গেস্ট হাউসের কাজে যত ভোরেই উঠতে হোক না কেন ভোপাল সিংকে, ঠিক ছটার সময় ওকে ঝুলা দেবীর মন্দির চত্বর ঝাঁটা মোছা করতে দেখা যাবেই। আর নতুন কেউ রানিখেত বেড়াতে এলে ও কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাদের দেবী মাহাত্ম্য কাহিনী শোনাবেই শোনাবে। যাঁরা শুনবেন তাঁদের কাছে হয়তো নিছক-ই গল্প কথা, কিন্তু ভোপালের মত পাহাড়িয়া কুমায়ুনির জন্যে তাতে সত্যি মিথ্যের কোন ব্যাপারই নেই। সেই ক্যামন করে রোজকার বাঘের ভয়ে কাতর পাহাড়বাসীদের মা স্বপ্নাদেশ দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন, ক্যামনভাবে ঝুলা চেয়েছিলেন নিজের বসার জন্য, আর তারপর সেই থেকে ক্যামন করেই বা আর কোনোদিনই বাঘের উপদ্রব হয়নি ও অঞ্চলে।
এ তো গেল ভোপালের ভোরবেলার টাইমটেবল। বিকেল চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে, ঠিক যখন পাহাড়ের ছায়া গাঢ় লম্বা হয়ে আসে আর কুমায়ুন রেজিমেন্ট মিউজিয়ামের দরজা বন্ধ হয় হয়, তখন ভোপালকে দেখা যায় বাঁকা করে পরা পাহাড়ি টুপি এক হাতে সামলিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে মিউজিয়ামের গেটের দিকে। কাজ হল মিউজিয়ামে রাখা যুদ্ধ ট্রফিগুলো ঝেড়ে মুছে রাখা। আসলে কাজটা তেমন কিছু না, বলা যেতে পারে অজুহাত। দশ ক্লাস অব্দি ওর পড়াশুনো, কিন্তু ইতিহাসের সাথে যেন ওর নিত্যি কথা বলা; আর হবে নাই বা কেন, ওর বাপ-পিতামো তো কুমায়ুন রাইফেলসেই জীবন কাটিয়েছেন, দেশের ওঠা পড়া, ভাঙা গড়ার কাহিনীতে ওঁরা তো বরাবরই সামিল ছিলেন। ব্রিগেডিয়র সাবের বাংলায় ভোপালের মা রসুই করে। মার পেছনে যে ও পড়ে থেকেছে ওই ঝাড়-পোঁছের কাজটার জন্যে সে শুধু ওই ট্রফিগুলো রোজ একবার চোখের দেখা দেখার তাড়ায়। ডাস্টিংএর সময় (ভোপাল ঝাড়া মোছাকে তাই বলে) ও যেন অন্য মানুষ; চোখ দুটো ওর জ্বলজ্বল করে। ভারি শ্রদ্ধায় নরম কাপড় দিয়ে বড় লম্বাটে কাঁচের বাক্সটা পুঁছতে পুঁছতে ভিতরে রাখা ঝাঁসির রানি লছমিবাইয়ের বিরাট ভারি রূপোর রাজদণ্ডটার দিকে তাকিয়ে ও কী সব যেন বিড় বিড় করে। হয়তো কান করলে শোনা যেত ও বলছে ‘রানি তুম হারি নঁহী, দেশ তুমহে চাহতা হ্যায়; জাগো জাগো, হমে জাগাও’। মিউজিয়াম দেখাশুনো করার কর্তারা ওকে লক্ষ্য করেছেন, তবে এমনিতে তো ও শান্ত, ভদ্র--তাই ও নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামায় নি।
মিউজিয়ামের যে দিকটায় কাঁচের শো কেসে অন্য পক্ষের হেরে যাওয়া সৈনিকদের অস্ত্র, যুদ্ধ পোশাক, হেলমেট রাখা আছে সেদিকেও ভোপালের বেশী মন। যুদ্ধে মারা যাওয়া এক সৈনিকের বুক পকেট থেকে পাওয়া একটা উর্দুতে লেখা চিঠি বার বার ক্যামন হাতছানি দেয় ভোপালকে। যত না কাঁচের শো কেস পোঁছে তারও বেশী ওই মনখারাপ করা হলদেটে কাগজের ওপর লেখা, ছেয়ে-ছেয়ে রঙা না-পড়া অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে কি যেন বোঝার চেষ্টা করে ও।
