স্মৃতি কণ্ডূয়ন---প্রণব বর্ধন। আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯, প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০১৩। ISBN 978-93-5040-312-9
কলেজ স্কোয়ারের উল্টোদিকে মধ্য-কলকাতার এক সংকীর্ণ গলি। এখানে নিম্নবিত্ত ঢাকাই বঙ্গাল এক স্কুলশিক্ষকের ঘরে জন্ম নেয় তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রসন্তান। ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ । এরপর যখন দেশবিভাগ হল, আট বছরের বালকটি দেখে ঘরে তার পূর্বদেশাগত আত্মীয়-পরিজনের ঢল। ছাপোষা বাপ শান্তিনিকেতনে মামার কাছে পাঠিয়ে দিতেন ছেলেকে, যাঁর অবস্থাও ছিলো তথৈবচ। কালে সেই বালক যখন এক বিশ্বখ্যাত অর্থবিজ্ঞানী হয়েছেন, তাঁর কলম বলছে, থামগুলো গড়া শুরু হয়েছিল সেই শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের গলি আর শান্তিনিকেতনের প্রান্তর থেকেই। তারপর আরও দূর, বহু দূরঃ প্রেসিডেন্সি কলেজ, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়! তারপর এম আই টি, বার্কলে থেকে প্রায় সারা বিশ্ব ঘুরলেও তাঁর মনের শেকড়টা এখানে রয়ে গেছে বলেই না এঁদো গলি ‘কণ্ডূয়িত’ করে, মানে চুলকায়। ভাগ্যিস চুলকানিটা বেঁচে ছিল, নৈলে এই ‘আনপুটডাউনেব্ল’-খানি পেতাম?
ভারতীয় অর্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে বাঙালিদের বড্ড রমরমা, অন্ততঃ এই সেদিন পর্যন্ত ছিল। কিন্তু তাঁরা যে চমৎকার গদ্য-লিখিয়েও হবেন, সে ধারাটা কে ঠিক করে দিল? ভবতোষ দত্ত (‘আট দশক’)-অশোক মিত্রের (‘আপিলা চাপিলা’) ধারায় প্রণব বর্ধনের ‘স্মৃতি কণ্ডূয়ন’ নবতম সংযোজন, ধারে-ভারে-সুখপাঠ্যতায় কম নয়, বরং বেশি। এনার আত্মজীবনীখানি পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে, হাতখানি কবিতার গো..., নিশ্চয়ই সেগুলো কোথাও লুকোনো আছে, উনি কুণ্ঠায় প্রকাশ করেননি। কারণ ওঁর মানের অর্থনীতিবিদের লেখায় জেমস মিড থেকে অমর্ত্য সেন, অশোক রুদ্র থেকে জাঁ দ্রেঁজ বারে বারে আসবেন সে তো স্বাভাবিক, কিন্তু লুই বুনুয়েলের ছবির গপ্পে উনি যখন নালেঝোলে হন, পাতার পর পাতা রবীন্দ্র-বিভূতি-মানিকের আলোচনা যখন অনায়াস আসে, বা বাল্যের কলকাতার বর্ণনায় যখন তাঁর কলম হয়ে ওঠে তুলি, মনে হয় প্রণব বর্ধন কি আসলে একজন কবি, আমরা চিনতে পারিনি?
অনুমানের প্রসঙ্গ থাক, ‘স্মৃতি-কণ্ডূয়ন’ প্রসঙ্গে আসি। ইকনোমিক্সের ‘ক’ জানি না, বর্ধনের আত্মজীবনী নিয়ে লেখার হিম্মত হয় কী করে? কেন, ভূমিকায় আস্কারা তো উনিই দিয়ে রেখেছেনঃ ‘এ বই পড়বেন কণ্ডূয়নের অলস চপলতার মেজাজে’! বস্তুতঃ, এ’কেতাবে অর্থনীতির কচকচি মোটেই নেই, বরং আমা-হেন আমজনতার মুখরোচক ছুট্-কাহানিতে (anecdote) ভরপুর তা---সে কিশোর বয়সে সাঁওতালনী ফুলমণিকে দিগম্বরী দেখা হোক্ বা নবকলেবরে ‘কামশাস্ত্র’ লেখার অপূর্ণ সাধই হোক্। বি টি রোডে আই এস আই স্টপ আসার আগে থেকে বাস-কন্ডাক্টর আজও ‘টেস্টিক্ল্’ ‘টেস্টিক্ল্’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে।
প্রণব বর্ধন আবাল্য অতীব মেধাবী ছাত্র ছিলেন, ১৯৫৪-র ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলেন হিন্দু স্কুল থেকে (এ’বইয়ে লেখেননি), টপার ছিলেন প্রেসিডেন্সিতেও---এ’সব তথ্য দিয়ে তাঁর মানের বিজ্ঞানীকে মাপা যায় না, কারণ এ’হেন সিভি নিয়ে বর্ধনের উচ্চতায় তাঁর পরে আর কোনো বাঙালি উঠতে পেরেছেন কিনা জানি না (আজকের অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৎছাত্র মৈত্রীশ ঘটকের মত দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া), তবু এ’গ্রন্থে সেসব প্রসঙ্গ সাবধানে এড়িয়ে গেছেন উনি। আমপাঠকের আকর্ষণ অবশ্য সেটা নয়, আকর্ষণ জীবনীটির সুখপাঠ্যতা। যেন এক উপন্যাস পড়ছি। যদিও তার ফাঁকে ফাঁকে দেয় তথ্যের ভাণ্ডারও কম নয়। যেমন, আমাদের ছাত্রকালে, সেই রমরমা বামপন্থার যুগে জোন রবিনসনের নামটিই মাত্র শুনেছিলাম, জানতাম কি যে মহিলা যে নোবেল প্রাইজ পাননি, তার অন্যতম কারণ, কমিটি ভেবেছিল পুরস্কার বিতরণের সভায় এই গোঁড়া বামপন্থী কোনো কাণ্ড বাধিয়ে বসবেন! শুধু অর্থনীতির জগতের মানুষজন কেন, ঐতিহাসিক কার্লো চিপোলা থেকে দার্শনিক বিমলকৃষ্ণ মতিলাল থেকে কিম্বদন্তী গণিতজ্ঞ স্টিভ স্মে-এর গল্প অনায়াসে করেন বর্ধন, হোঁচট কোথাও নেই। কোনো অর্থনীতিবিদের জীবনীতে পড়তে পাবো স্থপতি এন্টনিও গাউদির কথা—এ’ও তো ভাবিনি।
