লন্ডন ডায়রি; হাসান আজিজুল হক; প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ: গোলাম কিবরিয়া; প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ২০১২; যুক্ত, তেজগাঁও, ঢাকা, বাংলাদেশ, পৃষ্ঠাঃ ১৪৪; ISBN: 978-984-8828-85-4
|| ১ ||
দু দশক বা তারও কিছু বেশি আগের কথা--উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার যে সম্ভ্রান্ত অথচ সেই তুলনায় কম জনপ্রিয় পুস্তক বিপণীতে আমার নিয়মিত যাতায়াত--তাদের শো-কেসে একটি ঝকঝকে নতুন বইতে আমার চোখ আটকে যায়; গ্রন্থটির বিষয়বস্তু অভিনব ও বিরল--ইংরেজি অনুবাদে বাংলা ছোটগল্প, সম্পাদনা করেছেন কল্পনা বর্ধন। গ্রন্থটির নাম—“নারী, অচ্ছুত, কৃষক ও বিদ্রোহী--নির্বাচিত বাংলা ছোটগল্প” ('পরবাস'-এ ২০০১-সালে প্রকাশিত সুসান চাকো-র গ্রন্থ-সমালোচনা এইখানে)। কল্পনা আমার শহর থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে থাকেন, তবে আমার সঙ্গে পরিচয় নেই; কল্পনা এবং প্রণব বর্ধন—দুজনেই সুশিক্ষক, সুগবেষক এবং সুলেখক। যদিও তিরিশ ডলার মানে অনেকটাই দাম, সেই মহার্ঘ গ্রন্থটি সংগ্রহ না করে উপায় থাকলো না। কল্পনার বিস্তৃত অনুবাদ সাহিত্যের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। (এখন পাতা উল্টে দেখি গ্রন্থটির প্রকাশকাল মার্চ ১৯৯০, অর্থাৎ আমার হাতে এসেছিল তার কিছুকাল পরে।)
কুড়িটি বাংলা গল্পের ইংরেজি অনুবাদ সংকলিত ছিল সেই গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি—“জীবিত ও মৃত”, “শাস্তি”, “মধ্যবর্তিনী”, “হৈমন্তী” এবং “স্ত্রীর পত্র”—সাহসী, উদ্দীপ্ত, তেজস্বী নারীদের গল্প; তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি—“ডাইনী” এবং সেই গল্পেরই আর দুটি পুনর্লিখনের অংশবিশেষ; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারটি—“পোড়াকপালী”, “আজ কাল পরশুর গল্প”, “বুড়ি”, “নীচু চোখে একটি মেয়েলি সমস্যা”; মহাশ্বেতা দেবীর ছটি—“বিছন”, “ধৌলি”, “রুদালি”, “শিশু”, “গিরিবালা” এবং “ডাইনি”। বাকী চারটি গল্প আমার প্রায়-অচেনা এক লেখকের!
