এই পর্বে থাকছে উনিশ-বিশ শতকে ঠাকুরবাড়ির পরিচালনায় ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত স্বদেশ ভ্রমণের আসর-জমানো মনমাতানো গল্পের বিবরণ। এ গল্পের কথক এক তৎকালীন নারী সে তো বুদ্ধিমান পাঠক এই লেখার শিরোনাম দেখেই ধরে ফেলেছেন। তিনি বিলেত যাননি, বিদেশেই যাননি, শুধুমাত্র ভারত-ভ্রমণ করেছেন, এবং অনেক সময়েই তা পরিবারস্থ পুরুষদের চাকরির কল্যাণে। কিন্তু তবুও বেড়াতে গিয়ে কিম্বা বাংলা ভিন্ন অন্যান্য প্রদেশে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে আসার সুবাদে বারে বারেই যে অভিজ্ঞতা তিনি সঞ্চয় করেছেন তার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিমানসের অনন্য দৃষ্টি ও রসবোধের মিশেলে ফুটিয়ে তুলেছেন সেইসময়কার ভারতবর্ষের ভারতীয় এবং অভারতীয় অভিজাত উচ্চবর্গীয় সমাজের জীবন্ত চিত্র। সরস অথচ মার্জিত এই গল্পগুলির চরিত্র এমনকি একেক সময় হয়ে উঠেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিম্বা ‘বড়দাদা’ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনেক সময়েই সঙ্গে আছেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। আর তাছাড়াও উৎকৃষ্ট দেশীয় এবং বিদেশীয় ইংরেজ সমাজের আদব-কায়দা, সামাজিক ব্যাকরণের রসসিক্ত বর্ণনা চিঠির পাতা বেয়ে পৌঁছে গিয়েছে ‘ভারতী’ পত্রিকার পাতায় পাতায় পাঠকের দরবারে (সন ১২৯৩-১৩২০)।
হ্যাঁ, এই কথক স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২); রবীন্দ্রনাথের থেকে সাত বছরের বড় এই দিদিটির সুতীক্ষ্ণ মনীষার কথা বাঙালিমাত্রেরই গোচর। ভ্রমণকথা লেখার সময়েও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। রসোত্তীর্ণ এই লেখাগুলিতে যেমন আছে বেড়ানোর অবাধ বিবরণ তেমনি আছে স্বর্ণকুমারীর দৃষ্টি-নিস্নাত কখনো গভীর কখনো মজাদার বাহির-ছবি। বাঙালি নারী হয়ে জন্মাবার মহিমা, কিম্বা পরাধীনতার সুগভীর অথচ সর্বসমক্ষে লঘুভাবে প্রকাশ-যন্ত্রণার সঙ্গে শ্লেষাত্মক ইঙ্গিতে একাত্ম হয়ে মিশে গেছে স্বর্ণকুমারীর ধর্মবোধ, অন্তর-ভাবনা, শিক্ষা এবং মনোদীক্ষা। প্রয়াগ, গাজীপুর, সোলাপুর, দার্জিলিং, নীলগিরি, পাণ্ডারপুর এবং পুরী বেড়ানোর গল্প নিয়ে আসর জাঁকিয়ে, আজও পর্যন্ত একই রকম আকর্ষণীয়ভাবে পাঠকদের মাতিয়ে তুলেছেন স্বর্ণকুমারী।