এ’হেন প্রণববাবু যে কেবল সারাজীবন অক্সফোর্ড-বার্কলেই করে বেড়িয়েছেন তা নয়, দিল্লিতে কলকাতায় নানা শিক্ষন ও গবেষণার মধ্যে ছড়িয়ে আছে তাঁর ছাত্রকুল (প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত যাঁদের অন্যতম)। ডি স্কুলে পড়ানো কালে একবার বাগানের মালির শ্যালক এসে এসির জলে স্নান করে ফেলায় কী ভাবে তাঁর গবেষণার কাজ বানচাল হয়ে গিয়েছিল--সুস্বাদু সেই গল্পখানি জানতে হলে বইটি পড়তে হবে যে, আমার ভাঙা কলমে কুলোবে না। এ’হেন মজার গল্প যে কত কত! কে বলবে প্রণব বর্ধন গুরুগম্ভীর ‘জার্নাল অব্ ডেভলেপমেন্টাল ইকনোমিক্স’-এর মত এক বিশ্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন প্রায় বিশ বছর? কৈশোরে শান্তিনিকেতনে এক চিকিৎসককে দেখেছিলেন, যিনি তাঁর বিদ্যের খামতি পুরিয়ে দিতেন রোগীর প্রতি তাঁর মমতায়, তার ক্লেশের সমব্যথী হয়ে। এতো বছর পরে বৃদ্ধ অর্থবিজ্ঞানী সেই চিকিৎসকের প্রশংসা করছেনঃ প্রফেসর বর্ধন কোন মানসিকতার মানুষ, এই একটি উদাহরণেই সেটি বোঝা যায়।
ফ্রাঙ্ক হান থেকে জিম মারলিস থেকে রবার্ট সোলো--নানান অর্থনীতিবিদের মাঝে বেলজিয়ান (অধুনা ভারতীয় নাগরিক) জঁ দ্রেঁজের প্রশংসায় প্রো. বর্ধন একটু বেশিই প্রগল্ভ হয়ে পড়েছেন, যীশুখৃষ্টের সঙ্গে তুলনা করেছেন তাঁর। সেটা কিছু অস্বাভাবিকও নয়, কারণ বিশ্বমানের এক অর্থনীতিবিদ ভারতের মত এক দরিদ্র দেশের গরমে সেকেন্ড ক্লাস ট্রেনে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বাস্তবে দরিদ্র অপনোদনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন কেবল কেতাবি তত্ত্ব না আউড়ে--এ’ এক উদাহরণ বটে । আজকের ‘নরেগা’ (NREGA) প্রকল্প তো এসেইছে দ্রেঁজের হাত ধরে। দ্রেঁজের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেও বর্ধন কিন্তু এইভাবে ‘প্র্যাকটিকাল ইকনোমিক্স’-এর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়াটাকে অবশ্য-কর্তব্য বলে মনে করেন না, বরং তাত্ত্বিক ভিত্তিটাকে ‘আরও’ মজবুত করে তবেই কাজে ঝাঁপানো উচিত বলে মত দিয়েছেন (পৃ ২২৯)। প্রশ্ন ওঠে, ‘আরও’ কত মজবুত, স্যর? ভারতের দারিদ্র্য মাটি ফুঁড়ে পাতাল স্পর্শ করলে তবে আর্থিক তত্ত্ব কাজে আসবে? ‘ডক্টর’ না বনে কেবল ‘ইন্টারপ্রিটার অব (ইকনোমিক) ম্যালাডিজ’-ই থেকে যাওয়াটাকে ‘এড়িয়ে যাওয়া’ মনে হতে পারে। এটার সবিশেষ উল্লেখ আরও থাকে এই জন্যে যে বিষয়টা অর্থনীতি, যার বাস্তব প্রয়োগের অনন্ত সম্ভাবনা রয়েছে এবং সেটা না হলেই এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে অর্থনীতি কি তবে আলোচনা করারই বিষয় মাত্র, বাস্তবায়িত করার নয়?
তবুও তো প্যাঁচা জাগে, থুড়ি আশা। বেঁচে থাকে। আর তাই তো ছয়টি মহাদেশ ঘুরে প্রশান্ত মহাসাগরের কূলের আবাসের আকাশে আজও টক টক গন্ধ পান অর্থনীতিবিদ ডক্টর প্রণব বর্ধন। ভাগ্যিস পান।
ঢাইশো পৃষ্ঠার এই চমৎকার গ্রন্থ পড়ে অবিশ্যি নিজের মনের আকাশ চেটে দেখি বৃষ্টি ধুয়ে দিয়েছে তা। নাঃ, সেখানে কোনো গন্ধ নেই...একেবারে মিষ্টি!
Mohammed Rafi My Abba - A Memoir--Yasmin Khalid Rafi; first published in India by Tranquebar Press, 2012; ISBN 978-93-81626-85-6
আজ যখন এই লেখা নিয়ে বসেছি, কী সমাপতন, ক্যালেন্ডারে তারিখ বলছে ৩১শে জুলাই! ১৯৮০ সালে এই দিনে দেহ রাখেন সন্ত্ গায়ক মহম্মদ রফিসাহেব। রমজান মাসের শেষ জুম্মাবার ছিল সেটি, অতীব পবিত্র তিথি। প্রবল বর্ষণ ছাপিয়ে দশহাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন জুহু সমাধিস্থলে, বহু ভক্ত নিয়ে গেছেন সেই সমাধিমৃত্তিকা, ঘরে রাখলে পুণ্য হবে বলে। বন্ধু-তথা-গুরু নৌশাদ সাহেব শের বেঁধেছিলেন দু’পঙ্ক্তিঃ
“গুঞ্জতে হেঁ তেরে নঘ্মোঁ সে আমীরোঁ কে মহল,[তোমার পদে ধনীর অট্টালিকা গুঞ্জরিত হয়, গরীবের ঝুপড়িতেও বাজে তোমার সুর! সঙ্গীতকে দরিদ্র করে দিয়ে চলে গেলে আজ তুমি বন্ধু মোর, সঙ্গীত গর্বিত রয়ে যাবে তোমারই জন্য!!]
