Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines





পরবাসে সুরমা ঘটকের
লেখা


ISSN 1563-8685




সাক্ষাৎকার—সুরমা ঘটক

প্র: আপনার ছোটোবেলার শিলং আর সিলেটের কথা কিছু বলুন—

উ: ওটা হলো আমাদের দুটো ছুটি হয় শিলং-এ। একটা হল পুজোর ছুটি। আর একটা হল শীতের ছুটি। ওখানে তো গ্রীষ্মের ছুটি নেই। দুটো ছুটি। পুজোর ছুটির সময় আমরা শিলং যেতাম। শিলং থেকে সিলেট হল ৮৬ মাইল। ৫৬ মাইল হল পাহাড়ী রাস্তা তার পরে একটা স্টেশন, ডাউকি নাম। তো সেখানে নদীর ওপর একটা ব্রিজ আছে। ব্রিজটা পেরোলেই সমতল আরম্ভ হয়।

প্র: নদীটার নাম মনে আছে?

উ: না। নামই জানি না। সমতল আরম্ভ হলে সোজা রাস্তা। মানে যে নিসর্গ বা ল্যান্ডস্কেপ এতক্ষণ ছিল, ধরো একদিকে পাহাড়, একদিকে ঝরণা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাস্তা, সেটা শেষ হয়ে গেল। তখন হল অন্য নিসর্গ, তারপরে সবকিছুই অন্যরকম। ৩০ মাইল পরে গিয়ে সিলেট শহর। সিলেট শহরে ঢুকে প্রথমেই টিলার ওপরে এম. সি. কলেজ। মুরারী চাঁদ কলেজ। খুব বিখ্যাত। সেইটা পেরিয়ে গিয়ে ৩ মাইল দূরে মীরা-বাজারে আমার দাদামশায়ের বিরাট বাড়ি ছিল। তো আমরা কিছুদিন ওখানে, ওই বাড়িতে থাকতাম। আমার দাদামশাই, দিদিমা, বড়মামা, মামিমা, ছোটমাসি সবাই ছিল, ওখানে থাকতাম। আর ওই বাড়িতেই একটা আলাদা ফ্ল্যাট। কিংবা একটা কটেজের মতো, সেখানে থাকতেন কবি অশোকবিজয় রাহা। আমরা মামাবাবু ডাকতাম। তিনি আর মামিমা ওখানে ভাড়া থাকতেন, দাদামশায়ের বাড়ির ভেতরে।

প্র: পরে তো উনি (অশোকবিজয় রাহা) বিশ্বভারতীতে পড়াতেন। শেষের দিকে?

উ: হ্যাঁ। তো দাদামশায়ের বাড়িতে বিরাট বাগান, পুকুর। কিছুদিন থেকে আমরা ট্রেনে করে ত্রিশ মাইল গিয়ে একটা স্টেশনে নামতাম। জংশন স্টেশন। কুলাউড়া নাম। ওখানে নেমে ৩ মাইল দূরে আমাদের গ্রাম। তো আমরা প্রথমে পাল্কী করে যেতাম। ওখানে প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে পুজো। পুজো হয়ে গেল। তারপরে আমরা আবার ট্রেনে করে যেতাম। আর একটা স্টেশন, সমশের নগর। ওখানে নেমে ৬ মাইল দূরে আমার দাদামশায়ের দেশের বাড়ি। ওখানে তখন ওই ৬ মাইল আমরা গরুর গাড়ি করে যেতাম। এগুলো স্বাধীনতার আগে। তারপরে তো আমরা বড় হতে আরম্ভ করলাম।

প্র: শিলং-এ কী আপনাদের রিল বং-এ বাড়ি ছিল?

উ: হ্যাঁ। সে স্মৃতি সাংঘাতিক। আমি সুরমা নদীর দেশে বইতে লিখেছি। ইতিহাসও লিখেছি। মামার বাড়িতে এরপরে আমরা আবার যেতাম শীতের ছুটিতে। শীতের ছুটিতে মামার দেশের বাড়িতে যেতাম না। সেখানে হতো মাঘমণ্ডল ব্রত। বোনেরা একদম কুয়াশায় ঢাকা পুকুরে চান করে এসে পুজোয় বসত। সমস্ত উঠোন-ভর্তি আলপনাকে বলে মণ্ডল। সেই মণ্ডল দিত। নানারকম রং দিয়ে। সব পুজো করত। তারপর আবার কি সব মাটি দিয়ে গোল গোল তৈরি জলের মধ্যে রেখে। আর এটা হল কামনার পুজো। আমি দিলাম গুড়ের চিরুনী, আমি যেন পাই সোনার চিরুনী। একটা কথার কথা বলছি। ঠিক এইরকম।

প্র: গীতগুলো ওখানে আছে ...

