ISSN 1563-8685




মো ইয়ান—সাহিত্যের অথবা রাজনীতির নোবেল?

|| ১ ||

০১২ সালের ১১ই অক্টোবর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের তালিকায় যুক্ত হ’ল একটি নতুন নাম—চিনদেশের মো ইয়ান (জন্ম ১৯৫৫)। নোবেল কমিটি প্রেস-রিলিজে তাঁর বিষয়ে বললেন, “Who with hallucinatory realism merges folk tales, history and the contemporary...” নোবেল কমিটির সভাপতি পিটার আংলুন্ড (১৯৫৭-)-এর বক্তব্য আরও কাঠখোট্টা, “He has such a damn unique way of writing. If you read half a page of Mo Yan, you immediately recognise it as him.”

গত কয়েক দশকে নতুন নোবেল-প্রাপকের নাম ঘোষিত হলেই দুরকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। প্রথম প্রতিক্রিয়া—“সে কী! তার মানে ইনি এত দিন নোবেল পুরস্কার পাননি!” উদাহরণ, ইউজেনিও মনতালে (১৯৭৩) বিদ্যাধর নৈপাল (২০০১), মারিও বার্গাস য়োসা (২০১০) অথবা টোমাস ট্রানস্‌ট্রোমার (২০১১)। অন্য প্রতিক্রিয়া, “ইনি আবার কে? নামই শুনিনি কোনোদিন!” উদাহরণ, গাও শিন জিয়ান (২০০০), এলফ্রিডা ইয়েলিনেক (২০০৪) অথবা হের্টা ম্যুলার (২০০৯)। মো লেখক হিসেবে এই দুই তালিকার কোনোটাতেই ঠিক পড়েন না; তাঁর নোবেলযোগ্যতা নিয়ে সমালোচকদের মনে সতেজ সন্দেহ বর্তমান, কিন্তু তাঁর নামটি অচেনা নয়। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও গল্প সংকলনের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিমে। তাঁর রচিত কাহিনি অবলম্বনে ঝাং ইমৌ পরিচালিত চিনে ভাষার “লাল বাজরা” চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৮৭ সালে, বিদেশে প্রদর্শিত হয়ে তার ভাগ্যে জোটে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং ১৯৮৮ সালে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির স্বর্ণভল্লুক পুরষ্কারটি পায়। মার্কিন চলচ্চিত্র সমালোচক রজার ইবার্ট (১৯৪২–২০১৩) শিকাগো সান-টাইমস সংবাদপত্রে ছবিটির বিষয়ে লিখেছিলেন, “There is a strength in the simplicity of this story, in the almost fairy-tale quality of its images and the shocking suddenness of its violence, that Hollywood in its sophistication has lost.”

মো ইয়ানের বিরুদ্ধে সমালোচনার প্রধান কারণ দুটি; প্রথম, তাঁর রচনার সাহিত্যমূল্য। চিনে ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপিকা আনা সানের মতে মো এর রচনা “স্থূল”, “পূর্ব-নির্ধারণযোগ্য”, এবং “নন্দনতাত্ত্বিকতায় অগভীর”; তিনি লেখেন, “Mo Yan’s language is striking indeed, because it is diseased. The disease is caused by the renunciation of China’s cultural past.......” দ্বিতীয় কারণটি হ’ল তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান—অথবা দৃঢ় ও গভীর রাজনৈতিক মতামতের অভাব। তিনি মাও জে দং অথবা চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কোনোরকম তীব্র সমালোচনা করতে গররাজি। সতীর্থ কবি এবং গণতান্ত্রিক মানবতাবাদের কর্মী জেলখানায় বন্দী লিউ জিয়াও বো’র মুক্তির দাবীতে রচিত সন্দর্ভে তিনি স্বাক্ষর করেননি। চিনের রাজনৈতিক পটভূমিতে তাঁর ভূমিকা নীরব দর্শকের। তাঁর মতে, “For a writer, the best way to speak is writing. You will find everything I need to say in my work. Speech is carried off by the wind; the written word can never be obliterated.”

