ISSN 1563-8685




একজন আধ্যাত্মিক নায়িকার কথা

দীর্ঘ ৩৬ বছর নিজেকে অন্তরালে রেখে অবশেষে বিদায় নিলেন সুচিত্রা সেন। সুন্দরী মোহময়ী আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া একজন অভিনেত্রী কোন মনের জোরে এতদিন সমস্ত মিডিয়ার হাতের বাইরে, ফটো লেন্সের বাইরে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন? এর একমাত্র উত্তর — আধ্যাত্মিক জগতের ডাকে।

আমার সুযোগ হয়েছিল কুড়ি বছর টালিগঞ্জের সিনেমা-টিভির জগতে মেলামেশার। অভিনেতা অনিল চ্যাটার্জী, পরিচালক অসিত সেনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে অনেক আলোচনায় আমি সবসময় অন্য এক সুচিত্রা সেনকে আবিষ্কার করতাম।

পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় সুচিত্রা সেনকে সঠিক বর্ণনা করেছেন। তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা আর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। আর ছিল অসম্ভব আত্মসম্মানবোধ। রসবোধও ছিল গভীর। প্রয়োজনের বাইরে একটাও বাড়তি মন্তব্য করতেন না। যে কোন চরিত্রকে অনায়াসে নিজের মত করে তৈরী করে নিয়ে সেই সঙ্গে মিশিয়ে দিতেন তাঁর প্রবল ব্যাক্তিত্ব।

সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। দিবানাথ সেনের রাগের বহিঃপ্রকাশ তাঁকে দাবড়ে কুঁকড়ে রাখতো। বড়লোকের ছেলে টাকা নয়ছয় করে শেষে রমাকে নিয়ে গিয়ে সিনেমায় নামাতে যান। যখন সিনেমায় নাম করতে শুরু করলেন তখন সন্দেহ এবং রোজগেরে বৌয়ের সঙ্গে চিরকাল অশান্তি করে এসেছেন তাঁর স্বামী। পাবনার সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে বিয়ে করে কলকাতার অভিজাত পরিবেশে এসে এমন সাংসারিক অশান্তির মধ্যে পড়লেন, যে সে তাঁর নিজস্ব জগত তখন থেকেই তৈরী করতে শুরু করেছিলেন। তখন থেকে একমাত্র শান্তির জায়গা ছিল তাঁর ঠাকুরঘর। রামকৃষ্ণ শ্রীমা'র ছবি সম্বলিত নানান দেবদেবতার ছবি নিয়ে ঠাকুরঘরে গিয়ে মনের সমস্ত অশান্তি দূর করে শান্তি খুঁজতেন তিনি। সেই আধ্যাত্মিক শান্তি থেকে তিনি পেয়েছিলেন এক অসম্ভব মনের জোর, এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস, এক অসাধারণ আত্মসম্মানবোধ। যখন তিনি একনম্বর মোহময়ী লাস্যময়ী দাপুটে রোমান্টিক নায়িকা, তখনো তাঁর জগৎ ছিল নিঃসঙ্গ। একমাত্র মেয়ে ছাড়া তাঁর সম্বল ছিল ঠাকুরঘর। সেই জগৎটাই ছিল তাঁর আসল জগৎ।

তাই, সবছেড়ে নিজের আধ্যাত্মিক জগতে ৩৬ বছর কাটাতে তাঁর একটুও কষ্ট বা দুঃখ হয়নি। তিনি শান্তিতেই ছিলেন এই জীবনটায়।

নিঃসঙ্গতা সুচিত্রা সেনকে কখনো ছেড়ে যায়নি। টালিগঞ্জে চুটিয়ে সুটিং করে তিনি বাড়ী ফিরে আসতেন। মেয়ে যখন বাইরে পড়াশোনা করত, তখন তিনি নিঃসঙ্গ ঠাকুরঘর নিয়েই থাকতেন। শিল্পী সংসদের এক অনুষ্ঠানে হেমন্তর সুরে উত্তমের সঙ্গে গান গাওয়া, মস্কো ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী হওয়ার পর একটা পার্টিতে যাওয়া ছাড়া উনি খুব একটা পার্টি কখনো করেননি।

ওনার অসম্ভব ব্যাক্তিত্বের সামনে সবাই বেশ ভয়ে ভয়েই থাকতেন। সুরসিকা ছিলেন, উত্তমকুমারকে এত 'লেগ পুলিং' করতেন যে উত্তমকুমার বেশ নার্ভাস থাকতেন ম্যাডাম সেনের সঙ্গে সুটিং থাকলে। ওঁর রসিকতায় পর্যুদস্ত হননি এমন সহযোগী অভিনেতা পরিচালক কমই আছেন। কিন্তু যা কিছু ঐ সেটের আওতার ভেতরে, বাইরে নয়।

তারপর ১৯৭৬-৭৭এ ওঁনার চোখের একটা অসুখ ধরা পড়ল। তাঁর চোখ দুটো বেশ বড় বড় দেখতে লাগতো। 'প্রণয়পাশা' ছবিতে সেই চোখের চেহারায় পরিবর্তন দেখা গেছিল এবং সেটা তাঁর সুন্দর মুখের অভিব্যক্তিতে ব্যাঘাত করছিল। এটার জন্যও উনি ঠিক করেছিলেন চোখ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আর কাজ করবেন না।

সেই যে আত্মগোপনের ব্যাপারটা ঠিক করে ফেললেন, নিজের বাড়ীতেই লুকিয়ে রাখলেন নিজেকে। এর কিছুদিন পর থেকে দক্ষিণেশ্বর বেলুড় যাওয়া শুরু হোল। দীক্ষাও নিয়েছিলেন সম্ভবত। ঠাকুরঘর শ্রীমার ধ্যান, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ নিয়ে আধ্যাত্মিক চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়লেন, এবং অদ্ভুতভাবে মেয়ে নাতনীদের সঙ্গে সুন্দর সাংসারিক ব্যবহারটুকু বজায় রেখে গেছিলেন। তাদের অভিনয় জীবন নিয়ে খোঁজখবর নিতেন, উপদেশ দিতেন, ভালখারাপ নিয়ে আলোচনা করতেন। বাড়ীর বাগান ফুলগাছ নিয়ে সকালটা কাটিয়ে দিতেন।

সুচিত্রা সেনের ফিরে আসার কোন দরকার আছে বলে কখনো মনেই হয়নি। বয়েস হয়েছে কি চুল পেকে গিয়েছে এগুলো কোন ব্যাপারই ছিলনা তাঁর কাছে। ওঁনার গোটা জগৎটাই পালটে গিয়েছিল। আগেকার দিনের মানুষেরা তো কাশীবাসী হতেন, দেওঘরে চলে যেতেন। এর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। মাঝে মাঝেই মিডিয়ার কিছু অতি উৎসাহী সাংবাদিক তাঁর আড়াল-রাখা চেহারাটাকে বাইরে দেখাবার জন্য অযথা খবর তৈরী করতে গিয়ে আরও বিরক্ত করেছেন তাঁকে।

একজন আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ মহিলা যিনি একসময় ডাকসাইটে সুন্দরী অভিনেত্রী ছিলেন এবং ৩৬ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে ধ্যানমগ্না ছিলেন, এটাই থাকুকনা মনে।



(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)