উ: গীত আছে, তারপর সূর্যব্রত। সূর্যব্রত হল ওই পুকুরে চান করে ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে ওই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণের স্তবগান করতে হবে। গীত গাইতে হবে। বসতে পারবে না। আর যে ঘি-এর প্রদীপ জ্বালাবে, ওটা জ্বলবে। তারপর যখন সন্ধ্যা হয়ে যাবে তখন ওই বসবে। বসে কাপড়-টাপড় ছেড়ে প্রসাদ-টসাদ খাবে। এই দুটো আমি দেখেছি। আর একটা হত মঙ্গলচণ্ডীর জাগরণ। মানে সমস্ত রাত্তির ধরে গীত গাইবে। কিন্তু ঘুমোতে পারবে না। এইরকম আর কি সব স্মৃতি। এটা হল সিলেটের। আর সিলেটের হল সুরমা নদী। আর আমাদের দেশের বাড়িতে প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে একটা করে পুকুর। পুকুর থেকে ঢুকেই ডানদিকে গিয়ে শিবের মন্দির। প্রত্যেক দিন সকালে ওই শিব পুজো হবে। তারপর ভেতরে গেলে, ভেতরে গিয়ে বৈঠকখানা, চণ্ডীমণ্ডপ সব কিছু। একদম ভেতরে আবার প্রতিদিন যে পুজোপাট। আমাদের হত শ্রীধর। আমার দেশের বাড়িতে। আর পুজোর সময় তো সব পুজো হচ্ছে আর গীত হচ্ছে। আর মামার বাড়িতে প্রতিদিন যে পুজো হত, সেই ঠাকুরের নাম হল, ওখানে তো দীঘি, নামটা আমি ভুলে গেছি। কিন্তু ওই ঠাকুরটা পরে আমার এক বোন পেয়েছে। ওটা হল বুদ্ধমূর্তি। ওটাই শ্রীকৃষ্ণ দশম অবতার বলে পুজো হত। আমার এখন নামটা মনে আসছে না।

প্র: তবে আমি রাঢ়বাংলাতে অনেক জায়গায় দেখেছি শিবের পুজো হয়। কিন্তু শিবের মূর্তিটা বুদ্ধের মূর্তির মতো।

উ: তাই নাকি?

প্র: হ্যাঁ, তাকে রুদ্রদেব বলে পুজো করা হয়, আর বৈশাখ মাসে তার অনুষ্ঠান হয়।

উ: আসলে আগে সব বৌদ্ধ ছিল। তার পরে হিন্দুরা এসে ওই বৌদ্ধদের ধ্বংস করেছে। ওটা পাওয়া গেছে দীঘিতে। দীঘিতে ওই মূর্তিটা, আর একটা জিনিস কি পাওয়া গেছে, সেটা মন্দির-টন্দির করে রাখা হয়েছে। আর মামার বাড়িতে বলার মতো দুটো জিনিস। একটা হল বাড়িতে মহিষ বলি হতো। আর একটা হল যে মামাবাড়িতে ডুকলা গোষ্ঠী ওরা সব লাইন করে খেতে আসত। তো ডুকলা মানে কী ঢাক বাজায়? না ওরা কি? কিছুই জানি না। আমার মনে হয় ওরা রায়ত বা প্রজা হবে। প্রতিদিন খেত সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী। আর দশমীর দিন বসে থাকত ওই পাঁঠা বলি হবে, মাংস খাবে। তা সব কিন্তু ওই দিদিমা, মামিমা ওরাই রান্না করত। চাটাইয়ের মধ্যে ভাত। আর ওইরকম ডাল, তরকারি। আজকে সত্যি কথা বলতে কি, ধর তোমাদের তিনজনকে আমি নেমতন্ন করলাম, করে ভাবলাম। আমি কি বাজার করব? কি রান্না করব? একটু চিন্তার বিষয় হবে। আর তখন ওই চাটাই ভর্তি ভাত, ডাল, তরকারি সব রান্না হচ্ছে। হ্যাঁ কি প্রাচুর্যময় দিন ছিল। আর কি সিম্পল লাইফ। আর এখন এই অবস্থা। যাইহোক সেইসব স্মৃতি সিলেটের। আর এছাড়া আমি বাংলাদেশ সম্বন্ধে আমি কিছু জানতাম না। দু-একটা হাওর দেখেছিলাম। হাওর তো খুব বড়। হাওরের জল। পরে যখন আমি বাংলাদেশ গেলাম, তখন বুঝলাম বাংলাদেশটা কী।

