(এর আগে)
বাংলায় কথাসরিৎসাগর
কথাসরিৎসাগরের মতো মহাগ্রন্থের সঙ্গে পরিচয় ঘটলে বাঙালি হিসেবে প্রশ্ন জাগে, এ গ্রন্থ সম্বন্ধে কতটুকু অবহিত ছিলাম। সংস্কৃতসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের অধিকাংশ বাঙালির যতটুকু চেনাশোনা, আভাসে ইঙ্গিতে, ক্ষণিক উদ্ধৃতিতে, কোনো প্রসঙ্গে আনুষঙ্গিক উল্লেখে, তা তো পুরোটাই বিদগ্ধ লেখকদের হাত ঘুরে পাওয়া। এভাবেই আমরা কখনও উপনিষদ, কখনও পুরাণের কিয়দংশ, কালিদাস, বাণভট্ট, অথবা এক কণা ভবভূতির সাক্ষাৎ লাভ করেছি। বিশেষ করে কালিদাস ও বাণকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হয় প্রত্যক্ষ আলোচনা নয়তো চিত্রকল্পের সংকেতে বাঙালির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তুলেছেন। সেই তুলনায় কথাসরিৎসাগর অথবা হারিয়ে-যাওয়া বৃহৎকথার কতটুকু সান্নিধ্য পাওয়া গেছে বাংলাসাহিত্যের হাত ধরে?
আমরা আলোচনা করেছি যে পঞ্চতন্ত্র ও তজ্জাত হিতোপদেশ প্রসঙ্গে কথাসরিৎসাগরের উল্লেখ বাংলাভাষায় প্রায় প্রচলিত নয় বললেই চলে। পঞ্চতন্ত্র কিঞ্চিৎ খণ্ডিত অবস্থায় কথাসরিৎসাগরে সন্নিবিষ্ট, কিন্তু বেতালপঞ্চবিংশতি সামান্য রূপভেদ সত্ত্বেও পুরোপুরি বিরাজ করছে। পঁচিশখানা গল্পের কোনোটাই বাদ পড়ে নি। একটি প্রধান লম্বকের ছত্রিশ তরঙ্গের পঁচিশটি জুড়েই বেতালের বিস্তার। এবং, বেতাল কাহিনির অনুবাদেই আধুনিক বাংলা গদ্যের প্রথম পদপাত। তথাপি সে অনুবাদ পড়ে জানা যায় না কথাসরিৎসাগর বা বৃহৎকথার অন্য পাঠরূপের সঙ্গে বেতালের কোনো সম্পর্ক আছে।
এই সূত্র ধরেই আমরা বিদ্বান বাঙালির মানসলোকে কথাসরিৎসাগরের উপস্থিতি ও অভিঘাত বিষয়ে কৌতূহলী হতে পারি। সেই কবেকার গোবর্ধনাচার্যের উক্তি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। ব্রকহাউসও কথাসরিৎসাগরের যে সংস্কৃত পাঠ নির্মাণ করলেন সেই সংকলনের সূচনাতে ওই গোবর্ধনীয় উক্তি উদ্ধৃত হল। কাব্যলোকে গোবর্ধনের প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জোরালো, তাঁর সম্বন্ধে জয়দেব কী বলেছেন তা সুবিদিত; গোবর্ধনের বাক্য তাই প্রামাণিক। অতএব সেনযুগের বঙ্গে যে বৃহৎকথা অবিদিত ছিল না গোবর্ধনের উক্তিই তার সাক্ষ্য।
আমাদের কৌতূহল অবশ্য উনিশ শতক নিয়ে, যখন সোমদেবভট্ট আবিষ্কৃত হলেন। ১৮২৪-এ উইলসন প্রথম পাঁচ লম্বকের ইংরেজি সারাংশ দ্বারা যবনিকা উত্তোলন করলেন। কে বা কারা উইলসনের গোচরে এনেছিলেন এই কাব্য? যে সকল পুঁথি উইলসন পাঠ করেছিলেন তাদের সংগ্রহালয় নিশ্চয় ছিল রাজধানী কোলকাতা। অন্তত টনি যখন অর্ধশতাব্দী পরে ব্রকহাউস ও কয়েকটি হস্তলিখিত পুঁথির সাহায্যে অধ্যয়ন করছেন কথাসরিৎসাগর তখন সেই পুঁথিগুলি সংস্কৃত কলেজের সংগ্রহে ছিল।
এর মাঝখানকার পর্বে ব্রকহাউসের আবির্ভাব। তবে সেই সংস্করণ জর্মন ভাষায় হবার কারণে সেটি ভারতীয় পণ্ডিতদের নাগালের বাইরে ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু উইলসন ও টনি দু’জনেরই কর্মক্ষেত্র এই কোলকাতা। এবং তাঁদের অধ্যয়ন অবশ্যই সাধিত হচ্ছে দেশীয় পণ্ডিতদের সহায়তায়, পাশ্চাত্য অনুবাদকদের কাজ আজও যেমন হয়ে থাকে। সুতরাং এই পর্বে কেমন ছিল বাঙালির সঙ্গে সোমদেবভট্টের পরিচয়?
ইংরেজি ১৮৫৭ সালে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের বঙ্গানুবাদে ‘বৃহৎকথা’, প্রথম খণ্ড। বইয়ের নামপত্রে আছে - ‘Tales of Hindu History. বৃহৎকথা’। Tales of Hindu History কি কোনো পুস্তকমালার (সিরিজ) নাম? এই গ্রন্থের নাম শুনে চমকে উঠতে হয় – ‘বৃহৎকথা’ ! তারপর ইংরেজিতে লিখিত Introduction–এ বলা হয়, These tales were written in Sanskrit by Somadeva Pandit; they were collected and compiled about A. D. 1059, for the amusement of the grandmother of Harsha Deva, king of Kashmir. অনুবাদকও তাঁর ‘বিজ্ঞাপন’-এ লেখেন – ‘ইহা সোমদেব ভট্ট কৃত সংস্কৃত বৃহৎকথা গ্রন্থ অবলম্বন করিয়াই লিখিত হইয়াছে’।
এমন নয় যে সোমদেব ও গ্রন্থরচনার কাল সম্বন্ধে কোনো ভ্রান্তি আছে, কিন্তু গুণাঢ্য-বৃহৎকথা ও সোমদেব-কথাসরিৎসাগর এক হয়ে যাচ্ছে অনুবাদকের কাছে। আবার, বৃহৎকথাকে সংস্কৃত গ্রন্থও বলা হচ্ছে। এইসব বিভ্রান্তি তাৎপর্যবহ, যে-হেতু এগুলি অজ্ঞ লোকের প্রমাদ নয়। আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ (১৮১৯-৭৫) ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ, তত্ত্ববোধিনী সভার সদস্য, ও কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের উপাচার্য। এই প্রকাশনার পিছনে জ্ঞানী লোকের সমর্থনও কিছু কম ছিল না, কারণ জানানো হচ্ছে যে ‘বঙ্গভাষানুবাদক অধ্যক্ষ মহোদয়দিগের অনুমত্যনুসারে বিশেষতঃ শ্রীযুক্ত বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র ও শ্রীযুক্ত রেবরেণ্ড জে, লং মহোদয়ের আগ্রহাতিশয়ে’ এই গ্রন্থের প্রবর্তনা।
এই প্রমাদের কারণ কী? অনুবাদক মহোদয়ের অনবধান? না কি সেকালে প্রাপ্য প্রমাণের অপ্রতুলতা? এবং, পাশ্চাত্য গবেষণার সঙ্গে দেশীয় পণ্ডিতদের অপরিচয়, অথবা তা গ্রহণ করবার অনীহা – কারণ ১৮৪৩-এ ব্রকহাউসের কথাসরিৎসাগর প্রথম খণ্ড বেরিয়ে গেছে, এবং তিনি ও অন্যান্য পণ্ডিত বিস্তর লিখছেন এ বিষয়ে। আবার, এও স্মরণীয় যে ব্রকহাউস যদিও গ্রন্থের নাম বিষয়ে সুনিশ্চিত, তবুও তাঁর প্রথম খণ্ডের প্রতিটি পৃষ্ঠার শিরোনামে (header) রয়েছে Vrihat Katha নামটি। বৃহৎকথা যে সম্পূর্ণ লুপ্ত একটি গ্রন্থের নাম তা কি তখনও নিঃসংশয় রূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল না?[২৫]
আনন্দচন্দ্রের বিভ্রান্তির একটা কারণ অবশ্য বোঝা যায়। সোমদেবের প্রথম লম্বকের সূচনা অংশ তাঁর অনুবাদে অনুপস্থিত। আর, এই অংশেই ছিল বৃহৎকথার সারসংগ্রহ করে স্বতন্ত্র গ্রন্থরচনার প্রসঙ্গ। সেই সঙ্গে অষ্টাদশ লম্বকের অনুক্রম। আনন্দচন্দ্রের অনুবাদ শুরু হচ্ছে ‘হরপার্ব্বতী সংবাদ’ দিয়ে; এই নামও তাঁর নিজের দেওয়া বলে মনে হয়। এ থেকে ধারণা হয়, মূলের যে পুঁথি তিনি অনুসরণ করেছেন তাতেই গ্রন্থের প্রস্তাবনা অংশ না থাকায় তিনি এটাকে বৃহৎকথা বলেই ভেবেছিলেন।
