ISSN 1563-8685




একটি যৌথ স্মৃতিপাঁচালি

ই লেখাটা আদৌ গল্পটল্প জাতীয় নয় এটা একটা পাঁচমিশেলি স্মৃতি আলেখ্য। বন্ধুবান্ধব মিলে আড্‌ডার কথা অবলম্বনে এর জন্ম। এক বন্ধু আবার এর নাম দিয়েছে স্মৃতিমঙ্গল।

কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন আমাকে, আপনি কী লেখেন? আমি বড়ো অস্বস্তি বোধ করি। কারণ, আমি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি যা যা লেখকেরা লেখেন তা লিখতে পারিনা। সেসব কোনদিন চেষ্টা বা অভ্যেস করিনি। সুতরাং প্রশ্নকারীদের সত্যি কথাটাই বলি। বলি, আমি স্মৃতি-আলেখ্য লেখার চেষ্টা করে থাকি। অন্তত এযাবৎ কাল যা যা লিখেছি তার সবটাই স্মৃতি আলেখ্য। এ ধরনের লেখায় খুব একটা মননের বা নির্মাণের দরকার হয়না বলেই আমার ধারণা। আমার মনন চিন্তনের ব্যাপারটা খুব গভীর নয়। কাল্পনিক চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, তাদের নিয়ে কাহিনীবিন্যাস বা তাদের চরিত্রের উত্থান-পতন, নাটকীয়তার ব্যবহার বা চমৎকার সব সংলাপ নিয়ে যে কথাসাহিত্য নির্মাণ লেখকেরা করেন, সেই সৃজনশীল ক্ষমতা আমার নেই। স্বাভাবিক ভাবে তা আসেও না। তাই জীবনের নানা সময়ে ঘটা স্মৃতিই আমার লেখার সম্বল হয়।

কিন্তু আমার মাপের একজন অখ্যাত সাধারণ মানুষের জীবনে আর কতটা রোমাঞ্চকর স্মৃতি থাকে? বিষয় যা-ই হোক পাঠকের কাছে তা আকর্ষণীয় করে তো তুলতে হবে। বিষয় ছাড়া লেখার কথা আমি ভাবতেই পারিনা। কিন্তু স্মৃতি কাহিনী সম্বল করে দুএকখানা বই লেখার পরে দেখলাম পুঁজি শেষ। একেবারে কিছু-না থেকে স্মৃতি বানানোও যায় না, অন্তত, আমি পারিনা। ভয় হয়, যদি ধরা পড়ে যাই? আবার প্রেম, যৌনতা, ইত্যাদি নিয়ে যে দুকথা লিখব, তাও ভরসা পাই না। সে ব্যাপারে স্মৃতি কম নেই, কিন্তু উত্তম পুরুষের বয়ানে সেসব লেখার মত বুকের পাটা নেই। রাম, শ্যামের নামে হয়ত সেসব চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু তাহলে তো গল্পই লিখতে পারতাম। আমার উত্তম পুরুষ সর্বপ্রকারে আমিই। তাকে বা তার কার্যকলাপকে তৃতীয় ব্যক্তির কাজকর্ম বা আচরণ হিসাবে দেখার মত অবজেকটিভ অবজারভেশানের ক্ষমতা থাকলে তো কেল্লাফতে করে দিতে পারতাম। তা পারলাম না। নিজেকে স্তোক দিই, আমি স্মৃতি-কাহিনী লেখক, ঘটনার ব্যাপারে সত্যনিষ্ঠ এবং অকপট আমাকে থাকতেই হবে। তাতে সাহিত্য সৃষ্টি হোক বা না হোক। সাহিত্য সৃজনের দায় আমার নেই।

এখন যা বয়স এবং আত্মস্মৃতি নিয়ে যা যতটুকু লিখেছি তার বেশি বিশেষ কিছু আর নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, ভাগ্যিস দেশভাগ হওয়ার সময় বাংলাটাও ভাগ হয়েছিল, না হলে বোধহয় আমার আর 'ল্যাখক হওনের উপায় আছিল না'। কথাটা এক বন্ধুর। আমার একটা বেড়ানোর বাই আছে। জনা পাঁচেক বন্ধু মিলে একটা দল করেছিলাম। বছরে একবার শীতের শুরুতে বহুকাল ধরেই পচ্চিমে বেড়ানো এবং প্রায় একমাস কাটানোর একটা বিলাসিতা কর্মজীবনের প্রায় শুরু থেকেই আমাদের ছিল। এখন বয়স ঢলেছে শীতের রোদ্দুরের মত। তা অভ্যেসটা একেবারে যায়নি। তারই একবারের কথা নিয়ে এবারের স্মৃতি-চারণা। এটাও একরকম স্মৃতি আলেখ্যই। কমদিন তো হল না।