আমি আশা করেছিলাম যে বিভূতিভূষণ, সতীনাথ, সমরেশ অথবা অমিয়ভূষণ স্থান পাবেন এই সংকলনে। তার বদলে হাসান আজিজুল হককে দেখে যে খানিকটা হতাশই হয়েছিলাম সন্দেহ নেই। কিন্তু ভুল ভাঙলো গল্পগুলি পড়ে—ভাষার ব্যবধান ভেদ করে মন ছুঁয়ে যায় তাঁর অনুভূতির নির্ভেজাল প্রামাণিকতা। ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমেই তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় চারটি গল্পে—“The Daughter and the Oleander” (“আত্মজা ও একটি করবী গাছ”), “In search of Happiness” (“সুখের সন্ধানে”), “Through Death and Life” (“আমৃত্যু আজীবন”) এবং “A Day in Bhushan’s Life” (“ভূষণের একদিন”) —সেই থেকে আমার মুগ্ধতার সূচনা। এবং সবচেয়ে আশ্চর্য, তাঁর সঙ্গে পরিচয় মাতৃভাষার মাধ্যমে নয়, ইংরেজি অনুবাদে।
গ্রন্থের ভূমিকা থেকে জানা যায় লেখকের বিষয়ে নানান তথ্য। তাঁর জন্ম ১৯৩৮ সালে বর্ধমান জেলার যবগ্রামে (পরে জেনেছি এ তথ্যটি ভুল, তাঁর জন্ম ১৯৩৯ সালে) এবং জীবনের প্রথম ১৬ বছর কাটে পশ্চিমবঙ্গে তারাশংকরের মতনই-- রাঢ় বাংলার মাটিতে রোপিত তাঁর সাহিত্য-সৃষ্টির বীজ। ১৯৫৪ সালে স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি যান খুলনা জেলায় দিদির বাড়িতে থেকে কলেজের পাঠ শুরু করতে; তারপর সেখান থেকে রাজশাহী এবং ১৯৬০ সালে দর্শনশাস্ত্রে এম.এ. ডিগ্রি। ইতিমধ্যে তাঁর বাবা-মাও বর্ধমানের পাট গুটিয়ে সম্পত্তি বিনিময় করে চলে আসেন খুলনায়। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনার পর ১৯৭৩ সালে পাকাপাকিভাবে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে। সেখানেই তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তাঁর সাহিত্যচর্চার সূচনা এবং ১৯৬০ সালে প্রথম প্রকাশিত গল্প “শকুন”; ১৯৬৭ সালে ঢাকার মুক্তধারা প্রকাশন সংস্থা থেকে দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ[১] “আত্মজা ও একটি করবী গাছ”—পরপর অনেকগুলি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল সংকলনটির। একেবারে গোড়ার দিক থেকেই তিনি সমাজের পরিবর্তন এবং বিশৃঙ্খলার অন্তর্নিহিত অর্থ ও পটভূমি সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করতে আগ্রহী। যা কিছু তিনি নিজের চোখে দেখেছেন এবং অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, তাই তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য। গ্রামের গরীব চাষী এবং শহরের সমস্যাসংকুল মধ্যবিত্ত—দুজনের মনের কথাই তিনি প্রকাশ করতে পারেন সমান আন্তরিকতায় এবং সহজ, বাস্তব বিশ্লেষণে।
তিনি রবীন্দ্রনাথে আপ্লুত, কিন্তু কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পথ অনুসরণ করেন নি—রবীন্দ্রনাথের যে মানবতাবাদী আদর্শ, যা জাতিগত ও ধর্মগত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে, তা ১৯৪০এর দামাল, ধ্বংসক্ষয়ী দশাব্দে অথবা দেশভাগ পরবর্তী বাংলায় অথবা ভারতীয় উপমহাদেশে বজায় রাখা সম্ভব হত কিনা কে জানে? যে সমাজে তিনি বাস করেন সেখানে হিন্দু মুসলমানের বিভেদ, পূর্ব ও পশ্চিমের বিভেদ, ধনী ও দরিদ্রের বিভেদ, শিক্ষিত ও নিরক্ষরের বিভেদ—সেই বিভেদগুলিকে না সম্ভব ভুলে থাকা, না অগ্রাহ্য করা—তাদের কথাই তিনি লেখেন ঠিক যেমনটি তারা ধরা পড়েছে তাঁর চোখে। তাঁর গল্পে মানুষ যখন কাঁদে, সেই অশ্রু কেবল দু:খ অথবা শোকের প্রকাশ নয়—তার সঙ্গে মিশে থাকে রাগ, বিক্ষোভ, ঘৃণা এবং ব্যর্থতাজনিত হতাশা, ফোঁড়ার মধ্যে যেমন মিশে থাকে রক্ত ও পুঁজ।
লেখকের প্রথম জীবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে, পরবর্তী জীবন পুবে; রাঢ়বাংলা এবং বাংলাদেশ—উভয়েরই ভাষা, পরিবেশ ও আবহাওয়ায় তিনি সঞ্জীবিত; দুই পারের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে তিনি পরিচিত। একদিকে রক্তক্ষয়ী ধর্মভিত্তিক দাঙ্গা ও হানাহানি; অন্যদিকে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান—দুটোই এই উপমহাদেশের দৈনন্দিন বাস্তব। ১৯৮৮ সালে কলকাতার “বিজ্ঞাপন পর্ব” ক্ষুদ্রপত্রে প্রকাশিত লেখকের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত হয়েছে সংকলনের ভূমিকায়—“Writers, in their belief and personal relationship, may be above sectarianism, but they can not realistically deny its existence as a force, destructive or otherwise, in the society in which they live. A society’s division can be neither assumed away nor steamrolled.” সম্পাদিকার মতে, “Hasan Azizul is one of the most significant transcommunal writers of Bengal.”
