ISSN 1563-8685




শেষ অধ্যায়

বারুণ ভট্টাচার্য খ্যাতনামা সাহিত্যিক, বস্তুতঃ আমার মতন সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের কোনও সম্ভাবনা এমনিতে থাকার কথা নয়। কিন্তু পরিচয় হল, এবং তাঁর সঙ্গে কিছুটা অন্তরঙ্গতাও হল, তবে তা অত্যন্ত অল্প সময়ের জন্য।

তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয় তো বেশ কিছুকাল, বইমেলা, সাহিত্যসভা আর টেলিভিশনের পর্দায় দেখা, কিছুটা দূরত্ব রেখে, একজন মানুষকে সামগ্রিক ভাবে চেনার জন্য যা যথেষ্ট নয়। পরিচয় হল হঠাৎ। একদিন ছোটবেলার বন্ধু রঞ্জন (যে নিজেও চিকিৎসক) তার একেবারে নিজস্ব ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করল, গলফগ্রীনে গিয়ে কোনও ক্যান্সার রোগী দেখা সম্ভব কিনা, সময়টা মে মাসের শেষের দিক। রোগীর পরিচয় পেয়ে আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলাম, তারপর হাঁ বললাম। সে সময়ে আমার অবস্থা ঠিক বলে বোঝানো মুস্কিল। গত দশবছর শেষ পর্যায়ের ক্যান্সার রোগী দেখে আসছি। অনেক নামী লোককেই দেখেছি, কিন্তু নবারুণ ভট্টাচার্য সেই বিশিষ্টদের থেকে আলাদা, সেটা কিছুটা জানা আছে। মনটা খারাপও হয়ে গেল, কেননা তাঁর অসুখের যে বিবরণ শোনা গেল, তাতে খুব বেশীদিন সময় পাওয়া যাবে না।

নির্দিষ্ট দিনে রঞ্জনের সঙ্গেই গেলাম, আর প্রায় একঘন্টা পর যখন তাঁর বাড়ি থেকে বেরোলাম ততক্ষণে তিনি হয়ে গেছেন 'নবারুণদা'। তাঁর প্রথম কথাটাই ছিল "তোমার কথা রঞ্জনের কাছে অনেক শুনেছি"। আমি তখন দেখছি - রোগা, শরীরে ভয়ঙ্কর Pancreatic Cancer এর বিভিন্ন চিহ্ন ধারণ করেও উজ্জ্বল চোখের ধার এতটুকু কমেনি। মনে হল, হ্যাঁ কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে যিনি আমাদের যাবতীয় মধ্যবিত্ততাকে চুরমার করেছেন, আর তুলে এনেছেন subaltern দের জীবনচিত্র, তাঁর তো এরকমই চোখ হওয়ার কথা।

তারপরে বার চারেক তাঁর বাড়ি যাওয়া, আর প্রতিবারই সমসাময়িক কাল সম্পর্কে, রাজনীতি ও সমাজ সম্বন্ধে তাঁর কাছ থেকে টুকরো টুকরো কথা জেনে নেওয়া। এটুকু বুঝলাম তাঁর সাহিত্য ও জীবনচর্যাকে আলাদা করা যাবেনা, মনেপ্রাণে একটি radical দর্শনের ওপর তাঁর বিশ্বাস টলানো যাবেনা। আর সমাজের নীচুতলার ওপর তাঁর ভালবাসা তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এমনি এমনি ঝরে পড়েনি। যদিও তিনি অত্যন্ত স্বল্পবাক, তাঁর মধ্যেই কিছু কিছু কথায় আমার এরকম ধারণা হয়েছিল।

নিজের রোগযন্ত্রণা সম্বন্ধেও তাঁর কাছ থেকে জোর করে জেনে নিতে হত। কখনই অন্য অনেক রোগীদের মতন যন্ত্রণাকাতর ছিলেন না। কিন্তু সমসাময়িক কোনও অনিয়ম, অন্যায়ের কথা ওঠামাত্র তাঁর চোখ হত যন্ত্রণাকাতর। সাধারণতঃ শেষ পর্যায়ের রোগীরা নিজের ও পরিজনদের সম্পর্কে ভাবে, তাঁর ভাবনা ছিল অন্যরকমের।

যাইহোক, চিকিৎসক হিসেবে আমি জানতাম আমার বিশেষ কিছু করার নেই। Palliation অর্থাৎ কিছুটা কষ্ট কমানোর চেষ্টাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। তাঁকে নার্সিং হোমে ভর্তি করিয়ে একটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টকর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরের জমা জল বার করা হত, লেগেছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে বলতেন — "শোন তুমি এত ভালভাবে এটা করলে, আমার কোনও কষ্ট হয়নি"।

আস্তে আস্তে দিন ফুরিয়ে আসছিল। তিনি নিজেও তা জানতেন। তবু কোনও অনুযোগ তিনি করতেন না। আমি জানতাম মিরাক্‌ল ছাড়া কোনও ভাবেই তাঁর আয়ু বাড়ানো সম্ভব নয়।

১৮ই জুলাই তিনি আবার নার্সিং হোমে ভর্তি হলেন। ২২ তারিখে নিয়ে যাওয়া হল ঠাকুরপুকুরের ক্যান্সার সেন্টার ওয়েলফেয়ার হোমে, কেননা জণ্ডিস দেখা দিয়েছিল। কেবিনে রেখে তাঁর চিকিৎসা চলল, প্রতিদিনই অবস্থার অবনতি হতে লাগল, supportive medicine দেওয়া সত্ত্বেও, তবু যতবারই দেখতে গেছি, কোনও শারীরিক কষ্ট নিয়ে উচ্চকিত অনুযোগ নেই। শুনেছেন কবিতা, গান — নিজের পছন্দ মতন। বাইরের মানুষের ভীড়, মিডিয়া-র দাপাদাপিতে হয়তো অস্বস্তি বোধ করেছেন। তবে সে সময়েও পছন্দের মানুষের কাছেও ছিলেন অনর্গল।

২৮ তারিখ ছিল সোমবার, সকালেই অবস্থার অবনতি হওয়াতে ICU-তে নিয়ে যাওয়া হল। শেষের দিনটি ছাড়া সবসময়েই বলেছেন, ঠিক আছি। ৩১শে জুলাই ৪টা ২০ মিনিটে লড়াই শেষ হল। আমার মনে হল — একটা চলমান লড়াই থামল--কিন্তু আসলে আর একটা লড়াই শুরু হল। যে ফ্যাতাড়ুদের জন্য তাঁর কলম আগুন ঝরিয়েছে — তারা শেষ দেখবেই। সে সময়ে হয়তো নবারুণদা সামনে থাকবেন না — অথবা অদৃশ্য থেকে সেই তুমুল প্যান্ডিমনিয়ম দেখবেন। আশেপাশে যে চারপেয়েরা অদৃশ্য দাঁত, নখ বার করেছে--তারা সাবধান! প্রোটোকলের জন্য আমার মতন অনেকেই সেই ৩১ তারিখ যে শ্লোগান দিতে পারেনি তারা বলবে — নবারুণদা অমর রহে! লঙ লিভ্‌ ফ্যাতাড়ু!!


(ফ্যাতাড়ু সম্বন্ধে পরবাসে পূর্বে প্রকাশিত দু'টি লেখা দেখা যেতে পারেঃ তপোধীর ভট্টাচার্যের কার্নিভালের বিস্ফোরণঃ নবারুণ ভট্টাচার্যের কথাসাহিত্য এবং পারমিতা দাস-এর ফ্যাতাড়ুদের ওপর টপ-টেন Q&A--সম্পাদক)



(পরবাস-৫৮, নভেম্বর ২০১৪)