এটা ষাটের দশকের মাঝের দিকের কথা। এখন যেমন নভেম্বর মাসের শেষের দিকেও এদেশে শীতের দেখা পাওয়া যায় না, তখন অবস্থা অন্যরকম ছিল। শীত ব্যাপারটা নাকি পশ্চিমী দেশ থেকেই উধাও হতে বসেছে। কি যেন গ্লোবাল ওয়ার্মিং না কি। কাগজে তো এমনি দেখি।

শীতটা সেবার অক্টোবরের শেষ থেকেই জানান দিচ্ছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি আমরা বারাণসী। পাঁচজনের এই দলটার সবাই ডালহৌসি পাড়ার বিভিন্ন আপিসের পাঁচ-সাত বছরি নব্য কেরানি। তখনকার দিনে কেরানিগিরির যা রোজগার পকেটের অবস্থা কারুরই পুরুষ্টু নয়। সুতরাং পচ্চিম-বিলাসে সব চাইতে দূরবর্তী স্থান বারাণসী। সেখানে সেসব দিনে সস্তায় ভাঙ‌-এর সরবত এবং রাবড়ি পাওয়া যেত। আমরা তখন ভীষণ সাত্ত্বিক বামপন্থী বিপ্লববাদী। সুতরাং কেউই নিয়মিত নেশাখোঁড় ছিলাম না। ওই বেড়ানোর একমাসে বার দুয়েক এক আধপাত্তর বোতলের দ্রব্য আর বাকি দিনগুলোতে প্রায়ই ভাঙের সরবত এবং রাবড়ি। মদের মত, ভাঙ খেলে বদনাম হয়না।

পকেট পুরুষ্টু নয় কারুরই। তদুপরি দলের একমাত্র নরেন ছাড়া, বাকিদের পিতৃ সংসারের দায়িত্ব আছে। নরেনের বাবাই একমাত্র জীবিত এবং তাঁর অবস্থিতি নাকি পূর্ব পাকিস্তানে। নরেন তার এক মামার কাছে কোলকাতায় থাকে তখন। আমাদের বাবারা সব গত হয়েছেন। সুতরাং সংসারের দায়িত্ব আছে আমাদের সবারই। তখনো ব্যাপারটা আমরা দায় মনে না করে দায়িত্বই মনে করতাম। দায় কথাটা পরবর্তী প্রজন্মের।

এইসব কারণে, আমাদের কেউই তখনো যৌবনক্ষুধা মেটানোর সহজ উপায়টা অবলম্বন করতে সাহস পাইনি। প্রত্যেকেরই শৈশব কৈশোর কালটা প্রায় একই রকমের দৈন্য-দারিদ্রের। সবকয়জনই দেশভাগকালীন পড়ন্ত, ধ্বস্ত সময়ের সন্তান। সবে দশক দুয়েকও হয়নি দেশটা ভাগ হয়েছে। ঘা তখনো দগ্‌দগে। দেশছাড়ার সময়ের স্মৃতি তখনো টাটকা। আমাদের সবাই যে উদ্বাস্তু ক্যাম্পে থেকেছি এমন নয়। কারুর কারুর ভিন্ন ব্যবস্থাও ছিল। তবে কারুরটাই যে অন্যের কাছে ঈর্ষাজনক ছিল, এমন নয়।

পচ্চিম-বিলাসের সময়ই সেই সব দিনের কথা বেশি আলোচনা হত। ওটাই তখনো পর্যন্ত বড়ো স্মৃতি। আর স্মৃতি যতই দুঃখ দুর্দশার হয় ততই তার দক্‌ - একথা তো সবাই জানে। তারপর একটা সময় আসে যখন তার দাহের তাত্‌ পড়ে যায়। তখন শুরু হয়, সেইসব স্মৃতি নিয়ে রঙ-তামাসা, মশকরা, আত্মীয় পরিজনের লাথি ঝাঁটা, অবহেলার ঘটনা নিয়ে ঠাট্টা ইয়ারকি। এমনকি রাস্তার যে কোনো লোকের কাছে অপদস্থ, অপমানিত হওয়ার মত কারণ-হীন কাণ্ডগুলোও অনেক বিশ্রম্ভ অবকাশের আলোচনায়ই উপভোগ্য হয়। আমাদের পাঁচ ইয়ারের কাছে এই ব্যাপারগুলোর মধুময়তার পর্ব ততদিনে শুরু হয়ে গেছে। আসলে অতীত ব্যাপারটাই বড়ো মধুময়। একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারলে, কোনো অপমান, লাঞ্ছনা বা দাহই আর তীব্রতায় থাকে না। তখন সবটাই যেন কাব্য।