কয়েক বছর পরে তাঁর আরও একটি ছোটগল্প পড়ার সুযোগ হয়েছিল কৃষ্ণা দত্ত এবং অ্যান্ড্রু রবিনসনের ইংরেজি অনুবাদে। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত “ফেরা” গল্পটির অনুবাদ “Homecoming”—১৯৯২ সালে ভাইকিং পেংগুইন প্রকাশিত “কলকাতার দ্বিপ্রহর” গল্প সংকলনে। পরে ২০১০ সালে যখন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস কল্পনা বর্ধনের সম্পাদনায় দুখণ্ডে প্রকাশ করেন ইংরেজি অনুবাদে বাংলাসাহিত্যের মহাসংকলন, তাতেও সংকলিত হয়েছিল এই অনুবাদ-গল্পটি। মাতৃভাষার মাধ্যমে তাঁর গল্প পড়ার সুযোগ ঘটেছে আরও অনেক বছর পরে। সেও এক অনুপম অভিজ্ঞতা।
আর একটি স্বল্পজ্ঞাত ঘটনার কথা এখানে জানিয়ে রাখা ভালো। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু কলকাতায় ১৯৫৬ সালের তেসরা ডিসেম্বর। কয়েক সপ্তাহ পরে তাঁর স্মৃতিসভায় “উল্টোরথ”—চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের মাসিকপত্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় মানিক স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারের কথা—শ্রেষ্ঠ তিনটি উপন্যাসকে এই পুরস্কার দেওয়া হবে। বিভিন্ন তরুণ সাহিত্যিকের লেখা অসংখ্য উপন্যাস জমা পড়েছিল সেই উপলক্ষ্যে—বিচারক ছিলেন সেই সময়কার মহীরূহ সাহিত্যিকেরা। প্রথমে ১০০টি উপন্যাস বেছে নেওয়া হয়, দ্বিতীয় দফায় তাদের মধ্য থেকে ২৫টি, তার পরে সাতটি। পুরস্কার দেওয়া হয় প্রথম তিনজন সাহিত্যিকের উপন্যাসকে—সেগুলি একে একে প্রকাশিত হয় ‘উল্টোরথ’ পত্রিকায়।
প্রথম পুরস্কার: মতি নন্দী (১৯৩১-২0১0); উপন্যাসের নাম "ধুলোবালির মাটি"।
দ্বিতীয় পুরস্কার: অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩0 - ); উপন্যাসের নাম "সমুদ্র-মানুষ"।
তৃতীয় পুরস্কার: পূর্ণেন্দু পত্রী (১৯৩৩-১৯৯৭); উপন্যাসের নাম “দাঁড়ের ময়না”।
কিন্তু চার নম্বরে কে ছিলেন—এক ১৮ বছর বয়েসি তরুণ লিখেছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাসটি—নাম তার "শামুক"। তার লেখকও যুগান্তকারী ছোটোগল্প লিখেছেন, কিন্তু উপন্যাস লিখতে তাঁর অনাগ্রহ। তিনি “আগুনপাখি” নামে তাঁর প্রথম প্রকাশিতব্য উপন্যাস লিখবেন এই ঘটনার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে।
সেই তরুণের নাম হাসান আজিজুল হক!
