Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines








পরবাসে মুরাদুল ইসলামের লেখা



ISSN 1563-8685




বিস্মরণ

সেসেদিন সকালে ঝকঝকে রোদ উঠেছিল এবং রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন শফিক সাহেব। তাঁর মুখে চিন্তার ছাপ। এক পর্যায়ে সুলেমান মির্জাকে আসতে দেখা গেল। তিনি গলির রাস্তা ধরে হেটে মূল রাস্তায় উঠে আসছেন।

শফিক সাহেব তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার মির্জা সাহেব? কেমন আছেন?”

সুলেমান মির্জা উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শফিক সাহেবের দিকে। তারপর দ্বিধান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি শফিক সাহেব না?”

শফিক সাহেব কিছুটা অবাক হলেন। তিনি বললেন, “আপনি কী আমাকে চিনতে পারছেন না? আশ্চর্য ব্যাপার!”

সুলেমান মির্জা অপরাধীর মত মুখ করে বললেন, “স্যরি ভাই। চিনতে পারছিলাম আসলে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। আজকাল যে আমার কী হয়েছে। কিছুই মনে রাখতে পারি না।”

এই কথায় আরো অবাক হলেন শফিক সাহেব। তিনি বললেন, “আমারো তো ভাই একই অবস্থা। কিছুই মনে থাকে না। তাই এখন যাচ্ছিলাম ওই ডাক্তারের চেম্বারে। তাঁর নামটা যেন কী?”

সুলেমান মির্জা বললেন, “আমিও তো বের হলাম ডাক্তারের কাছে যাবো বলে। কিন্তু ডাক্তারের নাম আপনি ভুলে গেলেন কী করে? আপনারা না বন্ধু, একসাথে স্কুলে পড়েছিলেন?”

শফিক সাহেব মাথা চুলকে বললেন, “ভাই, সমস্যাটার কথা তো আপনাকে বলেছি। কারো নাম ধাম মুখ ইত্যাদি হুট করে ভুলে যাই। আবার কারো কারোটা মনে থাকে। এই যেমন আপনাকে দেখেই মোটামুটি চিনতে পারলাম। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে বাসার লোকদের কাউকেই চিনতে পারলাম না। তারাও তেমন আগ্রহ দেখাল না আমার প্রতি। আমি চিনি বা না চিনি বুঝা গেল তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আমার তো খটকা লেগেই রইল, আমার ঘরে এরা কারা? ফলে ঘুম থেকে উঠেই ভাবলাম ডাক্তারের কাছে যাই। মাথায় কিছু একটা হয়েছে নিশ্চিত। আচ্ছা, আমি কি বিবাহিত? বাচ্চা কাচ্চা আছে?”

সুলেমান মির্জা বললেন, “ভাই, ইয়ার্কি করবেন না। আপনি বিবাহিত কি না তা আমি কি করে মনে করব যেখানে আমি নিজেই বুঝতে পারছি না আমার পুরো নামটা কি?”

শফিক সাহেব চিন্তিত মুখে বললেন, “এ তো মহাসমস্যায় পড়া গেল। ডাক্তারের কাছে গেলে কি এর কোন সমাধান পাওয়া যাবে?”

সুলেমান মির্জা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “অবশ্যই পাওয়া যাবে। ডাক্তার হাসানের তুলনা হয় না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি আগেও একবার তাঁর কাছে এই সমস্যা নিয়ে গিয়েছিলাম।”

শফিক সাহেব বললেন, “আমারো এরকম কিছু মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এরকম কনভার্সেশন আরো কার সাথে যেন করেছি। তবে সেটা আপনি হবেন না। ওই লোকটার দাড়ি ছিল।”

সুলেমান মির্জা চোখ বড় বড় করে বললেন, “ওটা আমিই। দাড়িতো আজ ফেলে দিলাম। এই সকালে ঘর থেকে বেরোবার সময় মনে পড়ল কাকে যেন কথা দিয়েছিলাম দাড়ি কেটে ফেলব। তাই আর দেরি করিনি। কথা দিয়ে কথা না রাখা ভালো কথা নয়।”

