Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে শ্রেয়সী চক্রবর্তীর
লেখা




ISSN 1563-8685




দূর এসেছিল কাছে…


|| ৬ ||

তবে উজ্জ্বলতর করো দীপ…


“দূর এসেছিল কাছে/ ফুরাইলে দিন দূরে চলে গিয়ে/ আরো সে নিকটে আছে” …

এই দূরের স্বপ্ন কাছে আসার কাণ্ডারি বিদ্রোহিণী-অবিদ্রোহিণী মেয়েদের কথা কালের মাত্রায় স্বাধীনতার ছাপ-তিলক এঁকে দিয়েছে। গত কয়েকটি সংখ্যায় সে ইতিহাস আমরা ছুঁয়ে এসেছি। ফেলে আসা যুগের দুঃস্বপ্নের পর অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এবারে আমাদের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সময়ের মন্দমধুর হাওয়ায় গা ভাসালে ভ্রমণ-রসাস্বাদের উপভোগ্যতা একটা ক্রমপরিণতির সন্ধান পায় এ তথ্য এবং সত্য অনস্বীকার্য। তাই এই সংখ্যায় একালিনীর ভ্রমণ মানচিত্রের বিবর্তনের পথ ধরে সেকালিনীদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের ঘুরপথ-প্রয়াস।