|| ২ ||
হাসান সাহেবের ছয় দশকের সাহিত্যকীর্তির গভীর ও বিস্তৃত আলোচনা এখানে আমার উদ্দিষ্ট নয়; আমার আলোচ্য বিষয় একটি কৃশকায় ও সুদৃশ্য ভ্রমণ-ডায়েরি। ১৯৮০র দশকের শেষ ভাগে লেখককে কিছুকাল কাটাতে হয়েছিল ইংল্যান্ডে; সেখানে থাকাকালীন তিনি তাঁর বন্ধু প্রাবন্ধিক ও গবেষক গোলাম মুরশিদের সঙ্গে বেড়াতেও গিয়েছিলেন ফ্রান্সে ও স্কটল্যান্ডে। লন্ডনে মুরশিদ সাহেবের আতিথ্যে মাসাধিক কাল বসবাসের সময় তিনি নিয়মিত দিনপঞ্জী লিখতেন, সেখানকার দৈনন্দিন জীবনযাপন ও মানুষজনের কথা—“এই লেখাগুলি ডাইনিং টেবিলে, পার্কে, টেমস, সেইন, টে নদীর ধারে কখনো বসে, কখনো গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বা পাথরের বেঞ্চিতে হাঁটুর ওপর ডায়েরি রেখে লেখা। একেবারে পিঁপড়ের সারির মতো অক্ষর সাজানো, সেই ১৯৮৮ সালে, চব্বিশ বছর আগে। এগুলো নিয়ে কিছুমাত্র ভাবনা ছিল না, প্রকাশ করা তো দূরের কথা।” প্রথম ডায়েরিটির পরিধি বৃহস্পতিবার ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮ (যে দিন তিনি ঢাকা থেকে প্লেনে চড়ে রওনা হন) থেকে বৃহস্পতিবার ২০ অক্টোবর ১৯৮৮ (মুরশিদ সাহেবের সঙ্গে প্যারিসপানে রওনা হবার তিন দিন আগে) পর্যন্ত পাঁচ সপ্তাহ।
দ্বিতীয় একটি ডায়েরিতে ছিল মুরশিদ সাহেবের সঙ্গে তাঁর প্যারিস এবং স্কটল্যান্ড ভ্রমণের বিশদ বিবরণ—পরবর্তী কালে ঢাকায় একটি ট্যাক্সিতে সেই ডায়েরিটি ফেলে যান তিনি। সেটির আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হয় চন্দন আনোয়ার সম্পাদিত “গল্পকথা” ক্ষুদ্রপত্র—“গল্প ও গল্পভাষ্যের কাগজ”। গল্পকথার তৃতীয় সংখ্যাটি (প্রকাশ—ফেব্রুয়ারী ২০১২) হাসান আজিজুল হক বিশেষ সংখ্যা। সেই সংখ্যা থেকেই পাঠক জানতে পারেন এই ভ্রমণ ডায়েরির কথা—ডায়েরির প্রথম পাঁচদিনের বৃত্তান্ত মুদ্রিত হয়েছিল সেখানে। একটি মৃদু অনুযোগ—গল্পকথায় রচনার শিরোনাম ছিল “লন্ডন ডায়েরি”, কিন্তু পুস্তকাকারে তা হয়ে দাঁড়ায় “লন্ডন ডায়রি”—এই “এ-কার” বিলোপের বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট নয়।
“যুক্ত” প্রকাশনা সংস্থার নিশাত জাহান রানা এই ডায়েরি পুস্তকাকারে প্রকাশে আগ্রহী হলে দ্বিতীয় হারানো ডায়েরিটির খোঁজ পড়ে। চন্দন আনোয়ারের সহায়তায় লেখক দুদশকেরও বেশি পুরানো স্মৃতি হাতড়ে আবার নতুন করে লিখেছেন। তাঁর নিজের জবানীতে—“ ... দুটি ডায়েরির একটি ঢাকায় ট্যাক্সিতে ফেলে এসেছিলাম আমার অনবধানতায়। সেটার অন্তিম গতি কি হয়েছে আমি জানি না। তার কিছুটা আমি অস্পষ্ট স্মৃতি থেকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। সেখানে কিছু বড়ো সড়ো ভুল ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়।” “স্মৃতি থেকে তুলে আনা” নামক এই দ্বিতীয় অংশটি প্রথম অংশের লন্ডন ভ্রমণের তুলনায় অনেকটাই ছোট এবং খানিকটা অসম্পূর্ণও। সেখানে কেবল প্যারিস ভ্রমণের বিবরণ রয়েছে, স্কটল্যান্ডের কথা নেই।