এসব ব্যাপারে মানুষ সাধারণত খুবই আবেগপ্রবণ হয়, বিশেষত বাঙালদের স্মৃতি, 'দ্যাশের কথা' ইত্যাদির ব্যাপারে আবেগ তো বিশ্বখ্যাত। সে যাহোক, এই নিয়ে আমাদের ভ্রমণ, আড্ডা, জীবন উপভোগ। সেদিনও আমাদের উপজীব্য ছিল স্মৃতি, আজ যখন সে কথা লিখছি, তখন সেটাই আবার স্মৃতি-সামগ্রী হয়েই লেখার রসদ জোগাচ্ছে। এই কথাটা জেনেছি বলেই, লেখার এই সহজ পথটা বেছে নিয়েছি আমি। তবে একটা ব্যাপারের উল্লেখ এখানে করতে হয়, সেদিনের মানসিক সমস্যার গুরুত্ব আজকের আর নেই।

।। দুই ।।

মরা ইস্কুল কলেজের প্রাক্তন সহপাঠী কেউ না। আমাদের সবার একদার জন্মভূমি বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূব বাংলায় হলেও, গ্রাম বা জিলা সুবাদে কেউ একস্থানের নই। চাকরিজীবনে প্রবেশের পর সবার আপিস ডালহৌসী পাড়ায় হওয়ায় এবং টিফিনে একই খাবারের স্টলে সস্তা খাবার খেতাম বলে আমাদের আলাপ পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। সেই থেকেই গড়ে উঠেছিল আমাদের বৎসরান্তিক ভ্রমণ-বিলাস সংস্থা, ঝোড়ো দিনগুলোর নিয়ত রোমন্থন। সদস্য সংখ্যা পাঁচেই সীমাবদ্ধ থাকায়, আমরা খ্যাতি পেয়েছিলাম 'পাঁচ-ইয়ারি অভিযাত্রীক' বলে।

আবার বলছি, আমরা কেউই স্বভাবগত ভাবে মোদো মাতাল, গাঁজা বা ভাঙ-খোর নই। তবে এই পচ্চিমি টহলে, শীত জাঁকিয়ে পড়লে, কখনো এক আধ পাত্তর করে কোহলি পানীয় পান করিনা এমন নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কাশীতে বেড়াতে গেলে, গোধূলিয়ার মোড়ে এক-দু ভাঁড় ভাঙের সরবত সেবন করে এবং যথেষ্ট রাবড়ি বা জিলিবি খেয়ে, জাবর কাটতে আমাদের দিব্য লাগত। যেমন এই সেবার। তখন সস্তাগণ্ডার দিন ছিল বলে আজ মনে হয় বটে, কিন্তু পয়সার যোগানটা ছিল কমের চাইতেও সংক্ষিপ্ত। সুতরাং মৌজি ব্যাপারটা রইসি স্তরে নিয়ে যাবার সাহস বা সামর্থ্য আমাদের কারুরই ছিল না। আমাদের ব্যাপারটা ছিল অনেকটা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিবেশনকালীন আয়েসী শিল্পীর মত। পরিমাণমত মাত্রায় নেশার বস্তু সেবন করে আসরে বসলে গলা এবং মেজাজ নাকি বেশ শরীফ এবং খোলতাই হয়। ওস্তাদ গায়কদের ক্ষেত্রে সুরা এবং বাউল-ফকিরদের আসরে গাঁজার ব্যবহারের কারণ বোধহয় এটাই। আমাদের লাইনটা যদিও ভিন্ন — কিন্তু যাক্‌গে নেশার প্রসঙ্গ থাক। অনেকক্ষণ ধরে নাগাড়ে ঝোপঝাড় পেটানো হয়েছে, এবার খাস কথায় আসা দরকার। যেবারের কথা বলছি, সেবারের ভ্রমণ, আড্‌ডার কথাই বলি। পুরোনো একটা প্রায় পরিত্যক্ত, শীগ্‌গিরই ভেঙে ফেলা হবে, এমন ধর্মশালায়, সামান্য পয়সার বিনিময়ে রাত্রিবাস করি। সারাদিন পায়ে হেঁটে কাশীর নানান দর্শনীয় স্থান, এ-গলি, ও-গলি বা কাছেপিঠের এঘাট সেঘাট টহল মারি। সন্ধেয় মণিকর্ণিকার ঘাটে সুদীর্ঘ সময় গুলতানির আসর বাঁধাধরা। আগের প্রজন্মের হলে বাঈজি পাড়ায় যাওয়া হত, কিন্তু সেরকম রেস্ত বা সাহস নেই। এজি বেঙ্গলের আশুদা আমাদের সবার জ্যেষ্ঠ এবং দলের নেতা। আদিবাড়ি ছিল ঢাকায়। ভাষা বুলিতে সেই অভিজ্ঞান প্রকট। বেশ মজলিশি মানুষ। জীবনকে তার গতি অনুযায়ী গ্রহণ করার অপরিসীম ক্ষমতা মানুষটির। ব্যাপক মন্দের মধ্য থেকে ভালোটাকে খুঁজে নেবার অসামান্য ক্ষমতা বহুদর্শী আশুদার। পঞ্চাশের দাঙ্গায় তার পরিবারের ছ'জন সদস্যের মধ্যে একমাত্র সে ও তার বাবা ছাড়া বাকি চারজনই খুন হয়েছিল। বাবা তাকে নিয়ে এক জঙ্গলে পালিয়ে থাকার সময় জ্বলন্ত বাড়িটার আলোতে তার মা সহ অন্যদের খুন হওয়ার বীভৎসতা দেখেছিল সে এবং সেই সহ আরো অনেক বর্বরতা। আশুদার বয়স তখন আট-নয় হবে। তাদের বাড়িটা শহর থেকে মাইল পাঁচেক দূরের এক গ্রামে থাকায় জঙ্গলে লুকোবার সুবিধেটা পেয়েছিল তারা।

