Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে রঞ্জন ভট্টাচার্যের
লেখা




ISSN 1563-8685




শুনে পুণ্যবান

“সহসা পুরুষাঙ্গে যেন এক কঠিন পাথরের আঘাত লাগল তাঁর। তীব্র যন্ত্রণায় থরথর করে কেঁপে উঠলেন তিনি। তাঁর উদ্‌গত শুক্ররস স্খলিত হোলো ভূমিতে। রতিসুখের শীর্ষে এসে এইভাবে ব্যর্থরত হলেন তিনি।”

—এই কাহিনি হয়তো আগে কেউ বলে গেছেন। এখন আমি বলছি। আমার মতো করে। ভবিষ্যতে অন্য কেউ বলবেন। তাঁর মতো। যাই হোক আবার মূলকাহিনিতে ফিরে আসি।

“মহামুনি উতথ্যের পরমপ্রিয়া ভার্যা ছিলেন মমতা। মমতার ছিল অগাধ রূপের ঐশ্বর্য। আর উতথ্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতাই হলেন দেবগুরু বৃহস্পতি। যিনি বিপুল যশ ও ক্ষমতার অধিকারী। এহেন মহর্ষি বৃহস্পতি ভ্রাতৃবধূ মমতার প্রতি আকৃষ্ট হলেন। উতথ্যের অনুপস্থিতিতে বৃহস্পতি একান্তে মমতাকে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করলেন। সব শুনে মমতা চরম লজ্জিত ও স্তম্ভিত হলেন। ঋষি বৃহস্পতি মমতার মনোভাব বুঝেও এক নির্লজ্জ কামার্তের মত তখনই মমতার সঙ্গে সঙ্গম করতে উদ্যত হলেন। নির্জন আশ্রমে অসহায় মমতা তাঁকে সকরুণ মিনতি করে জানালেন যে তিনি অন্ত:সত্ত্বা। বৃহস্পতির জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উতথ্যের সন্তান সযত্নে লালিত হচ্ছে তাঁর গর্ভে। অতএব ঋষি বৃহস্পতি যেন লিপ্ত না হন এই অনুচিত কার্যে। চূড়ান্ত রতিলিপ্সায় অস্থির বৃহস্পতি মমতার কোনো কথাতেই কর্ণপাত করলেন না। অতএব শুরু হল বলাৎকার।

"‘ক্ষান্ত হোন। নিবৃত্ত হো্ন এই ভয়ঙ্কর কার্য থেকে। মনে রাখুন আপনি দেবগুরু বৃহস্পতি। আপনি অমোঘরেতা। আপনার নিক্ষিপ্ত বীর্য নিষ্ফল হওয়ার নয়। কিন্তু আমি এই ঘটনার বহুপূর্ব থেকেই এই মাতৃজঠরে আশ্রিত রয়েছি। তাই এখানে দ্বিতীয় কারো স্থান হতে পারে না। আমি থাকাতে আপনার ঔরস ধারণের কোনো স্থান নেই এখানে। তাই এখনি নিবৃত্ত হোন এই দুষ্কর্ম থেকে’ — কথাগুলি অতি আশ্চর্যভাবে উচ্চারিত হোলো মমতার গর্ভস্থ সন্তানের মুখ থেকে। কিন্তু বৃহস্পতি সেই কথায় কর্ণপাত করলেন না। অসহায় মমতা শেষ বারের মতো কাতর নিবেদনে বললেন—‘হে প্রভু। আমার গর্ভস্থ পুত্র সর্ববেদজ্ঞ মহাজ্ঞানী ও অলৌকিক ক্ষমতাধারী। আপনি দয়া করে তার কথার মর্যাদা দিন।’ সঙ্গমের তুঙ্গ মুহূর্তে মমতার এইসব কথা বৃহস্পতির কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হোলো। তিনি তাঁর সমস্ত কামনাকে একাগ্র করে মমতাকে তীব্রতম উল্লাসে বিদ্ধ করতে উদ্যত হলেন। আর তখনই সেই গর্ভস্থপুত্রের এক প্রবল পদাঘাত এসে পড়লো বৃহস্পতির লিঙ্গমুখে। এই অতর্কিত আঘাতে মমতার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় ভূপতিত হলেন তিনি।

এর পরেই এলো সেই ঘোরমুহূর্ত। যার ফলে গভীর অন্ধকারে চলে গেলো একজনের জীবন। চিরকালের মতো। অবশ্য শতসহস্র বর্ণাঢ্য মানুষের বিপুল ইতিহাসে তাঁর স্থান বিন্দুমাত্র। কিন্তু আমরা ওই বিন্দুর—"

—এই অবধি পড়ে ফেললাম কাগজটা। বহুদিন আগের লেখা। এখন আর পড়ে ভালো লাগছে না। এখন বড্ড বেশি নাটুকেপনা বলে মনে হচ্ছে। সত্যিকারের ছবিটা ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। কেন যে লিখেছিলাম ওইভাবে কে জানে। বিরক্ত হয়ে কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলাম সামনের বইয়ের স্তূপে। তখনই হঠাৎ চোখে পড়লো ওই বইয়ের স্তূপের মধ্যেই পড়ে থাকা একটা নীলরঙের পাতলা খাতাকে। আরে! এটাই তো খুঁজছিলাম। গত কয়েকদিন ধরে। সঙ্গে সঙ্গে খাতাটা টেনে নিয়ে পাতা উলটে দেখতে লাগলাম। হ্যাঁ এই লেখাটাই। কিছুকাল আগের লেখা। মনে আছে একনাগাড়ে লিখেছিলাম। হাতের লেখাটা কিছু কিছু জায়গায় বেশ জড়িয়ে গেছে। মাঝেমাঝে বেশ কাটাকুটিও আছে। যাই হোক পড়তে শুরু করলাম—