বাস্তবিক দেখা যায়, বেদান্তবাগীশ তাঁর প্রথম খণ্ডে যতটুকু অনুবাদ করেছিলেন তা কথাপীঠ লম্বক অতিক্রম করে কথামুখ-এর দ্বিতীয় তরঙ্গের শেষ অবধি (উদয়নের রাজ্যাভিষেক) পৌঁচেছিল – কিন্তু লম্বক-ভাগের লেশমাত্র, অথবা ‘লম্বক’ শব্দটি, কোথাও নেই। বরং ‘তরঙ্গ’ শব্দটি একবারও উল্লেখ না করলেও তিনি তরঙ্গ-বিভাগকে ১, ২ ইত্যাদি সংখ্যায় চিহ্নিত করে তার অন্তর্গত উপাখ্যানগুলিকে এক একটি নাম দিয়ে পরিবেশন করেছেন। তরঙ্গের সংখ্যাক্রম অবশ্য অষ্টম তরঙ্গ, অর্থাৎ কথাপীঠ-এর সমাপ্তির পরে মূল থেকে সরে গেল, কারণ লম্বক-ভাগ না থাকাতে কথামুখ লম্বক ৯-সংখ্যক কাহিনি রূপে শুরু হল।
এইসব কিছু বিভ্রান্তি থাকলেও দেখা যাচ্ছে ইতিহাসের প্রাসঙ্গিক সূত্র উল্লেখের কথঞ্চিৎ প্রচেষ্টা বেদান্তবাগীশের ছিল। কয়েকটি পাদটীকায় তিনি এ-জাতীয় সূত্র যোগ করেছেন। যেমন, সুপ্রতিষ্ঠিত নগর সম্বন্ধে পাদটীকা – ‘সুপ্রতিষ্ঠিত নগর শালিবাহন রাজার রাজধানী ছিল। কেহ২ মনে করেন, গোদাবরীতীরস্থ পুতান বা পিতান নগর পূর্ব্বে সুপ্রতিষ্ঠিত বলিয়া বিখ্যাত ছিল’। অন্য জাতীয় টীকাও আছে, যথা মহাপ্রস্থান – ‘স্বর্গারোহণের পথ অর্থাৎ সুমেরু পর্ব্বতের শিখরবিশেষ’।
বেদান্তবাগীশ তাঁর ক্ষুদ্র ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘ইহা ... অবিকল অনুবাদ নহে, ... অশ্লীল ও অলৌকিক গল্প সকল পরিত্যাগ করিয়া কেবল নীতি বিষয়ক মনোহর গল্প সকল গ্রহণ করা গিয়াছে’। এটা বোধহয় সে যুগের গ্রন্থকারদের একটা প্রচলিত ভণিতা, কারণ অশ্লীল বোধে বিশেষ কিছু তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন[২৬] বলে মনে হয় না, এবং তাঁর অনুবাদে অলৌকিক অংশেরও কোনো ঘাটতি নেই। আর, নীতির প্রতি খুব ঝোঁকই বা সোমদেবে কোথায়? আসলে এই অনুবাদ লক্ষ্য করলে দেখা যায় – একদিকে এটি অসম্ভব মূলানুগ, অন্য দিকে এটি মূলের সারসংক্ষেপ। যে অংশ তিনি অনুবাদ করেছেন তাতে মূলানুগ না হয়ে উপায়ই বা কী। আখ্যান এখানে দ্রুতগামী ও ঘনসন্নিবিষ্ট, সোমদেবের বিবরণে বাহুল্য কোথাও নেই। তাও আনন্দচন্দ্রের মূলানুগামিতার তারিফ করতেই হয়। যেমন, ‘ইত্যুক্ত্বা শৈলতনয়া ব্যরমত্তৌ চ তৎক্ষণাৎ। বিদ্যুৎপুঞ্জাবিব গণৌ দৃষ্টনষ্টৌ বভূবতুঃ’, এই পদ্যাংশ তাঁর অনুবাদে ‘এই কথা বলিয়া পার্ব্বতী প্রস্থান করিবামাত্র তাহারা উভয়ে বিদ্যুতের ন্যায় দৃষ্টনষ্ট হইল’। পরে দেখা যাবে ‘বিদ্যুৎপুঞ্জাবিব দৃষ্টনষ্টৌ’ বাংলায় অবিকল ভাষান্তরসাধ্য হলেও সব অনুবাদক তা রক্ষা করেন নি। মূলের ‘শৈলতনয়া’-ও বাংলায় বলা যেত, কিন্তু সমার্থক নাম ‘পার্বতী’-র ব্যবহার যেন বাংলা বাগ্ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রচনা করে। ব্রকহাউস-টনি প্রসঙ্গে আলোচিত ‘অবিনীত’ শব্দ নিয়েও আনন্দচন্দ্রের কোনো সংশয় নেই; তিনি নির্দ্বিধায় অনুবাদ করেন, ‘তোমরা যেমন অবিনীত তেমনি মর্ত্ত্য লোকে গিয়া জন্ম গ্রহণ কর’।
সারসংক্ষেপের প্রয়োজনে আনন্দচন্দ্র আখ্যানের কোনো অংশ বাদ দেন নি, কেবল সোমদেবের কিছু বর্ণনা বর্জন করেছেন। সেগুলি অবশ্য কবিত্বময় অংশ। ‘পিঙ্গোত্তুঙ্গজটাজূটগতো যস্যাশ্রুতে নবঃ। সন্ধ্যাপিশঙ্গপূর্বাদ্রিশৃঙ্গসঙ্গসুখং শশী’, (মহাদেবের) পিঙ্গল ও উত্তুঙ্গ জটাজূটবদ্ধ শশিকলা সন্ধ্যার পিশঙ্গরঞ্জিত (পীতাভ) পূর্বাদ্রিশৃঙ্গের সঙ্গসুখ লাভ করে, এ-জাতীয় বর্ণনা অনুবাদে পরিহার করেছেন আনন্দচন্দ্র। তেমনি, ‘রসিকো হি বহেৎ কাব্যং পুষ্পামোদমিবানিলঃ’ এই অংশে ‘সাতবাহন রাজাকে ইহা অর্পণ করুন, তিনি অতিশয় রসজ্ঞ’ অবধিই পৌঁছয় বঙ্গানুবাদ, অনূদিত হয় না ‘পুষ্পামোদমিবানিলঃ’, পুষ্পগন্ধবহ বায়ুর মতো তিনি (রাজা) এই কাব্য প্রচার করবেন। মনে হয়, সোমদেবের উপমাগুলিই এড়িয়ে গেছেন আনন্দচন্দ্র; আর ত্যাগ করেছেন দুই লম্বকের সূচনায় মঙ্গলাচরণ দু’টি।
আনন্দচন্দ্রের তাগিদ ছিল গল্প বলার দিকে, সেই মতো তাঁর গ্রহণ বর্জন, এবং গল্প বলার শিল্পে তাঁর অনায়াস দক্ষতা। তাঁর আখ্যানভঙ্গিতে গল্পগুলি তরতর করে এগিয়ে চলে অথচ কথারস সর্বথা ‘অবিঘাত’ থাকে। বাংলা বাগ্ধারায় তাঁর সহজ অধিকার, তাঁর সংস্কৃতজ্ঞান বাংলাভাষাকে গুলিয়ে তোলে না। সেকালের অনেক পণ্ডিতের মতোই খাঁটি বাংলা লেখার ক্ষমতা তাঁর ঈর্ষণীয়। তাঁর গদ্য আধুনিক বাংলা গদ্য, বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত বাক্যান্বয় তিনি স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করেন। সেটা আধুনিক বাংলাসাহিত্যের এতটাই প্রথম যুগ যে আনন্দচন্দ্রের এই সিদ্ধি বেশ বিস্মিত করে। তাঁর স্বচ্ছতোয়া গদ্যের একাংশের নমুনা এখানে পেশ করা গেল – একদা দুই জন ব্রাহ্মণ বহুদূর হইতে আগমন পূর্ব্বক পথশ্রান্ত হইয়া এক রাত্রি বাস করিবার জন্য আমাদিগের গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা যথাসম্ভব অতিথি সৎকার গ্রহণ পূর্ব্বক শয়ন করিয়া রহিয়াছেন এমন সময়ে দূরে বাদ্যধ্বনি হইতে লাগিল। তাহাতে মাতা আমাকে সম্বোধন করিয়া গদ গদ হইয়া কহিলেন, পুত্র ! বোধ হয় তোমার পিতার মিত্র নটসুত ভবনন্দ নৃত্য করিতেছেন, তাঁহারই ঐ বাদ্যধ্বনি। আমি কহিলাম, মা ! আমি উহা দেখিতে যাই, আসিয়া অবিকল ঐ রূপ গীত বাদ্যাদি তোমাকে শ্রবণ করাইব। আমার এই বাক্য শুনিয়া বিপ্রদ্বয় বিস্ময়াপন্ন হইলে মাতা তাঁহাদিগকে কহিলেন, হে বিপ্রদ্বয় ! সন্দেহ করিও না, আমার এই বালক এক বার যাহা শ্রবণ করে তাহাই হৃদয়ে ধারণ করিতে পারে। অনন্তর বিপ্রদ্বয় আমার সেই সামর্থ্য প্রত্যক্ষ করিবার অভিপ্রায়ে বেদের সম্পূর্ণ এক শাখা পাঠ করিলেন, আমিও একবার মাত্র শ্রবণ করিয়া অবিকল উহা তাঁহাদিগকে শ্রবণ করাইলাম।
আনন্দচন্দ্রের প্রথম খণ্ড মোটে এক লম্বক ও পরবর্তী দুই তরঙ্গ অবধি এগিয়েছিল। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১০৯। ওই হারে চললে সোমদেব সম্পূর্ণ করতে আঠারোটি খণ্ডের প্রয়োজন হত। এত প্রকাণ্ড গ্রন্থমালা কি সে যুগে কল্পনীয় ছিল? আনন্দচন্দ্র দ্বিতীয় খণ্ডও লিখেছিলেন, কিন্তু তাঁর উদ্যোগের অন্তিম পরিণতি কী হয়েছিল জানতে কৌতূহল হয়, যেমন জানতে ইচ্ছে করে তাঁর প্রচেষ্টাই বাংলাভাষায় কথাসরিৎসাগরের প্রথম অনুবাদপ্রয়াস কি না। কিন্তু তাঁর কাজ যদি শেষ হত তা হলে একটি পূর্ণাঙ্গ ও উচ্চমানের বঙ্গানুবাদ উনিশ শতকের সেই মধ্যপর্বেই বাঙালির হাতে পৌঁছে যেত। আমরা পেতে পারতাম কালীপ্রসন্নের মহাভারতের মতো অদ্যাবধি ব্যবহার্য কোনো মহাগ্রন্থ।
