ডক্টর রাধামাধব বল স্টেথোটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, টেবিলেই ছিল, বোধহয় কাগজ টাগজ চাপা পড়ে গিয়ে থাকতে পারে। চশমাটাও যে কোথায় রাখলেন--আজকাল খালি চোখে একটু অসুবিধা হয়, ওই বেশিক্ষণ কমপিউটারে বসার ফল আর কি—তাছাড়া কিছু ঠিকমতো খুঁজে না পাওয়াটা ইদানীং বেড়েছে আর সেটার কৃতিত্ব বা দোষ হারানকেই দিতে হয়। সারাক্ষণ সঙ্গে থাকে—‘মামু প্রেসক্রিপশনগুলো কি ওষুধ সমেত পেশেন্টদের বুঝিয়ে দোব? ঠাণ্ডা পড়ছে, তোমার মাফলারটা বার করে রাখছি। রাতে মাথার দিকের জানলাটা আধ-পাল্লা বন্ধ করে দিই, কি বলো? আমি পাশের ঘরেই আছি, ডাকবে কিন্তু, বাথরুমের আলো জ্বালা আছে, হোঁচট খেয়ো না যেন!’--এই হল হারান--রাধামাধব বাবুর হারানিধি। বি,এস,সি পাস করে হসপিটালের কম্পাউন্ডার ও তার সাথে ডক্টর বলের ছায়াসঙ্গী। মূর্তিমান নির্ভরতাও বলা যেতে পারে। আর যা হয়ে থাকে, নির্ভর করার মানুষটি একটু সরে গেলেই কেমন যেন ‘কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছি না’ ভাব আর হয়রানির একশেষ হতে হয়।
ঠিক এই মুহূর্তে স্টেথোটা খোঁজার কারণ এখন ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁই ছুঁই করছে, চশমাটা বোধহয় পকেটে রেখেই কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়াবেন ভাবছিলেন, দেখলেন একজন ওঁর চেম্বারের বাইরে জ্বরে নেতিয়ে ধুঁকছে---আর দ্বিরুত্তি না করে ডেকে নিলেন,--তাই স্টেথো। মনে মনে হেসে ভাবলেন হারান তো নেই ভাত খেতে দেরি হলে কে আর বকবে! ভেবেই মনটা খানিক উদাসও যে হল না তা নয়। রুগী দেখতে দেখতে চোখ চলে গেল টেবিলে রাখা বরবেশে হারান আর মালা-চন্দনে সাজা নার্স মৌমিতার ছবির দিকে। হাসছে ওরা--মাধব বাবুই জোর করে ওদের পাঠিয়েছেন সাত দিন দীঘা ঘুরে আসতে। হারান তাকে কমিয়ে করলে পাঁচ দিন।
হাসপাতালের কম্পাউন্ডের মধ্যেই একতলা সব কোয়ার্টার। সি,এম,ও হওয়ায় বাড়িটা একটু বড়। ডক্টর বল ভাবেন কি হবে এত বড় বাড়ি, বরং যারা বৌ-বাচ্চা নিয়ে হাঁসফাঁস করে তাদেরই তো বড় জায়গা দরকার। উল্টে যত বয়স বাড়ে ছোট বাড়িই ভালো। সেই যে বলে না ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’। তালা খুলতে খুলতে এত বছরের অভ্যাসে বলেই ফেললেন ‘কইরে হারান, কি রেঁধেছিস--?’ (বছর ষোলো হতেই হারান পড়াশোনা করার সাথে সাথে ওঁর সব ভারই নিয়েছিল যে, আর সেই ইস্তক হাসপাতালের কাজের সাথে রাধামাধববাবুর দেখাশুনো সবই ও কেমন করে যে সামলায় সে ওই জানে। ‘তুই এতসব দেখবি কেন? তোর না এখন লেখাপড়ার সময়?’--সবই বুঝিয়েছেন রাধামাধব, কিন্ত নাছোড় ছাড়লে তো!) তারপরই হাতে ধরা তালা চাবিটা দেখেই মনে পড়ল এ-কদিন তো বুধিয়ার মা-ই রেঁধে দিয়ে গেছে যা পেরেছে। হারান সব বুঝিয়ে বলে দিয়েছে ‘সাড়ে বারোটার আগে ভাত চাপাবে না কিন্তু, খাবার না ঠাণ্ডা হয়!’ কিন্তু কি জানি কেউ ব্যস্ত হওয়ার নেই তাই কি সব পানসে ঠেকল?