“'জন্মান্ধ হবি। জন্মান্ধ হবি। মহাপাতক কোথাকার।'—জন্মমুহূর্তে শোনা কথাগুলো মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসেও কি স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছি আমি—সমস্ত পুরোনো কথাগুলো কি ভয়ঙ্করভাবে ভেসে আসছে আমার কাছে—ঠিক এই জলের ঢেউগুলোর মতো আমায় ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে—ঠিক আগের মতোই, আরো নিষ্ঠুরভাবে—কাঁপিয়ে দিচ্ছে আমার শরীরের মজ্জা পর্যন্ত। আর আমি সহ্য করে যাবো এই যমযন্ত্রণা—যতক্ষণ না মরে কাঠ হয়ে নদীতে ভেসে যায় আমার দেহটা—আর ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুতেই রেহাই দেবে না আমায় ওরা, ওইসব ঘটনাগুলো—

"জন্মান্ধ। হ্যাঁ অন্ধ হয়েই জন্মালাম। অন্ধ হয়েই বড়ো হলাম। কিন্তু তাতে আমার কোনো দু:খ ছিলো না কোনোদিন। কারণ—

"উ: মাগো! মাথাটা যেন ফেটে গেলো। কি যে সে ধাক্কা খেলাম কে জানে। মনে হয় কোনো ভাসন্ত গাছের গুঁড়ি। ভেঙে চুরমারও হয় না মাথাটা, মরিও না আমি এতো কষ্ট পেয়েও—

"মাগো! আমার হতভাগিনী মা। কতোকাল আগে চলে গেছো আমায় ছেড়ে ওই দূর আকাশের কাছে। ওই দূর থেকে ওই উপর থেকে তুমি কি দেখতে পাচ্ছো আমায়? কিভাবে ভেসে যাচ্ছে আমি এই নদীর জলে—সারা শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, এই বৃদ্ধ অশক্ত শরীরটা কিভাবে ভেসে চলেছে কনকনে ঠাণ্ডা জলে—দেখতে পাচ্ছো? আমি কিন্তু সব দেখতে পাচ্ছি। প্রকাণ্ড আকাশের নীচে—অকুল জলের উপর—ঢেউয়ের ধাক্কায় সমানে উথালপাথাল হতে থাকা আমার শরীরটাকে। হয়তো মা ভাবছে অন্ধ ছেলের মরণকালে ভীমরতি হয়েছে। না গো মা। তুমি তো জানো মহামুনি উতথ্যের পুত্র আমি। তোমার গর্ভে থাকতেই বেদজ্ঞান সম্পূর্ণ হয়েছিলো আমার। ইচ্ছে করলেই যোগবলে আমি সবকিছুই দেখতে পাই। কিন্তু চাইনি। সেই মহর্ষির অভিশাপ ব্যর্থ করে দিতে চাইনি আমি। তাই মেনে নিয়েছিলাম আমার এই বাইরের অন্ধকার জগৎটাকে। কিন্তু অন্তরে আলো ছিল। তার জন্য এসেছিলো কতো পিতা—কতো ভক্ত। প্রদ্বেষীর মতো রূপসী ব্রাক্ষণ-কন্যার সঙ্গে বিয়ে হোলো—এল সুন্দর পুত্রসন্তান, কতো সুখী পরিবার—কিন্তু সেই ঋষির অভিশাপ যে এতো গভীরে গিয়ে—

"একি! হঠাৎ দম আটকে আসছে কেন? জলের ঘূর্ণিতে কোথায় তলিয়ে যাচ্ছি আমি? তাহলে এটাই কি শেষমুহূর্ত? এই মধ্যরাতে? তাহলে শেষ নিঃশ্বাসে বলে যাই—অন্ধ আমি—কিন্তু অন্তিম অন্ধকার সবার কাছে সমান, তাই—

"নাহ্‌। মৃত্যু এখনো নিলো না আমায়। টের পাচ্ছি মুখের উপরে এসে পড়ছে নতুন দিনের আলো। জলের সেই ভয়ঙ্কর টানটা আর নেই। যেন খুব হাল্কাভাবে ভেসে চলেছি। পাশ দিয়ে ভেসে চলে যাচ্ছে কতো কি। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার শরীর। আবার সব কিছু মনে পড়ছে—সব পুরোনো কথা—একের পর এক। কিছুতেই মনে করতে চাইছি না তাও ওরা চলে আসছে কি ভয়ঙ্কর ভাবে। মনে পড়ছে বলেছিলাম, 'গোধর্ম পালন করো—তোমরা সবাই গোধর্ম পালন করো। সহজ হও, উদার হও তোমাদের সমস্ত কামক্রিয়ায়—ওই পবিত্র চতুষ্পদ জীবটির মতো।' শুনে কতো রকমেরই না প্রতিক্রিয়া হোলো লোকজনের মনে। অনেকেই মুখে কিছু বললো না। কারণ এত বড়ো পণ্ডিত বেদজ্ঞ ব্রাক্ষণ আমি। আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস কোথায়! কেউ কেউ অবশ্য আমার মতটা মেনে নিলো খুব খুশি হয়ে—কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বললো না—তবে বেশিরভাগই হৈ হৈ করে বলে উঠলো, ‘উচ্ছন্নে গেছে লোকটা, দূর করে দাও ওকে আমাদের সমাজ থেকে।' আমি কিন্তু কিছুই বলিনি কাউকে। চুপচাপ নিজের পথেই ছিলাম।

"পাখি ডাকছে। খুব চেনা এই পাখির ডাকটা। যেন অনেককাল আগে শুনেছিলাম। কোথায় কখন কে জানে। মনে পড়ছে। হ্যাঁ মনে পড়ছে। সুচরিতার ওখানে। নাহ্‌! নাহ্! এর বেশি আর কিছু মনে করতে চাই না। দোহাই। তা সত্ত্বেও ওই যে—ওই—সুচরিতা এসে দাঁড়াচ্ছে আমার সামনে—

