি। তারা এক্ষুনি এসে পড়ল বলে।" - মার্লার কথায় আশ্বস্ত হল অনন্ত।
ইতিমধ্যে পাশের ল্যাব থেকেও কিছু লোক এসে জড়ো হয়েছে। কিন্তু এত হৈ-চৈ এর মধ্যেও কুমারস্বামী মাটিতে শুয়ে আছে নির্বিকারে। তার একটা হাত ভাঁজ করে মাথার তলায় রাখা — বালিশের কাজ করছে, আর অন্য হাতটা ভাঁজ করে দু-চোখের ওপরে ঢাকা দেওয়া যাতে বাইরের আলো চোখে না এসে লাগে। তার সাদা ল্যাব-কোটের বুক পকেটে দুটো পেন সযত্নে লাগানো আছে। তাদের ক্লিপগুলো আলো লেগে ঝিকমিক করছে। একটা পেন আর একটা রুলটানা খাতা পাশের ডেস্কে শুয়ে সবায়ের দিকে নিরীহভাবে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কুমারস্বামী নিজের ডেস্কে বসে কিছু লিখছিল। হঠাৎ ঘুমে তার দু-চোখ জুড়িয়ে আসে। আর, সেই ঘুমের প্রচণ্ড তোড় সামলাতে না পেরে ল্যাবের মাটিতেই সে মাথার তলায় হাত রেখে আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে। ল্যাবেতে এরকম ঘটনা একেবারে অচিন্তনীয়!
ড্যানিয়েল মাটিতে উবু হয়ে বসে কুমারস্বামীর নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে ঘোষণা করল যে কুমারস্বামীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকই আছে। ইতিমধ্যে বাইরে রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স আর দমকলের আওয়াজ শোনা গেল, আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথায় হলুদ টুপি আর গায়ে ফায়ারম্যানের জ্যাকেটপরা কয়েকজন লোক দৌড়তে-দৌড়তে ল্যাবের মধ্যে ঢুকে দ্রুত কুমারস্বামীর ভাইটাল সাইন নিয়ে একটা স্ট্রেচারে করে তাকে তুলে নিয়ে চলে গেল।
অনন্ত আস্তে আস্তে কুমারস্বামীর ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিছু বই পরিষ্কার করে র্যাকে সাজানো। খাতা, নোটপ্যাড ডেস্কের একপাশে। কতগুলো পেন-পেনসিল সুন্দর করে একটা কাপের মধ্যে গোছানো, পাশেই হুক থেকে একটা ধবধবে সাদা ল্যাবকোট ঝুলছে। কুমারস্বামীর হাতের কাজও ওর এই ডেস্কের মত - সাজানো-গোছানো, আবার বুদ্ধিরও কোন অভাব নেই। যদিও কুমারস্বামীকে পোস্টডক ট্রেনি হিসাবে তার ল্যাবে কাজ দিয়ে অনন্ত বেশ কিছুটা ঝুঁকিই নিয়েছিল। প্রথমত কুমারস্বামীর অ্যাকাডেমিক রেকর্ড সে রকম বিরাট কিছু নয়। বস্টনে অনন্তের ল্যাবে আসার আগে কুমারস্বামী ডিউক ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডকের কাজ করত। তার আগের বসের রেকমেণ্ডেশন চিঠিটা এখনো অনন্তর পরিষ্কার মনে আছে — 'হি ইজ আ র্যাদার ডিফিকাল্ট পার্সন ট্যু হ্যাভ ইন দ্য ল্যাব, বিকস হি ডাজ নট গো অ্যালং উইথ হিজ কলীগস ওয়েল।' তখন প্রয়োজনমতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই বেশ কিছুটা মরিয়া হয়েই কুমারস্বামীকে ফেলোশিপটা দিয়েছিল অনন্ত।