কথাসরিৎসাগরের বঙ্গানুবাদের কোনো ইতিহাস নেই, সংস্কৃতসাহিত্যের অনুবাদ ও পুনরাবিষ্কারের যুগে এ নিয়ে কোনো সম্যক উদ্যোগ নেই, যে অর্থে মহাভারত বিষয়ে আছে। শুধু ইতস্তত কিছু খণ্ডিত প্রচেষ্টার খবর আমরা নানা সূত্রে শুনতে পাই। যেমন, ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত উমেশচন্দ্র গুপ্ত কবিরত্ন অনূদিত কথাসরিৎসাগরের ‘পূর্বার্দ্ধ’-এর সংবাদ পাওয়া যায়। তার উত্তরার্দ্ধ প্রকাশের কোনো তথ্য নেই। কবিরত্নও তাঁর ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘বর্তমান গ্রন্থ মূল গ্রন্থের অবিকল অনুবাদ নহে। স্থানে স্থানে যে-সকল অংশ নিতান্ত অশ্লীল ও নীরস বোধ হইয়াছে, এতাবৎ পরিত্যাগ করিয়া উপাখ্যানের সৌন্দর্যরক্ষার জন্য যথাসাধ্য পরিশ্রম ও যত্ন করিয়াছি’।[২৭] তেমনি, মহামহোপাধ্যায় কমলকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের একটি অনুবাদের বিষয়েও জানা যায়। এ সম্বন্ধে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন সেটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ নয়। সে অনুবাদ বহুকাল অমুদ্রিত, এবং সুনীতিকুমারেরও প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই তার সঙ্গে।[২৮] মোটের ওপর বোঝা যায় এই অনুবাদকদের লক্ষ্য ছিল সংক্ষিপ্ত রূপ অর্থাৎ মঞ্জরী প্রকাশের দিকে, আদ্যোপান্ত সংকলনের দিকে নয়। তবে এগুলি অখণ্ড না হলেও বিশিষ্ট প্রচেষ্টা সন্দেহ নেই, কারণ অনুবাদকেরা ছিলেন ধ্রুপদী সাহিত্যে সবিশেষ অধিকারী।
অন্যদিকে বাংলা অভিধানে উল্লেখের সূত্র ধরে যদি গ্রন্থবিশেষের প্রভাব অনুমানের চেষ্টা করি তাহলে দেখতে পাই হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কথাসরিৎসাগর থেকে কতিপয় উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ‘বৈভব’ শব্দের ‘আয়োজন’ অর্থের সূত্রে উদ্ধৃত ‘উৎসবসম্ভারং স্বসিদ্ধ্যুচিতবৈভবম্’ এমন একটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস কথাসরিৎসাগর ব্যবহার করেন নি। অন্যদিকে কিন্তু অনেক আগেই মনিয়র উইলিয়ামস তাঁর সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধানে ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত দেন কথাসরিৎসাগর থেকে।
পাশ্চাত্য বিদ্বানদের কৌতূহল অনিঃশেষ ছিল। প্রাচ্যবাদের উৎসাহও সম্ভবত তাঁদের চিত্তে সক্রিয় ছিল। নানা ভাবে তাঁরা এই কাব্যকে ছুঁতে চেয়েছেন। সেগুলি কি চোখে পড়েছিল নবযুগের চালক বাঙালিদের? কেবল টনি নন, তাঁর সমকালেই জনৈক রেভারেণ্ড B. Hale Wortham দেবস্মিতার উপাখ্যান ইংরেজি পদ্যে রচনা করেছিলেন। খুব সুখপাঠ্য নয় সেই পদ্যরূপ A Metrical Version of the “Story of Devasmitā” ১৮৮৪-তে প্রকাশিত হয়েছিল রয়্যাল এশিয়্যাটিক সোসাইটির জার্নালে। কিন্তু যদি বলি পাশ্চাত্য উৎসাহের তুলনায় কথাসরিৎসাগর সাহিত্যজিজ্ঞাসু বাঙালির গোচরে আসে নি, তা হলে কি সেটা অসঙ্গত হবে? হয়তো অনুবাদের অপ্রতুলতার জন্য কবি সোমদেব অর্ধপরিচিত রয়ে গেলেন বাঙালির কাছে।
এই ঘটনাবলীর প্রায় এক শতাব্দী পরে সেই অভাব দূর করতে ব্রতী হলেন হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাস। তিনিও এই গ্রন্থ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ছিলেন না। অতএব তাঁর কাজও শুরু হল আকস্মিক ভাবে। হীরেন্দ্রলাল (১৯০২–৭৭) রেলওয়ের উচ্চপদস্থ চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কথাসরিৎসাগরের অনুবাদকর্মে মগ্ন হয়ে গেলেন। অশক্ত শরীরে সেই শ্রমসাধ্য কর্ম তাঁকে অচিরেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিল। তার আগে আদ্যোপান্ত বাংলা অনুবাদটি তিনি শেষ করে যেতে পেরেছিলেন। পাঁচ খণ্ডে কোলকাতার অ্যাকাডেমিক পাবলিশার্স থেকে প্রকাশনাও আরম্ভ হয়েছিল। অনুবাদকের জীবদ্দশায় তিন খণ্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১-র মধ্যে সমস্ত খণ্ডের প্রকাশ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার মুদ্রণের কিছুটা ব্যয় বহন করায় দাম ছিল যৎসামান্য, ২০–২৫ টাকার মধ্যে। একটি দ্বিতীয় মুদ্রণ ও কয়েক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সংস্করণ সম্ভব হয়েছিল। তারপর থেকে বইটি অপ্রকাশিত।
অনুবাদক হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাস প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির স্নাতক ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম-এ। তাঁর সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত। হীরেন্দ্রলাল ইংলণ্ডে ব্যারিস্টারি পাস করেন ও লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-কম হন। সংস্কৃতভাষায় তাঁর ভিত ছিল মজবুত। অল্পবয়সে টোলে পড়ে তিনি আদ্য ও মধ্য উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
পূর্বে আলোচিত পেন্জ়ারের সঙ্গে হীরেন্দ্রলালের অনুবাদ বৃত্তান্তের কিছু সাদৃশ্য আছে। হীরেন্দ্রলাল সর্বগ্রাসী পাঠক ছিলেন ও সংস্কৃতে অধিকারী, তথাপি কথাসরিৎসাগর বিষয়ে অবগত ছিলেন না। পেন্জ়ারের মতো তিনিও রিচার্ড বার্টনের গ্রন্থাবলীর মধ্যে এই কাব্যের সংবাদ পেলেন। প্রথম খণ্ডে ‘অনুবাদকের নিবেদন’-এ তিনি জানিয়েছেন – “এতকাল যে সমস্ত গ্রন্থ পাঠ করিবার ইচ্ছা সত্ত্বেও সময়াভাবে নিষ্ক্রিয় থাকিতে হইয়াছিল স্বতঃই সেদিকে আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হইল। গত শতাব্দীতে Burton কর্তৃক অনূদিত Arabian Nights–এর মূলানুগ অনুবাদ প্রায় আড়াই বৎসর পড়িয়া শেষ করিলাম। সেই পুস্তকে ‘কথাসরিৎসাগরের’ উল্লেখ দেখিতে পাইয়া প্রায় ৬ মাসে প্রেসিডেন্সী কলেজের প্রখ্যাত অধ্যক্ষ Tawney সাহেবের ইংরেজী অনুবাদ পাঠ করা গেল। ... তখন মূল সংস্কৃত গ্রন্থের অনুসন্ধান করিয়া Asiatic Society–র পুস্তকাগার হইতে উহা সংগ্রহ করিলে ... ঐ গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করিবার সংকল্প করিলাম”। তারপর দু’বছরের অব্যাহত চেষ্টায় সেই অনুবাদ সমাপ্ত হয়, এবং রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুধাংশুমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর অনুবাদের ভাষা অনুমোদন করেন।