ঝোপড়োঁ মেঁ ভী গরীবোঁকে তেরী আওয়াজ হ্যায়।
আপনী মৌজিকী পে সবকো ফকর হোতা হ্যায় মগর,
মেরে সাথী, আজ মৌজিকী কো তুঝ পার নাজ হ্যায়।।”
আর প্রতিযোগি-বন্ধু মান্না দে পরে বলেছিলেনঃ “... রফির সঙ্গে আমার তুলনা করা হয় ... ওর তুলনায় আমি কোনো গায়কই নই ... বম্বে ফিল্ম জগতে রফির মত ভার্সেটাইল গাইয়ে আর দ্বিতীয় জন আসেনি...ও’ই শ্রেষ্ঠ”... স্পষ্টভাষী মান্না দে বিনয়-টিনয়ের বড্ড ধার ধারতেন বলে শোনা যায় না। ‘গ্রেটেস্ট’ আখ্যা উনি ম. রফিকেই দিয়েছেন, আর কারোকে নয়।
পুত্র যদি পিতার জীবনেতিহাস লেখে, বা কন্যা, তা কি আর ইতিহাস থাকে, না কেবল ব্যক্তিস্তুতি হয়ে দাঁড়ায়? আর লেখক কন্যা না হয়ে বধূমাতা হলে? এবং ব্যক্তিটির নাম যদি হয় মহম্মদ রফি? এন্তেকালের আজ সাড়ে তিন দশক পরে এখনও এফএমে ‘তু গঙ্গা কি মউজ মেঁ যমুনা কা ধারা’ শুনলে দু’মিনিট সব কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় না?
চমৎকার প্রচ্ছদ ও শিরোনাম দেখে ফ্লিপকার্টে কিনি বইটা। না, কোনো গবেষণাধর্মী জীবনী পড়ার উচ্চাশা নিয়ে নয়, নিছক ব্যক্তি রফিসাহেবকে আরেকটু জানার জন্য। এবং ঘরে এ’হেন মানুষের জীবনী রাখলে পুণ্য হয় বলে। এবং বইটি সফল ক্রয়।
১৯২০-এর দশকের লাহৌর এক রাজনৈতিক ফুটন্ত শহর ছিল, মানে ক্যালকাটা-বম্বের পরেই। সেখানকার ভাটি গলিতে হাজি মহম্মদ আলির রোটি-কবাবের দোকানের সুনাম ছিল। তাঁর পঞ্চম পুত্র রফির জন্ম হয়েছিল ঈশাপ্রভুর জন্মদিনের আগের দিন, সালটা ১৯২৪। সেজোদাদা মহম্মদ দীনের ছিল একটি হেয়ার কাটিং সেলন, যেখানে বালক রফির সে-পেশায় হাতেখড়ি। ভাবুন তো, ভারতের কত্তবড় ক্ষতি হয়ে যেত ছেলেটি যদি ঐ পেশাতেই সফল হয়ে পড়তো? আল্লামিঞার ইচ্ছা তাই তো ছিল না, অতএব সায়গল সাহেবের গানের এক আসরে কিশোর রফির গাইবার সুযোগ ঘটে গেল ও তার ভাগ্যের চাকাটি ঘুরতে শুরু করল----লাহৌর থেকে বম্বে থেকে কোটী সঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়ে হৃদয়ে। ‘বড়ি দূঊঊর সে আয়ে হেঁ প্যার কা তোফা লায়ে হেঁ....’
আগেই বলেছি, কোনো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারে ম.রফি কত বড় গায়ক ছিলেন, বা কে বড় ছিলেন রফি না কিশোর না মুকেশ...এ’সবের চুলচেরা বিচার করার জন্য এ’বই নয়। লেখক এর নন রাজু ভরতন বা ইকবাল আহমেদ গনম । এ’বই ইয়াসমিন-দিদির বড় প্রাণের জীবনদেবতার প্রতি অর্ঘ্যঃ ইন্দৌরের কিশোরী মেয়েটি ছিল যাঁর ফ্যান আর যিনিই কিনা তার শ্বশুরমশায় হয়ে পড়লেন। আব্বু কী খেতে ভালোবাসতেন, কেমন ভাবে কাজ শেষ হলেই বাড়ি ফিরে আসতেন পরিবারের মাঝে নাতিদের সঙ্গে ক্যারাম খেলতে বা ছেলের বিয়ের পাত্রী দেখতে গিয়ে কী রকম নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন এ’সবের গল্প রয়েছে এতে। নির্ভেজাল ব্যক্তিগত। ধর্মভীরু প্রতিভাবান মানুষটিকে বড্ড কাছ থেকে চেনায়। সুরের জাদুতে ভারত মাতাচ্ছেন যিনি, দু’দশক ধরে যিনি ভারতসেরা পুংগায়ক, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দু’শ প্রতিশত সৎ, প্রযোজক কন্ট্র্যাক্টের বেশি টাকা দিতে এলে যেচে ফিরিয়ে দেন। লতার সঙ্গে তাঁর বিরোধের সূত্রপাতই তো রয়্যালটির টাকার ওপর সিঙ্গারের অনধিকারের রফি-তত্ত্ব নিয়েই। আজীবন মদ্য স্পর্শ করেননি,প্রিয় পানীয় কাঁচা দুগ্ধ । পাঁচ ওয়ক্তের নমাযি! ঘুড়ি ওড়াতে বড্ড ভালোবাসতেন। বন্ধুবর মান্নার সঙ্গে তাঁর ঘুড়ির লড়াই তো কিংবদন্তী। লেখিকা অতি নিকট থেকে দেখেছেন বলে অনেক বক্তিগত বিষয়ে দীর্ঘ গল্প এসে পড়েছে, যেমন পুত্রকন্যার মিউজিক কেরিয়ার গড়ার বিষয়ে সাহেবের অমত বা তাঁর প্রয়াণের দিনের বিস্তারিত গল্প। নিয়মানুবর্তিতার পরাকাষ্ঠা ছিলেন রফিসাহেব। রেকর্ডিং এ কখনও পাঁচ মিনিট দেরি করে এসেছেন উনি, এমন উদাহরণ নেই। আর শত প্রতিশত ফ্যামিলিম্যানঃ চল্লিশ বছরের কেরিয়রে কোনো গায়িকা-নায়িকা নিয়ে দুটি শব্দও খরচ করার স্কোপ পায়নি গসিপ লিখিয়েরা। রেকর্ডিং শেষে সোজা বাড়ি ফিরে আসতেন, ফিল্মি পার্টি-টার্টিতে বড় একটা যেতেন না। লেখিকা আবার অভিনেতা সলমান খানের পিসতুতো দিদিও বটেন, তাই সেলিম মামুর গল্পও উঠে এসেছে অনেক। এ’সবই চমৎকার সুখপাঠ্য।