যা আশঙ্কা করা গেছিল তা প্রায় একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় মিলে গেল। অনন্তর ল্যাবে কারোর সাথে কুমারস্বামীর বনিবনা হয় না। প্রথমতঃ প্রায় ছ-ফুট লম্বা চেহারা, তার ওপর একরোখা, সবায়ের সাথে ঝেঁকে কথা বলে - সুতরাং অনন্তের ল্যাবে প্রায় ছোটখাটো বিদ্রোহ দেখা দেওয়ার অবস্থা। জেরার্ড নামের ফরাসী গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট কুমারস্বামীর সম্বন্ধে অভিযোগ করল - সে ভীষণ 'বসী'। জিম নামের আর একজন গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট বলেই দিল যে কাজের ব্যাপারে সে কুমারস্বামীর সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না। কিন্তু দু-জনেই স্বীকার করল যে কাজের ব্যাপারে কুমারস্বামীর হাত একেবারে যাদুকরের মত। অনন্তর ল্যাবের মেয়েদের ব্যাপারটা বেশ একটু অন্যরকম। কিছুদিনের মধ্যেই মার্লা একেবারে কুমারস্বামীর বশংবদ হয়ে পড়ে। অ্যান নামের একজন পোস্টডক অনন্তর ল্যাবে কয়েকমাস এসেছিল কিছু টেকনিক শিখতে। সে শীগগিরই কুমারস্বামীর হাতের ম্যাজিকের খোঁজ পেয়ে গিয়ে চুপচাপ তার অত্যাচার সহ্য করে নিল। খালি নেদিন নামের অন্য এক পোস্টডক কুমারস্বামীর বশ মানে নি। তার ফলে সে অনন্তর কাছে নিয়মিত কুমারস্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে চলেছে। অনন্তকে চুপ করে এ সব শুনতে হয় - কারণ কুমারস্বামীকে ছাড়া তার ল্যাব চালানো মুশকিল।
কুমারস্বামীর কি অসুখ করেছে, কবে সারবে, তাকে ছাড়া ল্যাবের কাজ চলবে কী করে — এইসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে অনন্ত তার অফিসে গিয়ে চেয়ারে বসার ঘন্টাখানেকের মধ্যে টেলিফোন বেজে উঠল। কাছেরই এক হাসপাতালের এমার্জেন্সি থেকে ফোন - সেখানে কুমারস্বামীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে এখনো অচৈতন্য কিন্তু অবস্থাটা সামলে উঠেছে। তারা ইউনিভার্সিটির সাথে যোগাযোগ করে কুমারস্বামীর চাকরিদাতা হিসাবে অনন্তর নাম পেয়েছে। তা ছাড়া তার কাগজপত্রে নাকি এ দেশে 'নেকস্ট অফ কিন' বলতে তার নামই আছে। তাই অনন্তকে ফোন। তারা জানাল যে আশা করা যায় যে আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে ওর অসুখের ডায়গনোসিস হয়ে যাবে।
দেখতে-দেখতে বছর চার হতে চলল কুমারস্বামী অনন্তের কাছে কাজ করছে। আর এই চার বছরে অনন্ত আর কুমারস্বামীর মধ্যে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতাও যথেষ্ট বেড়েছে। কুমারস্বামী ব্যাঙ্গালোরের এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে, ভাই-বোন কেউ নেই। দেশেই তার পড়াশুনো ও ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া। এর পর পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনিং নিতে আমেরিকা আসার ব্যাপারে ওর বাবা-মার যথেষ্ট আপত্তি ছিল - 'অনেক পড়াশুনো হয়েছে - এবার একটা ভাল চাকরি জোগাড় করে, একটা বিয়ে করে ঘর-সংসার করো। না, অ্যামেরিকায় গিয়ে আরো বিদ্যে বাড়ানো!' কুমারস্বামী অনন্তকে ওর মা-বাবার আপত্তির কথা, তাকে বিয়ে করা নিয়ে জোরাজুরির কথা বলেছে। 'তা বিয়ে করলেই পারো' — অনন্তের উক্তি। তাতে কুমারস্বামীর উত্তর - 'তা সম্ভব নয়।' কেন সম্ভব নয় তার কোন সঠিক উত্তর সে দেয়নি। তার কি কোন শারীরিক অসুবিধে আছে? এতটা ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞাসা করা যায় না। এমনিতে সুস্থ মনে হলেও কুমারস্বামী মাঝে-মাঝে সপ্তাহ-খানেক হাওয়া হয়ে যায়। এটা শুরু হয় মাথা ব্যথা দিয়ে - তখন অনন্ত দেখেছে তাকে ডেস্কে চুপ করে মাথা নিচু করে ঘুমোতে। তারপর কয়েকদিন ল্যাবে আসা বন্ধ। তারপর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আবার সব ঠিক। কেন এমন হয়, কি করলে ভাল হয় — এ ব্যাপারে অনন্তর প্রশ্নের কোন জবাব সে দেয় নি।