সেই স্মৃতি দুঃস্বপ্নের মত এখনো তার মধ্যে ক্রিয়া করে, যদিও আশ্চর্য এই যে সেজন্য অধিকাংশ ভুক্তভোগীর মত সে গোটা মুসলমান সমাজকে দায়ী করে না। তার বাবা তাকে নিয়ে চলে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে কিভাবে যেন। মামারা দেশ স্বাধীন হবার সমকালেই চলে এসেছিলেন। সেখানে আশ্রয় নিয়ে কয়েকদিন থম মেরে ছিলেন বাবা। একদিন দুপুরে হঠাৎই একখানা হেঁসো না কাটারি নিয়ে, মামাদের সুকিয়া স্ট্রীটের বাসা থেকে রাজাবাজার বস্তির দিকে ছুট লাগালেন। মুখে একটাই বাক্য, 'হালার পুতেগো ব্যাকটিরে কাইট্যাই ফালামু। হালার গোরু খাউগার গুষ্টি'। বাসার সবাই এবং পাড়ার লোকজন, অনেক কষ্টে যখন তাঁকে ধরে নিয়ে আসে, তখন তিনি বদ্ধ উন্মাদ। অনেকে চেষ্টা চিকিৎসা করেও যখন কিছু করা গেল না, তখন বাধ্য হয়ে গোবরার লুম্বিনী উন্মাদাগারে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। যতদিন বেঁচে ছিলেন, কখনো চিৎকার করে, কখনো বা বিড়বিড় করে শুধু বলতেন, 'আমারে তোমরা ছাইড়া দেও। হালার পুতেগো ব্যাকটিরে আমি কাইট্যা ফালামু'। এক রাতে গলায় ধুতির ফাঁস দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়েছিলেন তিনি। আরও একটা কথা নাকি তিনি বিড়বিড় করতেন, 'আমার বিষয় আশয়, জমিজাগা বেয়াক হালার পুতেগো গভ্‌ভে গেল'।

আশুদা, এই কাহিনীটা বলার সময় প্রত্যেকবারই বলত, 'বাবার হালায় আসলেই মুসলমান বিদ্বেষী। পাগল হইয়াও তার থিকা নিস্কিতি পাইল না।' আমি বলেছিলাম, 'কিন্তু, যে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেটার ভূমিকা কি তুমি মানবে না?'

'মানতাম। কিন্তু আমাগো ব্যাপারটার আসল কারণটা যতটা হিন্দু-মুসলমানী ব্যাপার আছিল, তার থিকা বেশি আছিল জমিজমার কাইজা। বুঝ্‌জস্‌? সেইটা অনেক দিনের পুরাণা ব্যাপার। পরে মামাগো ধারে শুনছি। জমিজমার লাইগা তাইনে এ্যারগো উপার অইত্যাচার কোম করেন নাই। মামারা কইছিলেন।' আশ্চর্য - আশুদা কখনোই এই ঘটনাটা বলার সময় মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কোনো কটূক্তি বা নিন্দামন্দ উচ্চারণ করত না, যেসময় ওইসব আমরা হামেশাই করতে বা শুনতে অভ্যস্ত ছিলাম। সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সেকুলারিজম, নন্‌সেকুলার, এমন কি ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি আধুনিক আলোচনা আমার এই কাহিনীকথার উদ্দিষ্ট নয়। তবু এই কথাগুলো উল্লেখ করছি একা্রণে যে, আশুদা যখন তার বাবার বিষয়ে ওইরকম বলত তখন এইসব শব্দগুলো হিন্দুমুসলমান সমাজে তেমন বিস্তৃতিই পায়নি। চৌষট্টির দাঙ্গা তখনো অনেক দিনের ঘটনা নয়। আশুদার তৎকালীন বাসস্থান ছিল গোবরারই একটা বস্তিতে। কারণ তার বাবা ওখানেই লুম্বিনিতে ছিলেন। আশুদা গোবরার দাঙ্গা চাক্ষুষ দেখেছিল, দাঙ্গাকারীদের দাঙ্গার খরচের চাঁদা আদায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বেধড়ক ঠেঙানিও খেয়েছিল। সেই দাঙ্গাপন্থীরা যে সবাই পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু উদ্বাস্তু ছিল এমনও নয়। মোদ্দা কথা, এ ব্যাপারে তার দৃষ্টিকোণ স্বচ্ছ ছিল।