|| ২ ||

মো ইয়ান-এর জন্ম ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫, চিনের পূর্বউপকূলবর্তী শানডং প্রদেশের গাওমি জেলার একটি গ্রামে যেখানে হলুদ নদী (হোয়াংহো) মিশেছে প্রশান্ত মহাসাগরে। গ্রামটির নাম দালান, পরিবারটি কৃষক— কিন্তু বাবার অক্ষর-পরিচয় ছিল। তিনি ছেলেকেও লেখাপড়া শিখতে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। “ডাম্পলিং”—মাংস এবং সবজির পুর দিয়ে ভরা ময়দার পিঠে—চিনের মহার্ঘ্য খাবার। গ্রামের চাষি পরিবার গরীব—ডাম্পলিং খাওয়া জোটে কেবল নববর্ষের উৎসবের সময় দুয়েক বার, আর সারা বছরে কখনও নয়। মো বন্ধুদের মুখে শুনলেন, যাঁরা লেখক তাঁরা শহরে এমন সুখে থাকেন প্রতিদিনে তিনবার ডাম্পলিং খেতেও তাঁদের কোনো অসুবিধে নেই। তখন সেই অল্প বয়েসেই তিনি স্থির করলেন যে বই লিখবেন। অনেক লেখক বলেন—আমি লিখি সমাজটাকে পাল্টে দেব বলে; কেউ বলতে চান—আমি সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের মনে নতুন রূপ দিতে চাই। মো ইয়ান কিন্তু তা নন—নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঠিক পরেই এক সাক্ষাৎকারে তিনি সোজাসুজি বলেন—আমি লিখতে শুরু করেছিলাম পেট ভরে ভালো-মন্দ খাবার খাব বলে।

লেখকের আসল নাম গুয়ান মোয়ি; কথা বলতে শেখার পর থেকেই বকবক করা তাঁর স্বভাব—অভিভাবকেরা বিরক্ত হয়ে বলতেন, “মো ইয়ান” অর্থাৎ “চুপ করো;” লেখকের বয়েস যখন এগারো, দেশ জুড়ে শুরু হ’ল সাংস্কৃতিক বিপ্লব—তার বিরুদ্ধে মুখ খুললেই সমূহ বিপদ—মা-বাবা বার বার সাবধান করতেন ছেলেকে মুখ ফসকে বিপজ্জনক কিছু বলে না ফেলার জন্যে। তাই যখন তিনি লিখতে শুরু করলেন—নিজের নাম “মোয়ি”-এর চিনে অক্ষরটিকে লম্বালম্বি ভেঙে দু-টুকরো করে নিলেন—বাঁদিকটি হয়ে দাঁড়াল “মো” এবং ডানদিকটি “ইয়ান”—নতুন নাম “মো ইয়ান”। তাঁর লেখার বিষয় হবে চিনের রাজনৈতিক এবং যৌনজীবনের আবহমান ইতিহাস—অন্য লেখকেরা তখন অব্দি চুপ করে থেকেছেন যে বিষয়ে।

১৯৬৬ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনায় লেখক তাঁর স্কুল থেকে বিতাড়িত হলেন—তাঁকে জোর করে পাঠানো হল ক্ষেতমজুরের কাজ করতে; তারপর আঠের বছর বয়েসে এক সুতোর কারখানায়। অমানুষিক শারীরিক পরিশ্রম ছাড়াও তাঁকে পীড়া দিত সুসাহিত্য পড়তে না পারা— বদলে লভ্য কেবলমাত্র পার্টি-অনুমোদিত চিনে লেখকদের সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার কথাসাহিত্য। ১৯৭৬ সালে মাও-এর মৃত্যু এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সমাপ্তি, কিন্তু লেখককে নাম লেখাতে হল সেনাবাহিনীতে। মুক্তিফৌজের যোদ্ধা হিসেবে কাজের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিয়মিত সাহিত্যচর্চার শুরু।

১৯৭০ দশকের শেষভাগে অর্থনৈতিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক উদারীকরণের সূচনা হয় দেশে। লেখক সেনাবাহিনীর শিল্পচর্চার কেন্দ্রে যোগ দেন এবং মুক্তিফৌজের সাহিত্যপত্রিকায় প্রকাশ পায় তাঁর কয়েকটি ছোট গল্প। “স্বচ্ছ মুলো” নামে একটি নভেলা লিখে তিনি সেনাবাহিনীর সাহিত্য-পুরস্কার পান। তখন তাঁর প্রধান অনুপ্রেরণা চিনে লেখক লু শুনের (১৮৮১–১৯৩৬) সামাজিক বাস্তবতা এবং প্রাচীন চিনের লোককথায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের বর্ণনা। ১৯৮০-এর দশকে তিনি আবার ফিরে গেলেন লেখাপড়ার জগতে, নাম লেখালেন বেইজিং নর্মাল বিশ্ববিদ্যালয়ে; ১৯৯১ সালে সেখান থেকে সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রি। তার আগেই অবশ্য তিনি প্রতিষ্ঠিত লেখক।

