চাষী অনোরেঁ মৃত্যুপথ-যাত্রী মায়ের বিছানায় পাশে বসা ডাক্তারের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। বিছানায় শায়িতা বৃদ্ধা শান্তভাবে ডাক্তার আর ছেলের কথা শুনছিলেন। মরে যাচ্ছেন তিনি—এই সত্যটি মেনে নিয়েছেন বিরানব্বুই বছরের বৃদ্ধা।
খোলা দরজা আর জানালা গলে জুলাই মাসের রোদ ঢুকেছে ঘরে। বাইরে সূর্য তার প্রখর তাপ আর রশ্মি ঢালছে বাদামি আদুল মাটিতে। তপ্ত হাওয়ার মধ্য দিয়ে খেতের গন্ধ উড়ছে। মধ্যাহ্ন সূর্যের উত্তাপে গম আর ঘাসপাতার গন্ধ প্রকৃতি জুড়ে। এমনই পরিবেশে ডাক্তার উচ্চকিত স্বরে বললেন—‘অনোরেঁ, তুমি তোমার মাকে এ অবস্থায় একা ফেলে রাখতে পারো না। যে-কোনো মুহূর্তে উনি মারা যেতে পারেন।’
অনোরেঁ বলল, ‘বললাম তো, গম আমাকে তুলতে হবে। অনেকদিন পড়ে আছে। গম তোলার এই-ই সময়। তুমি কি বলো, মা?’ সে মায়ের দিকে তাকাল। এ-কথায় মুমূর্ষু মহিলা মাথা নাড়লেন। তারপর ছেলের ইচ্ছেয় সায় দিয়ে বললেন, ‘তোমরা একলাই মরতে দাও আমাকে।’ ডাক্তার তখন রেগে গিয়ে মাটিতে পা ঠুকে বললেন, ‘তুমি একটা পিশাচ, অনোরেঁ। তোমাকে আমি তা করতে দেব না। বুঝেছ? যদি তোমাকে আজই ফসল তুলতে হয় তবে তোমার মাকে দেখার জন্য নার্স র্যাপেঁকে নিয়ে এসো। কী বলেছি, মাথায় ঢুকেছে? যা বললাম না করলে যখন তুমি অসুখে পড়বে, তখন শুধু চেয়ে দেখব যে তুমি কুকুরের মতো মরছো, বুঝেছ?’
রোগা-ঢ্যাঙা ধীরগতির অনোরেঁ দুলতে লাগল সিদ্ধান্তহীনতায়। একদিকে ডাক্তারের শাসানি, অন্যদিকে মিতব্যয়ী হবার লোভ—দুয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সে ইতিউতি করছিল। কেননা মায়ের দেখাশোনার জন্য কাউকে রাখতে গেলে গাঁটের পয়সা খসে যাবে তার। সে তোতলিয়ে বলল, ‘মা র্যাপেঁ কত নেয়?’
‘আমি কী করে জানব?’—খেঁকিয়ে উঠলেন ডাক্তার, ‘এটা নির্ভর করে কতদিন তুমি তাঁকে রাখবে তার ওপর। নিকুচি করি তোমার হিসেবের। তুমি নিজেই তার সাথে ব্যবস্থা করে নাও। কিন্তু আমি তাঁকে এক ঘন্টার মধ্যে চাই। বুঝতে পারলে?’