বলা বাহুল্য একালিনীরা অনেকেই ভ্রমণে সিদ্ধি এবং প্রসিদ্ধি দুই-ই লাভ করেছেন। সে বিষয়ে বাঙালিদের মধ্যে নবনীতা দেবসেন চলতা-ফিরতা লেজেন্ড। তাঁর ভ্রমণ তাঁর কর্মকাণ্ডের বিশালতার মতই অবিস্মরণীয়। একদম একা নারীর ভ্রমণ অন্তত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালির জীবনে তাঁর হাত ধরেই সূচিত হয়েছিল। মশালবাহিনী নবনীতাকে বাদ দিয়ে কোনো ভ্রমণ-আড্ডারই মধুরেণ সমাপয়েৎ অসম্ভব। কেমন করে ভূতের রাজার (থুড়ি, এখানে রানীর) জুতোয় পা গলিয়ে যেখানে-সেখানে, যখন-তখন ইচ্ছামতন ঘুরতে চলে যাওয়া যায় তার সাক্ষাৎ নিদর্শন যুবতী নবনীতার কালজয়ী ভ্রমণের ডায়েরি, “করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে” (প্রথম প্রকাশঃ ১৯৭৭, 'দেশ' শারদীয়া সংখ্যা)। কেমন করে হায়দ্রাবাদের ন্যাশনাল সেমিনার চোখ খুলে দেখা স্বপ্নের আলোছায়ায় এলাহাবাদের কুম্ভমেলায় বদলে গেলো সেই জাদুদণ্ডের নাম “করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে”। আর মাননীয় পাঠকবর্গ সে কথা সম্পূর্ণ অবহিত বলেই আমার বিশ্বাস। তাই নবনীতার লেখা নিয়ে চর্বিত চর্বণের ভার আপনাদের পড়তে (আসলে গিলতে) বাধ্য করে আমি মোটেও দুর্নামমাহাত্ম্যে খ্যাত হতে চাই না। শুধু মেয়েদের ভ্রমণ প্রসঙ্গে এই ধরতাইটুকুই নবনীতার লেখা থেকে ধরিয়ে দিতে চাই যখন তিনি বলেন, “গেছি তো গেছি। বেশ করেছি। পাপকার্যে নিরত তো হইনি। গেছি পুণ্যকর্মেই। তাতেও এত কথা? কোথায় তীর্থ করে এলাম আমাকে যত্ন করে পা ধুইয়ে দেবার কথা, তা নয়, ফিরে অবধি আপাদমস্তক আড়ং ধোলাই চলছে। এর চেয়ে বাপু পাপটাপ করা অনেক সোজা হতো। প্রথমত, লোকে জানতেও পারত না। দ্বিতীয়ত, যদি বা জেনে ফেলত কেউ কৈফিয়ত চাইতো না, কেননা ওটা সবাই বোঝে। ... ” ১৯৭৯ সালের শিক্ষিত বাঙালির ঘরে-বাইরে নবনীতাকে নিয়ে এতাবৎ চর্চা এবং তার ফলশ্রুতি থেকে স্বাধীন চিন্তার নির্যাস (এ স্বাধীনতা কায়িক ও মানসিক দুয়েরই) বইবন্দী হয়ে সমাজের সব স্তরে না হলেও কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষকে চিরকালের জন্য অনুপ্রেরণায় ঋদ্ধ করেছিল এ কথা অনায়াসে বলা যায়। কারুর উপর বিন্দুমাত্র নির্ভর না করে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাঠ দিয়েছেন নবনীতা তাঁর ভ্রমণ লেখার ছত্রে ছত্রে। সে লেখনীতে স্বাধীনতার নবলব্ধ আস্বাদ উদ্‌যাপনের আনন্দ অবর্ণনীয়। তাই ভ্রমণ শেষে সকলের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বাড়ি ফিরে এসে মা এবং মেয়েদের কাছে নবনীতার সগর্ব ঘোষণা, তীর্থে গিয়ে আমার দুজন বাবা হয়েছেন, এবং চমৎকার একটা ছেলেও হয়েছে আমার!! আসলে ধুলোয় মাটিতে লেগে থাকা সম্পর্কগুলোর মায়া নবনীতা বাক্স ভরে এনেছেন কলকাতা শহর পর্যন্ত আর তারপর পাঠকের পঠনের ওমে সেঁকে নিয়ে মুচমুচে স্মৃতিময় সুস্বাদ ছড়িয়ে দিয়েছেন বাঙালিয়ানার বৈঠকখানায়। আসলে নবনীতা চিরকাল সম্পর্কের কাঙাল। তিনি একা একাই বেরিয়ে পড়েন। তাঁর মনের গভীরেই বাস করে আরেক বৈরাগী মন যাকে তিনি অন্তত একটি বছর সংসারকৃত্য থেকে সরিয়ে সৌন্দর্যের আরাধনায়, স্পিরিচুয়ালিজ্‌মের উপভোগ্যতায় নিমজ্জিত করতে চান। অথবা কখনো সঙ্গী হয় তাঁর সন্তানেরা কিম্বা পাতানো ভাইবোনের দল। তবু নবনীতা অন্যত্র লিখেছেন কারুর জীবনে প্রথম নাম হয়ে ওঠার গুরুত্ব তাঁর কাছে কতখানি, কতখানি আনন্দের স্বাদ সেই সম্পর্কের সঙ্গে ভ্রমণে কিম্বা কতখানি একাকিত্বের খরতৃষ্ণা নিবারিত হতে পারে সেই নবনীতাকে জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ, সবার প্রথমে ভাবতে পারা মানুষটির হৃৎকমল-স্পর্শে। (“হে পূর্ণ তব চরণের কাছে”) তবু সেই জলের মতন একাকী মন নিয়েই নবনীতা ভ্রমণ করে ফেললেন আবিশ্বপৃথিবী। হাঁপানি, বাত, গলার কষ্ট, চোখের সমস্যা এবং এবম্বিধ আরও নানান নিগড়কে হেলায় তুচ্ছ করে নবনীতা বেরিয়ে পড়েছেন বারে বারে, আর সঙ্গে ট্যাঁকে গুজে নিয়ে চলেছেন সাধারণ আটপৌরে বাঙালি সমাজের কুসংস্কার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার উস্কানি, যা বইয়ের পাতা থেকে জীবন্ত হাতছানি দেয় মেয়েদের, মায়েদের, মায়ের মায়েদের… মানব সভ্যতার একটা বড় অংশকে। লেডি অবলা বসু তাঁর একটি ভ্রমণকথায় লিখেছিলেন পাশ্চাত্যে ছোট থেকে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে পৃথিবী বেড়ানোর তালিম দেওয়া হয়, সেখানে কোনো ভেদবুদ্ধি কাজ করে না। আর আধুনিক সময়ে সেই মননশীল কাজটি দায়িত্ব নিয়ে সম্পাদন করলেন নবনীতা দেবসেন, কারুর মা হয়ে, কারুর মেয়ে হয়ে, কারুর বা শুধুই ভ্রমণসঙ্গী হয়ে ‘আমিত্বের’ চেতনায় আঘাত করলেন। জ্বলে উঠল আলো। আর তারপর সেই অকম্প্র মশালের শিখা ক্রমেই উস্কে দিয়ে তাকে উৎসবের আতসবাজির রোশনাইয়ে পরিণত করেছেন প্রীতি সান্যাল, সুদীপ্তা সেনগুপ্তের দল। এবং এখানেই শেষ নয়।