বেশ কয়েকটি ছোটগল্প রচনা ও প্রকাশের পরে তিনি হাত দিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস রচনার কাজে। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হ’ল প্রথম উপন্যাস, “বসন্ত রাতের বৃষ্টিপাত”—গ্রন্থটির এখনও ইংরেজি অনুবাদ হয়নি, তাই বিশেষ কিছু জানা যায় না তার সম্বন্ধে। তিনি পড়তে শুরু করলেন বিদেশি সাহিত্য, বিশেষ করে মার্কিন লেখক উইলিয়াম ফকনার (১৮৯৭–১৯৬২); ফকনারের ইয়োক্‌নাপাটাওয়াফা কাউন্টির কৃষকদের জীবনযাত্রার পুনর্জন্ম ঘটলো গাওমি জেলার কৃষকদের জীবনে।

|| ৩ ||

মো ইয়ানের লেখক জীবন প্রথম থেকেই ফকনারের অনুগামী, কিন্তু ১৯৮৪ সালে ঘটলো আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা—প্রকাশিত হল গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর “শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা” উপন্যাসের প্রথম চিনে ভাষার অনুবাদ। গ্রন্থটি পরবর্তী দশকগুলোতে অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার করবে নতুন প্রজন্মের চিনে ভাষার কথাসাহিত্যিকের মধ্যে। যাদুবাস্তবতা, চিনে ভাষায় যার নাম '“বুম” সাহিত্য’, গড়ে তুলবে উপন্যাস সাহিত্যের নতুন সম্ভাবনা। গার্সিয়া মার্কেসের রচনা প্রচণ্ডভাবে আঘাত দিল মো ইয়ানের মননে। তিনি গভীর বিস্ময়ে উপলব্ধি করলেন এই জগৎ ও পরিবেশ তাঁর বিশেষভাবে পরিচিত। যাদুবাস্তবতা খুলে দিল নতুন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। তার সঙ্গে থাকলো ফকনারের ঘনপিনদ্ধ ভাষাভঙ্গি এবং দরিদ্র কৃষকের কঠিন, কঠোর, হাড়ভাঙা জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচিতি।

মিসিসিপির বদলে শানডং; মাকন্দোর বদলে গাওমি; একই রকমের লোকগাথা, একই রকমের অলৌকিক ঘটনাবলী; মানুষ, পশু, প্রকৃতি এবং অপ্রাকৃতিক অস্তিত্বের নতুন অর্থবোধ ও ভাষা—গড়ে উঠতে লাগলো মো ইয়ানের মহান উপন্যাস; “লাল বাজরার বংশ” নামে পাঁচখণ্ডে প্রকাশিত হ’ল ১৯৮৭ সালে; ১৯৯৩ সালে ইংরেজি অনুবাদে উপন্যাসটির নাম “Red Sorghum Clan”। পরপর পাঁচটি খণ্ড—১) “বাজরার মদ”, ২) “বাজরার অন্ত্যেষ্টি”, ৩) “সারমেয় পথ”, ৪) “উদ্ভট ও মৃত”, ৫) “লাল বাজরা”। প্রথম ও পঞ্চম খণ্ডটি মিলে উচ্চ-প্রশংসিত “লাল বাজরা” চলচ্চিত্র। গ্রন্থটি ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত শান ডং পরিবারের আখ্যান—তার পাশাপাশি ইতিহাসের ঘনঘটা—জাপানি আক্রমণ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, কমিউনিস্ট বিপ্লব এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব যা ঘটছে, যা ঘটেনি এবং যা ঘটতে পারতো। বাজরা দিয়ে খাবার বানিয়ে শরীর রক্ষা, বাজরা দিয়ে মদ বানিয়ে শরীরী বিলাস—বাজরা তাঁদের জীবনযাত্রার কেন্দ্রস্থল। আর রয়েছে মৃত্যু—জাপানি সৈন্যদের হাতে শোচনীয় মৃত্যু, দলীয় সংঘর্ষে মৃত্যু, পাগল কুকুর লেলিয়ে দেওয়ায় মৃত্যু, খুন ও আত্মহত্যা, দুর্ভিক্ষে অথবা প্রবল শৈত্যে মৃত্যু—মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই নেই এই উপন্যাসে।

পরবর্তী উপন্যাস “রসুন-গীতিকা” প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে; “The Garlic Ballads” নামে ইংরেজি অনুবাদ ১৯৯৫ সালে; গ্রন্থটি রচিত সত্য ঘটনা অবলম্বনে এবং চিনের সরকার গ্রন্থটিকে নিষিদ্ধ করেছেন। গাওমি অঞ্চলের কৃষকেরা এই উপন্যাসের কুশীলব; কমিউনিস্ট সরকার থেকে ফতোয়া জারী করা হয়েছে তাঁরা তাঁদের ক্ষেতে একটি মাত্র ফসলই ফলাতে অনুমতি পাবেন এবং তা হ’ল রসুন। কিন্তু ফসল ফললো প্রচুর, সরকারি গুদামগুলি ভ’রে গেল অল্প সময়ে এবং কর্তৃপক্ষ বন্ধ করলেন চাষীদের ফসল কেনা। সরকারি আমলারাও নিরক্ষর চাষীদের সাহায্য দেবার নাম করে ভরিয়ে ফেললেন নিজেদের পকেট। শুরু হ’ল চাষীদের স্বত:স্ফূর্ত প্রতিবাদ, আন্দোলন ও দাঙ্গাহাঙ্গামা। ক্ষুদ্র, সমবেত মানুষদের সঙ্গে বৃহৎ শক্তিশালী সরকার, পার্টি ও সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ।