|| ৩ ||
ডায়েরির সূচনা ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে—তিনি যাচ্ছেন লন্ডনের বাংলা সাহিত্য পরিষদের আমন্ত্রণে—তাঁর বিমানসঙ্গী শিশু সাহিত্যিক এখলাসউদ্দিন আহমদ। যাত্রা খানিকটা ঘুরপথে—ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি-বাগদাদ-লন্ডন। উদ্যোক্তারা কেউ বিমান বন্দরে আসেননি তাঁকে স্বাগত জানাতে সময়মত—সেই চিরাচরিত দৃশ্য। শেষ পর্যন্ত তাঁদের প্রতিনিধি এলেন, তিনি পৌঁছালেন প্রিয় বন্ধুর বাসস্থানে এবং শুরু হ’ল লন্ডন ভ্রমণ। প্রতিটি দিনের কথা তিনি লিখেছেন মুখের ভাষায়, সহজ ভঙ্গিতে—তাঁর সহজাত প্রসাদগুণে পড়ে ফেলা যায় একনি:শ্বাসে।
তিনি ঘুরে দেখেছেন লন্ডনের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যস্থানগুলি, পরিচয় হয়েছে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে; তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে, অংশ নিয়েছেন আলোচনা-সভায়—ভাল মন্দ মিশিয়ে সবকিছুই লিখেছেন কুন্ঠাহীন ভাবে। খুব সামান্য কোনো বস্তুও তাঁর কাছে ফ্যালনা নয়। রেস্তোরাঁর মেনুতে মনে রাখার মত কিছু পেলে তিনি উল্লেখ করেছেন—“Food is divine. Cooking is an art. We believe in both. There is no half measure in food cooking.” ট্রেনের কামরায় কবিতার পঙ্ক্তি সাঁটা থাকলে তিনি মন দিয়ে পড়েছেন এবং একটির বাংলা অনুবাদও করে দিয়েছেন—
“মাথার উপরে অন্ধকার আকাশতিনি অচেনা বিদেশে গেলেও পুরো সময়টাই ছিলেন নিকট মানুষজনের সান্নিধ্যে, তাই লন্ডনের শ্বেতকায়/কৃষ্ণকায় নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগই হয় নি বলতে গেলে। তিনি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন লন্ডনের দ্রষ্টব্যস্থানগুলি এবং লিখে রেখেছেন তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। লন্ডন শহরের বাইরে তিনি গিয়েছেন অক্সফোর্ড এবং লিপিবদ্ধ করেছেন তার ইতিবৃত্ত। লন্ডনে তিনি সময় নিয়ে ঘুরে দেখেছেন ভিক্টোরিয়া ও অ্যালবার্ট মিউজিয়াম, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি, ব্রিটিশ লাইব্রেরী, ব্রিটিশ মিউজিয়াম প্রভৃতি স্থানে এবং বিশদ বর্ণনা করেছেন তাদের। আমার সৌভাগ্য ঘটেছিল এই দ্রষ্টব্যস্থানগুলি দেখার—ওনার প্রায় এক দশক পরে, অনেক পুরানো স্মৃতি মনে পড়িয়ে দিল এই ভ্রমণবৃত্তান্ত। ঢাকা থেকে আগত দুই অধ্যাপক মহোদয়ের সঙ্গে তাঁর উত্তর-পূর্ব লন্ডনের হাই গেট অঞ্চলে কার্ল মার্কসের সমাধি খুঁজে বের করার কাহিনিতে রয়েছে রহস্য গল্পের আমেজ।