দুটো কাজই ওর অল্প সময়ের। বলা যেতে পারে পার্ট টাইম। গেস্ট হাউসের বড়রা সবাই-ই অত সকালে ট্যুরিস্টদের রুম সার্ভিসে চা-কফি দিতে গররাজি--ওরা বলে ভোপাল ছেলেমানুষ, ও-ই ঝট করে ভোর ভোর উঠে চা দেওয়ার কাজটা করুক, তা ছাড়া আদা গোল মিরিচ দিয়ে পাহাড়ি কড়ক চায় বানাতে ভোপালের মত ওস্তাদ কেউ নেইই; আর মিউজিয়ামের ঝাড়-পোঁছ--সে তো মাত্র আধা ঘণ্টা খুব জোর পয়তাল্লিশ মিনিটের। গেস্ট হাউসের সারা দিনের টুকটাক কাজ, সেও ঠিক মতো হয়ে যায়। তাই রাতে ভোপাল পাহাড়ের গায়ে, একটু নামোনের দিকে নিজেদের ছোট ঝুপড়িতে মা-ইর কাছেই শোয়। যদিও পাহাড়ে বিজলি বাতি এসে গেছে, ওদের ঘরে এখনো কেরোসিনের আলো। আগে ছিল ছোটো নারকেল তেলের টিন কেটে ন্যাকড়ার সলতে পাকানো রেড়ির তেলের কুপো। এখন কাঁচের শেড দেওয়া লম্ফ। তেল-নুন আলুর সাথে একদিন মা-ই খরিদ করে এনেছিল পাকদণ্ডীর গায়ে বসা ছোট বাজার থেকে। মুলো পালং তো ঝুপড়ির পেছনে যেখানটায় রোদ পড়ে সেখানেই উগিয়ে নেয় ওরা।
রাতে রসুই ঘরে মা চাপাটি বানায় আর ভোপাল ইতিহাস বইটা খুলে মাকে কত গল্প-ই না বলে। তার মধ্যে ও সবচেয়ে বেশী পড়ে ওই ঝাঁসির রানি লছমি বাঈয়ের কথা। ও যখন পড়ে ইতিহাস আর ইতিহাস থাকে না, হয়ে যায় এককা ভিনয়। কখনো ঘোড়ায় বসা রানির মত গর্জে ওঠে 'মেরি ঝাঁসি নঁহী দুঙ্গী!’ আবার কখনো অদৃশ্য সব সৈন্যদের তাঁতিয়া টোপি, নানা সাহেবের মত উৎসাহ দেয় ‘ভাইসব বঢ়তে চলো, বঢ়তে চলো, রুকনা নঁহী’। কখনো কখনো সুরেলা গলায় রামায়নি গানও গেয়ে শোনায় মাকে। শ্রীরামের ত্যাগ, লব-কুশের নির্ভীক মন ওকে বড় টানে। ফি বছর দশেরার দিন সাঁঝের বেলা পাহাড়ি পথ ধরে বিশাল কাগজের রাবণ নিয়ে যে জুলুস বেরোয় তাতে ভোপাল রাম সাজবেই, তাই মা ওর বসন্তি ধুতিটা দুরগা মাতার পরব শুরু হওয়ার আগেই নতুন করে হলুদে ছুপিয়ে রাখে, আর ভোপাল হাটিয়া থেকে রাংতা এনে বানায় মাথার তাজ, গলার হার, আর কাঠের তলোয়ারটাও নতুন রাংতা জড়িয়ে নেয়। পাহাড়ি ঘু্রপথে খালি গায়ে লরির মাথায় বসে ভক্তদের ‘জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীরাম’ শুনতে শুনতে আশ্বিন- কার্তিক মাসের সাঁঝের হিমও ওর গায়ে লাগেনা।
ভোপালের রক্ত যে ফুটতে থাকে দেশের জন্য মা সেটা বোঝে। তাই প্রায়ই মা-ই বলে ‘বেটা তু ফৌজ মেঁ ভরতি হো যা’; (মা বেটা দুজনে হিন্দীই বলে, ওরা কুমায়ওনি প্রায় ভুলতেই বসেছে)। আর তখনই ভোপাল ক্যামন যেন মনমরা হয়ে পড়ে। চোখে ভাসে মিউজিয়ামে কাঁচের বাক্সে রাখা ওই মলিন চিঠিটা। সৈনিক পুত্র ভোপাল, দেশই প্রাণ দেশই মান-এর পাঠ মার জঠরে থাকতেই ওর পড়া হয়ে গিয়েছে। মার দুধ টানতে টানতে সে পাঠ ওর যেন আরো রপ্ত হয়েছে। কিন্তু ওই চিঠি---? ও যেন ভোপালকে টেনে রাখে এক সিপাহীর জীবন থেকে! হয় জান নেওয়া নয় জান দেওয়া—এ ছাড়া কি সৈনিকের আর কোনো পরিচয় থাকতে নেই? সেই নাম না জানা যোদ্ধা নিজের ওয়াতনের জন্য জান দিয়েছে, এই তার পরিচয়, আর যে ভিনদেশের মাটিতে সে মারা গেল সেখানে সে শুধু বিজিত এক শত্রু! কেউ ভাবেনি কার চিঠি ওটা। মাকে লেখা, নাকি পথ-চাওয়া কোনো বহু-বেটিকে! ও কল্পনায় ঠাউর করার চেষ্টা করে। আজ ওটা ধূসর, সেদিন যখন মনের কথায় ভরপুর তাজা ছিল, বাক্সে রাখার আগে কেউ কি পড়েছিল চিঠিটা? অত মাথাব্যথা কারো ছিল কি! চিঠি তখন পরাজিত, মৃত সৈনিকের কাছ থেকে জিতে নেওয়া বিজেতার প্রাপ্য। তাছাড়া উর্দু পড়ার কেউ ছিল না বোধহয়, নাম না জানায় হয়তো ঠিকানায় পৌঁছনোও যায় নি। ঝাঁসির রানির রাজদণ্ড ভোপালকে দেশরক্ষী হতে অভয় দেয়, মৃত সৈনিকের চিঠি অব্যক্ত ভাষায় বলে ‘যেও না ভোপাল, মা-ইকে লেখা তোমার চিঠিও তো এমন ধূসর মলিন কাঁচবন্দী হয়ে থাকতে পারে!’ এত সব ভাবনা মা-ইকে ঠিক বোঝাতে পারে না ভোপাল। চুপ করে থাকে। মার হাতের মোটা চাপাটি পেঁয়াজ, লঙ্কা আর অল্প খানিক সব্জি দিয়ে খেয়ে লম্ফ নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। আলো নিভতেই ছোট খিড়কি দিয়ে আসা রাতের পাহাড়ের কতসব আধ ফোটা শব্দ, মায়া ভরা অস্পষ্ট আলো শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে এক সময় চোখ বুজে আসে, আর সবের মাঝে ভাসে ঝুলা দেবীর প্রসন্ন মুখখানি।
যুদ্ধ প্রাঙ্গনে সশস্ত্র সৈনিক না হলেও দেশরক্ষীর শ্যেন-দৃষ্টি যেন জন্মসূত্রেই ভোপালের ছিল। তাই একদিন রোজকার মত ছুটতে ছুটতে মিউজিয়ামের দিকে যাওয়ার সময় হঠাতই ভোপালের চোখে পড়ল ক্যান্টনমেন্ট ঘেরা দেওয়ালের নীচে একজন কি একটা রাখছে। লোকটাকে দেখে তো মনে হল এলাকার কেউ না। ওর মনটা একটু খচ খচ করে উঠল। একবার ভাবল তুরন্ত ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটাকে ধরে ফ্যালে। কিন্তু তার সঙ্গে যদি অস্ত্র থাকে? একেবারে খালি হাতে এগোনোটা কি ঠিক হবে? সে তো শুধু হিন্দী ছবিতেই সম্ভব। দশ ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই তো ভোপাল বেশ কিছু ছবি দেখেছে, যাদের নাকি বলে অ্যাকশন মুভি। ‘শোলে’ই তো বার তিনেক দেখা হয়ে গ্যাছে। চেঁচিয়ে যে লোক জড়ো করবে—সাঁঝ হব হব, পাহাড়ি রাস্তা এমনিতেই ফাঁকা। তাই আর একটুও সময় নষ্ট না করে আরো জোরে ছুট দিয়ে মিউজিয়ামে পৌঁছেই যে অফিসার ছোট্ট লবিটায় থাকেন, যারা আসেন তাদের নামধাম খাতায় লেখেন, মোবাইল জমা নেন, তাঁকে হাঁপাতে হাঁপাতেই ও কথাটা জানাল। উনি ওর মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে ওকে ওর কাজ করতে বলে মোবাইলে কিছু খবর পাঠালেন। কিন্তু সেদিন আর ঝাড়-পোঁছের কাজ বিশেষ এগোলো না। সিকিউরিটি জিপ এসেই ভোপালকে জায়গা চেনাবার জন্য নিয়ে গিয়ে উদ্ধার করল দেওয়ালের নীচে রাখা একটা তাজা বোমা। অফিসার স্নেহভরে ওর পিঠ চাপড়ালেন।
সাঁঝের খানিক পরে মা-ইর কাছে ওইসব অত তাড়াতাড়ি ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বকবক করতে করতে ভোপাল অন্য দিনের মত ঘুমিয়ে পড়েছিল যদিও রোজের থেকে খানিক দেরিতে। সেই হঠাৎ ঘটনার ঢেউয়ে মা-ইর সাধাসিধে গেরস্থালি খানিক নাড়া খেয়ে গিয়েছিলই। ছেলের জ্বলজ্বলে মুখের দিকে তাকিয়ে চাপাটি কটা বেশি আঁচ পেয়ে পুড়েছিল। সকালে উঠেই ঝুলা দেবীকে পরনাম করতে হবে--এইসব সাতপাঁচ ভেবে হাতের কাজও থেমেছিল কবার।
ছাব্বিশে জানুয়ারীর বীরত্ব পুরস্কারের জন্যে বিগ্রেডিয়র সাব ওর নাম পাঠালেন দিল্লীতে। ভোপাল কিন্তু তখনও তা জানে না। যখন জেনেছিল ওর মনে হয়েছিল পুরস্কার নাহয় হল, কিন্তু এতো ওর ফর্জ, ও যে মনে প্রাণে সৈনিক; দেশ-প্রহরী। সে ঘটনার রাতে আর বাকি আরও আরও রাতে পাহাড়ের আধ ফোটা সব শব্দ আর অস্পষ্ট আলো ওকে ঘিরে রইল, আর ঘিরে রইল দেবীর দুই হাত।
(পরবাস-৫৭, জুলাই ২০১৪)