ভূতচতুর্দশী; উদয়নারায়ণ সিংহ; প্রথম প্রকাশ: ২০১২, কারিগর - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ১৩৪; ISBN:
ভূত নিয়ে মানুষের আগ্রহের সীমা নেই। শরীর পঞ্চভূতে লীন হয়ে গেলেও মানুষের আত্মার বিনাশ হয় না। সেই আত্মাই কর্মদোষে পুনর্জন্ম বা মুক্তি না-পেয়ে ভূত হয়ে বিচরণ করে পৃথিবীতে। কায়া না-থাকলেও ছায়া হয়ে কখনও কখনও দৃশ্যমান হয় জীবন্ত মানুষের কাছে। সেই ছায়া সবসময় যে নিরীহ হয় তা' নয়, বরং তার ভৌতিক অঙ্গভঙ্গী বা কঙ্কালমূর্তি কিংবা পৈশাচিক হাসি রাতের অন্ধকারে মানুষের বিভীষিকার কারণ হয়ে ওঠে। তার লম্বা হাত পথের পাশের শ্যাওড়া গাছ থেকে নেমে এসে মানুষের ঘাড় মটকে পর্যন্ত দিতে পারে। ভূত এভাবেই প্রবেশ করেছে লোককথায় আর ছেলেভোলানো গল্পে। তারপর একসময় ভূতের গল্প পাকাপাকিভাবে অধিকার করে বসেছে সাহিত্যের একটা এলাকা। ছোটোদের সঙ্গে বড়োরাও মেতেছে গা-ছমছম করা রসের আস্বাদনে। বাংলায় যশস্বী লেখকদের প্রায় সকলেই লিখেছেন ভূতের গল্প, রবীন্দ্রনাথও বাদ পড়েন নি। ক্ষুধিত পাষাণ, মণিহার, কঙ্কাল তার সাক্ষী।
গ্রামের নগরায়ণ আর শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ভূতকে বাস্তুচ্যুত করেছে। ত্রৈলোক্যনাথ লিখেছিলেন, 'যেমন জল জমিয়া বরফ হয়, তেমন অন্ধকার জমিয়া ভূত হয়।' সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারময় জনমানবহীন পথঘাট এখন গ্রামে নেই, শহরে নেই হানাবাড়ি। তাই বাংলাসাহিত্যে ভূতের চরিত্র বদলেছে। ভূত ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় সর্বভূতে। এই পরিবর্তনের সূত্রপাত পঞ্চাশ ষাট বছর আগে। পাঠকরা মনে করতে পারেন হেমেন্দ্রকুমার রায়ের 'কঙ্কাল সারথি', যেখানে কলকাতার রাজপথেই বেশি-রাত্রির বাসের প্যাসেঞ্জার দেখতে পায় ড্রাইভারের সিটে সমাসীন এক কঙ্কাল। কিংবা শিবরাম চক্রবর্তীর 'সমগোত্র', যেখানে দার্জিলিং-এ জলাপাহাড়ের দৃশ্য উপভোগরত দুজনেই অশরীরী, কিন্তু সেটা পরস্পরের কাছে অজ্ঞাত। এই দুটি গল্পের অবতারণা এজন্যেই যে এদের পটভূমি ছিল গভীর রাত্রির পরিবেশ, কিংবা জলাপাহাড়ের নির্জনতা। সাম্প্রতিককালের ভূতেরা সেই নির্জনতাটুকুও পায় না। তাই ভূতের ভবিষ্যৎ ভেবে সিনেমা হয়, গল্পেও ভিড় জমায় আম-আদমি আদলের ভূতেরা। আলোচ্য বই-এর গল্পগুলোর ভূতেরাও চেহারায় মানবিক। চরিত্রেও বহুলাংশে তাই, অবশ্যই কিছু অলৌকিকতার মিশ্রণে। দুটি গল্পে রয়েছে মনুষ্যেতর ভূতেরা, একটিতে অজৈবিক বর্ণমালার ভূত।
'ভূতচতুর্দশী'তে রয়েছে চৌদ্দটি গল্প। কোনোটিতে খোকাখুকু ভূত প্ল্যানচেট করে মানুষকে আসরে নামিয়েছে, কোনোটিতে শাশুড়ি-বউ ভূত মানুষের বাড়িতে নতুন বউকে লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচাতে তার শাশুড়ি ননদকে ভৌতিক দাওয়াই দিয়েছে, কোনোটিতে চ্যাংড়া ভূতের শাস্তি জুটেছে সন্ন্যাসী ভূতের হাতে, কোনোটিতে বর্ণিত হয়েছে দুই কমবয়েসি ভূতের মানুষ হয়ে ফিরে এসে স্কুলে হেনস্তা হবার কাহিনি। একটি গল্পে কথক ভূত এক আজগুবি গল্পের আসরে ঘুমিয়ে-পড়া খোকাকে সঙ্গী করে নিয়ে উলটপুরাণের দেশ থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে। আর একটি গল্পে ভূতের ওঝা হবার জন্যে পরীক্ষা দিতে বসে পরীক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষ করে জলজ্যান্ত ইনভিজিলেটরকে টেবিলে ছবি হয়ে যেতে। ডিটেকটিভ প্রবর ব্যোমকেশ কিরীটি লালমোহনবাবুকেও ভৌতিক ধাঁধার মধ্যে ফেলেছেন লেখক একটি গল্পে। একটি গল্পে লেখক এক গাধাকে টেনে নিয়ে গেছেন ভুতুড়ে ঘোড়ার দেশে, একটিতে এক মোরগভূতের বাস্তবতা থেকে পালাতে গিয়ে ট্রাকের তলায় পড়ে শিকার হবার কাহিনি। ভূতের সমাজে পোকাভূত মায় কমপিউটার ভাইরাসকে ভূত হিসেবে আমদানি করে লেখক নতুন ভূতের সংযোজন ঘটিয়েছেন। বিদেহিনী প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমের কথা বলতে না-পেরে জনৈক সুনীল স্যারের মৃত্যু আর একটি গল্পের উপজীব্য।
বিষয়বৈচিত্র্যে গল্পগুলি ঋদ্ধ। গল্প বলার ভঙ্গীতে লেখক সাবলীল, কিন্তু সরল পথের অনুসারী নন। বাস্তব আর পরাবাস্তবের বুনট খুলতে পাঠককে প্রয়াসী হতে হয় মাঝেমাঝেই, যেটা চিরাচরিত ভূতের গল্প থেকে আলাদা করে গল্পগুলিকে একটা আধুনিক মাত্রা দিয়েছে। অনেকগুলি ছড়া যোগ করা হয়েছে গল্পের সাথে, এবং সচেতনভাবেই সেগুলোকে উদ্ভট বা হেঁয়ালি করে তোলা হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলি চর্যাপদের সন্ধ্যাভাষা পর্যায়ে চলে গেছে। এগুলির প্রয়োগ সর্বত্র যথার্থ হয়েছে বলে সব পাঠক গ্রহণ না-করতেও পারেন, তবে 'শাশুড়ি আর বউভূতের ছড়াগুলির চাপানউতোরের শ্লেষ নিঃসন্দেহে উপভোগ্য হয়েছে। এমনই এক নমুনা :
বেগুণে গুণ না চেনে রে মুষা চেনে বিড়ালি অপ্রেমী কি পিরিত চিনে কাঠ কি চেনে কুড়ালি?
লেখক একজন সুপরিচিত শিক্ষাবিদ এবং ভাষাবিদ। বাংলা ভাষায় বানান সংস্কারের গুরু বিষয়টিকে লঘু চালে পরিবেশন করেছেন মুন্সিয়ানার সঙ্গে তাঁর 'ঋ-কারের আর্তনাদ' গল্পে। গল্পটি অবশ্যই অন্য গল্পের থেকে আলাদা। ৯-কার তো ভূত হয়েই গেছে, অনুস্বার (ং) এবং বিসর্গও (ঃ) খানিকটা সেই পথে। তবে 'ঋ-কার' সম্পর্কে কি সেই কথা বলা চলে? হৃদয়, কৃপা, সমৃদ্ধি ইত্যাদিকে তো হ্রিদয়, ক্রিপা, সম্রিদ্ধি লেখা শুরু হয়নি। কিংবা বাংলার বাইরে ওড়িয়া বা মারাঠিতে হ্রুদয়, ক্রুপা, সম্রুদ্ধি? তবে এই ঋ-কারের প্রসঙ্গে লেখক এক ঝুড়ি ঋ-আদ্য শব্দের সমাবেশ ঘটিয়েছেন এক প্যারাগ্রাফে — ঋজু, ঋষি, ঋক মন্ত্র, ঋক্থ, ঋক্ষ, ঋণাত্মক, ঋদ্ধ, ঋতানৃত, ঋতুনাথ, ঋভু, ঋষ্যশৃঙ্গী, ঋষ্ট-দৃষ্টি — যেটা কম মজার প্রাপ্তি নয়।
কয়েকটি শব্দ ব্যবহারের বিষয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথের লেখায় দেখা মিললেও 'কালেজ' কি এখন চলে? 'গাড়ল' গল্পে পাচ্ছি 'এইসব করে যদি মনে হয় শোস' — আফশোস অর্থে 'শোস' প্রয়োগ কি সমীচীন? 'কসাই-কুণ্ডলী' গল্পে 'পারানি' ব্যবহৃত হয়েছে 'পারের কড়ি'র পরিবর্তে 'মাঝি' অর্থে। ছড়ায় 'গুন' লেখা হয়েছে 'গুণের' বদলে নৌকার কাছি বোঝাতে। ওই গল্পেই 'আশেপাশে অশ্লেষে চারদিক জুড়ে ঘুরছে'র অর্থ কী? 'অশ্লেষা বেলা' কি মুদ্রণপ্রমাদে পরিণত হয়েছে 'অশ্লেষা বালা'য়?
গল্পগুলিতে নয়, অবতরণিকার শেষ পংক্তিতে বলা হয়েছে 'এদেরকে ভয় পেতে নেই'। লেখ্যভাষায় দ্বিতীয়া বা চতুর্থী বিভক্তির বহুবচনে 'এদের তাদের আমাদের...' রূপই গ্রাহ্য 'এদেরকে তাদেরকে আমাদেরকে...' আঞ্চলিক প্রয়োগ। এই প্রসঙ্গে 'পরবাস'-এর পূর্ববর্তী কোন সংখ্যায় সৈয়দ কওসর জামাল যথার্থ প্রশ্ন তুলেছিলেন। এ-বিষয়ে পরিমল গোস্বামীর প্রবন্ধ 'শব্দের ব্যবহার ও উচ্চারণ' (বেতার জগৎ সেরা প্রবন্ধ সংকলন, সম্পাদনা অমিত চক্রবর্তী ও কৃষ্ণশর্বরী দাশগুপ্ত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০০) দ্রষ্টব্য।
বইটির মুদ্রণ পরিপাটি, প্রচ্ছদ সুদৃশ্য, অলংকরণ সুচারু। বইটি বহুপঠিত হবার অপেক্ষা রাখে।
(পরবাস-৫৭, জুলাই ২০১৪)