ISSN 1563-8685




স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা ছোটগল্পে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম মানসের স্বাতন্ত্র্য


র্ম শব্দের অর্থ ধারণ করা। যে সকলকে ধারণ বা পোষণ করে। যার অভাবে কোনও জীব বস্তু বা বিষয়ের অস্তিত্বই থাকে না, তাকেই বলা হয় ধর্ম। যেমন, মনুষ্যত্ব। অভিধানে উল্লেখিত ধর্মের বহু অর্থের আর একটি—দেশ ভেদে জাতি বিশেষের পরকাল প্রভৃতির অলৌকিক পদার্থ বিষয়ক বিশ্বাস এবং উপাসনা প্রণালী—religion—হিন্দুধর্ম, খৃষ্টধর্ম, ইসলামধর্ম...। সাধারণভাবে religion অর্থেই ধর্মকে দেখা হয়। জন্মসূত্রে কোনও না কোনও ধর্মসম্প্রদায়ের অন্তর্গত প্রতিটি মানুষ। যাঁরা সচেতনভাবে ধর্মানুমোদিত পথে জীবন-যাপন করেন না তাঁরা নিজের অজান্তে একটি নির্দিষ্ট ধর্মে অবস্থান করেন। জন্মের পর থেকে সেই নির্দিষ্ট ধর্মের উপাসনা পদ্ধতি, পূজা-পার্বণ-উৎসব, বিশ্বাস, সংস্কার, কিংবদন্তী ইত্যাদির সঙ্গে অবগাহন করতে করতে বড় হয়ে ওঠে মানুষ। তার জীবনচর্যায় এভাবেই লগ্ন হয়ে যায় ধর্ম। ধর্মসাধনায় জীবন অতিবাহিত না করলেও সামাজিক মানুষের পক্ষে ধর্ম-বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন সম্ভব নয়।

অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম ও জাতিকে একাকার করে ফেলেন কেউ কেউ। বলাবাহুল্য, ধর্ম এবং জাতি দুটি পৃথক বিষয়। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাবন্ধিক গবেষক সুধীর চক্রবর্তী একটি লেখায় তাঁর চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। সুধীরবাবুর গাড়ির ড্রাইভার মন্টু গতরখাটা গরিব খ্রিশ্চান। একদিন বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় একটা সরু পথে গাড়ি ঢুকিয়ে মন্টু একটি মন্দির প্রাঙ্গনে নিয়ে আসে। আয়েসপুরে নদীয়ার রাজার প্রতিষ্ঠিত মদনগোপাল মন্দির। সুধীরবাবুর কথায়—

আমার দেবদ্বিজে ভক্তি নেই তাই নন্দনের অভিবন্দনা করি। কিন্তু খ্রিশ্চান মন্টু দোকান থেকে বাতাসা কদমা খই মুড়কি কিনে খুরি করে মন্দিরে উঠে পুজো দেয় ভক্তিভরে, তারপরে চরণামৃত চেয়ে নিয়ে মুখে এনে দেয়, মাথায় রাখে। তারপরে প্রসন্ন মুখে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে। হতবাক আমি তাকে জিগ্যেস করি, ‘তুমি মদনগোপালের ভক্ত বুঝি?’ ‘হ্যাঁ, খুব জাগ্রত দেবতা জানেন? এখানে মানসিক করলে তা পূর্ণ হয়।’ ‘তুমি কোনো মান্‌সা করেছ নাকি?’ ‘সেই জন্যেই তো আসা স্যার। প্রত্যেক সপ্তায় আসি, মাছ মাংস খাই না।’ জিগ্যেস করতে নেই, তবু জানতে ইচ্ছে করে ‘কী চাও তুমি মদনগোপালের কাছে?’
নতমুখে কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে সে বলল, ‘তাঁকে বলেছি যেন আমার এই ড্রাইভারি জীবনটা বদলে উনি একটা মানুষের মতো কাজে লাগিয়ে দেন। তাহলে বউয়ের নার্ভ ভালো থাকবে, মেজ মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাবে না—সংসার করব মন দিয়ে। দেখবেন, মান্‌সা পূর্ণ হবেই।’ হিন্দু দেবতার প্রতি এই খ্রিস্টভজনাকারীর দৃঢ় আস্থা আর প্রত্যয় দেখে অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি তো খ্রিশ্চান, আমাদের দেবতাদের মানো?’
সে গভীর স্বরে বলল, ‘কেন মানব না বলুন, আমার ঠাকুরদার বাবা পর্যন্ত তো ছিলেন হিন্দু। আমরাও তাই নয় কি? ধর্ম পাল্টেছে বলে কি জাত গিয়েছে?’ [১]

মন্টুর জাত যায়নি নিশ্চয়ই। সে আজও বাঙালি। কিন্তু তার কাছে বাঙালি আর হিন্দু একাকার হয়ে গেছে। সে খ্রিশ্চান হয়েও সত্তার গভীরে বাঙালি হিন্দু হয়েই আছে। একটা সময় পর্যন্ত ধর্মান্তরিত বহু মুসলমানের মধ্যে এই বোধ ক্রিয়াশীল ছিল।

তেরো শতকের গোড়ায় লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে, দাসবংশীয় সুলতান কুতবউদ্দিন আইবকের সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করবার সময় থেকে বাংলায় ইসলাম ধর্মের বিস্তার শুরু হয়। বহু মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন। বহু ক্ষেত্রে ধর্মান্তরিত মুসলমানরা তাঁদের বংশানুক্রমিক বৃত্তিও ত্যাগ করেননি। আচার আচরণ ধর্ম বিশ্বাসও ছাড়তে পারেননি। সামাজিকভাবে আত্মীয়তা অনুভব করেছেন হিন্দুদের সঙ্গে। মুসলমানরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে হিন্দুদের অনুকরণও করেছেন। ফলে বাংলার মুসলমান পরিবারের বহু রীতি-নীতির সঙ্গে হিন্দুদের রীতি-নীতির মিল পাওয়া যায়। বহু বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করার ফলেও এমনটা হয়। আজও বহু হিন্দু পিরের থানে সিরনি মানত করেন। সমাজের নিচুতলায় দুই ধর্মের মানুষের সহাবস্থান থাকলেও বৃহত্তর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবধানটাও বিস্তর। প্রাক-ঔপনিবেশিক সময় থেকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ স্পষ্ট। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়া, বৈষম্য—সবমিলিয়ে বাংলার মুসলমানদের যাপন প্রক্রিয়া, জীবনসংগ্রামের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের বিস্তর ব্যবধান।

একটা ভ্রান্ত-বোধ থেকেই মুসলমানদের বাঙালি বলে স্বীকার করতে চান না বহু মানুষ। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই ধারণা এখনও বদ্ধমূল। ‘বাঙালি মুসলমান’ বা ‘মুসলমান বাঙালি’ শব্দ ব্যবহারে উষ্মা প্রকাশ করেন অনেকেই। মুসলিমরা বাইরে থেকে এখানে এসেছেন। অর্থাৎ সকল মুসলমানের পূর্বপুরুষরা বহিরাগত—অবাঙালি। এরকম ভাবনা লালন করেন বহু মুসলমানরাও। নানান তর্ক-বিতর্ক থাকলেও একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে বাংলার অধিকাংশ মুসলমানই ধর্মান্তরিত নিম্ন বর্ণের হিন্দু। কিছু বৌদ্ধও। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস, মণ্ডল, মল্লিক, সরকার, নাহার, চৌধুরী, মজুমদার প্রভৃতি উপাধির প্রচলন তাঁদের প্রাক্‌-ইসলাম হিন্দু বাঙালি জীবনের সাক্ষ্য বহন করে।[২] বাঙালি মুসলমানের বাঙালি হিসেবে পরিচিত হওয়ার প্রবণতা বিশেষভাবে দেখা যায় দেশভাগের পর। তার আগে এই পরিচয় তারা ভুলে গেছিল বা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাইরের আক্রমণে ভুল ভাঙল তাঁদের। পশ্চিম পাকিস্তানের জোর করে উর্দু চাপানোর চেষ্টা জাগিয়ে দিল তাঁদের জাতিসত্তাকে। আক্রান্ত বাংলাভাষাকেই আঁকড়ে ধরলেন সেখানকার বাঙালি। বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে ইতিহাস তার মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তা খোঁজার পরিচয়।[৩]

সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার মধ্যে মুসলমানকে পৃথক করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সামাজিক উৎসব আচার-অনুষ্ঠান রীতিনীতির মধ্যে কিছু মিল থাকলেও বিস্তর পার্থক্য মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের। এবং সেই পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলায় কথা বললেও ভাষারীতি এবং শব্দ চয়নে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। বহু ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস এমনকি পোশাক-আসাকও নির্ভর করে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের উপর।

একজন মানুষের জীবনসংগ্রাম, যাপন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে তার মনন। দৈনন্দিনতার সঙ্গে যুক্ত সকল বোধ বিশ্বাস ছায়া ফেলে ব্যক্তিজীবনে। অলক্ষে এসবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষটির ধর্মচেতনা। একই প্রতিবেশে বসবাসকারী একই ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষদের মেজাজ ও মানসিকতার মধ্যেও ঐক্য দেখা দেয়।

সাহিত্য তো সমাজেরই দর্পণ। বিশেষত, কথাসাহিত্যে, গদ্যসাহিত্যে মানুষের যাপন-প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটিও ধরা পড়ে। এতদিনকার বাংলা সাহিত্য-পাঠে দেখা যাবে বাঙালির মনন বাঙালির চেতন বাঙালির জীবন-যাপন সর্বাঙ্গীনভাবে বাংলা ছোটগল্পে যতটা প্রকাশিত হয়েছে ততটা সাহিত্যের অন্য কোনও শাখায় হয়নি। এখানে আর একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে—ছোটগল্পে প্রতিফলিত এই যাপনচিত্রকে যদি ধর্মীয় আধারে চিহ্নিত করা যায় তবে দেখা যাবে হিন্দুজীবন, হিন্দুমননই অধিকমাত্রায় প্রকাশিত। তবে এই সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের রচনার প্রেক্ষিতে। বাংলাদেশের লেখকদের রচনায় স্বভাবতই মুসলিম-জীবন মুসলিম-মানস গুরুত্ব পেয়েছে। ‘মুসলমান’ শব্দটি শুধু ধর্মীয় পরিচয়ে নিঃশেষ নয়, সংস্কৃতিরও একটা অঙ্গ ও প্রেরণা।[৪] আর এই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ধরতে গেলে ধর্মবোধসহ বুঝতে হবে।

বাংলাদেশের মুসলিম মানসের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ ও সামগ্রিকভাবে মুসলিম মানসের মধ্যে অনেক তফাৎ। দেশভাগের ফলে এখানকার মুসলমানরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন। কিন্তু পাশের দেশে সংখ্যাগুরু তাঁরা। সীমান্ত অঞ্চলে দু-এক কি মি-র ব্যবধানে একই ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষরা শুধু রাজনৈতিক কারণেই কোথাও সংখ্যাগুরু, আবার কোথাও বা সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘুদের দৈনন্দিন জীবনচর্যার সঙ্গে সংখ্যাগুরুদের দৈনন্দিনতার পার্থক্য অনেক। তাছাড়া দেশভাগের পরে অভিজাত শিক্ষিত ধনী মুসলমানদের অধিকাংশই পূর্ববঙ্গে চলে গেলেন। এপারে যাঁরা থেকে গেলেন তাঁরা মূলত দরিদ্র নিরক্ষর চাষি। ফলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে অসমতা ছিল তা না কমে হঠাৎই অনেকটা বেড়ে গেল।[৫] এখানকার মুসলমানদের এই নিজস্বতা চিহ্নিত করে দেওয়া প্রয়োজন। এই নিজস্বতাকেই খোঁজার চেষ্টা করা হবে বাংলা ছোটগল্পের নিরিখে।