প্র: আপনার বাবা, তিনি তো, আমি শুনেছি যে সিলেট সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক ছিলেন। এবং অনেক বই-ও লিখেছেন। উ: ৩৫ বছর সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক ছিলেন। অনেক বই-ও লিখেছেন।

প্র: বাবার কথা একটু বলুন।

উ: আমার ঠাকুরদা ছিলেন নাড়িজ্ঞানী কবিরাজ। আমি দেখিনি। নাড়িজ্ঞানী মানে, ওই যে মুসলমান মেয়েরা, ওরা তো বোরখা দিয়ে সব ঢাকা। হাতটা একটু বের করে দিত। তখন ওই নাড়ি ধরে রোগনির্ণয় করতেন। চিকিৎসা করতেন। এটা খুব কঠিন কাজ। তো ঠাকুরদা নাকি ঘোড়ায় চড়ে সমস্ত এলাকা ঘুরে চিকিৎসা করতেন। তার পরে ওঁর স্ট্রোক হল। তখন উনি হাতি করে ঘুরতেন। তার পরে আরও বাধক ব্যাধি-ট্যাধি হল। তখন পাল্কি করে ঘুরতেন। আর উনি ছিলেন পিসিনপাশা নবাবের গৃহ চিকিৎসক। আর একটা খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার; বেশিরভাগই তো হিন্দুর থেকে মুসলমান হয়ে গেছে। এই পরিবারটাও তাই। যাইহোক মুসলমানদের সম্বন্ধে যেটা হল হিন্দুদের সঙ্গে খুবই সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, শান্তি--দেশে কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্ত যা হয়েছে বাবাই লিখেছেন যে, ওই ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল ব্রিটিশের। এটার জন্যে ওই দেশভাগ তারপর ওই দাঙ্গা এইসব কিছু। কিন্তু একটা বিষয়ে এই হিন্দুরা বা আমার যে সমাজ, আমার সমাজটা হল সিলেটের বৈদিক সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ। এরা কোত্থেকে এল? এরা খুব সম্ভব আগরতলা হবে। তার থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ / পাঁচ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ আনিয়ে ছিলেন মিথিলা থেকে। আর একটা মত হল কাণ্যকুব্জ থেকে। যাই হোক আমরা মনে করি মিথিলাই হবে। ওই বৈদিক ব্রাহ্মণরা এল। এসে ওরা যজ্ঞটজ্ঞ করেন। ওরা গিয়ে আরও পাঁচ গোত্রীয় ব্রাহ্মণকে নিয়ে আসেন। এইভাবে আমাদের সমাজটা গড়ে ওঠে। বললাম তো মুসলমানদের সঙ্গে সম্প্রীতি শান্তি। কিন্তু একটা বিষয়ে ভীষণ স্ট্রিক্ট। খাওয়া থাকা আলাদা। এখন তুমি ধর মুসলমান, তুমি এলে তোমাকে আমি এক গ্লাস জলও আমি দেব না, খেতেও বলব না, কিছু বলব না। বুঝতে পেরেছো ভীষণ স্ট্রিক্ট। খাওয়া থাকা আলাদা। এই যে পিসিনপাশার নবাব, নবাবের স্ত্রীর সঙ্গে আমার ঠাকুরমার সই পাতানো হয়েছিল। ওই পান-সুপুরি এইসব বিনিময় করে। কিন্তু খাওয়া থাকা আলাদা। ওই একটাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এমনিতে ছিল শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য। কোনরকম হিন্দু-মুসলমান সমস্যা ছিল না। আর দুই নম্বর হল, সিলেট হল মুসলমানপ্রধান দেশ। কারণ শাহজালান, শাহজালানের যে গুরু আরকি আরব দেশ না কোন দেশ থেকে হাতে এক মুষ্টি মাটি নিয়েছিল। মাটি নিয়ে বলেছিলেন যে তোমরা হিন্দুস্থানের দিকে প্রস্থান কর। ওখানে গিয়ে সেখানে এই মাটি পাবে, সেখানে রাজত্ব করবে। তা শাহজালান তো চললেন শিষ্যদের নিয়ে। আসতে আসতে আসতে শিষ্যের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে বাড়তে সিলেটে এসে পৌঁছলেন। সিলেটে এসে দেখলেন তাঁর হাতে যে মাটি, ওখানকার মাটিও সেইরকম। কিন্তু উনি রাজত্ব করলেন না। রাজত্ব অন্যজন করলেন। সেইজন্য উনি হলেন পীরশাহজাদা। তাঁর সব সমাধি-টমাধি সিলেটে আছে। আর যে ৩০০ জন না কতজন শিষ্য তাদের বললেন তোমরা গিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার কর। ওরা বেরিয়ে গেল প্রচার করতে। আর আমাদের হিন্দুদের যেটা হল, ধরো তুমি অত্যন্ত নীচু শ্রেণীর, নীচু জাত। আমি এখন চান করে কলসি করে জল নিয়ে যাচ্ছি, তোমার ছায়া যদি আমার গায়ে পড়ে যায়, তাহলে আমাকে ওই জল ফেলে দিতে হবে। অস্পৃশ্যতা। সুতরাং দলে দলে নীচু জাতের যে হিন্দু তারা মুসলমান হয়ে গেল। সিলেট হল মুসলমান প্রধান দেশ। আমি, আমার মা মারা গেলেন যখন আমি এইটের পরীক্ষা দিয়েছি। তখন আমি সিলেটে দুবছর ছিলাম। আমার দাদামশায়, দিদিমা ছাড়েননি। নাইন-টেন ওখানে পড়েছি। কোনরকম অশান্তি, কোন কিছু নেই। এত সুন্দর শান্তি, সবকিছু। এই সবকিছু অশান্তি ব্রিটিশদের জন্যে। ব্রিটিশরা এসে আমাদের দেশটাকে ধ্বংস করল।