"হ্যাঁ হ্যাঁ আমি বলেছিলাম তখন সুচরিতাকে বলেছিলাম, ‘এসো—নির্দ্বিধায় এসো—নি:সংকোচে আমার সঙ্গে মিলিত হও।’ সুচরিতা বলেছিলো, ‘ছি ছি! একি কথা বলছেন আপনি! আপনি আমার শ্বশ্রূপিতা। এ কি অশোভন আচরণ আপনার!' আমি বলেছিলাম, ‘শোনো সুচরিতা। আমি মানুষের ইচ্ছার মর্যাদা দিই সর্বাগ্রে। কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো সংযোগকে আমি ঘৃণা করি। তাই তুমি যেতে পারো স্বচ্ছন্দে। তবে মনে রেখো নিজের আত্মার সঙ্গে কোনোদিন দ্বিচারিতা কোরো না। দ্বিধাহীনভাবে গোধর্ম পালন কোরো যদি পারো।' সুচরিতা সেদিন চলে গিয়েছিলো নি:শব্দে। এতকাল বাদে আবার এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে। আমার শেষগতি দেখবে বলে। 'দ্যাখো—দ্যাখো। আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা একটা অথর্ব অন্ধ বৃদ্ধ কিভাবে জলে ভেসে যাচ্ছে দ্যাখো।'

"বেলা বাড়ছে। সূর্য বোধহয় ঠিক মাথার উপরে এলো। কি অসহ্য তাপ। কি অসহ্য এই যন্ত্রণা। এইভাবে আমায় ভেসে যেতে হবে আমৃত্যু। আর ততক্ষণ সমস্ত পুরোনো কথাগুলো একের পর এক পাথরের মতো এসে পড়বে আমার উপর।

"ওই যে, ওই যে আরেকটা মুখ—উপরের ওই সূর্যের চেয়েও ভয়ঙ্করভাবে এসে দাঁড়াচ্ছে আমার সামনে—আমার স্ত্রী।

"—‘আপনি সংসারে থাকার অযোগ্য। কোনোদিন কিছু উপার্জন করতে পারলেন না। সংসার প্রতিপালন করা তো অনেক দূরের কথা। আপনাকেই আমাদের ভরণপোষণ করতে হয়। তার উপর আপনার এই কদর্য আচরণ।’

"—‘ঠিক আছে। আমি অন্ধ মানুষ। একা তো কোথাও চলে যেতে পারবো না। তোমরা আমায় কোনো সম্ভ্রান্ত ক্ষত্রিয়ের বাড়ি নিয়ে চলো। আমি অর্থোপার্জন করে এনে দেবো তোমাদের।’

"—'আপনার উপার্জিত অর্থ স্পর্শ করতেও আমাদের ঘৃণা করে। আপনার ব্যবহারের জন্য সমস্ত ঋষিসমাজ আপনাকে ত্যাগ করেছে। এবার আমাদের মুক্তি দিন। নয়তো আমরাও বাধ্য হবো’—

"একি! এমন থরথর করে কেঁপে উঠছে কেন আমার শরীরটা! কই কোনো কিছুর সঙ্গে তো আর ধাক্কা লাগেনি আমার, কোনো চোরা স্রোত তো আছড়ে নিয়ে ফেলেনি আমায় কোনো ঘূর্ণিজলে—তাহলে কি সেই পুরোনো স্মৃতিটাই আমার অস্থিমজ্জা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে? হ্যাঁ হ্যাঁ—আমার স্ত্রী প্রদ্বেষীর কথা শুনে আমি তখন রাগে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে বলেছিলাম, 'এতো বড়ো স্পর্ধা এই স্ত্রীলোকের! আজ থেকে আমি এই নিয়ম প্রতিষ্ঠা করলাম যে স্ত্রীলোকের একটি মাত্র পতিত্বই হবে। স্বামী মারা গেলে বা নিরুদ্দেশ হলে অথবা অন্য যে-কোন অবস্থায় অন্যত্র জীবিত থাকলে কোনো বিবাহিত স্ত্রীলোক দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারবে না। কিংবা অন্য পুরুষকে অবলম্বন করতে পারবে না। যে স্ত্রী স্বামী-ভিন্ন অন্যপুরুষের অনুগামিনী হবে সে সমাজে পতিতা হবে। কোনো বিধবা নারী যদি অন্যপুরুষে সামান্যতম অনুরাগিনী হয়, তাহলে সে তার মৃত স্বামীর পরিবার ও সম্পত্তি থেকে সম্পূর্ণ বর্জিত হবে।'

"এর উত্তরে প্রদ্বেষী ততোধিক চিৎকার করে বলেছিলেন, 'যে স্ত্রীজাতির সম্মান দিতে জানে না সে আবার স্ত্রীজাতির উপর নিয়মশৃঙ্খলার বাঁধন দিতে চায়? যাও, পুত্রেরা একে দূর করে দাও। এই জঘন্য মানুষটা যেন আমাদের ত্রিসীমানার বাইরে থাকে।'

"এরপর আমার আর কোনো বোধ কাজ করছিলো না। যেন একটা পাথরের খণ্ডের মতো হয়ে গেলাম। অনেক পরে বুঝলাম যে ওরা আমাকে সারা শরীরে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা ভেলায় করে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছে।

"বাতাসে হঠাৎ ঠাণ্ডা ভাব পাচ্ছি যেন। সূর্য ডুবে গেলো বোধ হয়। শেষ হয়ে গেলো আরেকটা দিন। এইভাবে আরো কটা দিন গুনতে হবে আমায় কে জানে। কারণ মহাপাপ করেছি যে। হ্যাঁ মহাপাপ। নিজের মাকে চরম লাঞ্ছনার হাত থেকে রক্ষা করে। ওই লম্পটটার পুরুষাঙ্গে লাথি মেরে। কারণ সেই লম্পট যে দেবগুরু বৃহস্পতি। তাই মহাপাপ হোলো আমার। লাগলো ভয়ানক অভিশাপ।