মুসলমান এবং হিন্দুরা, সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আলোচনা করার সময়ও নিজের সম্প্রদায়কে 'আমরা' আর অন্য সম্প্রদায়কে 'ওরা' বলেই উল্লেখ করে থাকে। আশুদাকে দেখেছি সে দাঙ্গা-বিরোধী হিসাবে নিজেদেরকে, হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে আমরা বলেই উল্লেখ করত, দাঙ্গাকারীদের ওরা বলে।

আমাদের, একমাত্র নরেন ছাড়া, বাকিদের স্মৃতিচারণ করার সময় এই প্রসঙ্গটি ব্যাপকভাবেই আসত, আর এর ফল হিসাবে পরবর্তীকালীন যাবতীয় দুঃখদৈন্যের পাঁচালি। নরেন স্মৃতিচারণ প্রায় করতেই চাইত না। প্রায়শই শ্রোতার ভূমিকায় থেকে, এড়িয়ে যেতে চাইত নিজের কথা। নরেন পশ্চিমবঙ্গের অভিবাসী হলেও তার বাবা পূর্বপাকিস্তানেই থেকে গিয়েছিলেন। নেত্রকোণায়, চাকরির স্বার্থে। কিন্তু সেকথা ক্রমশ আসবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার দেশত্যাগের ব্যাপারে ব্যথার স্মৃতি অনেক থাকলেও সেখানে বীভৎসতার অভিজ্ঞতা কিন্তু তেমন ছিল না বলে, আমিও শ্রোতা হিসাবেই থাকতাম। আচার্য্যও ছিল ঢাকা জিলার মানুষ। সে আলোচনায় যোগ দিত বটে, কিন্তু নিজের দুঃখ দিনের কথা কিছুই প্রায় বলত না। সাধারণ আলোচনাই করত। আচায্যি বলত, 'আমরা হালায় ব্যাকেই পাপী, বুঝজস্‌নি? খালি খালি একে অন্যরে গাইল খামার দিয়া লাভ কী? হারামজাদা মানুষ দুতরফেই আছে'।

পানু, আশুদা এবং কম মাত্রায় হলেও আমি দেশভাগ, দাঙ্গা, ফেলে আসা গ্রাম, উদ্বাস্তু জীবনের অসহনীয় দারিদ্র যন্ত্রণা নিয়ে একটু বেশিই স্মৃতিচারণ করতাম। সবাই যেন কমবেশি প্রমাণ করতে চাইতাম, কত কষ্ট করে আমরা জীবনযুদ্ধ করেছি দেখ। তথাপি হার মানিনি। সেইসঙ্গে আমরা সমালোচনা করতাম দেশভাগের সময়কার জাতীয় নেতাদের, বিশেষ করে জিন্না, নেহেরু, এমন কি গান্ধীজীরও। কুৎসিৎ ভাষায় গালাগালি করতাম তাঁদেরকে। প্রমাণ করতে চাইতাম, মনুষ্যত্বের এই চূড়ান্ত অবমাননার জন্য তাঁরাই দায়ী।

যেদিনের কথা বলছি, সেদিনও এইসব নিয়ে কখনো গুরুগম্ভীর, কখনো বা সরস আলোচনা করছিলাম আমরা। সরস আলোচনাটা এজন্য যে তখনকার তাবৎ লাঞ্ছনা, কষ্ট অতিক্রম করে আপেক্ষিক ভাবে মোটামুটি একটা স্থিতিশীল অবস্থায় আসতে পেরে প্রাক্তন যেসব অভিজ্ঞতা আমাদের স্মৃতিতে জমা হয়েছিল। তার দুঃখদায়ী ক্ষমতাটা স্বাভাবিক ক্রমেই ভোঁতা হয়ে একটা আত্মবিশ্বাস, না কি আত্মতৃপ্তির ভাবই বলব, তৈরি হয়েছিল। আসলে সংগ্রামে মোটামুটি ভাবেও সফল হওয়া মানুষদের যে একরকম অহংভাব জন্মায়, যা অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক অনুরূপ সংগ্রামে অনভিজ্ঞ মানুষকে তথা অসফল মানুষদের আমল দিতে চায়না, সেইরকম একটা একদেশদর্শী মানসিকতা আমাদের মধ্যে ছিল। ফলে, আমাদের অতীত তিক্ততা নিয়ে আলোচনা কালে, যতটা বাহাদুরির প্রকাশ ঘটত, ততটা বিশ্লেষণাত্মক হতনা ব্যাপারটা। সে কারণে তা যেন একটা বিলাসই ছিল। তার মধ্যে গভীরতা তেমন কিছুই থাকত না।