অনোরেঁ মনস্থির করে ফেলেছে ততক্ষণে। বলল, ‘এই যাচ্ছি আমি। রাগ করবেন না ডাক্তার সাহেব।’
‘হ্যাঁ, তাই যাও,’ ডাক্তার চলে যেতে যেতে বললেন—‘এখন বাছা তুমি সাবধান হও। যতক্ষণ আমি ছিলাম, তখন একরকম। আমি সরে গেলে তখন তা আর হাসি তামাশার বিষয় থাকে না।’
ডাক্তার চলে যাবার পর চাষী মা’র দিকে ফিরে হাল ছেড়ে-দেয়া গলায় বলল, ‘ডাক্তার যা বললেন করতেই হচ্ছে। আমি যাচ্ছি র্যাপেঁকে ডাকতে। আমি না ফেরা পর্যন্ত অস্থিরতা করো না।’ অনোরেঁ বাইরে বের হয়ে গেল।
নার্স র্যাপেঁ অতি বৃদ্ধা ও কুঁজো। ইস্তিরি আর সূচির কাজই তিনি আঁকড়ে ধরে আছেন। সেই সাথে তাঁর একটা কাজ হলো মুমূর্ষু ব্যক্তির মৃত্যুকালীন সেবা করা। ইনি এই গাঁয়ে ও কাছাকাছি অঞ্চলে বহু মৃত্যু আর মরণাপন্ন ব্যক্তিকে দেখেছেন। কোনো মৃত লোকের কাপড় সেলাই করে জুড়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ তিনি চলে যেতে পারেন জীবন্তদের জামা ইস্তিরি করে দিতে। চিমসে লাগা পুরোনো আপেলের মতোই তাঁর শরীর। মুখ সদা বিদ্বেষপূর্ণ। হিংসুক চাহনি। এখনও কব্জিতে অবিশ্বাস্য শক্তি রাখেন বৃদ্ধা। সবসময় নুয়ে চলেন—যেন খদ্দেরদের কাপড় ইস্তিরি করেই তাঁর এই হাল। মৃত্যু ও মৃত্যুশয্যা সম্পর্কে এক ধরনের নারকীয় ও বিচ্ছিরি আগ্রহ তাঁর। আর র্যাপেঁর আলোচনার একমাত্র বিষয় তাঁর শুশ্রূষাপ্রাপ্ত মৃত ব্যক্তি এবং তাঁর দেখা বিভিন্ন রকমের মৃত্যু। এসব সম্পর্কে বিস্তারিত গল্প করেন তিনি একজন পাকা শিকারির শিকারের অভিযান নিখুঁত বর্ণনা করার মতো।
বুড়ির বাড়িতে এসে অনোরেঁ বনতেমপ্স মেয়েদের জামার কলারে নীল ঘষতে দেখল তাঁকে।
‘শুভ অপরাহ্ন মা র্যাপেঁ। কেমন চলছে আপনার?’ অনোরেঁ তোষামোদের ভঙ্গিতে বলল। র্যাপেঁ মুখ তুলে চাইলেন, বললেন—‘চলছে চলছে। এই তো। তুমি কেমন?’
‘আমি ভালো। কিন্তু মা ভালো নেই।’
‘তোমার মা?’
‘হ্যাঁ, আমার মা।’
‘কি হয়েছে?’
‘উনি সম্ভবত সব চুকিয়ে দিতে যাচ্ছেন।’
বুড়ি পানির গামলা থেকে হাত তুললেন। স্বচ্ছ নীলাভ জলবিন্দু তাঁর আঙুল গড়িয়ে গামলায় পড়ছিল। ‘এমনই অবস্থা?’ বুড়ির চোখেমুখে আগ্রহ খেলে গেল।
‘সেরকমই। ডাক্তার বলেছেন অপরাহ্ন পর্যন্ত তিনি টিঁকবেন না।’
‘তবে তো খুবই খারাপ অবস্থা।’
অনোরেঁ ইতস্তত করছিল। মোদ্দা কথাটা পাড়ার আগে কিছু বলতে চাইল সে। কিন্তু কিছুই মনে না আসাতে সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলো; ‘মাকে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত দেখাশোনা বাবদ কত চান আপনি? আমার অবস্থা তো জানেনই। বাড়ি দেখভাল করার জন্য লোক রাখার সামর্থ্যও আমার নেই। এই একটা কাজই আমি মা’র জন্য করতে চাই। তাঁর বয়স বিরানব্বুই। তিনি একলাই দশজনের কাজ করতেন।’