প্র: শিলং-এ কোন স্কুলে পড়তেন?

উ: শিলং-এ ক্লাস ফাইভে আমি একটা অন্য স্কুলে পড়তাম। তারপর সিক্স থেকে পড়েছি লেডিকিন গার্লস স্কুল অ্যাণ্ড কলেজ। কিন্তু এইট ...

প্র: এইটে আবার সিলেটে ফিরে গেলেন।

উ: সিলেটে গিয়ে আবার নাইন-টেন পড়লাম। পড়ে যেটা আমার সব্বোনাশ হল, সেটা হল টেস্ট পরীক্ষা দেওয়ার পরে দেখা গেল রেজাল্ট সব ঠিক আছে, কিন্তু অঙ্কটা খারাপ। মানে অঙ্কতে আমি ভয় পেতাম খুব। তা আমার দাদামশাই একজন মাস্টার রাখলেন। বাবা আট-নয় দিন খুব বেশি হলে দশদিন পরে এসে আমাকে শিলং-এ নিয়ে চলে এলেন। তিনমাস। মা এমনভাবে বাড়িটা করেছিলেন, যে বাড়িটাকে ভাড়া দিয়ে উনি একবছর দেশের বাড়িতে গিয়ে থাকবেন—এমন ব্যবস্থা হয়েছিল। আমাদের পাঠশালা ছিল মেয়েদের। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত। তারপর আর মেয়েদের পড়াশোনার কোন সুযোগ ছিল না। আর আমরা এমনি এক ভাই, এক বোন। কিন্তু আমাদের জ্যাঠতুতো, তারপর সবাই মিলে বোধহয় ১০ জন হবে ভাইবোন। দুই দিদি তারপর সাত বোন। তো মা তিন বোনের বিয়ে দিয়েছিল। তখন মা বললেন যে আমি একবছর দেশে গিয়ে থাকবো। দেখি এরপরে আর মেয়ের কি করে পড়াশোনা করতে পারে। আর আরো যদি একটা বোনের বিয়ে দেওয়া যায় এইরকম ... মানে আসলে ভগবানই ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছেন। আর বাবাকে অন্য জায়গায় পেয়িং গেস্ট রেখেছেন। তারপরে ওইসময়ে পেয়িং গেস্ট উঠে গেলেন, বাবা বাড়িতে এলেন, তখন গিয়ে আমাকে নিয়ে এলেন। এখন আমি যদি না আসি তাহলে বাবাকে আবার কে দেখবে? কিন্তু আমার সব্বোনাশ হয়ে গেল।

প্র: ওই তিনমাস পড়ার সময় ছিল ...