স্বর্ণকুমারীর ভালো লাগে ইতিহাস জানতে, চিনতে, বুঝতে এবং বোঝাতে। মন্দির সম্পর্কে আগ্রহী হলেও হিন্দু মন্দিরের রীতি-নীতির বাড়াবাড়ি, আচারের অনর্থক ঘটা স্বর্ণকুমারীকে বিরক্তই করে তোলে। সব চাইতে মজা হয় যখন রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে দার্জিলিং যান স্বর্ণকুমারী এবং মহিলা দলবল, সেখানে রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন সকলের অভিভাবক, কেননা একে পুরুষ তায় আবার রবীন্দ্রনাথের এটি দ্বিতীয় দার্জিলিং ভ্রমণ। তা এহেন রবির ছবি এঁকেছেন সাত বছরের বড় দিদি যাতে করে মানুষ রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায় বড় কাছের করে, “ ... আমরা যদিও এই নূতন দার্জিলিং আসিয়াছি, কিন্তু আমাদের অভিভাবকটি যিনি আমাদের সঙ্গে করিয়া আনিতেছিলেন (তিনি এখন কলিকাতায় গিয়াছেন) আগে আর একবার আসিয়াছিলেন। ঘুম স্টেশনে পৌঁছিবার কিছু আগে হইতে তিনি ভাবিয়া লইয়াছেন এইবার ট্রেন দার্জিলিং স্টেশন আসিবে। তিনি যত বাড়িঘর দেখিতেছেন ততই প্রফুল্ল হইয়া উঠিতেছেন, তাঁহার পূর্ব স্মৃতি ততই নূতন হইয়া উঠিতেছে, গতবারের যে বাড়িতে ছিলেন তাহার কাছে যে ঝরনাটি ছিল সেটি পর্যন্ত তিনি আমাদের দেখাইলেন, সবই মিলিয়া গেল, এখন কেবল গাড়ি থামিলে হয়—দার্জিলিং-এ নামা মাত্র বাকি। গাড়িও থামিল, তিনি চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন আমাদের কেহ লইতে আসিয়াছে কিনা, দেখিলেন কোথায় কেহ নাই। কাজেই আমরা গাড়িতে বসিয়া রহিলাম, লোকজন ডাকিয়া আমাদের যাইবার বন্দোবস্ত করিবেন বলিয়া তিনি নামিলেন। এদিকে কুলিরা জিনিস লইতে উপস্থিত, ভুটিয়া কুলির চেহারা সেই প্রথম একেবারে আমাদের চোখের কাছে—কী রকম ষণ্ডা চেহারা, গাল দিয়া যেন রক্ত পড়িতেছে, মুখের হাড়গুলা সব বাহির হইয়া রহিয়াছে, এক একজন স্ত্রীলোক পরণে একটা ঘাগরা, তার উপর কোর্তা, কোর্তার উপর এক রাজ্যের মালা, চেহারা ঠিক ডাইনির মতো, দেখিলে ভয় হয়। তাহারা অবুঝ ভাষায় কেহ ভিক্ষা মাগিতেছে, কেহ কুলি—জিনিস লইবে কিনা জিজ্ঞাসা করিতেছে। আমরা কী বলিব কিছু ভাবিয়া পাইতেছি না, --- আমাদের ভাব দেখিয়া একজন কুলি একটা বাক্সে হাত দিয়া চোখ মুখ নাড়িয়া বলিল--- গুম-গুম স্টিশন উত্রেগা? আমরা তখন বুঝিলাম এটা দার্জিলিং নয়। এই সময় আমাদের অভিভাবকটিও ফিরিয়া আসিলেন, তখন ঘুম শুনিয়া তাহার ঘুম ছুটিয়া গেল। .........”