বার্টনে প্রাপ্ত সূত্র থেকে টনি, টনির অনুবাদ থেকে মূল গ্রন্থে প্রবেশ করলেন হীরেন্দ্রলাল। সেটি কোন্ মূল পাঠ? হীরেন্দ্রলাল জানান নি, কিন্তু মনে হয় সেটা ছিল দুর্গাপ্রসাদের সংস্করণ। কারণ পরিশিষ্টে ‘গ্রন্থকর্তুঃ প্রশস্তিঃ’ ও লম্বকের সূচনায় মঙ্গলাচরণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। হীরেন্দ্রলালই একমাত্র অনুবাদক যিনি কোনো অংশই পরিহার করেন নি। এ ব্যাপারে তিনি বঙ্গানুবাদকদের তো বটেই, টনিকেও অতিক্রম করেছিলেন।
কিন্তু হীরেন্দ্রলাল যতটুকু জানিয়েছেন তার মধ্যে পেন্জ়ারের বৃহৎ সংস্করণের অনুল্লেখ একটু বিস্ময়কর। ওই সংস্করণের কোনো প্রতিফলনও তাঁর কাজের মধ্যে দেখা যায় না। বিস্তারে অকৃপণ এবং তথ্য ও বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ আলোচনা তিনি একটিও লেখেন নি। দ্বিতীয় খণ্ডে একটি ভূমিকা তিনি লিখেছিলেন, সেটাই একমাত্র, তার ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু কাজের কথা আছে; এ ছাড়া তাঁর নিবেদনগুলি মূলত ধন্যবাদ জ্ঞাপন। তাঁর আগের বাংলা অনুবাদের মধ্যে একমাত্র উমেশচন্দ্র গুপ্ত কবিরত্নের বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন; সেটাও যেন তাঁর নিজের কাজের মাঝামাঝি পর্বে হঠাৎ করে পেয়ে যাওয়া খবর। মনে হয় হীরেন্দ্রলালের হাতে সময় ছিল কম, মূল গ্রন্থের আকস্মিক অভিঘাতের পরে একটা বৃহৎ আয়োজনের সম্বল ছিল স্বল্প। তিনি মূলত লক্ষ্য করেছিলেন যে বাংলাভাষায় কথাসরিৎসাগরের কোনো পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ নেই। তাই অন্যতর উদ্যোগে কালক্ষেপ না করে তিনি অনুবাদের কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। টনি ছিলেন তাঁর রেফারেন্স, আর দুর্গাপ্রসাদের পাঠ ছিল তাঁর বজ্রভিত্তি। এবং তাঁর নিজের সংস্কৃত জ্ঞান তাঁকে প্রায় অনতিক্রম্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল।
অনুবাদের প্রথম খণ্ডের নামপত্রে এই গ্রন্থের নাম ‘সোমদেব ভট্ট বিরচিত কথাসরিৎসাগর’। দ্বিতীয় খণ্ড থেকে ‘বিরচিত’ হয়ে গেল ‘রচিত’। পরবর্তী সংস্করণেও নামের এই অসমতা দূর হয় নি, বোধহয় বাহুল্যবোধে উপেক্ষিত হয়েছে। নামপত্র, প্রকাশনার তথ্যজ্ঞাপক পৃষ্ঠা, কখনওবা সূচিপত্রে এ-জাতীয় ব্যাপার অবশ্য বিরল নয় বাংলা বইয়ে। এ বইয়ে পাদটীকা প্রায় নেই বললেই হয়, অন্য টীকা বা তথ্যসূত্র বা পরিশিষ্টের তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিটি খণ্ডের প্রচ্ছদে রঙিন চিত্র আছে, তাতে একটু পৌরাণিক পরিবেশ; কিন্তু চিত্রকর্মটি কার তা বলা নেই। প্রথম খণ্ডে নির্ঘণ্ট আছে, দ্বিতীয় খণ্ডে নেই, আবার অন্যান্য খণ্ডে আছে। সে নির্ঘণ্ট অবশ্য নির্ঘণ্ট-বিজ্ঞানের সরলতম প্রকরণ, অর্থাৎ অনুবাদে উল্লিখিত চরিত্র ও স্থানের নামের সূচি, তবে সেটুকু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সংকলিত ও পাঠকের পক্ষে মোটামুটি সহায়ক। কিন্তু পাঁচ খণ্ডের কোনো সামূহিক নির্ঘণ্ট নেই যা দিয়ে বোঝা যাবে নামবিশেষ (যথা, সমুদ্রদত্ত) কতগুলি ভিন্ন প্রসঙ্গে আবর্তিত।
পাঁচটি খণ্ডের মুখবন্ধ লিখেছিলেন যথাক্রমে রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সরকার, কৃষ্ণগোপাল গোস্বামী ও সুধাংশুমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। সুনীতিকুমার লিখেছিলেন ইংরেজিতে, অন্যেরা বাংলায়। সেগুলিতে পাই অনুবাদকের সৎ প্রচেষ্টার প্রশংসা, ও বৃহৎকথা প্রসঙ্গে সাধারণ কিছু তথ্য; কোনোটাই বিশেষ প্রতিপাদ্য নিয়ে লেখা নিবন্ধ নয়। একেকজন মুখবন্ধকার তাঁর পূর্বসূরীর আলোচনার বাইরে গিয়ে নতুন আলোকপাত করেন এমন নয়; অনেক ক্ষেত্রে দু’জন মুখবন্ধকার পরস্পরবিরোধী তথ্যও পেশ করেন। সুধাংশুমোহনের মুখবন্ধ পঞ্চম খণ্ডের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু তিনি লেখেন, ‘আলোচ্য তৃতীয় খণ্ডে শশাঙ্কবতীর চারিটি তরঙ্গ, মদিরাবতীর একটি, ... গ্রন্থকর্তার প্রশস্তি লিপিবদ্ধ হয়েছে’। শশাঙ্কবতী লম্বকটিও পঞ্চম বা তৃতীয় খণ্ড নয়, চতুর্থ খণ্ডের অন্তর্গত। মোটের ওপর, এই মুখবন্ধগুলি অনুবাদগ্রন্থের সংযোজন মাত্র, সম্পদ নয়।
বিষয়ের গুরুত্ব যাই হোক না কেন, বাংলা প্রকাশনা চিরকালই একপ্রকার স্বল্পশ্রমসাধ্য জনমুখী (popular) সংস্করণে উৎসাহী, আলোচনাঋদ্ধ (critical) সংস্করণে নয়। বর্তমান প্রসঙ্গে বলা চলে, বাংলা অনুবাদের ইতিহাসে হীরেন্দ্রলালের উদ্যোগ তার বিষয়গুণে এত গুরুতর সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল যে তাতে কী নেই ও কী থাকতে পারত সেটা জিজ্ঞাসু পাঠকের কাছে প্রত্যাশা ও আক্ষেপের বিষয় না হয়ে যায় না। এই সূত্রেই মনে আসে ঈশানচন্দ্র ঘোষের জাতক অনুবাদের প্রসঙ্গ। এই মহান অনুবাদকও প্রৌঢ় বয়সে, অকালমৃত বালক পৌত্রের শোকে মুহ্যমান হয়ে ‘শোকমন্থর সময় অপনোদন করিবার জন্য’[২৯], বিপুল বৌদ্ধজাতকমালার বঙ্গানুবাদে হাত দিয়েছিলেন। বাঙালির সৌভাগ্য যে ঈশানচন্দ্র পালি ভাষা শিক্ষা, আনুষঙ্গিক যাবতীয় গ্রন্থ পাঠ ইত্যাদি প্রস্তুতিতে নিজেকে সমৃদ্ধ করে ষোলো বছরের অধ্যবসায়ে তাঁর কর্ম কেবল সমাপ্ত করা নয়, নিজ ব্যয়ে প্রকাশ করে যেতে পেরেছিলেন। এই অনুবাদকর্ম বাংলাভাষায় critical সংস্করণের বিরল ও অন্যতম দৃষ্টান্ত। ছয় খণ্ডের প্রথম দুই খণ্ডের জন্য বহু যত্নে উপক্রমণিকা লিখেছিলেন ঈশানচন্দ্র। প্রথমটিতে জাতক-প্রাসঙ্গিক জ্ঞাতব্য তথ্য ও বিশ্লেষণের দ্বারা পাঠের সহায়ক একটি বিরাট প্রেক্ষাপট রচিত হয়। দ্বিতীয় উপক্রমণিকায় (‘জাতকে পুরাতত্ত্ব’) জাতকে প্রাপ্ত সূত্র ধরে পুরাকালীন সমাজ-ইতিহাসের পুনরুদ্ধার করা হয়। অনুবাদে কোনো প্রসঙ্গই পাদটীকা থেকে বঞ্চিত হয় না; সেগুলি শুধু ব্যাখ্যায় নয়, ক্রস রেফারেন্স-এ সমুজ্জ্বল। এই টীকারাশি এতই অমূল্য যে তা পড়তে পড়তে বৌদ্ধ দর্শন সম্বন্ধে একটি প্রাথমিক ধারণা গড়ে তোলাও অসাধ্য থাকে না। অনুবাদকের বিশেষ আগ্রহ জাতক-লভ্য নানা শব্দের সঙ্গে আধুনিক বাংলাভাষার সম্বন্ধ স্থাপনে – ভিত্তিপ্রস্তরকে ‘মঙ্গলেষ্টক’, চাঁদাকে ‘গণদান’, বা ভোটকে ‘সংবহুল’ বলা যায় কিনা, ইত্যাদি প্রস্তাব বিদ্বৎসমাজের বিবেচনার জন্য পেশ করেন তিনি। সযত্নসংকলিত নির্ঘণ্ট যুক্ত হয় প্রতিটি খণ্ডে, টীকায় আলোচিত প্রসঙ্গেরও নির্দেশ থাকে সেখানে। বিশেষত প্রথম খণ্ডে ‘জাতকোল্লিখিত প্রধান প্রধান ব্যক্তি ও স্থানের পরিচয়’ নামক একটি পরিশিষ্ট পাঠকের জিজ্ঞাস্য সমস্ত প্রশ্নেরই মীমাংসা করে। লেখকের ব্যবহৃত গ্রন্থপঞ্জীও সংযোজিত হয়। অনুবাদকের একা হাতে করা এই সম্পাদনার ব্যাপ্তি ও ঘনত্ব বিস্ময়কর। এর আগে দু’একটি শিশুপাঠ্য পুস্তকের রচয়িতা ছিলেন ঈশানচন্দ্র। কিন্তু জাতকের কাজকে অল্পায়াসে বালবোধিনী করে তোলার তাগিদে তিনি চালিত হন নি। উনিশ শতকী পাশ্চাত্য গ্রন্থ-সম্পাদনার আদর্শ তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তথাপি জাতকবিষয়ক কাজকে তাঁর ভারতীয়ত্ব যে স্বকীয় জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে সেখানে তিনি সম্পূর্ণ সার্থক হতে পেরেছিলেন।