রফিসাহেব যে দীর্ঘদিন কোনো গুরুর কাছে গান্ডা বেঁধে ধ্রুপদী সঙ্গীতের রেওয়াজ করেছিলেন, তা নয়। কিরানা ঘরের আব্দুল ওয়াহিদ খানসাহেব বা পাতিয়ালার বড়ে গোলাম আলির ভাই ছোটে গোলাম আলির কাছে তাঁর শিক্ষাপ্রাপ্তি নাতিদীর্ঘকাল , এবং বংশেও সঙ্গীতের ফোঁটামাত্র চর্চা ছিলনা কভু। তা সও্বেও ‘চৌধবি কা চাঁদ হো’(রাগ পাহাড়ি) বা ‘মধুবন মেঁ রাধিকা নাচে’(রাগ হামীর)-র মত খেয়ালাঙ্গ গানে তাঁর ঐ স্তরের পারঙ্গমতা, এবং ’৫০-’৬০ দুই দশক ধরে বলিউড-হেন কণ্ঠচ্ছেদন প্রতিযোগিতার স্থলে তাঁর স্লট-ওয়ান দখল করে থাকার পেছনের কারণটা কী? ঈশ্বরের প্রসাদ তো বটেই। তবে তাঁর দিক থেকে প্রয়াস প্রয়াস এবং প্রয়াস। রেওয়াজ রেওয়াজ এবং রেওয়াজ! বৌমা লিখছেন, ১ নং থাকা কালীনও আব্বার রেওয়াজের কোনো খামতি ছিল না—কত শ’ বার যে গাইতেন একই খানি গান! তাঁর প্রয়াণের দিনও সকালে শ্যামল মিত্র গেছেন ‘রফি ম্যানসনে’, তাঁর সুরে সাহেবকে একখানি বাঙলাগানের মহড়া করাতে। আর ‘আরাধনা’-র (১৯৬৯) পর কিশোর কুমার যখন ক্রমে এক নম্বর স্থানটিতে উঠে আসছেন, দুখী হয়েছিলেন বটে বিগত দুই দশকের ১ নং আসনটি খুইয়ে , তবে রেওয়াজটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নৈলে, যখন নাকি আর ১ নং নেই, তখনও কি “ইয়েহ দুনিয়া ইয়েহ মহফিল” , “শবাব পে মৈঁ জরা...” , বা “ক্যা হুয়া তেরা ওয়াদা” র মত গান বেরোয়? শেষেরটির জন্য যুগপৎ ফিল্মফেয়ার ও জাতীয় পুরষ্কার পান রফিসাহেব । ‘আরাধনা’ ছবিতেও তাঁর কণ্ঠে ‘গুণগুণা রহেঁ হেঁ ভওরে...’ কিশোরের ‘রূপ তেরা মস্তানা’-র চেয়ে কোনো অংশে পিছনে ছিল কি ? আর, অন্ততঃ দু’টি ছবির কথা মনে পড়ে , যেখানে ও পি নাইয়ার বা শঙ্কর-জয়কিষেণের মত সুরকার কিশোরকুমারের প্লেব্যাক গাইবার জন্য রফিসাহেবের শরণাপন্ন হনঃ ‘রাগিনী’ তে ‘মন মোরা বাঁওরা’ আর ‘শরারত’ ছবিতে ‘কভি হাসা দিয়া, রুলা দিয়া কভি’। আর দোস্ত কিশোর কুমারের ‘শবাস ড্যাডি’ ছবিতে প্লেব্যাক করতে মাত্তর একটি টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন রফি সাহেব। এ’সব গল্পকথা মনে হয় এখন।
মহম্মদ রফি সাহেবের সম্বন্ধে কত নতুন নতুন তথ্য জানতে পেলাম এই বই পড়েঃ
১. ১৯৪৭এর ১৫ অগাস্ট রেড ফোর্টে প্রথম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মাত্র তিন মিনিট গাইবার সুযোগ পান উনি। পণ্ডিত নেহরু এতোই আপ্লুত হন, যে পরে তিনমূর্তির আবাসে আমন্ত্রণ করে ঘণ্টাভর তাঁর গান শোনেন।২. রফিসাহেবের জন্মের সময় তাঁর পিতার বয়স ছিল আটষট্টি বৎসর । ১৯৬১তে উনি এন্তেকাল করেন ১০৪ বৎ বয়সে।
৩. মহম্মদ রফির মাতৃভাষা পঞ্জাবী হলেও, বিবাহে পর থেকে উনি ঘরে উর্দুতেই বাতচিত করতেন কারণ ওনার গৃহিণী বম্বের কন্যে, পঞ্জাবী বোঝেন না।
৪. স্কুলের মিউজিক কম্পিটিশনে গাইবে বলে পুত্র হামিদ বাপের কাছে এসে বায়না করলো ‘আ যা তুঝকো পুকারে মেরে গীত রে’ গানটি তুলিয়ে দেবার জন্যে। রফিসাহেব বড় একটা পাত্তা দিলেন না (‘ইয়ে তুমহারা বশ কা বাত নহি’)। ছেলে রাগ করে কিশোর কুমারের ‘মেরি ভিগি ভিগি সি’ গাইলো কম্পিটিশনে। সেকেন্ড হল। যে ফার্স্ট হয়েছিল, সে গেয়েছিল রফি সাহেবের ঐ গানটি।
জীবনীসাহিত্য হিসেবে অবশ্য বইটিকে বড় উঁচু স্থান দেওয়া যাবে না। মাঝে মাঝেই আলোচনা বড্ড একপেশে আর একঘেয়ে হয়ে উঠেছে ও লেখিকার ব্যক্তিগত জীবনের বহু কথা উঠে এসেছে, যেগুলো জানতে আমরা বড় একটা আগ্রহী নই। দুর্বল বাক্যগঠন ও বানান ভুল। পরিশিষ্টে দেওয়া ওনার গানের কালানুক্রমিক সূচিটি অবশ্য বেশ উপযোগী হয়েছে, যদিও পূর্ণাঙ্গ নয়। অনেকগুলো সাদাকালো ছবি রয়েছে—তার মধ্যে মহ. আলির সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধের ছবিটি উপভোগ্য, আর গৃহিণীর সঙ্গে (প্রায়) ডান্সেরটিও। সবচেয়ে উপভোগ্য সুফিসাধকের ভুবনভোলানো হাসিটি। অমলিন। চিরকাল।
গাজিনামা--কবিঃ সেখ মনুহর; সংকলন ও সম্পাদনাঃ ড. রমেন্দ্র বর্মণ; অক্ষর পাবলিকেশনস্, আগরতলা, ত্রিপুরা; ISBN: 81-86802-17-7
না, এ’বই আর আজকাল কেউ পড়ে না।
“সেখ মনুহরে কহে পঞ্চগলি সরস।
গাজির নামা পুস্তক হেন মধুরস।......