"'আপনি যেখানেই থাকুন শুনে রাখুন ঋষি বৃহস্পতি, এই মহাপাপ আমি প্রতি জন্মেই করতে চাই—গর্ভধারিণী মায়ের সম্মানরক্ষার জন্য আপনার মতো কামুকের পুরুষাঙ্গে লাথি মারতে আমি প্রতি জন্মেই প্রস্তুত, এর জন্য জন্মজন্মান্তরে যদি অন্ধ হতে হয় তবুও—'

"উ: কি তীব্র যন্ত্রণা—কে যেন আমার অন্ধ চোখটাকে উপড়ে নিতে চাইছে—আবার, আবার ওই আঘাত—যেন বল্লম দিয়ে কেউ খোঁচাচ্ছে আমার গোটা মুখটা! কিন্তু তা কি করে সম্ভব? আমি তো ভাসছি নদীর জলে। ওহ্‌! এইবার বুঝতে পেরেছি—শকুন কিংবা চিল! শেষপর্যন্ত এরা এসে জুটেছে আমার শরীরের উপর। চমৎকার। অতি চমৎকার! আয় আয়। আরো আরো আয়। আমার সারা শরীরে এসে বোস। আমায় এভাবে খুবলে খুবলে খা। তবে না আমার মুক্তি হবে।

"কারণ এটাই আমার প্রাপ্য ছিলো! এতকাল ধরে বলে এসেছি, ‘মুক্ত হও, বাধাবন্ধহীন হও—ওই চরিত্রের ঊর্ধে ওঠা নিষ্পাপ পশুপাখীদের মতো অবাধে অসঙ্কোচে যে যার সঙ্গে স্বেচ্ছায় মিলিত হও; কোনোদিন কোনো শৃঙ্খলে নিজেকে বেঁধো না—সম্পর্কের শৃঙ্খল, জ্ঞানের শৃঙ্খল, মায়ার শৃঙ্খল—সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে মুক্তমনে উদার কামভাবে বাঁচতে শেখো।’ তাই এই শেষসময়ে আমার সারা শরীরে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা—ভেসে যাচ্ছি মৃত্যুর দিকে আর আমার গোটা দেহে মহানন্দে ঠুকরে বেড়াচ্ছে ওই মুক্তপাখীর দল। বড়ো চমৎকার আমার এই শেষগতি।

"মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে এলো। কেমন হয় সন্ধ্যার আকাশ? পূর্ণিমার চাঁদ? রাতের তারাভরা আকাশ? নাহ্‌। কখনো দেখতে পাইনি আমি। দেখতে পাইনি কোনো সূর্যোদয়। ফুলের রঙ। নারীর মুখশ্রী। কোনোদিন আলোর মুখ দেখতে না পেয়ে মানুষের সাধারণ বোধবৃত্তিও কি অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছিলো আমায়? অন্ধ হলাম কি অন্তরেও? ওই গোধর্ম কি আরো অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিলো আমায়? ঋষি বৃহস্পতির অভিশাপের গভীরতা কি এতটা ভয়ানক?

"রাত বাড়ছে—সেই সাথে জলের টানও, বোধহয় ফের কোনো জলের ঘূর্ণিতে এসে পড়লাম—আরো অন্ধকার, কি ভয়ঙ্কর গাঢ়—নাহ্‌ ভয় পাচ্ছি না, ওতো আমার আজন্মের সঙ্গী—এবার যেন বড়ো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে আমায়। উ: মাগো—

"শ্বাস আটকে আসছে ভীষণভাবে—এজন্মে যদি কিছুমাত্র সুকৃতি করে থাকি—তাহলে পরজন্মে অবশ্যই একজন মানুষ হয়ে জন্মাবো, সাধারণ অতি-সাধারণ মানুষ—অজ্ঞ, শাস্ত্রহীন—শুধু দুটো সাধারণ চোখ আর সাধারণ দৃষ্টি—"


—অসহ্য। অসহ্য লাগছে নিজের লেখাটাকে। অনেকক্ষণ ধরে পড়ছিলাম। অনেক ধৈর্য ধরে। নিজের লেখা তো নিজের সন্তানের মতো। খারাপ হলেও ছুঁড়ে ফেলে দিতে কষ্ট হয়। তাই চেষ্টা করলাম পড়তে। কিন্তু একেবারে যাচ্ছেতাই। কোনো বাঁধনই নেই লেখাটার। উত্তম পুরুষে লেখা। সেখানে নিজের কথা বলতে গেলেও তো একটা বাঁধন থাকবে। বাক্যের বিন্যাস অত্যন্ত অগোছালো। আর—

থাক্। রাগে কুচিকুচি করে দিতে ইচ্ছে করছে লেখাটাকে। হু হু করে হাওয়া বইছে। বিশ্রী আওয়াজ করে আছড়াচ্ছে খাতার পাতাগুলো। হাতের সামনে থাকা হরিচরণের শব্দকোষ চাপিয়ে দিলাম লেখাটার উপর। নিশ্চুপ হয়ে থাক। চোখের আড়ালে চলে যা। বরাবরের মতো।

টেবিলের থেকে মুখ তুলে সামনের দিকে তাকালাম। জানালায় মাঝরাতের ঘন কালো আকাশ। ঘরের মধ্যে কেমন একটা দম আটকানো ভাব লাগছিলো। বাইরে এলাম। বারান্দায়। এই মাঝরাতে বিরাট আকাশটার দিকে তাকালে কখনো কখনো নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। কেন জানি না খুব অস্থির লাগছিলো। ঘরে চলে এলাম। আমার লেখার টেবিলে। একটা সাদা কাগজের বাণ্ডিল থেকে কয়েকটা পাতা টেনে নিলাম। হঠাৎ লিখতে শুরু করলাম। যেন একটা ঘোরের মধ্যে লিখতে লাগলাম—

“কতোক্ষণ? আর কতোক্ষণ? আর কত সময় লাগবে আপনার? আমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আছি। আপনার মুখ থেকেই শুনবো বলে। আপনার আশ্চর্য কাহিনিটি। কিন্তু আর কতোক্ষণ?