পানুদের দেশ ছিল যশোরে। ও নিজে যদিও মধ্য-পঞ্চাশেই এসেছিল এপারে, ওদের বাকি পরিজন দেশেই থাকত। ওরা ছিল সাহা। বাবা পরম্পরাগত ভাবে সফল ব্যবসায়ী। মা, বাবা, তিন ভাই নিয়ে সম্পন্ন, সচ্ছল গেরস্থালি। পানু তার এক কাকার কাছে থেকে পড়াশোনা করত। বাবার ইচ্ছে ছিল গোটা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে এপারে নতুন গেরস্থালি স্থানান্তরিত করা। কিন্তু এর মধ্যেই চৌষট্টির দাঙ্গায় যথাসর্বস্ব হারিয়ে শুধু প্রাণমাত্র সম্বল করে শরণার্থী হিসাবে কুপার্স ক্যাম্পে। ততদিনে বাবার সম্পূর্ণ নতুনভাবে, নতুন জায়গায় থিতু হওয়ার বয়স বা শক্তি আর ছিল না। পানু তখন ছাত্র এবং কাকার কাছেই ছিল। কাকার পক্ষে সবাইকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছা ছিল না। মা, বাবা এবং ছোট দুই ভাইকে দীর্ঘকাল কুপার্স ক্যাম্পেই ভীষণ দীনতায় কাটাতে হয়েছিল। পানু তার পরিজন এবং ক্যাম্পবাসীদের ওই নরকবাস প্রত্যক্ষ করতে করতে একসময় প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে ঠিক করেছিল, পড়াশোনা আপাতত স্থগিত রেখে রোজগারপাতির চেষ্টা করবে। তখন সে বি. কম। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেটা পাশ করতে পারলে চাকরি বাকরির হয়ত অনেকটা সুবিধে হত। কিন্তু সে উপায় ছিল না আর। যা হোক্‌, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, সাতঘাটের জল খেয়ে একসময় একটা ব্যাংকে কেরানির চাকরি জোটাতে পারল। তারপর অনেক ক্লেশ, ক্লিষ্টতা ভোগ করে আজ খানিকটা স্থিতু হয়েছে। সেই সব দিনের কথা এখন এই সমবেত দুঃখ, দৈন্য গ্লানির রোমন্থন সভায়, মণিকর্ণিকার ঘাটে বসে বলছে সে।

পানু তার বাবার দেশে থাকাকালীন ব্যাপক সচ্ছলতা, তাঁর ব্যবসা বিধ্বস্ত হওয়ার কাহিনী এবং কুপার্সে মানবেতর জীবন যাপনের বিষয় নিয়ে একটা তুলনামূলক আলোচনার করুণতম বিবরণ বলছিল। কিন্তু আচার্য্য বিষয়টার মধ্যে কোনো অসাধারণ কষ্ট লাঞ্ছনার নিদর্শন যেন পেল না। অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সে বলল, 'ওইটার লইয়া এতো বিষাদসিন্ধু গাওনের কি আছে? এরকমতো লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর কপালে অহনো নিত্য দিনের ব্যাপার।' কথাটা আমাদের সবার কানেই বেশ রূঢ় শোনালো। আশুদা বলল, 'অমন কইরা কইস্‌ না। আসলে অতবড়ো একটা অবস্থার থিকা এক্কেরে রসাতলে পইড়্যা যারে কয়, নান্দিভাস্যি কাণ্ড তো। কষ্টটা বেশিই অইছিল, বুজলি না?' আচায্যি আশুদার কথার সূত্র ধরেই পানুকে জিজ্ঞেস করল, 'তর বাবায় য্যান্‌ কিসের ব্যবসা করত?'

'একটা বড়োসড়ো মুদির দোকান ছিল, পাইকারি আর খুচড়াও। তা ছাড়া রাখি কারবার, তেজারতির ব্যবসা যাকে বলে।'

'রাখি কারবার? তেজারতি? মানে হইল গা, সস্তায় কিইন্যা, সীজনে মাল গাপ্‌ কইরা, আর্টিফিসিয়াল মালের ক্রাইসিস ক্রিয়েট করা, তার পরে অস্বাভাবিক দামে বেইচা লাভের উপার লাভ। তর বাপেতো হালায় ডাকাইতের থৈলদ্দার আছিলরে ভাই। আর তেজারতি তো সুদের কারবার, সব পাপের বড় পাপ।'

'কেন সেটা কি অন্যায় ব্যবসা না কি? ডাকাত বলছিস?' পানু দৃশ্যতই আহত। আচায্যি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও ছেড়ে দিল না তার আক্রমণাত্মক ভূমিকা। বলল, 'না, কইলাম আর কি। চাষিগো দাদন গাদন, তেজারতির ব্যবসাটা খুব একটা সৎ কাজ না।'

'কেন? আর তুই এসব কথা ওরকমভাবে জিজ্ঞেস করছিস যে?'