পলাশির যুদ্ধের প্রায় চল্লিশ বছর পূর্বে কুমিল্লা-রোশনাবাদ (ত্রিপুরা) অঞ্চলে এক শিশুর জন্ম হয় হতদরিদ্র কৃষকের ঘরে। পিতা তার ছিলেন এক পীর বা ফকির, ভাগ্যান্বেষণে যিনি জন্মভূমি কচুয়া গ্রাম ছেড়ে দক্ষিণ শিকায় গিয়ে ওঠেন। সেখানে সামান্য দুটি লাউ চুরির দায়ে রাজার কাছে নীত হন। দুই শিশুসন্তানের অনাহার ঘোচাতেই এই কাজ---এই স্বীকারোক্তি মেনে নিয়ে জমিদার নাসিরুদ্দিন নিজ রাজ্যে ঠাঁই দিলেন তাকে, বালক দুটির শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন। আশৈশব সমশের নিজের প্রতিভার পরিচয় দিয়ে এসেছে, সে মক্তবে পাঠ পড়ায় হোক্ বা ভরা নদীতে বাচ খেলায় হোক্ বা ধানুকিপনার মোকাবিলায়। স্বাভাবিক নেতা সে, যেন সিকি শতাব্দী কাটিয়ে মারাঠাদেশ থেকে এসে বাংলাদেশে শিবাজী পুনর্জন্ম নিয়েছেন! কৈশোরেই নিজ অনুগামীদের নিয়ে এক দল গঠন করে সমশের। স্থানীয় জমিদারের কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার পাণিপ্রার্থনা করলে ক্রোধান্বিত জমিদার তাকে গ্রেপ্তার করতে লস্কর পাঠালেন। উল্টে সামশেরের ভ্রাতা ছাদু ও বন্ধু ভৌমিক নূর মহম্মদের হাতে জমিদারেরই নিধন হল। সেই শুরু। এরপর সমশেরের জীবনে ঘটে গদা হুসেন খোন্দকার নামক এক পীরের আবির্ভাব, যিনি তাঁকে দিলেন এক মন্ত্রপূত তরবারি ও অশ্ব এবং ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে সে একদিন বাহুবলে চাকলা-রোশনাবাদ জয় করবে।
“পীরে বোলে মন দিআ সুন পীরসুত।
এথ ভর্গ ঘোড়ার জান কির্মতে বহুত।।
এই খভর্ণ অশ্ব তোমা দিলুম কারণ।
মুল্লুক বিজয়ে হৈব জানিয়া আপন।।”
হয়েও ছিল তাই। সমশের দ্বারা জমিদার নাসিরুদ্দিনের কোতলের পর তার পুত্রগণ ত্রিপুরারাজের কাছে গিয়ে নালিশ করল। ত্রিপুরারাজ পাঠালেন এক বাহিনী উজির জয়দেব ও সেনাপতি লুচিদর্পের অধীনে। ত্রিপুরারাজের বিপুল বাহিনীর বিরুদ্ধে এঁটে ওঠা অসম্ভব বুঝতে পেরে সমশের রাতের অন্ধকারে উজিরকে উঠিয়ে নিয়ে গেল! কী পাঠক, গেরিলা যুদ্ধের গল্প মনে হচ্ছে, কি বলেন? বস্তুতঃ, নামখানি আজকে হয়েছে বটে, কিন্তু নিম্নবর্গের প্রতিরোধের ইতিহাসে গেরিলা লড়াই সর্ব দেশে কালেই ছিল। আর ছিল প্রতিষ্ঠানী শক্তি দ্বারা এ’হেন লড়াকুকে 'ব্যান্ডিট' বলে দেগে দেবার পরম্পরা---সে কল্পনার রবিন হুড হোক্ বা স্লোভাকিয়ার জুরাজ জানোসিক। সমশের এবার আরও বল সংগ্রহ করে ত্রিপুরা রাজের বিরুদ্ধেই আঘাত হানে ও সিংহাসনচ্যুত করে তাঁকে। রোশনাবাদে গাজী যুগ শুরু হল—১৭৪৫-১৭৫৮। গোটা বাংলাদেশে তখন টালমাটাল অবস্থা। রাজধানী মুকসুদাবাদের (মুর্শিদাবাদ) ওপর তখন ফোঁসফোঁস ইংরেজি নিশ্বাস পড়ছে! সমশের কিন্তু নিজে ত্রিপুরার মসনদে বসলেন না, পরাজিত ত্রিপুরারাজ উদয়মাণিক্যের এক ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মণমাণিক্যকে দেখনদারির রাজা করে বসালেন উদয়পুরের রাজসিংহাসনে। ওদিকে, মুর্শিদাবাদে নবাব আলিবর্দিকে নজরানা পাঠাতে ভোলেনি কিন্তু সমশের, সেকালে চারিশত টংকা!