হসপিটালে যাওয়া আবার তিনটেয়, ইনডোরের রাউন্ড সেরে আউটডোরের পেশেন্ট দেখা শুরু সেই সাড়ে পাঁচটায়। এই বাড়িটায় বেশ কিছু আগেকার দিনের আসবাব ছিল, রাধামাধববাবু আর সেগুলো পাল্টাতে দেন নি। ওঁর দাদুর যেমন আরাম কেদারা ছিল ঠিক তেমন এখানেও একটা আছে। সেটাতেই এলিয়ে এবারের পূজোসংখ্যা আনন্দমেলাটা দেখছিলেন--ছোটবেলার ওই অভ্যাসটা রয়েই গেছে। বইয়ের ফাঁকে পেজ-মার্ক করা একটা ছবি পড়ল কোলে--ধুতিপাঞ্জাবি, টোপর পরা, কেঁদে কাজল রগড়ানো এক শিশুকে সমস্ত আনন্দ দিয়ে জাপটে ধরে মুখের দিকে চেয়ে আছে তিরিশ বছরের প্রাণোচ্ছল এক যুবক—সদ্য জয়েন করা ডাক্তার রাধামাধব বল। ভালো করে দেখলে বোধহয় দেখা যেত শিশুর মুখে অন্নপ্রাশনের পায়েস লেগে রয়েছে। কিম্বা হয়তো মনের ছবিতেই ওটা ধরা পড়ে—সেদিন ছিল হারানের প্রথম ভাত খাওয়া--সারা দিন কি হই হই--হসপিটাল ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে সকলেই উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছিল প্র্যামে শোয়া হারানকে। ডক্টর বল কাজের ব্যাপারে যে একটু এদিক ওদিক চান না তা তো ততদিনে সবাই জেনে গ্যাছে। মেট্রন ছায়াদি নিজে পায়েস রেঁধেছিলেন, ফুল মালা দিয়ে সাজানো হয়েছিল হারানের ঠ্যালা গাড়ি। হসপিটালের সব স্টাফ, ঝাড়ুদার বজরংগী, ওর জরু ফুলমতিয়া, মালি রাজকিষেণ; সবার সেদিন কি ব্যস্ততা--ডাগদারবাবুর ভাগ্নের মু ঝুট্টী। যত না গল্পের বই পড়লেন ছবির দিকেই তাকিয়ে রইলেন ডক্টর বল, ফিরে গেলেন ছবি তোলার মুহূর্ত থেকে ছ মাস আগের সেই দিনটায়--আর ভাবনার খেই ধরে আরো আরো আগে--
ইন্টার্নশিপ শেষ করে পোস্টিংএর অপেক্ষায় বেশিদিন থাকতে হয় নি রাধামাধবকে। কারণ শহর গ্রামের মধ্যে বাছাবাছি তো ছিল না। এই নিয়ে ওঁর বন্ধুরা কতই না ক্ষেপিয়েছে। ‘তোর আর ভাবনা কি, দেশসেবাকে ব্রত করেছিস, গাড়ি-বাড়িতে কাম কী?’ রাধামাধব নাম নিয়েই যে কত সইতে হয়েছে! ‘তুই তো হলি এ যুগের কেষ্টা, তা বাবা তোর রাধাটির খোঁজ পেলি?’—এমন কত সব কথা! কিন্তু রাধামাধব বিকারহীন--ঠাম্মার দেওয়া নাম--ও বেশ আছে, তা ছাড়া নামে কী এসে যায়? অন্তত ওঁর তো যায় না।
যাইহোক পোস্টিং তো হল এই সদর হসপিটালে। অনেক কিছুই এখানে ছিল না। কিন্তু কপালক্রমে স্টাফেদের শেখার জানার ইচ্ছে ছিল। সেটা ভাঙিয়েই রাধামাধব গড়ে তুললেন যা, তাকে আদর্শ প্রতিষ্ঠান বললে খুব ভুল হবে না—আধুনিক সরঞ্জাম কিছু কম থাকলেও সেবা করার ইচ্ছেয় কমতি ছিল না সেখানে।