হেঁটে বাড়ি ফিরছি
মনে পড়ছে একটি প্রবল ঝড়ো মুহূর্ত
মাথার উপরে পড়লো বড় একটি জলের ফোঁটা
কিছু ভাবার আগেই দ্বিতীয় ফোঁটাটি পড়লো
একেবারে নাকের ডগায়
কেমন একটা সুড়সুড়িতে হেসে উঠলাম আমি।”
তাঁর দেখার চোখ এবং কলমের জোরে শহরতলির এক নামহীন পার্কও হয়ে ওঠে জীবন্ত—“পথে এক হলুদ, শুকিয়ে যাওয়া বেনাঘাসে ভরা জঙ্গলে যেখানে আদিম প্রকৃতির আকাশ, চকচকে কালো পানি, বুনো হাঁস, পানির ধারে নিভৃত গাছ আর গাছের নীচে পাখিদের বিষ্ঠার ঝাঁঝাল গন্ধ—এসব মিলে একটা নির্জন, মানুষের স্পর্শশূন্য পৃথিবীর আবহ তৈরী করা আছে লন্ডন শহরের ভিতরে।” আর রয়েছে পরিচিত, অপরিচিত অথবা সদ্য-পরিচিত মানুষদের কথা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নিরাসক্ত অথচ চাঁচাছোলা ভাষায়। বাঙালিদের সময়ানুবর্তিতার অভাব এবং অকারণ দলাদলির বিরুদ্ধে প্রকাশ করেছেন তাঁর বিরক্তি।
|| ৪ ||
সারা পৃথিবী জুড়ে ভ্রমণকাহিনির ঘরানাটি মহাকাব্যের মতই প্রাচীন এবং নিরবচ্ছিন্ন। আদি যুগ থেকেই মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে পায়ে হেঁটে, ঘোড়ার অথবা গাধার পিঠে চড়ে, অথবা পাল তোলা নৌকায় সুদূরের ডাকে। অনেকে ফিরেই আসেনি, অন্যেরা ঘরে ফিরে এসেছে ভাগ করে নিয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা। রাম, লক্ষণ ও সীতার বনবাস তো এক ধরনের ভ্রমণই—অযোধ্যা শহরটি (তা সে সেখানেই অবস্থিত হোক না কেন) থেকে লংকাদ্বীপের ভৌগোলিক দূরত্ব কম নয়। মহাভারতে পাণ্ডবদের বনবাস ও অজ্ঞাতবাস—সেও আর এক দীর্ঘ পর্যটন। রাজধানী ইন্দপ্রস্থ ছেড়ে অর্জুন গিয়েছেন পূর্ব প্রত্যন্তের দেশ মণিপুরে আবার সুদূর পশ্চিমে দ্বারকায়। মেঘদূতের বিরহী যক্ষ নিজে যেতে পারেন নি বলে এক পশলা মেঘকে পাঠিয়েছেন ভ্রমণে—মেঘদূত কি প্রেম ও বিরহের কাব্য না এক অনুপম ভ্রমণকাহিনি? খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে ট্রয়ের যুদ্ধ —দশ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে ইথাকায় ঘরের পথে রওনা দিলেন অডিসিউস—বাড়ি পৌঁছাতে লাগলো দশ বছর—হোমার লিখলেন তাঁর বিবরণ—১২,১১০ পঙ্ক্তির প্রাচীন ভ্রমণকাহিনি, “দ্য অডিসি”। আর আমরা বড়ো হয়েছি রবীন্দ্রনাথ, অন্নদাশংকর রায়, যাযাবর প্রমুখের ভ্রমণকাহিনি পড়ে। “আরণ্যক” কি উপন্যাস না জংগল মহালের ভ্রমণকাহিনি?