বৃদ্ধা র্যাপেঁ গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘দুই রকম রেট আছে। ধনীদের জন্য দুই ফ্রাঁ দিনে আর রাতে তিন ফ্রাঁ। অন্যদের জন্য দিনে এক ফ্রাঁ আর রাতে দুই ফ্রাঁ। তুমি তা-ই দিও আমাকে।’
অনোরেঁ ভাবনায় পড়ল। মাকে সে ভালো করেই চেনে। জানে তাঁর একগুঁয়েমি, প্রচণ্ড মনোবল আর টিঁকে থাকার শক্তির কথা। ডাক্তার যা-ই বলুক না কেন, উনি আরও এক হপ্তাও টিঁকে যেতে পারেন। অনোরেঁ ভেবেচিন্তে বলল, ‘আপনি পুরো কাজটার জন্য আমাকে একদর বলে দেন। ঝুঁকি সমানই থাকল। ডাক্তার বলেছেন যে মা শীঘ্রই মারা যাবেন। যদি তাই হয় তো আপনি জিতে যাবেন। কিন্তু কাল পর্যন্ত বা তার পর দিন টিঁকে থাকেন তো আমি জিতব, আপনি হারবেন।’
র্যাপেঁ অবাক চোখে অনোরেঁকে দেখলেন। এর আগে তিনি একদরে কাজের দায়িত্ব নেননি। বৃদ্ধা বাজির খেলার লোভে দুলতে লাগলেন। পরক্ষণেই তাঁর মনে সন্দেহের ছায়া নামল। ভাবলেন, চাষা হয়তো কোনো চালাকি করছে। বৃদ্ধা বললেন, ‘তোমার মাকে না দেখে কথা দিতে পারছি না।’
‘তবে আসুন তাঁকে দেখতে।’ অনোরেঁ বলল।
র্যাপেঁ হাতটাত মুছে চাষীর সঙ্গে চলল। পথে কোনো কথা হোলো না। বৃদ্ধা এত দ্রুত হাঁটছেন যে অনোরেঁকে খানাখন্দ পার হবার মতো প্রায় লাফিয়ে চলতে হচ্ছে। ওদের গমনের সাড়া পেয়ে গরমে কাতর হয়ে মাঠে শুয়ে থাকা গোরুগুলো ঘাড় উঠিয়ে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ওদের দেখে তারপর মাথা নামিয়ে নিল।
বাড়ির কাছে এসে অনোরেঁ বিড়বিড় করে বলল, ‘খুব সম্ভব শেষ।’
কিন্তু মরেননি বৃদ্ধা। তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। লালচে চাদরে হাত দুটি বিছিয়ে আছে তাঁর—সাংঘাতিক সরু ও কুঁচকানো হাত। বেতো এবং কোঁকড়ানো বলে তাঁকে মনে হচ্ছে কাঁকড়াজাতীয় কোনো প্রাণী। প্রায় এক শতাব্দীর কঠোর পরিশ্রমের স্বাক্ষর তাঁর সমস্ত দেহে।
র্যাপেঁ বিছানার কাছে গিয়ে মৃতপ্রায় অনোরেঁর মাকে ভালো করে দেখতে লাগলেন। তিনি বৃদ্ধার নাড়ি দেখলেন, বুকে হাত রাখলেন আর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনলেন। সেই সাথে বৃদ্ধাকে দুয়েকটি প্রশ্ন করলেন তাঁর স্বর পরখ করার জন্য। তিনি শেষবারের মতো মহিলাকে দেখে নিয়ে বাইরে এলেন। র্যাপেঁ স্থির নিশ্চিত হলেন যে রাত পোহাবার আগেই বৃদ্ধা শেষ হয়ে যাবেন।
‘কেমন দেখলেন?’
অনোরেঁর প্রশ্নের জবাবে র্যাপেঁ বললেন, ‘উনি আরো দুদিন, এমনকি তিনদিনও টিঁকে থাকতে পারেন। তুমি সাকুল্যে ছয় ফ্রাঁ দেবে আমাকে পুরো কাজের জন্য।’
‘ছয় ফ্রাঁ!’ অনোরেঁ চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো? আমি বলছি উনি বড়জোর পাঁচ কি ছয় ঘন্টা বেঁচে থাকবেন!’