দেশভাগ নিয়ে বাংলায় সাহিত্য রচনা শুরু হয়েছে অনেক পরে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাঙালিদের জন্য স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র—বাংলাদেশের জন্মের পরে বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ একটা বড় জায়গা করে নিল। তার আগে যে এই বিষয়ে একেবারে লেখা হয়নি তা নয়। বিচ্ছিন্নভাবে বাংলায় কিছু গল্প লেখা হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির আত্মপ্রকাশের পর বাংলায় যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি চর্চিত হতে থাকে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে দেশভাগ সংক্রান্ত সাহিত্যের আলোচনায় উদ্বাস্তু সমস্যাই অধিকতর প্রাধান্য পেয়ে আসছে। কিন্তু দেশভাগের প্রভাব শুধু উদ্বাস্তু সমস্যা-কেন্দ্রিক নয়। ওপার বাংলার হিন্দুদের সমস্যা নয়। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের জীবনচর্যায়ও ধাক্কা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে থেকে যাওয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনে একটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে এই দেশভাগ। তাদের প্রাত্যহিকতায় জন্ম দিয়েছে আশ্চর্য এক অস্থিরতার। সামগ্রিকভাবে এখানকার মুসলিম মানসের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাটাই বদলে গেছে। দেশভাগজনিত ট্রমা এখনও প্রতিনিয়ত বিপন্ন করে মুসলমানদের। তারই সাহিত্যিক বয়ান কীভাবে উঠে এসেছে এই সময়ের বাংলা গল্পে তা-ই দেখার চেষ্টা করা হবে এখানে।


রবীন্দ্রনাথ

বীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় একশোর কাছাকাছি গল্প লিখেছেন। তার মধ্যে মাত্র ছ-সাতটি গল্পে এসেছে মুসলিম চরিত্র বা মুসলিম অনুষঙ্গ। এই গল্পগুলি হল ‘দালিয়া’(১২৯৮/১৮৯১), ‘রীতিমত নভেল’(১২৯৯/১৮৯২), ‘কাবুলিওয়ালা’ (১২৯৯/১৮৯২), ‘সমস্যাপূরণ’(১৩০০/১৮৯৩), ‘ক্ষুধিত পাষাণ’(১৩০২/১৮৯৫) ‘দুরাশা’(১৩০৫/১৮৯৮) ও ‘মুসলমানীর গল্প’(১৩৬২/১৯৪১)। এর মধ্যে ‘সমস্যাপূরণ’ ও ‘মুসলমানীর গল্প’-এ এসেছে বাঙালি মুসলমানদের প্রসঙ্গ। অন্যান্য গল্পে অবাঙালি মুসলমান। সেগুলির পটভূমিও বহির্বঙ্গ।

তাঁর গল্পে তথা সমগ্র রবীন্দ্র-সাহিত্যে মুসলিম প্রসঙ্গ প্রাধান্য না পাওয়ার সঙ্গত কারণ ছিল। মুসলিম জীবন-মুসলিম সমাজের সঙ্গে গভীর পরিচয় ছিল না তাঁর। যদিও চাকর-বাকর খানসামাদের মধ্যে অনেক মুসলিম ছিলেন। আবুল ফজল প্রমুখদের মতো অনেক মুসলিম বন্ধুও ছিল। কিন্তু আপামর মুসলমানদের জীবনযাত্রার সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না তাঁর। ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঠাকুর এস্টেটের জমিদারি দেখাশোনার কাজে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর অঞ্চলে কাটিয়েছিলেন। এই পল্লীবাংলার অভিজ্ঞতাই উঠে এসেছে তাঁর ছোটগল্পগুলিতে। মুসলমান সমাজ-মুসলিম পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এই সময়ে। পূর্ববঙ্গের উক্ত অঞ্চলগুলিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের বসবাসই বেশি। কিন্তু মুসলিম সমাজের সমস্যাকে জানতে হলে সমাজের অন্তরের দিক থেকে জানতে হবে। এখানে তার সুযোগ ছিল না। তাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে সম্পর্ক তা জমিদার ও প্রজার সম্পর্ক—শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক। সেখানে অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশার সমস্যা তো ছিলই।[৬] ফলে মুসলিম সমাজের ভিতরের খবর জানা ছিল না তাঁর। তাঁর লেখায় মুসলিম চরিত্র, মুসলিম অনুষঙ্গ থাকলেও সেখান থেকে সামগ্রিক মুসলিম মানসের কোনও ছবি পাওয়া যাবে না।

তাঁর মুসলিম চরিত্র নিয়ে লেখা প্রথম গল্প ‘দালিয়া’ (মাঘ ১২৯৮)। ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা হয়েছে গল্পটি। ঔরঙ্গজীবের ভয়ে তার ভাই শা সুজা তিন সুন্দরী কন্যাকে নিয়ে আরাকান-রাজের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। আরাকান-রাজ রাজপুত্রদের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব দিলে তাতে রাজি হন না সুজা। বিরক্ত রাজা ছল করে নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন। বড় মেয়ে তখন আত্মহত্যা করে। মেজো মেয়ে জুলিখাকে নিয়ে সাঁতরে পালায় সুজার বিশ্বস্ত অনুচর রহমত আলি। আর ছোট মেয়ে আমিনাকে ঠেলে জলে ফেলে দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে মারা যায় সুজা।

গল্পের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ ঐটুকুই। এরপর আমিনা এক ধীবরের জালে আটকে যায়। সেই ধীবর তাকে বড় করে তোলে। ধীবরের কুটিরে সমাজ জনবসতির বাইরে দালিয়া নামে একটি কিশোরের সাহচর্যে আমিনার দিন কাটে। আর রহমত জুলিখাকে নিয়ে বহু জায়গায় ঘুরে সেখানে হাজির হয়। ছদ্মনামে রহমত আরাকান রাজসভায় চাকরি নেয়। জুলিখা থাকে আমিনার কাছে। জুলিখা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে উদ্দীপ্ত করে বোনকে। আর আমিনা মগ্ন থাকে দালিয়াতে। প্রথম প্রথম দালিয়াকে দেখে জুলিখা বিরক্ত হলেও পরে দারিদ্রের ছায়ায় জুলিখার কুলগর্ব শিথিল হয়ে যায়। আমিনা-দালিয়ার মিলনে সেও খুশি হয়—“দুটি সমযোগ্য নরনারীর মিলনদৃশ্য দেখিতে রমণীর যেমন সুন্দর লাগে এমন আর কিছু নয়। এত রহস্য, এত সুখ, এত অতলস্পর্শ কৌতূহলের বিষয় তাহার পক্ষে আর-কিছুই হইতে পারে না।”[৭] কৈলু গাছের ছায়ায় আমিনা এবং দালিয়ার মিলনের মনোহর খেলা দেখতে বড়ো আনন্দ হয় তার।

এরমধ্যে রহমত শেখ জুলিখাকে গোপনে চিঠি লিখে জানায় যে, আরাকানের নতুন রাজা তাদের দুই বোনের সন্ধান পেয়েছে এবং আমিনাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে। বিয়ে করে প্রাসাদে আনার আয়োজন করছে। প্রতিহিংসার সুযোগ সামনে। দালিয়ার সামনেই জুলিখা আমিনাকে বলল রাজাকে হত্যা করবার কথা। দালিয়ার জন্য মন খারাপ করলেও রাজি হয় আমিনা।

মহাসমারোহে দুই বোন রাজ-প্রাসাদে গেল। মছলন্দ-শয্যার উপর রাজবেশ পরিহিত রাজাকে দেখল তারা। রাজা—দালিয়া মুচকি হাসছে তখন। আমিনা মূর্ছিতা হয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আর রাজা—দালিয়া উঠে আহত পাখির মতো কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেল তাকে। আমিনা সচেতন হয়ে বুকের ভিতর থেকে ছুরি বার করে দিদির মুখের দিকে তাকাল। দিদি তাকাল দালিয়ার মুখের দিকে—“দালিয়া চুপ করিয়া হাস্যমুখে উভয়ের প্রতি চাহিয়া রহিল, ছুরিও তাহার খাপের মধ্য হইতে একটুখানি মুখ বাহির করিয়া এই রঙ্গ দেখিয়া ঝিক্‌মিক্‌ করিয়া হাসিতে লাগিল।”[৮]

এ গল্পে প্রতিহিংসা রূপান্তরিত হল প্রেমে। প্রেমেরই জয়গান করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু দুটি নারী-পুরুষের প্রেম নয়, জয় হল মানবপ্রেমের। রাজকন্যা দরিদ্র ধীবরের ঘরে যেভাবে জীবন কাটিয়েছে; যুবরাজ দালিয়া যেভাবে দরিদ্র-ধীবরের বাড়িতে সময় কাটিয়েছে, আমিনার প্রণয়-অত্যাচার সহ্য করেছে সেখানে চরিত্রগুলির সামাজিক আভিজাত্য ম্লান। মানব-প্রেমের এক সর্বজনীনতার কথাই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সমাজ থেকে দূরে এগল্পের পটভূমি। চরিত্ররা মুসলিম হলে কি হবে মুসলমান জীবনের কোনও ছবিই উঠে আসেনি। মুসলিম পরিবারের কোনও বিশেষ সমস্যাও প্রাধান্য পায়নি এ গল্পে।

রবীন্দ্রনাথের ‘রীতিমত নভেল’ (ভাদ্র-আশ্বিন ১২৯৯) গল্পে মুসলিম প্রসঙ্গ এসেছে। প্রসঙ্গই আছে শুধু, কোনও মুসলিম চরিত্রও নেই। কাঞ্চীর বীর সেনাপতি ললিত সিংহের পরাক্রমের কথা বলতে গিয়ে তার বিপরীতে তিন লক্ষ যবনসেনার উল্লেখ করা হয়েছে গল্পের শুরুতে—“আল্লা হো আকবর’ শব্দে রণভূমি প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। একদিকে তিন লক্ষ যবনসেনা, অন্য দিকে তিন সহস্র আর্যসৈন্য।” ললিত সিংহের বজ্রমন্দ্রিত ‘হর হর বোম্‌ বোম্‌’ শব্দে তিন লক্ষ ম্লেচ্ছকন্ঠের ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি নিমগ্ন হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ গল্পে মুসলিম প্রসঙ্গ বলতে এটুকুই। এই ধরনের বর্ণনার মাধ্যমে এক শ্রেণির লেখকের প্রতি বিদ্রূপই করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তো গল্পের এহেন নাম—‘রীতিমত নভেল’।

তাঁর একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য গল্প ‘কাবুলিওয়ালা’ (অগ্রহায়ণ ১২৯৯)-র প্রধান চরিত্রটি মুসলিম—কাবুলি মেওয়াওয়ালা। রহমত তার নাম। পরনে ময়লা ঢিলে কাপড়, মাথায় পাগড়ি, ঘাড়ে ঝুলি, হাতে থাকে আঙুরের বাক্স। কিন্তু এই মুসলিম চরিত্রটি বাঙালি নয়। ব্যবসাসূত্রে এখানে আসে। প্রতি বছর মাঘমাসে রহমত চলে যায় দেশে। দেশে থাকে তার আদরের মেয়ে। মেয়ের হাতের চিহ্ন বুকে আগলে বাংলায় পড়ে থাকে সে। আর বাঙালি মেয়ে মিনির মধ্যে সে তার মেয়েকেই যেন খুঁজে পায়। রহমতের ধর্ম প্রাধান্য পায়নি। সে একজন পিতা এটাই তার সবচেয়ে বড় পরিচয়। হিন্দু-মুসলমান বাঙালি-কাবুলি এ সব পরিচয় ম্লান হয়েগেছে তার পিতৃত্বের কাছে।