শফিক সাহেব বললেন, “তা ঠিকই বলেছেন। তবে দাড়িওয়ালা আপনার সাথে কথা বললাম কিন্তু আপনার মুখ মনে করতে পারছি না। কী আশ্চর্য! আচ্ছা, ঐ যে ফেক দাড়ি লাগিয়ে অভিনয় করে লোকে ওইসব দাড়ি লাগিয়ে একটু দাঁড়াতে পারবেন আমার সামনে? তাহলে দেখব মনে পড়ে কি না।”

সুলেমান মির্জা বললেন, “ভাই, এসব বাদ দেন। আগে চলেন আমরা ডাক্তারের কাছে যাই। তাঁর চেম্বারে যাবার রাস্তাটা কী আপনার মনে আছে? ডাক্তারের নামটা যেন কী বলেছিলাম?”

শফিক সাহেব বললেন, “রাস্তা মনে আছে। এ পথেই তো রোজ অফিসে যাওয়া আসা করতে হয় আমার। আর এই অল্পক্ষণের মধ্যে ডাক্তারের নাম ভুলে গেলেন! আপনার অবস্থা তো আমার থেকেও খারাপ। চলুন চলুন, আর দেরি করা যাবে না। পরে রাস্তাটাও ভুলে যাবো।”


রাস্তায় পাশাপাশি শফিক সাহেব ও সুলেমান মির্জা হেঁটে যেতে লাগলেন। রাস্তা সচরাচর শহুরে রাস্তার মত ব্যস্ত না হলেও অনেক মানুষজন ও যানবাহন ছিল। মানুষেরা চিন্তিত মুখে হাটছে।

শফিক সাহেব ও সুলেমান মির্জা হাসান ডাক্তারের চেম্বারের সামনে এলেন। কিন্তু তা বন্ধ। দুজনই হতাশ হয়ে একে অন্যের দিকে তাকালেন। এখন উপায় কী?

ডাক্তারের উপরে বাসা আর নিচে তিনি রোগী দেখেন। শফিক সাহেবের ব্যাপারটা মনে পড়ল। তিনি বললেন, “চিন্তা নেই। হাসান ডাক্তারের বাসা তো উপরে। তাকে ডেকে আনলেই হবে। হয়ত রোগী নেই দেখে ব্যাটা উপরে গিয়ে ঘুমোচ্ছে।”

সুলেমান মির্জা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “দেশে কারো রেসপনসিবিলিটি বলতে কিছু নেই।”

তারপর তাঁরা দুজন হাসান ডাক্তারের বাসার সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজালেন দু বার।

এক ভদ্রলোক বের হয়ে আসলেন।

শফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি হাসান ডাক্তার?”

লোকটা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “জি, আমি ইমরুল হাসান। তবে আমি ডাক্তার নই। আমি ক্রিকেটার।”

সুলেমান মির্জা এগিয়ে এসে বললেন, “কী বলছেন এসব! আপনি ডাক্তার। আমার চিকিৎসা করলেন না কয়দিন আগে? ভুলে গেছেন?”

হাসান ডাক্তার মাথা চুলকে বললেন, “দেখুন ভাই আমার কী হয়েছে আমি বুঝতে পারছি না। আমি একজন ক্রিকেটার। কিন্তু সকাল থেকে লোকেরা এসে আমাকে বলছে ডাক্তার। আমার বাসার নিচেও আমার নামে কে যেন ডাক্তারি চেম্বার বসিয়ে রেখেছে। আমি কিছুই মনে করতে পারছি না।”


এভাবেই পৃথিবীতে বসবাস করতে লাগল অমর মানুষেরা। অমরত্বের বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল স্মৃতিশক্তি।



(পরবাস-৬০, অগস্ট ২০১৫)