বলা বাহুল্য, হীরেন্দ্রলালের উদ্যোগ এই স্তরের নয়। মোটের ওপর তাঁর সংস্করণ সম্পাদকীয় সংযোজন ও প্রসঙ্গ-সূত্রাদির ব্যাপারে শতবর্ষ আগের আনন্দচন্দ্রের ‘বৃহৎকথা’-রই সগোত্র। সম্পাদনার যতটুকু প্রচেষ্টা তা-ও হয়তো তাঁর নিজের, প্রকাশকের নয়। সম্পাদনার অসমতাও আছে। একটি খণ্ডে নির্ঘণ্টের অনুপস্থিতির কথা আগেই বলেছি। তেমনি, অন্তিম দু’টি খণ্ডে পাওয়া যায় অনূদিত অংশের পাশে মূলের শ্লোকসংখ্যা। এই সূত্র কিন্তু প্রথমদিককার খণ্ডগুলিতে নেই। আবার, প্রথম খণ্ড শেষ হল ১৭০ সংখ্যক পৃষ্ঠায়, দ্বিতীয় খণ্ড শুরু হচ্ছে পৃষ্ঠা ১৭১, কিন্তু পৃষ্ঠাসংখ্যার এই ধারাবাহিকতা পরে আর ধরে রাখা হল না। এ-জাতীয় অসমতার দায় অনুবাদকের না প্রকাশকের তা বোঝা যায় না। স্পষ্টতই হীরেন্দ্রলালের সম্পাদনার প্রকরণ স্বল্প, কিন্তু সম্পাদনার ভার না থাকলেও তাঁর অনুবাদে কোনো হীনতা নেই। তাঁর কাজের ধার তীব্রতা ও সফলতা সেখানেই।
অনুবাদের মাধ্যম হিসেবে হীরেন্দ্রলাল বেছে নিলেন বাংলা সাধু গদ্য রীতি। সেই রীতিরও যে-সকল বর্ণবিভাগ আছে তার মধ্যে হীরেন্দ্রলালের ভাষা রবীন্দ্র-গোত্রের নয়। ঠিক রবীন্দ্রপূর্ব বাংলাও একে বলা চলে না, বরং রবীন্দ্রনাথের সমকালে অন্যান্য বিশিষ্ট লেখকেরা (যেমন, দীনেশচন্দ্র সেন) যে স্বকীয় বাংলায় গদ্য লিখতেন সেই শৈলীই লক্ষ্য করা যায় হীরেন্দ্রলালে। ১৯৭০-এর দশকে এই বাংলা পুরাতনী বৈকি, কিন্তু নীরদচন্দ্র চৌধুরী, হীরেন্দ্র-সুহৃদ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, অথবা তারও পরে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত এই রীতিতে লিখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ হয়ে বাংলাভাষার নানা বিবর্তন ও আধুনিক বাংলা গদ্যের উৎকর্ষ এইসব লেখকদের যেন স্পর্শ করে নি।
হীরেন্দ্রলালের অনুবাদে পুরাতনী ঢঙ তাঁর শব্দপ্রয়োগ ও বাক্যনির্মিতিতে স্পষ্ট। বানানে তিনি পুরোপুরি প্রাচীন নন, আবার সচেতন ভাবে আধুনিকও নন। রেফে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব তিনি পরিহার করেন ‘পূর্বক’ ‘পার্বতী’ ‘অর্ধ’ ‘ঊর্ধ্ব’ ইত্যাদি শব্দে; কিন্তু ‘যশ’-কে ‘যশঃ’, ‘প্রথিতযশা’-কে ‘প্রথিতযশাঃ’ লেখেন বিসর্গ দিয়ে। ‘জন্য’ অর্থে ‘নিমিত্ত’ তো বটেই, তুলনায় বিরলতর ‘বিধায়’ জাতীয় ক্রিয়াবিশেষণ অজস্র প্রয়োগ করেন তিনি। যথা, “রাজার হিতৈষিণীবিধায় তাঁহার পত্নী ‘দেবী’ আখ্যা লাভ করেন”। অতি দুর্লভ ‘পৃষ্ট’ (asked অর্থে) এত স্বচ্ছন্দে তিনি ব্যবহার করেন যে শব্দটার অনাত্মীয়তা ঘুচে যায়। ‘যেরূপ’ ও ‘তদ্রূপ’ সংযোগে উপমাবন্ধন – ‘নীলকণ্ঠ ময়ূর মেঘদর্শনে যেরূপ জীবন ফিরিয়া পায় তদ্রূপ তাহাকে দর্শন করিয়া’ জাতীয় বাক্য ঘন ঘন দেখা যায়। তৎসম শব্দের প্রাচুর্যের পাশে আশ্চর্য বিমিশ্রতাও ছিল এই ধরনের বাংলার লক্ষণ। হীরেন্দ্রলালেও ‘পূরণার্থ’, ‘লাভার্থ’, ‘পুরঃসর’, ‘তদ্দর্শনে’, ‘প্রদানান্তর’, ‘নয়নানন্দকারক’, ‘সৌৎসুক দৃষ্টি’, ‘স্মৃতিপথে উদিত হওয়া’ যেমন আছে তেমনি আছে ‘মর্জিমত’ জাতীয় শব্দ। সাধু বাংলার যাবতীয় কৌশল ছিল তাঁর দখলে। অসমাপিকা ক্রিয়াপদ, নানাবিধ ক্রিয়াবিশেষণ ইত্যাদি উপাদান বাক্যের মধ্যে একপ্রকার গভীর দৃঢ়তা আনত। আবার অতিপ্রয়োগের শ্রান্তিও ঈষৎ অনুভব করা যেত কখনও, যেমন – ‘বারংবার মাতা কর্তৃক পৃষ্ট হইয়া সে মাতা ও তাহার মধ্যে একটি পর্দা স্থাপন করিয়া তাহার মৌনতার কারণ প্রসঙ্গে রাত্রির সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করিল’।
কথা থেকে কথার উৎপত্তি হতে থাকে; তাই কথাসরিৎসাগরে সর্বাধিক সাক্ষাৎ মেলে যে বাক্যের তা হীরেন্দ্রলাল মূলত এইভাবে অনুবাদ করেন – ‘ইহার প্রমাণস্বরূপ একটি কাহিনী বলিতেছি, শ্রবণ করুন’। টনি সাধারণত বলেন – and in proof of this listen to the following tale. এই বাক্যভঙ্গির কোনো ব্যতিক্রম নেই। সংস্কৃত মূলে কোথাও আছে ‘এতাং কথাং শৃণু’, কোথাও ‘শৃণ্বিদং কথয়ামি তে’, কোথাওবা আর কিছু, এবং ‘প্রমাণস্বরূপ’ বলতেই হবে এমন বাধ্যতা নেই। কিন্তু সেই ছোটোখাটো বৈচিত্র্য ধরবার চেষ্টা নেই টনি বা হীরেন্দ্রলালের।
দুর্গাপ্রসাদ যে মঙ্গলাচরণটি প্রত্যেক লম্বকের সূচনায় যুক্ত করেছেন তার প্রথম শ্লোকের অপূর্ব অনুবাদ করেন হীরেন্দ্রলাল – ‘এই কথামৃত প্রাচীনকালে শিব এবং পার্বতীর প্রণয়রূপ মন্দর পর্বতের আলোড়নের ফলে হরমুখসমুদ্র হইতে উদ্গত হইয়াছিল’। সেটি তিনি কথাপীঠ-এ ব্যবহার করলেন, কথামুখ-এ বাদ দিলেন; আবার লাবাণক থেকে মদনমঞ্চুকা এই চারটি লম্বকে দিলেন ভিন্নরকম অনুবাদ, তারপর পুনরায় ফিরে গেলেন পুরোনো পাঠে। সম্ভবত মূলের ‘গুরুগিরীন্দ্রজাপ্রণয়মন্দরান্দোলন’ পদের সমাসবন্ধনকে অন্যভাবে ভেঙে, এবং ‘কিল’ শব্দের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে, তিনি লিখলেন – ‘মন্দর পর্বত কর্তৃক মন্থনে সমুদ্র হইতে যেরূপ অমৃতের উৎপত্তি হইয়াছিল, এই সুধারস নিষিক্ত কাহিনীও তদ্রূপ হিমালয়-দুহিতার প্রেমে আলোড়িত হইয়া পুরাকালে হরমুখ হইতে নির্গত হইয়াছিল’। (এতে যেন ‘হরমুখাম্বুধি’-ও আর সমাসবদ্ধ পদ নয়, নিছক একটি সন্ধি রূপে গৃহীত হল।) নিতান্ত আপতিক হলেও চোখে পড়ে, টনি মোটে একবার এই স্তোত্রটি উদ্ধৃত করেছিলেন কথামুখ-এর সূচনায়, এবং অর্থ করেছিলেন অবিকল এইরকম। টনির অনুবাদ – This nectarous tale sprang in old time from the mouth of Śiva, set in motion by his love for the daughter of the Himālaya, as the nectar of immortality sprang from the sea when churned by the mountain Mandara. সমস্যা অবশ্য এই সাদৃশ্য নয়; আসলে পুনরাবৃত্ত এই স্তোত্রের আকস্মিক কোনো পাঠান্তর প্রত্যাশিত ছিল না হীরেন্দ্রলালের অনুবাদে।