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশে বেদব্যাস বা বাল্মীকির মতন মহাকবি ছিলেন, চাণক্যের মতন ঝানু রাজনীতিক ছিলেন, ছিলেন আর্যভট্টের মতন বিজ্ঞানী; কিন্তু ছিলেন না কোনো নামকরা ঐতিহাসিক—গ্রিস দেশের যেমন হেরোডোটাস। আমাদের ইতিহাস তাই এখনও পর্যন্ত অসম্পূর্ণ এবং অনেকটাই বিদেশি পর্যটকের ওপরে নির্ভরশীল।
চিনের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ফা-হিয়েন (৩৩৭-৪২২ খ্রীষ্টাব্দ) ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন এক দশক, সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে। উপমহাদেশের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই পাওয়া গিয়েছে তাঁর রচনা থেকে। ভারতে আদি বৌদ্ধধর্মের বিকাশের অনেক কথাই চিরতরে হারিয়ে যেত তিনি লিখে না রাখলে। তিন শতাব্দী পরে চিনের আর এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হিউয়েন সাং (৬০২-৬৬৪ খ্রীষ্টাব্দ) এসেছিলেন সতেরো বছরের দীর্ঘ তীর্থযাত্রায়—নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সমকালীন মঠ-মন্দির, পুঁথি–ধর্মগ্রন্থ ও রাজা–প্রজা-মানুষজনের বিবরণ পাওয়া গেছে তাঁর রচনার মাধ্যমে। এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়—আল বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮), ইবন বতুতা (১৩০৪-১৩৭৭), মার্কো পোলো (১২৫৪-১৩২৪) যাঁরা অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়েও নতুন দেশে গিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন এবং দেশে ফিরে বিশদভাবে লিখেছেন তাদের বিষয়ে।
হাসান সাহেবের লন্ডন ভ্রমণের পটভূমি হল মার্গারেট থ্যাচারের (১৯২৫-২০১৩) শাসনকাল—তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৭৯-১৯৯০। তিনি শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ শ্রমিক ইউনিয়নগুলির এবং সরকার পরিচালিত শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থাগুলিকে বিকিয়ে দিয়েছিলেন ধনী শিল্পপতিদের কাছে। আমি যখন এই গ্রন্থটি প্রথম পাঠ করেছি (এপ্রিল-মে ২০১৩) তখন সদ্য মৃত্যু ঘটেছে থ্যাচারের (৮ এপ্রিল ২০১৩) এবং দেশটি তোলপাড় তাঁর উত্তরাধিকারের ভালো মন্দ নিয়ে। গ্রন্থটিতে থ্যাচারের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু বিশেষ কোন মতামত প্রকাশ করেন নি লেখক। রয়েছে ডাকঘরে ধর্মঘটের কথা—চিঠি ফেলতে গিয়ে তিনি দেখেছেন রাস্তার ডাকবাক্স লোহার পাত দিয়ে সাঁটা। আর লক্ষ করেছেন কমবয়েসি, দিগ্ভ্রান্ত, বেকার তরুণ তরুণীদের। সেইসময় বিশেষ দক্ষতাহীন কর্মীদের মধ্যে বেকারত্ব ছিল আকাশ-ছোঁয়া।
|| ৫ ||