দার্জিলিং-এর বিখ্যাত বাড়ি কাস্লটন হাউসে থাকাকালীন প্রথমদিকে স্বর্ণকুমারী অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছুদিন, আর স্বাভাবিকভাবেই এইসময় তাঁর মন কলকাতার বাড়ির জন্য কাতর হয়ে উঠেছিল আর এমনি সময় দিদির লেখায় আবার পাই ভাই ফিলজফার রবীন্দ্রনাথকে : “ …বলব কী ভাই, তখনকার দুঃখ মনে করে এখনও আমার চক্ষের জলে বক্ষ ভেসে যেতে পারে—তবে যে যায়না—সে কেবল আমার একটি ফিলজফার বন্ধুর উপদেশে হঠাৎ আমি ফিলজফার হয়ে উঠেছি বলে। তাঁর ফিলজফি হচ্ছে— ‘যে কোনো কষ্টের ভাবনা হোক না কেন তার সঙ্গে একটা মস্ত ‘যদি’ কথা বসাতে পারলেই সে কষ্ট হতে অব্যাহতি পাওয়া যায়। মনে করো তোমার যদি কোনো একটা জিনিস খুব পছন্দসই হয় আর কিনতে ইচ্ছা করে তখনই তুমি ভাববে এ জিনিসটা যদি নাই দেখতে কিংবা যদি না ভালো হত তাহলেও তো তোমার কিনতে ইচ্ছা হবার কোনো কারণ থাকতনা, তাহলে এখনই বা ইচ্ছা করবে কেন? …………দুঃখের বিষয় এই, সমস্ত সময়টাই আমাদের এই কথা মনে থাকে, কেবল আসল সময় ছাড়া। যাঁহারা উপদেশ ক(??) তাঁহারা যে এই সম্বন্ধে বাদ পড়েন তা নয়, নিদেন আমাদের ফিলজফারটিকে তো বেশি সময় তাঁহার নিজের কথাই মনে করিয়ে দিতে হয়, তখন তাঁর উত্তর কিন্তু সম্পূর্ণ আর একতর(??) হয়ে পড়ে… ” (দার্জিলিংপত্র)
আবার প্রয়াগ যাত্রার সময় উঠে আসে ‘সক্রেটিসদাদা’র কথা। বলাবাহুল্য ইনি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, উদ্ভট খেয়াল আর প্রতিভার অফুরন্ত ভাণ্ডার। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসে ছোট ছেলেমেয়েদের হাত ধরে দাঁড়িয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্বর্ণকুমারীর হকচকিয়ে যাওয়া মনের অবস্থা আর তার থেকে পরিত্রাণের উপায় এই সক্রেটিস দাদা, “ …… যষ্টিস্বরূপ-স্বরূপিনী পুত্র-কন্যা দুইটিকে লইয়া হাসিতে হাসিতে ঘোড়ার গাড়িতে উঠিলাম। …… কী একটা ভীষণ হট্টগোলের মধ্যে আসিয়া পড়িলাম, যাত্রী দিগের দৌড়াদৌড়ি, মুটেদের ছুটাছুটি, --- জিনিসপত্র বোঝাই হাতগাড়ির ঠেলাঠেলি… একটা অকুলপাথারের মধ্যে যেন পড়িয়া গেলাম। … ভাবিতে লাগিলাম—প্ল্যাটফর্মরূপ ভবসাগর পার হইয়া কী করিয়া প্রাণে প্রাণে তিনটি নিরীহ প্রাণী রেল গাড়ির কামরায় গিয়া উঠি; ভাবনাটা এমন বলবৎ হইয়া দাঁড়াইল যে শেষ উইলের বন্দোবস্ত পর্যন্ত মনের মধ্যে আসিয়া গেল। এমন সময় একজন সাহেবকে আমাদের দিকে অগ্রসর হইতে দেখিলাম, কিন্তু সাহেবটি নিকটে আসিবামাত্র তাহার হ্যাটকোটের খোলসের মধ্য হইতে সক্রেটিসদাদার পরিচিত বাঙ্গালী মুখটি, এবং সে মুখের নীরব আস্ফালনটা পর্যন্ত যেই চোখে পড়িয়া গেল—অমনি মনে মনে অনেকটা ভরসার উদয় হইল, তাহার পর তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে নির্বিঘ্নে যখন গাড়ির কামরায় গিয়া উঠিয়া বসিলাম—তখন মনে হইল—আমি তো আর্যনারী; একশোবার ছাড়া একবার ঐ প্ল্যাটফর্মটা প্রদক্ষিণ করিয়া আসিতে পারি। তখন আগের সঙ্কোচটা মনে করিয়া হাসি পাইল!” এখানেই শেষ নয়, দাদার পরিচয় আরও আছে, “ ... আর একজন ইঁহার নাম রাখিয়াছেন ব্যস্তবাগীশ। কেন না ইনি যেখানে যান, গিয়াই ঘড়ি খুলিয়া যাই যাই আরম্ভ করেন, আর অগাধ কাজের হিসাব খুলিয়া রেলগাড়ির সহিত নিজের জীবনের তুলনা করিতে বসেন। সময়ের মূল্য তাঁহার মতো আর কেহ বোঝে না—তাই তিনি একবার যেখানে গিয়া বসেন—সেইখানেই দিনটা কাটাইয়া আসেন।” (প্রয়াগ)
কৃষ্ণভাবিনীর মতো স্বর্ণকুমারীর লেখাতেও উঠে এসেছে ইংরেজি পোশাকের মাহাত্ম্য। এই প্রয়াগ যাত্রাপথেই নিজেদের কামরা থেকে আপামর বঙ্গবাসী যাত্রীসাধারণকে দূরে রাখার জন্য দ্বিজেন্দ্রনাথ দরকার মতো সেজেছেন হ্যাটকোটধারী ইংরেজ আর লালমুখোদের দূরে রাখতে চাপকান-টুপি পরিহিত সম্ভ্রান্ত জেনানার চলনদার বাঙালি পুরুষ! ভাগ্যিস সে সময় গাড়ি রিজার্ভ করলেই বেড়াতে যাওয়ার অর্ধেক সমস্যা মিটে যেত, আজকালকার মতো সিট রিজার্ভ করার চল থাকলে স্বাতন্ত্র্য-পিয়াসী স্বর্ণকুমারীদের অবস্থা সঙিন হতে বাধ্য হত বৈকি। লেখায় নানাভাবে পাওয়া যায় স্বর্ণকুমারীর স্বাধীন মনের পরিচয়। কৃষ্ণভাবিনীর মতোই স্বর্ণকুমারী ভ্রমণ করেছেন ১৮৮২ সালের পর, অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষ ভাগে, কিন্তু বলাই বাহুল্য সমুদ্রযাত্রার দায় তাঁকে নিতে হয়নি, তাছাড়াও ঠাকুর পরিবারের সদস্য হিসেবে স্বর্ণকুমারীর ভ্রমণ সর্বদাই খোলা হাওয়ার রসদ যুগিয়েছে। সেখানে সামাজিক বিধিনিষেধের গণ্ডি তার কূট-কলা বিস্তার করতে পারেনি। তাই অনায়াসে প্রকাশ পায় স্বর্ণকুমারীর স্বাধীন মন, যার সঙ্গে জুড়ে যায় বঙ্গললনার সামাজিক চরিত্র, “আমরা যে খাঁচার পাখি, খাঁচায় মরতে আমাদের তো দুঃখ নেই, কিন্তু কষ্টে সৃষ্টে শিকলি কেটে আকাশে ওঠা যদি কেবল সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে ধূলায় লুটিয়ে পড়ার জন্যই হয় তো সে কি সামান্য কষ্ট? ” (দার্জিলিং পত্র)
রসিকতায় স্বর্ণকুমারীকে এঁটে ওঠা মুশকিল। লঘু থেকে গুরু এমন খুব কম বিষয়ই আছে যাতে স্বর্ণকুমারীর রসবোধ বর্ষিত হয়নি! ইংরেজ সাহেবকে জুতো ছুঁড়ে মারা কিম্বা নিজের পঞ্চত্ব প্রাপ্তির আশঙ্কা কিম্বা বিজন প্রদেশে একাকী বেরিয়ে পথ হারানোর অসীম দুর্গতি অথবা মেমসাহেবিয়ানার কেতাদুরুস্ত্ গল্প বা তিব্বতি লামার সুন্দরী বউ-এর বর্ণনা সবেতেই স্বর্ণকুমারীর তির্যক খোঁচার আড়ালে নির্মল হাসিভরা মুখের আদল পাঠকের চোখ টানতে বাধ্য। যেমন এই আকেলকোট যাওয়ার সময় ট্রেনের কামরায় ঘটা একটুকরো মজার মজলিসি বর্ণনা: “ ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বলিয়া গিয়াছেন বটে, স্ত্রীলোকের দীর্ঘ কেশ দেখিয়াই সাপিনী তাপিনী হইয়া বিবরে লুকাইয়াছে, কিন্তু ইংরাজ ললনার স্বল্পকেশ সত্ত্বেও সাপিনী যখন সে দেশে মুখ দেখাইতে লজ্জা পায়…উক্ত কারণ সুন্দরীর দীর্ঘকেশ-রাশি নহে, তাহার শক্তি-রূপা জিহ্বা। স্টেশনে সেদিন মহা ভিড়, ফার্স্ট ক্লাসেও এমন একটি খালি কামরা পাওয়া গেল না, যেটি আমরা চারিজনে নির্বিবাদে অধিকার করিয়া বসি। কাজেই আমাদের দুজনকে একটি মহিলা কক্ষে আশ্রয় লইতে হইল; আর আমাদিগের সঙ্গী পুরুষ দুইজন স্বতন্ত্র গাড়িতে গিয়া বসিলেন। গাড়িতে উঠিয়া দেখিলাম একজন ইংরাজ ললনা তখন রাত্রিবেশ পরিধৃত অবস্থায় একটি বেঞ্চে অর্ধলীন হইয়া আয়েসে চা পান করিতেছেন, আর একটি স্থূলকায় ফিরিঙ্গি-রমণী অন্য বেঞ্চে বসিয়া আছেন। আমরা গাড়িতে উঠিয়া যথোচিত ভদ্রভাবে তাঁহাদের অধিকৃত দুইটি বেঞ্চের যৎকিঞ্চিৎ করিয়া স্থান অধিকার করিয়া বসিলাম। তাহাতে আমরা অনধিকার চর্চা বা কাহারও কিছু ক্ষতি করিতেছি না বলিয়াই জানিতাম, কিন্তু সার্বভৌমিক স্বাধীনতাধিকারবাদী ইংরাজললনাটির মেজাজ ইহাতে নিতান্তই বিগড়িয়া গেল, তিনি তো চায়ের পেয়ালা পিরিচ সশব্দে পোর্টম্যান্টের উপর রাখিয়া সহচরীকে সম্বোধনপূর্বক আমাদের আগমন সম্বন্ধে সক্রোধ মন্তব্য প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। ভদ্রলোকের মেয়ে এমন রূঢ় হইতে পারে আমি তো আগে তাহা জানিতাম না। ফার্স্ট ক্লাসের আরোহী, কাজেই ভদ্রমহিলা বলিয়া ধরিয়া লইতে হয় (তাহাছাড়া দেখিতেও মন্দ নহে)। …… তাঁহার এইরূপ অকারণ ক্রোধ দেখিয়া প্রথমটা আমরা ভারী অবাক হইয়া গিয়াছিলাম; কিন্তু তাহার পর নির্বিকার দার্শনিকের মতো শান্তভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মনোভাবের সহিত মুখ সৌন্দর্যের সম্বন্ধালোচনা করিতে করিতে একটা নূতনজ্ঞান এবং বেশ একটু আনন্দলাভ করিলাম। ...... সেদিন সুন্দরীর ক্রোধ-বিকৃত মুখের দিকে চাহিয়া জ্ঞানোদয় হইল যে সুন্দর মুখে উগ্র বিকৃত ভাবের মতো বীভৎস এবং আশ্চর্জজনক দৃশ্যসংসারে আর কিছু নাই। ... আমার তখন এমনটা ইচ্ছা করিতেছিল একখানা আয়না লইয়া তাঁহার মুখের সামনে ধরি!” (পত্র/ সোলাপুর, শ্রাবণ ১৮৯২)