‘সমস্যাপূরণ’ (অগ্রহায়ণ ১৩০০) গল্পটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে বেশ আধুনিক। ধর্মনিষ্ঠ ‘অতিশয় সচ্চরিত্র’ হিন্দু জমিদারের সঙ্গে মুসলমান রমণীর নিষিদ্ধ প্রণয়-সম্পর্কের কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ এই গল্পে। ঝিঁকড়াকোটার এই বদান্য জমিদার কৃষ্ণগোপাল সরকার সুশিক্ষিত পুত্র বিপিনবিহারীর হাতে জমিদারের দায়িত্ব অর্পণ করে কাশীবাসী হন। বিপিনবিহারী জমিদার হিসেবে বেশ কড়া। অনেক প্রজা তার বশ্যতা স্বীকার করলেও মির্জাবিবির পুত্র উদ্ধত অছিমদ্দি বাগ মানল না। এতদিন ধরে সে নিষ্কর জমি ভোগ করত, সে অধিকার কোনও মতে ছাড়তে চায় না সে। মামলা পর্যন্ত গড়ায়। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচারের দিন কাছারিতে হঠাৎ হাজির হন বৃদ্ধ কৃষ্ণগোপাল। ‘খালি পা, গায়ে একখানি নামাবলি, হাতে হরিনামের মালা, কৃশ শরীরটি যেন স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময়।’ বিপিনকে ডেকে বললেন, অছিমের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে এবং সে যাতে করে খালাস পায় তার ব্যবস্থা করতে। বিপিন কারণ জানতে চাইলে তিনি নির্দ্বিধায় বলেন, ‘অছিমদ্দিন তোমার ভাই হয়, আমার পুত্র।’ ছেলেকে এই খবরটুকু জানিয়ে ধর্ম মতো কাজ করতে বলে সেখান থেকেই ফিরে গেলেন। মামলা থেকে নিষ্কৃতি পেল অছিমদ্দি। সম্পত্তিও ফিরে পেল। শুধু পুত্র বলে নয়, জমিদার কৃষ্ণগোপালের মহত্বই উঠে এসেছে গল্পে। হিন্দু-মুসলমান সকল প্রজাই সমান তাঁর কাছে। একজন জমিদারের এমনই প্রজাবৎসল হওয়া উচিত। মুসলমান পরিবারের কথা থাকলেও মুসলমান পরিবারের বিশেষ কোনও সমস্যা প্রাধান্য পায়নি এখানে। গল্পে উঠে আসা সমস্যা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে যে কারোরই হতে পারত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ (শ্রাবণ ১৩০২)। অতীতের মুসলিম হারেমের প্রসঙ্গ এসেছে এগল্পে। প্রায় আড়াই শত বছর আগে দ্বিতীয় শা-মামুদ ভোগবিলাসের জন্য শুস্তা নদীতীরের নির্জন স্থানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। পরিত্যক্ত এই প্রাসাদটির পটভূমিতে বিন্যস্ত হয়েছে গল্পটি। ঐতিহাসিক পরিবেশে সৌন্দর্য কল্পনার মিশ্রণে এই অভিশপ্ত প্রাসাদে মূর্ত হয়েছে অতীতের সেই বৈভব। প্রাসাদটি সম্পর্কে জানা যায় যে—“এক-সময় ওই প্রাসাদে অনেক অতৃপ্ত বাসনা, অনেক উন্মত্ত সম্ভোগের শিখা আলোড়িত হইত—সেই-সকল চিত্তদাহে, সেই-সকল নিষ্ফল কামনার অভিশাপে এই প্রাসাদের প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ড ক্ষুধার্ত তৃষার্ত হইয়া আছে, সজীব মানুষ পাইলে তাকে লালায়িত পিশাচীর মতো খাইয়া ফেলিতে চায়। যাহারা ত্রিরাত্রি ওই প্রাসাদে বাস করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে কেবল মেহের আলি পাগল হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছে, এ পর্যন্ত আর কেহ তাহার গ্রাস এড়াইতে পারে নাই।”[৯]

এ এক অলৌকিক বিভ্রমের গল্প। স্বপ্ন ও বাস্তব একাকার হয়ে গেছে। মুসলমান আমলের বিলাস-বৈভবের অনুষঙ্গ থাকলেও সমকালীন মুসলিম সমাজের কোনও পরিচয় নেই এই গল্পে।

‘সমস্যা পূরণ’ গল্পে হিন্দু পুরুষের সঙ্গে মুসলিম রমণীর প্রণয় সম্পর্কের উল্লেখ ছিল। আর ‘দুরাশা’ (বৈশাখ ১৩০৫) গল্পে হিন্দু পুরুষের প্রতি মুসলমান কন্যার প্রেম কাহিনি মূর্ত হয়েছে। বদ্রাওনের নবাব-দুহিতা সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ কেশরলালের প্রেমে পড়ে কত ত্যাগ স্বীকার করেছে তারই মরমী কাহিনি বিধৃত এই গল্পে। নবাব-কন্যা দার্জিলিঙে মেঘবৃষ্টিতে আচ্ছন্ন একটি দিনে লেখককে তার অপূর্ব প্রেম কাহিনি শুনিয়েছিল। নিশ্ছিদ্র জেনানা মহল থেকে নানাভাবে সে খোঁজ নিত তার প্রেমিকের। লেখকের কাছে তার প্রেমের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে সে বলেছে—“আমাদের পূর্বপুরুষের কেহ-একজন একটি ব্রাহ্মণকন্যাকে বলপূর্বক বিবাহ করিয়া আনিয়াছিলেন, আমি অন্তঃপুরের প্রান্তে বসিয়া তাঁহারই পুণ্যরক্তপ্রবাহ আপন শিরার মধ্যে অনুভব করিতাম, এবং সেই রক্তসূত্রে কেশরলালের সহিত একটি ঐক্যসম্বন্ধ কল্পনা কিয়ৎপরিমাণে তৃপ্তি বোধ হইত।”[১০] তার দুর্দিনে নিজের সমস্ত অলংকার হিন্দু দাসীকে দিয়ে গোপনে কেশরলালের কাছে পাঠিয়েও দিয়েছিল। আর সেই দান গ্রহণ করায় আনন্দে তার ‘ভূষণবিহীন প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুলকে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল।’

রণক্ষেত্রে মৃত্যু পথযাত্রী কেশরলালকে সে জল দিয়ে বাঁচিয়েছে। আর প্রতিদানে মুসলিম বলে অপমানিত হয়েছে। মৃত্যুকালে বিধর্মী যবনের জলে তার ধর্ম নষ্ট হয়েছে বলে কেশরলাল তাকে পদাঘাত করেছে। তবুও প্রেমে অবিচল সে। মুসলিম হয়েও প্রেমে পাগল নবাব-দুহিতা যোগিনী সেজে কাশীর শিবানন্দস্বামীকে পিতৃ সম্বোধন করে তাঁর কাছে সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছে। ভৈরবী বেশে তীর্থে তীর্থে, মঠে মন্দিরে ভ্রমণ করেছে প্রেমিকের খোঁজে। দার্জিলিঙে অবশেষে তার দেখা পায় সে—“বৃদ্ধ কেশরলাল ভুটিয়াপল্লীতে ভুটিয়া স্ত্রী এবং তাহার গর্ভজাত পৌত্রপৌত্রী লইয়া ম্লানবস্ত্রে মলিন অঙ্গনে ভুট্টা হইতে শস্য সংগ্রহ করিতেছে।”[১১]

সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিতে লেখা এই গল্পে ‘মুসলমান ব্রাহ্মণী’র প্রেমসাধনা, প্রেমে অবিচল নিষ্ঠা প্রতিভাত। মুসলিম জীবনের তেমন পরিচয় নেই।

রবীন্দ্রনাথের আর একটি গল্পে মুসলিম অনুষঙ্গ এসেছে। সেই গল্পটি হল ‘মুসলমানীর গল্প’ (আষাঢ় ১৩৬২)। একে ঠিক গল্প বলা যাবে না। এটি গল্পের খসড়া মাত্র। হিন্দু কন্যার ঘটনাক্রমে মুসলমান হওয়ার কাহিনি এই গল্প। পিতামাতাহীন কমলা কাকার কাছে মানুষ। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় ডাকাতের শিকার হয়। আর তাকে বাঁচান বৃদ্ধ হবির খাঁ। তিনি কমলাকে নিজের বাড়ি নিয়ে জান। হিন্দু হয়েই সে থাকে সেখানে। কাকার গৃহে জায়গা পায়নি। কিন্তু হাবির খাঁর কাছে বড় যত্নে দিন কাটে তার। এর মধ্যে যুবতী কমলা প্রেমে পড়ে খাঁ সাহেবের মেজো ছেলে করিমের। বিয়ে হল। তার নাম হল মেহেরজান। প্রেমে পড়েই সে নিজের থেকে ধর্মান্তরিত হল। তার কাকার মেয়ের বিয়ের সময়ও একইভাবে ডাকাতের আক্রমণ হয়। আর তাকে বাঁচায় মেহেরজান। বোন সরলাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসে কাকার বাড়িতে। এইভাবে সে শোধ করে কাকা-কাকির ঋণ।

অসাধারণ একটি গল্প হতে পারত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এটি শেষপর্যন্ত লিখে উঠতে পারেননি। খসড়া আকারে মুখে মুখে প্রতিমাদেবীকে বলেছিলেন। হবির খাঁকে কমলা বলেছিল—

যে দেবতা আমায় আশ্রয় দিয়েছেন সেই ভালোবাসার সম্মানের মধ্যে তাঁকেই আমি পুজো করি, তিনিই আমার দেবতা—তিনি হিন্দুও নন, মুসলমানও নন। তোমার মেজো ছেলে করিম, তাকে আমি মনের মধ্যে গ্রহণ করেছি—আমার ধর্মকর্ম ওরই সঙ্গে বাঁধা পড়েছে। তুমি মুসলমান করে নাও আমাকে, তাতে আমার আপত্তি হবে না—আমার নাহয় দুই ধর্মই থাকল।[১২]

প্রেমের কাছে ম্লান হয়ে যায় জাতিধর্ম। রবীন্দ্রনাথ বারবার এ কথা বলেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়। এখানেও সেই প্রেমধর্ম মানবধর্মই প্রাধান্য পেয়েছে।

‘মুসলমানীর গল্প’ ছাড়া আলোচিত বাকি গল্পগুলি রচিত হয়েছে উনিশ শতকের শেষ দশকে। জাতীয়তাবাদে উত্তাল তখন বাংলা। কোনও কোনও লেখক তাঁদের লেখায় তুলে ধরছেন হিন্দুদের অতীত গৌরব। সেই হিন্দুয়ানার সময়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই গল্পে মুসলিম চরিত্ররা যতটা সম্মান ও গুরুত্ব পেয়েছে তা উল্লেখ করার মতো। মুসলমান নারীরাও যথেষ্ট মর্যাদা নিয়ে হাজির হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গল্পে। রবীন্দ্রনাথের আগে উনিশ শতকের বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকের লেখায় মুসলিম চরিত্র এসেছে। তার অধিকাংশই বাঙালি নয়। রবীন্দ্রনাথের কলমেই মুসলমানদের মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হল। অবাঙালি মুসলমানের পরিবর্তে বাঙালি মুসলমানের আবির্ভাব ঘটল। বাংলা গল্প-উপন্যাসে মুসলিমরা এতদিন ছিলেন ‘যবন’, ‘পরদেশি’, শত্রুভাবাপন্ন, পররাজ্য লুণ্ঠনকারী ইত্যাদি। রবীন্দ্র-রচনায় দেখা গেল এঁরা হিন্দুর প্রতিবেশী, আত্মীয়।[১৩]