সেদিনও আটটার দিকে, বড় বড় পা ফেলে হসপিটালের দিকে এগোচ্ছিলেন রাধামাধব। সেই কোন ছোটবেলায় মা বলেছিল ‘ঘুম থেকে উঠেই ভাববি আজ কি কি সব ভালো ভালো কাজ আছে তোর, দেখবি বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠতে কষ্ট হবে না’—ঘুম কাতুরে ছিলেন তো--তাই মায়ের ওই কৌশল। এই প্রতিদিন সকালের মধ্যে নতুন আনন্দকে খোঁজার অভ্যাস এমনি ছাপ ফেলেছিল ওঁর স্বভাবে যে দেখলে মনে হত ওঁর চলায় যেন কেমন একটা স্প্রিং লাগানো আছে। সিঁড়ি দিয়ে একরকম তরতর করেই উঠতে উঠতে দেখলেন এলাকার চৌকিদার ভক্তরাম ছোট একটা পুঁটুলি কোলে ভারি বিমর্ষ মুখে বসে আছে। রাতের পাহারাটা ও-ই দেয়, হয়তো জ্বর-জ্বালা বাধিয়েছে; তাই বললেন ‘চলে আয়, আগে তোকেই দেখে দিই--সারা রাত তো ঘুমোস না’। ভক্ত শশব্যাস্ত হয়ে ‘না গো দাদাবাবু, আমি না, এই এইটা—’ বলে পুঁটুলিটা এগিয়ে দিল। এবার চোখে পড়ল ন্যাকড়ার ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে ক্ষুদে একটা লাল পা। জড়ানো কাপড়টা সরিয়ে স্টেথো দিয়ে শুনলেন ধুকপুক শব্দ। হই হই ফেলে দিলেন রাধামাধব। নার্স অন ডিউটি সুরবালা সঙ্গে সঙ্গে গরম জলে এন্টিসেপ্টিক দিয়ে বাচ্ছাকে স্নান করিয়ে স্টেরিলাইজড তোয়ালেতে মুড়ে রাখল। স্নানের আগে উলটো করে পিঠ চাপড়িয়ে কাঁদিয়ে দেখে নিল—নাহ! সব ঠিক আছে। খালি লাল পিঁপড়ের কামড়ে এক রত্তি গা-টা আমবাতের মত লাল দাগে ভরে গেছে, কুকুরের টানাটানিতে পায়ে আঁচড়ও ছিল, তাই টেটেনাসও দরকার ছিল তখনই। হসপিটালে আর সদ্যজাতের জামা কাপড় কই, প্রসূতিরা তো নিজেরাই সব আনেন। তাই বজরংগীকেই শত খানেক টাকা দিয়ে পাঠালেন রাধামাধব।
যে একদিনের শিশু ডাস্টবিনে পড়ে থাকে তাকে যে কেউ নিতে আসবে না তা রাধামাধব জানতেন। তা নিয়ে ওঁর মাথা ব্যাথাও ছিল না। নাম দিলেন হারানিধি। হসপিটাল স্টাফেরা সোৎসাহে মেনে নিলে। তারপর--কত রাত জেগে কাটিয়েছেন রাধামাধব। মাসখানেক ইনটেনসিভে রাখতে হয়েছিল। ব্যস! জংলি আগাছার তেজ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল হারান—নিজের মনে হাসা, কাঁদা (ঠাম্মা বলত মা ষষ্ঠীর সাথে খেলা করা), উপুড় দেওয়া, বুকে হাঁটা, জানলায় কাক দেখে ধরতে যাওয়া, সারারাত পেট ব্যথা নিয়ে চিল চিৎকার, গ্রাইপ খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে রাধামাধবের কাঁধে ঘুমিয়ে খাটে শোয়ালেই কান্না--সব মাইলস্টোন ঠিকঠাক মত পেরিয়ে আজকের পঁচিশ বছরের হারান--হারান আর মৌমিতা—ডক্টর বলের ভাগ্নে আর নতূন ভাগ্নে বৌ--উনি নিজেই যে অন্নপ্রাশনের দিন বড়মামা হয়ে পায়েস খাইয়েছিলেন। হারানের এই বড় হয়ে ওঠার ধারাবাহিক ছবি কোথাও ধরে রাখা ছিল না, কিন্তু তারা এত জ্বলজ্বলে যে ক্যামেরার শটকেও হার মানায়—মন ছবি বলেই বোধহয়।
ডঃ বল তৈরি হয়ে বিকেলের রাউন্ডে বেরোবার আগে করি কি করি নার দোটানায় শেষমেষ মোবাইলে ওদের খবর নিয়েই ফেললেন। ওদিক থেকে হারানের গলা ভেসে এল ‘মামু—কেমন আছো তুমি? সব ঠিক আছে তো? আমরা দুদিন আগেই ফিরছি, মৌমিতাও তাই চাইছে’। রাধামাধব আপত্তি করতে পারলেন না। চোখের সামনে ওদের দুটির ঘুরঘুর করাটা দেখতে ওঁর মনও যে চাইছিল।
আউটডোর পেশেন্ট দেখে আর একটা ইভনিং রাউন্ড সারতে বরাবরই ডকটর বলের রাত নটা বেজে যায়। সিরিয়স কেসগুলো নিয়ে চিন্তা করতে করতে বাড়ি ফেরাটা ওঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেদিন সদ্য ভর্তি হওয়া এক সন্তান পরিতক্তা বুড়িমার ফ্যালফ্যালে চোখ ওঁকে যেন আরও অন্যমনস্ক করে দিল। (যাঁর রোয়াকে শুয়েছিল বুড়ি তিনিই হাসপাতালে দিয়ে গ্যাছেন।) উনি বেশ বুঝতে পারছিলেন বৃদ্ধার যত না ওষুধের দরকার তত দরকার ভালবাসা ভরা এক ঘর যা পৃথিবী থেকে উধাও হতে চলেছে।
কোয়ার্টারের কাছাকাছি আসতে দেখলেন সব ঘরেই আলো জ্বলছে, ঠিক যেমন হারান থাকলে হয়--আলো জ্বললে মন ঝলমল করে একথা হারান কতবার যে বলেছে। তবে কি সেদিনই ওদের ফেরার ছিল? ঠিক তাই। বেল দিতেই দরজার ও পাশে দেখলেন হারানের হাসিমুখ। হাত থেকে স্টেথোটা চেয়ে নিতে ডাঃ বল নিজের ঘরে গেলেন পাজামা পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিতে। রিডিং টেবলে দেখলেন একটা ছবি--দীঘার সমুদ্রতটে হারান, মৌমিতা আর ডাঃ বল। সাদা ফেনার মুকুট পরা নীল ঢেউ ওদের হাঁটু ছুঁয়ে গ্যাছে। রাধামাধব বেশ একটু অবাকই হলেন। অবশ্য এই কাট-এন-পেস্টএর যুগে সবই সম্ভব, আর ওঁর ছবি তো হারানের কাছেই থাকে সর্বদা। কিন্তু যে ভালবাসা ভরা মনের এই কারচুপি তার কাছে স্বেচ্ছায় আবারও ধরা দিলেন ডাঃ বল। সেদিন রাত হলেও চা আর মাখা মুড়ির বড় জামবাটিটা হয়ে উঠল খুশির ঝর্ণা।
(পরবাস-৫৯, এপ্রিল ২০১৫)