আর সেই সময়কার লাটসাহেব সমাজের অনবদ্য চিত্রাঙ্কনের তো জুড়ি মেলা ভার। তথাকথিত ‘সোসাইটি’-র ব্যঙ্গচিত্রের কয়েক ঝলকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি স্বর্ণকুমারীর মন-মৌজি, আমোদ-ঘন ভ্রমণকথার মধুরেণ সমাপয়েত ঘটানো যাক, “একবার এইরূপ নিমন্ত্রণে আসিয়া বিজাপুরের ইঞ্জিনিয়ার সপরিবারে আমাদের বাড়িতে অতিথি হইয়াছিলেন। সপরিবার বলিতে তিনি, তাঁহার স্ত্রী এবং তাঁহার স্ত্রীর পূর্বস্বামীজাত যুবতিকন্যা। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যুবাপুরুষ কিন্তু তাঁহার স্ত্রী অর্ধ-বৃদ্ধা। তিনি যে কন্যাকে বিবাহ না করিয়া মাতাকে কেন বিবাহ করিলেন ইহাতে সকলেই বিস্ময় প্রকাশ করিত। কখনো কখনো এমনও ঘটিয়াছে, নবাগতেরা তাঁহাদের সহিত আলাপ করিতে আসিয়া কন্যাকেই গৃহকর্ত্রী বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন, এইরূপ ঘটনায় গৃহিণীর ক্রোধের আর সীমা থাকিত না।” (পত্র৬/ সোলাপুর)
অথবা, “বাস্তবিক, মেয়েরা সব দেশেই সমান। ভালোই হউক মন্দই হউক, পরের কথা লইয়া থাকিতে পারিলে ইঁহারা যেমন আরামে থাকেন এমন কিছুতে না। গভর্নর আসিতে তো ইঁহাদের সুখের সীমা ছিলনা। গভর্নর এখানে ছিলেন বড়োজোর ৩৬ ঘণ্টা; ইহার মধ্যে ত্রিশ ঘণ্টা কাল তো তাঁহাদের অশ্রান্ত আমোদ, মধ্যাহ্নভোজ, রাত্রিভোজ, বৈকালিক ব্যায়াম ক্রীড়া, সায়াহ্নিক আতসবাজি, স্কুলসমিতির অভিনন্দন, সভাসমিতির অভিনন্দন—এইরূপ নিমন্ত্রণের উপর নিমন্ত্রণে, সাজের উপর সাজ পরিবর্তনে তাঁহাদের তো উত্তেজনার বিরাম নাই… ” (ঐ)
আবার জবরদস্ত উচ্চবিত্ত ইঙ্গবলরুমে ফ্যান্সিড্রেস পার্টিতে, “ …… ফ্যান্সি বলে যিনি নর্তকী সাজিয়াছেন, তিনি অবশ্য নাচিতেছেন না। কাহারও পারসি ললনার সাজ, কেহ জাপানি ললনার জাঁকালো কোর্তা পরিয়াছেন। (জাপানি-বেশী রমণীটি কিছু স্থূলকায়, তাঁহাকে লক্ষ করিয়া অন্য একজন মহিলা নেপথ্যে বলিলেন, She is too fat for that dress) … এমনও ইংরাজ মহিলা আছেন যাঁহারা একরাত্রির জন্য এরূপ ব্যয়ে কুণ্ঠিতচিত্ত; তাঁহারাই এসময়ে কেহ পঞ্জাছক্কা বা দাসীবাঁদি সাজেন। নহিলে সকল সুন্দরীগণেরই মনোগত অভিপ্রায় কিসে তিনি অন্যের সাজের উপর টেক্কা দিবেন। পুরুষদের মধ্যে…চিনেম্যানের সাজই বেশিরভাগ, কেহ বা সম্ভ্রান্ত চিন, কেহ গরীব চিন, কেহ কাবুলি, কেহ নবাব, কেহ রাজা। …………… আবার ব্যান্ড বাজিয়া উঠিল, যিনি যেখানে ছিলেন দ্রুতবেগে নাচ ঘরে আসিয়া পৌঁছিলেন, যাঁহার সহিত যাঁহার নাচিবার কথা আছে দুজনে পাশাপাশি হইয়া দাঁড়াইলেন, আবার নাচ আরম্ভ হইল। নাচ ঘরের দুইপার্শ্বে উচ্চমণ্ডপ; যাঁহারা নাচেন না, শুধু দর্শক, তাঁহারা সোপানারূঢ় হইয়া সেইখানে আসিয়া বসিয়াছেন, আমরাও বসিয়াছি, সম্মুখের উত্তেজনা, উন্মত্ততা, ঘুর্ণ্যমান অপূর্ব দৃশ্যের দিকে অবাক নেত্রে চাহিয়া ভাবিতেছি, অসভ্য ভুটিয়া নরনারীর নাচে, আর এই সুসভ্য মহামহিমার্ণব ইংরাজ নরনারীর সতালচরণ বিক্ষেপে ভাবগতরুচিগত প্রভেদটা এমনকি?” (পত্র-৫/ সোলাপুর)
(পরবাস-৫৮, নভেম্বর ২০১৪)