তাঁর গল্প-উপন্যাসে মুসলমান চরিত্রদের মর্যাদা দিলেও মুসলিম চরিত্র ও সমাজ নিয়ে তিনি যে বিশেষ কিছু লেখেননি এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। এর জন্য তাঁকে অভিযুক্তও হতে হয়েছিল। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের অভিযোগের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সমাজের অভ্যন্তরীণ তত্ত্বের সংবাদ না জানলে সেই সমাজের কথা লেখা যায় না। তিনি আরও বলেছিলেন, মুসলমান লেখকদেরই এ-সম্বন্ধে লেখা উচিত।[১৪] অ-মুসলিম কোনও লেখক মুসলমান সমাজ নিয়ে লেখার চেষ্টা করলেও যে সফল হতে পারবেন না এ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে দেখা যাবে মুসলমান সমাজ নিয়ে বিস্তর গল্প লেখা হবে। কিন্তু তার অধিকাংশই মুসলমান লেখকদের হাতেই। রবীন্দ্রনাথ মুসলিম চরিত্রদের যে উচ্চতায় নিয়ে গেলেন পরবর্তীকালের সাহিত্যে দেখা যাবে তারই প্রতিফলন। বিধর্মী ‘যবন’ নয়, মুসলমানরাও দোষে-গুণে ভরা মানুষ, স্বমহিম চরিত্র—রবীন্দ্রনাথই তা দেখালেন।


স্বাধীনতা-পূর্ব ছোটগল্প

বীন্দ্রনাথের পরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মাত্র দুটি গল্পে এসেছে মুসলিম অনুষঙ্গ। তাঁর ‘স্বামী’ গল্প সংকলনের ‘একাদশী বৈরাগী’ গল্পে একটি মুসলিম চরিত্র আছে। একজন সাধারণ গ্রামীণ দরিদ্র মুসলিম চরিত্র নফর। সংক্ষেপে আলোচিত এই চরিত্রটির গুরুত্ব গল্পটিতে কম নয়।

তাঁর ‘হরিলক্ষ্মী’ গল্প সংকলনের ‘মহেশ’ গল্পটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের একটি সাড়া জাগানো গল্প। মুসলমান জীবনেরই গল্প এটি। একজন দরিদ্র মুসলিম কৃষকের পালিত গরুর প্রতি ভালোবাসা গল্পটিতে প্রকাশিত। নিজের সন্তানের চোখে দেখে সে গরুটিকে। পাশাপাশি এই গল্পের একজন বর্ণ হিন্দুর গরুকে খোঁয়াড়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ক্ষুধার্ত গরুটিকে এক মুঠো আহার দেয়নি হিন্দু জমিদার, ব্রাহ্মণেরা। আর একজন মুসলমান হয়েও এই গল্পের গফুর নিজে না খেয়ে তার মহেশকে খাইয়েছে। এর থেকেও বড় কথা হিন্দু জমিদার, ব্রাহ্মণদের দ্বারা দরিদ্র মুসলিমরা কতটা নির্যাতিত হত তা স্পষ্ট হয়েছে এই গল্পে।

স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের গল্পেই সবচেয়ে বেশি মুসলিম প্রসঙ্গ এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই এসেছে তা। তাঁর অধিকাংশ গল্পের কাহিনির কেন্দ্রে আছে মুসলিম চরিত্র ও মুসলিম পরিবারের সমস্যা। নজরুলের মুসলিম জীবন নিয়ে লেখা উল্লেখ করবার মতো গল্পগুলি হল, ‘ব্যথার দান’ ‘হেনা’ ‘ঘুমের ঘোরে’ ‘রিক্তের বেদন’ ‘মেহেরনেগার’ ‘সালেক’ ‘স্বামীহারা’ ‘পদ্মগোখরো’ ‘জিনের বাদশা’ ‘অগ্নিগিরি’ ‘শিউলি মালা’ ইত্যাদি। প্রথমদিকের গল্পগুলিতে প্রেমাবেগ প্রাধান্য পেয়েছে। সেখানে মুসলিম মানস তেমন ফুটে ওঠেনি। তবে অপেক্ষাকৃত পরে লেখা গল্পগুলিতে মুসলিম পরিবার, সমাজজীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। বিশেষ করে গ্রামীণ মুসলিমদের প্রসঙ্গ। প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, মাদ্রাসা শিক্ষা, ধর্মীয় আচার আচরণ ইত্যাদি।

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম লেখক সৈয়দ মুজতবা আলি। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও তাঁর বহু গল্পে ইসলামিক জীবন-পরিবেশের একটা আবহ উঠে এসেছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের থেকে পূর্ববঙ্গীয় মুসলিমদের জীবনচর্যার আভাস তাঁর গল্পে বেশি করে পাওয়া যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁর ‘নোনা-মিঠা’ গল্পটির কথা। সিলেটের মুসলিম খালাসিদের কথা এসেছে এই গল্পে। এই সময়ের আর একজন মুসলিম লেখক কাজী আবদুল ওদুদ। বিখ্যাত প্রাবন্ধিক ওদুদ প্রথমদিকে কিছু গল্পও লিখেছিলেন। সেগুলি মুসলিম জীবন নিয়েই লেখা। যেমন তাঁর ‘করিম পাগলা’ গল্পটি।

রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে মুসলিম প্রসঙ্গ বিশেষভাবে এসেছে তারাশংকর, বিভূতিভূষণ, অচিন্ত্যকুমার ও নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখায়। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নারী ও নাগিনী’, ‘ইমারত’, ‘রাঙাদিদি’, ‘কামধেনু’, ‘কান্না’, ‘যাদুকরের মৃত্যু’, ‘যাদুকরী’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘বিস্ফোরণ’, ‘আফজল খিলোয়াড়ী ও রমজান শের আলি’ ইত্যাদি গল্পে এসেছে মুসলিম প্রসঙ্গ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আহ্বান’, ‘ফকির’, ‘বারিক অপেরা পাটি’, ‘গল্প নয়’, ‘অন্তর্জলি’ ইত্যাদি গল্পে আছে মুসলিম জীবন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘ওষুধ’,‘ডাকাত’, ‘তসবির’, ‘ঘর’, ‘সরবানু ও রোস্তম’, ‘সারেঙ’, ‘দাঙ্গা’, ‘নুরবানু’, ‘জমি’, ‘যতনবিবি’, ‘বস্ত্র’, ‘স্বাক্ষর’, ‘টান’, ‘বাঁশবাজি’, ‘বিড়ি’, ‘কেরামত’, ‘মাটি’, ‘নতুন দিন’, ‘কেরাসিন’, ‘মুন্সি’, ‘জাত-বেজাত’, ‘খেলওয়ালী’, ‘বেদখল’ ‘জনমত’, ‘সাহেবের মা’ ইত্যাদি গল্পের কেন্দ্রে আছে গ্রামীণ মুসলিম জীবনের নানান প্রসঙ্গ। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’, ‘চাঁদ মিঞা’, ‘পালঙ্ক’, ‘সোহাগিনী’, ‘তুফানী’, ‘পুনশ্চ’, ‘দ্বিরাগমন’, ‘কেরামত’, ‘ভুবন ডাক্তার’,‘বন্যা’ ইত্যাদি গল্পেও গ্রামীণ মুসলিমদের প্রাত্যহিক জীবনের কথাই প্রাধান্য পেয়েছে। এই চারজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে মুসলিম জীবন নিয়ে অনেক গল্প লিখেছেন। এঁদের লেখায় সমকালের গ্রামীণ মুসলিমদের কথা জানা যায়। এঁরা সকলেই গ্রাম-জীবনকে ভালো করে চিনতেন। গ্রামীণ মুসলিমদের জীবন চর্চার সঙ্গেও নিবিড় পরিচয় ছিল তাঁদের। কর্মসূত্রে অচিন্ত্যকুমারকে বাংলাদেশের বহু জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। প্রচুর মুসলিম পরিবারের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়েছে। তাঁর গল্পে সেই অভিজ্ঞতাই উঠে এসেছে। বস্তুত সমকালে আর কারও গল্পে এভাবে মুসলিম জীবন উঠে আসেনি।

এছাড়াও মনোজ বসুর ‘হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা’, রমেশচন্দ্র সেনের ‘সাদা ঘোড়া’, বনফুলের ‘তাজমহল’, কালী নাগের ‘ইতিহাসের ধারা’, সোমেন চন্দের ‘দাঙ্গা’ ইত্যাদি গল্পে এসেছে মুসলিম অনুষঙ্গ। এঁদের অনেকের লেখাই উঠে এসেছে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে। দাঙ্গা নিয়ে কম গল্প লেখা হয়নি বাংলায়। তারাশংকরের ‘কলিকাতার দাঙ্গা ও আমি’, রমেশচন্দ্রের ‘সাদা ঘোড়া’, অচিন্ত্যকুমারের ‘স্বাক্ষর’, মনোজ বসুর ‘হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা’ ও ‘একটি দাঙ্গার কাহিনী’, সোমেন চন্দের ‘দাঙ্গা’, কালীনাগের ‘ইতিহাসের ধারা’ ইত্যাদি গল্পগুলির বিষয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। এ প্রসঙ্গে এখানেই উল্লেখ করা যেতে পারে পরবর্তীকালে রচিত সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পটির কথা। এই গল্পটিও দাঙ্গা নিয়ে লেখা।

হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাংলায় বহু আগে থেকে হচ্ছে। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে সিলেট শহরে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধেছিল মহরমের তাজিয়াকে কেন্দ্র করে। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর কলকাতার চাঁদনিতে দাঙ্গা ঘটেছিল দুর্গাপুজোর নবপত্রিকাকে গঙ্গা থেকে স্নান করিয়ে ফেরার সময়। ১৮৯১-তে দাঙ্গা বাধে শ্যামবাজারে একটি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে। এরপর থেকে বাংলার মাটি বহুবার রক্তাক্ত হয়েছে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ফলে। তবে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর দাঙ্গাটি ঘটে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। এই দাঙ্গার শুরু হয়েছিল কলকাতায় কিন্তু পরে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। আর স্বাধীনতা পররবর্তী সময়ের মারাত্মক দাঙ্গা ১৯৬৪-র দাঙ্গা। স্বভাবতই ভয়বহ দাঙ্গা বাংলার মানুষের সমাজ-অর্থনীতিতে যেমন প্রভাব ফেলেছে তেমনি প্রভাবিত করেছে বাংলা সাহিত্যকেও। তারই প্রমাণ উল্লেখিত গল্পগুলি। বহু উপন্যাসেও উঠে এসেছে এই দাঙ্গার রক্তাক্ত চিত্র।

মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ ধীরে ধীরে প্রবল হয়ে উঠলেও এর সূত্রপাত বহু আগেই। নানাভাবেই বাংলার মুসলমানরা বঞ্চিত হয়ে এসেছেন। এই প্রসঙ্গে জাহিরুল হাসান একটি লেখায়[১৫] ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাইয়ের কলকাতার ফারসি সংবাদপত্র ‘দুরবিন’-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন আমাদের সামনে এনেছেন। প্রতিবেদনটির অর্থ এরকম—

“বড়ো-ছোটো সমস্ত রকমের চাকরি মুসলমানদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অন্য জাতের লোকদের বিশেষ করে হিন্দুদের দেওয়া হচ্ছে।...সম্প্রতি সুন্দরবন কমিশনারের অফিসে কিছু পদ খালি হওয়ায় উক্ত রাজকর্মচারী সরকারি গেজেটে এই মর্মে বিজ্ঞাপন দেন যে এইসব পদে হিন্দু ভিন্ন আর কাউকে নেওয়া হবে না।”