'না জিগাই। মানে অইতে আছে গিয়া তর বাপের শ্রেণী চরিত্রটা একটু জাইনা লইলাম। ডাকাইত কথাটা কথার কথা। বাপ জেঠাগো ওই সব কওন বহুকালের নিষিদ্ধ ব্যাপারতো, কানে লাগে। তয় কওনডা দরকারও। যাউক্‌, কিছু মনে করিস না।' পানু আচায্যির কথায় বেশ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। তবে স্বভাবগতভাবে ওর মধ্যে রাগ ব্যাপারটা উগ্র ছিল না। শুধু বলল, 'বাবার শেষ সময়টা বড়ো কষ্টদায়ক হয়েছিল। উদ্বাস্তু জীবনটা সত্যই সবার জন্য কষ্টকর ছিল, সন্দেহ নেই। তবে তাদের মধ্যে যারা সচ্ছল ছিল, হঠাৎ আতান্তরে পড়ে, ওরকম দিশেহারা হয়ে পড়েছিল তারা। কষ্টের অভ্যাস তো ছিল না কি না।' আশুদা বলল, 'সেইটা সত্য কথা। বেশির ভাগই তো আছিল সাধারণ অবস্থার চাইতেও গরীব। কষ্টে অভ্যস্ত।'

আমিও আচায্যির কথার ঝাঁজে অস্বস্তি বোধ করছিলাম। বললাম, 'বাপ জেঠাদের নিয়ে টানাটানি করার দরকার কি? আশুদাও নিজের বাবার কথা বলতে গিয়ে কিরকম যেন সমালোচনার সুরেই কথা বলছিল। দেখ, এখানে একমাত্র নরেনের বাবা ছাড়া আর কারুর বাবাতো বেঁচেই নেই। ছেড়ে দাও না তাঁদের কথা।' আশুদা বলল, 'আমরা হালায় ব্যাকটিই অহনো নাবালক। আরে আম্‌গো বাপ জেঠারা কি হক্কলে ভাল মানুষ আছিল না কি? আমি কই, আইজকা কথাটা যখন উঠলই তখন হক্কলের বাপের ছেরাদ্দই করন যাউক। আর হক্কলরেই কই, কথা কবা দিল্‌ খুইল্যা। মুখ ভার হওন চলবে না। কী, মঞ্জুর?' আচায্যি বলল, 'মঞ্জুর। আমার মতে পেছন দিকটা একটু ঘাটাঘাটি করন দরকার। তাতে সহ্যের হজমশক্তি বাড়ে।'

একমাত্র নরেন ছাড়া সবাই সহমত হল। আশুদা নরেনকে সায় দিতে নিশ্চেষ্ট দেখে জিজ্ঞেস করল, 'নরেইন্যা হালায় চুপ মাইরা রইছস্‌ কিয়ারে? তর বাপে হালায় নবী প্যাকম্বর নিকি? কোনো পাপ নাই তাইনের? ঠিকঠাক জানস্‌ তো?'

প্রত্যেকটি 'মৌজের' দিনই অন্যদের চাইতে এক দু ভাঁড় ভাঙ বেশিই খায় নরেন। আজও যথারীতি দুয়ের জায়গায় তিন ভাঁড় সেই সরবত এবং দু প্লেট রাবড়ি সেঁটে বোধহয় আরেক পাত্তরের জন্য অজুহাত খুঁজছিল। ভাঙের নেশায় নাকি বেশি বকা স্বাভাবিক। কিন্তু নরেনের বেলায় ব্যাপারটা ছিল উলটো। এমনিতেই আড্‌ডায় সে কথা বলত কম। ভাঙের সরবত বা এক আধ পাত্তর মদ খেলে সে যেন আরো ভোম্‌ মেরে থাকত। সে বলল, 'নারে ভাই, আমার বাবাকে নিয়ে ওইসব কথা বলতে পারব না। বিশেষ করে ওই চরিত্র টরিত্রের কথা।' আচায্যি বলল, 'আমি কিন্তু ব্যক্তিগত চরিত্তিরের কথা তখন কই নাই। শ্রেণী চরিত্রের কথাটাই তুলছিলাম। আমি জানি, বাবা ব্যাপারটা আম্‌গো বেয়াকের ধারেই হইল গিয়া ওই একটা পবিত্র ব্যাপার। আমরা হালায় মানতেই পারি না যে কাউর বাপ মাতাল আছিল, বা কেউ মাইয়া মানুষ পুষত। আরে যারা এগুলা করত, তারা কাউর না কাউর বাপই তো না কি?' আশুদা বলল, 'আমার বাপে তো হালায় মাতাল আছিল না ঠিকোই, মাইয়া মানুষও পুষত না, তয়, আমার মায়রে যা কষ্ট দিত, সেই কথা ভাবলে তাইনেরে অহনো চিতার থিকা তুইল্যা ক্যালাইতে ইচ্ছা করে। এই চরিত্তিরডা খুব ভাল কবি তরা?'