কয়েক ঘন্টা পর কুমারস্বামীকে দেখতে অনন্ত সেই হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে হাজির। কুমারস্বামী তখন একটা ধবধবে সাদা চাদর গায়ে চাপা দিয়ে চোখ বুজিয়ে অচৈতন্য হয়ে খাটে শুয়ে আছে। চারদিকের দেয়াল-মেঝে সমস্ত কিছু একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। কোথাও কোন ধুলো-ময়লা নেই। এই অতিরিক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অনন্তের মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ভয় ঢুকিয়ে দেয়। এটা যেন পৃথিবীর বাইরে কোন জগৎ। আর এর বাইরে বেরোলেই বাস্তব জগতের যত ক্লেদ, যত জীবাণু যেন একসাথে এসে আক্রমণ করবে। একটা চেয়ারে বসল অনন্ত, আর তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল নানান চিন্তা - এতক্ষণ অচৈতন্য কেন! এর মধ্যে কী ডায়াগনোসীস হয়ে গেছে? সত্যিই যদি সিরিয়াস কিছু হয়, তাহলে তার ল্যাবে রিসার্চের কাজ আপাতত শিকেয় উঠবে। এই কথা ভেবে তার গা শিউরে উঠল। হঠাৎই প্রায় অস্ফুটভাবে তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল — 'ভগবান, ওর যেন কিছু না হয়।'
ভগবান! সে তো ঈশ্বরবিশ্বাসী নয়! এখন কি বিপদে পড়ে ঈশ্বরের কথা মনে পড়ছে! এ ব্যাপারে তো তাহলে যাদের এতদিন অশিক্ষিত - অর্বাচীন বলে মনে করেছে - তাদের থেকে তো তার কোন তফাত নেই! সকালে — ওয়ান ফর সরো, টু ফর জয়, আর সন্ধেতে বিপদের আশঙ্কায় ভগবানের নাম! আসলে সে তাহলে একটা ফার্স্ট রেট হিপোক্রীট! সেই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসেও অনন্ত কুল-কুল করে ঘামতে আরম্ভ করল। কিছু দূরে কুমারস্বামী শুয়ে আছে চোখ বুজিয়ে - অচৈতন্য, আর তার সামনে বসে অনন্ত আত্মজিজ্ঞাসায় জর্জরিত। হঠাৎ মনে পড়ল - টু ফর জয়! ডুবে যেতে যেতে মানুষ যেমন কুটো আঁকড়ে ধরে, তেমনি অনন্ত নিজের মনকে সান্ত্বনা দিল - নাঃ, অসুখটা বোধহয় বিশেষ কিছু নয়।
এমন সময় দরজার পর্দা সরিয়ে অ্যাটেণ্ডিং নার্স আর সাদা ডাক্তারী কোটপরা এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। তার কোটের বুকপকেটে নীল সুতো দিয়ে নাম সেলাই করা - জন উইলসন, এম. ডি। নার্স ভদ্রমহিলা পরস্পরকে আলাপ করিয়ে দিলেন - 'ডাঃ উইলসন একজন অঙ্কোলজী স্পেসালিস্ট। আর ডাঃ ড্যাস এখানকার প্রফেসর ও সায়েন্টিস্ট। তাছাড়া উনি পেশেন্টের বস ও এদেশে নেক্সট ওফ কিন।'
অঙ্কোলজী? অঙ্কোলজী কেন? অনন্তর মনে বিদ্যুৎ চমকে উঠল।
ডাঃ উইলসন অনন্তর সাথে করমর্দন করার পর তাকে ঘরের এক পাশে টেনে নিয়ে গেলেন। তারপর গলাটা একেবারে নামিয়ে বললেন —
"এক্সরে করে ডাঃ কুমারস্বামীর ব্রেনের সামনের দিকে বেশ বড় একটা গ্রোথ পাওয়া গেছে।"
"ইয়্যু মীন ব্রেন ক্যানসার?" — অনন্ত চাপা গলায় প্রায় কঁকিয়ে উঠল।
"আমরা জানি না টিউমারটা ম্যালিগন্যান্ট না বিনাইন। বায়পসী করা হয়েছে। কালকের মধ্যে ফল জানা যাবে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার - এতবড় টিউমার মাথায় নিয়ে এই পেশেন্ট এতদিন বেঁচে আছে কি করে!"
