ISSN 1563-8685




নির্বাচিত অসমীয়া কবিতা

মূল অসমীয়া থেকে অনুবাদ: অমিতাভ



কবি: সনন্ত তাঁতি (১৯৫২)

আমার প্রিয় বিষয় সম্পর্কিত

আমার প্রিয় বিষয় যদি জানতে চাও আমি বলবো চিন্তার আয়তনে আমার
ভাসমান দেহ
কবিতা তার মন্ত্রপুতঃ ফুল জীবন তার প্রকৃতি
যদি প্রিয় কথা জানতে চাও আমি বলবো জীবনের বিষয় জীবন
আমি বলবো সংগীতের কথা আমায় যুদ্ধে অনুরণিত করে জ্বালিয়ে দেয়
প্রতিবার আমার রক্তকে
আমাকে আলোড়িত করে দশ লক্ষবার

আমার প্রিয় বিষয় যদি জানতে চাও আমি বলবো লক্ষ আমার স্থির
মানুষের সাহসে
আমি পুঁতে রাখতে চাই মানুষের সমূহ যুদ্ধে আমার চোখ
প্রেম তার উতস মানুষ তার উৎস পৃথিবী নিসর্গ জীবন তার উৎস

যদি প্রিয় কথা জানতে চাও আমি বলবো প্রতিবারেই আলোড়িত করে যে ক্ষুধা
আর প্রতিবারেই আলোড়িত করে যে চিন্তা
আমি অন্ধকারে তারি প্রতীক্ষায় থাকি।


প্রসংগত বাবাকে নিয়ে

কবিতার সভায় কিংবা কোনো উজ্জ্বল মহোৎসবে
প্রসংগত যখন কথা ওঠে আমার বাবার
ছয় ঋতুর ভারতবর্ষ কেঁপে ওঠে বেয়নেটের স্পর্শে
উদ্‌ভ্রান্ত ক্ষুধার জ্বালায় কেঁপে ওঠে সমস্ত ভারতবর্ষ

প্রসংগত যখন কথা ওঠে আমার বাবার
প্রসংগত যখন তাঁর বিবেকের সঙ্গে আমার স্বাধীন সম্পর্কের
তাঁর রক্তের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার
তাঁর চোখের সঙ্গে আমার নির্বিকার প্রদক্ষিণের
তাঁর উড্ডীন এবং ভাসমান দুই চোখের ছুঁয়ে যাওয়া আমার সময়ের
ভারতবর্ষের নিসর্গে তখন উড়ে থাকে রঙীন চড়াইগুলি

কবিতার সভায় কিম্বা কোনো উজ্জ্বল মহোৎসবে
এমনি কোনো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডার সময় অকস্মাৎ
প্রসংগত যখন কথা ওঠে আমার বাবার
অকস্মাৎ যখন তাঁর প্রাত্যহিক স্বভাব সম্পর্কে কোনো কোনো
তরুণ কবি ফিরিয়ে আনে মৃত্যুপূর্বের সমস্ত ঘটনা
কোনো কোনো কবি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোনো কোনো বিষণ্ণ মুহূর্তেও

যদি থাকে সেখানে কোনো নারী সে নদী হয়
যদি থাকে সেখানে কোনো যুবতী সে নদী হয়
যদি থাকে সেখানে কোনো ফুল
সে নদীর মাঝে পড়ে থাকে

কবিতার সভায় কিম্বা কোনো উজ্জ্বল মহোৎসবে
প্রসংগত যখন কথা ওঠে আমার বাবার
ছয়টি ঋতুর ভারতবর্ষ কেঁপে ওঠে বেয়নেটের স্পর্শে
উদ্‌ভ্রান্ত ক্ষুধার জ্বালায় কেঁপে ওঠে সমস্ত ভারতবর্ষ

প্রসঙ্গত কোনো শ্রমিক সমাবেশে যখন আলোচনা হয় যুদ্ধের
আমি আমার বাবাকে ফিরে পাই
জ্ঞাতব্য বিষয়—
আমার বাবা ছিল চা বাগানের মজুর
আর ভারতবর্ষের নাগরিক।