মার্কিন সমালোচকরা গ্রন্থটির তুলনা করেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিকায় জোসেফ হেলার (১৯২৩-১৯৯৯) রচিত এবং ১৯৬১ সালে প্রকাশিত “উভয় সংকট” (“Catch–22”) উপন্যাসের সঙ্গে। মানুষের তৈরি করা সমস্যা, যার সমাধান করতে গেলে সরকারি আইন ভাঙতে হবে অর্থাৎ বেআইনী কাজ করতে হবে—মানব জীবনের সেই চিরন্তন সমস্যা। রাজনৈতিক আখ্যানের পাশাপাশি রয়েছে একটি প্রেম কাহিনি— উত্তরপূর্ব গ্রাম্য চিনের রুক্ষ মধুর প্রকৃতির পটভূমিতে। সেই প্রেমের প্রকাশভঙ্গিতেও রসুনের গন্ধ—“A surge of hot air floated up from her stomach, bestowing on Gao Ma the taste of garlic and fresh grass.”

|| ৪ ||

চিনের সরকার মো ইয়ানের উপন্যাসাটি নিষিদ্ধ করলেও ক্রমশ: বুঝতে পারলেন যে লেখকের কোনো রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নেই। ১৯৮১ সালে ৪ঠা জুন তিয়েন-আন-মেন চত্বরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদে মুখর হলেন চিনের লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবিরা, কিন্তু নীরব থাকলেন মো। তাঁর ছদ্মনামটি-ই তাঁর আদর্শ—তাঁর কাজ কথা বলা নয় লিখে যাওয়া। নিন্দুকেরা বলেন যে তিনি নীরব থাকেন আত্মরক্ষা ও স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। কিন্তু সারা পৃথিবীতে অনেক নামকরা লেখকই তো রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় নন অথবা প্রতিবাদ করতে অনাগ্রহী।

এই বিষয়ের দ্বৈতমানটি (double standard) লক্ষ করার মত। ভ্লাদিমির নবোকভ ভিয়েতনামে মার্কিন বোমাবর্ষণের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন—তার ফলে তাঁর সুনাম ও সাহিত্যকীর্তির এতটুকু ক্ষতি হয়নি। সল বেলো ঘৃণা করতেন প্যালেস্টিনিয় মুসলমানদের এবং সমর্থন করেছেন ওয়েস্ট ব্যাংক-এ ইস্রায়েলি অবৈধ অধিকার ও উপনিবেশ। তাঁর সাহিত্যের আলোচনার সময় কেউ উল্লেখও করেন না সেই কথা। সাম্প্রতিককালে অনেক মার্কিন এবং ব্রিটিশ লেখক নীরব অথবা সরব সমর্থন জানিয়েছেন জর্জ বুশের ইরাক আক্রমণের। মো ইয়ানের বিষয়েও আলোচনা হওয়া উচিত তাঁর রচনার সাহিত্যমূল্য নিয়ে।

ফিরে আসি তাঁর উপন্যাসের আলোচনায়। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হ’ল তাঁর উত্তর-আধুনিক গোয়েন্দা কাহিনি, “মদ প্রজাতন্ত্র”; ২০০০ সালে তার ইংরেজি অনুবাদ “The Republic of Wine” নামে। গ্রন্থটি গোয়েন্দা গল্প অথচ স্যাটায়ার আবার তার বিষয়বস্তু চিনের জীবনমাত্রায় খাদ্য ও পানীয়ের গভীর ভূমিকা; সরকারী দুর্নীতি ও অমিতাচার—যার ফলে সরকারি কর্মচারীদের নৈতিক অধ:পতন—তাঁর প্রতিটি রচনার মতনই এই উপন্যাসেও বিদ্যমান।

এই আখ্যানে রয়েছে দুটি সমান্তরাল কাহিনি প্রবাহ—একটি গোয়েন্দা গল্পের এবং অন্যটি চিঠিপত্রের—মো ইয়ান নামে এক কাল্পনিক লেখকের সঙ্গে লি ইডো নামে এক তরুণ কথাসাহিত্যিকের পত্র বিনিময়; রিলকের তরুণ কবিকে লেখা পত্রগুচ্ছের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। একটি চিঠির সঙ্গে লি যখন তাঁর সদ্য লেখা “অ্যালকোহল” নামক গল্পটি পাঠান সেটি হয়ে দাঁড়ায় উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের চতুর্থ অংশ। এখানে বলে রাখা ভালো যে তরুণ লেখকের নামের আক্ষরিক অর্থ, “এক পাত্তর লি”, তিনি বাস করেন মদ্যপ্রদেশে এবং সেখানকার চোলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি মদ্যবিদ্যায় পি এইচ ডি করেন। উপন্যাসের শেষ কয়েকটি পৃষ্ঠা জেমস জয়েসের “ইউলিসিস” উপন্যাসের অনুকরণে রচিত।