"এর কি কোন আর্লি সাইন থাকে না?"
"থাকবে না কেন। প্রায়ই মাথা ধরা নিয়ে অনুযোগ করা। মাঝে মাঝে ব্ল্যাক-আউটও হতে পারে। আপনি কি সে রকম কিছু দেখেছেন?"
"আমি ডাঃ কুমারস্বামীকে চিনি প্রায় চার বছর। এর মধ্যে প্রতি মাসে মধ্যে অন্ততঃ একবার সে মাথা ব্যথা নিয়ে অভিযোগ করবেই করবে। মাইগ্রেনের জন্য নানান ওষুধ খায়, আর চুপ করে মাথা নিচু করে শুয়ে থাকে। তখন কোন কথাবার্তা, কোন আওয়াজ একেবারে সহ্য করতে পারে না। আমি ভেবেছি মাইগ্রেন হলে তো এরকমই হয়। তাই বিশেষ কিছু মনে করি নি। তবে এ রকম অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটা আমার দেখা এই প্রথম।"
অনন্ত মাথা তুলে দেখতে পেল কুমারস্বামী সেই একই রকম অচৈতন্য হয়ে সাদা চাদরে সব শরীর ঢেকে, খালি মুখটা বার করে শুয়ে আছে। সেই মুখে কোন ভাষা নেই।
ডাঃ উইলসন আরম্ভ করলেন —
"আপনি যা বললেন তাতে ব্রেন টিউমারের সমস্ত সীম্পটমই রয়েছে। টিউমার বাড়তে বাড়তে বেলুনের মত ফুলে উঠে ব্রেনের নানান নার্ভে চাপ দিতে আরম্ভ করে। তার ফলে মাথা ধরা থেকে ব্ল্যাক-আউট-এ সবই হয় - যেমন এ ক্ষেত্রে হয়েছে। অ্যাডভ্যান্সড কেসে চোখের দৃষ্টির গণ্ডগোল থেকে মানসিক ভারসাম্যের অভাব, এমন কি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারও হতে পারে। তবে এ কথা বলে রাখা ভাল যে সব ব্রেন টিউমার কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট নয়।"
অনন্ত চুপ করে শুনে যাচ্ছে। ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে হাসপাতালের সামনে সবুজ ঘাসের লনে একটা ম্যাগ্নোলিয়া গাছ হালকা গোলাপী ফুলে-ফুলে একেবারে হেসে উঠেছে। শহরে ইতিমধ্যে বসন্ত এসে গেছে পুরোদমে। কিন্তু এই ঘরের মধ্যে যা ঘটছে বাইরের প্রকৃতিতে তার কোন প্রতিফলনই নেই। ডাঃ উইলসন কিছুক্ষণ অপলকে সেই গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে আবার শুরু করলেন।
"টিউমারের সাইজ দেখে মনে হচ্ছে এ অনেক পুরোনো ব্যাপার। একটা ব্রেন স্ক্যান করলেই সেটা ধরা পড়ত। ডাঃ কুমারস্বামী নিজে বৈজ্ঞানিক হয়ে এ ব্যাপারে আদৌ কিছু জানতো না, তা মেনে নিতে কিন্তু বেশ কষ্ট হচ্ছে।"
"আমার মনে হয় কুমারস্বামী এ ব্যাপারে কিছুটা অন্ততঃ জানত। কারণ আমি যখনই তার মাথা ব্যথা নিয়ে কথা বলেছি, তখনই সে এড়িয়ে গেছে। এই অদ্ভুত ব্যবহারের আমি কোন কারণ খুঁজে পাই নি।"
"নানা কারণে রোগীদের মধ্যে বাস্তবকে এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা আকচারই ঘটে — কেউ মানতে চায় না তার কিছু হয়েছে, আবার কেউ অসুখের কথা জেনেও ভয়ে তার চিকিৎসা করায় না।"
"আমার তো আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে দ্বিতীয়টাই কুমারস্বামীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।"
"তা হয়তো ঠিক। কিন্তু এখন কি করা যায় সেটাই চিন্তার ব্যাপার। ওষুধে কিছু কাজ হবে না। সার্জারী করে টিউমার বার করে নেওয়া যায়। তাতে মাথা ধরা, ব্ল্যাক আউট কমবে, কিন্তু ইট ক্যান অলসো কজ ডেথ। আর তার জন্যই লাগবে পেশেন্টের পারমিশান। কিন্তু যেহেতু সে অচৈতন্য তার কোন নেক্সট-অফ-কিন বা প্রক্সীর অনুমোদন লাগবে।"
কুমারস্বামীর কোন আত্মীয়-স্বজনের কথা অনন্ত জানে না। আর তার কাছে চাকরী করে বলে অনন্তই সেই প্রক্সী! যেন হঠাৎ সেই বন্ধ ঘরের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দে একটা ঝড় বয়ে গেল। সামনে কুমারস্বামী অচৈতন্য হয়ে শুয়ে আছে। আর অনন্তকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কুমারস্বামীর মাথায় সার্জারী করা হবে কি না। সে মরবে না বাঁচবে! হী হ্যাজ টু প্লে গড!