পরবর্তী সময়েও এই ধারা সমানে চলেছে। বাংলার বহু মুসলমানই তাঁদের নিজেদের বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করবার তাগিদে ইংরেজদের আনা বঙ্গ-ভঙ্গ প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। সমাজের এলিট শ্রেণীর মুসলিমরাই উদ্যোগী হয়েছিলেন এক্ষেত্রে। মুসলিম লিগ গঠনের পেছনেও ছিলেন এই এলিট মুসলিমরা। উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁদের মধ্যে বহু মুসলিমই ছিলেন উর্দুভাষী। গ্রাম-বাংলার সাধারণ দরিদ্র বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে তাঁদের তেমন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করতেন তাঁরাই।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ককে যথেষ্ট খারাপ করেছিল। পরে ’৪৬-র দাঙ্গা এই সম্পর্ককে আরও খারাপ করে। হিন্দু মুসলিম একে অপরকে শত্রু ভাবতে শুরু করে। ইংরেজরা কাজে লাগায় এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে।

১৯৪৭-এ দেশভাগ। দেশভাগের পরে পূর্ব-পাকিস্থান থেকে যেমন প্রচুর হিন্দু শরণার্থীরা আসেন পশ্চিমবঙ্গে। তেমনি প্রচুর মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে গেলেন পূর্ব-পাকিস্থানে। এই প্রবাহ স্বাধীনতার পরেও চলে প্রায় দুই দশক ধরে। শিক্ষিত আর্থিকভাবে সচ্ছ্বল মানুষরাই সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়লেন। আর সংখ্যালঘু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে যে সমস্ত মুসলিম পরিবারের মানুষরা থেকে গেলেন তাঁদের অধিকাংশই অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল, শিক্ষার দিক থেকেও পিছিয়ে পড়া। ফলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে সমাজ-অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল তা স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে আরও বেড়ে গেল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা ছোটগল্পে তারই পরিচয় পাওয়া যাবে।

স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে যেমন বাংলা সাহিত্যে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব বড় কম ছিল, তেমনি স্বাধীনতার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্যক্ষেত্রে মুসলিম লেখকদের খুব বশি দেখা যায়নি, এবং অ-মুসলিম লেখকদের লেখায় তেমন করে মুসলিম প্রসঙ্গ আসেনি। তার একটা কারণ হয়তো এটাই যে হিন্দু পাঠকরা মুসলিমদের জীবন নিয়ে লেখা পড়বে কিনা সে বিষয়ে লেখকদের সন্দেহ ছিল। শুধু লেখকদের নয়, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সম্পাদকদেরও এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। ফলে ছোটগল্পে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জীবন তথা মুসলিম মানস ব্যাপকভাবে আসতে অনেকটা সময় লেগেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের এই আলোচনায় স্বাধীনতার কয়েক দশক পরে লেখা গল্পগুলিই প্রাধান্য পাবে।


সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষ। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে এই জেলার গ্রামীণ আবহে।এই অঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। তাঁর গল্প-উপন্যাসে সেই প্রেক্ষাপট ঘুরে আসে বারবার। ইতিহাসের পদধ্বনি শোনা যায় তাঁর লেখার পাতায় পাতায়। তাঁর গল্পে উঠে আসা মুসলিম মানসেও সেই সুর।

খানদানি মুসলিম পরিবারে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা তাঁর। মুর্শিদাবাদের এই খানদানি মুসলিম পরিবার তাঁর অনেক গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। যেমন, তাঁর ‘জুলেখা’[১৬] গল্পটি। কেন্দ্রীয় চরিত্র জুলেখা নিজে খানদানি পরিবারে না জন্মালেও সে বড় হয়েছে খানদানি পরিবারে। সেই পরিবারের আদব কায়দায় অভ্যস্ত সে। পদ্মাপারের এলাকা থেকে দরিদ্র মানুষরা দলবেঁধে আসত অন্নের জন্য সফরে। তাদের বলা হত মুসাফির। সেই মুসাফিরদের দলছাড়া হয়ে দু-বছরের শিশু জুলেখাও এসেছিল মায়ের সঙ্গে। উঠেছিল গল্পের কথক অঞ্জুমান—অঞ্জুর বাড়িতে। রাতে দলিজঘরের বারান্দায় আশ্রয় পেয়েছিল তারা। সেখানেই ভেদবমিতে মারা যায় তার মা। অঞ্জুর দয়ালু দাদুর কৃপায় সেই বাড়িতেই থেকে যায় সে। এতটুকু মেয়ের চুলের বহর দেখে দাদুই নাম রেখেছিল ‘জুলেখা’—কেশবতী।

তার থেকে সাতবছরের বড় জুলেখার স্নেহে ভালোবাসায় বড় হয়ে ওঠে অঞ্জু। একসঙ্গে খেলে ঘুমোয়। এভাবে তার শরীরও কিছুটা চিনে ফেলে অঞ্জু। নাস্তিক বাবার ঔদাসীন্যে একটু বেশি বয়সে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় অঞ্জুর খৎনা হয়। তখন তার সেবা করে জুলেখা। ধীরে ধীরে বিয়ের বয়স হয়। কিন্তু লেখাপড়া না জানায় খানদানি পরিবারের বিয়ের সমস্যা হয় তার।

এর মধ্যে অঞ্জুর রিটায়ার করা রাশভারী জাঁদরেল প্রাক্তন ডেপুটি মামা আসেন তার বাড়িতে। তিনি এলে সাজো-সাজো রব পড়ে যায়। শুধু বাড়িতে নয়, সারা অঞ্চলে। ডিসিপ্লিন, পরিচ্ছন্নতা, ধর্মীয় আদব কায়দা নিয়ে সর্বদা মাথা ঘামাতেন তিনি। নানান গঠনমূলক কাজে তৎপর ছিলেন। রিটায়ার করার পর সেই তৎপরতা একান্তভাবে মুসলিম সমাজমুখী হয়ে যায়। তিনি একে বলেন ‘কওমি খিদমত’ অর্থাৎ জাতির সেবা।

এতদিন জুলেখার বিয়ে না হওয়ায় চিন্তিত হন তিনি। তিনি বিপত্নীক। ছেলেরা দেশভাগের পরে পাকিস্তানে। শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় জুলেখার। অঞ্জুও আটকাতে পারে না এই বিয়ে। সে জুলেখাকে বলে যে সে বড় হলে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু সম্পর্কে ফুফু হয় জানিয়ে অঞ্জুর মুখে হাত চাপা দেয় জুলেখা। বিয়ের আগেরদিন রাতে জুলেখা আদরে আদরে অস্থির করে অঞ্জুকে—“শিগগির-শিগগির তুমি বড়ো হয়ে ওঠো। সোনার ছেলেটা! তুমি যদি বড়ো হতে, কে সাহস পেত আমাকে বিয়ে করার?”

ডেপুটি মামা অঞ্জুর জীবন থেকে তার জুলেখাকে মুছে দেন। অঞ্জুর একটি প্রিয় কুকুর ছিল। সেই কুকুর কালুকেও কেড়ে নেন। তিনি এসে প্রথমদিন কুকুর দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন—“ইসলামি শাস্ত্রে আছে, কুকুর পোষা না-জায়েজ (অসিদ্ধ)। বিল্লির ঝুটো বরং পাক, কিন্তু যে-বাড়িতে কুকুর থাকে, সে-বাড়িতে রাতবিরেতে ফেরেশতা (দেবদূত) ঢোকে না।” তিনিই ব্যবস্থা করেছিলেন কুকুর তাড়ানোর।

এই গল্পে প্রাসঙ্গিকভাবে মুসলিম পরিবারের আরও নানান অনুষঙ্গ এসেছে। যেমন, মুসলিম কুমারীদেরও ঘোমটা দেওয়া নিয়ম। তাই জুলেখা ঘোমটা এঁটে যেত ডেপুটির কাছে। স্ত্রীলোকদের কণ্ঠস্বর বাড়ির বাসরে পৌঁছনো বারণ। শরিয়ত মতে শাড়ি পরতে হয়। ডেপুটি আসার কয়েকদিন আগে থেকে অঞ্জুর মা তারই অভ্যাস করতেন। তাঁকে কেন্দ্র করে খানদানি পরিবারের নারীদের সুখদুঃখের কথাও এসেছে গল্পে। শোবার ঘরের দেওয়ালে ছবি ঝুলিয়ে রাখতেন তিনি। পত্রিকা থেকে রঙিন ছবি ছিঁড়ে বাঁধিয়ে রাখতেন। এর কারণ হিসেবে লেখক বলেছেন—“স্বপ্নাচ্ছন্ন এক মুসলিম যুবতী, বাইরে পৃথিবীতে যার পা ফেলা বারণ, সে বাইরের পৃথিবীর রূপরসশব্দগন্ধস্পর্শ অনুভব করার জন্য নিজের ঘরে তাকে প্রতিফলিত করতে চাইতো।”

খৎনার প্রসঙ্গও এসেছে। অঞ্জুকে খৎনার পরে খিড়কির ঘাটে জলে নামিয়ে হাতের তালুতে জল ঠেলে-ঠেলে ক্ষতস্থানে ঢেউয়ের ঝাপটানি দিত জুলেখা। দ্রুত ঘা সেরে যাওয়ার জন্য এটাই ছিল প্রচলিত পদ্ধতি।

‘একটি অনুসন্ধান’[১৭] গল্পটি একটি মুসলিম নারীর পীরান হওয়ার গল্প। আঙ্গুরা নাম তার। তার বাপ ছিল চোর। আর মা কুড়ুনি। আঙ্গুরাকে তিনবার বিয়ে দিয়েছিল তার বাপ। তিনবারই তালাক খেয়েছে সে। তারপর বুড়া নৈমুদ্দি বিয়ে করতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মরতে হয়েছে তাকে আঙ্গুরার হেঁসোর আঘাতে। আসলে আঙ্গুরা প্রেমে পড়েছিল প্রহ্লাদ নামে এক হিন্দু যুবকের। প্রহ্লাদও পড়েছিল প্রেমে। বৃদ্ধ প্রহ্লাদ সেই প্রেম কাহিনি শুনিয়েছে গল্পের কথককে। “যৈবন হিঁদু-মোছলমান মানে না!” আঙ্গুরবালা তাকে বলেছিল অন্য কোথাও চলে যেতে। কিন্তু প্রহ্লাদের তখন বিয়ে করা বউ ঘরে। একটা ছেলেও হয়েছে।

তারপরই আঙ্গুরা পীরান হয়ে যায়। মাথায় জটা। একা একা থাকত জঙ্গলে। ভর করত তাকে। মুসলমানরা বলত জিনে ধরেছে, হিন্দুরা বলত মা কালীর ভর। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই আসত তার কাছে। তার মাজারেও আসে মানুষ। সেখানে এখন কমিউনিস্ট পার্টির লোকদের দাপট। পার্টির লোকজনদের অন্যায় অত্যাচারের কথাও এসেছে এই গল্পে। তাদের সেখানে মেলা বসার আয়োজন চলে। বাঁধানো হয় মাজার। সার্বিক অবক্ষয়রোধে বিশেষত হিন্দু-মুসলিম মৈত্রী সম্পর্ক পুনরাদ্ধারের জন্য এই প্রয়াস তাদের। কারণ, “মা আঙ্গুরা ছিলেন হিন্দু-মুসলিম সবার শ্রদ্ধাভাজন মহিলা।”

এই আয়োজন যখন চলছে মাজারে তখন প্রহ্লাদ শুনিয়েছে তার অসমাপ্ত প্রেমকাহিনি। একদিন রাতে লুকিয়ে সেও গেছিল আঙ্গুরাকে দেখতে। আঙ্গুরা তখন পিরান হয়েছে। প্রহ্লাদ দেখে আঙ্গুরা মানুষের মতোই খাচ্ছে। কুকুরের ডাকে সে বুঝতে পেরেছিল প্রহ্লাদের আসার কথা। চেঁচিয়ে সে তখন বলেছিল—“লুকোছাপা ক্যানে রে আবাগির পুত? আসবি? তো কাছে আয়। ওরে! আমার আর কি সে যৈবন আছে? শুকনো নদীতে সাঁতার কাটবি? বালিতে ঘষা খেয়ে লোহু ঝরাবি? ওরে নম্পট! সুদিনে আসিসনি ক্যানে? ভরানদীতে ভাসতিস...।” ক্রমে তার কথা পরিণত হল খিস্তিতে। দুকানে আঙুল চেপে দৌড়ে চলে আসে প্রহ্লাদ। তার মনের মধ্যেও যে একটা লম্পট আছে তা বুঝতে পেরেছিল আঙ্গুরা।

নৈমুদ্দিকে খুন করার কারণ জানতে চাইলে প্রহ্লাদ বলে—“যৈবন যৈবনকে বুকে ধরে। নৈমুদ্দি ছিল আঙ্গুরার প্রায় বাপের বয়সী।” তখন গ্রামে আরও অনেক যৌবন ছিল। কিন্তু তাদের সাহস ছিল না—“সাহস বিনে যৈবন কি যৈবন, বলুন?”