আজ আরও বলব তেমনি এক অনন্যা আধুনিকার কথা, যাঁর ভ্রমণকে মণ্ডিত করেছে শিল্পদৃষ্টির দুর্লভ বাসনা। উমা সিদ্ধান্ত (জন্ম ১৯৩৩)। প্রখ্যাত ভাস্কর। জীবন সায়াহ্নে ভ্রমণ করেছেন (বলা ভালো ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছেন) শিল্পী য়ুরোপের মানস-অলিন্দে। সঙ্গী চিত্রকলা এবং শিল্পকলা বিষয়ক আরেক উজ্জ্বল বিশেষজ্ঞ সহপাঠী বন্ধু বিশ্বরাজ মেহ্‌রা। উমার করা ভাস্কর্যের মতই উমার লেখা বই ‘ইউরোপের ডায়েরি’তে সহজ করে বলা কথা আর শিল্প ও শিল্পীর একান্ত আলাপচারিতা অত্যন্ত বিশেষত্বপূর্ণ। সমস্ত বই জুড়ে উমা ভারি কোমল। স্বচ্ছন্দ তাঁর চলন। এমনকি কথামুখে বেড়াতে বেরনোর আগের কথাও বলেছেন তিনি। সে পথ এই নিত্যকার আধুনিকতার অভ্যাসের গণ্ডিতেও কোথাও যেন দৈনন্দিনতার বেড়া পেরিয়ে উঁকি দেয়নি। ভূমিকায় উমা নির্লিপ্ত স্বরে বলছেন, “মনের এক সুপ্ত বাসনা—নিজের দেশের শিল্পকলার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, আসল কাজগুলি কোনও কোনও সময় দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে। কিন্তু ঐ পাশ্চাত্যের বিখ্যাত কাজগুলি কি কোনও দিন সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হবে? দেখার এক তীব্র বাসনা। একবার সুযোগ এল। ফ্রেঞ্চ সরকারের স্কলারশিপে বাইরে যাওয়ার। কিন্তু বাড়ির থেকে আপত্তি এল। ছেলে তখনও খুব একটা বড় হয়নি। তাকে ছেড়ে যাওয়া উচিত নয়। ...’’ এ ঘটনা ৬ দশকের; কিন্তু অবশেষে যাওয়া হল (২০০২)। সেই বসন্ত এল নতুন শতাব্দীর মুক্তচিন্তার হাত ধরে। আর তারও ঠিক এক দশক পর (২০১২) লেখা বইয়ের পাতায় নেমে এলেন মিকেলেঞ্জেলো আর তাঁর পিয়েত্রা সান্তার মর্মর অধিবাস হাত ধরাধরি করে।

ভারি সুন্দর গল্প শুনিয়েছেন উমা ... “কার্ডিনাল জিউলিও মাইকেল অ্যাঞ্জেলোকে আদেশ করলেন মেদিচি বংশের নিজ গির্জা সান লোরেঞ্জোর বহির্ভাগ গড়ার জন্য। তার সঙ্গে আর যে কথা বললেন, পিয়েত্রা সান্তায় সব থেকে সেরা মর্মর পাওয়া যায় এবং কাজের জন্য সেখান থেকেই মর্মর আসবে। ...

“মাইকেল আঞ্জেলো বলেন—মান্যবর আমি শুনেছি, সত্যই ওখানে শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য মর্মর পাওয়া যায়। কিন্তু কোন রাস্তা নেই। ... সমতল থেকে এক মাইল উঁচু ওই শ্বেত মর্মরের জায়গা। সেখানে কেমন করে রাস্তা তৈরি হবে?