আবার সেই ভগবান - যার অস্তিত্ব সে মানে না! অথচ এই বিপদের সময়ে যার নাম বার বার তার মাথায় ধাক্কা মারছে। কোথায় গেল তার বিজ্ঞান-শিক্ষিত, যুক্তিবাদী মন! একটা চেয়ারের ওপর বসে পড়তে পড়তে সে দেখতে পেল সেই নার্স আর ডাঃ উইলসন বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে।
অনন্তর মনে পড়ে গেল জীবন নিয়ে ভগবান সাজার ঘটনা তার আরো একবার ঘটেছিল। তখন সে খুব ছোট। পপি ছিল তাদের বাড়ির অনেকদিনের পোষা কুকুর। তার বয়স হয়েছিল অনেক। শেষের দিকে চোখে ভাল দেখতে পেত না, হাঁটতে কষ্ট হত, কিছু খেলে পেটে ধরে রাখতে পারত না। তাই ভেটেরিনারিয়ান ডাঃ বসাক উপদেশ দিয়েছিলেন পপিকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে — যা থেকে সে আর কোনদিন জেগে উঠবে না। বাড়ির অন্য সবায়ের অমত না থাকলেও অনন্ত ভীষণভাবে তার প্রতিবাদ করেছিল। আর তার স্বীকৃতির ওপরেই ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাকেও পপিকে ইউথেনাইজ করার স্বপক্ষে যেতে হয়েছিল। পপি ছিল অনন্তর খুব প্রিয়। তাই আজও পপির কথা মনে হলে সে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না। বাড়িতে ঠাকুমা অনেক বয়স হয়ে অশক্ত হলে কি তাকে চিরঘুমে পাঠিয়ে দিতে হয়! ভগবানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রশ্ন করার বয়স তার হয়নি। কিন্তু এটুকু বুঝতে পেরেছিল পপির ব্যাপারে তাকে ভগবান সাজতে হয়েছিল! কারণ কোন প্রাণীর জীবন দেওয়া বা নেওয়ার ক্ষমতা তো একমাত্র ভগবানেরই আছে!
মাথায় মস্ত টিউমার নিয়ে সামনে কুমারস্বামী শুয়ে আছে — নিশ্চল, নির্বাক। অনন্তর ব্রেন সার্জারীর ব্যাপারে 'হ্যাঁ' কি 'না' সিদ্ধান্তের ওপরে নির্ভর করবে কুমারস্বামী কোনদিন এই ঘুম থেকে জেগে উঠবে কি না! হঠাৎ অনন্তর মনে হল - আচ্ছা, সে কী সত্যিই সকালবেলা দুটো রবিন দেখেছিল? না কি ভুল দেখেছে? একটা রবিনকে দুটো ভেবে এতক্ষণ মনের আনন্দে ছিল। আসলে সেখানে ছিল একটা পাখি - ওয়ান ফর সরো, ওয়ান ফর সরো - বার বার তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। সামনে শুয়ে কুমারস্বামী — অজ্ঞান, অচৈতন্য।
(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)