শ্রী তপন রায়চৌধুরী ‘সকলেই জানেন, সাহেবরা সর্বজ্ঞ’ বলে যতই রঙ্গ করুন না কেন, তাঁদের টান থেকে কি রেহাই আছে বাঙালি বিদ্বানের? আমাদের আলোচ্য হীরেন্দ্রলালেও কখনও কখনও টনির অভিকর্ষ অনুভূত হয় বৈকি, তাঁর ছায়ানুগমন করতে থাকেন তিনি। অবশ্যই সেটা সজ্ঞানে নয়। এটুকু খাদ না থাকলেই ভালো হত। রাজশেখর বসু যে মৌলিকতার সঙ্গে রামায়ণ মহাভারতের সারানুবাদ সম্পন্ন করেছিলেন, মহাকাব্য মন্থন করে সৃষ্টি করেছিলেন অনুবাদের পরিবেশ, ঠিক তেমনই সম্ভাবনা নিয়ে হীরেন্দ্রলাল শুরু করেছিলেন। কত জায়গায় যে তিনি মূলাভিরাম তা আমাদের লক্ষ্য করতেই হবে। বাংলা যে সংস্কৃতের সঙ্গে রক্তসূত্রে বাঁধা, সেই উত্তরাধিকারকে তিনি এসব অংশে সবিশেষ কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। জীমূতবাহনের সঙ্গে যখন তাঁর জন্মান্তরপ্রিয়তমা মলয়বতীর সাক্ষাৎ হচ্ছে (নরবাহনদত্তজনন লম্বক) সেখানে ‘যূনোরন্যোন্যদর্শনম্’ কী করে ‘মন্দবাগুরাবন্ধসন্নিভম্’ হয়ে উঠল সেই অংশের অনুবাদ হীরেন্দ্রলাল করেছেন এইভাবে – ‘তাঁহার পূর্বজন্মের প্রিয়ার সহিত সর্বজ্ঞ জীমূতবাহনের সাক্ষাৎ হইলে যুবক-যুবতীর কোমল দৃষ্টিজালে যেন তাঁহাদের মনোমৃগ ধরা পড়িল’। এর পাশে টনির অনুবাদ (And the mutual gaze of those two young people was like catching in a frail net of the deer of the mind) সেই চঞ্চল ও পলায়নপর মৃগের ব্যঞ্জনায় পৌঁছতে পারে নি।
আমাদের আলোচ্য ইংরেজি ও বঙ্গানুবাদের কয়েকটি বিশিষ্ট অংশ এখানে উদ্ধৃত করব।
এক – আমরা আগেই দেখেছি (প্রসঙ্গ-সূত্র ১৬), সুরতমঞ্জরী লম্বকের প্রথম তরঙ্গে মূলের ‘অসিতগিরি’ বা ‘অসিতাচল’ (টনিতে Black Mountain) হীরেন্দ্রলালের সংস্করণে হয়ে উঠেছে ‘অমিতগিরি’। এই অসিতগিরিতে কশ্যপের আশ্রমে নরবাহনদত্ত আকাশ থেকে বিমানযোগে অবতরণ করলেন। সেই পবিত্র ও অপূর্ব আশ্রমের সঙ্গে তাঁর যে সাক্ষাৎ ঘটল তার বর্ণনা এইরকম - সপ্রেক্ষিতমিবানেককৃষ্ণসারমৃগভ্রমৈঃ। সস্বাগতাচারমিব কণিতেন পতত্রিণান্॥ (শ্লোক ৯৭) এই অংশের ব্যাপারে ইংরেজি ও বঙ্গানুবাদে বেশ প্রভেদ দেখতে পাই। হীরেন্দ্রলাল লিখছেন – ‘ইতস্ততঃ সঞ্চরমাণ মৃগগণ যেন নেত্র দ্বারা এবং বিহগগণ কলকাকলি দ্বারা তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়াছিল’। এখানে কর্তা ‘মৃগগণ’ ও ‘বিহগগণ’। টনির ভাষান্তরে - It seemed to gaze on him with many roaming, black, antelope-like, rolling eyes, and to welcome him with the songs of its birds. অর্থাৎ, মৃগ বা পতত্রী (পাখি) নয়, ওই আশ্রমই (সর্বনামে it) তাঁকে অভ্যর্থনা করল। এবং, মূলের ‘ভ্রম’-কেই কি একবার সঞ্চরমাণ (roaming) আরেকবার ঘূর্ণায়মান (rolling) অর্থে নিলেন টনি? ‘কণিত’ শব্দটিও লক্ষ্য করবার মতো। এর প্রচলিত আভিধানিক অর্থ আর্তনাদ; যেমন মনিয়র উইলিয়ামসে crying out with pain, উইলসনেও তদ্রূপ (আপ্তে ও অন্য অনেক অভিধানে এ শব্দ নেই)। তবে কি রাজাকে সপার্ষদ আকাশ থেকে নামতে দেখে পাখিরা ভয়ে আর্তরব করে উঠল? ‘স্বাগতাচার’ শব্দটি আছে বলেই হয়তো অনুবাদকেরা ‘কণিত’-কে বুঝলেন কলকাকলি।
তারপর শ্লোক ৯৯ - বহুভূধরনাগেন্দ্রমাশ্রিতম্ কপিলোৎকরৈঃ। অপূর্বমিব পাতালমূর্ধ্ববর্তি বিতামসম্॥ It was full of many mountain-like, huge elephants, and resorted to by troops of monkeys; and so seemed like a strange sort of Pātāla, above ground, and free from darkness. বঙ্গানুবাদ – ‘ঐ তপোবন পর্বতসদৃশ গজেন্দ্রগণ এবং কপিযূথে পূর্ণ ছিল এবং উহাকে ভূতলে অবস্থিত অন্ধকার বিচিত্র পাতালের ন্যায় দেখাইতেছিল’। দেখা যাচ্ছে, ‘বিতামসম্’ ইংরেজিতে free from darkness, অথচ বাংলায় ‘অন্ধকার’। বি-উপসর্গটিকে কি ‘বিশেষ রূপে’ অর্থে গ্রহণ করলেন হীরেন্দ্রলাল? আমাদের প্রশ্ন, দুই অনুবাদের মধ্যে কোন্টা প্রামাণিক?
দুই - কথাসরিৎসাগরে ঋতুর বর্ণনা যা আছে সবই বসন্তের; বর্ষা বা শরৎ নেই বললেই চলে। হীরেন্দ্রলালের অনুবাদে এমন একটি অংশ এইরকম – তখন বসন্তকাল সমাগত হইয়া তাহার সুখ বর্ধিত করিল। বহুকাল পরে চন্দ্রের জ্যোৎস্নালোক[৩০] সুপরিস্ফুট হইল এবং বসুন্ধরা নবীন শাদ্বলে আবৃত হইল ও শিশিরসিক্তা হইয়া প্রীতি জ্ঞাপন করিল। মলয় মারুত কর্তৃক আন্দোলিত হইয়া ঘন সন্নিবিষ্ট পাদপরাজি পুনঃ পুনঃ পরস্পরকে আলিঙ্গন করিয়া কম্পমান হইয়াছিল। পুষ্পধন্বার প্রতিহার কোকিল চূতবৃন্ত প্রদর্শন করাইয়া কুহুস্বরে মানবতীদিগকে মান করিতে নিষেধ করিতেছিল এবং বীর যোদ্ধা কন্দর্পদেবের ধনুকভ্রষ্ট শায়কের ন্যায় পুষ্পিত বল্লরী হইতে ভৃঙ্গপংক্তিসমূহ সশব্দে পতিত হইতেছিল। নরবাহনদত্তের গোমুখ প্রমুখ মন্ত্রিবর্গ বসন্ত ঋতুর এই ক্রিয়াকলাপ দর্শন করিয়া তাহাকে বলিল, ‘রাজন্, অবলোকন কর, এই ঋষভ পর্বত এখন সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হইয়াছে। মধুশ্রী প্রভাবে ইহার গভীর অরণ্যানী প্রস্ফুটিত কুসুমে আবৃত হইয়া পুষ্পাদ্রিতে পরিণত হইয়াছে। ... (সুরতমঞ্জরী, প্রথম তরঙ্গ)[৩১]
এখানে লক্ষণীয়, বসন্ত যখন এল ফুলের রথে চেপে তখন পৃথিবীর শরীরে আনন্দের লক্ষণস্বরূপ স্বেদের সঞ্চার হল। আমরা দেখি, মূল কাব্যে ‘শিশির’-এর কোনো উল্লেখ নেই। মূলের ‘সস্বেদাভূদ্বসুন্ধরা’-র সংকেত বোঝাতে টনি ও হীরেন্দ্রলাল উভয়েই প্রীতির সঙ্গে শিশির যোগ করে অনুবাদের প্রসারণ ঘটিয়েছেন। টনি করেছেন এইরকম – ‘showed its joy by sweating dew drops’. হর্ষের লক্ষণ যে স্বেদ কম্প পুলক ইত্যাদি তা ভারতীয় মানসে সুবিদিত। ইংরেজ পাঠকের বোধের জন্য হয়তো স্বেদের সঙ্গে dew drops-এর সংযোজন জরুরি ছিল। টনি তাঁর পাদটীকায় স্বেদের কারণ উল্লেখ করেছেন (‘There is a play on words here. Sanskrit poets suppose that joy produces in human beings trembling, horripilation and perspiration.’)। হীরেন্দ্রলাল কিন্তু তাঁর ‘শিশির’ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব।
আরও লক্ষ্য করি, বনস্পতিরা কেবল ‘কম্পাকুলাঃ’ নয়, তার সঙ্গে যে ‘কণ্টকিতাঃ’ ও ‘সরসা’ হল (‘কম্পাকুলাঃ কণ্টকিতাঃ সরসা বানরাজয়ঃ’), সে অনুষঙ্গও বাদ দেন হীরেন্দ্রলাল। আবার, কণ্টকিত-র মধ্যেও হয়তো আনন্দ-লক্ষণের (রোমাঞ্চ) ইঙ্গিত ছিল, কিন্তু টনি দেখলেন কেবল কাঁটা (bristling with thorns).