“রাস্তা তৈরি করতে হবে। যাও চেষ্টা করো। আবার সেই কঠোর আদেশ। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে উদ্‌ভ্রান্তের মতো রাস্তা হাঁটেন। যে মর্মরশিল্পী তাকে হতে হয়েছে চিত্রকর, ব্রোঞ্জ শিল্পী এবং বাস্তুকার। আর এখন হতে হবে খনিকার। ও জানে না ও নিজে কী। কিন্তু সেই সময়ের দেশের মান্যবররা জানতেন তার মধ্যে এক মহান শক্তি আছে। ...

“এই পিয়েত্রা সান্তাতেই শ্রেষ্ঠ শ্বেত মর্মরকে পাহাড়ের এক মাইল উঁচু থেকে নামিয়ে আনা সম্ভব করেছিলেন। তার কর্মকুশলতা ও অদম্য শক্তির কাছে শ্রমিকরা হার মেনে ছিল। .... এই মহান কীর্তির পিছনে শিল্পীর পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। পিয়েত্রা সান্তায় মাইকেল আঞ্জেলোর প্রথম পদার্পণ ২৭ শে এপ্রিল ১৪৩৫ সাল। বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। সেই বাড়িটারই এখন নাম ‘বার মাইকেল আঞ্জেলো’।...”

তবে শুধু গল্পই নয় বাস্তবও উমার নজর কেড়ে নিয়েছে। মিলানে পৌঁছে লিখছেন, “শহরটা দেখলাম। মজা লাগল পুরানো ঝরঝরে ট্রাম। খোলা জায়গায় অসংখ্য পায়রা। বাচ্চারা হাতে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ... নতুন ট্রাম ও বাস দেখলাম। খুব সুন্দর আধুনিক ব্যবস্থা। পুরনো ও নতুনের সমন্বয় দেখলাম। মিলান পোশাকের ফ্যাশানের জন্য বিখ্যাত। রাস্তার ধারে ধারে পোশাকের শো-রুম। নতুন নতুন ডিজাইনের জামা কাপড়। সুন্দর করে সাজানো শো-কেসের পাশের দেওয়ালে ‘দেওয়াল লিখন’। আমরা ভাবি আমাদের দেশেই বুঝি লোকেরা দেওয়াল লিখে নোংরা করে। তা নয়, পাশ্চাত্যের অতি সভ্য নাগরিকরাও দেওয়াল লিখে নোংরা করে। ...”

ভ্রমণের শুরুতেই পিয়েত্রা সান্তা মাতাল করে তুলেছে প্রথম বাঙালিনী ভাস্করকে। বার মিকেলেঞ্জেলো থেকে মর্মর পাহাড়ের প্রাকৃতিক শোভা, পথপার্শ্বের ক্যাফে থেকে কাস্টিং ফাউণ্ড্রি দর্শনের সৌভাগ্য রোমকূপের গোড়ায় আনন্দের হিল্লোল তুলেছে উমার। সঙ্গে চলেছে য়ুরোপ ঘোরার প্রথম পর্যায়ে ইতালির বিখ্যাত স্থাপত্য এবং মিউজিয়াম দর্শনের আকুল তৃষ্ণার শান্তিবারি সেচন। এরই মধ্যে শিল্পীবন্ধুর ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া ভোজসভায় অভিজ্ঞ নারীদৃষ্টি সঞ্চালনের ফলে অর্জিত আধুনিক নারীর সংকট নিয়ে প্রত্যক্ষ অনুভূতি, “এখানে দেখলাম অনেকগুলো মেয়ে যাদের বয়স চল্লিশের কাছে বা তার ওপরে, তারা সবাই নিজেদের জীবন সম্বন্ধে অত্যন্ত হতাশ। তাদের অনেকেরই সঙ্গী আছে। হয়তো তারা বিয়ে করে ঘরও বাঁধতে চায়। কেউবা একত্রে বসবাস করছে এবং সন্তানও হয়েছে। কিন্তু এরা সবাই বিয়ে করতে ভয় পায়। নবীন প্রজন্মের মূল্যবোধ যে পালটে গেছে। এরা কিছু গড়তে ভয় পায়--- পাছে ভেঙে যায়।”