উ: তিনমাস পড়ার সময় ছিল। আর দুনম্বর আমি তো আর মাস্টারের কাছে পড়তে পারলাম না। আর বাবা মাস্টার রাখেননি। আমিও কিছু বলিনি। সুতরাং আমার পড়াশোনাটা/ কেরিয়ারটা একটু খারাপ হয়ে গেল। অঙ্কের জন্যে। পাশ করলাম। কিন্তু যা করতে পারতাম, তা করতে পারলাম না। একা বাড়িতে ছিলাম। এইখানে আর একটু কথা বলি। আমাদের যে পাড়াটা, এরকম একটা U শেপের। রিলবং নাম। উঠেই কেঞ্চেস্ট্রেস। ওটা মানে অনেক দূর অবধি ঘুরে ঘুরে ঘুরে গেছে, গিয়ে আবার এখানে এসে মিশেছে। আর পাইন গাছ। দুদিকে পাইন গাছ। এত নির্জন, এত সুন্দর। সকালবেলা সোনালি রোদ। আর রাত্তির বেলা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। কেঞ্চেস্ট্রেসে উঠে প্রথম যে বাংলোটা, জিতভূমি বাংলো। সেখানেই রবীন্দ্রনাথ থাকতেন। আর বাঁদিকে আর একটা বাংলো ব্রুকসাইট, সেখানেও রবীন্দ্রনাথ থাকতেন। তা ব্রুকসাইট সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না। কিন্তু এই জিতভূমিতে যখন আমরা বড় হলাম, যখন যে এসে থেকেছেন, আমরা যেতাম। তারপরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষে, বাবা ওই কমিটির সেক্রেটারি হিসেবে সব জায়গায় ফলক বসালেন। তখন দেখা গেল যে জিতভূমিতে বসে উনি (রবীন্দ্রনাথ) লিখেছিলেন রক্তকরবী নাটক। রক্তকরবী নাটক আর শিলং-এর চিঠি। আর একটু দূরে আর একটা বাংলোতে থাকতেন। সেখানে বসে শিখেছিলেন যোগাযোগ উপন্যাস।

প্র: শেষের কবিতার একটা বড় অংশ তো শিলং-এই ...

উ: শেষের কবিতা তো ওখানেই ... তো আমার বাবার বাড়ি যেখানে শেষ হয়েছে, পেছনে ওখানে উঠে আর একটা বাংলো। তা আমরা বলতাম ওটাকে, কি বাংলো যেন বলতাম ... বাবা প্রতিদিন ওই জিতভূমি বাংলোর পাশ দিয়ে আমাকে ভাইকে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। মনীষীদের কথা বলতেন। বক্তৃতা দেওয়া শেখাতেন। তার পরে আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে প্রথম পুরস্কার আনতাম। আর মা রোজ সন্ধের সময় গীতাঞ্জলি পড়তেন। এইরকম একটা পরিবেশে, আদর্শ পরিবেশ, শিক্ষা, আদর যত্নে আমরা মানুষ হয়েছি। আর ছুটি হলেই দেশের বাড়ি, মামার বাড়ি। কিন্তু মা মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে এইসব শেষ হয়ে গেল।

প্র: আপনাদের জন্মদিনে, আপনার বাবা একটা করে রবীন্দ্র-রচনাবলীর খণ্ড উপহার দিতেন?

উ: হ্যাঁ, বাবা প্রত্যেক জন্মদিন কিম্বা নববর্ষে রবীন্দ্র-রচনাবলী দিতেন।

প্র: একটা করে খণ্ড?

উ: হ্যাঁ। একটা করে খণ্ড। মা গীতাঞ্জলি পড়তেন। এদিকে জিতভূমি বাংলোতে রবীন্দ্রনাথ থাকতেন। সুতরাং আমার প্রথম যেটা হল, আমি রাবীন্দ্রিক পরিবেশে বড় হয়েছি।

প্র: আচ্ছা, এইরকম ঘটনা ঘটেছিল যে, যখন বাবা আপনাদের দিতেন একটা করে বই, রবীন্দ্র-রচনাবলী। লিখে দিতেন বাবা ও মা। যখন মা নেই তখনো লিখে দিয়েছেন বাবা ও মা?

উ: হ্যাঁ। যে মা তোমাদের সঙ্গে সবসময়ই আছে। তারপরে যেটা হল, যে ম্যাট্রিক পরীক্ষা, অঙ্কের জন্যে রেজাল্ট খারাপ হল। পাশ করেছি কিন্তু যেটা করতে পারতাম সেটা হল না। আর বাবাও কিছু মাস্টার রাখলেন না। আমিও বাবাকে কিছু বলিনি। ইন্টারমিডিয়েট যখন পড়ি তখন ওই একটা চাপরাশি রান্না করত। সে মাঝে মাঝে ওর বাবুর সঙ্গে মফস্বলে চলে যেত। তখন আমাকে রান্না করতে হত। রান্না করে কলেজ করা।

(ক্রমশ)



(পরবাস-৬১, ডিসেম্বর ২০১৫)