ISSN 1563-8685




ম্যাজিক

রূপক বার বার দরজার দিকে তাকাতে থাকে। সব কিছু ঠিক থাকলে আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটবে ঘটনাটা। টেবিলের ওপাশে নীপা এক মনে অংকের হিসেব মেলাতে ব্যস্ত। টিউবলাইটের উজ্বল আলো প্রতিদিনের মতো আজকেও সোকেশের ক্রিস্টাল মূর্তিগুলোকে জ্যোতির্ময় করে রেখেছে। ক্লাস টেস্ট আর সেশনালের চাপের মাঝে সময় বাঁচিয়ে পলাশী থেকে টিউশনিতে আসতে আজও এক ঘন্টা খরচ হয়ে গেছে। তবুও রূপক জানে আজকের দিনটি গত কালের মতো নয়, অন্ততঃ তেমন যাবে না।

ঠিক দু' মিনিট বাদে দরজায় ঈষৎ টোকা। এক কাপ চা আর একটা প্লেটে চারটে নাবিস্কো বিস্কুট হাতে বুয়া ভেতরে ঢোকে। রূপক তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বুয়াকে থামতে বলে। বুয়া রীতিমত চমকে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সামান্য চা ছলকে প্লেটের উপর পড়ে। রূপক এবার নীপার দিকে তাকায়।

— তুমি একটু তোমার আম্মা আর আব্বাকে ডাক। আজ একটা মজার জিনিষ দেখাব।

নীপা পরিচিত গোবেচারা শিক্ষককে আজ কেন যেন চিনতে পারে না। ও চিনবে কি? রূপক তো নিজেই নিজেকে চেনে না আজকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে রফিক সাহেব আর মিসেস রফিক রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেন। রূপক গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করে।

—মাননীয় খালু, খালাম্মা। আমার প্রিয় ছাত্রী ও বুয়া। আজ আমি আপনাদের একটা জাদু দেখাব।

সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। রফিক সাহেব ভাবতে থাকেন, এ ছেলেকে দেখে তো কখনো মনে হয় নি মাথার স্ক্রু ঢিলা আছে।

—নীপা, তুমি বল দেখি বুয়ার প্লেটে কয়টা বিস্কুট আছে?

—চারটে – নীপা প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলে।

—তুমি এই বিস্কুটগুলো সম্পর্কে আর কি জান?

নীপা কিছুক্ষণ ভালো করে দেখে। তারপর বলে,

—এগুলো নাবিস্কো কোম্পানির তৈরি।

রূপক হাসে। তারপর বাকি সবাইকে প্রশ্ন করে,

—আপনারা কেউ আর কিছু যোগ করতে চান?

সবাই মাথা নাড়ে।

রূপক একটা অদৃশ্য লাঠি ঘুরিয়ে বিড় বিড় করে তিনবার বলে ‘আব্‌রা কা ডাব্‌রা’। তারপর নীপার দিকে তাকায়।

— নীপা, তুমি প্লেটের কাছে যাও। প্রত্যেকটা বিস্কুট ভাল করে দেখ। তারপর বল নতুন কিছু দেখছ কি না?

নীপা এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখতে থাকে। তারপর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রূপকের দিকে। রূপক হাসে।

—উপস্থিত ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়ারা, প্রত্যেকটি বিস্কুটের পেছনে লেখা রয়েছে “রূপক-বুয়েট”। আপনারা সামনে এসে পরীক্ষা করতে পারেন।

এবার মিসেস রফিক এগিয়ে এসে নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকেন।

রূপক সময় নেয় উপস্থিত জনগণের বিস্ময় কাটাতে। তারপর শুরু করে,

—আমার প্রথম ম্যাজিক। তাই ঠিক করেছি সবাইকে রহস্যটা জানিয়ে দেব। বুয়া, তুমি প্লেটটা এখন টেবিলের ওপর রাখতে পার। বুয়া কাঁপা কাঁপা হাতে প্লেটটা টেবিলের ওপর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

—গত তিন মাস হল নীপাকে পড়াচ্ছি। এখানে পড়াতে আসার পর থেকেই দেখছি আমাকে প্রত্যেকদিন চা আর চারটে করে নাবিস্কো বিস্কুট দেয়া হচ্ছে। আমি চা খাই, কিন্তু বিস্কুটগুলো খাই না। এক দিন কি মনে করে একটা বিস্কুটের একটু কোনা ভেঙে রাখি। পরের দিন সেই কোনা-ভাঙা বিস্কুটটা আবার এলো আমাকে দর্শন দিতে। গত এক সপ্তাহ কোনা-ভাঙা বিস্কুট দেখতে দেখতে বুদ্ধি এলো বিস্কুটগুলোর পেছনে আমার নাম লিখে রাখতে। গত কালই নামগুলো লিখেছি।

মিসেস রফিক মাথা নীচু করে স্বামীর পায়ের নখগুলো দেখতে থাকেন। নখগুলো খুব বড় হয়ে গেছে, কাটতে বলতে হবে। তিনি রূপকের কথায় আবার মাথা তুলে তাকান।

—দেখুন, কাল থেকে আমি আর টিউশনিতে আসব না। ঠিক করেছি এর চেয়ে বরং রাস্তায় রাস্তায় ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াব। রূপক ওর ব্যাগটা টেবিল থেকে তুলে রাস্তার দিকে ফেরে। রফিক সাহেব পেছন থেকে ডেকে ওঠেন,
—আপনার এ মাসের বেতন টা নিয়ে যান।

রূপক ফিরে তাকায়,
—ওটা দিয়ে নতুন টিচারের জন্য এক কৌটা নতুন বিস্কুট কিনে রাখবেন।

রাস্তায় পা দিয়েই রূপকের ওই বিস্কুট চারটের জন্য কেমন যেন মায়া হতে থাকে। সুখে দুখে অনেক সময় একসাথে কাটিয়েছে। ওগুলোকে স্যুভেনির হিসেবে নিয়ে এলেও পারত।



(পরবাস-৫৭, জুলাই ২০১৪)