পিয়েত্রা সান্তার এই কটা দিন অতীতের সঙ্গে সহবাস করেছেন উমা। ধ্যানবোধিতার কলমে উঠে এসেছে তাঁর ভাষ্য, “এই ‘বার মাইকেল আঞ্জেলো’তে বসে রোজই কফি খেতাম। আর ভাবতাম কতযুগ আগের কথা। এই মহান শিল্পীকে আমি অনুভব করতে পারি সাহিত্যের গল্প গাথার মধ্যে দিয়ে, ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে। সেই ইতিহাসের গল্প কতটা সত্য কতটা কাল্পনিক জানি না। তবে সত্য উপলব্ধি করতে পারি তাঁর অমর শিল্প সৃষ্টির মধ্যে। তাঁর সব কিছু যন্ত্রণা বেদনা দুঃখ অপমানের গরল থেকে উঠেছে এই অমৃতের ধারা। কণ্টেসিনা ও ক্লারিসার পবিত্র ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে রচিত হল দুটি নারী মূর্তি ঊষা ও রাত্রি। পবিত্র কন্যা মূর্ত হল তাঁর ছেনি হাতুড়ি মর্মরের প্রতিকৃতিতে। তরুণী কন্যা পরিণত পরিশ্রান্তা জননী, স্নিগ্ধ ও শুদ্ধ—সেই হল রাত্রি। ঊষা গড়ে উঠল অর্ধচেতনার এক স্বপ্নময় সত্তার মধ্যে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ দিনের আলো ফোটার অপেক্ষায়। …’’ শুধু এই-ই নয়, লেখকের শিল্পীস্বরূপের অভিজ্ঞান সমস্ত বই, পাতার পর পাতা জুড়ে নবীন কিশোরী মেঘের মতোই লীলাচঞ্চল। অনাদ্যন্ত কালের গিয়াম্বোলগ্নার The Rape of the Sabine Women থেকে শুরু করে আধুনিক ভাস্কর ইগর মিটোরাজ এর কাজের শিল্প সৌকর্য তাঁকে মোহিত করেছে, ভাবিত করেছে। উমার মনে হয়েছে মিটোরাজের কাজের মধ্যে প্রবহমান আবহমানের ছন্দ, তবু তা আধুনিক, বলা ভালো সমসাময়িক। ভ্রমণকথার অন্দরে অন্দরে বুনে দিয়েছেন উমা রসবেত্তার হৃদয়সঞ্চার। একটি ভাস্কর্য সম্পর্কে বলছেন, “অত্যন্ত যত্ন সহকারে তৈরী সুঠাম সৌন্দর্যময়ী নারী মূর্তি, পরীও বলা যায়। কারণ পিঠে দুটি পাখনা আছে। অত্যন্ত সুন্দর মন্মোহিনী মুখখানি, মাথাটি কেটে তারই পায়ের কাছে অতি সন্তর্পণে রাখা আছে। কোনও এক পুরুষের বলিষ্ঠ হাত কব্জি পর্যন্ত মেয়েটির পা পিছন থেকে ধরে রেখেছে, যেন—যেতে নাহি দিব। মেয়েটির গোপন অঙ্গ এক পুরুষের মুখ। সর্বশেষ তার ডানাটির মধ্যে কাটা একটি জানালা এবং জানালার মধ্যে জ্বলজ্বলে এক পুরুষের মুখ। যেন কল্পনায়ও তোমাকে মুক্ত হতে দেব না।’’--- এ বিষয়ে অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