তিন - লাবাণকে আছে - স্বামী প্রবাস ভ্রমণ করিয়া প্রত্যাবর্তন করায় সেদিন নগরীকে সুসজ্জিত করা হইয়াছিল। রক্তাংশুক পতাকা হইয়াছিল তাহার পরিধেয় বস্ত্র, গবাক্ষ হইয়াছিল তাহার আয়ত চক্ষু, দ্বারদেশের সম্মুখে অবস্থিত পূর্ণকুম্ভ হইয়াছিল তাহার পীনোন্নত কুচযুগ, জনতার আনন্দকোলাহল হইয়াছিল তাহার আনন্দের ভাষা এবং শ্বেতসৌধ হইয়াছিল তাহার হাস্য।[৩২] মূলে আছে – ধ্বজরক্তাংশুকাচ্ছন্না গবাক্ষোৎফুল্ললোচনা। প্রদ্বারদর্শিতোত্তুঙ্গপূর্ণকুম্ভকুচদ্বয়া ॥ জনকোলাহলানন্দসংলাপা সৌধহাসিনী। সা প্রবাসাগতে পত্যৌ তৎকালং শুশুভে পুরী॥ এই চমৎকার অন্বয়, ‘প্রদ্বারদর্শিতোত্তুঙ্গপূর্ণকুম্ভকুচদ্বয়া’-র মতো সমাসবদ্ধ পদ বাংলাভাষার স্বাভাবিক ধর্মে আঘাত না করে কতটা রক্ষা করা যায় সেটা একটা প্রশ্ন। টনি ও হীরেন্দ্রলাল উভয়েই দু’টি শ্লোককে ঢেলে সাজিয়েছেন ইংরেজি বাংলার মতো আধুনিক ভাষার ছাঁচে, মোটামুটি একই ভাবে। উৎফুল্ললোচন-কে expanded eyes করেছিলেন টনি; হীরেন্দ্রলাল করলেন ‘আয়ত চক্ষু’। হাসির ধবলতা বোঝাতে টনি সৌধ-এর সঙ্গে যোগ করেছিলেন white বিশেষণ, white palaces; হীরেন্দ্রলালে পাই ‘শ্বেতসৌধ’, যদিও ‘সুধা’ থেকে আগত ‘সৌধ’ শব্দে ধবলতার ইঙ্গিত নেই এমন নয়।
ইংরেজির মতো বিজাতীয় ভাষায় সংস্কৃত কাব্যের অনুবাদসাধনের প্রাথমিক অসুবিধা টনিকে সইতে হয়েছে নিশ্চয়। উপরন্তু তিনিই ছিলেন প্রথম অনুবাদক। হীরেন্দ্রলালের এই অসুবিধা ছিল না। অনুবাদের কিছু জায়গায় টনি যথার্থ হতে পারেন নি, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন; সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেইসব অংশের সঙ্গে হীরেন্দ্রলালের অনুবাদের সাদৃশ্য এত প্রকট যে বেশ অবাক হতে হয়। হীরেন্দ্রলালের যতটুকু লক্ষ্যচ্যুতি, মূলের প্রতি যে অনবধান, সামান্য কিছু কিছু বাদ দিয়ে বসা, তার কারণ কি রোগ ও বার্ধক্যজনিত কোনো দৌর্বল্য, নাকি একটু তাড়াহুড়ো, কে জানে।
মূল গ্রন্থের ভাষাতে অনুবাদক যদি হন বিশেষ পারঙ্গম, আর তাঁর হাতের কাছে যদি থাকে কোনো আধুনিক ভাষায় একটি অনুবাদ, তাহলে সম্পন্ন হতে পারে আরেকটি চমৎকার অনুবাদকর্ম। এই প্রত্যাশা নিয়ে অনুধাবন করলে দেখা যায়, হীরেন্দ্রলালের পায়ের তলায় এই দুই মাটিই ছিল, তবু তাঁর কর্মে ইংরেজি অনুবাদের অস্তিত্ব উপেক্ষণীয় নয়। সংস্কৃত কাব্যের মৌলিক ভূমিতে তিনি অবিরত যাতায়াত করলেন, ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমিক ভূমি তাঁকে পথ দেখিয়ে দিল, আর যে বাংলা গদ্যকে তিনি অবলম্বন করলেন তাতে ছিল তাঁর নিখাদ অধিকার। ইংরেজি পাঠকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি, তথাপি এই ত্রিধারা সংযোগে তাঁর অনুবাদে এসেছে অপরাহত শক্তি। কথাসরিৎসাগর যে উৎকৃষ্ট সাহিত্যরচনা, তাতে আখ্যানবর্ণনা আছে, প্রকৃতিবর্ণনা আছে, বাক্চাতুরী আছে, বক্তব্যের ঋজুতা আছে, লৌকিক সংলাপ আছে, তার সমস্ত দিকই তিনি ধারণ করতে পেরেছেন। মূলকে ছাপিয়ে যথেচ্ছ বিহারে তাঁর অভিরুচি নেই, এ ক্ষেত্রে তিনি সোমদেবেরই আদর্শের অনুগামী। নিজেকে জাহির করবার বিষম চেষ্টা না করে তাঁর অনুবাদকে তিনি গভীর সাহিত্যে উন্নীত করেছেন।
হীরেন্দ্রলালের অনুবাদমালার প্রায় সমকালে, ১৯৮২-তে প্রকাশিত হয়েছিল তারাপদ রাহার অনুবাদে ‘তুলি কলম’ প্রকাশনী থেকে তিন খণ্ডে কথাসরিৎসাগর। বইয়ের নামপত্রে একে অনুবাদ বলা হলেও এটি বাংলায় পুনর্লিখিত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্যরূপ। তারাপদ রাহা প্রখ্যাত অনুবাদক ও বাংলাভাষায় আরব্য রজনীর লেখক। কথাসরিৎসাগরের জন্য তিনি পড়েছিলেন বসুমতী প্রকাশিত বাংলা অনুবাদ। তাঁর ‘মুখবন্ধ’-এ, অন্য কোনো অনুবাদের, বিশেষত তাঁর সমকালীন হীরেন্দ্রলালের, উল্লেখ নেই। এই সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন সুকুমার সেন। মূলত কিশোর পাঠকের জন্য এ বই লেখা, উপাখ্যানগুলির প্রতিই লেখকের মনোযোগ বেশি। তবু তাঁর গভীর অধ্যয়নের ছাপ পড়ে তাঁর গল্প-বলায়, তাঁর প্রাঞ্জল গদ্যে তিনি ধারণ করতে পারেন সমগ্র কথাসরিৎসাগর। মূলের আস্বাদ এখানে না পাওয়া গেলেও এ বই মূলাশ্রিত স্বতন্ত্র একটি গল্পের বই হিসেবে সার্থক। বইটির পরবর্তী কোনো মুদ্রণ হয়েছিল কিনা জানা নেই। সন্ধানী ক্রেতা হয়তো পুরোনো বইয়ের দোকানে কোনো শুভদিনে আবিষ্কার করতে পারেন এর বহুকাল অস্পৃষ্ট ও অনাঘ্রাত একটি কপি।
সম্প্রতি (২০১২) প্রকাশিত হয়েছে কথাসরিৎসাগরের আরেকটি রূপান্তর। লেখক অদ্রীশ বর্ধন (কল্পবিজ্ঞান-খ্যাত), গ্রন্থের নাম ‘মহাকবি সোমদেব ভট্ট বিরচিত কথাসরিৎসাগর’, প্রকাশক পারুল প্রকাশনী। এটি ‘পুনঃকথন’, তাই আমাদের অনুবাদ প্রসঙ্গের আওতায় সরাসরি পড়ে না। কিন্তু বিষয় কথাসরিৎসাগর বলেই এই কাজটির প্রতি আমরা সংক্ষেপে দৃষ্টিপাত করব।
লেখকের ভূমিকা থেকে তাঁর প্রস্তুতির কিছু আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলছেন, কথাসরিৎসাগরের ‘পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে। অনুবাদক সি এইচ টনি’। টনির অনুবাদ প্রকাশের কাল ১৮৮০-৮৪, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৯২২ সালে, আমরা আগেই আলোচনা করেছি। ১৯২৪-এ আরম্ভ হয় পেন্জ়ারের বৃহৎ সংস্করণের প্রকাশনা। লেখক উমেশচন্দ্র গুপ্ত কবিরত্নকে প্রথম বঙ্গানুবাদক মনে করেন, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবগীশকে নয়। এই সংবাদটি বইয়ের ব্লার্বেও বিজ্ঞাপিত। যথেষ্ট সন্ধান না করে কাউকে প্রথমের মর্যাদা দিয়ে ফেলাটা বিপজ্জনক। তিনি নিজে মহামহোপাধ্যায় কমলকৃষ্ণ স্মৃতিতীর্থের অনুবাদের সঙ্গে পরিচিত, কিন্তু গ্রন্থরচনায় কী কী উৎসের ওপর নির্ভর করেছেন তা ব্যক্ত করেন না। হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের বিপুল অনুবাদের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অনুক্ত থাকে। লম্বকের যে অনুক্রম তিনি পেশ করেন তা টনি বা দুর্গাপ্রসাদের সঙ্গে মেলে না। তাঁর হিসেবে আঠারোটি লম্বকে মোটে ৬৪টি তরঙ্গ, এই সংখ্যাও একটু বিস্ময় জাগায়। এ ছাড়া, মূল গ্রন্থের রচনা শ্রীঅনন্ত না শ্রীহর্ষের সময়ে, তা নিয়ে তাঁর ধন্দ আছে। এই ধন্দটি একটু সেকেলে। সোমদেবের ‘প্রশস্তি’ সংস্কৃত সংস্করণে গ্রথিত হবার পরে এ নিয়ে আর সংশয় কোথায়।
অদ্রীশ বর্ধনের কাজটি এতই সদ্যোজাত ও সমসাময়িক যে তা নিয়ে সম্যক আলোচনা যোগ্য ব্যক্তিরা করতে পারবেন। কয়েকটি বহিরঙ্গ দিক আমাদের চোখে পড়ে। প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘মঙ্গলাচরণ’। দুর্গাপ্রসাদের পাঠে মঙ্গলাচরণম্ বলে যে স্তোত্রটি আছে তার ভাষান্তর (তারাপদ রাহায় ছিল) এখানে নেই। তাহলে পুরো অধ্যায়টিই, যা কিনা ‘কথাপীঠ’ অবলম্বন করে, কি মঙ্গলাচরণ? পুরো বইয়ে বেশ কিছু চরিত্র-নাম একটু অন্যরকমের। শকটাল এখানে ‘শকটার’, যৌগন্ধরায়ণ এখানে ‘সৌগন্ধনারায়ণ’, মদনমঞ্চুকা কোথাও ‘মদনমঞ্জুকা’ কোথাওবা ‘মদনমঞ্জুষা’; এবং ‘মাল্যবানের উপাখ্যান’-এ রাজার নাম ‘সাতবাহনাখ্য’। ‘আখ্য’ (‘আখ্যা’ থেকে) সংস্কৃতে বহুল ব্যবহৃত শব্দ, যার অর্থ ‘নামক’। সত্যিই কি রাজার নাম ‘সাতবাহনাখ্য’? লেখক ‘রত্নপ্রভা’ লম্বকের উল্লেখ করেছেন কিন্তু লম্বকের নায়িকার নাম হেমপ্রভা, রত্নপ্রভা নয়। হেমপ্রভার ভাইয়ের নাম এখানে রত্নপ্রভ, বজ্রপ্রভ নয়। লেখক যদি তাঁর রচনার উৎস নির্দেশ করতেন তাহলে এই নামগুলির উৎপত্তির সূত্র পাওয়া যেত।