'ক্যান্‌ মারার কারণ?' আচায্যির প্রশ্ন।

'আরে হালায়, তহনকার দিনে বৌরে পিটানের কি কোনো কারণ লাগত নিকি? না আইজকার দিনে লাগে। আসলে মানুষটা আছিল পয়লা নম্বরের মামলাবাজ। পাড়া প্রতিবেশি, হিন্দু মুসলমান সগ্‌গলের লগেই জমি জাগা, এটা সেটা লইয়া বিরোধ আর ঝগড়া। মায় আছিল শিক্ষিত ঘরের মাইয়া। এইসব লইয়া প্রতিবাদ করত। আর সেই লইয়া সে কি মাইররে ভাই। তহন, আমি হালায় নেহাৎ ছোট, নাইলে, সত্যই আমি বাবারে ক্যালাইতাম। মায়ের কষ্ট সইজ্য অইত না। সেই কারণে তার ওইভাবে মরার লাইগাও আমার দুঃখ হয় নাই'।

আশুদার বর্ণনায় তার বাবার প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধেরও প্রকাশ ছিল না। একমাত্র আচায্যি ছাড়া আমরা কেউই বোধহয় আশুদার এরকম চাঁছাছোলা কথায় সায় দিতে পারছিলাম না। নরেনের ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছিল না। শত হলেও বাবা তো। জন্মদাতা। সে যুগে এটাই আমাদের মূল্যবোধের জায়গা। মা বাবার সমালোচনা করাটা সেকালে আমাদের অভিজ্ঞতায় ছিল না। আজ যখন ওইসব কথা লিখছি, তখন ব্যাপারটাকে আদৌ অশালীন বলে তো বোধ হচ্ছেই না বরং সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্যই বলে মনে হচ্ছে। সময়ের কি মাহাত্ম্য!

আমার বাবা বা পরিজনদের বিষয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বলার কিছু ছিল না। বিশেষত, বাবার স্বভাব বিষয়ে। তথাপি পারিবারিক দুঃখ দৈন্যের ব্যাপার ছিল ব্যাপক এবং তার জন্য বাবার অলসতা আর উদাসীনতাই ছিল প্রধানত দায়ী। বন্ধুরা তার গোটা ইতিহাসই বহুবার শুনেছে। সুতরাং আমার নতুন করে কিছু বলার বা ওদের শোনার আগ্রহ কোনোটাই ছিল না। তাঁকে ওরা অপদার্থই ধরে নিয়েছিল। আপাতত তাই আরেক প্রস্থ ভাঙ টানতে সাময়িক বিরতি নেওয়া হল।

রাত তখন সাড়ে সাতটা আটটা মত হবে। এমন কিছু রাত বলা যায়না তাকে। কিন্তু শীত পড়ে ছিল তীব্র। গোধূলিয়ার দিকে ফিরে যেতে যেতে পানু কি করে যেন, অথবা যেটুকু নেশা হয়েছিল তার ঘোরেই বোধহয় একটা ষাঁড়ের সঙ্গে ধাক্‌কা খেল। ষাঁড়টা শুয়ে শুয়ে, চোখ বুজে জাবর কাটছিল, যেন আমাদের ততক্ষণের রোমন্থনের মতই। আশুদা বলল, 'পাউন্যা, তর আরেক ভাড়ের বায়না বাদ গেল গা। কাশীর রাস্তায় যে ষাঁড়ের লগে ধাক্‌কা খায়, তারে আর ভস্‌সা করন যাইবো না।'

'ষাঁড়টা চোখ বুজে ওরকম ছিল বলেই না' — পানু সাফাই গাওয়ার চেষ্টা পায়। আশুদা বলল, 'হাটতে অছিল ক্যায়, তুই না ষাঁড়ডা? জানস কাশীতে ষাঁড়ের লগে কলিশন অইলে আর কইলকাতায় গরুর গাড়ির তলায় পড়ল একোই শাস্তি?'

'কী শাস্তি?'

'শহর থিকা বাইর কইরা দেওন। বুজজস্‌?'

'সেই কারণেই বোধহয় কোলকাতায় গোরুর গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কাশীতেও ষাঁড় নিষিদ্ধ হওয়া দরকার।'

'সম্ভব না'।

'কেন?'

'কাশী বিশ্বনাথের রাজত্ব, আর ষাঁড় হইল গিয়া তাইনের 'কার' মানে বাহন। তারে কী নিষিদ্ধ করন যায়?'

আচায্যি বলল, 'ও তো আসল কথাটাই জানেনা দ্যাখ্‌তাছি।'

'কী কথা?' পানুর প্রশ্ন।

(চলবে)



(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)