"আমরা অবাক হয়েছিলাম আপনাকে এখানে দেখে। কিন্তু এতো আপনিই! নি:সন্দেহে আপনি। মাঝরাতে অন্ধকার। লোকের চোখের আড়ালে আপনি এখানে এসেছেন। কি আশ্চর্য ব্যাপার তাই না?

"অবশ্য আপনার বেঁচে থাকাটাই তো ভারী আশ্চর্যের। আমরা তো ভেবেছিলাম আপনি মরেই গেছেন। আর ভাববো নাই বা কেন বলুন? একটা জরাজীর্ণ বৃদ্ধ। সারা শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ভেসে যাচ্ছে নদীর জলে। চিল শকুনে গায়ে এসে বসেছে। তাকে জ্যান্ত ভাববো কি করে?

"কিন্তু দেখুন এইভাবে ভাসতে ভাসতে আপনি কোথায় এসে ঠেকলেন! অতো বড়ো একজন রাজার পায়ের কাছে! যিনি কিনা তখন নি:সহায় হয়ে একান্তে তাঁর ইষ্টদেবতার আরাধনা করছিলেন ওই নদীর পাড়ে জলের ধারে দাঁড়িয়ে। ভবিতব্য! কি মনে হয় আপনার?

"আপনি যেন শুনতে পেলেন বহুদূর থেকে কেউ বলছে আপনাকে, 'চোখ মেলে তাকান, তাকান আমার দিকে—আমার হাতটা ধরুন।’ তখনই যেন এক কোমল উষ্ণস্পর্শ পেলেন তাঁর আঙুলগুলির। অনুভব করলেন এক স্নিগ্ধ মধুর বাতাস।

"মুহূর্তের জন্য আপনার মনে হোলো—একেই কি পুনর্জন্ম বলে?

"আপনি শুনতে পেলেন এক মধুর অথচ গম্ভীর কণ্ঠস্বর, “আসুন, আমার সঙ্গে আসুন।” আপনার মনে হোলো, 'এও কি সম্ভব কখনো?' আপনার খুব আবছা আবছাভাবে মনে পড়ছিলো। ফলে আপনার চেতনা লুপ্ত হচ্ছিল এক ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্টের মধ্যে। তখন আপনি প্রার্থনা করেছিলেন আরেক মনুষ্যজন্মের। যেখানে দুচোখ মেলে দেখতে পারেন জগৎটাকে। তাহলে, এই মুহূর্তে যে আলো-বাতাস–ধ্বনি-স্পর্শের অনুভূতি পাচ্ছেন তা পরজন্ম ছাড়া আর কি হতে পারে? এই সময় আপনি শুনলেন সেই কণ্ঠস্বর, ‘আসুন ঋষিবর, আসুন আমার প্রাসাদে; আসুন আমাকে ধন্য করুন।’ আপনার বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই আবার শুনলেন, ‘আমি আপনাকে চিনেছি ঋষিবর—আপনি মহর্ষি দীর্ঘতমা। ইষ্টদেবতার আশীর্বাদেই এইভাবে আপনার দেখা পেলাম।’ তখনই আপনি বুঝতে পারলেন যে কোনো পুনর্জন্ম নয়—আপনি সেই মহামুনি উতথ্যের পুত্র। লাঞ্ছিতা মাতা মমতার গর্ভজাত এবং দেবগুরু বৃহস্পতির অভিশাপগ্রস্ত জন্মান্ধ ঋষি দীর্ঘতমাই অতি আশ্চর্যভাবে জীবন ফিরে পেয়েছেন। শরীরের সমস্ত বাঁধন কেটে দুহাতে পরমযত্নে তিনি যখন আপনার অশক্ত শরীরটাকে দাঁড় করালেন তখন আপনি বলেছিলেন, ‘কে আমার প্রাণ বাঁচালে এভাবে?' উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি সামান্য রাজা। আমার নাম বলি। আর আপনার প্রাণ যে অমূল্য ঋষিবর।’ সেকথা শুনে আপনি অতি নগণ্য মানুষের মতো কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেছিলেন, ‘না মহারাজ – না – আমি অতি ঘৃণিত মানুষ - অতি কদর্য আমার অতীত - আপনার সেসব জানা নেই।’ বলিরাজা প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘আমার সব জানা আছে মহর্ষি। কিন্তু আপনার অতীতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কারণ আপনার এই বর্তমান অস্তিত্বের উপরেই নির্ভর করছে আমার ভবিষ্যৎ। সেকথা পরে হবে ঋষিবর। এখন প্রাসাদে চলুন। বিশ্রাম নেবেন।’

"বলিরাজার কথায় আপনি অতি বিস্মিত হয়েছিলেন। আপনার মনে হয়েছিলো, ‘এখনো আমার জীবনের মূল্য আছে? মানুষকে আলো দেওয়ার ক্ষমতা আছে?' যেন একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে আপনি প্রাসাদে পৌঁছেছিলেন। তারপর সারাদিন কেটে গিয়েছিলো আপনার এক গভীর চিন্তায়। সমস্ত পুরোনো কথা পুরোনো ঘটনা বিশ্লেষণ করতে বসেছিলেন আপনি। ভাবছিলেন পিতা উতথ্যের আশ্চর্য যোগবলে গর্ভাবস্থাতেই সর্ববেদজ্ঞ হয়েছিলেন। আর সেই গর্ভস্থকালেই আবার জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি বলাৎকারের সাক্ষী। মহর্ষি বৃহস্পতিকে সেই মৈথুনে বাধা দিয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই চরম শাপগ্রস্ত। যে ব্যভিচারকে ভ্রূণাবস্থাতেই সজোরে পদাঘাত করেছিলেন সে ব্যভিচারেরই প্রচারক বলে দুর্নাম জুটলো সর্বত্র। চরম লাঞ্ছনায় স্বজনের দ্বারা বিসর্জিত হলেন অতি নিষ্ঠুরভাবে। ‘কোনোদিন পৃথিবীর আলো দেখিনি বলে কি অজান্তেই কামনার অন্ধকারে নেমে যেতে হোলো? নাকি ঋষি বৃহস্পতির অভিশাপের গূঢ় উদ্দেশ্য ছিলো এটাই? জীবনে শুধুমাত্র রতিলিপ্সাই সার—একথা তো বলতে চাইনি আমি।' সারাদিন আপনি জর্জরিত হলেন এইসব চিন্তার স্রোতে। শেষে উপস্থিত হলেন এই বোধে—'ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ভালোবাসার আলোই শ্রেষ্ঠ।' স্থির করলেন এই আলোর সন্ধানই দিতে হবে মানুষকে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোয়। আত্মগ্লানির এক বিপুলভার নেমে গেলো আপনার উপর থেকে। আর তখনই আপনি অনুভব করলেন সূর্যাস্তের আঁধার ঘনিয়ে আসছে চারিপাশে। তাই না?