বস্তুতপক্ষে, এটা বোঝাই যায় না মৌলিক উৎস সংস্কৃত কথাসরিৎসাগরের সঙ্গে তাঁর কতটুকু যোগাযোগ, আর কোন্ মাধ্যমিক উৎস থেকে তাঁর যাবতীয় আহরণ। তাঁর সেই অনামিত উৎসের গুরুত্ব হয়তো এককালে ছিল, কিন্তু তার আগে বা পরে আরও যে প্রামাণিক চর্চাগুলি হয়ে গেছে তার মূল্য কম কী।
এটি যে-হেতু পুনঃকথন, অনুবাদ নয়, তাই লেখকের অবাধ স্বাধীনতা আছে। এই সংকলনের লক্ষ্য ‘গৃহী বাঙালি পাঠক’, অতএব এটি কিশোরসাহিত্য নয়। লেখক মূল আখ্যানকে তাঁর রুচি অনুসারে রক্ষা করেছেন, অথবা করেন নি। তাঁর আগ্রহ উপাখ্যানগুলিকে নিয়ে, সেই ভাণ্ডার থেকে তিনি নির্বাচন করেছেন। মূল গ্রন্থে জটিলতা ও গুরুত্ব অনুসারে অধিকাংশ উপাখ্যানের বিস্তার; এই সংকলন সেই অনুপাতের প্রতি মনোযোগী নয়। পাটলিপুত্র নগরের উৎপত্তি এখানে এত সুবিস্তৃত যা মূলে অভাবনীয়। জমিয়ে গল্প বলাই যেন লেখকের উদ্দেশ্য, মূলের মিতভাষিতা ধরে রাখা নয়। ‘কাজেই ধরা পড়ল পুত্রক। টেনে আনা হল তাকে রাজার সামনে। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন রাজামশায়’ – এ-জাতীয় বাক্যে ঘূর্ণিত হতে থাকে আখ্যান। এবং অগণন অনুচ্ছেদের বিভঙ্গে আর যতিচিহ্নের প্রাচুর্যে খুলে যায় বাংলা জনপ্রিয় কথাসাহিত্যের পরিচিত আঙ্গিক। পুনঃকথনের প্রাবল্যে চাপা পড়ে মূল গ্রন্থের সত্য ও আস্বাদ; যে নম্রতায় টনি বা হীরেন্দ্রলাল কান্তিমান তা আমরা খুঁজে পাই না। ৬৭২ পৃষ্ঠার পরিবেশনে যেমন পাই না অবনীন্দ্রনাথের মতো কোনো সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্যও।
আনন্দচন্দ্রের ১৮৫৭-র সংস্করণে যত মুদ্রণপ্রমাদ ছিল, ১৯৭৫-এর হীরেন্দ্রলালে ছিল তার থেকে কিছু বেশি। ২০১২-র এই সংস্করণে সেই সংখ্যা গণনার অতীত। বাংলা প্রকাশনার যে যথার্থ উন্নতি ঘটেছে প্রচ্ছদে টাইপে অলংকরণে অথবা বইয়ের অঙ্গসজ্জায়, যা এই সংস্করণেও সমাদরের যোগ্য, তার পাশে মুদ্রণ-শুদ্ধির এই প্রগতিও চোখে পড়ে বৈকি। কিন্তু কাঞ্চনমূল্যে বাংলা বই কিনে যে পাঠক কেবল নেই-নেই করবেন তিনি অবিশ্বাসী ও জঘন্য নাস্তিক, তাঁর কথা কানে নিতে নেই।
এই দীর্ঘ আলোচনায় অনেক কিছুই বাদ পড়ল। অনুবাদ প্রসঙ্গে যেমন উমেশচন্দ্র গুপ্ত কবিরত্ন ও মহামহোপাধ্যায় কমলকৃষ্ণ স্মৃতিতীর্থ। বাংলাভাষায় কথাসরিৎসাগর কোনো ধারাবাহিক চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে নি। তার নানা আবির্ভাব ও আলোচনা এতটাই খাপছাড়া এবং আকস্মিক, দুষ্প্রাপ্যতায় দুর্গম ও বিস্মৃতিতে আচ্ছন্ন যে সাধারণ পাঠক কেন, যাঁরা এ নিয়ে কাজ করেছেন তাঁরাও পূর্বগামীদের সমস্ত কাজ বিষয়ে অবহিত নন। যা কিছু প্রচেষ্টা হয়েছে তার মধ্যে হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের কাজ মহত্তম। কিছু সম্পাদকীয় অপূর্ণতা সত্ত্বেও এই অনুবাদ মূলের সত্য ও জিজ্ঞাসাকে বহন করছে। বহুকাল হল এই সংস্করণটি অপ্রাপ্য ও বিস্মৃত। সেটি পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারেন প্রকাশক। নতুন করে সম্পাদিত হয়ে তার একটি সটীক ও সভাষ্য বৃহৎ সংস্করণও বেরোতে পারে। সেই উপলক্ষ্যে মূল কাব্যের নিরিখে অনুবাদটি গভীর ভাবে খুঁটিয়ে দেখতে পারেন সংস্কৃতজ্ঞ কোনো পণ্ডিত।
কথাসরিৎসাগরের সংস্কৃত-বাংলা সমান্তরাল পাঠের একটি দ্বিভাষিক সংস্করণই বা কেন থাকবে না? আবার, চলিত ভাষায় সম্পূর্ণ নতুন একটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কথাও ভাবা উচিত। সেটা হীরেন্দ্রলালের অনুগামী না হয়ে, কিংবা কোনো ইংরেজি অনুবাদের বশবর্তী না হয়ে, একেবারে মূলের ভূমি থেকে বিকশিত হবে। সেই সঙ্গে সাবালক পাঠকের উপযোগী একটি সারানুবাদেরও প্রয়োজন আছে। মূল থেকে চয়ন করা কিছু উদ্ধৃতি সেখানে মূলের সঙ্গে পাঠকের ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে তুলবে, যেমন রাজশেখরের সারানুবাদগুলিতে আছে, সেই আশাও থাকবে অনুবাদকের কাছে। হয়তো জীবানন্দ বিদ্যাসাগর প্রণীত সেই ‘গদ্যাত্মকঃ কথাসরিৎসাগরঃ’-কেও কাজে লাগাতে পারবেন ভবিষ্যতের অনুবাদকেরা।
বাংলা কথাসাহিত্য অদ্যাবধি খুব গ্রহণ করে নি কথাসরিৎসাগর থেকে। অভিনবত্বের খোঁজে অধুনা অনেক সাহিত্যিক পৌরাণিক বিষয়ে উৎসাহী হয়েছেন। সমকালীন বিষয় বোধহয় অতিব্যবহারে ক্লিষ্ট অথবা পরিস্থিতির জটিলতায় বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। কথাসরিৎসাগরে আগ্রহী হলে বাংলা সাহিত্যরচনায় নিশ্চয় নতুন উপাদানের সম্ভাবনা দেখা দেবে।
প্রসঙ্গ-সূত্র :
[২৫] অথচ উইলসনের কোনো সংশয় নেই। সোমদেবকে তিনি compiler of the Vrihat Katha বলে উল্লেখ করেছিলেন। (পূর্বোক্ত Hindu Fiction নিবন্ধ)
[২৬] কোনো চরিত্র কামতাড়িত হচ্ছে, প্রধানত সেই উল্লেখগুলো এড়িয়ে গেছেন আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ।
[২৭] কথাসরিৎসাগর ২য় খণ্ড, হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের অনুবাদ, অনুবাদকের ভূমিকায় উদ্ধৃত।
[২৮] কথাসরিৎসাগর ২য় খণ্ড, হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের অনুবাদ – সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত Foreword-এ আলোচিত।
[২৯] উৎসর্গ-পত্র, জাতক, ১ম খণ্ড, ঈশানচন্দ্র ঘোষ, (করুণা প্রকাশনী)
[৩০] এই অংশে সোমদেব চন্দ্রালোক অর্থে ‘চন্দ্রিকা’ ও চন্দ্র (মৃগাঙ্ক) অর্থে ‘মৃগলক্ষ্মা’ শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন।
[৩১] টনির অনুবাদ - After long intermission the light of the moon was beautifully clear, and the earth, enfolded by the young fresh grass, showed its joy by sweating dew drops, and the forest trees, closely embraced again and again by the winds of the Malaya mountain, were all trembling, bristling with thorns, and full of sap. The warder of Kāma, the cuckoo, beholding the stalk of the mango-tree, with its note seemed to forbid the pride of coy damsels; and rows of bees fell with a loud hum from the flowery creepers, like showers of arrows shot from the bow of the great warrior Kāma. And Naravāhanadatta’s ministers, Gomukha and the others, beholding at that time this activity of spring, said to Naravāhanadatta: “See King, this mountain of Ṛishabha is altogether changed, and is now a mountain of flowers, since the dense lines of forest with which it is covered have their blossoms full-grown with spring…
[৩২] টনির অনুবাদ - The city was resplendent on that occasion, her lord having returned from sojourning abroad. She was clothed in the red silk of banners, round windows were her expanded eyes, the full pitchers in the space in front of the gates were two swelling breasts, the joyous shouts of the crowd were her cheerful conversation, and white palaces were her smile.
(পরবাস-৫৭, জুলাই ২০১৪)