ঋত্বিকতন্ত্র; সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়; প্রথম প্রকাশ: ২০১৪, সপ্তর্ষি - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ১৫০; ISBN: নেই
গোষ্ঠী সমাজে জ্যেষ্ঠ পুত্রের সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত হত। তবে সাংস্কৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রে আপামর জনসাধারণকেই উত্তরাধিকারী মেনে নেওয়াই রীতি। বস্তুত যত বেশী দিন ধরে – প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে – একজন শিল্পী চর্চিত হন তাঁর উত্তরাধিকার তত সমৃদ্ধ। কিন্তু তাও কারও কারও গায়ে আঁকা থাকে তাঁর সময়ের উল্কি। সেই সময়কে বাদ দিলে যেমন তাঁরা খণ্ডিত হন তেমনি তাঁদের বাদ দিলে তাঁদের সময়ের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যেমন বীটলসদের বাদ দিয়ে ষাটের দশক বা চে-কে বাদ দিয়ে কুবার বিপ্লব।
এই সব শিল্পীরা সাধারণত তীক্ষ্ণবাক্, রোখালো, যুযুধান, বিতর্কিত। নিজের সময়ে সব শ্রেণীর ভোক্তার আনুগত্য জোটা এঁদের কপালে থাকে না। যদিও ভবিষ্যৎ কখনও কখনও তাঁদের মহত্ত্বের মুকুট দান করে থাকে। কারও কারও জন্যে রচিত হয় পক্ষাবলম্বনের ইস্তাহার যা ১৮৪৮-এ প্রকাশিত ইস্তাহারটির মতই উপেক্ষা করা অসম্ভব। ঋত্বিকের মৃত্যুর অল্প কদিন বাদেই যখন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের 'ঋত্বিকতন্ত্র' প্রকাশিত হয় শত্রু মিত্র সকলেই নাড়া খেয়েছিলেন। আলোচিত বইটির কেন্দ্রে রয়েছে সেই প্রবন্ধটি। আর তাকে ঘিরে রয়েছে ঋত্বিকের অষ্টম গর্ভের আটটি ছবি নিয়ে আটটি সন্দর্ভ এবং কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ঋত্বিককে নিয়ে করা ছবি 'মেঘে ঢাকা তারা' নিয়ে একটি আলোচনা। রচনাগুলির কাল ১৯৭৬ থেকে শুরু করে ২০১৩ পর্যন্ত।
দেখা যাবে বাকি লেখাগুলি ঐ ১৯৭৬-এর বীজসন্দর্ভটির থেকেই উৎসারিত। তার মানে এই নয় যে চল্লিশ বছর ধরে সঞ্জয়ের ভাবনা একইরকম থেকে গেছে। 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' ছবি সম্পর্কে যেমন তিনি পুনর্বিবেচনা করেছেন। কিন্তু যে অগ্নিপথ পাড়ি দেওয়ার কালে ঋত্বিক তাঁর (এবং আমাদের) আত্মায় চিরস্পর্শ রেখে গেছেন সেই বন্ধনের কোনও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। যে যে কারণে তরুণ সঞ্জয় ঋত্বিকগ্রস্ততায় আক্রান্ত হয়েছিলেন সেগুলি এখনও সমান সক্রিয়। সেই জরুরী অবস্থার অবসানে এসেছে বামফ্রন্টের ৩৪ বছর, আন্তর্জাতিক মানচিত্র বদলে গেছে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর, শিল্পকে মূলত সমাজ বদলাবার হাতিয়ার ভাবার বদলে ঝোঁক এসেছে তাকে একটি চিহ্ন হিশেবে পড়বার। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে মহাকালের সামনে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন সঞ্জয় তিনি শত চাপ সত্ত্বেও তার বয়ান বদল করেননি।
ঋত্বিককে নিয়ে তাঁর প্রথম লেখায় সঞ্জয় ফুঁসে উঠছিলেন দুই শত্রুর বিরুদ্ধে। একদিকে যে বাজার ঋত্বিককে বাণিজ্যসফল করেনি, ঠেলে দিয়েছে নানা আত্মপীড়নের দিকে, যে বাজারি সমালোচনা তাঁকে একটু অগোছালো একটু সীমিত দেশবিভাগের কাহিনিকার করে রেখে দিতে চায় তাঁকে বিদ্রূপের আগুনে দগ্ধ করছেন সঞ্জয়। অন্যদিকে ঋত্বিককে সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছে যারা সেই টিকিধারি বামপন্থীদের বিদ্ধ করছেন, প্রশ্ন করছেন, মিনতি করছেন চক্ষুষ্মান হওয়ার জন্যে। সেই সংক্ষুব্ধ সময়ের রাজনৈতিক কর্মী সঞ্জয় সেই সময়েই যান্ত্রিকতার উপরে উঠতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর দর্শনের অগ্নিপরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন।
কেন ঋত্বিক ঘটক তাঁকে আচ্ছন্ন করেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একাধিকবার সঞ্জয় বলবেন মহৎ শিল্পীদের কাছ থেকে তাঁর প্রত্যাশা কী। নিপুণতা নয়, তিনি চান প্রাবল্য। হোক তা অগোছালো। শিল্পীর থাকবে অবাধ্যতা, অবশ্যতা, অস্বীকারের দুঃসাহস, অসফলতার স্পর্ধা, আর মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান। আর জীবনে আর শিল্পকর্মে ঋত্বিক ভিন্ন কে সম্পূর্ণ করেছে এই প্রমত্ততার পাঠক্রম? আর কোন অমিতাচারী দাবি করতে পারেন এই মুকুট? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর জীবনানন্দ দাশ ছাড়া?
তাঁর উপাস্য দেবতাদের মতই সঞ্জয় অলঙ্কারশাস্ত্রের বেড়া টপকাতে ভালবাসেন। তাঁর প্রবন্ধ তাই কখনও শুধুমাত্র প্রবন্ধ নয়, কবিতাও। এলিয়ে পড়া কবিতা নয়, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ঋজু, মনীষাদীপ্ত কবিতা। এই মেধা আর আবেগের অঞ্জলি অর্পণ করার জন্যে ঋত্বিক ভিন্ন আর কোন্ নাশকতার দেবদূতকেই বাছা যেত?
(পরবাস-৬০, অগস্ট ২০১৫)