তাঁর মাত্র বারো বছরের রাজত্বকালে সুশাসনের বেমিসাল নজির রেখেছিলেন সমশের গাজি। বাজারের দ্রব্যে দর বেঁধে দিয়েছিলেনঃ চাউল এক সের এক পয়সা, মুশুরি ডাল এক সের দুই পয়সা, ঘৃত এক সের পাঁচ আনা....এমন। ৮২ সিক্কা ওজনে সের ধার্য করা হয়েছিল। এই সব খুঁটিয়ে লিখেছেন মনুহর তাঁর কাব্যে। কঠোর আইনের শাসন বলবত করেন সমশের---রাতবিরেতেও পথ চলতে ডাকাতের ভয় ছিল না। আর সর্বাপেক্ষা প্রশংসার্হ কাজ করেছিলেন শিক্ষা প্রসারেঃ সন্দ্বীপ থেকে এক অন্ধ হাফিজ আনিয়ে তাঁকে আবাসিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন যিনি কোরান পড়াতেন। তাঁর সহকারী ছিলেন ঢাকার এক মৌলভি, আরবিভাষার শিক্ষক। জুগড়িয়া থেকে আসা এক অধ্যাপকের ওপর ছিল বাঙলা পড়ানোর দায়িত্ব। সক্কলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন, বিদ্যালয়ের সময়ও বেঁধে দেন সকাল আটটা থেকে বারোটা ফের দুপুর দু’টো থেকে বিকেল চারটে। বস্তুতঃ , সর্বশিক্ষা-বিষয়ে এক দেশি ‘ডাকাত’-এর এ’হেন দূরদৃষ্টি অবাক করে বৈকি! তুলনীয়, দিল্লির মসনদে শের শাহ্ সুরির পাঁচ বৎসরের রাজত্বকাল (১৫৪০-৪৫ খৃ.)। মুর্শিদাবাদ অবশ্য সমশেরের এ’হেন বাড়বাড়ন্ত ভালো চোখে দেখেনি। ভুলিয়ে ভালিয়ে রাজধানীতে ডেকে পাঠান নবাব। তারপর? মন্ত্রীদের প্ররোচনায় তোপের মুখে উড়িয়ে দেওয়া হল সমশের গাজীকে। ত্রিপুরায় আবার প্রাচীন রাজবংশের শাসন ফিরে এলো। কিন্তু এর অর্ধশতাব্দী পরে পর্যন্তও ত্রিপুরা অঞ্চলের লোকমুখে ‘সমশের গাজীর গান’ গীত হত, ১৮০৫-১০ নাগাদ সেখ মনুহর কর্তৃক যা সংগৃহীত ও লিখিত হয়, এবং ১৮১৩-এ নোয়াখালির সেরেস্তাদার মৌলবি লুৎফুল খবির দ্বারা যা প্রথম মুদ্রিত হয়। এই বইটিও লুপ্তপ্রায়। বর্তমান লেখক/সংকলক বহুক্লেশে তা উদ্ধার করে তার মুদ্রণ করেছেন। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎবঙ্গ’ গ্রন্থে উল্লেখ করলে ‘গাজিনামা’ বৃহত্তর পাঠককুলের গোচরে আসে।
সমশের গাজির নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, সেটা আসলে ছিল এক কৃষক অভ্যুত্থান। বছরের পর বছর ধরে নবাব-জমিদার-মহাজনের হুজ্জুতে জর্জরিত গ্রামীণ কৃষকের অস্ত্রধারণ করা ছাড়া আর গত্যন্তরও ছিল না, সমশের গাজি তাদেরই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কৈলাসচন্দ্র সিংহ লিখিত বা সংকলিত প্রামাণ্য ত্রিপুরার ইতিহাস ‘রাজমালা’-তেও সমশেরের কথা আছে (আমি পড়িনি, পড়ার ইচ্ছে আছে)। বস্তুতঃ, ‘গাজী’ উপাধির মধ্যেই সমশেরের মহত্ত্ব লুকিয়ে আছে। ‘গাজী’ মানে ধর্মযুদ্ধে জয়ী বীর, কোনো ডাকাতকে এ’উপাধি দেওয়া যায় না। বর্তমান কাব্যটিও গ্রন্থিত হয়েছিল সমশেরের প্রয়াণের প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পরে। কবি শেখ মনুহর তাঁর পিতামহের মুখে সমশের গাজীর কাহিনী শুনে অনুপ্রাণিত হন ‘গাজিনামা’ কাব্য লিখতে। পয়ারের ছন্দে চারিহাজার শ্লোকে (মানে, আট হাজার লাইন) গ্রথিত কাব্যখানি। সমশেরের বেবাক স্তুতিগাথা মাত্র নয়, অনেকানেক ঐতিহাসিক তথ্যাদি বহু যত্নে আহরণ করেছিলেন এই স্বল্পশিক্ষিত গ্রাম্য কবি, যার অনন্য ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। এবং এখানেই কাব্যখানির গুরুত্ব, কারণ কেবল কাব্যবিচারে এর মান অতি উচ্চ বলা যাবে না।
মধ্য ও প্রাক্-আধুনিক যুগে বাঙলায় কাহিনী-কাব্যের এক পরম্পরা ছিলঃ ইয়ুসুফ-জোলেখা, লয়লা-মজনু ইত্যাদি। তবে সে-সবই প্রেমকথা নিয়ে এবং তাদের পটভূমিকাও স্থানীয় ছিল না। ‘গাজিনামা’ কাব্যের জন্ম সেইদিক থেকে সম্পূর্ণ স্থানীয় এবং এটি একটি মৌলিক কাব্য । প্রাক্-আধুনিককালে প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রতিরোধী আন্দোলন বাঙলাদেশে কম হয়নি। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় বঙ্কিম উপন্যাস লেখেন তার প্রায় পৌনে-শতাব্দী পরে। চোয়াড় বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে সাহিত্যের কোনো শাখায় কিছু হয়নি, এমনকি তিতুমিরকে নিয়েও প্রায় নয়। সেই দিক থেকে সমশের গাজির বিদ্রোহ ও তার ওপর লেখা সেখ মনুহরের এই কাহিনী-কাব্যের এক অনন্য গুরুত্ব রয়েছে। বাঙলাসাহিত্যে খাঁটি বীরগাথা আর দ্বিতীয়টি আছে বলে জানি না।