কুশল বিনিময় করি কিম্বা বিনিময় করি যুদ্ধের কৌশল

কে কাকে স্বাধীন করতে পারে যদি বিপ্লব না হয় ভেতরে ভেতরে
শব্দই জানি আনতে পারে কেবল সংবাদ
যদি অন্ধ থাকে চোখ আর বধির থাকে কান
তাই এসো যুদ্ধ করি প্রতিদিন যুদ্ধ অনুভব করি
নিজের রক্ত থেকে উদ্ধার করি নিজস্ব রক্তের গান প্রতিদিন
আইন অমান্য করি পুড়িয়ে ফেলি শহর নগর উদ্যান

কে কাকে স্বাধীন করতে পারে যদি অজ্ঞাত থাকে উৎস অবিরত
প্রতিজ্ঞা পূরণ নাহলে স্বপ্নমাত্র দৃশ্যমান হয় স্বপ্নের ভিতরে
সেই বিশ্বাস আয়ত্ত্ব করি প্রতিদিন ছন্দ লয় গতির মধ্যে
দীঘল দূরত্ব ভেঙে অনায়াস রক্তের ভিতরে ভিতরে রক্তের ভিতরে ভিতরে

রক্তের ভিতরে ভিতরে কুশল বিনিময় করি কিম্বা
বিনিময় করি যুদ্ধকৌশল

কে কাকে স্বাধীন করতে পারে
যদি বিপ্লব না ঘটে ভিতরে ভিতরে।


কখনও নদী ক্লান্ত হলে

কখনও নদী ক্লান্ত হলে নদীর শব্দে কেঁদে উঠে নদী
রোদের প্রখরতায় রোদ পলির পর পলি হৃদয় ক্লান্ত হয়

কখনও নদী ক্লান্ত হলে নদীর ভালোলাগায় আমরা জেগে থাকি বহুরাত

ইতিহাসের পৃষ্ঠা খসে পড়ে নদীর জলে অকস্মাৎ

কখনও নদী ক্লান্ত হলে নদীর শব্দে ঘনায় রাত
সন্ধেবেলা বেজে ওঠে করুণ শোকের বাঁশি
নদী ক্লান্ত হলে অবসাদ
নদী ক্লান্ত হলে রক্তক্ষরণ
নদী ক্লান্ত হলে হাহাকার

কখনও নদী ক্লান্ত হলে নদীর মধ্যে নদী জেগে
                                                    থাকে বহুদিন
নদীর ভিতরে নদী পড়ে থাকে বহুদিন

তোমাকে আমার জন্মের পরেই বলেছিলাম
নদী মানে নারী প্রেম অথবা জননী নদী মানে নারী প্রেম অথবা
                                                               জননী

নদী মানে নারী প্রেম অথবা জননী।


নিজের ভিতরেই মানুষের সমুদ্র

শুনেছি নিজের ভিতরেই মানুষের সমুদ্র
আর মানুষ সমুদ্রে ডুব দেয়

সমুদ্রে ডুব দিয়ে তুলে আনা যায়
কাঞ্চন মুক্তোমালা

কখনও বা সমুদ্রে ডুবে মরে থাকে মানুষ
সমগ্র জীবন

শুনেছি নিজের ভিতরেই মানুষের সমুদ্র আর
সমুদ্রের শব্দে মানুষের স্মৃতি
একদিন খুব দ্রুত
বেড়ে ওঠে

সমুদ্র মানুষ একদিন খুব কাছাকাছি এলে
সন্ধিপত্র
বাতাসে উড়ে।


কুশল সংবাদ

সকলই শুনতে ভালো লাগে যখন অব্দি জীবনের প্রথম বিপর্যয়
শোকের নদী বেয়ে নেমে আসেনি। হৃদয়ের ভিতরে সাতরঙা
                                                        একটি রামধনু
অথবা নক্ষত্রের ঝিলিমিলিতে অবাক করা চঞ্চলতায়
কুশল সংবাদ নিয়ে আসে প্রেম। পায়ে অসীম শক্তি নিয়ে কোনো
অগ্নিবলয়ের মধ্য দিয়ে পার হওয়া যায় অক্লেশে। কাছেই
দেখা যায় আকাশ সমুদ্র আর সুখ।

সকলই ভালো থাকে রূপের মধ্যে ফুলে ওঠে অপরূপ রূপ
যখন শোকের নদী বেয়ে নেমে আসেনি জীবনের প্রথম বিপর্যয়
তারপর কখনোবা ভালো আছি কখনোবা ভালো নেই
এইভাবে চলতে থাকে শব্দের অনন্ত খেলা হৃদয়ে।

এই খেলা নিরন্তর চলে মৃত্যু অবধি।


(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)