দর কষাকষি চলল। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। একসময় র্যাপেঁ ফিরে যাওয়ার হুমকি দিলেন। সময় বয়ে যাচ্ছিল। গম তো কিছু আর নিজে থেকে উঠে আসবে না। শেষে বুড়ির প্রস্তাবেই রাজি হলো অনোরেঁ। বলল, ‘ঠিক আছে। ছয় ফ্রাঁ। মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত।’
‘ঠিক ছয় ফ্রাঁ।’ র্যাপেঁ বললেন।
লম্বা পদক্ষেপে ফসল তাদারকিতে চলে গেল চাষী অনোরেঁ। রোদে পুড়ছিল ফসল। এদিকে র্যাপেঁ চলে এলেন রোগিনীর কাছে। সাথে কিছু কাজ নিয়ে এসেছেন র্যাপেঁ। এ জাতীয় কাজে এসে সূচিকর্মটাও চালিয়ে যান তিনি। নিজ পরিবারের বা অন্যের অর্ডারি সূচির কাজ। তাতে তাঁর আয় দ্বিগুণ হয়। র্যাপেঁ মৃতপ্রায় রমণীকে শুধলেন, ‘মাদাম বনতেমপ্স, মনে হচ্ছে আপনি শেষ সংস্কারের কাজ সেরে রেখেছেন।’
বৃদ্ধা না-সূচক মাথা নাড়লেন। র্যাপেঁ উদারতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বৃদ্ধার পায়ের কাছে লাফিয়ে পড়ে বললেন, ‘হায় ঈশ্বর! এখনও নয়! আমি যাচ্ছি পুরোহিতকে ডাকতে।’ বুড়ি র্যাপেঁ এক ছুটে বাইরে এসে দৌড়ালেন পুরোহিতের বাড়ির দিকে। চত্বরের ক’টি বাচ্চা ছেলে অবাক হয়ে বুড়িকে দেখল। নিশ্চয়ই কোনো অঘটন ঘটে থাকবে।
শাদা আঙরাখা পরা পুরোহিত সাথে বালক গায়েনকে নিয়ে গম্ভীর মুখে রোদদগ্ধ শান্ত গাঁয়ের পথ ধরে চলছিলেন—যেন স্বয়ং ঈশ্বর নেমে এসেছেন মর্ত্যলোকে। বালকটি ঘণ্টি বাজিয়ে যাচ্ছিল। মাঠে কর্মরত কৃষকেরা ছড়ানো হ্যাট খুলে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল, যতক্ষণ না পুরোহিত একটা ফার্মহাউসের আড়ালে অদৃশ্য হলেন। গমের স্তূপের কাছে মেয়েছেলেরা কাজকাম ফেলে সোজা দাঁড়িয়ে বুকে ক্রুশ আঁকল।
চৌকাণাকৃতির টুপি পরা শাদা পোশাকের গুরুগম্ভীর যাজক একদিকে মাথা হেলে বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে চলছিলেন। পেছনে আসছিলেন র্যাপেঁ। তাঁর মাথা প্রায় হাঁটু ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
খানিকটা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে অনোরেঁ তাঁর গোলার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘পুরুত কোথায় যাচ্ছে রে?’
‘কেন, আপনার মাকে তিনি সংস্কার-বাক্য পাঠ করাবেন!’ অনোরেঁ মোটেও অবাক হলো না এ কথায়। সে ‘যথেষ্ট, যথেষ্ট’ বলে ফের কাজে মন দিল।
বৃদ্ধা বনতেমপ্স পুরোহিতের কাছে ঈশ্বরের অসীমত্ব স্বীকার করলেন। একসময় পুরোহিত চলে গেলেন দুই বৃদ্ধাকে এক শ্বাসরুদ্ধকর কুটিরে রেখে।
র্যাপেঁ তাকিয়ে ছিলেন মৃত্যপথযাত্রিনীর দিকে। মহিলা বুঝি মরতে আরো সময় নেবেন। দিনের আলো নিভে আসছিল। শীতল হাওয়া বইতে শুরু করল। হাওয়ায় কুটিরের দেয়ালে টাঙানো সস্তা চিত্রকর্ম উল্টোপাল্টা দুলতে লাগল। জানালার ছোটো বিবর্ণ পর্দাটিও যেন বৃদ্ধার প্রাণবায়ুর সাথে সাথে বেরিয়ে যাবে। নিশ্চল দুই চোখ খোলা বৃদ্ধা শান্তভাবে অপেক্ষা করছেন মৃত্যুর জন্য। যে মৃত্যু এত কাছে, তবু যেন ধীরগতিতে সে আসছে। বৃদ্ধার রুদ্ধ–শ্লেষ্মা গলায় দ্রুতগতির নিঃশ্বাস শিসের শব্দ তুলছিল—শীঘ্রই থেমে যাবে তো, পৃথিবীতে একজন মহিলা কমে যাবেন, যাঁকে কেউ মনে রাখবে না।