"সায়াহ্নেই বলিরাজা এলেন আপনার ঘরে। এসে বললেন, ‘আপনি ঈশ্বরপ্রেরিত। আপনি আমার ভবিষ্যৎ। আমার বংশের, আমার দেশের ভবিষ্যৎ।’ আপনিও রাজার হাত দুটি ধরে বলেছিলেন, 'মহারাজা আপনি শুধু আমার প্রাণ বাঁচাননি, আপনি আমার জীবনের নতুন আলোর সন্ধানের সুযোগ দিয়েছেন। আপনার জন্য আমি সবকিছুই করতে প্রস্তুত।’ আর এর পরেই শুনলেন এই কথাগুলি, ‘আজ রাতে আপনাকে আমার মহিষীর সঙ্গে মিলিত হতে হবে। আমি অপুত্রক; আপনার দ্বারা আমার বংশ বাহিত হোক সেই আমার ইচ্ছা। আমার বিশ্বাস আপনি আপনার দেহমন সর্বতোভাবে নিয়োজিত করবেন এই মহান কার্যে।’

"'মহান কার্য। সর্বতোভাবে দেহমন নিয়োজিত’—কথাগুলি আপনার কাছে কিভাবে এলো বলুন তো? খানিক আগেই মনে মনে নিজের শেষজীবনের যে ছবিটা এঁকেছিলেন সেটিতে কতোটা গাঢ় কালো রঙ ঢেলে দিলো আপনার নিয়তি কিংবা ভবিতব্য। তাই নি:শব্দে মাথা তুলে আপনি তাকালেন বলিরাজার দিকে। বলিরাজা হাত জোড় করে বলেছিলেন, ‘মহর্ষি আমি নিশ্চিন্ত হলাম। কারণ তাঁর পক্ষে আপনার অন্ধ চোখদুটির ভাষা পড়া সম্ভব ছিলো না।’

"বলিরাজা বিদায় নিলে আপনি একান্ত নির্জনে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন সে অমোঘ মুহূর্তের জন্য। নতুনজীবনে ঊর্ধ্বরেতা হয়ে হিরণ্ময় প্রেমের জয়গান করার বদলে আপনাকে যে খানিকবাদেই বাধ্য হতে হবে উপস্থিত হতে—নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট কক্ষে, নির্দিষ্ট রমণীর কাছে নির্ধারিত মৈথুনের জন্য—তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে না? তাই আপনার নিষ্কাম প্রেমের সাধনা ডুবে গেল খানিকবাদেই গহন অন্ধকারে এক প্রগাঢ় সঙ্গমে। সেই পরমাসুন্দরীর সঙ্গে আপনার বাধ্যতামূলক সঙ্গমের বর্ণনা আমরা উহ্য রাখলাম।

"আমরা জানি যে সেই নির্ধারিত মিলন সম্পন্ন হয়েছিলো নির্বিঘ্নে। তাই পরদিন বলিরাজা আপনার কাছে এসে নতজানু হয়ে বলেছিলেন, ‘মহর্ষি আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আমার বংশরক্ষার জন্য আপনি যা করলেন তার ঋণ আমি কোনোদিন শুধতে পারবো না। কথাটা শুনে নিজেকে খুব হীন মনে হয়েছিলো আপনার। আপনি মাথা নীচু করে অনুচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘মহারাজ। এই ভাবী সন্তানটি আপনার ক্ষেত্রজ পুত্র হতে পারবে না। ও হবে আমারই বংশধর।' বলিরাজা চিৎকার করে বলেছিলেন, 'কি কারণে ঋষিবর!’ আপনি শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার এই কদর্য আকৃতিতে এক হয়তো কদর্যতর সঙ্গমের আশঙ্কায় মহারাণী তাঁর এক সুন্দরী দাসীকে সুসজ্জিতা করে পাঠিয়েছিলেন এই অন্ধ মানুষটির কাছে। আমি জন্মান্ধ বটে কিন্তু যোগবলে ইচ্ছা করলেই যে কোনো কিছুই দৃষ্টিগোচর করতে পারি। সেই ইচ্ছা আমি সর্বদা সংযত রাখি। প্রয়োগ করি শুধুমাত্র বিশেষ প্রয়োজনে।’ বলিরাজা লজ্জায় মাথা নীচু করেছিলেন। আর আপনি বলেছিলেন, ‘মহারাজা তাহলে আমায় এবার বিদায় দিন। আমায় অনেক দূর যেতে হবে। অনেক জায়গায়।’ বলিরাজা এক অদ্ভুত শীতল কন্ঠে বলেছিলেন, ‘চলে যাবেন? আমার বংশধর সৃষ্টি না করেই?'

"অতএব আপনিই। এবং একমাত্র আপনিই। আপনাকেই আসতে হোলো আবার। লোকচক্ষুর অন্তরালে। মধ্যরাত্রে। রাজার নির্দেশে। নয়তো আপনার কখনোই ওই সময়ে ওখানে থাকার কথা ছিলো না। তাই না?