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর এখন পর্যন্ত জনপ্রিয়তম উপন্যাস, “স্ফীত বক্ষ এবং প্রশস্ত শ্রোণী”—বিংশ শতাব্দীর এক বড় অংশ ধরে মা এবং তাঁর আট মেয়ের কাহিনি। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় তার ইংরেজি অনুবাদ, “Big Breasts and Wide Hips” নামে। ৫৩২ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য—“If you like, you can skip my other novels, but you must read ‘Big Breasts and Wide Hips’. In it, I write about history, war, politics, hunger, religion, love and sex.’’ বর্তমান কালের চিন বিষয়ে গ্রন্থের একটি চরিত্রের মন্তব্য, “No more class, no more struggles. All anyone can see these days is money.’’ উপন্যাসটির চরিত্রের সঙ্গে চার্লস ডিকেন্সের প্রবাদপ্রতিম উপন্যাসগুলির মিল রয়েছে; ডিকেন্স যদি অলৌকিকভাবে বিংশ শতাব্দীর চিনদেশে জন্মাতেন, তিনি হয়ত এইভাবেই লিখতেন। গ্রন্থের যদি কোনো দোষ ধরতে হয় তা হ’ল নাটকীয়তার আধিক্য।

|| ৫ ||

ষষ্ঠ উপন্যাস “চন্দনকাঠের মৃত্যু” প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে; ইংরেজি অনুবাদ “Sandalwood Death” প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে, লেখকের নোবেল জয়ের অল্প কিছুদিন পরে। কাহিনির পটভূমি চিনের বক্সার বিদ্রোহ—১৮৯৯ থেকে ১৯০১ সাল—দু বছর ব্যাপী উত্তর-পূর্ব চিনের কৃষকদের বিদ্রোহ—বিদেশি ঔপনিবেশিক শক্তি এবং খ্রীষ্টধর্মী ধর্মপ্রচারকদের দ্বারা বলপূর্বক ধর্মান্তরের বিরুদ্ধে। এটি চিনের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ, যার ফলে বিদেশি শক্তিরা বুঝতে পারে দেশটিকে জোর করে দখল করা সম্ভব নয়। মার্ক টোয়েন এবং তলস্তয়ের মতন মহান লেখকেরা চিনের বক্সার যোদ্ধাদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রবন্ধ লেখেন।

গ্রন্থটি তিনখণ্ডে বিভক্ত একটি উপন্যাস অথবা ওই একই নামের একটি অপেরার তিনটি অংশ। ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন “This novel will not likely be a favourite of readers of Western literature, especially in the highbrow circles, but will be appreciated only by readers who have an affinity with the common man.” গল্পের প্রধান নারীচরিত্রের নাম সান মেই নিয়াং, যে খাবার রান্না করে বিক্রি করে গ্রামে গ্রামে—কুকুরের মাংস এবং ভুট্টার দানা থেকে তৈরি মদ। প্রাচীন ইয়োরোপের অপরাধী বা শত্রুকে ক্রুশে বিদ্ধ করার মতন চিনের চন্দনকাঠের মৃত্যু—অনেকক্ষণ সময় ধরে প্রচুর যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে মানুষকে হত্যা করা। কাহিনির এক জার্মান সামরিক অফিসারের জবানীতে, “Inflicting unberable pain on someone before killing him is a unique Chinese art and is at the core of its governing philosophy.” বলার অপেক্ষা রাখে না যে উপন্যাসটি সুখপাঠ্য নয়।

পরের উপন্যাসের নাম “জীবন ও মৃত্যু আমাকে জীর্ণ করে” (প্রকাশ ২০০৬) ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় ইংরেজি অনুবাদ “Life and Death Are Wearing Me Out.” এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের পটভূমি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ—শিমেন নাও শানডং প্রদেশের এক জনদরদী জমিদার—মাও জে দং পরিচালিত ভূমি-সংস্কার আন্দোলনে তাঁর সব জমি বাজেয়াপ্ত হয় এবং তাঁকে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। পরলোকে যমরাজ (হ্যাঁ, তিনিও এই কাহিনির অসংখ্য চরিত্রের একজন) তাঁর বিচার করেন এবং তাঁর পুনর্জন্ম ঘটে প্রথমে গাধা, তারপরে ষাঁড়, শুয়োর, কুকুর, বানর এবং সবশেষে আবার মানুষ হিসেবে; এবং প্রতি জন্মেই মানুষ অথবা পশুরূপে তাঁর রাজনৈতিক ভাষা বর্ণিত হয়। যমরাজের মুখে একটি ডায়ালগ, “Many people who deserve to die somehow live on while those who deserve to live die off.” বইটি পড়লে মনে হয় যে চিনে এখন লেখকদের নিজস্ব মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা বেড়েছে এবং চেয়ারম্যান মাও-এর অল্পসল্প সমালোচনা করতেও অসুবিধে নেই।