রাতে বাড়ি ফিরে অনোরেঁ দেখল তার মা তখনও জীবিত। অনোরেঁ মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন বোধ করছো?’ অনোরেঁর জড়তাহীন জিজ্ঞাসা। যেন সে সামান্য রোগাক্রান্ত কারুর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিচ্ছে। এরপর সে র্যাপেঁকে পাঠিয়ে দেবার সময় বলল, ‘সকাল পাঁচটার মধ্যে অবশ্যই।’ বুড়ির কাছ থেকে উত্তর এলো, ‘অবশ্যই।’
রাত পোহাবার সাথে সাথেই র্যাপেঁ চলে এলেন। অনোরেঁ তখন কাজে যাবার আগে নিজ হাতে বানানো স্যুপ খাচ্ছিল।
‘তোমার মা কি মরে গেছে?’ র্যাপেঁর প্রশ্নের উত্তরে চাষীর চোখে শয়তানি ঝলক খেলে গেল। বলল, ‘মনে হচ্ছে আজ একটু ভালোর দিকে।’ কথাটা বলে অনোরেঁ বাইরে চলে গেল।
র্যাপেঁ পড়লেন অস্বস্তিতে। তিনি সরে এলেন মুমূর্ষু বৃদ্ধার কাছে। মহিলা আগের অবস্থাতেই রয়েছেন; তেমনি অনুভূতিহীন। আর চোখ খোলা, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষীণ। দুই হাত আঁকড়ে ধরে আছে বিছানার প্রান্ত। র্যাপেঁ অনুমান করলেন; এই অবস্থা দুইদিন, চারদিন এমনকি এক সপ্তাহও চলতে পারে। ভীতি গ্রাস করে তাঁকে—যে দুষ্ট চাষী তাঁর সাথে চালাকি করেছে, তাঁর বিরুদ্ধে তো বটেই, এমনকি মরতে অনিচ্ছুক এই মহিলার বিরুদ্ধেও ক্রোধ জমে ওঠে তাঁর। তবু তিনি প্রাচীন বৃদ্ধার কুঁচকানো মুখের দিকে চেয়ে সূচিকর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন।
অনোরেঁ রাতের খাবার খেতে বাড়িতে এলো। তৃপ্ত দেখাচ্ছে তাকে। সম্ভবত ফসল এবার ভালোই হয়েছে। সে আবার বেরিয়ে গেল।
র্যাপেঁ ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর কাছে সময় নষ্ট আর অর্থনাশ বলেই প্রতীয়মান হচ্ছিল। র্যাপেঁর মনে হলো এই একগুঁয়ে, শুয়োরমুখো বোকা মহিলার টুঁটি চেপে ক্ষীণ অথচ দ্রুতগতির নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেন চিরতরে। কিন্তু গলা টিপে হত্যার পরিকল্পনাটা তাঁর কাছে বিপজ্জনক মনে হলো। কিছুক্ষণ পর র্যাপেঁর মাথায় কুবুদ্ধি খেলে গেল। তিনি বৃদ্ধা বনতেমপ্সকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি শয়তান দেখেছো?’
‘না, ‘ক্ষীণ গলায় বললেন বৃদ্ধা বনতেমপ্স।
র্যাপেঁ এবার বৃদ্ধার দুর্বল মনকে ভয়ে জর্জরিত করে দিতে শুরু করলেন উচ্চস্বরে কথাবার্তা আর ভূতুড়ে গল্প। র্যাপেঁ বললেন, ‘মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে শয়তান মরণাপন্ন ব্যক্তিদের কাছে আসে। তার হাতে থাকে ঝাড়ু আর মাথায় রান্নার পাত্র, আর সে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে। যেইমাত্র তুমি তাকে দেখে ফেললে, ব্যস্, তোমার দফারফা। মাত্র কয়েকমুহূর্ত তুমি বেঁচে থাকবে, পরমুহূর্তেই পটল তুলবে।’ রাপেঁ তাঁর উপস্থিতিতে এ-যাবৎ যেসব ব্যক্তিদের কাছে মৃত্যুর আগে শয়তান এসেছিল, গলগলিয়ে তাঁদের নাম বলে গেলেন: জোসেফাইন লয়জল, ইউলালি রাতিয়েঁ, সফি পাদাগুনউ, সেরাফাইন গ্রস্পাইড ...।