আসলে প্রহ্লাদ নিজেও সাহসী ছিল না। সেই অর্থে যৌবন ছিল না তার মধ্যেও। সেদিন একটু সাহস দেখালে আঙ্গুরাকে পীরান হতে হত না। মানুষের মতো বাঁচতে পারত সে। তাকে যে পীরান সেজে থাকতে হল তার মূলেও সেই মুসলিম সমাজে প্রচলিত তালাক ব্যবস্থা। বারবার তালাক খাওয়ার পর যুবতী আঙ্গুরার কাছে ভালোবেসে সেদিন কেউ এগিয়ে আসেনি। পুরুষ তার মর্জি অনুসারে আঙ্গুরাকে তালাক দিয়ে সরিয়ে না দিলে এই হাল হত না তার।

‘মৃত্যুর ঘোড়া’[১৮] গল্পে জীবন ও মৃত্যুর পারস্পরিক সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন লেখক। এগল্পের কথক শৈশবের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী সময়ে ন-বছর বয়সের সেই অভিজ্ঞতা মনে পড়বে বারবার। আর সেই স্মৃতি ফিসফিসিয়ে তাকে বলবে—“তোমার যাত্রা তোমার পূর্বপুরুষের অভিমুখে!”

এই গল্পের কথকের দাদু ছিলেন মুসলমান সমাজের ধর্মগুরু মৌলানা। শিষ্যদের বাড়িতেই ঘুরে বেড়াতেন। কথকের ঠাকুমা মৌলানার শেষ বউয়ের মৃত্যুর পর তিনি আর বাড়ি আসতেন না। তাঁর মৃত্যুও হয়েছিল বাড়ি থেকে দূরে। সে খবর এনেছিল একজন চাষা। তার পায়ের আঙুলগুলো হাজাধরা ফাটা বাঁকাচোরা। হাতের আঙুলগুলোও হলদে, বিশ্রী ধরনের। মৌলানার ইচ্ছে ছিল তাঁর নাতি নিজের ভিটের মাটি নিয়ে কবরে দেবে। সেই কারণে লোকটির আসা। তার সঙ্গে গল্পের কথক ভিটের মাটি নিয়ে চলে। সারাদিন মাঠ নদী নালা পেরিয়ে ঢুকে পড়ে অন্ধকার জগতে। সেই পথেরই বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। অন্ধকারে এতদূর হেঁটে আসার পর বালকটি যখন প্রায় ক্লান্ত, তখনই লোকটি আলগোছে কাঁধে তুলে নেয় তাকে। বালকটি বসে থাকে চুপচাপ। সে ধীরে ধীরে গতি বাড়ায় তার। তারপর ঘোড়ার মতো দৌড়োতে শুরু করে। অন্ধকার রাতের মাঠ কুয়াশা ঢাকা গ্রাম পেরিয়ে এগিয়ে যায় কবরের উদ্দেশ্যে—

দৃশ্যহীন কালো দুনিয়ায় কেবল চিৎকার করছিল কিছু পেঁচা, কতিপয় শেয়াল আর হাজার লক্ষ কোটি—সংখ্যাহীন পোকামাকড়েরা। কিছুক্ষণ পরেই মাথার ওপর নক্ষত্রময় আকাশটাও ঢেকে গেল। তখন যেন একটা অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করলাম আমরা। আমি কেশর-ফোলানো ধাবমান একটা গলা জড়িয়ে সেঁটে রইলাম। একহাতে ঠাকমার রেশমী শাড়ির টুকরোয় বাঁধা দাদুর ভিটের কিছু মাটি। সাঁত সাঁত করে সারা জীবজগৎ সসম্ভ্রমে দু-পাশে সরে সরে যেতে থাকল।

গতিময় সেই চলা থেকে পরবর্তীকালে রেহায় পাননি গল্পের কথক। ন-বছর বয়সেই জীবন ও মৃত্যুর পারস্পরিক সম্পর্কটা টের পেয়েছিলেন তিনি।

প্রাসঙ্গিকভাবে মুসলিম সমাজের কিছু বিষয়ও উঠে এসেছে গল্পে। যেমন মুসলিম ধর্মমতে একসঙ্গে চারটে বউ রাখা যায়। এই গল্পের মৌলানা চারটে হিসেবে দুবার, দুটো একবার এবং শেষে একজনকে বিয়ে করেছিলেন। শেষের বউ ছাড়া সকলেরই মৃত্যু হয়েছিল বিদঘুটে রোগে। শেষজন অর্থ্যাৎ কথকের ঠাকুমা হিন্দু ছিলেন। তাঁকে ডাইনী বলে মারধর করা হয়েছিল। সেই সময় মৌলানা ঐ পাড়ায় ছিলেন শিষ্যের বাড়িতে। আহত যুবতীকে উদ্ধার করেছিলেন। আর তা করতে গিয়ে দাঙ্গাও বেধেছিল। শেষ পর্যন্ত মামলা পর্যন্ত হয় মৌলানাকে আসামী করে। দাঙ্গার জন্য নয়, এক হিন্দু যুবতীর প্রতি লাম্পট্যের কারণে।

সেই মৌলানাকে এবং আদালতসুদ্ধ সকলকে অবাক করে দিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যুবতীটি বলেছিলেন—“ধর্মাবতার—মৌলানা আমার ইচ্ছানুসারে আমায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছেন এবং সাদি করেছেন।”নিরুপায় হয়ে এমনটা করতে হয়েছিল তাঁকে। তিনি জানতেন তাঁর নিজের ধর্মের মানুষ বাঁচতে দেবে না তাঁকে। মুসলমান হলে ডাইনী অপবাদে মরতে হবে না। নিজের ধর্ম বাঁচতে দিল না। মুসলমান বাঁচাল। মৌলানা আদালত থেকে ফিরেছিলেন নতুন বউকে নিয়ে। হিন্দু কুসুম হল কুলসুম। হিন্দুদের বাড়ি, মুসলমানের বাড়ি—এই প্রবাদ একই সঙ্গে মিলে গেল মৌলানার পরিবারে। তেইশ কি পঁচিশ বছরে কুলসুম বাহান্ন কি পঞ্চান্ন বছরের মৌলানাকে ভক্তি করতেন খুব। তিনি স্বামীর কাছে আরবি ফারসি কেতাব পড়া, কোরান পড়া শিখেছিলেন। হাদিস সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান হয়েছিল তাঁর।

তাঁর ‘বুঢ়াপীরের দরগাতলায়’[১৯] একটি বিখ্যাত গল্প। খাটিয়ে পুরুষ বৃন্দাবন অন্ধ হওয়ার পরে গ্রামের বাইরে জনহীন এই দরগাতলায় এসে বসে। ভিক্ষে করতে লজ্জা করে তার। মেজ ছেলে নির্মলকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসে। ক্বচিৎ কোনও লোক দরগাতলায় সিন্নি চড়াতে এলে সেও প্রসাদ পায়। মানুষের শব্দে বুলি আওড়ায় বৃন্দাবন—“পীরবাবার দয়া লাগে, অন্ধকে একটা দুটো পয়সা।” আর নির্মল কাঠবিড়ালির সঙ্গে অথবা একা একা গাছ-পাতার সঙ্গে খেলে বেড়ায়। মাঝে মাঝে বাপের কাছে ছড়া শোনার বায়না ধরে।

একদিন এই দরগাতলায় সম্ভ্রান্ত এক হাজিসাহেব আসেন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে। তাঁরা মানত করেন। সিন্নি চড়ান। লোকটিকে হাঁ করে দেখে নির্মল। ‘জোহর’ নামাজের সময় ওজু করার জল নিতে পুকুরে গিয়ে দেখেন কাদা। নির্মলকে বলেন বদনাটা নিয়ে জল তুলে আনতে। পয়সার লোভও দেখান। ধীরে ধীরে জল তুলে দেয় সে। তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নামাজ পড়া দেখে। তারপর দেখে লোকটা দরগার ঢিবিটার সামনে কান্নাকাটি করছে। এর আগে এখানে কাউকে কাঁদতে দেখেনি সে।

হাজি সাহেব তার সঙ্গে আলাপ জমান। নাম শুনে একটু হকচকিয়ে যান—হিঁদুর ছেলের হাতের পানিতে অজু করেছেন! খোদাতালার গোঁসা হবে না তো? তিনি সিন্নি দেন নির্মলকে এবং তার বাবা বৃন্দাবনকে। বৃন্দাবনের সঙ্গে গল্প করেন। কথা প্রসঙ্গে জানান তিনি নিঃসন্তান। তাঁর বিবিজানেরও চোখে পড়ে ছেলেটিকে। ভালোও লাগে। খাওয়ার সময় নির্মলকেও খাওয়াতে চান। ধর্মের কথা মাথায় রেখে হাজিসাহেব বৃন্দাবনকে বলেন—“খোদা-ভগমানের দুনিয়ায় খাদ্যর কুনো জাত নাই আছে কি? তুমার ছেলেটাকে কিঞ্চিৎ হালুয়া পরোটা দিই?”