পরবর্তী দুটি উপন্যাস "পরিবর্তন" (প্রকাশ ২০১০) এবং "ব্যাং" (২০১১)— তাদের ইংরেজি অনুবাদ এখনও হয়নি এবং কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি বই দুটির বিষয়ে। লেখকের সাম্প্রতিকতম উপন্যাসের নাম “দুম!”-- ইংরেজি অনুবাদে “Pow!” (উভয়ের প্রকাশ ডিসেম্বর ২০১২; ইংরেজি সংস্করণের প্রকাশক কলকাতার সিগাল বুকস)। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু মাংস এবং কসাইখানা, তার সঙ্গে অবশ্যই লোভ, দারিদ্র, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যৌনতা। লেখক হিসেবে তিনি এবার জাতে উঠেছেন—মার্কেস, য়োসা, গ্রাস, কুন্দেরা অথবা মুরাকামির মতনই তাঁরও নতুন লেখা মাতৃভাষায় এবং ইংরেজিতে প্রকাশিত হচ্ছে একই সঙ্গে। উপন্যাসের নামটি বিস্ফোরণের শব্দ এবং উপন্যাসে বিস্ফোরণ ঘটে বেশ কয়েকবার। শাদা মাংসে ছুরি বসালে তা বেরিয়ে আসে রক্তে লাল হয়ে—মানব জীবনে এবং সাহিত্যে এর বেশি আর রয়েছে কী!

|| ৬ ||

চিনে সাহিত্যের গবেষক ও অধ্যাপক হাওয়ার্ড গোল্ডব্ল্যাটের (১৯৩৯-) বয়েস সত্তর পেরিয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে তিনি মার্কিন নৌবাহিনীতে নাম লেখান এবং সেই সূত্রে তাঁকে তাইওয়ানে বসবাস করতে হয় কয়েক বছর—সেখানে তিনি চিনে ভাষা শেখেন। আমেরিকায় ফিরে এসে তিনি চালিয়ে যান চিনে ভাষার চর্চা। ১৯৭৪ সালে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে; ২০০২ সাল থেকে তিনি অধ্যাপনা করছেন ইন্ডিয়ানা রাজ্যের নোট্‌র ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মো ইয়ানের রচনার প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ইংরেজি অনুবাদ—১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে রচিত ছ’টি মাঝারি ও বড়ো গল্পের সংকলন “বিস্ফোরণ এবং অন্যান্য গল্প”; হংকং এর চিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদ ও গবেষণা কেন্দ্র “উপস্থাপনা” (“Renditions”) নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন—তাঁরাই প্রকাশ করেছিলেন গ্রন্থটির; সম্পাদক—জ্যানিস উইকেরি। গল্পের অনুবাদ করেছিলেন জ্যানিস উইকেরি এবং ডানকান হিউইট। প্রকাশকাল ১৯৯১।

পরবর্তীকালে কিন্তু মো ইয়ানের একমাত্র ইংরেজি অনুবাদক হাওয়ার্ড গোল্ডব্ল্যাট—সাতটি উপন্যাস, একটি গল্প সংকলন এবং একটি স্মৃতিচারণ। ২০০৫ সালে মার্কিন কথাসাহিত্যিক জন আপডাইক লিখেছিলেন, “American translation of contemporary Chinese fiction appears to be the lonely province of one man, Howard Goldblatt.” হাওয়ার্ড এখন তাঁর অষ্টম মো ইয়ান উপন্যাসের অনুবাদে রত (২০১১ সালে প্রকাশিত “ব্যাং”)—চিনের “এক সন্তান” সংক্রান্ত নিয়মকানুন এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু; লেখকের এক পিসির পেশা ছিল দাইবৃত্তি এবং সরকারি আদেশে তাঁকে নিয়মিত গর্ভপাত করাতে হত সন্তানের জন্ম দেবার বদলে—তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই উপন্যাসটি রচিত।