"তাই তো রাজমহিষী সুদেষ্ণা তখন ধীরে ধীরে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাবরণ করেছিলেন আপনার সামনে। তারপর কাছে এগিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘এবার রাজার ইচ্ছা পূর্ণ করুন মহর্ষি।' আপনি কি তখন যোগবলে দেখতে পেয়েছিলেন প্রদীপের নম্র আলোয় ঢাকা সুদেষ্ণার হিরণ্ময়ী মূর্তিটিকে? সুদেষ্ণা কিন্তু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেছিলেন আপনার জীর্ণ শীর্ণ কুশ্রী আকৃতিটিকে। এবং তখন তাঁর মনে হয়েছিলো—তাহলে ইনিই সেই ব্যক্তি যিনি মানুষকে পশুপাখিদের মধ্যে অবাধ মিলনের কথা বলেছিলেন। পরমুহূর্তেই সুদেষ্ণা চোখ বন্ধ করেছিলেন এবং কম্পিত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি প্রস্তুত আছি ঋষিবর।’ আর আপনি তখন সুদেষ্ণার আরো কাছে গিয়ে তাঁর কোমল হাত দুটি আপনার অস্থিসার মুঠোয় শক্ত করে ধরে নিজের কপালে ঠেকিয়েছিলেন। সুদেষ্ণার সমস্ত শরীর যেন থরথর করে কেঁপে উঠেছিলো সে মুহূর্তে।

"‘পুত্রবতী হও। পুত্রবতী হও’—যেন অতিকষ্টে বলতে পেরেছিলেন আপনি। আপনার অন্ধ নয়নদুটি থেকে তপ্ত অশ্রুজল শীর্ণধারায় নেমে এসেছিলো আপনার চর্মসার গাল বেয়ে। তারপর বিন্দু বিন্দু করে খসে পড়েছিলো সুদেষ্ণার আঙুলগুলির উপর। আর তখনই হঠাৎ নিবে গিয়েছিলো ঘরের একমাত্র প্রদীপের সামান্য আলোটি। সহসা গভীর অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিলেন আপনি এবং সদ্যোনগ্না সুদেষ্ণা। তাই ওই বিপুল অন্ধকারে আমরা আর কোনো অশ্রুধারার অনুসরণ করতে পারলাম না।

"কিন্তু অপেক্ষা করছিলাম। ওই ঘরের বাইরে। বহুক্ষণ ধরে। সময় যেন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ওই নিথর অন্ধকারের সঙ্গে মিশে।

"দীর্ঘকাল, অতি দীর্ঘকাল অপেক্ষা করার পরেও সে অন্ধকার কিছুমাত্র কমলো না। আপনাকেও দেখা গেলো না সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। অর্থাৎ আমাদের কাহিনিটা এইভাবে অন্ধকারে তলিয়ে গেলো বরাবরের মতো।"

—এই পর্যন্ত একটানা লিখে মাথা তুলে তাকালাম জানালার ওপারের বিরাট আকাশটার দিকে। তখনই শুনলাম কে যেন বলে উঠলো আমার পাশ থেকে—‘মোটেও না।’

আরে! কি আশ্চর্য। এই ভদ্রলোকটি কখন এসে হাজির হয়েছেন আমার ঘরে! একমনে লিখছিলাম। তাই টেরই পাইনি। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম—এক প্রখরদৃষ্টি প্রৌঢ় ব্যক্তি। দেখেই মনে হয় শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত। ‘এটিই কি আপনার কাহিনি?'—জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। আমি বললাম, 'হ্যাঁ।' উনি মাথা নড়িয়ে বললেন, ‘হয়নি।’ আমি বললাম, 'কেন?' একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উনি বললেন, ‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান।’ রাগে আর বিরক্তিতে একটু তেতো গলাতেই বলে ফেললাম, ‘এ কাহিনিতেও অমৃতের সন্ধান পেলেন?' উনি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বললাম, 'বসুন।' আমার টেবিলের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে উনি বললেন, 'নাহ্‌ থাক।' তারপর আমার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে উনি বলতে লাগলেন—

"ওই অন্ধকারে আমিও অপেক্ষা করেছি—তুমি চলে যাওয়ার পরেও—অনেকদিন, অনেককাল—তারপর হঠাৎ দেখতে পেলাম ওই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি—একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি নাহ্‌। ইনি তো সেই শীর্ণদেহী মানুষটি নন। বরং এক দীর্ঘ বিশালাকৃতি ব্যক্তি। ভাবলাম কে ইনি? গহন অন্ধকার যেন এক মাটির স্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনি কে?' কোনো উত্তর এলো না। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, 'ঋষি দীর্ঘতমা কোথায়?' এবারেও কোনো উত্তর এলো না। বরং কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে উনি তাকালেন আমার দিকে। এবার একটু সাহস করে ওনার দিকে এগিয়ে গেলাম। বললাম, ‘আপনি জানেন। জানেন, সব জানেন এইখানে ঋষি দীর্ঘতমা এসেছিলেন অনেককাল আগে। আর সেইখান থেকেই আপনি বেরিয়ে এলেন এখন। বলুন—কি ঘটেছিলো তারপর?' আমার কথা শুনে যেন অনেকদূর আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই আকাশকেই উদ্দেশ্য করে উনি খুব ক্লান্তস্বরে বললেন, ‘তারপর রানী সুদেষ্ণা গর্ভবতী হলেন, যথাসময় তাঁর পাঁচ পুত্রসন্তান হয়েছিলো যাঁরা পরবর্তীকালে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সূহ্ম নামে বিখ্যাত রাজা হয়ে পৃথিবীশাসন—' প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ওনার কথার মাঝখানেই বলে উঠলাম, ‘আমি দীর্ঘতমার কথা জানতে চাইছি—কি হোলো ওনার শেষ পর্যন্ত।' উনি কোনো উত্তর না দিয়ে পাথরের মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝলাম ওনার কোনো উত্তর দেওয়ার নেই। এইবার ওনার মুখটা ভালো করে লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম। সেই আবহাওয়াতেই মনে হোলো দেখতে পাচ্ছি একটা বিষণ্ণ বিধ্বস্ত কদাকার মুখ।