ভূতুড়ে গল্প বলে র্যাপেঁ বৃদ্ধা বনতেমপ্সকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন। বৃদ্ধা অস্থির হয়ে হাত নাড়তে লাগলেন। মাথা উঁচু করে ঘরের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করছিলেন তিনি। র্যাপেঁ হঠাৎ বৃদ্ধার বিছানার পায়ের কাছে লুকিয়ে পড়ে ওয়ারড্রোব থেকে চাদর বের করে নিজেকে মুড়ে ফেললেন। মাথায় বসালেন রান্নার পাত্র। পাত্রের তিনটে কালো পা শিংয়ের মতো লাগছিল। তিনি তারপর ডান হাতে নিলেন ঝাড়ু আর বাঁ হাতে বাল্তি। বাল্তিটাকে তিনি শূন্যে ছুঁড়ে মারলেন। ঠন-ঠনাক শব্দে ঘরজুড়ে বিচ্ছিরি শব্দ খেলে গেল। এবার একটা চেয়ারে দাঁড়িয়ে বনতেমপ্সের পায়ের কাছের মশারি তুলে বদখৎ চিৎকার জুড়ে কদাকার অঙ্গভঙ্গি শুরু করলেন র্যাপেঁ। তাঁর মুখ তিনপেয়ে রান্নার হাঁড়িতে অদৃশ্য। র্যাপেঁ চিৎকার আর অঙ্গভঙ্গির সাথে এবার ঝাড়ুটা দোলাতে লাগলেন বৃদ্ধার মুখের সামনে।
বিজাতীয় আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে গেল বৃদ্ধা বনতেমপ্স-এর চোখ। একেবারেই শক্তিহীন বৃদ্ধা বিছানা থেকে উঠে পালিয়ে যাবার অমানুষিক চেষ্টা করলেন কিন্তু তিনি কেবল কাঁধের খানিকটা উঠাতে পারলেন। এরপরই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সঙ্গে নেতিয়ে পড়লেন।
র্যাপেঁ ধীরে-সুস্থে জিনিসপত্তর সব ঠিকঠাক স্থানে রেখে রাখলেন। ওয়ারড্রোবের কোনে ঝাড়ু রেখে চাদরটা পাত্রে গুঁজে রেখে দিলেন উনুনের খালি জায়গাটায়। তাকের ওপর রাখলেন বাল্তি আর চেয়ারটা দেয়াল ঘেঁষে।
চোখেমুখে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে র্যাপেঁ মৃতার চোখদুটি বন্ধ করলেন। বিছানায় রাখলেন পবিত্র পানিভর্তি পাত্র, তাতে বক্সউডের শেকড় ডুবিয়ে পাত্র থেকে পবিত্র পানি ছিটিয়ে দিলেন বিছানায়। সেইসঙ্গে প্রবলবেগে তাঁর জানা সব মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন।
অনোরেঁ রাতে ফিরে এসে র্যাপেঁকে প্রার্থনারত দেখতে পেল। সে তৎক্ষণাৎ হিসেব কষে ফেলল; র্যাপেঁ গোটা একটা ফ্রাঁ বেশি আদায় করে নিলেন তার কাছ থেকে। হিসেব অনুযায়ী পাঁচ ফ্রাঁ হয়। কারণ র্যাপেঁ তিনটে দিন আর একটা রাত কাটিয়েছেন তার মা’র কাছে। অথচ অনোরেঁ পুরো ছয় ফ্রাঁ ঋণী হয়ে গেল র্যাপেঁর কাছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে গী দ্য মোপাসাঁ (১৮৫০-১৮৯৩) বিশাল ও বিস্তীর্ণ ফরাসি সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে সৃষ্টির স্বাক্ষর রেখেছেন তা এক কথায় অসাধারণ। তাঁর রচনার মাধ্যমে মানুষের চরিত্রের অসংখ্য ত্রুটি ও দুর্বলতাকে পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন এবং তীক্ষ্ণ শ্লেষ ও বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছেন।
হেনরি রেনে অ্যালবার্ট গী দ্য মোপাসাঁ ফরাসি সাহিত্যে ছোটোগল্প লেখক হিসাবে লাভ করেছেন সমস্ত বিশ্বের স্বীকৃতি, ভালোবাসা ও জনপ্রিয়তা। তিনি যে সমস্ত ছোটোগল্প রচনা করেছেন, কোনো-না-কোনোভাবে সেই সমস্ত গল্পের চরিত্রদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁর রচনা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফলে তিনি ছোটোগল্পকার হিসাবে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে তাঁর সমগ্র রচনা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে বাঙালি পাঠকসমাজের কাছে মনোগ্রাহী রচনা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
(পরবাস-৬১, ডিসেম্বর ২০১৫)