১৯৮৫ সালে হাওয়ার্ড যখন চিনের মান্‌চুরিয়া প্রদেশের হার্ডিন শহরে এক বছরের জন্যে বসবাস করছেন—তাঁর গবেষণার বিষয় চিনের ওই প্রদেশটি জাপানের অধিকারে থাকার সময়ে সেই অঞ্চলে রচিত কথাসাহিত্য—তখন তাঁর হাতে আসে “১৯৮৫ সালের চিনে কথাসাহিত্য” নামে একটি সংকলন। চিনে ভাষার গ্রন্থটিতে ছিল আটটি গল্প, তার মধ্যে একটির লেখক মো ইয়ান। চিনের সাহিত্য তখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রভাব থেকে বেরিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তাঁর নিজের জবানীতে—“Mo Yan’s was a terrific story, really unusual, quite revolutionary.” লেখকের নামটি তাঁর মনে রয়ে যায়। আমেরিকায় ফিরে আসার বছর দুই পরে তাঁর হংকং-নিবাসী এক বন্ধু তাঁকে পাঠান চিনে ভাষার এক সাহিত্য-ত্রৈমাসিক এবং তাতে রয়েছে পুরো ‘রসুন-গীতিকা’ উপন্যাসটি। “I was absolutely knocked out. I have never been so stunned by a piece of literature.” তিনি খোঁজ খবর করে মো ইয়ানকে চিঠি লিখে তাঁর মুগ্ধতা জানান এবং গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদের অনুমতি প্রার্থনা করেন। মো সানন্দে রাজি এবং সেই থেকে তাঁদের দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বের সূচনা।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেন—মো শৃঙ্খল-ধূমপায়ী এবং ধোঁয়ার প্রকোপ সহ্য করতে না পেরে হাওয়ার্ড বাধ্য হয়ে ধূমপান শুরু করেছেন। মো তাঁকে বলেন যে ইংরেজি ভাষার পাঠকেরা মো পড়ছেন না তাঁরা পড়ছেন গোল্ডব্ল্যাট এবং তাতে কোনো অসুবিধে নেই—“বইটির নামটি আমার, কপিরাইট আমার, বাকি সব কিছু আপনার।”

দস্তয়েভস্‌কি (১৮২১–১৮৮১) পেয়েছিলেন কন্‌স্ট্যান্‌স গার্নেট (১৮৬১ – ১৯৪৬)-কে; মার্কেস (১৯২৭-২০১৪) গ্রেগরি রাবাসা(১৯২২-)-কে; আমাদের সৌভাগ্য মো এবং গোল্ডব্ল্যাট এঁকে অন্যকে খুঁজে পেয়েছেন এবং তার ফলে ঋদ্ধ হয়েছেন পাঠক-পাঠিকা।

|| ৭ ||

যখন কোনো দেশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে প্রচুর উন্নতি করে, তখন দেখা যায় সেই দেশের একদিকে যেমন অলিম্পিকের পদক সংখ্যা বাড়ে, তেমনি বাড়ে নোবেল পুরস্কারের সংখ্যা। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সবচেয়ে বেশি দাপট ছিল ইয়োরোপের দেশগুলির এবং নোবেল পুরস্কার ছিল তাদের একচেটিয়া। সেই তুলনায় এশিয়া থেকে রবীন্দ্রনাথ (১৯১৩) এবং কাওয়াবাতা (১৯৬৮)--এর মধ্যে ৫৫ বছরের ব্যবধান। পরবর্তী ৩২ বছরেও মোটে চারজন এশিয়া অথবা আফ্রিকার লেখক—ওলি সোয়িংকা, নাগিব মাহফুজ, কেন্‌জাবুরো ওয়ে এবং গাও শিন জিয়ান। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আমেরিকার দাপট বাড়তে লাগলো পৃথিবীতে এবং সেই সঙ্গে নোবেল পুরস্কারের সংখ্যাও।