সমস্তক্ষণ চরকি পায়ে চক্কর দিয়েছেন উমা শুধু শিল্পের সান্নিধ্যে দিনগুলিকে কুসুমের মাসে পর্যবসিত করার জন্য। ইতালি-সুইট্‌জারল্যান্ড- নেদারল্যান্ড-প্যারিস-নিউ কাস্‌ল্‌-ক্রয়ডন সর্বত্রই উমার ভ্রমণের টান শিল্পকলা এবং ভাস্কর্যের টানে। সঙ্গে প্রখর সচেতন এক মন। আর আছে বন্ধুত্বের উষ্ণ নিদর্শন। আছে ইতালির ছোট্ট গ্রাম জোভানে থাকার সবুজ স্মৃতি। প্রগাঢ় শৈশবের মাধুর্য লেগে থাকা শেষ বিকেলের আলোয়, “এই বাড়ির আড়াই বছরের ছোট ছেলে ফ্র্যানচেস্‌কো তাদের ফ্ল্যাটের দরজাটা একটু ফাঁক করে বেরিয়ে এল। সিঁড়ির পাশে হয়ে থাকা বড় চেরিগুলোকে সে একবার দেখল, তার গায়ে হাত বোলাল। বড়দের মতো গাছের ধারে ধারে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। ছোট গাছে লেবু হয়ে আছে। তার গায়ে হাত বোলায়। ফুলের গন্ধ শোঁকে। ঘুরে ফিরে বড় গাছতলায় এসে দিব্যি উপুড় হয়ে বসে কাঠবেড়ালীর মত টুক টুক করে ছোট ছোট চেরী তুলছে, আর মুখে পুরছে। খানিকক্ষণ পর উঠে দাঁড়ালো, ফরসা গোলাপী গাল আর ঠোঁট চেরির রসে লাল হয়ে আছে। কি অপরূপ দেখতে লাগছে! এক স্বর্গীয় শিশু!”

এই ভ্রমণের কত না স্মৃতি, কতই না মজার পর্যবেক্ষণ, কত না বৈশিষ্ট্য। ইতালির কাস্টিং স্টুডিয়ো আর তাতে শিল্পীদের কাজের সুবিধে দেখে ভাস্কর উমার সে কি উচ্ছ্বাস উন্মাদনা। আবার রোদ-পোড়া চামড়ায় ব্রাউনিশ কালো রঙ যা উমার নিজের নিতান্তই না-পসন্দ তাই কিনা য়ুরোপীয় রমণীর মনে উদ্রেক করে পরম শ্লাঘা! মহাদেশ ভেদে রুচির এই পার্থক্য বাঙালি উমার কাছে খুবই অর্থবহ এবং মজাদার। কেননা কালা আদমির দারিদ্র্য অশিক্ষা বদঅভ্যাসে ভরা এককালীন উপনিবেশের প্রতি সাদা চামড়ার অসূয়া-বিদ্বেষ কিছুই ভারতবর্ষীয়া উমার চোখ থেকে মুছে যায়নি। তাই কোথাও কোথাও উমা তৃতীয় বিশ্বের স্বদেশের মানুষের মতই য়ুরোপীয় সভ্যতায় লালিত মানুষের আচরণ দেখে প্রশ্ন লুকিয়ে রাখেননি, তা সে সাদা চামড়া সোনালী চুল মানুষের রাস্তায় জলত্যাগের মতন যত ‘তুচ্ছ’ ঘটনাই হোক না কেন! সেই প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়েছে এমনকি তথাকথিত আধুনিক শিল্পকলার বিশ্লেষণেও। মিউজিয়াম বাইজম্যানস্‌-এ বিখ্যাত আমেরিকান শিল্পী প্রয়াত কিথ হারিং-এর কাজের প্রদর্শনী দেখে উমার প্রশ্ন জাগে, “শিশুদের নিয়েই বেশিরভাগ কাজ। আফ্রিকার লোকশিল্পের আভাস মেলে কাজের মধ্যে।এক একটা ছবির মাপ ২০-ফুটx৩০-ফুট। একটা জিনিস আমার কাছে অবাক লাগলো। শিশুদের নিয়েই যখন বেশির ভাগ কাজ, শিশুরা তো ফুলের মত পবিত্র। কিন্তু এই সব শিশুদের ছবির মধ্যে যৌনতার ইঙ্গিত কেন? ... ”