গ্রন্থের ফ্রান্স ভ্রমণের অংশটি সংক্ষিপ্ত এবং বিক্ষিপ্ত, তবে তার একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে ভের্সাই শহরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের দুটি বসতবাটি ঘুরে দেখা এবং তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। তথ্যগুলি পরে স্থান পেয়েছে মুরশিদ রচিত মাইকেল জীবনী গ্রন্থে। অনেক বছর পরে আমি যখন প্যারিসে যাই, তার আগে পড়ে নিয়েছিলাম মুরশিদ সাহেবের মহাগ্রন্থ এবং সঙ্গে ছিল মাইকেলের বাড়ির ঠিকানা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাকে প্যারিস থেকে ভের্সাই যেতে হয়েছিল একটি নির্বাহী ভ্রমণের (conducted tour) অংশ হিসেবে, ফলে হাতে সময় ছিল না একা একা ঘুরে দেখার। ট্যুরবাসের জানালা থেকে বাড়িটি দেখেই আমাকে ফিরে আসতে হয় প্যারিসে।
লন্ডনে গিয়ে হাসানসাহেব জানতে পারেন যে তখন প্যারিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তাঁর কলেজের সহপাঠী। বন্ধুর আমন্ত্রণেই তাঁরা প্যারিসে যান এবং বন্ধুর বাড়িতেই ওঠেন। বাংলাদেশের দারিদ্র্য এবং প্যারিসে বাংলাদেশী দূতের আড়ম্বর ও জাঁকজমক তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এবং তুলনা করেছেন ফকিরের রাজবেশ ধারণের সঙ্গে।
লেখকের চোখে ধরা-পড়া লন্ডন ও প্যারিস শহরের স্থাপত্যের এবং মানুষজনের তফাৎগুলি সুখপাঠ্য ও ভেবে দেখার মত। দুই শহরের ভূগর্ভস্থ রেলওয়ের তুলনা করে তাঁর বেশি ভালো লেগেছে প্যারিসের ব্যবস্থা, কারণ তাতে শব্দ কম হয় এবং লাইনের দুপাশে অনেকটা ফাঁকা জায়গা থাকে। দুই শহরের রাস্তাঘাট এবং দুই নদীর তুলনা করেও তাঁর ভালো লাগার দাঁড়িপাল্লা ঝুঁকেছে প্যারিসের দিকে “মোট কথা, প্রথমেই মনে হল প্যারিস বুকচাপা মহানগরী নয়। এই শহর কাউকে চেপে ধরে না। ফাঁকা জায়গা বেশি। আকাশ রাজপথ অনেক বেশি মুক্ত।” আমি দুটি শহরেই কয়েকবার গিয়েছি এবং তাঁর এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।
বইটির আকার ও আকৃতি নিয়েও দুয়েকটা কথা বলা উচিত—বইটির আকার ডায়েরির মতন—অন্য বইপত্রের চেয়ে খানিকটা ছোট। দৈর্ঘ্যে ৫ ১/২ ও প্রস্থে ৪ ১/৪ ইঞ্চি। সহজেই ধরে যায় কোটের পকেটে—সঙ্গে নিয়ে বেরুতে কোনো অসুবিধে নেই। লেখক যেমন বিচিত্র সব স্থানে বসে ডায়েরিটি লিখেছেন, বইটি আমি পড়েওছি একই ভাবে। আমার মেয়ে রূপকথাকে নাচের স্কুলে অথবা জিমনাস্টিকের আখড়ায় পৌঁছে দিয়ে হাতে যে ৬০ থেকে ৯০ মিনিট সময় থাকে—সেই সময়ে আমি পার্কের বেঞ্চিতে অথবা কফিশপে বসে বইটি খুলে পড়েছি। একবার কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়েছে তার গায়ে। আশা রাখি যে লেখক অসন্তুষ্ট হবেন না এতে।
বইএর প্রতিটি পাতা সাধারণ সাদা কাগজ নয়, দেখতে ডায়েরির মতন, মৃদু লাইন টানা। সঙ্গে রয়েছে অনেকগুলি ছবি। প্রকাশককে অভিনন্দন জানাই গ্রন্থটির অঙ্গসৌষ্ঠবের জন্যে। সবই মিলিয়ে হালকা মেজাজে পড়ার জন্যে এক সুদৃশ্য, মনোরম গ্রন্থ, যার মধ্যে বেশ কিছু ভেবে দেখার মতন কথা রয়েছে।
[১] তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থের (“সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য”, ১৯৬৪) নাম জেনেছি অনেক বছর পরে।
(পরবাস-৬১, ডিসেম্বর ২০১৫)