চিনের পটভূমিকায় গল্প উপন্যাস লিখে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন পার্ল এস বাক (১৮৯২-১৯৭৩) ১৯৩৮ সালে, কিন্তু সমসাময়িক চিনে ভাষার মহান লেখকেরা তা পাননি। আমরা বাঙালিরা যেমন ক্ষুব্ধ — শরৎচন্দ্র, তিন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যান্য লেখকদের নোবেল পুরস্কার না দেওয়া ভীষণ অন্যায়, চিনের বুদ্ধিজীবিরাও তেমনি বলেন তাঁদের যোগ্য লেখকদের কথা—লু শুন (১৮৮১-১৯৩৬), শেন কং ওয়েন (১৯০২-১৯৮৮), লাও শে (১৮৯৯-১৯৬৬) অথবা বা জিন (১৯০৮-২০০৫) এর কথা। ১৯৮০ এর দশক থেকে চিনে অর্থনৈতিক উদারীকরণের সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা হলেও কমে আসে সংস্কৃতির বাধা নিষেধ—সাহিত্য রচনা, সাহিত্য প্রকাশ, বিদেশি ভাষায় চিনে সাহিত্যের অনুবাদের সূচনা সেই সময়। সরকারি আমলারা বুঝতে পারেন যে নোবেল পেতে হ’লে ইয়োরোপ-আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রয়োজন। চিনে অনুষ্ঠিত হতে থাকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন; বিদেশে ভ্রমণ ও বক্তৃতা করতে আসেন চিনে লেখকরা; পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বইমেলায় চিনের সাড়ম্বর উপস্থিতি ঘটে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পঁচাত্তর বছরে যেখানে চিনে সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদের সংখ্যা মুষ্টিমেয়, সেখানে অন্তিম পঁচিশ বছরে অনূদিত হয়েছে প্রায় ১৮০টি গ্রন্থ। গত দুদশকে চিনের এই নোবেল প্রচেষ্টা এবং নোবেল সচেতনতা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে—আলোচকদের মতে চিনের সরকারি এবং বুদ্ধিজীবী মহলে জন্ম নিয়েছে এক “নোবেল গূঢ়ৈষা” অথবা “নোবেল কমপ্লেক্স”; লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিনে সাহিত্যের অধ্যাপক জুলিয়া লোভেল (১৯৭৫-) এই বিষয়ে লিখেছেন আস্ত একটি গ্রন্থ। ২০০০ সালে নোবেল পেলেন চিনে ভাষার ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার গাও শিন জিয়াং (১৯৪০-), কিন্তু তিনি বাস করেন প্যারিসে, ফ্রান্সের নাগরিক, চিনে সরকার ও পার্টির তীব্র সমালোচক—তাঁর পুরস্কারে কর্তৃপক্ষের ক্ষোভ ও হতাশা আরও বাড়লো। ২০১০ সালে চিনের কবি ও মানবাধিকার কর্মী লিউ জিয়াওনো (১৯৫৫-)-এর নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তিতে ঘটলো অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। বেজিংএ নরওয়ের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র দপ্তরে ডেকে এনে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হ’ল—পুরস্কারের সংবাদটিও জানলেন না চিনের সাধারণ মানুষ — কড়া সেনসারের জন্য।

মো ইয়ানই চিনের প্রথম সরকার অনুমোদিত নোবেলজয়ী সাহিত্যিক। ন’জন সদস্যবিশিষ্ট চিনের পলিটব্যুরোর সদস্য লি চ্যাংচুন সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিনন্দন বার্তা পাঠালেন চিনের লেখক সংঘকে—মো ইয়ান আবার তার সহ-সভাপতি। সংবাদপত্রে, টিভিতে, ইন্টারনেটে উল্লাস— এক জন মূল ধারার চিনে সাহিত্যিক নোবেল পেয়েছেন। পুরস্কারটি— “Not only an embodiment of the flourishing progress of Chinese literature, but also an embodiment, the continuing rise in the overall strength of our state, and its international influence.”

এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার ঘোষণা করলেন মো ইয়ানের জন্মস্থান গাওমি গ্রামে ১১০ মিলিয়ন ডলার খরচা করে “মো ইয়ান সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা কেন্দ্র” গড়ে তোলা হবে।

মো ইয়ানের নোবেল জয় বিষয়ে দুটি উল্লেখযোগ্য উক্তি—প্রথমটি হাস্যরসিক ওয়াং জিয়াও হং এর লেখা—মি: আলফ্রেড নোবেল তার কবরের মধ্যে ছটফট করছেন আর বলছেন—“Two years ago my people gave prize to a Chinese and in doing so offended the Chinese government. Today they gave another prize to a Chinese and in doing so offended the Chinese people. My goodness, the whole of China offended in only two years!” দ্বিতীয় উক্তি তাঁর বন্ধু ও অনুবাদক হাওয়ার্ড গোল্ডব্ল্যাট-এর “Like everyone else writing in China, he knows the rules and the rules are flexible enough that he can write about anything so long as he doesn’t touch the three T’s: Tibet, Taiwan, and the Tian-an-men.”

নোবেল কমিটির কী কোনো দিকবদল ঘটেছে—তাঁরা কি উন্নতিশীল দেশগুলির দিকে নজর দেবেন এর পরে? না কি মো ইয়ান এক বিরল ঘটনা? একমাত্র ভবিষ্যতই এর উত্তর দিতে পারে। এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয় তার উত্তর; পরের দুবছরে সাহিত্যের নোবেল গেয়েছেন কানাডা এবং ফ্রান্সের লেখকেরা।

তথ্য সূত্র:
—“The Politics of Cultural Capital—China’s Quest for a Nobel prize in Literature”—Julia Lovell; University Of Hawaii Press, USA; 2006.

—“The writer Mo Yan as I know Him”—Liu Yiran: Chinese Literature, Winter 1989 issue.

—“If China has a Kafka, it may be Mo Yan. Like Kafka, Mo has the ability to examine his society through a variety of lenses, creating fanciful, metamorphosis-like trasformations or evoking the numbing bureaucracy and casual cruelty of modern governments.” —পাবলিশার্স উইক্‌লি




(পরবাস-৬০, অগস্ট ২০১৫)