"এইবার প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করলাম, ‘তাহলে কি হোলো শেষ পর্যন্ত?' উনি কিরকম অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘তোমরা—তোমরা কেউ আমার কথা শুনলে না; আমি বলছিলাম ধর্মপথে থাকো, ধর্মপথে থাকলে সব আসে—অর্থ আসে, কাম আসে, মোক্ষ আসে যথাসময়—কিন্তু তোমরা কেউ শুনলে না।’ সেই কথাগুলিতে আর সেই দৃষ্টিতে আমার ভিতরটা যেন থরথর করে কেঁপে উঠলো। বুঝলাম উনি সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্ত। খুব সাবধানে আস্তে করে বললাম, 'আপনি কি বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন তো।' উনি আরেকবার গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। তারপর কেমন যেন একটা চাপা অথচ গভীর স্বরে বললেন, ‘বলবো, বলবো, সব বলবো—আমি সমস্ত ধর্মের কথা বলবো, অর্থের যাবতীয় বিষয়ে বলবো, আর কাম—কামেরও যা কিছু আছে সব বলবো।' আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। দেখলাম উনি মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছেন যেন বিড়বিড় করে কিসব বলতে বলতে—ওই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে, যেন নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে বোঝার মতো টানতে টানতে—কোথায় চলেছেন কে জানে। তখনই হঠাৎ মনে হোলো—হ্যাঁ চিনতে পেরেছি, চিনতে পেরেছি এইবার এই বৃদ্ধটিকে। ইনিই তো সেই ব্যক্তি যিনি কারো নির্দেশে তিন তিনজন নারীকে রমণ করে বেরিয়ে আসছেন মধ্যরাতে অন্ধকারে লোকচক্ষুর অন্তরালে—তাদের কি ভয়ঙ্কর গর্ভসঞ্চার করে চলে যাচ্ছেন এক বিশেষ বংশরক্ষার জন্য এক রক্তাক্ত ভবিষ্যতের জনক হয়ে—সেইজন্যেই যেন জগতের সমস্ত ক্লান্তি, ঘৃণা, আর বিতৃষ্ণা ফুটে উঠেছে তাঁর ওই বিকট মুখটিতে। ইনিই তো সেই কালপুরুষ, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস! ভাবতে ভাবতেই কোন অন্ধকারে কোন পথে যে উনি চলে গেলেন কে জানে। মনে হোলো যেতে তো তাকে হবেই—লিখতে হবে যে মানুষের যাবতীয় পরাজয়ের কথা—

"ঠিক তখনই হঠাৎ শুনতে পেলাম তাঁর কণ্ঠস্বর—‘সমস্ত মানুষকে প্রণাম জানিয়ে, বিশ্ববিধাতাকে প্রণাম জানিয়ে আর বাগ্‌দেবী সরস্বতীকে প্রণাম জানিয়ে ‘জয়’ কথাটা উচ্চারণ কোরো।’

"কিন্তু কোথায় তিনি? চারিদিকে তো কেউ কোত্থাও নেই। যেন বহুদূর থেকে ভেসে এসে মিলিয়ে গেলো তাঁর কণ্ঠস্বর। দূরে—যতো দূরে পারি ভালোভাবে লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, দেখতে পেলাম—দূরে, দেখা যাচ্ছে— সূর্য উঠছে, অন্ধকার পেরিয়ে—নতুন দিনের আলো—অমৃতসমান।"


এরপর চুপ করে গেলেন তিনি। কয়েকমুহূর্তের নি:স্তব্ধতার পর জিজ্ঞাসা করলাম, 'কিন্তু আপনি কে?'

উনি গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘না মানে যদি আপনার পরিচয়টা—' উনি স্মিত হেসে বললেন, ‘আমার নাম পুণ্যবান। আর তুমি?'

মাথা নীচু করে বললাম, ‘আমিই দীর্ঘতমা। উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। বললাম, ‘কেন? হতে পারি না? দীর্ঘতমা হয়ে বলতে পারি না নিজের কথা?' উনি আরো বিস্মিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘দীর্ঘতমা?' বললাম, ‘হ্যাঁ। দীর্ঘতমা, যার কথা কেউ বললো না কোনো দিন।’ আশ্চর্য শান্তভাবে আবার চোখে চোখ রেখে উনি বললেন, ‘অবশ্যই। অবশ্যই পারো। শুধু দীর্ঘতমা কেন? আরো যারা অন্ধকারে রয়ে গেল তাদের প্রত্যেকের কথাই বলতে পারো—নিজেকে সেই অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে লিখতে পারো—।' মুখ নীচু করে বললাম, ‘কি হবে লিখে? কেউ তো পড়বে না। শুনবে না।’ উনি নি:শব্দে এসে আমার পিঠে হাত রাখলেন। তারপর খুব আস্তে করে বললেন, ‘আমি তো শুনবো।’

শুনবেন? সত্যিই শুনবেন? ভাবতেই কিরকম লাগছিলো। হাতের সামনের সাদা কাগজটায় হঠাৎ লখে ফেললাম—‘শুনে পুণ্যবান।’ তারপর মুখ তুলে ওনাকে বলতে গেলাম—

—আরে! কেউ তো নেই কোথাও—
—ফাঁকা ঘরে আমি একা
—চেয়ারে বসে আছি
—সামনের পড়ার টেবিলে বইপত্তর

আর দিনের প্রথম আলো এসে পড়েছে আমার ঘরে, টেবিলে, সদ্যলেখা অক্ষরগুলির উপর।




(পরবাস-৬০, অগস্ট ২০১৫)