‘শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়’ দিয়ে নান্দীমুখ করছেন কবি সেখ মনুহর। মনুহর কেমন নাম? হয়ত মনোহর ছিল। অধ্যায় ভাগ করা আছে। ‘দির্গবন্দ’ ‘খর্ব চন্দ রাগ মর্লারে’ ‘পয়ার ছন্দঃ রাগ বেলাবেলি’ ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, ত্রিপুরা অঞ্চলে ইহা ‘সমশের গাজীর গান’ হিসেবেই গীত হয়, কেবল পাঠ করার কাব্য হিসেবে নয়। গ্রাম্য কবি মনুহরের তাই কাব্য-ছন্দ-ইতিহাসই কেবল নয়, সুরেও মুন্সিয়ানা ছিল বলে অনুমান! বর্তমান কাব্যখানি যে রূপে আজ ‘অক্ষর পাবলিকেশনস্’ বের করেছেন, সেটিও পূর্ণাঙ্গ নয়। তবুও, পূর্ণাঙ্গখানি এখনও পাওয়া যায়নি বলে এ’খানিও এখন প্রকাশ করা যাবেনা--এ’হেন সিদ্ধান্ত নেন নি বলে প্রকাশক শুভব্রতবাবুকে ধন্যবাদ দিই দিল্লি বইমেলায় তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপে। সংকলক ও সম্পাদক ড. রমেন্দ্র বর্মণ-লিখিত উৎসর্গ-পত্রটি পড়ে মুগ্ধ হলামঃ “এই তো আমার জন্মভূমির আলোর কথা....”। তন্বী কেতাব, বারো আনা জুড়ে কাব্যখানিই। আটটি পরিশিষ্টে দীনেশ সেন-ব্রজেন দত্তের মত পণ্ডিতজনের লেখা থেকে উদ্ধৃত গ্রন্থটিকে ভারাক্রান্ত করেনি বরং না থাকলেই আমা-হেন গোলা লোক দিগভ্রান্ত হইত। এই প্রখর বাণিজ্যায়নের যুগে, প্রাইম টাইমের দেড় মিনিট নিয়ে যখন চুলোচুলি চলে, ভারতের এক কোণে বসে এক বাঙালি এ’হেন বই ছাপিয়ে চলেছেন, তার জন্যেও তো এ’বই কিনে ঘরে রাখতে হবে। নৈলে এ’ হারিয়ে যেতো যে! প্রকাশককে অনেক অনেক ধন্যবাদ তাই।
অসীম মানসলোকে একাকী এক কবি---ড. হিরণ্ময় সাহা; শ্রীভারতী প্রেস, কলকাতা-৪৭; প্রথম প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ২০১৪, দ্বিতীয় প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০১৪; ISBN: 978-81-928276-7-4
হ্যাঁ, সেই তো তোমার প্রাণ!
যদিও, না, না, এই কবিকে তো আমরা চিনতাম না?
এই কি সেই কবি, জগতের আনন্দযজ্ঞে যাঁর সতত নিমন্ত্রণ? এই কি তিনি, যিনি বন্ধ তালা ভেঙে আপন মাঝে দেখতে পান গোপন রতনহার? না তিনি, মরণ যাঁর কাছে শ্যামসমান?
আশৈশব হেলাফেলায় চাকরবাকরদের হেফাজতে মানুষ। মায়ের কোলের ‘কালো’ ছেলেটি, মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত, বঞ্চিত মাতৃস্নেহ থেকেও। চোদ্দ বছর বয়সে মা-কে হারানোর পর এক আশ্রয় খুঁজে পান রবি নতুন-বৌঠানের মধ্যে। তাঁরও আচম্বিত প্রস্থান কাঁচা বয়স পঁচিশে, কবির তখন মাত্র তেইশ। বছরের হিসেবে দীর্ঘকাল কাছে পাননি সখী-বৌঠানকে, আর অশীতিপর বয়স পর্যন্ত বয়ে বেড়িয়েছেন সেই শ্যামলা-সুন্দরীর স্মৃতি কত ভারাক্রান্ত মনে আমরা আমজনতা তার কী বুঝি? বস্তুতঃ, সারাজীবন ধরে প্রিয়জনের মৃত্যুমিছিলের সাক্ষী হতে হয়েছে সেই ঋষিকে---নতুনবৌঠান...মৃণালিনী...রানি...শমী....দৌহিত্র নীতিন্দ্রনাথ... আরও আরও অনেকে......যেন মৃত্যুমিছিল! জিজ্ঞাসা, কেন তাঁরই উপর মহামহিমের এমনধারা বিচার? তবু গেয়ে উঠেছেন, “আঘাত করে নিলে জিনে/কাড়িলে মন দিনে দিনে।। সুখের বাধা ভেঙে ফেলে তবে আমার প্রাণে এলে/বারে বারে মরার মুখে, অনেক দুখে নিলেম চিনে।।” দেহেমনে সমর্থ স্ত্রীহারা যুবক, বয়স তখন তাঁর একচল্লিশ মাত্র ... অতঃপর তাঁর কি মনে স্ত্রীসঙ্গলাভের ইচ্ছা জাগত না? কে জানে? কেমন ছিলো তাঁর মনের মধ্যের আলোড়ন অকালে (বা, ভুল কালে) যখন ওকাম্পো আসেন তাঁর জীবনে, বা জাপানী অনুরাগিনী টোমি ওয়াডা? পৌত্রীবয়সিনী রাণুর সঙ্গে ‘প্রেম’-সম্পর্কেও ভুল বোঝাবুঝি। আর এই ঋষিকেও বারংবার অহেতুক সমালোচনায়, কুৎসায় বিঁধতে বাধেনি সেকালের বাঙালি বিদ্দ্বজ্জনের, ‘সুহৃদ’ ডি এল রায় তার মধ্যে প্রধান। পৌত্র সুভো ঠাকুর তো তাঁকে তস্করও বলেছিলেন!! কবির অসহ্য মনোবেদনাই প্রকাশ হয়ে পড়েছিল নোবেলপ্রাপ্তির সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে (‘... আপনাদের সম্মানের এই মদিরা ওষ্ঠে স্পর্শ করলুম, অন্তরে গ্রহণ করতে পারলুম না!’)। বৃদ্ধবয়সেও শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের জন্য ভিক্ষার ঝুলি হস্তে নৃত্যগীতের ডালি সাজিয়ে বেরিয়েছেন ভারতভ্রমণে! সামান্য অর্থ সময়মত দিতে পারেননি বলে জামাতা পর্যন্ত অপমান করেছে। আর সেই ঋষি সারারাত জেগে বেঁধেছেন গান। ...যদি হায় জীবনপূরণ নাই হল মম...