বৃন্দাবন সম্মতি দিয়ে ডাকপুরুষের বচন শোনায়—“জাত—খেলে যায় না, বুললে যায়।” বাপছেলে দুজনেরই জোটে মসলার গন্ধমাখা হালুয়া পরোটা। নির্মলকে আদর করে খাওয়ান বিবিজান। খাওয়ার পরে জঙ্গলে একা একা খেলছিল নির্মল। হাজিসাহেব সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে খেলতে মজা পেয়ে যান। তার মায়ায় পড়ে যান। বৃন্দাবনকে জানানও সেকথা। তারপর চেয়ে ফেলেন তাকে—“আমার ঘরে ব্যাটা নাই বেন্দাবন। যার ব্যাটা নাই, তার কী আছে? তুমার ছেলেটা দাও।”

বেন্দাবন ভেবে পায় না কী বলবে। একটু পরে জানতে চায় দত্তক নেবেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেন—“আমার ধম্মেতে দত্তক নাই বেন্দাবন। তবে কথা কী, সব সম্পত্তি ছেলেটার নামে দানপত্রকরব। তাতে আটকাবে না।” গৃহস্থবাড়িতে কদিন পরে রাখতে হবে নির্মলকে। সেইভাবে রাখতে চান হাজিসাহেব। তা শুনে সে আমতা আমাতা করে বলে যে সেখানে মাইনে কড়ি বছরে পায় লোকে।

বৃন্দাবনের হাতে পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দেন। মাঝে মাঝে তাঁর বাড়িতে গিয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করে টাকাপয়সা নিয়ে আসতে বলেন। নির্মল চলে যায় হাজিসাহেবের সঙ্গে। বৃন্দাবন ভাবে—“বেচে তো দিইনি। গেরস্থবাড়ি রাখতেই হত—নেহাত কদিন আগে আর পরে বলে কথা। ছেলেটা ভালই থাকবে। শুধু গাঁয়ের কাউকে না বললেই হল যে মোছলমানের বাড়ি আছে।”

বাড়ি ফিরে স্ত্রী সুখেশ্বরীকে বলে না প্রথমে। পরে সে টাকা দেখতে পেয়ে জানতে চাইলে হাজিসাহেবের কথা বলে। সেই টাকায় সে বিড়ির মসলা কিনে বিড়ি বাঁধবে। ভিক্ষে করতে লজ্জা করে তার।

এরপর বুড়াপীরের দরগাতলায় বসে বিড়ি বাঁধে সে। সুখেশ্বরী তাকে সেখানে বসিয়ে দিয়ে যায় সকালে। বিকেলে এসে নিয়ে যায়। বিড়িবিক্রির টাকায় অন্নের সুরাহাও হয়। মাস যেতে না যেতেই মায়ের মন টাটায় নির্মলের জন্য। ছেলেটাকে দেখতে তল্লাস করে পাঁচক্রোশ পথ হেঁটে যায় রূপপুর-কাঁকসা গ্রামে। কিন্তু সেই গ্রামে গিয়ে শোনে সেটা হিন্দুর গ্রাম। সেখানে কোনও হাজিসাহেবের বাস নেই। মা ছেলের জন্য কাঁদে শুধু।

বৃন্দাবন বোঝে হাজিসাহেব সেজে এক ছেলেধরা এসেছিল। নিয়ে গেছে তার ছেলেকে। বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে সে ভাবে একদিন তার ছেলে ফিরে আসবে তাকে নিতে। মোছলমানের বাড়িতে সে যাবে না বললে আলাদা বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার কথা বলবে নির্মল।

বুঢ়াপীরের দরগাতলায় কাঠবেড়ালির শব্দ, ঘুঘুর ডাক শুনতে পায় বৃন্দাবন। দুচোখের কোণায় জলের ফোঁটা নিয়ে বিড়ি বাঁধে সে। আর “তার পিছনে এক অদৃশ্য বালক দিনমান আপনমনে খেলে বেড়ায়। তার গায়ের গন্ধ ভেসে থাকে বাতাসে। বেন্দাবন ঠিকই টের পায়। শ্বাস টেনে বুঢ়াপীরের উদ্দেশে বলে, সাক্ষী থেকো বাবা! আমার অন্ধের নড়িটাকে দেখো। সুহালে রেখো তাকে, যেখানেই থাক।...”

নিঃসন্তান হওয়ার হাহাকার এখানে উঠে এসেছে মুসলমান হাজি সাহেবের মধ্যে। আর তার হাত থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে এই মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছে তাঁকে। যাতে করে নির্মলকে হারাতে না হয় তাই বৃন্দাবনের কাছে মিথ্যে ঠিকানা দিয়েছেন। তিনিও তাঁর সমাজে একইভাবে লুকোবেন। এই ছেলে যে হিন্দু ধর্মের তা বলবেন না। বৃন্দাবন ও হাজি সাহেব একইভাবে আড়াল করবে সন্তানের জন্মগত ধর্ম। হাজি সাহেব অবশ্যি নির্মলকে ধর্মান্তরিত করতে পারবেন। বৃন্দাবন দারিদ্রের কারণে ছেলেকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে। আর হাজিসাহেব একটা সন্তানের জন্য এত কাণ্ড করেছেন। ধর্ম এখানে ম্লান। দারিদ্রের কাছে ধর্ম ম্লান হয়েছে। আর সন্তানহীনতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার কাছেও ম্লান হয়ে গেছে ধর্মবোধ।

সিরাজের একটি বিখ্যাত গল্প ‘গোঘ্ন’[২০] বাঘড়ী অঞ্চলের এক মুসলিম গাড়োয়ান—হারাইয়ের গল্প। স্বামী-স্ত্রী দুজনই তার বলদদুটো—ধনা-মনাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে। রাঢ়মুলুকে সে ভিক্ষে করতে আসে না। খন্দ-ফল-মূল-সবজির বদলে এদেশ থেকে ধান নিয়ে যায়। মরশুমে বাঘড়ী অঞ্চল থেকে সদলবলে আসে তারা। কিন্তু গল্পের ঘটনা ধানের সময়ের নয়, ফাল্গুনে। রাঢ়ের চারু মাস্টারের মেয়ের বিয়ে। চারু মাস্টারের বেহালায় মুগ্ধ হয়ে হারাইয়ের ভাই দোলাই কথা দিয়েছিল, মাস্টারের মেয়ের বিয়েতে যত কুমড়ো কলাই লাগে সব দেবে। কিন্তু বিয়ের আগেই কবরে গেছে দোলাই। ভাইয়ের দেওয়া কথা রাখতে এসেছিল হারাই।

আর এখান থেকে ফেরার পথের ঘটনা নিয়েই গল্প। একটা গোরু ধনা অসুস্থ হয়ে পড়ে চারু মাস্টারের বাড়িতে থাকা কালীন। রাস্তায় সানকিডাঙায় গাড়ি রেখে পিরমিল হাড়ি কোবরেজকে দেখাতে বলে। সন্ধের আগে সেখানে পৌঁছে পিরমিলের কাছে ওষুধ নিয়ে ধনাকে দেয়। পিরমিল তাকে জানায়, যে গাছে ধনাকে বেঁধেছে সেই ডালে ইসমিল নামের একজন আত্মহত্যা করেছিল। এখান থেকে চলে গিয়ে রাতটা মেদীপুরের বাজারে জিরেন নিতে বলে। সেই মতো হারাই মেদীপুরের রাস্তায় পা বাড়ায়। ধনাকে গাড়ির পেছনে বাঁধে। তারপর মনাকে ডাইনের জোয়ালে জুতে দিয়ে নিজে বাঁ-দিকের জোয়াল ধরে বুকের সঙ্গে ঠেকিয়ে টানে।

অন্ধকারে পথ যেন শেষ হয় না। অনন্ত যাত্রা করছে যেন। গাড়ি টানতে টানতে বুড়ো হয়ে যায় সে। একসময় একজন মানুষের দেখা পায়। সেও মুসলমান। দিলজান নাম তার। সে ধনাকে দেখে বলে যে বাঁচবে না। এখন বিক্রি করলে সে কিনে নিতে পারে। তাতে হারাইয়েরই লাভ। তিরিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত দাম দেয় দিলজান। কিন্তু হারাই সাফ জানায়—“আপনি হামার কলজে কিনে লেন, দিব। ধনা হামার বড় কষ্টের ধোন! হামার বহু ধনাকে বেটার মতন পেলে বড় করেছে।” অনেক চেষ্টা করেও দিলজান ধনাকে কিনতে পারে না।

অনেক রাতে হারাই পৌঁছোয় মেদীপুরে। বিশ্রাম নেয় সেখানে। চারু মাস্টারের কাছ থেকে পাওয়া সোনার ধানের কিছুটা বিক্রি করে চিড়েগুড় সংগ্রহ করে খায়। পরদিন সকালে ধনার অবস্থা আরও খারাপ হয়। শুকনো ঘাসে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে নামাজ পড়ে। হুহু করে কেঁদে বলে—“হামার বেটার জান মাঙি হুজুর। আর কিছু মাঙি না সংসারে।...হেই পরোয়ারদিগার! হামরা মাগমরদ বাঁজা লই তুমার মেহেরবানিতে। তুমি এক ব্যাটার জানের বদলে হামারঘে আরেক ব্যাটার হায়াত (আয়ু) দাও!” এই উচ্চারণ চমকে দেয় আমাদের। নিজের সন্তানের বিনিময়ে তার পালিত বলদের জীবন ভিক্ষে করে খোদাতালার কাছে।

মেদীর বাজারে লোকজন বলদের অবস্থা দেখে তাকে বেচে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। দিলজান হাজির হয় সেখানেও। আজ আর পঞ্চাশ টাকা নয়, তিরিশ টাকা গুঁজে দেয় হারাইয়ের হাতে। টাকা হাতে নিয়ে বসে থাকে সে। দুচোখ দিয়ে জল গড়ায় শুধু।

আবার সে যাত্রা শুরু করে মনাকে একদিকে, নিজেকে গাড়ির একদিকে জুতে। ভট্টমাটির মাঠে পৌঁছোলে বদর হাজির দেখা পায়। দয়ালু হাজি সব কথা শুনে রাতে তার বাড়িতে থাকার কথা বলেন। বাঘড়ীর একদল গাড়োয়ান এসেছে তাঁর বাড়িতে, রাতে যাত্রা করবে তারা। তাদের সঙ্গে যাওয়ার পরামর্শ দেন হাজি। দস্তরখানায় রাতে খেতে ডাকেন হাজি সাহেব তাকে। মৌলবি হাজির সঙ্গে খেতে বসে হারাই। আমির বড়লোকদের সঙ্গে জীবনের প্রথম সে খাচ্ছে। জীবনের সব দুঃখ, বঞ্চনা, হারানোর শোক, ক্ষোভ আর ধনার মৃত্যুর কথা ভুলে গেল সে।

স্বাদু সুগন্ধি ভাত। একটা প্রকাণ্ড চীনেমাটির পাত্র থেকে কী একটা তুলে হাজি সাহেব মৌলবিকে দেন, হারাইকেও দেন। খেতে খেতে হাজি বলেন এই গ্রামের প্রায় সব লোকই ‘পরোজি’—গোরুর গোশতো খায় না। হিন্দু জমিদারের মাটিতে হালাল হয় না। মাঝে মাঝে মেদীপুরে হালাল হলে লুকিয়ে চুরিয়ে কেউ কেউ এনে খায়। তারপর বলেন—“আমার ভাগ্নেব্যাটা একেবারে গো-খাদ (খাদক)। আজ হাটবার ছিল। দিলজান একটা হালাল করেছে শুনে নিয়ে এসেছিল। তা দেখছি, ভালই হল। আপনি আছেন। আর এই আমার মেহমান বেটা আছে। মেহমানেরও খাতির হল।”

হারাই সবে এক টুকরো মুখে পুরেছিল। চমকে ওঠে সে। বাইরে এসে ওয়াক তোলে। সে ভাঙা গলায় বলে—“হাজিসাব! হামাকে হারাম খাওয়ালেন!” মৌলবি গর্জে ওঠেন হালালকে হারাম বলার জন্য। সে কানে তোলে না কথা—“হামাকে হামারই বেটার গোশতো খাওয়ালেন! হেই হাজিসাব! হামার ভেতরটা জ্বলে খাক হয়ে গেল গে! এক-পদ্মার পানিতেও ই আগুন নিভবে না গো।” মৌলবি শোনান হাদিসের নির্দেশ—“হালালকে হারাম, আর হারামকে হালাল করে যে, তার পিঠে চল্লিশ কোড়া (কশা) মারো!” জবাই করা প্রাণীর মতো ধড়ফড় করে হারাই।

হাজি সাহেবের বাড়ির গাড়োয়ানরা অন্য জায়গায় যাবে। একা একা সে আগের মতো চলে বাড়ির উদ্দেশ্যে। নক্ষত্রভরা আকশে ভেসে ওঠে বাড়ির ছবি। সেখানে তার বউ বদনায় পদ্মার পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধনা-মনার পা ধুইয়ে দেবে বলে।

সাধারণভাবে গোরু মুসলমানদের প্রিয় খাদ্য। কিন্তু এখানে দেখছি হারাই গোরুকে ভালোবাসে সন্তান স্নেহে। আমাদের মনে পড়বে শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পের গফুরের কথাও। সেও মহেশকে সন্তানের মতো ভালোবাসত। কিন্তু এখানে হারাই নিজের একটা সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে গোরুর প্রাণ ভিক্ষা করেছে। পশুর সঙ্গে মানুষের মানবিক সম্পর্কের গল্প বাংলায় অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু হারাই এখানে যেভাবে তার প্রিয় বলদের প্রাণভিক্ষা করেছে খোদার কাছে, তার তুলনা পূর্বাপর কোনও গল্পে পাওয়া যাবে না।