শিল্পী শুধুই শিল্পী নন, একজন সমকালীন মানুষ। আর সমকালের সঙ্গে তাঁর হৃদয় ও মস্তিষ্কের চলিষ্ণুতার নানান বর্ণময় উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে উমা সিদ্ধান্তের লেখায়। রেমব্রান্টের বাড়ি দেখা থেকে সমকামিতা সবরকম প্রসঙ্গেই তাঁর ভ্রমণকাহিনি ভরপুর। মধুর মিশেল দিয়েছে নারীমনের বিশেষ দৃষ্টিকোণ, “আমস্টারডাম টাউন হলেও দেখলাম অনেক পুরোনো ছবি। একটা ছবি তো ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস বলা যায়। বিষয়বস্তু মেয়েদের কতটুকু অধিকার ছিল সেই যুগে। একটি বিচারসভার দৃশ্য। একটি মেয়ে পাবলিক পানশালায় উপস্থিত হওয়ায় তাকে অপরাধী হিসাবে বিচার করা হচ্ছে। কারণ সেই যুগে মেয়েদের পানশালায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এমন এক প্রতিবাদী ছবি শহরের টাউন হলে রাখা আছে দেখে ভাল লাগলো।” পম্পিদু মিউজিয়ামে মডার্ন আর্ট সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছেন, “মডার্ন আর্টের নামে বর্তমানে কিছু ম্যাডনেস বা চূড়ান্ত পাগলামো চলছে সে ধরনের কাজও এখানে অনেক আছে। আস্ত একটা পিয়ানো কে চট দিয়ে মুড়ে তার গায়ে একটা রেডক্রসের চিহ্ন লাগানো বা আমাদের দেশে গড়িয়াহাটের মোড়ে ফুটপাথের দেওয়ালে যেমন অনেক রং বেরং-এর বিভিন্ন জামা কাপড় ঝোলানো থাকে বিক্রির জন্য ঠিক তেমনি ওখানে একটা ঘরের মধ্যে আলোর হেরফের করে কোথাও অল্প আলো কোথাও বেশি আলোর মধ্যে একই ভাবে বিভিন্ন রং-এর জামাকাপড় টাঙানো। এটাই একটা ইনস্টলেশন বা শিল্পীর ক্রিয়েশন।

“একটা দরজা তার অর্ধেকটা পর্দা টাঙানো, মাথা নিচু করে ঢুকে দেখলাম আমাদের দেশে পর্দার কাপড়ের যে নামকরা বড় বড় দোকান আছে তেমনি দোকানের মতো ঘর ভর্তি মোটা মোটা কাপড়ের বান্ডিলগুলি বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে রাখা আছে। এই হল আরেক শিল্পীর সৃজন।” তুলনা করছেন একই সংগ্রহশালায় রাখা বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী শিল্পীদের কাজের সঙ্গে, “আলেকজান্ডার (Calder Alexander, 1945) ক্যালডারের কাজ ‘বাগেন ভেলিয়া’ মোবাইল স্কাল্পচার রয়েছে। অ্যানটন (Pevsner Antoine) পেভসনার (১৯৫৯)-এর কাজ ভালো লাগে, কারণ এই সময়টা যারা নতুন কিছু করবো বা পরিবর্তন প্রয়োজন--এই মানসিকতার জন্য ছিলো তাদের কঠোর সাধনা। কর্মে নিপুণতা ছিল। রিয়ালিস্টিক কাজ তারা জানতেন তাই তারা গড়তে যেমন পারতেন সুন্দরভাবে, তেমনি ভেঙেও আবার গড়তে পেরেছেন সুন্দর ভাবে। সেখানে ক্রাফটস্‌ম্যানশিপ যে কতখানি উন্নত, সেটাই লক্ষণীয়।” মানব প্রজাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উমাকে ভাবিয়েছে আমস্টারডাম শিল্পশালার পোস্টার, ‘No More Art’.

উমা স্বামীর মৃত্যুর পর ভ্রমণ করেছেন য়ুরোপ। ততদিনে তিনিও বার্ধক্যের ছায়ায়। তবু তাঁর মননের মধু আদ্যোপান্ত বিস্ময়করী শাশ্বত। কেবলমাত্র সমকালীন নয়, তা চিরকালীন। আর তাঁর এই বিশেষ সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালি মেয়ের কলমে নতুন তো বটেই। আগামীর জন্য সযত্নরক্ষিত দীপদণ্ডের একটি শিখা হিসেবে তাঁর ভূমিকা কিছুতেই খাটো করে দেখার নয়। অলমিতি ।।

(শেষ)



(পরবাস-৬০, অগস্ট ২০১৫)