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, কবিগুরু, গুরুদেব। তাঁর সূর্যসম জীবন কত মানুষকে আলো দেখিয়েছে। কিন্তু তাঁরই জীবনে এতো অন্ধকার? এত হাহাকার? হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলেন কবি? পড়ে শিউরে উঠতে হয়। আবার এই কবিই লেখেন, এই অন্ধকারকে আমি জয় করবই। করেওছিলেন। তাই না তিনি গুরু, তিনি ঋষি--তাঁরই হাতে আলোকবর্তিকা। এ’বই সেই অন্ধকার থেকে আলোকে উত্তরণেরই আলেখ্য।
লেখক হিরন্ময় সাহা প্রখ্যাত মনোচিকিৎসক। এক বিশেষজ্ঞের চোখে গুরুদেবকে দেখেছেন তিনি, তন্ন তন্ন করে পড়েছেন তাঁর চিঠিপত্র, খুঁজেছেন ‘মানুষ’ রবীন্দ্রনাথকে, খুঁজেছেন পেছনের অন্ধকারকে এবং লিখেছেন তা থেকে উত্তরণের ইতিহাস। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো সেই তো তোমার আলো ...। এই আলোর সন্ধানেই একের পর এক অধ্যায়ের অবতারণা ... ‘প্রেমের বেদনা থাকে সমস্ত জীবন’, ‘আঁধার পেরিয়ে আলোয় ফেরা’, ‘যাবার সময় হল বিহঙ্গের’--এমন কয়েকটি অধ্যায়ের নাম। অতি সুপ্রযোজ্য যৌক্তিক আলোচনা। পুত্র রথীন্দ্রনাথের পিতৃস্মৃতি বারেবারে এসেছে আলোচনায়, কন্যা মীরাদেবীর স্মৃতিকথাও। তাঁর পুত্র, কবির দৌহিত্র নীতিন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াণে শান্তিনিকেতন বাৎসরিক বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠান বাতিলের প্রস্তাব উঠলে কবি বলেছিলেন, “... সে হতে পারে না। আমার শোকের দায়িত্ব আমিই নেব। ... বাইরে থেকে কোনো রকম সান্ত্বনার চিহ্ন, কোনোরকম আনুষ্ঠানিক শোক একটুও দরকার নেই, তাতে আমার অমর্যাদা হয় ...” কী, পড়লে চোখে জল ভরে আসে না, সুধী পাঠক? উপর্যুপরি অবসাদ থেকে কবির মুক্তির পথ ছিল নিঃসঙ্গ নির্জন বাস। এবং এই এই পর্যায়েই কবির শ্রেষ্ঠ কাব্য-সঙ্গীতকীর্তি বেরিয়ে এসেছে। এবং এখানেই ড. সাহার লেখনীর কাছে আমাদের একটু প্রাপ্তির আশা বাকি রয়ে গেল। লেখক বারংবার ঘটনাবলীর উল্লেখ করে করে কবিজীবনের অবসাদ-পর্যায়ের কথা শুনিয়েছেন কিন্তু তা থেকে উত্তরণের গল্পে কবির অসাধারণ শিল্পকীর্তির নমুনা কোথাও দেননি। কিছু উদাহরণ দিইঃ “ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে...” (রচনাঃ ২৫ নভেম্বর ১৯২৬) গানখানি গুরুদেব গ্রীসদেশে বসে লিখেছিলেন তাঁর এক অবসাদের কালেঃ সাম্প্রতিক ইতালিভ্রমণের পর তিনি নাকি ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির সমর্থক বলে সমালোচিত হবার পর। বা, “কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়? জয় অজানার জয়” গানটি। জ্যেষ্ঠাকন্যা মাধুরীলতা (মৃ. ১৬ মে ১৯১৮) তখন মৃত্যুশয্যায়। সুহৃদ পিয়ার্সনকে জীবনমৃত্যুর অমোঘ-সংশয়িত প্রহেলিকার উল্লেখ করে লিখেছিলেন, ‘death is the obverse side of life, it is one with it, and I do not look upon it with any particular fear.’ ড. সাহা যদি কবির অবসাদের সময়কালের উল্লেখের সাথে সাথে এ’হেন কীর্তিরও নমুনা দিতেন সেটি পাঠকের কাছে এক বিশেষ প্রাপ্তি হয়ে উঠত। ‘যদি হায় জীবন পূরণ নাই হল মম’ (রচনাকালঃ ৩০-০৯-১৯৩৯) বা, ‘এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার’ (১৫-০৩-১৯২৩)--এমন দু’টি অবসাদের গান যাদের রচনার পশ্চাদপট জানবার আগ্রহ ছিল, রয়ে গেল।
প্রকাশনালয় শ্রীভারতী প্রেসের নাম আগে শুনিনি, এই কাজটি চমৎকার করেছেন এঁরা। প্রশংসার্হ ছাপাই-বাঁধাই-মুদ্রণ। দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় কৃত প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা, রঙ ও কবির প্রতিকৃতিটির নির্বাচন অতি সুপ্রযুক্ত হয়েছে।
ধর্মগ্রন্থের উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষকে প্রেরণা যোগানোর, অন্ধকার থেকে আলোকে উত্তরণের পথ দেখানো, তবে এই গ্রন্থকে এক ধর্মগ্রন্থের দর্জা দিই। আমরা নিশ্চিত, এ’বই অনেক মানুষকে আলো দেখাবে।
এ’ বইয়ের কালো মলাট সাদা হয়ে দেখা দেবে তখন।
(পরবাস-৬০, অগস্ট ২০১৫)