‘দিওজেনিসের মৃত্যু’[২১] গল্পের নায়ক মহতাব মানুষটি আর পাঁচজন মুসলমানের মতো নয়। মুসলিম সমাজের একজন একঘরে মানুষ। সে জুম্মাবার তো দূরের কথা, ইদের পরবেও নামাজ পড়ে না। সবাই যখন সেজেগুজে ইদের নামাজ পড়ার জায়গায় যাচ্ছে তখন সে বাড়ির সামনে নিমতলায় বসে হুঁকো টানছে। খোঁচা-খোঁচা গোঁফ-দাড়ি, এলোমেলো চুল, পরনে লেংটির মতো একটুকরো কাপড়। প্রান্তিক চাষী সে। তবু খাদ্যাভাব নেই বাড়িতে। একাই থাকে। বিয়ের পরদিনই সে বউকে তালাক দিয়েছিল বছরের শস্য একদিনে খাবার অপরাধে। বোন নহলার বাড়ি গ্রামেই তবু তাকে মেলাপার্বনে আলাদা করে ডাকে না। নহলার জামাই একবার নিজের চোখে পরী দেখার কথা বলতে মহতাব নতুন জামাইকে ছুঁড়ে ফেলেছিল পচা পুকুরে।তার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে লেখক বুঝেছিলেন, নিরক্ষর মানেই কুসংস্কারের ডেঁপো কিংবা ভূত ও ভগবানে বিশ্বাসী, একথা মনে করার কারণ নেই। আসলে বিশ্বাস-অবিশ্বাস মানসিক গড়নের ওপর নির্ভর করে।

এই মহতাবের মৃত্যুই গল্পের বিষয়। তার মৃত্যুটা ভয়ংকর রকম হবে বলে ধারণা ছিল অনেকের। সেই মতো মৃত্যু পথযাত্রী মহতাবকে দেখতে এসেছে সকলে। গল্পের কথকও এসেছেন। তিনি এসে দেখেন— মৌলবি কানের কাছে কোরান পড়ে শোনাচ্ছেন। নহলা পাশে বসে আছে। মহতাব হঠাৎ করে মৌলবিকে চুপ করতে বলে। কারণ, তার কানে খুব বাজছে এই শব্দ। বেওকুফ বান্দার কথা শুনে মৌলবি তাড়াতাড়ি চলে যান সেখান থেকে। মোড়ল জানতে চান সে পর-দুনিয়ার কিছু দেখতে পাচ্ছে কিনা। মহতাব সাফ জবাব দেয় যে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। মোড়লও থাকে না আর। নহলা বারবার করে ব্যাকুল হয়ে বলে, “মাফ মেঙে লাও ভাই সবার কাছে!” মহতাব বলে যার কাছে মাফ চাইত সে আর নেই। কে জানতে চাইলে সে কোনও রকমে বলে নামুপাড়ার ওহিদের কথা। পীরপুকুরের পাড়ে বাঘের কথাও বলে। তারপরই মারা যায় সে।

মহতাবকে দেখে লেখকের মনে হয়েছে গ্রিক দার্শনিক দিওজেনিসের কথা। সেও তেমন পণ্ডিত ছিল না। অথচ জীবনের মৌলিক ব্যাপারে সহজ সত্যটা বলত অকপটে। মহতাব এবং দিওজেনিস দুজনেই ছিল সিনিকের মতো। দিওজেনিসের মৃত্যুর পরে তার যে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেই মূর্তি ছিল কুকুরের।

ওহিদের মৃত্যু হয়েছিল বাঘের কামড়ে। এরপর ওহিদের বউয়ের কাছে যান লেখক। তার কাছ থেকে জানতে পারেন যে, ওহিদকে চালাকি করে পাকুড়তলায় বাঘের মুখে পাঠিয়েছিল মহতাব। মধুভাঙার নেশা ছিল ওহিদের। পীরপুকুরের পাড়ে বাঘটাকে দেখে এসে মহতাব তাকে মিথ্যেমিথ্যি বলেছিল মৌচাক দেখে আসার কথা। বউটি বুঝেছিল তখনই। তাকে বিয়ে করবে কথা দিয়েছিল মহতাব। কিন্তু পরে করেনি।

এই প্রেম কাহিনির সঙ্গেও দিওজেনিসের প্রেমের কাহিনির মিল পেয়েছেন লেখক। করিন্‌থের রাজকুমারী ইডোরো প্রেমে পড়েছিল দিওজেনিসের। কিন্তু ইডোরার বিয়ে হয়েছিল সেনাধ্যক্ষ দিয়াত্রুসের সঙ্গে। একদিন একটা ষাঁড় ক্ষেপে বহু নরহত্যা করে জিউসের মন্দিরে আশ্রয় নেয়। দিয়াত্রুসের সঙ্গে দিওজেনিসের দেখা হলে সে ঠাটটা করে বলে, তার মতো একজন কুকুরের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর দিয়াত্রুসের উচিৎ জিউসের মন্দিরে গিয়ে নিজেকে শুদ্ধি করা। তখনই সেখানে সে যায়। এবং ষাঁড়ের হাতে মৃত্যু হয় তার। পরদিনই দিওজেনিস করিন্‌থ ছেড়ে পালায়। ইডোরার সঙ্গে আর দেখা হয় না তার। দিওজেনিসের প্রেমে পড়ার মতো তার মৃত্যুর ব্যাপারটাও বড় রহস্যময় এবং নিন্দনীয়। তাই শহরের স্তম্ভের উপরে কুকুরের মূর্তি বসিয়ে তলায় লেখা হয়েছিল দিওজেনিসের নাম।

মহতাবের সম্পর্কেও মানুষ খারাপ ধারণা নিয়ে থাকবে। কুকুরের মূর্তি তার নামে বসানো না হলেও কুকুরের মতো মানুষের মনে তার প্রতি ঘৃণা জেগে থাকবে। লেখক অবশ্য দিওজেনিসের সঙ্গে তার তুলনা করে তাকে সম্মানিত করতে চেয়েছেন। একজন নিরক্ষর মুসলমান হয়েও যে উদার, সাহসী, নাস্তিক হওয়া যায় মহতাব তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখা গল্পের পরিমাণ কম নয়। কিন্তু মুসলিম জীবন নিয়ে লেখা গল্পের সংখ্যা তুলনায় বেশ কম। মুসলিম জীবন নিয়ে লেখা গল্প-উপন্যাস ছাপতে প্রথম থেকেই অনাগ্রহ ছিল বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলির। সে কারণে দেখা যাচ্ছে সৈয়দ মুজতবা সিরাজের লেখায় মুসলিম জীবন সেভাবে আসেনি। অথচ তাঁর গল্পে মুসলিম-জীবনেরই প্রাধান্য পাওয়া সঙ্গত ছিল। পাঠকরা গ্রহণ করবে কি-না এই ভয় যেমন ছিল তেমনি পত্রিকায় প্রকাশের ক্ষেত্রেও সমস্যা ছিল বইকি। তাই তাঁর লেখায় বড় কম এসেছে নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনচর্যার কথা। অবশ্যি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এই সম্পর্কে বলেছেন যে তিনি আলাদা করে মুসলিম জীবনকে তাঁর লেখায় তুলে ধরতে চাননি। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তিনি মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন। আলাদা করে মুসলিম জীবনকে প্রাধান্য না দেওয়ার মূলে হয়তো আর একটি কারণও ছিল। তিনি যে কাগজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর অধিকাংশ গল্প যে সব পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হত সেই সব পত্রিকায় সাধারণভাবে মুসলিম জীবন নিয়ে লেখা ছাপা হত না। সিরাজ রাঢ়-মুর্শিদাবাদের প্রকৃতি পরিবেশের সঙ্গে সেখানকার মানুষদের কথাও বলেছেন তাঁর গল্প-উপন্যাসে। সেই মানুষদের মধ্যে হিন্দু যেমন আছে তেমনই আছে মুসলিমরা। তারই সূত্রে কিছু কিছু গল্পে মুসলমান জীবনের ঘটনাও বিষয় হয়ে উঠেছে। সেরকমই কিছু গল্পের নিরিখে তাঁর গল্পে প্রতিভাত মুসলিম মানসের পরিচয় তুলে ধরা হল এখানে।


তথ্যসূত্র :

[১] সুধীর চক্রবর্তী, ‘পথে চলে যেতে যেতে’, ‘বারোমাস’, শারদীয় ২০০৯, পৃ-২২১

[২] যোগনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘বঙ্গ অভিধান’, এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রা লি, পৃ-৮৩

[৩] অরুণ সেন, ‘মুসলমান বাঙালির কণ্ঠস্বর’, ‘কোরক’, বইমেলা ২০১১, পৃ-১৯

[৪] অরুণ সেন, ‘মুসলমান বাঙালির কণ্ঠস্বর’, ‘কোরক’, বইমেলা ২০১১, পৃ-১৯

[৫] মিলন দত্ত, ‘তাহাদের কথা’, গাঙচিল, ২০০৫

[৬] শেখ আতাউর রহমান, ‘বাংলা কথাসাহিত্য : মুসলিম চরিত্র পরিবার ও সমাজ’, বাংলা একাডেমী ঢাকা, জানুয়ারি ১৯৯১, পৃ-২৯৬

[৭] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘দালিয়া’, গল্পগুচ্ছ, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বৈশাখ ১৩৯৮, পৃ-৫১

[৮] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘দালিয়া’, গল্পগুচ্ছ, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বৈশাখ ১৩৯৮, পৃ-৫৪

[৯] ‘ক্ষুধিতপাষাণ’, ঐ, পৃ-২৭৮

[১০] ‘দুরাশা’, ঐ, পৃ-২৯৮

[১১] ‘দুরাশা’, ঐ, পৃ-৩০২

[১২] ‘মুসলমানীর গল্প’, ঐ, প্রৃ-৭৪৭

[১৩] শেখ আতাউর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ-৪

[১৪] রমেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, ‘রবীন্দ্র-সমীপে’, মাসিক মোহাম্মদী, আশ্বিন ১৩৪৪। শেখ আতাউর রহমান তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে প্রসঙ্গটির উল্লেখ করেছেন। তারই অনুসরণে বিষয়টির অবতারণা করা হল এখানে। ‘বাংলা কথাসাহিত্য : মুসলিম চরিত্র পরিবার ও সমাজ’, পূর্বোক্ত, পৃ-২৯৬

[১৫] ‘রাজনীতি ও দেশভাগের আবর্তে মুসলিম সমাজ’, জাহিরুল হাসান, ‘বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর’, পূর্বা, ২০১১

[১৬] ‘জুলেখা’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, দে’জ, পৃ-

[১৭] ‘একটি অনুসন্ধান’, ‘গল্প সমগ্র’, ৪র্থ খণ্ড, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, করুণা প্রকাশনী, ১৯৯৬, পৃ-২২

[১৮] ‘মৃত্যুর ঘোড়া’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, পূর্বোক্ত, পৃ-

[১৯] ‘বুঢ়াপীরের দরগাতলায়’, ‘শতবর্ষে শতগল্প’, তৃতীয় খণ্ড, সম্পাদনা-সাগরময় ঘোষ, বঙ্গবানী,এপ্রিল-১৯৯৮, পৃ-৪০

[২০] ‘গোঘ্ন’, ‘গল্প সমগ্র’, পূর্বোক্ত, পৃ-৬৪

[২১] ‘দিওজেনিসের মৃত্যু’, ঐ, পৃ-১৬২


(চলবে)



(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)